স্বাধীন ভাবে বাঁচার খরচ ও বাঙালি মুসলিমের ব্যর্থতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

গোলাম রূপে বাঁচার কোন খরচ নাই। বরং গোলামকে পানাহারে বাঁচিয়ে রাখার দায়টি খোদ মনিবই বহন করে -যেমন সে বাঁচিয়ে রাখে তার নিজের পোষা গরু-ছাগল ও কুকুর-বিড়ালকে। আফ্রিকা থেকে যে লক্ষ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গদের জাহাজে করে আমেরিকায় নিয়ে যায়, তাদেরকে পানাহারে বাঁচিয়ে রাখা হয় দাস রূপে ব্যবহারের জন্য। এমন গোলামদের জীবনে শুধু গোলামীই থাকে; এবং গোলামগণ বাঁচে কেবল তার মালিকের এজেন্ডা পূরণের লক্ষ্যে। এমন দাসদের নিজেদের জীবনে কোন এজেন্ডা থাকে না। আমৃত্যু তাকে বাঁচতে হয় শুধু গোলামী, গ্লানি ও অপমান নিয়ে। গোলামের জীবনে তার নিজের জন্য কোন যুদ্ধ থাকে না, বরং মনিবের যুদ্ধই তার নিজের যুদ্ধে পরিণত হয় এবং মনিবকে বিজয়ী করতে এমন কি তার নিজের জীবনকেও বিলিয়ে দিতে হয়। সেটির প্রমাণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বহু লক্ষ ভারতীয় ও আরব মুসলিম সৈনিক ব্রিটিশদের বিজয়ী করতে যুদ্ধ করেছে এবং বহু হাজার মুসলিম সৈনিক প্রাণও দিয়েছে।

                                                                                                                                                  কিন্ত স্বাধীন ভাবে বাঁচার খরচটি বিশাল। জালেম শাসককে হটাতে রক্তাক্ত লড়াই লড়তে হয়। আরাম-আয়েশ ছেড়ে শ্রম, সময়, অর্থ ও জানের কুর’বানী দিতে হয়। অধিকার ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচার এ ছাড়া কোন বিকল্প পথ নাই। ইসলামে এটিই পবিত্র জিহাদ। এখানেই ঈমানের  বড় পরীক্ষা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে রূপ সভ্য বাঁচায় বাংলাদেশীদের কি রুচি আছে? মহান আল্লাহ তায়ালা চান, তাঁর ঈমানদার বান্দাগণ স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, ই্জ্জত ও শক্তি নিয়ে বসবাস করুক। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত এমন কি বহু ঘুষখোর, সূদখোরও পালন করতে রাজী, কিন্তু তারা শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে রাজী নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা সেটি জানেন। অথচ তাঁর নিজ ভূমিতে কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তী আইন, কতটা নির্মূল হবে দুর্বৃত্তি, কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে সুবিচার এবং কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা -সে বিষয়গুলি দেশে কতজন নামাজী, রোজাদার ও হাজী তার উপর নির্ভর করে না। বরং নির্ভর করে কতজন জান ও মাল দিয়ে সে লক্ষ্য সাধনে যুদ্ধ করলো -তার উপর। ইসলামে সে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধই হলো পবিত্র জিহাদ। অন্যান্য ইবাদতগুলি যতই পালিত হোক, জিহাদ পালিত না হলে মুসলিমদের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও  ইজ্জত বাঁচেনা। এজন্যই জিহাদই হলো সর্বোচ্চ ইবাদত। যারা সে জিহাদে নাই, বুঝতে হবে তারা মুসলিমদের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ইজ্জত নিয়ে তারা ভাবে না। এমন নির্লিপ্ত ও নিষ্ক্রিয় মুসলিমদের জন্য মুসলিম ভূমিতে বিজয় পায় শয়তানের বাহিনী। এ কারণেই বাংলাদেশের মত অধিকাংশ মুসলিম দেশ নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলাম বেঁচে নাই। নবীজী (সা:) ইসলাম বাঁচলে তো তার শরিয়তী আইন বাঁচতো। তখন প্রতিষ্ঠা পেত ইসলামী রাষ্ট্র।  

মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তারাই সবচেয়ে প্রিয় যারা বাঁচে তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে বাঁচে। সেটির ঘোষণা এসেছে সুরা সাফ’য়ের ৪ নম্বর আয়াতে। অথচ আজকের মুসলিমদের এখানেই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। মুসলিমদের জীবনে যুদ্ধ আছে। তবে সে যুদ্ধগুলি ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে হয়নি; সেগুলি হয়েছে ভাষা, দল, ব্যক্তি, ভূগোলভিত্তিক স্বার্থ হাছিলের লক্ষ্যে। এমন কি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও হিন্দুত্ববাদী ভারতের বিজয় বাড়াতেও তারা যুদ্ধ করেছে ও রক্ত দিয়েছে -যেমনটি দেখা গেছে ১৯১৭ ও ১৯৭১’য়ে।  কিন্তু তারা নাই মুসলিম উম্মাহর সুরক্ষা ও বিজয় বৃদ্ধির জিহাদে। তাই মুসলিমদের সংখ্যা বিপুল হারে বাড়লেও মুসলিমদের শক্তি, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও গৌরব বাড়েনি।

মুসলিমদের ব্যর্থতার মূল কারণ, গৌরব যুগের মুসলিমদের ন্যায় তারা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত তথা জিহাদ নিয়ে তারা বাঁচে না। তারা নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, দোয়া-দরুদ পালনে রাজি; রাজি পবিত্র কুর’আনকে বিশুদ্ধ ভাবে পড়তে ও মুখস্থ করতে; তারা রাজি হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে এবং রাজি তাবলিগী ইজতেমা ও ওয়াজ মহফিলে লাখে লাখে হাজির হতে। কিন্তু তারা রাজি নয় জিহাদে নিজ জান, মাল ও মেধার বিনিয়োগ। গৌরব যুগের মুসলিমদের সাথে আজকের মুসলিমদের মূল পার্থক্য বস্তুত এখানেই। অথচ ব্যক্তির ঈমান ও আমলের মূল পরীক্ষা হয় জিহাদে। গৌরব যুগের মুসলিমগণ সে পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর নিয়ে পাশ করলেও আজকের মুসলিমগণ ফেল করছে শূণ্য নাম্বার নিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *