বাঙালি মুসলিমের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম এবং সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

বাঙালি মুসলিমের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি

বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসে যেমন রয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি, তেমনি রয়েছে জঘন্যতম অপরাধ কর্মও। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিশাল কীর্তিটি হলো ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই মুসলিম রাষ্ট্রের নির্মাণই ছিল দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। এ দেশটির সৃষ্টিতে উল্লসিত হয়েছিল সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। কারণ, ৫০টি বেশী মুসলিম রাষ্ট্রের সবগুলিই ক্ষুদ্র মাপের; কিছু কাল আগে বিলুপ্ত হয়েছে উসমানিয়া খেলাফত। ফলে তাদের পাশে দাঁড়াবার মত অভিভাবক সুলভ কোন বৃহৎ রাষ্ট্র ছিল না। পাকিস্তানের সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছিল বাঙালি মুসলিমগণ। মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল যেমন ঢাকাতে, তেমনি মুসলিম লীগের মূল ঘাঁটিও ছিল বাংলায়। ভারতীয় উপমহাদেশের আর কোন প্রদেশে মুসলিম লীগ এ রকম মজবুত ঘাঁটি গড়তে পারিনি। ব্রিটিশ আমলে বাংলার জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ ছিল মুসলিম এবং বাকি ৪৪ ভাগ ছিল হিন্দু। কিন্তু শিক্ষা, চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে হিন্দুরা ছিল মুসলিমদের চেয়ে অধিক অগ্রসর। দেশের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ জমিদার ছিল তারা। বাংলার বুকে নির্মিত ইটের দালান, পুকুর ও বাগানের শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগের মালিক ছিল হিন্দুরা। অধিকাংশ মুসলিম ছিল ভূমিহীন প্রজা। তাদের দরিদ্র বানানোই ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের প্রকল্প। ১৭৫৭ সালে পলাশীর বিজয়ের পর শুরু থেকেই ব্রিটিশেরা মুসলিমদের শত্রু এবং হিন্দুদের সহায়ক শক্তি রূপে গণ্য করতে থাকে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হিন্দুদেরকে তারা কলাবোরেটর রূপে ব্যবহার করে। মুসলিম শাসন আমলে দেশের শতকরা প্রায় ২০ ভাগ জমি মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দ ছিল। এসব জমিকে খাজনামূক্ত তথা লাখেরাজ জমি বলা হতো। ব্রিটিশ সরকার এ জমি কেড়ে নিয়ে হিন্দু জমিদারদের হাতে তুলে দেয়। ফলে অর্থের অভাবে মাদ্রাসাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। বস্তুত এ ছিল মুসলিমদের অশিক্ষিত বানানোর সুপরিকল্পিত ব্রিটিশ প্রকল্প।

বাঙালি মুসলিমদের ঘাড়ে ছিল নির্যাতন ও শোষণের দুটি জোয়াল। একটি ব্রিটিশদের, অপরটি হিন্দু জমিদারদের। জমিদারদের পূজোর উৎসব এবং সন্তানের বিয়েতেও মুসলিমদের খাজনা দিতে হত। কিন্তু এতো বঞ্চনার পরও মুসলিমগণ বসে থাকেনি। পশ্চাৎপদ এই মুসলিম জনগণই রাজনীতির ময়দানের প্রতাপশালী হিন্দুদের পরাজিত করেছিল; এবং তাদের সে বিজয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলিম লীগ।  ১৯৩৭ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাদেশিক সরকার গঠনের পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে যে তিন জন ব্যক্তি বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তাদের সবাই ছিলেন মুসলিম। তারা হলেন শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দীন। অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্য প্রদেশগুলিতে সেরূপ বিজয় মুসলিমরা পায়নি। ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত পাঞ্জাবে ক্ষমতায় ছিল হিন্দু, মুসলিম ও শিখদের নিয়ে গঠিত সেক্যুলার ইউনিয়োনিস্ট পার্টি এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস পার্টির সরকার। সিন্ধু প্রদেশে মুসলিম লীগ ক্ষমতা পেয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে এসে। এক্ষেত্রে বাংলা ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। এবং সেটি সম্ভব হয়েছিল মুসলিম লীগের সফল নেতৃত্ব ও বাঙালি মুসলিমদের সচেতনার জন্য। আর সে সচেতনতা ও স্বাধীনতার আকাঙ্খা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল ব্রিটিশ ও হিন্দু জমিদারদের নৃশংস শোষণ ও নির্যাতন।  

উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ার পর বিলুপ্ত হয় মুসলিম সভ্যতার পরিচয়বাহী সিভিলাইজেশনাল স্টেট। ভূ-রাজনৈতিক ভাবে বিভক্ত মুসিলমগণ গড়ে তুলেছিল অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতীয়, উপজাতীয়, গোত্রীয় ও আঞ্চলিক রাষ্ট্র। তাদের রাজনীতি, চিন্তা-ভাবনা ও আশা-আকাঙ্খা সীমিত হয়ে পড়েছিল বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চল ভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে। সেসব স্বার্থ নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে রক্তাক্ষয়ী সংঘাতেও জড়িয়ে পড়েছিল। মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থ, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও গৌরব নিয়ে ভাাবার সময় ও সুযোগ তাদের ছিল না। মনে হচ্ছিল, বিভিন্ন ভাষা, বর্ণ, মজহাব ও অঞ্চলে বিভক্ত মুসলিমগণ সামর্থ্য হারিয়েছে অখণ্ড মুসলিম রাষ্ট্র নির্মাণের। অথচ সেরূপ রাষ্ট্র গড়াই হলো মহান নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত। তিনি সেরূপ একটি রাষ্ট্রের ১০টি বছর রাষ্ট্র প্রধান ছিলেন। সে রাষ্ট্র ভেঙ্গে আজ ৬টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। এরূপ রাষ্ট্র গড়া নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত এ জন্য যে, নফল রোজা, নফল নামাজ, উমরাহ, দাড়ি-টুপি, আতর-মেছওয়াকের ন্যায় সূন্নতগুলি যতই পালন করা হোক, তাতে মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ইজ্জত বাড়ে না। কারণ, এ সূন্নতগুলি সে কাজের জন্য নয়। বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠার জন্য নির্দেশিত হাতিয়ার হলো মুসলিম উম্মাহর একতা এবং জিহাদ। অথচ বিভক্ত মুসলিম উম্মাহর মাঝে নবীজী (সা:)’র নানা রূপ সূন্নত পালনে আগ্রহ দেখা দিলেও বিলুপ্ত হয়েছে একতা ও জিহাদে আগ্রহ। ফলে আরব, ইরানী, তুর্কি, কুর্দি, হাবসীদের নানা ভাষীদের একতাবদ্ধ করে নবীজী (সা:) যেরূপ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিলেন, মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে সেরূপ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। এমন কি ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠা দিতে। ফলে মুসলিম ভূমিতে বিপুল ভাবে বিজয়ী হয়েছে শয়তানের বিভক্তিকরণের এজেণ্ডা।

কিন্তু মুসলিম উম্মাহর এতো ব্যর্থতার মাঝেও গৌরবের ইতিহাস সৃষ্টি করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের শিক্ষাকে অনুসরণ করে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মুসলিমগণ ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে মুসলিম লীগের পতাকা তলে একতাবদ্ধ হয় এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা দেয়। ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিত্তিক বন্ধনকে বাদ দিয়ে তারা কালেমায় তাওহীদের রশিকে আঁকড়ে ধরে। স্লোগান তুলে, “পাকিস্তান কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” সে অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে আজকের পাকিস্তানের ২৫ কোটি এবং বাংলাদেশের ১৭ কোটি মিলে গড়ে তুলতে পারতো ভারত ও চীনের পর ৪২ কোটি জনসংখ্যার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র -যা হতো পারমানবিক অস্ত্রধারীও। তখন অভিভাবক রূপে এ পারমানবিক রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আরাকানের নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়াতে পারতো। সে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি রূপে বাঙালি মুসলিমগণ পেত বিশ্ব রাজনীতিতে -বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ। বস্তুত এটিই ছিল বাঙালি মুসলিমের ১৯৪৭’য়ে স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্নকে হত্যা করে জাতীয়তাবাদ, বাঙালি ফ্যাসিবাদ, সেক্যুলারিজম ও হিন্দুত্ববাদের জোয়ারে ভাসা ইসলামের শত্রুগণ।    

 

বাঙালি মুসলিমের সবচেয়ে বড় অপরাধ    

বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নাশকতার কাণ্ডটি ঘটে ১৯৭১’য়ে। সেটি নিজ হাতে গড়া পাকিস্তানকে খণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে। সেটি করা হয় মুসলিমদের চির শত্রু ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী কাফিরদের অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও সামরিক সহায়তা নিয়ে। এ নিষিদ্ধ কর্মে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলাম থেকে দূরে সরা বাঙালি ফাসিস্ট, উগ্র সেক্যুলারিস্ট এবং বামধারার নাস্তিকগণ। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ন্যায় পৌত্তলিক কাফিরদের কোলে উঠার এমনক ঘৃণিত কর্ম বিগত ১৪ শত বছরেরর মুসলিম ইতিহাসে কখনোই ঘটেনি। অথচ কোন মুসলিমের ঘর ভাঙ্গা যেমন অপরাধ, তার চেয়ে শতগুণ অধিক অপরাধ হলো মুসলিম রাষ্ট্র ভাঙ্গা। কারণ রাষ্ট্র ভাঙ্গলে মুসলিম উম্মাহ দুর্বল, স্বাধীনতাহীন ও নিরাপত্তাহীন হয়। তখন বিলুপ্ত হয় ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি নির্মাণের ভূ-রাজনৈতিক অবকাঠামো। আজকের মুসলিমগণ সংখ্যায় ১৫০ কোটির অধিক হওয়া সত্ত্বেও তারা শক্তিহীন, স্বাধীনতাহীন ও নিরাপত্তাহীন। তার কারণ, তাদের হাতে কোন বৃহৎ রাষ্ট্র নাই। নানা ভাষা, বর্ণ, জাতপাত ও অঞ্চলে বিভক্ত হিন্দুরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র গড়তে পারলেও মুসলিমগণ তা পারিনি। হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদীদের সিভিলাইজেশনাল রাষ্ট্র রয়েছে, কিন্তু সেরূপ সিভিলাইজেশনাল রাষ্ট্র মুসলিমদের নাই। মুসলিমগণ ব্যস্ত জাতীয়, উপজাতীয় বা গোত্রীয় রাষ্ট্র নির্মাণ নিয়ে।

পাকিস্তান ভাঙ্গাকে জায়েজ করা হয় পাকিস্তান আর্মির হাতে বাঙালি হত্যাকে অজুহাত রূপে দেখিয়ে। কোন সভ্য ও বিবেকবান মানুষই নিরপরাধ মানুষের হত্যাকে সমর্থন করে না। তবে একটি অপরাধকে কখনোই আরেকটি গুরুতর অপরাধের জন্য বাহানা বানানো নিকৃষ্ট অপরাধ। একাত্তরের শুধু বাঙালি হত্যা হয়নি, বাঙালির চেয়ে বেশী হয়েছে অবাঙালি হত্যা। বাঙালি নারীদের চেয়ে বেশী ধর্ষিতা হয়েছে অবাঙালি নারী। এবং সেগুলি বাঙালিদের হাতে। বাঙালির সর্বকালের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। কোন বাঙালির গৃহ অবাঙালিরা কেড়ে নিয়ে তাকে বস্তিতে পাঠানো হয়নি। কিন্তু প্রতিটি অবাঙালির গৃহ, গৃহের আসবাবপত্র ও দোকানপাট কেড়ে নেয়া হয়েছে। অথচ অবাঙালিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সে নৃশংস বর্বরতার বিরুদ্ধে কোন বাঙালি রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক কোন নিন্দাবাক্য উচ্চারণ করেনি। তাদের কাছে একমাত্র বাঙালি হত্যা এবং বাঙালি রমনীদের ধর্ষণই নিন্দনীয়, অবাঙালিদের হত্যা করা ও অবাঙালি নারীদের ধর্ষণ করা নয়।  

আওয়ামী ফ্যাসিস্ট, বাঙালি সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার নেতাকর্মীদের বয়ান হলো, পাকিস্তান সেনাবাহিনী লক্ষ্য ছিল বাঙালি নির্মূল। কিন্তু ১৯৪৭ থেসে শুরু করে ১৯৭০ -এই ২৩ বছরে কি ২৩ জন বাঙালিকেও পাক আর্মি করেছে। অথচ মুজিব তিরিশ হাজারের বেশী বাঙালিকে হত্যা করেছে মাত্র তার আড়াই বছরের শাসনে। নিহতরা ছিল বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী। বহু হাজার বাঙালি গুম, খুন ও বিচারবহির্ভুত হত্যার শিকার হয়েছে হাসিনা। ২০২৪’য়ের জুলাই-আগস্টের বিপ্লব থামাতে প্রায় ২ হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে এবং ২৪ হাজার মানুষকে আহত করা হয়েছে।

অথচ নবীজী (সা:) শুধু নিজের ঘর ও মসজিদ গড়েননি, তিনি গোত্রীয় রাষ্ট্রের উর্দ্ধে উঠে সিভিলাইজেশনাল স্টেট গড়েছেন। সে রাষ্ট্রের ভূমিতেই নির্মিত হয়েছে ইসলামী সভ্যতা এবং মুসলিমদের উত্থান হয়েছে সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তি রূপে। অথচ পরিতাপের বিষয় হলো, আজকের মুসলিমগণ বাঁচছে নবীজী ইসলাম ও তাঁর রাষ্ট্র নির্মাণের সূন্নত বাদ দিয়ে। নামাজ আদায়ের কাজটি মন্দিরে হয় না, সে জন্য মসজিদ গড়তে হয়। তেমনি অনৈসলামী রাষ্ট্রের আদালত, প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ নীতি ও অর্থনীতিত ও যুদ্ধবিগ্রহে পূর্ণ ইসলাম পালনের কাজটি হয়না, সে জন্য ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হয়। নবীজী (সা:) তো এভাবেই ইসলাম পালন করেছেন। অথচ বাঙালি মুসলিমের কাছে এ বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পায়নি বিশ্বের অন্য মুসলিমদের কাছেও। তারা রাষ্ট্র নির্মাণ করেছে জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদ ও সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা দিতে। গাদ্দারী এখানে মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর মহান রাসূল (সা:)’র সাথে।  

 

যুদ্ধ ডেকে আনা এবং যুদ্ধ শুরু করাই যুদ্ধাপরাধ

বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য কখনোই পাকিস্তান বাঁচানো ছিল না। সেটি ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ বানানো। সে কাজটি নির্বাচনে বিজয়ে হয়েও সম্ভব ছিলনা। সেজন্য বিদ্রোহ ও যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। সেরূপ একটি বিদ্রোহ ও যুদ্ধের ষড়যন্ত্র ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্রে। কিন্তু মুজিব সে ষড়যন্ত্র সফল করার আগেই গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। ফলে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। মুজিব  পাকিস্তান ভাঙ্গার নতুন স্ট্রাটেজি নেয় ১৯৭১’য়ে। সে লক্ষ্যে যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। মুজিব একাত্তরের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্দানে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় এবং জনগণকে হাতের কাছে যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলে। সকল ক্যান্টনমেন্টগুলিতে খাদ্য-পানীয় সরবরাহ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এ নিবন্ধের লেখক মুজিবের সে বক্তৃতা সোহরাওয়ার্দী উদ্দানের জনসভায় উপস্থিত থেকে শুনেছে।  কথা হলো, এরূপ ঘোষণার পরও কি যুদ্ধ শুরুর কিছু বাকি থাকে? ছাত্র লীগের নেতারা ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা টানিয়ে গর্বভরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করতে যায়। আমি তখন ঢাকায়। মনে হচ্ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটেছে। তাই যারা বলে, মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার কারণে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে, তারা যে শুধু পরিস্থিতি নিয়ে পুরা অজ্ঞ -তাই নয়; চিন্তা-ভাবনা শূণ্যও।

যুদ্ধ কোন দেশেই একাকী আসে না। যুদ্ধের সাথে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং জুলুমও আসে। কারণ অস্ত্রধারীরা তখন জনপদে নামে এবং অস্ত্রের জোরে যা ইচ্ছা তাই করার সুযোগ পায়। সেনাবাহিনীকে তাই তোপের মুখে রণাঙ্গণে রাখতে হয়, আবাসিক এলাকায় নয়। জনপদে সৈনিক নামার ফলে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং জুলুম কাশ্মীরে বিগত ৭০ বছর ধরে চলছে। গণহত্যা বাংলাদেশেও হয়েছে; সেটি যেমন মুজিবের আমলে,তেমনি হাসিনার আমলে। তাই যারা যুদ্ধ ডেকে আনে বা যুদ্ধ শুরু করে তারই হলো বড় যুদ্ধাপরাধী। আর একাত্তরের যুদ্ধটি ডেকে আনে এবং শুরু করে মুজিব। শুরুটি হয় স্বাধীনতার ঘোষণা,  স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং নানা স্থানে অবাঙালি হত্যা ও সেনা হত্যার মধ্য দিয়ে। সেরূপ একটি যুদ্ধের মটিভ মুজিবের মাঝে ষাটের দশক থেকেই বিরাজ করছিল। ১৯৭০ সালে নির্বাচনী বিজয়ের পর মুজিব তার পাকিস্তান ভাঙ্গার আগরতলা ষড়যন্ত্র সফল করতে নতুন বল পায়। মুজিব তার নির্বাচনী বিজয় বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে রায় বলে চালিয়ে দেয়। অথচ কোন জনসভাতেও স্বাধীনতার পক্ষে ভোট চায়নি; বরং পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়েছে।

একাত্তরের ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্দানের ভাষণে শেখ মুজিব প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেয় এবং হাতে কাছে যা আছে তা নিয়ে যুদ্ধ নামতে নির্দেশ দেয়। হুকুম জারি করে সকল ক্যান্টনমেন্টগুলিতে খাদ্য, পানীয় ও রশদ সরবরাহ বন্ধ করার। পরিকল্পনা নেয়া হয় অবাঙালি সৈন্যদের অনাহারে ও বিনা পানিতে হত্যার। ১৯৭১’য়ের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই হামলা ও লুটপাট শুরু হয় অবাঙালিদের ঘরবাড়ী ও দোকান-পাটের উপর। অথচ সে সময় পাকিস্তান সরকারের কোন যুদ্ধপ্রস্তুতি ছিলনা। সেটির প্রমাণ, একাত্তরের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মাত্র ১১ হাজার সৈন্যের ১ ডিভিশন সৈন্য। মুজিব ভেবেছিল, এ মুষ্টিমেয় সৈন্যকে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বিডিআর ও পুলিশের বিপুল সংখ্যক সশস্ত্র সদস্য সহজেই পরাস্ত করতে পারবে। মেজর জিয়াও সেটিই ভেবেছিল। সেরূপ সহজ বিজয়ের আশা নিয়েই মেজর জিয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। পরে প্রমাণিত হয়, ভারত তার আড়াই লাখের বেশী সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ শুরু না করলে পাকিস্তান সেনবাহিনীকে পরাজিত করার সামর্থ্য মুক্তিবাহিনীর ছিল না। সেটির প্রমাণ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধে নামার আগে একটি জেলা বা মহকুমা দূরে থাক, একটি থানাও মুক্তিবাহিনী স্বাধীন করতে পারিনি। বাঙালি মুসলিমদের নিয়ে গঠিত রাজাকরগণই তাদেরকে সব সময় দৌড়ের উপর রেখেছিল।       

 

গণহত্যার অপরাধ ও ফিতনার অপরাধ

১৯৭১’য়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভূমিতে দুটি গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। একটি হলো গণহত্যা। অপরটি হলো ফিতনা। গণহত্যার কাজটি যেমন পাকিস্তান সেনাবাহিনী করেছে, তেমনি করেছে মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনী এবং সেক্যুলারিস্ট ফ্যাসিস্ট ও বামধারার সৈনিকেরা। ফলে হ্ত্যার শিকার হয়েছে যেমন বাঙালিরা, তেমনি অবাঙালিরাও। বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামপন্থীদের দ্বারা গণহত্যার পাশাপাশি আরেকটি গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেটি হলো ফিতনা। ফিতনাকে মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ২১৭ নম্বর আয়াতে মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ বলেছেন। যে রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার পরাজয় আনে এবং বিজয়ী করে শয়তানের এজেণ্ডাকে -সেটি হলো ফিতনা।  ফিতনার নাশকতাটি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে। গণহত্যায় কিছু মানব সন্তান নিহত হয়। আর ফেতনায় শুধু মানব হত্যা হয়না, নিহত হয় মুসলিম রাষ্ট্র। এবং অসম্ভব করা হয় ইসলামের বিজয়।

মুসলিম উম্মাহ আজ যেরূপ পরাধীন, নিরাপত্তাহীন ও ইজ্জতহীন -তার কারণ গণহত্যা নয়; বরং রাষ্ট্র হত্যা। নবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের গবেষণা মতে মুজিবের শাসনামলে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। ভাতের অভাবে মানুষ বমি খেয়েছে। কাপড়ের অভাবে মানুষ জাল পড়েছে। অর্থের অভাবে মা তার নিজ সন্তানকে বিক্রি করেছে।  বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ অপমান কুড়িয়েছে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি রূপে। পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে এরূপ দুর্ভিক্ষ পূর্ব পাকিস্তানে একবারও আসেনি। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল ভারতের অধিকৃত করদ রাজ্যে। বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি বলতে কিছু ছিল না। ভারতের নীতিই ছিল মুজিবের নীতি। মুজিব একদলীয় বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কবরে পাঠিয়েছিল। যুদ্ধ শুরু করেছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। বিরোধীদের দমনে নগরে-বন্দরে ও গ্রামে ময়দানে রক্ষিবাহিনী নামিয়েছিল।  

বাংলাদেশীদের এরূপ করুণ পরিণতির কারণ, পাক আর্মি কর্তৃক একাত্তরের গণহত্যা ছিল না। বরং সেটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামপন্থীদের দ্বারা রাষ্ট্র হত্যা। এবং তাদের হাতে নিহত সে রাষ্ট্রটি ছিল পাকিস্তান নামের বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। আজ গণগত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে গাজাতে। শত্রুশক্তির হাতে ধ্বংস, গণহত্যা ও অধিকৃতির শিকার হয়েছে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, ইয়েমেন। তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নাই। এর কারণ, বেঁচে নাই উসমানিয়া খেলাফত। খেলাফত নামক সর্ববৃহৎ সে মুসলিম রাষ্ট্রটির বিলুপ্তিই ছিল মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বিশাল নাশকতা। সে নাশকতাটি ঘটিয়েছে জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট ও সেক্যুলারিস্টদের সৃষ্ট ফিতনা। এবং তাদেরকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে ঔপনিবেশিক কাফির শক্তি।

মুসলিম দেশ ভাঙ্গার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অর্থ আল্লাহ তায়লার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এমন হারাম যুদ্ধে প্রাণ গেলে জাহান্নাম অনিবার্য। মুসলিমদের উপর ফরজ হলো, তারা যুদ্ধ করবে মুসলিম রাষ্ট্রের অখণ্ডতা বাঁচতে। কারণ, আল্লাহ তায়লা চান মুসলিম উম্মাহর একতা এবং মুসলিম রাষ্ট্রের অখণ্ডতা। সুরা ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে তিনি ফরজ করেছেন একতাকে এবং বিভক্তিকে হারাম করেছেন। অতএব কোন মুসলিম দেশকে ভাঙ্গা হারাম। রাষ্ট্রে বৈষম্য, অবিচার ও দুর্বৃত্তি থাকতেই পারে। ফরজ হলো সেগুলির নির্মূলে জিহাদ; কিন্তু হারাম হলো সেগুলিকে বাহানা বানিয়ে দেশ ভাঙ্গা। সেটি মূলত শয়তানের এজেণ্ডা। তাই যারা কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গে, তারা মূলত শয়তানের খলিফাদের বিজয়ী করে। ১৯৭১’য়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলারিস্ট ও বাম ধারার লোকেরা সে কাজটিই করেছে। মুক্তিবাহিনী শয়তানের পৌত্তলিক খলিফাদের বিজয়ী করছে। একাজে ইসলামী দলগুলির নেতা-কর্মীদের যেমন দেখা যায়নি, তেমনি দেখা যায়নি কোন আলেম, ইমাম বা পীর সাহেবকে।

 

পাক আর্মির হাতে নিহত হয়েছে বহু পাকিস্তাপন্থীও

পাকিস্তান আর্মির হাতে শুধু পাকিস্তানের শত্রুরাই নিহত হয়নি, নিহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু পাকিস্থানপন্থীরাও। উদাহরণ দেয়া যাক। সে সময় ছাত্রদের মাঝে ইসলামপন্থী ও অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষের ছাত্র সংগঠন ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ। এ সংগঠনের ঢাকা শহর শাখার সভাপতি ছিলেন জনাব শাহ জামাল চৌধুরী। তাকে পাক আর্মি হত্যা করে। তার সাথে হত্যা করে ফরিদপুর জেলা ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আব্দুস সালামকে। কুষ্টিয়া জেলার প্রখ্যাত আইনজীবী ছিলেন জনাব এ্যাডভোকেট সা’দ আহমেদ। তিনি ছিলেন পাকিস্তানপন্থী। তিনি এক সময় আওয়ামী লীগের কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বোর্ডের চেয়্যারমান ছিলেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ৬ দফা পেশ করলে তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। পাক আর্মি তাঁর দোতলা বাড়ি ও গ্যারাজে রাখা গাড়িও জ্বালিয়ে দেয়। তিনি প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাননি। তিনি কুষ্টিয়া জেলা শান্তি কমিটির সভাপতি হয়েছেন এবং অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন। সে কারণে ১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বরের পর তাকে জেলে যেতে হয়েছে। আমার পরিচিত সিরাজগঞ্জের এক কৃতি ছাত্রের পিতা, তার নানা এবং ভাইকে আর্মি হত্যা করে। তারা সবাই ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। ইসলামপন্থী না হয়ে তারা যদি সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী হতেন তবে প্রতিশোধ নিতে হয়তো ভারতে গিয়ে উঠতেন। সেখানে ট্রিনিং নিয়ে পাক আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতেন। কিন্তু তারা তা করেননি। বরং সে পরিবারের সকল সদস্যদের অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে।

আপন জন হারানো বেদনা এ নিবন্ধের লেখকেরও কম নয়। একাত্তরের মে মাসে আমি আমার সহোদর ভাই ও ভাগ্নেকে হারিয়েছি। তারা নিহত হয়েছে বিহারীদের হাতে। উভয় ছিল নবম শ্রেণীর ছাত্র। আমরা তাদের লাশও পায়নি। ছেলে হারানোর বেদনায় আমার মা’য়ের মাঝে দেখতে পেতাম। বহুবার তাঁকে মাঝ রাতে উঠে কাঁদতে দেখেছি। সে এক করুণ স্মৃতি। আমার ভাইয়ের মৃত্যুরও প্রেক্ষাপট রয়েছে। হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরী করেছে আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা। একাত্তরের মার্চ মাসে আমার নিজ জেলা কুষ্টিয়াতে চলে বিহারীদের উপর নির্মম গণহত্যা। তাতে নিহত হয় হাজার হাজার বিহারী, দখলে নেয়া হয়তাদের ঘরবাড়ী ও দোকানপাট। ধর্ষিতা হয়েছে শত শত বিহারী রমনী।

 

বিহারী হত্যা ও বিহারীদের প্রতিহিংসা

বিহারীরা আমার ভাই ও ভাগ্নেকে হত্যা করেছে বিহারী হত্যার প্রতিশোধ নিতে। কারণ একাত্তরের তারাই সবচেয়ে বেশী গণহত্যার শিকার হয়েছে। কুষ্টিয়া শহরে বহু হাজার বিহারীর বসবাস গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। তাদের জন্য কুষ্টিয়া শহবের এক প্রান্তে সরকারি উদ্যোগে আবাসিক কলোনী গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ অবধি ২৩ বছরে তাদের হাতে কোন বাঙালি নিহত হওয়ার কাণ্ড ঘটেনি। একাত্তরে বাঙালি হত্যার জন্য দায়ী তো সেসব আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা যারা একাত্তরের মার্চের পূর্ব থেকেই স্লোগান দিচ্ছিল, “একটা একটা ছাতু (বিহারী/অবাঙালি) ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর।” তাই আওয়ামী দুর্বৃত্তদের নজর ছিল বিহারীদের ঘরবাড়ী, দোকানপাট ও তাদের রমনীদের উপর। এভাবেই পরিকল্পিত ভাবে বাঙালি-অবাঙালির হানাহানির প্রেক্ষাপট তৈরী করেছিল স্বার্থান্বেষি মুজিব ও তার অনুসারী ফ্যাসিস্ট দুর্বৃত্তরা। একই কথা বলা যায় সেনাবাহিনীর ব্যাপারেও। পূর্ব পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বসবাস ১৯৪৭ থেকেই। কিন্তু তাদের হাতে কি একজন বাঙালি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ -এই ২৩ বছরে নিহত হয়েছে বা ধর্ষিতা হয়েছে? হয়নি। তাদের হাতে সকল নৃশংসতা ঘটেছে একাত্তরের ৯ মাসে।

বাঙালিদের পক্ষ থেকে বিহারী ও পাক সেনাবাহিনীর উপর হামলা শুরু হয়েছিল সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চের রাতে এ্যাকশন শুরুর বহু আগেই। সেরূপ একটি হামলার নির্দেশ দিয়েছিল শেখ মুজিব নিজে। ক্ষমতার নেশায় যারা এভাবে নৃশংস হত্যা ও সহিংসতার জন্ম দেয়, তাদের নিজেদের পরিণতিও ভাল হয়না। পাপ কাউকে ছাড়ে না। শাস্তি যেমন তাদের দুনিয়ার জীবনে হাজির হয়, তেমনি অনিবার্য হয়ে উঠে আখেরাতেও। তাই মুজিব ও তার পরিবারকে সহিংসতার পথেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। অন্যদেরকে যারা নিরাপদে বাঁচতে দেয়, তারা নিজেরাও শান্তিতে বাঁচার পথ পায়। কিন্তু ফ্যাসিস্টগণ সেরূপ শান্তিপূর্ণ রাজনীতিকেই অসম্ভব করে। মুজিব যেমন বিরোধীদের বেঁচে থাকাটি অসম্ভব করতে দেশজুড়ে রক্ষিবাহিনী নামিয়েছে মানবহত্যা চালিয়েছে, হাসিনা তেমনি শাপলা চত্বরের গণহত্যা, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, বৈচারিক হত্যা, গুম, খুন ও আয়না ঘরের নৃশংসতাকে চালু করেছে। 

 

গণহত্যার চেয়েও ক্ষতিকর হলো রাষ্ট্রহত্যা

আমার ভাইয়ের নিহত হওয়াতে আমার পরিবার দারুন ভাবে ব্যথিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই অবস্থা স্বজনহারা সবার। কিন্তু পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার ক্ষতি শতগুণ বেশী। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ -বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় ৬৫ কোটি মুসলিম। তাদের কোমর ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর ভারত যা ইচ্ছে তাই নির্ভয়ে করার সাহস পাচ্ছে। তারা মসজিদ ভাঙ্গছে, মুসলিমদের গৃহও ভাঙ্গছে। এখন ওয়াকফ সম্পত্তি দখলে নেয়ার জন্য আইন তৈরী করছে। মুসলিমগণ নীরব ও নিষ্ক্রিয়। মুসলিমদের প্রতিবাদের সাহসও নাই। সাহসের জন্য তো শক্তি চাই। দেশ ভাঙ্গলে কি শক্তি থাকে? দেশ ভাঙ্গার সে ভয়ানক নাশকতার কারণ, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের সৃষ্ট এই ফিতনা। অর্থ, অস্ত্র, লোকবল ও পরিকল্পনা দিয়ে তাদের নাশকতায় মদদ জুগিয়েছে চিহ্নিত শত্রু ভারত। আগ্রাসী ভারত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যেমন চায়নি, দেশটি বেঁচে থাকুক -সেটিও চায়নি।

ভারতের পাকিস্তানধ্বংসী প্রজেক্টের সাথে একাত্ব হয়েছে ক্ষমতালোভী শেখ মুজিব ও তার অনুসারীরা।  মুসলিম উম্মাহর একতা, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও ইজ্জত নিয়ে তাদের কোন ভাবনাই ছিল না। তাদের একমাত্র তাড়না ছিল, যে করেই হোক ক্ষমতালাভ- প্রয়োজনে পাকিস্তান খণ্ডিত করে হলেও। কুয়ার ব্যাঙ যেমন কুয়ার বাইরের বিশাল জগত নিয়ে ভাবে না, তেমনি মুসলিম উম্মাহ নিয়ে ভাবে না জাতীয়তাবাদী ও গোত্রবাদী ক্ষুদ্র চেতনার স্বার্থপর ক্ষুদ্র লোকেরা। মুসলিম উম্মাহ আজ ৫০’য়ের বেশী টুকরোয় বিভক্ত ও শক্তিহীন মুলত তাদের সৃষ্ট ফিতনার কারণেই। এরূপ প্রতিটি ফেতনাই হলো মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে নাশকতার হাতিয়ার। মহাপ্রজ্ঞাময় মহান আল্লাহ তায়ালা হয়তো এজন্যই ফিতনাকে মানব হত্যার চেয়ে অধিক ক্ষতিকর বলেছেন।  ১৭/০৪/২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *