যে যুদ্ধ পলাশীতে শেষ হয়নি
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on January 19, 2025
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
‘শত্রুর যুদ্ধ কখনো শেষ হয়না
শত্রু দেশের আগ্রাসনটি নিছক রণাঙ্গনে শেষ হয়না। শত্রু অবিরাম যুদ্ধ নিয়ে হাজির হয় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অঙ্গণেও। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের লড়াইটি তাই পলাশীর ময়দানে শেষ হয়নি। বরং সেটি আরো তীব্রতর হয়েছে বাঙালি মুসলিমের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও অর্থনীতির ময়দানে। সে লড়াইটি তীব্রতর করতে বাংলায় এবং পরে ভারতে তারা শুধু সামরিক সেনা ছাউনিই গড়েনি, গড়েছে শিক্ষা, ধর্ম, গবেষণা ও সংস্কৃতির নামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। তাই সৈনিকদের পাশাপাশি বহু প্রফেসর ও গবেষকও এনেছে। তাই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরা একদিকে যেমন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গড়ে এদেশের হিন্দুদের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সুরক্ষায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিযেছে, তেমনি এসিয়াটিক সোসাইটি গড়ে গবেষণার নামে হিন্দুদের মন মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত করার লক্ষ্যে শত শত বইও লিখেছে।
শুধু সামরিক শক্তির জোরে কোন শক্তিই কোন দেশকে বেশী দিন ধরে রাখতে পারে না। শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে গাছ যেমন মজবুত শিকড় গড়ে, সরকারও তেমনি দেশের জনগণের গভীরে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক সংযোগ গড়ে। এই মজবুত সংযোগটির কারণেই ভারতে মুসলিম শাসন ৮ শত সাল টিকে থাকে। ইংরেজদের কাছেও এদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের লক্ষ্যটি নিছক কিছু বছরের জন্য ছিল না, ছিল শত শত বছরের জন্য। তারা জানতো, নব প্রতিষ্ঠিত এ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের আয়ু বাড়াতে হলে শুধু দেশের ভূগোলে নয়, মনের ভূগোলেও অধিকার জমাতে হবে। এ দেশবাসীর মধ্য থেকে প্রচুর সংখ্যক দালাল বা কলাবোরেটর গড়ে তুলতে হবে। কয়েক হাজার প্রবাসী ইংরেজদের দ্বারা এ বিশাল ভারত দীর্ঘকাল অধিকারে রাখা অসম্ভব ছিল। এ লক্ষ্যে ধর্মান্তর যেমন জরুরী, তেমনি জরুরী বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কনর্ভাশন।
দখলদার ইংরেজগণ এটি ভাল করে জানতো, কলাবোরেটর বা সহযোগী খোঁজার কাজটি করতে হবে হিন্দুদের মাঝে। মুসলিমদের মাঝে সেটি অসম্ভব। কারণ ইংরেজগণ মুসলিমদের থেকে রাজ্য ছিনিয়ে নিয়েছিল; তাতে মুসলিমদের ভাগ্যে নেমে আসে দুর্বিসহ দুর্যোগ। ফলে মুসলিমদের কাছে ইংরেজরা ছিল তাদের স্বাধীনতা, ধর্ম, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির দুশমন। মুসলিম মনে ইংরেজদের হাতে এ পরাজয়ের বেদনাটি ছিল প্রতিদিন ও প্রতি মুহূর্তের। ব্রিটিশরা সেটি বুঝতো। ফলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিস্তার ও সেটি প্রতিরক্ষার বিরুদ্ধে মুসলিমদেরকেই তারা মূল শত্রু ভাবতো। এবং নির্ভরযোগ্য পার্টনার ভাবতো হিন্দুদের। কৃষক তার গরুকে ঘাস দেয় যাতে সে লাঙল টানতে পারে। তেমনি ইংরেজগণও শিক্ষার নামে তাদের কলাবোরেটরদের সামর্থ্যবাড়িয়েছে -যাতে শাসন ও লুন্ঠনে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়। এজন্যই মুসলিমদের শিক্ষিত করায় তাদের কোন আগ্রহ ছিল না। ফলে রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি তাদের কাছে গুরুত্ব পায় হিন্দুদের মাঝে ইংরেজী ভাষা, ইংরেজের দর্শন, সাহিত্য ও সংস্কৃতির দ্রুত বিস্তার। এবং সে লক্ষ্যে প্রণীত করে সুপরিকল্পিত এক শিক্ষানীতি। ভারতে এমন একটি শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ব্যাখা করতে গিয়ে লর্ড ম্যাকলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “ব্রিটিশ সরকার ভারতে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করবে যার মাধ্যমে এমন একদল ভারতীয় সৃষ্টি হবে যারা শুধু রক্তে-মাংসে ভারতীয় হবে, কিন্তু চিন্তা-চেতনা, মন ও মননে হবে ব্রিটিশ।” অর্থাৎ ব্রিটিশের সেবক।
ব্রিটিশের সে স্ট্রাটেজীকে সামনে রেখে ময়দানে নামে উইলিয়াম কেরীর ন্যায় বহু পাদ্রী। প্রতিষ্টিত হয় শ্রীরাম পুর কলেজ, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, হিন্দু কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। গড়ে তোলা হয় ছাপা খানা। প্রকাশনা শুরু হয় বিস্তর বই ও বহু পত্র-পত্রিকার। লক্ষ্য, বাংলার হিন্দুদেরকে তাদের প্রতিবেশী মুসলিমদের থেকে আলাদা করে মন ও মননে, চেতনা ও দর্শনে ভিন্ন করে তাদের অতি কাছের মানুষ রূপে গড়ে তোলা। বাংলার হিন্দুদের মাঝে তখন সাজ সাজ রব, বিশেষ করে বর্ণ হিন্দুদের মাঝে। প্রশাসন, বিচার ও শিক্ষা থেকে মুসলিমদের পরিকল্পিত ভাবে হঠিয়ে হিন্দুদের জন্য বিশাল শূন্যস্থান সৃষ্টি করা হয়। তাদের জন্য সষ্টি করা হয় অর্থ উপার্জনের বিপুল সুযোগ। ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর কেরানী, এজেন্ট, ঠিকাদার, ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব কালেক্টর, আদালতের মুন্সেফ-ম্যাজিস্টেট, উকিল, ডাক্তার, ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থার এজেন্ট -এগুলো হয়ে দাঁড়ায় সে কালের বাঙ্গালী হিন্দুদের কাছে অতি আকর্ষণীয় পেশা। এতে হিন্দুদের বাড়ে বিপুল আর্থিক সচ্ছলতা। ফলে শুধু কলকাতাতেই নয়, বাংলার জেলা,মহকুমা ও থানা শহরে -এমন কি গ্রাম এলাকাতেও হিন্দুদের ভিটায় গড়ে উঠতে থাকে হাজার হাজার দালান বাড়ি। জমিদারগণ নির্মাণ করতে থাকে প্রাসাদ। এটিই বাঙালি হিন্দুর সমৃদ্ধির কাল। বাঙালি মুসলিমগণ এরূপ সমৃদ্ধির ধারে-কাছেও ছিলনা।
বঙ্কিম চন্দ্রের ন্যায় প্রথম সারির হিন্দু লেখকদের জীবনের সিংহভাগ কেটেছে ব্রিটিশ সরকারের অতি অনুগত রাজস্ব কালেক্টর রূপে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কলকাতা থেকে পত্রিকা বের করেছেন -যার মূল কাজ ছিল ইংরেজদের বন্দনা করা, মুসলিম চরিত্রে কালীমা লেপন করা, আর ব্রিটিশ সেবায় হিন্দুদের অনুপ্রাণিত করা। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের জীবন কেটেছে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী ও ব্রিটিশ সরকারের অতি বিশ্বাসভাজন এজেন্ট রূপে। কলকাতার উঠতি বাবু সম্প্রদায়ের যৌন চাহিদা মেটাতে রবীন্দ্র নাথের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতায় গড়ে তোলে বিশাল আকারের পতিতাপল্লী। এটি ছিল সে আমলের লাভ জনক ব্যবসা। কলকাতার জোঁড়াসাকোর বিশাল প্রাসাদতুল্য বাড়ির তিনিই হলেন নির্মাতা।
ব্রিটিশের অনুগত বর্ণ হিন্দুদের অর্থনৈতিক ভিতটা আরো মজবুত করতে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় জমিদারি। জমিদারদের কাজ ছিল দ্বিমুখী। এক). ভূমির রাজস্ব আদায়। প্রতি বছর মৌজা ও গ্রাম ভিত্তিক খাজনার একটি পূর্ব-নির্ধারিত অর্থ ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়ে জমিদারী কিনতে হতো এবং প্রতিবছর সে জমিদারীর নবায়ন করতে হতো। দুই). বিদ্রোহ দমন এবং ব্রিটিশ শাসনের নিরাপত্তা বিধান। কোন প্রজা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে জমিদারের দায়িত্ব ছিল, সে বিদ্রোহকে নিজ শক্তি বলে দমন করা। একাজে জমিদারগণ পাইক-পেয়াদা ও লাঠিয়াল পালতো। নিজ সামর্থ্যে না কুলালে জমিদারের দায়িত্ব ছিল উর্দ্ধতন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে হস্তক্ষেপে আহবান করা।
মুসলিম শাসনামলে নবাবের পক্ষ থেকে বাংলার প্রায় সিকি ভাগ জমি বরাদ্দ ছিল মাদ্রাসা ও মসজিদের খরচ নির্বাহের জন্য। ছাত্রদের কোন বেতন দিতে হতো না। শিক্ষকগণ জীবিকা নির্বাহ করতো জমির আয় থেকে। ফলে সে আমলে মুসলিমদের শিক্ষার হার ভাল ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সে বরাদ্দকৃত লা-খেরাজ জমি তথা খাজনামুক্ত ভূমি মাদ্রাসাগুলি থেকে কেড়ে নিয়ে জমিদারদের হাতে তুলে দেয়। ফলে মাদ্রাসাগুলি অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলিমদের পক্ষে শিক্ষিত হওয়াই অসম্ভব হয়। সে সময় সারা বাংলার গ্রামে গঞ্জে ব্রিটিশ শাসনের নিরাপত্তা দেয়ার মূল দায়িত্বটি ছিল জমিদারদের উপর। মুষ্টিমেয় ব্রিটিশদের তাই রাজ্য শাসনে গ্রামে-গঞ্জে নামতে হয়নি, বরং তাদের কাজ ছিল জেলা ও মহকুমা শহরগুলিতে বসে শুধু নির্দেশ দেয়া। এভাবে ব্রিটিশ সরকার গড়ে তোলে সুবিধাভোগী ও স্বার্থপর এক কলাবোরেটর শ্রেনীর বিশাল নেটওয়ার্ক। হাজী নিসার আলী তিতুমীরের মত যারাই ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ময়দানে নেমেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধটি করেছে এই জমিদারগণ। জমিদারগণ পরাজিত হলে, ব্রিটিশ বাহিনী যুদ্ধে নেমেছে।
ব্রিটিশ শোষণ ও বিধ্বস্ত মুসলিম অর্থনীতি
ব্যবসায়ী কোম্পানীর মূল লক্ষ্য ব্যবসায়ে সর্বোচ্চ মুনাফা লাভ। ব্যবসা কখনোই কোন খয়রাতি কাজ বা জনকল্যাণ কর্ম নয়। ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী মুনাফা বাড়াতেই ভারতে আসে: এবং ভারতে এসে সে লক্ষ্যে নতুন নতুন রাজ্য জয় করে। সে সব রাজ্যে দুর্গ গড়েছে নিছক শোষণভিত্তিক সে বাণিজ্যিক প্রজেক্টের অঙ্গ রূপে। কোম্পনী জনগণ থেকে উচ্চহারে রাজস্ব নিয়েছে সে শোষণ ও শাসন প্রক্রিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে ও তীব্রতর করতে। এভাবেই মুনাফা বাড়িয়েছে এবং মুনাফার সে অর্থ বিলেতে ব্রিটিশ সরকার ও কোম্পানীর শেয়ার হোল্ডারদের হাতে নিয়মিত পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশে ব্রিটিশ শাসন তাই সর্বার্থেই ছিল এক সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসন। তবে তাদের আয়ের যতটা না ছিল ব্যবসায়ীক মুনাফা, তার চেয়ে বহুগুন বেশী ছিল দস্যৃবৃত্তিক ব্যাপক লুন্ঠন। যেখানেই তাদের কোন পণ্য দেশী পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয়েছে, সেখানেই তারা সে দেশী শিল্পের ধ্বংস সহিংস হয়েছে। মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করতে তারা তাই তাঁতিদের আঙ্গুলও কেটেছে। বাণিজ্যিক স্বার্থে কৃষকদের বাধ্য করেছে নীল চাষে। তাদের সে সীমাহীন লুন্ঠন ও অর্থনীতি ধ্বংসের ফলে বাংলা জয়ের মাত্র ১২ বছর পর ১৯৬৯-৭০ সালে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে। সে দুর্ভিক্ষে বাংলার জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মারা যায়। ইতিহাসের সেটিই ভয়াবহ ছিয়াত্তরের মনন্তর রূপে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসকেরা বাংলার উপর আরেকটি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপহার দেয় ১৯৪৪ সালে; সেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে। তখন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামরিক বিজয়, জনগণকে দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচানো নয়। ১৯৪৪’য়ের দুর্ভিক্ষে ১৫-২০ লক্ষ বাঙালির মৃত্যু ঘটে। এ দুর্ভিক্ষের কারণ, গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের যুদ্ধ পলিসি। সেদিন চার্চিলের নির্দেশে বাংলার জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্য শস্যকে ইউরোপের রণাঙ্গনে পাঠনো হয়েছিল।
তাছাড়া ব্রিটিশ সরকারের নৃশংস শোষনের ফলে অধিকাংশ মুসলিম পরিবারে প্রতি বছর লেগেই থাকতো দারিদ্রতা ও অনাহার। W.W Hunter নামক সে আমলের একজন ব্রিটিশ আমলা মুসলিম জীবনে ব্রিটিশ শাসনের কুফল নিয়ে তার বইতে লিখেছেন, “যে মুসলিমদের জন্য একসময় দরিদ্র হওয়াই অসম্ভব ছিল, তার পক্ষে এখন সচ্ছল থাকাই অসম্ভব।” অনাহারে শিশু মৃত্যুর হার ছিল অতি উচ্চ। ফলে ব্রিটিশের ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে বাংলার মুসলিম জনসংখ্যা খুব একটা বৃদ্ধি পায়নি। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর। লক্ষণীয় হলো, ১৯৪৭-৭১ -পাকিস্তানের এই ২৪ বছরে ভারতের সাথে তিন বার যুদ্ধ হলেও পাকিস্তানে কোন দুর্ভিক্ষ হয়নি।
আরো লক্ষণীয় হলো, সাত শত বছরের মুসলিম শাসনে বাংলায় বা ভারতে একটি বারও কোন দুর্ভিক্ষ আসেনি। বরং শায়েস্তাখানের আমলের বাংলা খাদ্যপণ্যের সস্তা মূল্য বিশ্বে রেকর্ড গড়েছিল। বাংলায় বা ভারতে মুসলিম শাসনকে তাই কোন অবস্থাতেই ঔপনিবেশিক শাসন বলা যায় না। কোন বিদেশী শাসনও নয়। মুসলিমগণ এদেশে কখনই ব্যবসায়ীক লক্ষ্যে বা লুন্ঠনের স্বার্থে সাম্রাজ্য স্থাপন করেনি। এদেশে আর্য ও অনার্য বহু জাতির মানুষ যেমন বাংলার বাইরে থেকে এসে এদেশে মিশে গেছে, তেমনি মিশে গেছে মুসলিমগণও। আর বেশীর ভাগ মুসলিম তো বাংলার আদিবাসী; তারা মুসলিম হয়েছে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম কবুলের মাধ্যমে। মুসলিম শাসকগণ যা কিছু গড়েছে তা একমাত্র বাংলাতেই গড়েছে। এখানকার সম্পদ নিয়ে ব্রিটিশগণ যেমন বিলেতে বড় বড় নগর-বন্দর গড়েছে, সেরূপ নগর-বন্দর বাংলার কোন মুসলিম শাসকগণ বাংলার বাইরে গিয়ে গড়েনি। ঢাকা, সোনার গাঁ, গৌড়, মূর্শিদাবাদ, বাগের হাট ও উত্তর বঙ্গে যা কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন -তা তো মুসলিমদেরই গড়া। অথচ বৌদ্ধ ও হিন্দু রাজাও তো এদেশে শত শত বছর শাসন করেছে। কিন্তু তাদের গড়া সে নিদর্শনগুলি কোথায়? তাছাড়া এদেশের উপর বর্গী হামলা, মগ হামলা, মারাঠা হামলা ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের অধিকাংশ তো মুসলিম। পলাশী রণাঙ্গন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, মজনু শাহের ফকির বিদ্রোহ বা দুদূ মিয়ার ফারায়েজী আন্দোলন –সর্বত্র তো শুধু মুসলিমরাই। স্বাধীনতার সেসব লড়াইয়ে মুসলিমগণ যেরূপ রক্ত দিয়েছে -তা হিন্দুরা দেয়নি। এরপরও হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমদের বলে বহিরাগত।
ভারতীয় কংগ্রেস দলের এমপি এবং জাতিসংঘের সাবেক জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল মি. শশি থারুর তাঁর গবেষণাধর্মী বই “Inglorious Empire”য়ে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ১৭০০ সালে সম্রাট আওরোঙ্গজেব যখন মোঘল বাদশাহ, তখন বিশ্ব অর্থনীতির শতকরা ২৭ ভাগ অংশ ছিল ভারতের। এটি ছিল সমগ্র ইউরোপের অর্থনীতির প্রায় সমান। আর সে ২৭ ভাগ অর্থনীতির সিংহ ভাগ জোগান দিত সুবে বাংলা। নবাব সিরাজুদ্দৌলার শাসনামলে বাংলা ছিল বিশ্বের প্রধানতম ধনী দেশ। তখন বাংলা বলতে বুঝাতো সম্মিলিত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা। ভারতের অন্য কোন রাজ্য বাংলার সমকক্ষ ছিল না। মোঘল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক রাজস্ব জোগাতো এই সুবে বাংলা। বাংলা বিশ্ববিখ্যাত ছিল তার মসলিন ও মখমলের ন্যায় প্রসিদ্ধ বস্ত্র শিল্প, রেশম ও সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য। ব্রিটিশগণ যখন ভারত ত্যাগ করে তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের হিস্যা শতকরা ২৭ ভাগ থেকে নেমে মাত্র ৩ ভাগে পৌঁছে। কারণ, ব্রিটিশরা নিজেদের পণ্যের বাজার বাড়াতে বাংলার শিল্পকে ধ্বংস করেছিল। মসলিনের তাঁতিতের আঙ্গুল কেটেছিল ও তাদের তাঁতগুলি ভেঙ্গে দিয়েছিল। প্রশ্ন হলো মুসলিম শাসনামলে বাংলা যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল তা কি ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন এবং ৭০ বছরের ভারতীয় শাসন বাংলাকে দিয়েছে?
অতি বিস্ময়ের বিষয় হলো, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে বাঙালি হিন্দুদের দ্বারা ব্রিটিশ শাসনের সুরক্ষা, তাদের লুণ্ঠনে সহায়তা ও তাদের পক্ষে দালালীর যে ঘৃণিত ইতিহাস নির্মিত হলো -সেটিকেই বাঙালির রেনেসাঁ যুগ বলা হয়। ব্রিটিশের সাথে বাঙালি হিন্দুদের সহযোগিতা এতোই গভীর ছিল যে, সে সময় ভারতীয় জনগণের চোখের সামনে বাবু বলতে দুই প্রকার বাবুর চিত্র ফুটে উঠতো। সাদা চামড়ার ইংরেজ বাবু এবং তাদের পার্শ্বচর রূপে শ্যামলা রঙয়ের বাঙালি বাবু। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় ছিলেন সেরূপ বাঙালি বাবুর একজন। কথা হলো, যে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসন গোলামী, গণহত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন এবং বার বার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ উপহার দিল এবং ধ্বংস করলো বাংলার শিল্প ও অর্থনীতিকে -সে ব্রিটিশ শাসনকে চিত্রিত করা হচ্ছে আশির্বাদ রূপে! এমন কি কবি রবীন্দ্রনাথও ইংরেজ রাজার পঞ্চম জর্জের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় “জনগনমন অধিনায়ক” নামে একটি কবিতা লেখে ফেললেন। প্রখ্যাত বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী তো ব্রিটিশ প্রেমে এতোটাই মোহমুগ্ধ ছিলেন যে, বাংলা ছেড়ে অক্সফোর্ডে গেয়ে ঘর বেঁধেছিলেন এবং আর কখনোই বাংলার মুখ দেখতে ফেরেননি। এমন ব্রিটিশপ্রেমী ও মুসলিম বিদ্বেষীদের পক্ষ থেকে মুসলিম শাসনামলকে বলা হয় অন্ধকার যুগ! এবং ইংরেজ যুগকে বলা হয় আশির্বাদের যুগ। অবশ্য এর কারণও রয়েছে, তাদের পেটে ব্রিটিশের নিমক অনেক বেশী পরিমাণেই পড়েছিল। ফলে ভারতের অর্থনীতিতে ব্রিটিশের সহিংস নাশকতাও তাদের কাছে আশির্বাদ গণ্য হয়েছে।
মুসলিমবৈরী ব্রিটিশ এবং বাঙালি হিন্দুর বিষ উদগীরণ
বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যরা তাদের সাহিত্যে যে মুসলিম বিরোধী বিষ উদগীরণ করেছে সেটি বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও আলোবাতাস থেকে উদ্ভুত হলে তার নমুনা মধ্য যুগের বা আদি যুগের সাহিত্যেও পাওয়া যেত। কিন্তু তা নেই। তাদের মগজে ঘৃণাপূর্ণ মিথ্যার বিষটি ঢুকিয়েছিল ইংরেজগণ। তারাই প্রথম আবিস্কার করে, ভারতের মুসলিম শাসন শুধু ধ্বংস, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও শোষণ ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। বলেছে, মন্দির ভেঙ্গে তার উপর মসজিদ গড়া হয়েছে। তাদের কারণেই মোঘল বাদশাহ আওরঙ্গজীব চিত্রিত হয়েছেন কুৎসিত ভিলেন রূপে। বাংলায় হিন্দুদের বাস মুসলিমদের চেয়ে অধিক কাল ধরে। অথচ তাদের ব্যর্থতা হলো, সমগ্র ইতিহাস ঘেঁটে একজন হিন্দুকেও বের করতে পারিনি যাকে তারা স্বাধীনতার লড়াইয়ে বাংলার মানুষের সামনে আদর্শ হিসাবে চিত্রিত হতে পারেন। তেমন চরিত্রের তালাশে বঙ্কিম ও মাইকেল মধুসূদন যেমন ব্যর্থ হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথও ব্যর্থ হয়েছেন। সে এক বিশাল শূন্যতা। রবীন্দ্রনাথকে তাই অবাঙালি শিবাজীকে হিরো রূপে পেশ করতে হয়েছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “শিবাজী উৎসব” কবিতায় শিবাজীর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন,
“হে রাজ-তপস্বী বীর, তোমার সে উদার ভাবনা
বিধর ভাণ্ডারে
সঞ্চিত হইয়া গেছে, কাল কভু তার এক কণা
পারে হরিবারে?
তোমার সে প্রাণোৎসর্গ, স্বদেশ-লক্ষীর পূজাঘরে
সে সত্য সাধন,
কে জানিত, হয়ে গেছে চির যুগ-যুগান্তর ওরে
ভারতের ধন।”
এই হলো রবীন্দ্রনাথের বিচার বোধ। এই হলো রবীন্দ্র মানস ও চেতনা! তবে এটি শুধু রবীন্দ্রনাথের চেতনার সমস্যা নয়, এটিই মূল সংকট ছিল হিন্দু বাঙালির রেনেসাঁর কর্ণধারদের। কিছু দালানকোঠা ও কলকারখানা গড়া, কিছু ডিগ্রিধারি মানুষ তৈরি, কিছু কবিতা-উপন্যাস লেখা, রাজনীতিতে কিছু আলোড়ন তোলাই একটি জাতির জীবনে জাগরণ আনার জন্য যথেষ্ট নয়। এরূপ বিশাল কাজের জন্য উন্নতর একটি দর্শনও লাগে। সে দর্শনটিই আনে জনগণের চেতনা রাজ্যে বিপ্লব। কিন্তু বাংলার হিন্দুগণ সে দর্শনের খোঁজ পায়নি। ফলে তাদের মনের রাজ্যে বিপ্লবও আসেনি। বরং ঘোর অন্ধকারই রযে গেছে। রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ সে দর্শনের খোঁজে হিন্দুর পৌত্তলিকতা ছেড়ে একাশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। মধসূদন দত্ত খৃষ্টান হয়ে গেছেন। কিছু বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দো ঘোষেরা হিন্দুদের আবার সনাতন তথা আদিম পৌত্তলিকার দিকে ফিরেয়ে নিয়েছে। ফলে হিন্দুদের আবার ফিরে গেছে সে স্থানটিতে যেখান থেকে রাম মোহন, দ্বারকানাথ ও তাদের সাথীরা যাত্রা শুরু করেছিল। এরই ফল হলো, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সন্তানেরাও আর সে ব্রাহ্ম ধর্মে স্থির থাকতে পারেননি, ফিরে গেছেন হিন্দু পৌত্তলিকতায়। রবীন্দ্রনাথ এমন এক কট্টর হিন্দু হওয়ার কারণেই শিবাজীকে হিরো বানিয়েছেন। আর শিবাজীর মত একজন দস্যু চরিত্রের মানুষ যখন হিরো হয় তখন কি কোন জাগরণ বেঁচে থাকে? আর এটিই বাঙালি হিন্দুর রেনেসাঁর আদর্শিক ও নৈতিক সংকট। এমন সংকট খোদ রেনেসাঁরই মৃত্যু ঘটায়। বাঙালি হিন্দুর রেনেসাঁও তাই বাঁচেনি। সেটিই বাঙালি হিন্দুর আত্মঘাত।
দেখা যাক, রবীন্দ্রনাথ যাকে “হে রাজস্বী বীর” বলে মুগ্ধ মনে কবিতা লিখেছেন তার প্রকৃত পরিচয়টি কি? রবীন্দ্র মানস ও তাঁর চেতনাকে চিনতে হলে শিবাজীকেও চিনতে হবে। এতে বুঝা যাবে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রভক্তদের রাজনৈতিক এজেন্ডা। প্রশ্ন হলো, তিনি কি আদৌ বীর ছিলেন? শিবাজীর পরিচয় হলো, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে তিনি ব্যস্ত রেখেছিলেন মারাঠা অঞ্চলে লুকিয়ে থেকে অতর্কিত হামলার মধ্য দিয়ে। সম্মুখ সমরে আসার সামর্থ্য তার ছিল না। যুদ্ধে একবার পরাজিত ও বন্দী হওয়ার পর ফন্দি করে লুকিয়ে পালিয়েছিলেন। আরেক বার সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি আফজাল খাঁর নেতৃত্বে ১০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনীকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। যুদ্ধের বদলে আলোচনায় ডেকে আফজাল খাঁকে তিনি হত্যা করেন। সেটি ছিল কাপুরুষিত হত্যা। সে সময় আফজাল খাঁ তাকে ইসলামী উদারতায় আলিঙ্গনে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সে মুহূর্তে তার বাঁ হাতে লুকানো “বাঘের নখ” দিয়ে তার দেহ ছিন্ন করেন। অথচ এ নিরেট কাপুরুষতা বীরতুল্য গণ্য হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাছে, যা নিয়ে বিশাল এক কবিতাও লিখেছেন। এ হলো রবীন্দ্রনাথের বিবেচনা ও মানবতার মান! রবীন্দ্রনাথ বরং সে সব ঐতিহাসিকদেরও নিন্দা করেছেন যাদের দৃষ্টিতে শিবাজী ছিলেন এক বর্বর দস্যু। রবীন্দ্রনাথ তাঁদেরকে মিথ্যাময়ী বলেছেন, এবং তাঁদের বিদ্রুপ করে লিখেছেন,
“বিদেশীর ইতিবৃত্ত দস্যু বলে করে পরিহাস
অট্টহাস্য রবে…
তব পুণ্য চেষ্টা যত তস্করের নিস্ফল প্রয়াস
এই জানে সবে।
অয়ি ইতিবৃত্ত কথা, ক্ষান্তু করো মুখর ভাষণ
ওগো মিথ্যাময়ী,
তোমার লিখন- ‘পরে বিধাতার অব্যর্থ লিখন
হবে আজি জয়ী।
যাহা মরিবার নহে তাহারে কেমনে চাপা দিবে
তব ব্যঙ্গ বাণী
যে তপস্যা সত্য তারে কেহ বাধা দিবে না ত্রিদিবে
নিশ্চয় সে জানি।”
ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গে লিখেছেন, “হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল, যদিও স্বজ্ঞানে তাঁদের অনেকেই কখনোই এর উপস্থিতি স্বীকার করবেন না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে, ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ যাঁর পৃথিবীখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবিকতাকে সাম্প্রদায়িক দৃ্ষ্টভঙ্গীর সঙ্গে কিছুতেই সুসংগত করা যায় না। তবুও বাস্তব সত্য এই যে, তাঁর কবিতাসমূহ শুধুমাত্র শিখ, রাজপুত ও মারাঠাকুলের বীরবৃন্দের গৌরব ও মাহাত্মেই অনুপ্রাণিত হয়েছে, কোনও মুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনো একচ্ছত্রও লেখেননি –যদিও তাদের অসংখ্যই ভারতে আবির্ভূত হয়েছে। এ থেকেএ প্রমাণিত হয় উনিশ শতকী বাংলার জাতীয়তা জ্ঞানের উৎসমূল কোথায় ছিল।”–(সূত্র: Dr. Romesh Chandra Majumder, History of Bengal, p 203.)
ব্রিটিশের কলাবোরেটর রূপে বাঙালি হিন্দু
বাঙালি হিন্দুর রেনেসাঁ যুগে সবচেয়ে ঘৃণ্য যে কাজটি হয়েছে তা হলো, ইংরেজদের কলাবোরেটর তথা সহযোগী রূপে তাদের যোগদান। সমগ্র উপমহাদেশে তারাই সর্বপ্রথম এ পেশায় নামে। কয়েক শত নবেল প্রাইজ দিয়েও কি বাঙালি হিন্দুর এই কলংক ঢাকা যাবে? বাঙালি বাবুদের ইংরেজ-সেবা শুধু প্রশাসনে সীমাবদ্ধ থাকেনি এবং শুধু বাংলাতেও সীমাবদ্ধ রাখেনি। প্রশাসনের পাশে বুদ্ধিবৃত্তি ও সাহিত্যেও সেটি প্রবল ভাবে প্রকাশ পায়। বাংলার সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাতসহ ভারতের অন্যান্য প্রদেশে। শিকারী যেমন শিকারী ঘুঘুকে দিয়ে ঘুঘু ধরে, তেমনি ইংরেজগণও বাঙালি হিন্দুদের দিয়ে সমগ্র ভারতের অন্যান্য প্রদেশের হিন্দুদেরও তাঁবেদারে পরিণত করে। ইংরেজ সেবার যে আদর্শ রবীন্দ্র-পরিবার ও বঙ্কিমচন্দ্র স্থাপন করেন, সেটিই ভারতীয় হিন্দুদের আদর্শে পরিণত হয়।
এমনকি কংগ্রে স নেতা করম চাঁদ গান্ধিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে যোগদান ও প্রাণদানের পক্ষে নিজ প্রদেশ গুজরাতে সৈন্য সংগ্রহে নেমেছিলেন। সেরূপ ভূমিকা ছিল আরো বহু নেতার। এরই ফল হলো, ১৯১৭ সালে ইংরেজগণ যখন উসমানিয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে ইরাকে যুদ্ধ শুরু করে সে যুদ্ধে ৭ লক্ষ ভারতীয় সৈনিক যোগ দেয়। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যুদ্ধকে হিন্দুগণও নিজেদের যুদ্ধ রূপে গণ্য করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৭৪,১৮৭ ভারতীয় সৈনিক ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধে প্রাণ দেয়। এবং আহত হয় বহু হাজার। ভারতে ব্রিটিশদের সংখ্যা শতকরা ০.০৫ ভাগও ছিল না, কিন্তু তাদের শাসন ১৯০ বছর বেঁচেছিল। এর কারণ ব্রিটিশরা পেয়েছিল বাঙালি হিন্দুদের সর্বাত্মক সহায়তা। একাজে তারা অতি দক্ষতা ও আগ্রহের পরিচয় রেখেছিল। বাঙালি হিন্দুদের দেখাদেখি ভারতের অন্যভাষী হিন্দুরাও ব্রিটিশ সেবায় বিপুল সংখ্যায় যোগ দেয়। তবে ব্রিটিশ সরকার কিছু মুসলিমদেরও সহায়ক হিসাবে পেয়েছিল। কিন্তু মুসলিমদের সংখ্যাটি হিন্দুদের তূলনায় ছিল নগন্য। এর কারণ, ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ ব্রিটিশ কাফিরদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়াকে হারাম মনে করতো। এ বিষয়ে আলেমদের ছিল কঠোর অবস্থান। কিন্তু হিন্দুদের ক্ষেত্রে সেরূপ কোন ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ছিলনা।
ভারতীয় রাজনীতিতে উগ্র-হিন্দুত্ববাদ ও বাঙালি হিন্দুর ভূমিকা
বাঙালি হিন্দুদের অপরাধ শুধু নয় যে, মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষ ছড়িয়ে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে তারা বিষাক্ত করেছে। তারা বিষাক্ত করেছে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের হিন্দুদের মনও। ইংরেজ ওরিয়েন্টালিস্টগণ মুসলিম বিদ্বেষপূণ মিথ্যা দিয়ে যেসব ইতিহাস রচনা করে, সেগুলি সর্বপ্রথম গলধঃকরণ করে বাঙালি হিন্দুগণ। পরে তারা সেগুলির সাথে নিজ মনের আবেগ মিশিয়ে নিজেরাও ইতিহাস লেখে এবং তা সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে দেয়। বস্তুত এসব হিন্দু বাঙালিদের লেখা বইগুলোই বহুকাল যাবত পঠিত হয়ে আসছে সারা ভারতের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই রূপে। অহিন্দু ও অভারতীয় ইংরেজ ওরিয়েন্টালিস্টদের লেখা ইতিহাসের স্থলে সে বইগুলোর বাড়তি সুবিধাটি হলো, বাঙালি হিন্দুদের হাতে রচিত হওয়ার সেগুলো ভারতের অন্য এলাকার হিন্দুদের কাছে সহজে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়। সে সময়ের ইতিহাসে আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিবৃত্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শুরুও এই বাংলা থেকে। সেটিও বাঙালি বর্ণ হিন্দুদের হাতে। সেটির মূল নায়ক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্রপাধ্যায়। তিনি প্রথম বাঙালি জাগরণের কথা বললেও পরবর্তীতে সর্বভারতীয় হিন্দু জাগরণের অবতারে পরিণত হন। তার উপন্যাস আনন্দমঠ সে জাগরণের বানি নিয়ে প্রথমে বাংলায় এবং পরে সমগ্র ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী জাগরণ আনে। তার গান বন্দেমাতরমের মধ্য দিয়ে বিমুর্ত হয় হিন্দু রেনেসাঁর মূল সুর। কংগ্রেস সে গানকে ভারতের জাতীয় সংগীতে পরিণত করে।
এতো গেল সাহিত্য বা বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কথা। রাজনৈতিক ময়দানেও মুসলিম বিরোধী উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার জন্মও বাঙালি হিন্দু বাবুদের হাতে। ভারতে আজ ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপী)’র যে মুসলিম বিরোধী প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সেটিও বালঠ্যাকারের মহারাষ্ট্রে বা নরেন্দ্র মোদীর গুজরাতে জন্ম নেয়নি। অযোধ্যাতেও জন্ম নেয়নি। জন্ম নিয়েছে বাঙালি বাবুদের দ্বারা বাংলায়। হিন্দুত্ব শব্দের প্রথম ব্যবহার করে বঙ্কিমচন্দ্র চ্যাটার্জি তার আনন্দ মট উপন্যাসে। ভারতের জাতীয সঙ্গীত “বন্দে মাতরম” গানটিও এ উপন্যাসের একটি গান থেকে নেয়া। আজকের যে বিজিপি, সেটিই শুরুতে ছিল হিন্দু মহাসভা। আর হিন্দু মহাসভার জন্ম কলকাতায়, এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তিনি ছিলেন বাঙালি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখার্জির পুত্র। তিনি নিজেও ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ অবধি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। নাথুরাম গডসে নামক আততায়ী হাতে গান্ধীর মৃত্যু হলে দোষ বর্তায় হিন্দু মহাসভার উপর। সে দুর্নাম থেকে বাঁচার তাগিদে তিনি নতুন দল গড়েন ভারতীয় জনসংঘ -যা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় ভারতীয় জনতা পার্টি, সংক্ষেপে বিজেপী। বার বার নাম পরিবর্তন হলেও এ দলের মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ কট্টর সাম্প্রদায়িক নীতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।
তাই ভারতের মুসলিম নিধনের রাজনীতির সূত্রপাত আহমেদাবাদ, মোম্বাই, অযোধ্যা বা মিরাটে হয়নি, হয়েছিল হিন্দু রেনেসাঁর জন্মভূমি কলকাতায়। এ রাজনীতির শুরু বস্তির গুন্ডা বা দুর্বৃত্তদের হাতেও নয়, বরং হযেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বাঙালি উপাচার্যের হাত দিয়ে। সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষের মনও কতটা যে বিষাক্ত ও প্রতিহিংসাপূর্ণ করতে পারে এ হলো তার নমুনা। শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ১৯৪১ সালে হিন্দুদের এক জনসভায় বলেছিলেন, মুসলিমরা যদি পাকিস্তান চায় তবে তাদের তল্পিতল্পা বেঁধে ভারত ত্যাগ করা উচিত।–(BLCP, 1941)। পাকিস্তানের জন্ম ও তার বেঁচে থাকাটি তাঁর মত হিন্দু নেতাদের কাছে যে কতটা অসহ্য ছিল এ হলো তার নমুনা। তাঁর কাছে অসহ্য হলো ভারতে মুসলিমদের বসবাসও। বাবরী মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ইতিহাস গড়েছেন বিজেপী নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানী। বিজিপির আরেক নেতা নরেন্দ্র মোদী ইতিহাস গড়েছেন গুজরাতে মুসলিম হত্যায় নেতৃত্ব দিয়ে। তবে যে শহরে মুসলিম হত্যা রাজনৈতিক আচার রূপে সর্বপ্রথম যাত্রা শুরু করে সেটিও অন্য কোন শহর নয়, সেটি বাঙালি হিন্দুদের শহর কলকাতা। আহমেদাবাদ, মুম্বাই, মুরাদাবাদ, বিহার, আসামের নেলী এবং ভারতের অন্যান্য স্থানের দাঙ্গাগুলো তো এসেছে বাঙ্গালী বাবুদের সৃষ্ট ১৯৪৬ সালে ১৬ আগস্টের কলকাতার দাঙ্গাটির পর।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- যে যুদ্ধ পলাশীতে শেষ হয়নি
- ১৯৪৭’য়ের নেতৃবর্গ এবং ১৯৭১’য়ের নেতৃবর্গ
- অসভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের আওয়ামী মডেল
- মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি এবং অর্জিত বিপর্যয়
- গণতন্ত্র ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নতুন সমীকরণ
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- January 2025
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018