দেশের সংবিধান ও নির্বাচন পদ্ধতিই যখন গণতন্ত্রের বড় দুশমন

ফিরোজ মাহবুব কামাল

বাংলাদেশের সংবিধান ও নির্বাচন পদ্ধতিই হলো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দুশমন। বর্তমান সংবিধান ও নির্বাচন পদ্ধতিকে সংস্কার না করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দেয়া অসম্ভব।  কারণ, এ সাংবিধানিক রীতি ও নির্বাচন পদ্ধতির মধ্যে রয়ে গেছে দেশের বৃহত্তম দলের একক স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার বিধান। সেরূপ নৃশংস স্বৈরশাসন যেমন মুজিব আমলে দেখা গেছে, তেমনি দেখা গেছে হাসিনার আমলেও। দেখা গেছে এমন কি বিএনপি’র আমলেও। সে নির্বাচন পদ্ধতির বদৌলতে মুজিব ও হাসিনার আচরণ ছিল রাজা-বাদশাহদের ন্যায় স্বৈরাচারী। এ পদ্ধতির ফলে জন্ম নিয়েছিল নৃশংস দলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন। এ পদ্ধতি চালু থাকলে দেশে আবারো দলীয় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা পাবে। সে দলীয় ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি ইতিমধ্যেই রাজপথে শোনা যাচ্ছে। বুঝতে হবে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনা হলেও দেশে এখনো ফ্যাসিবাদের কবর হয়নি।

গণতন্ত্রের অর্থ হলো নানা মতের ও নানা মানুষের প্রতিনিধিত্ব। এবং নির্বাচনে গণনা করা হবে এবং গুরুত্ব দেয়া হবে প্রতিটি ব্যক্তির ভোটকে। কিন্তু সেটি অসম্ভব করা হয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানিক রীতি ও নির্বাচন পদ্ধতিতে। বর্তমান পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠা পায় দেশের সর্ববৃহৎ নিরেট স্বৈরতন্ত্র। কারণ, তারা নির্বাচনে শতকরা ৩৮ ভাগের কম ভোট পেয়েও ক্ষমতায় যায়। তখন দেশের বাকি শতকরা ৬২ ভাগ লোকের মন্ত্রী পরিষদে কোন প্রতিনিধিত্ব থাকে না। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের কোন প্রভাব থাকে না। জনগণের ভোট বহু দলের মাঝে ভাগাভাগী হয়ে যাওয়াতে ক্ষমতায় যেতে আওয়ামী লীগকে কখনোই শতকরা ৩৮ ভাগের বেশী ভোটের প্রয়োজন পড়েনি। প্রয়োজন পড়েনি এমন কি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’রও।  এতে ক্ষতি হয়েছে ছোট ছোট দলগুলোর।‌ ছোট দলগুলো সবাই মিলে শতকরা ৬০ ভাগের বেশি ভোট পায়, কিন্তু তাদের ভোটগুলি বহু দলে ভাগাভাগী হয়ে যাওয়াতে তাদের মধ্য থেকে একজনও মন্ত্রী পরিষদে স্থান পায়না। ক্ষমতাসীন দল তখন ক্ষমতায় বসে বাকি জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করে না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এভাবেই রাষ্ট্রের উপর প্রভাব ফেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এটি নিরেট অবিচার এবং গণতন্ত্রের নামে প্রহসন।

বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে যেহেতু সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলটি লাভবান  হয়, সেজন্যই তারা সে সুবিধাটি বহাল রাখতে বর্তমানের এ নির্বাচন পদ্ধতিকেই বহাল রাখতে  চায়। নিজেদের সে দলীয় স্বার্থটি ধরে রাখতেই ১৯৭২’য়ের সংবিধানে ও নির্বাচনী বিধিমালায় সে বিধানটি সংযুক্ত করেছে। এ বিধানের মাঝে পরিচয় মেলে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নিরেট দলীয় স্বার্থবাদ। সে স্বার্থান্বেষী নীতি যেমন বেঁচে ছিল আওয়ামী লীগের মাঝে, তেমনি আজ বেঁচে আছে বিএনপির মাঝে। তাদের ষড়যন্ত্র এবং দুশমনিটি এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিরুদ্ধে। এ বিধানের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাদের হাতে জিম্মি।

দেশে এমন দল আছে যারা নির্বাচনে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ ভোট পায়। অথচ সংসদে সে অনুপাতে তারা প্রতিনিধিত্ব পায় না। শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ ভোটের অর্থ কয়েক কোটি মানুষের ভোট। ফলে সংসদে ও মন্ত্রি পরিষদে সে কয়েক কোটি মানুষের মতামত তুলে ধরার কেউ থাকেনা। এটি নিরেট অবিচার ও গণতন্ত্র বিরোধী। সংবিধানের দায়িত্ব হলো সংসদে প্রতিটি নাগরিকের প্রতিনিধিত্বকে নিশ্চিত করা। কারণ দেশ তো তাদেরও। কোন সভ্য ও বিবেকবান নাগরিক তাই এ বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা মেনে নিতে পারে না। জার্মানীসহ বহু দেশে এরূপ বৃহৎ দলীয় স্বৈরাচারকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সেটি করতে হবে। জনগণের বিরুদ্ধে এরূপ সাংবিধানিক অবিচারকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায়না।

গণতন্ত্রের লক্ষ্য হলো, সকল নাগরিকদের মতামতকে মূল্য ও ইজ্জত দেওয়া। তাই সবার ভোটকে মূল্য ও ইজ্জত দিতে হলে বর্তমানের এই অবিচারপূর্ণ ও অগণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতিকে অবশ্য বিলুপ্ত করতে হবে। নইলে জনগণের বিরুদ্ধে এ অসহনীয় অন্যায় লাগাতর চলতে থাকবে। তখন দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিকদের ক্ষমতার চৌহদ্দি থেকে দূরে রাখা হবে। তাই দেশের সংস্কারের শুরু হোক সংবিধান ও নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারের মধ্য দিয়ে।

বুঝতে হবে, কোন দলীয় সরকার কখনোই চলমান এ সাংবিধানিক অবিচারকে বিলুপ্ত করবে না। কারণ তারা জানে, প্রাপ্ত  মোট ভোটের ভিত্তিতে সংসদের আসন সংখ্যার বন্ঠন হলে তাদের দলীয় স্বৈরাচার বিলুপ্ত  হবে। শতকরা ৪০ ভাগের কম ভোট পেয়ে তারা যেভাবে দেশের শতকরা ১০০ ভাগ মালিক হয়ে যায় -সে সুযোগ আর থাকবে না। তাই অতীতে আওয়ামী লীগ যেমন এটিকে বিলুপ্ত করেনি, বিএনপিও করবে না। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজটি করতে হবে প্রফেসর ইউনুসের নির্দলীয় সরকারকেই। কারণ এতে প্রফেসর ইউনুসের হারাবার কিছু নেই; এতে জনগণের জন্য রয়েছে বিশাল বিজয়।

এ সাংবিধানিক ও নির্বাচনী সংস্কারটি করা হলে আরো বহু সংস্কারের পথ খুলে যাবে। তখন ইজ্জত ও গুরুত্ব পাবে দেশের আপামর জনগণের রায়। তখন বহু রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের বৈধ stakeholder’য়ের মর্যাদা পাবে।  তাই এর চেয়ে বড় সংস্কার আর কি হতে পারে? তাই চালু করা হোক নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সংসদের আসন বন্ঠন। তখন যে দল নির্বাচনে শতকরা ৩০ ভাগ ভোট পাবে, সে দলটি ৩০০ এমপির সংসদে পাবে ৯০টি আসন। এবং যে দল নির্বাচনে ১৫ ভাগ ভোট পাবে সে ভাবে ৪৫টি আসন। কোন দলের পক্ষেই তখন দলীয় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা দেয়া সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক দলগুলি তখন সমন্বয়ের ও কোয়ালিশনের রাজনীতিতে অভ্যস্থ হবে। তখন নির্বাচনে প্রতিটি ভোট গুরুত্ব পাবে। তখন নির্বাচনে ভোটদাতার সংখ্যাতেও বৃদ্ধি পাাবে। তাতে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতা বাড়বে জনগণের। কারণ, তারা বুঝবে, সরকার গঠনে তাদের ভোট গুরুত্ব পাবে। ফলে যাদের বিবেক আছে এবং গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার আছে, তারা কি এমন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন পদ্ধতির বিরোধীতা করতে পারে? ০৯/০৩/২০২৫   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *