বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট ও সেক্যুলারিস্টদের অপরাধনামা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

একাত্তরের গণহত্যা এবং মুজিব

একাত্তরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোন বিতর্ক নাই। কিন্তু বিতর্ক হলো এ হত্যাকাণ্ডের জন্য কে দায়ী -সে বিশেষ ব্যক্তিটিকে নিয়ে। অথচ সেটিই হলো ইতিহাস চর্চার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইতিহাসের কাজ শুধু ঘটনার বর্ণনা দেয়া নয়, বরং আত্মত্যাগী মহৎ ব্যক্তিদের পাশাপাশি স্বার্থান্বেষী দুর্বৃত্তদের চেহারাও জনসম্মুখে তুলে ধরা। ইতিহাস এ ভাবে জনগণের সামনে পেশ দলিল পেশ করে এবং পথ দেখায়। অথচ সে কাজটি বাঙালি মুসলিমদের ইতিহাস চর্চায় হয়নি। ফলে মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের খুনি, বাকশালি ফ্যাসিস্ট, দুর্বৃত্তদের পালনকর্তা এবং ভারতের ন্যায় হিন্দুত্ববাদী শক্তির এজেন্টও নেতা, পিতা ও বন্ধু রূপে নন্দিত হয়। ইতিহাস বিকৃতকরণের এটিই হলো বড় নাশকতা।

একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনীতিতে দুটি পক্ষ ছিল। একটি পক্ষ হলো অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ; অপরটি ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ নির্মাণের পক্ষ। দ্বিতীয় পক্ষের নেতা ছিল শেখ মুজিব। বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদ, ভারতমুখীতা ও সেক্যুলারিজম ছিল তাদের আদর্শ। যারা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিল তাদের জন্য সে সময় কোন যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল না; যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল দ্বিতীয় পক্ষের। কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য পাকিস্তান ভাঙ্গাটি তাদের জন্য জরুরি ছিল; এবং দেশভাঙ্গার কাজটি সফল করতে অপরিহার্য ছিল একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের। পাকিস্তানের শত্রুরা পাকিস্তান ভাঙ্গার এ যুদ্ধকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে থাকে। তারা জানতো, তাদের একার পক্ষে এ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া অসম্ভব। ফলে তারা যুদ্ধে পার্টনার খুঁজতে থাক। পার্টনারও পেয়ে যায়। পার্টনার রূপে বেছে বিশ্বের মূল পৌত্তলিক শক্তি ভারতকে -যা মহান আল্লাহতায়ালা হারাম করেছেন সুরা আল-ইমরানের ২৮ নম্বর এবং সুরা মুমতাহানার ১ নম্বর আয়াতে। কিন্তু তাদের কাছে কুর’আনের এ নিষেধাজ্ঞা আদৌ গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে যে কোন ভাবে পাকিস্তান ভাঙ্গাকে। চেতনার দিক দিয়ে তারা ছিল ইসলাম থেকে দূরে সরা জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট এবং হিন্দুত্বপ্রেমী। তারা এতোটাই ইসলামশূণ্য (de-Islamised) ছিল যে, মুসলিমদের চিরশত্রু ও চির আগ্রাসী ভারতের কাছেও তারা গৃহিত হয়েছিল বিশ্বস্থ আপন লোক রূপে। রাজনৈতিক আশ্রয়, প্রশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে ভারত তাদেরকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামায়। তাদের পক্ষে যুদ্ধ জয় অসম্ভব দেখে ভারত নিজেই আড়াই লাখ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে নামে।   

যুদ্ধ প্রেম-প্রীতির জায়গা নয়;  যুদ্ধের লক্ষ্যই হলো প্রতিপক্ষকে অধিক সংখ্যায় হত্যা করা। সে নীতি ছিল মুক্তিবাহিনীরও। মুক্তিবাহিনীর কাছে হত্যাযোগ্য শত্রু রূপে চিহ্নিত হয়েছিল শুধু পাকিস্তান সরকার ও পাক বাহিনীর সৈন্যরা নয়, বরং সেসব নিরস্ত্র মানুষও যারা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। ফলে মুক্তিবাহিনীর হত্যার তালিকাতে এসে যায় যেমন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামীর মত পাকিস্তানপন্থী সংগঠনের নেতাকর্মী, তেমনি আলেম ও ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং পাকিস্তানপন্থী বিহারীগণ। এই বিহারী জনগণের অতি দুঃখ-কষ্টের এক করুণ ইতিহাস আছে। সে ইতিহাসটি বার বার সব কিছু হারানোর।  ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলা থেকে জান-মাল ও ইজ্জত-আবরু বাঁচাতে নিজেদের ঘরবাড়ী-দোকানপাট ভারতে ফেলে পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১’য়ে বাঙালি ফ্যাসিস্টদের কাছে এই নিরস্ত্র বিহারী নারী, পুরুষ ও শিশুরা গণহত্যার টার্গেটে পরিণত হয়।

১৯৭১’য়ে সবচেয়ে বেশী নিহত, ধর্ষিতা ও নির্যাতিত হয়েছে বিহারীগণ। কারণ, তাদের জন্য পালানোর বা আশ্রয় নেয়ার কোন নিরাপদ জায়গা ছিল না। তাদের নিরাপত্তার পক্ষে খাড়া হওয়ারও কেউ ছিল না। হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু বিহারীদের সামনে সেরূপ কোন আশ্রয়স্থল ছিল না। ফলে তাদেরকে যেরূপ পেরেছে সেরূপ হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে এবং তাদের অর্থ ও ঘরবাড়ী ডাকাতি করে নিয়েছে। এমন কোন বিবেকবান বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী বা রাজনীতিবিদ দেখা যায়নি যে, এরূপ বাঙালি বর্বরতা ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। এমন কি বাংলাদেশীদের লেখা ইতিহাসের বইয়ে সে নৃশংসতার কোন বিবরণ নেই। বাঙালি ফ্যাসিস্ট ও সেক্যুলারিস্টদের কাছে সেগুলি ইতিহাসের উপাদান রূপে গণ্য হয়নি। বিবেকহীনতা এক্ষেত্রে বিশাল। অতিশয় পরিতাপের বিষয় হলো, ভারতের ন্যায় কাফির দেশে বা ইহুদীবাদী ইসরাইলে নয়, বরং বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এ অবাঙালি মুসলিমদের শুধু ঘরবাড়ী, ব্যবসা-বাণিজ্য. দোকান-পাট হারাতে হয়নি,  বরং ভয়ানক গণহত্যা, গণধর্ষণ ও গণনির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির ৫৫ বছর পরও বিহারী মুসলিমদের আজ বাঁচতে হচ্ছে বস্তিজীবনের অবর্ণনীয় ও অন্তহীন যাতনা নিয়ে।

 

 

আল্লাহর দেয়া পরিচতি এবং বাঙালি মুসলিমের আমলনামা

মুসলিমদের পরিচিতি ও পরস্পরের বন্ধনের ভিত্তি বেঁধে দিয়েছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। তিনি সুরা হুজরাতের ১০ নম্বর আয়াতে মুসলিমদের পরস্পরের ভাই বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। বলা হয়েছে:

إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌۭ فَأَصْلِحُوا۟ بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

অর্থ: “মুমিনগণ হলো পরস্পরে ভাই; অতঃপর নিজ ভাইদের মধ্য সমস্যা থাকলে তা সংশোধন করে নাও। এবং ভয় করো আল্লাহকে -যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হতে পারো।”

উপরিউক্ত আয়াতে করুণাময় মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের প্রকৃত পরিচয় ও পারস্পারিক বন্ধনের ভিত্তিটি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই প্রকৃত মুসলিমের দায়িত্ব হলো, চেতনায় সে বিশেষ পরিচয়টি সর্বক্ষণ ধারণ করে বাঁচা এবং সেটিকে লাগাতর সমুন্নত করা। তাই মুসলিম উম্মাহর নির্মাণ হতে হবে ভাতৃত্বের বন্ধনের উপর। এবং সে ভাতৃত্বের বন্ধনটি কোন ভাষা, গোত্র বা বর্ণের ভিত্তিতে হবে না, বরং গড়ে উঠবে মহান আল্লাহ তায়ালার উপর বিশ্বাসের উপর। কারণ তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে মহান আল্লাহতায়ালার সেনাদলের সৈনিক রূপে। হারাম হলো সে সেনাদলে বিভক্তি গড়া। তাই মুসলিম উম্মাহর ভাতৃত্বের বন্ধনে ফাটল ধরানোর যে কোন প্রচেষ্টাই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তথা কুফুরি। অথচ সে ভাতৃত্বের বন্ধন বিলুপ্ত করে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, বর্ণবাদ ও শ্রেণীবাদের ন্যায় হারাম মতবাদগুলি। তাই মূর্তিপূজা, মদ, জুয়া শুকরের গোশতের ন্যায় এ মতবাদগুলিও হারাম। তাই মুসলিম যেমন মূর্তিপূজারী হতে পারেনা, তেমনি হতে পারেনা জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী ও বর্ণবাদী। মুসলিম উম্মাহর পতনের শুরু তো তখন থেকেই যখন থেকে তারা ইসলাম ছেড়ে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ ও বর্ণবাদের স্রোতে ভাসা শুরু করেছে। এবং সে হারাম মতবাদের স্রোতে ভাসায় বাঙালি মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে। এমন কদর্য ইতিহাস বাঙালি মুসলিমের অতীতে কখনোই দেখা যায়নি।

তাই মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু নামাজী, রোজাদার ও হাজী হওয়া নয়, বরং থাকতে হয় অপর মুসলিমের প্রতি ভাতৃসুলভ ভালবাসাও। ঈমান বাড়লে, বাড়ে সে ভাতৃত্ববোধ। কিন্তু এক্ষেত্রে বাঙালি মুসলিমদের ব্যর্থতাটি বিশাল। ব্যর্থতা এখানে মহান আল্লাহর হুকুমের প্রতি অনুগত হওয়ায়। সামান্যতম ভাতৃত্ববোধ থাকলে কি তারা বিহারীদের ঘরবাড়ী, সহায়-সম্পদ ও দোকানপাট কেড়ে নিয়ে আকাশের নীচে বস্তিতে পাঠাতো? তারা কি বিহারী হত্যায় ও তাদের নারীদের উপর ধর্ষণে নামতো? বেঈমানী শুধু নামাজশূণ্য বা ইবাদতশূণ্য হওয়া নয়, বরং অপর মুসলিমের প্রতি ভাতৃত্ববোধ না থাকাটিও। বিহারীদের দুর্যোগের কারণ, তাদের বসবাস পশ্চিম পাকিস্তানে না হয়ে উগ্র ফ্যাসিবাদ ও বর্ণবাদে আক্রান্ত পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছিল। ভারত থেকে যে বিপুল সংখ্যক মুসলিম পশ্চিম পাকিস্তানে হিজরত করেছিল তাদের জীবনে এরূপ দুর্যোগ ও বিপর্যয় আসেনি -যেরূপ এসেছে বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারীদের জীবনে। কারণ, জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ পশ্চিম পাকিস্তানীদের এতোটা নৃশংস ও বর্বর করেনি -যতটা সে বর্বরতা একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে দেখা গেছে। ফলে সেখানে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পরও প্রায় ২০ লাখ বাঙালি মুসলিম বাংলাদেশ থেকে সেখানে বে-আইনী ভাগে গিয়ে বসবাসের সুযোগ পেয়েছে।  

ঈমানদারের জীবনে নানা ভাবে পরীক্ষা আসে। পরীক্ষা হয়, সে কতটুকু বাঁচলো চুরি-ডাকাতি, মিথ্যাচারীতা ও প্রতারণামূলক দুর্বৃত্তি থেকে। পরীক্ষা হয়, সে কতটা সদয় হলো এবং ভাতৃত্ব দেখালো ভিন্ ভাষা, ভিন্ ভূগোল ও ভিন্ বর্ণের প্রতিবেশীর প্রতি। কিন্তু ঈমানের সে পরীক্ষায় কতটুকু পাস করেছে বাঙালি মুসলিমগণ? কাফির দেশে একজন নাগরিকের সে অধিকারটুকু থাকে সেটু্কুও দেয়া হচ্ছে না বাংলাদেশে বিহারী মুসলিমদের। বিলেতে যে কোন বিদেশী আইনসঙ্গত ভাবে ৫ বছর বসবাস করলে সে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পায়। তার সাথে ব্রিটেনে জন্ম নেয়া কোন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি থেকে ভিন্ন রূপ আচরণ (racial discrimination) করা হলে সেটি আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ বিহারীদের দুঃখ-কষ্টের শেষ নাই; নাই কোন আশার আলো। বাংলাদেশে অর্ধ শতাব্দীর বেশী কাল বসবাসের পরও তারা বঞ্চিত হচ্ছে মৌলিক মানবিক ও নাগরিক অধিকার থেকে। কিছু বিহারীদের নাগরিকত্ব দেয়া হলেও তাদের চাকুরি নেয়া হয়না। এমন কি পাসপোর্টও দেয়া হয়না। ফলে তারা সুযোগ দেয়া হয় না জীবিকার সন্ধানে বিদেশে যাওয়ার।

দেশে মসজিদ-মাদ্রাসার বিপুল সংখ্যা বা ঘরের পাশে মসজিদ দেখে কি মানুষের ঈমান বুঝা যায়? ঈমান কি শুধু নামাজ-রোজায় ধরা পড়ে? বহু সূদখোর, ঘুষখোর, প্রতারকও তো নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করে। বরং ঈমান দেখা যায় অপর মুসলিমের প্রতি মানবিক ও ভাতৃত্বসুলভ আচরণ দেখে। ঈমানের সেটিই দৃশ্যমান রূপ। কিন্তু বিহারীদের প্রতি বাঙালি মুসলিমের সে মানবতা কোথায়? কোথায় সে ভাতৃত্ববোধ? চোখের সামনের আল্লাহর ঘর ক্বাবা দেখেও তো আরবের লোকেরা মূর্তিপূজারী কাফির হয়েছে। ফলে ঘরের পাশে মসজিদ বা মাদ্রাসা থাকলেই ঈমানদার হবে -সে নিশ্চয়তা কোথায়? মুজিব, জিয়া, এরশাদ, খালেদা, হাসিনা -কত জনই তো ক্ষমতায় এলো। কিন্তু এই হতভাগা বিহারীদের প্রতি কেউ সামান্যতম মানবিক আচরণও করিনি। বিহারীদের অপরাধ, একাত্তরে তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে সমর্থণ করেছিল। অথচ সেরূপ সমর্থণ তো লক্ষ লক্ষ বাঙালিরাও করেড়ছিল। সে বাঙালিদের ঘরবাড়ী কি কেড়ে নেয়া হয়েছে। বৈষম্য কি শুধু বিহারী হওয়ার জন্য? তাছাড়া ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তানকে বানিয়েছিল তো বাঙালি মুসলিমরাই। পাকিস্তানের নির্মাণ যদি দোষের না হয়, তবে দেশটি বাঁচানোর পক্ষে থাকা দোষের হবে কেন?

 

একাত্তরে নিহত ৩০ লাখ: বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার

বাংলাদেশীরা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা খেলাধুলায় ইতিহাস গড়তে ব্যর্থ না হলেও ইতিহাস গড়েছে বড় মাপের মিথ্যা রটনায়। সেরূপ একটি মিথ্যা হলো, ১৯৭১’য়ের ৯ মাসের যুদ্ধে পাক বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ বাঙালির মৃত্যুর। এ মিথ্যা বয়ানের পিতা হলো খোদ শেখ মুজিব। বাংলাদেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী, লেখক, আদালতের বিচারপতি, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাজ হয়েছে মুজিবের জন্ম দেয়া সে মিথ্যা বয়ানকে বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করা। অথচ মিথ্যা বলাই শুধু অপরাধ নয়, অপরাধ হলো মিথ্যার প্রচার করাও। এক্ষেত্রে মুজিব-অনুসারীদের সফলতাটি বিশাল। তারা দেশের বিপুল সংখ্যাক মানুষকে শুধু মিথ্যুকে পরিণত করেনি, মিথ্যার প্রচারকেও পরিণত করেছে। অথচ মিথ্যাই হলো সকল পাপে মা। অর্থাৎ যে মিথ্যাচারী, সে নানারূপ দুর্বৃত্তি তথা পাপের জন্ম দিয়ে বাঁচে। এমন দেশ তাই মিথ্যার প্লাবনে ভাসে। সে দেশ পাপে তথা দুর্বৃত্তিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ে। বাংলাদেশ তাই দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়েছে। তাই মুজিব যে মিথ্যার বীজ রোপ করেছিল, সে মিথ্যা গ্রাস করেছে সমগ্র দেশকে।  

তবে যে কোন দুর্বৃত্তির ন্যায় মিথ্যাচারীতারও প্রেক্ষপট থাকে। বাঙালি ফ্যাসিস্ট দুর্বৃত্তদের একাত্তরের অপরাধের তালিকাটি বিশাল। গুরুতর অপরাধটি যেমন পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহর অপূরণীয় ক্ষতিসাধন এবং সে সাথে বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নভঙ্গ, তেমনি পৌত্তলিক কাফির শক্তির ঘরে বিজয় তুলে দেয়া। খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ার পর বাঙালি মুসলিমগণই নেতৃত্ব দিয়েছিল বিশ্বের বুকে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র নির্মাণে। বাংলা প্রদেশ ছিল সমগ্র ভারতের বুকে মুসলিম লীগের একমাত্র ঘাঁটি।  লক্ষ্য ছিল, দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের জন্য স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করা এবং সে সাথে বিশ্বরাজনীতিতে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের প্রতিরক্ষায় ভূমিকা রাখা। কিন্তু ভারতসেবী বাঙালি ফ্যাসিস্টগণ সে স্বপ্নকে নস্যাৎ করে দেয় এবং বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করে।  মুসলিম উম্মাহ -বিশেষ করে বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে এটি হলো এক গুরুতর অপরাধ। সে অপরাধের সাথে ভারতসেবী বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার নেতা-কর্মীদের আরেক নৃশংস বর্বরতা হলো, তারা দুই লাখের বেশী বিহারী হত্যা, হাজার হাজার বিহারী মহিলাদের ধর্ষণ ও তাদের ঘর-বাড়ী, সম্পদ ও দোকানপাটের উপর ডাকাতি।

নিজেদের সে অপরাধ ও বর্বরতা ঢাকতে বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার নাস্তিকগণ বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের মজলুল রূপে জাহির করে। মজলুম রূপে প্রমাণ করতেই তারা পাক বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ নিহত ও ২ লাখ নারীর ধর্ষিত হওয়ার বানোয়াট কিচ্ছা বাজারে ছাড়ে। সে সাথে লুকানোর চেষ্টা করেছে নিজেদের নৃশংস ও বীভৎস বর্বরতাগুলিকে – শেখ হাসিনা যেমন লুকিয়েছে ২০১৩ সালে ৫ মে’র শাপলা চত্বরের নিষ্ঠুরতাকে। লক্ষণীয় হলো, তিরিশ লাখ বাঙালি নিহত হওয়ার দাবী করলেও তারা মৃতদের কোন তালিকা ও কবর পেশ করতে পারিনি। এবং দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকলেও নিহতদের সঠিক সংখ্যাটি খুঁজে বের করার জন্য কোন সার্ভে করেনি। এবং সে অনুসন্ধানে কোনরূপ আগ্রহ দেখায়নি। তবে সেরূপ আগ্রহ না থাকাটি বরং কাঙ্খিতও। কারণ, মিথ্যা রটনাকারীদের উদ্দেশ্য তো সত্যকে লুকানো, সত্য আবিষ্কারে এজন্যই তাদের আগ্রহ থাকে না। বরং তাদের চেষ্টা তো এক মিথ্যাকে লুকাতে হাজার মিথ্যার উৎপাদন। ফলে বাংলাদেশে প্লাবন এসেছে মিথ্যাচারীতার। তবে ৩০ লাখের সংখ্যাটি যে সম্পূর্ণ ভূয়া -সেটি বুঝার জন্য পণ্ডিত হওয়া লাগে না।  স্কুলের শিশুও সেটি বুঝতে পারে। তবে সেজন্য শর্ত হলো বেশী বেশী ভাবতে শেখা এবং বিবেককে জাগ্রত করা।  

ভেবে দেখা যাক, ৩০ লাখ নিহতের বিষয়টি নিয়ে। একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি অর্থাৎ ৭৫ মিলিয়ন।  তিরিশ লাখ নিহত হওয়ার অর্থ তিন মিলিয়ন নিহত হওয়া। এর অর্থ, প্রতি ২৫ জনে এক জনের মৃত্যু (৭৫/৩=২৫)। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনের মাঝে ৪ জনের মৃত্যু। অর্থাৎ যে গ্রামে ১ হাজার মানুষের বাস সেখানে মৃত্যু হতে হবে ৪০ জনের। তাছাড়া ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করতে হলে গড়ে প্রতিদিন ১১ হাজারের বেশী মানুষকে হত্যা করতে হয়। সেটি অবিশ্বাস্য। তখন বাংলাদেশ প্রায় ৬৮ হাজার গ্রাম ছিল। বাংলাদেশের শতকরা ৭৫ ভাগের বেশী মানুষ বাস করতো গ্রামে। ফলে ৩০ লাখ মানুষ মারতে হলে তো অবশ্যই গ্রামে যেতে হয়। অথচ সে গ্রামগুলি ছিল বিল, হাওর, নদীনালা দিয়ে বিচ্ছিন্ন। অনেক গ্রাম ছিল সাগরের দ্বীপে। সামরিক যানে এসব বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলিতে পৌঁছা অসম্ভব ছিল। তখন পূর্ব পাকিস্তানে পাক সেনাবাহিনীর মোট সৈন্য ছিল মাত্র ৪৫ হাজার। তাদের পক্ষে ৬৮ হাজার গ্রাম যাওয়া দূরে থাকে, ৯ মাসে ৫ হাজার গ্রামে যাওয়াও কি সম্ভব ছিল? তাছাড়া পাক সেনাবাহিনীর যুদ্ধ তো নিরস্ত্র গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে ছিল না। তাছাড়া মানুষ খুন করতে যদি তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে তবে সীমান্তে যুদ্ধ করলো কারা? অপর দিকে গ্রামে গ্রামে না ঘুরে যদি শুধু শহরগুলি থেকে ৩০ লাখ হত্যা করতো তবে তো ২৫ জনে এক জন নয়, প্রতি ১০ জনে এক জনকে বা তার চেয়েও উচ্চ হারে মানুষ হত্যা করতে হতো। প্রশ্ন হলো, দেশের কোন শহরের প্রতি ১০ জনের একজন কি নিহত হয়েছে? এরপরও কি বুঝতে বাকি থাকে, ৯ মাসে ৩০ লাখ নিহত হওয়ার দাবীটি কতটা মিথ্যা? অথচ সে মিথ্যাটি বহু মন্ত্রী, বহু সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক তথা নানা পেশার মানুষের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। বস্তুত বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মিথ্যাটি হলো একাত্তরে ৩০ লাখ নিহতের মিথ্যা।

মিথ্যা কথা বলতে বুদ্ধি-বিবেক লাগে না, কথা বলার সামর্থ্য থাকলেই চলে। একটি দেশে মূর্তিপূজারীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দেখে সহজেই বুঝা যায় দেশটি মূলত কাফিরদের। তেমনি একটি দেশে মিথ্যার বিপুল বিজয় দেখে বুঝা যায়, দেশটির মিথ্যাচারী মানুষটি ঈমানের দাবী করলেও সত্যিকার ঈমানদার নয়। ঈমানদার হলে তো সে মিথ্যাকে তারা দাফন করতো। গায়ে জ্বর উঠলে বুঝা যায় তার দেহে নিশ্চিত ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া বা টাইফয়েডের জীবাণু ঢুকেছে। তেমনি কাউকে মিথ্যা বলতে দেখে বুঝা যায় ব্যক্তিটির চিত্তে নিশ্চিত বেঈমানী ঢুকেছে। কারণ ঈমান থাকলে সে কখনোই মিথ্যা বলতো না। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মাপের মিথ্যাবাদী ও মিথ্যার প্রচারক যে শেখ মুজিব ও তার অনুসারীরা -তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ থাকে? গুরুতর অপরাধ তো মিথ্যার  প্রচারক হওয়া। কোন ঈমানদার ব্যক্তি কি সে অপরাধীকে সম্মান দেখাতে পারে? সম্মান দেখালে কি তার ঈমান থাকে? এখন এটি সুস্পষ্ট, ইসলামশূণ্য ও মানবতাশূণ্য বাঙালি ফ্যাসিস্টরা বাঙালি জনগণের বিবেক হত্যার কাজটি অতি ভয়ানক ভাবেই করতে পেরেছে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ বস্তিবাসী বিহারীরা বিশ্ববাসীর সামনে প্রতি দিন তুলে ধরছে। বাঙালি মুসলিমের এ বিবেকহীনতা নিয়ে শত শত বছর পরও দেশে দেশে বিচার বসবে। সে সাথে ধিক্কারও উঠবে -যেমনটি উঠছে জার্মান ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে।  কারণ পাপীরা মারা যায়, কিন্তু তাদের পাপগুলি ঘৃণা নিয়ে ইতিহাসে যুগ যুগ বেঁচে থাকে।

 

মুজিবের যুদ্ধাপরাধ

যুদ্ধ মাত্রই মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে আনে। তাই যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াই শুধু অপরাধ নয়, রক্তাক্ত একটি যুদ্ধ ডেকে আনাও গুরুতর যুদ্ধাপরাধ। শেখ মুজিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেরূপ একটি রক্তাক্ত যুদ্ধ ডেকে এনেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের নামে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানীরা যে স্বাধীনতা ১৯৪৭ সালে পেয়েছিল, সেরূপ স্বাধীনতা ১৯৭১’য়ে পায়নি। অন্ততঃ ১৯৪৭’য়ে পূর্ব পাকিস্তানে কোন বিদেশী সৈন্য ছিল না। অথচ আড়াই  লক্ষের ভারতীয় সৈন্যের পদচারণা দেখা গেছে ১৯৭১য়ে। তাই বাংলাদেশ কার্যতঃ সেদিন ভারত দ্বারা সামরিক ভাবে অধিকৃত হয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে সেদিন ব্যাপক লুণ্ঠনও হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ভারতীয় লুণ্ঠনজনীত দুর্ভিক্ষও সেদিন দেখা গেছে। তাই স্বাধীনতা যুদ্ধের নামে শেখ মুজিব ও তার সহযোগীরা যে যুদ্ধকে অনিবার্য করলো সেটি শুধু পাকিস্তানকেই খণ্ডিত করেনি, বহু লক্ষ মানুষের জীবনে মৃত্যুও ডেকে এনেছিল। তাই দুর্ভিক্ষে ১৫ লক্ষ বাংলাদেশীর মৃত্যু থেকে মুজিব নিষ্কৃতি পায় কিরূপে?

ঘরের শত্রুদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে এতো বড় যুদ্ধ করতে হবে -সেটি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ভাবতেও পারিনি।। সেটি বুঝা যায় যুদ্ধের জন্য পাক সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি না দেখে। যুদ্ধের প্রস্তুতি থাকলে একাত্তরের মার্চে কি তারা মাত্র এক ডিভিশন তথা ১১ হাজার সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে রাখতো? পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ সৈন্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বৈষম্য ও গাদ্দারী। সেদিন ৬ বা ৭ ডিভিশন সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে থাকলে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে সাহস পেতনা। পাক বাহিনীর ১১ হাজার সৈন্যকে পরাস্ত করাটি পুলিশ, বিডিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বহু হাজার সৈনিকের পক্ষে অতি সহজ হবে জেনেই মেজর জিয়া সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল।

মুজিব ও তার অনুসারীগণ একাত্তরের যুদ্ধকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলেছে। অথচ একাত্তরের মূল যুদ্ধটি লড়েছে ভারত। ভারত সে যুদ্ধে আড়াই লক্ষ সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলা করেছিল। ফলে সে যুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ থাকেনি; পরিণত হয়েছিল পাক-ভারত যুদ্ধে। এজন্যই পাকবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজী একমাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করেছিল, মুক্তি বাহিনীর কমাণ্ডার কর্নেল ওসমানী তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। তাকে side show তেও রাখা হয়নি।

মুজিব ও তার অনুসারীদের গুরুতর অপরাধ হলো, তারা ভারতের ন্যায় চিহ্নিত শত্রু শক্তিকে পূর্ব পাকিস্তানে ডেকে এনেছিল। তারা খাল কেটি কুমির এনেছিল। মীর জাফর একই অপরাধ করেছিল পলাশীর ময়দানে ইংরেজদের ডেকে এনে ও তাদেরকে বিজয়ী করে। বাংলার স্বাধীনতা এভাবেই সেদিন অস্তমিত হয়েছিল। বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা দ্বিতীয়বার অস্তমিত হয় ১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসে এ দিনটি কলংকিত। কারণ, এ দিনটিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের উপর পৌত্তলিক কাফির শক্তির বিজয় কেতন উড়েছিল। এ কলংক বেঁচে থাকবে ক্বিয়ামত অবধি। বাঙালি মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, তারা ব্যর্থ হয়েছিল মুসলিম ভূমিতে কাফির শক্তির বিজয় রুখতে। ক্বিয়ামত অবধি ধিক্কার উঠবে বাঙালি মুসলিমের এ ব্যর্থতা নিয়ে। রোজ হাশরের বিচার দিনে কাফিরদের বিজয়ী করার অপরাধে শেখ মুজিব, বাঙালি ফ্যাসিস্ট, বাম নেতাকর্মী  ও মুক্তিবাহিনীকে আসামীর কাটগড়ায় দাঁড়াতে হবে।   

হিংস্র নেকড়েকে চিনতে এমন কি শিশুও ভূল করে না। তাই প্রাণ বাঁচার বাহানায় কেউ নেকড়ের কাছে আশ্রয় নেয় না। নেকড়েকে দাওয়াতও করে না। অথচ শেখ মুজিব সেটিই করেছে। ভারতের আগ্রাসী চরিত্র বুঝতে ইতিহাসের শিশু ছাত্রেরও ভূল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মুজিব ও তার অনুসারী ভূল করেছে। কারণ তারা শুধু ঈমানশুণ্যই ছিল না, বোধশূণ্যও ছিল। ইতিহাস বার বার বলে, ভারত কাউকে স্বাধীনতা দেয় না, বরং ছিনিয়ে নেয়। তাই স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে কাশ্মীর, হায়দারাবাদ, গোয়া, মানভাদাড় ও সিকিমের। ভারত একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানকেও দখলে নিয়েছিল। অথচ বিস্ময়ের বিষয় হলো, একাত্তরের ভারতীয় অধিকৃতিকেই মুজিব ও তার অনুসারী স্বাধীনতা বলেছে। ফলে তারা জড়িয়ে ধরেছে ভারতের ন্যায় নেকড়ে চরিত্রের একটি রাষ্ট্রকে। অথচ বাংলাদেশে লুণ্ঠন করা এবং দেশটিকে অধিকৃত করদ রাজ্য বানানো ছাড়া ভারতের আর কোন লক্ষ্যই ছিলনা। ক্ষমতালোভী মুজিব প্রচণ্ড মিথ্যাচার করেছে ১৯৪৭ সালে অর্জিত স্বাধীনতাকে পরাধীনতা বলে। কথা হলো, যে পাকিস্তানের দুইজন রাষ্ট্রপতি, তিনি জন প্রধানমন্ত্রী, বহু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, তিনজন স্পীকার এবং কয়েকজন প্রধান বিচারপতি বাঙালি ছিলেন -সে পাকিস্তানকে কি ঔপনিবেশিক বলা যায়? কোন বিবেকবান মানুষ কি সে তত্ত্ব মেনে নেয়? সে কাজ তো বিবেকশূণ্য ভারতীয় সেবাদাসদের!  

১৯৭১’য়ে ১৬ ডিসেম্বরের পর পাকিস্তান আর্মির হাজার হাজার কোটি টাকার অব্যবহৃত সকল ট্যাংক, কামান, মেশিনগান, গোলাবারুদ, সামরিক যানবাহন ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারতে নিয়ে যায়। সে অস্ত্রের উপর ন্যায্য হক তো বাংলাদেশের। বিস্ময়ের বিষয় হলো, মুজিব, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া ও হাসিনার সরকারের কেউই ভারতের  কাছে বাংলাদেশের সে ন্যায্য পাওনাটা ফেরত দেয়ার দাবী করেনি। ভারতের প্রতি সে দাসসুলভ আচরণ যেমন মুজিবের রাজনীতিতে দেখা গেছে, তেমনি দেখা গেছে পরবর্তী শাসকদের রাজনীতিতেও। ভারতকে দেয়া নিয়েই মুজিব ও হাসিনার আনন্দ। তাই পদ্মা, তিস্তাসহ সকল নদীর পানি দিয়েছে, বাজার দিয়েছে, করিডোর ও বন্দরের সুবিধাও দিয়েছে। এ থেকে বুঝা বাংলার স্বাধীনতা বলতে মুজিব-হাসিনা ও তাদের অনুসারীরা কি বুঝতো।

 

অপরাধ সত্য গোপনের

বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার লোকেদের অতি বড় অপরাধ হলো সত্য গোপনের। তারা পাকিস্তানী আমলকে বলে থাকে বাঙালির উপর পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন। প্রশ্ন হলো, ঔপনিবেশিক শাসন বলতে কি বুঝায় -সেটি কি তারা জানে? অথচ ইতিহাসের বহু সত্য কথা তারা ইচ্ছা করেই বলে না। তারা একথা কখনোই বলে না যে, পাকিস্তানের মোট রাজস্বের মাত্র শতকরা ২৬ ভাগ দিত পূর্ব পাকিস্তানীরা। অথচ পাকিস্তানে চতুর্থ পাঁচশালা পরিকল্পনার বাজেটের শতকরা ৬০ভাগ বরাদ্দ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। তৃতীয় ৫ সালা পরিকল্পনায় বরাদ্দ ছিল বাজেটের শতকরা ৫৩ ভাগ। দ্বিতীয় ৫ সালা পরিকল্পনায় বরাদ্দ ছিল বাজেটের শতকরা ৫০ ভাগ।  মিথ্যাচারের তো একটা সীমা আছে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার নেতা-কর্মীদের মিথ্যাচারের কোন সীমা-সরহাদ নাই। মিথ্যাই এদের রাজনীতির মূল পুঁজি।  মিথ্যা দিয়ে ভারতীয় হিন্দু পুরোহিতরা যেমন জনগণকে মূর্তিপূজারী, লিঙ্গ পূজারী ও গবরভোজী বানিয়েছে, বাঙালি ফ্যাসিস্টরা তেমন পাকিস্তান বিরোধী বানিয়েছে।   

দেশের নানা শহরে বিহারীদের বসবাস ১৯৪৭ থেকেই। কিন্তু তাদের হাতে কি একজন বাঙালি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ -এই ২৩ বছরে নিহত হয়েছে বা ধর্ষিতা হয়েছে? হয়নি। কিন্তু সে ইতিহাস তারা বলে না। একই কথা বলা যায় সেনাবাহিনীর ব্যাপারে। সেনানীবাসগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বসবাস ১৯৪৭ থেকেই। কিন্তু তাদের হাতে কি একজন বাঙালি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ -এই ২৩ বছরে নিহত হয়েছে বা ধর্ষিতা হয়েছে? হয়নি। এ সত্যাটিও পাকিস্তানের শত্রু পক্ষ কখনো বলে না। অভিযোগ করা হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে বৈষম্য নিয়ে। প্রশ্ন হলো, বৈষম্য কি পাকিস্তান সৃষ্ট করেছিল? বৈষম্য তো ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকেই ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিনেই পশ্চিম পাকিস্তানে লাহোর, করাচী, পেশোয়ার ও কোয়েটা -এ তিনটি প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ার মত বদ বড় শহর ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সেরূপ শহর একটিও ছিল না। ঢাকা তখনও জেলা শহর। রাতারাতি তো পূর্ব পাকিস্তানে লাহোর, করাচী, পেশোয়ার ও কোয়েটার ন্যায় রাজধানী শহর গড়া সম্ভব ছিল না। লাহোর গড়ে উঠেছিল মোঘল আমলে; শহরটি এক সময় রাজধানী শহর ছিল। ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে বড় ক্যান্টমেন্ট শহর ছিল রাওয়ালপিণ্ডি। ব্রিটিশ আমল থেকেই বিখ্যাত ছিল কোয়েটা মিলিটারি স্টাফ কলেজ। বাঙালি মুসলিমদের মাঝে একজন ICS (Indian Civil Service) অফিসার ছিল না। অথচ ভারতের অবাঙালি মুসলিমদের মাঝে ছিল শতাধিক। তারা সবই পশ্চিম পাকিস্তানে যায়। প্রশাসনিক ক্যাডারে তো এভাবেই বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এজন্য কি পাকিস্তানকে দায়ী করা যায়? বাঙালিদের মাঝে কোন শিল্পপতি ছিলনা। অথচ ভারত জুড়ে বহু মুসলিম শিল্পপতি ছিল। যেমন আদমজী, বাওয়ানী, দাউদ, সায়গল ইত্যাদি। তারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানে যায়। একমাত্র ইস্পাহানী কোম্পানি পূর্ব পাকিস্তানে আসে। এ বৈষম্য কি পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল?

বিশাল বৈষম্য ছিল সেনাবাহিনীতে। সেটিও ব্রিটিশ আমল থেকে। বাঙালি মুসলিমদের মাঝে মেজরের উপর কোন সামরিক অফিসার ছিলনা, কিন্তু অবাঙালিদের মাঝে বহু কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার, জেনারেল ছিল। পাকিস্তান সরকার তো ২৩ বছরে বৈষম্য কমিয়ে এনেছিল। কয়েকজন বাঙালি অফিসারকে বৈষম্যমূলক বাড়তি প্রমোশন দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব পদে উন্নিত করা হয়েছিল। বেশ কয়েকজন ব্রিগেডিয়ার এবং একজন জেনারেল পদে উন্নিত হয়েছিলেন। কাউকে তো রাতারাতি জেনারেল বা সচিব করা যায়না। এর জন্য সময় লাগে, নির্দিষ্ট মেয়াদের চাকুরির অভিজ্ঞতা লাগে।

১৯৪৭’য়ের পর থেকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে বিরাজমান বৈষম্য কমতে শুরু করেছিল। পাকিস্তান বেঁচে গেলে হয়তো পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে অধিক এগিয়ে যেত। তখন পূর্ব পাকিস্তানের পণ্য পেত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্রের বিশাল বাজার। সে পারমানবিক রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে বাঙালি মুসলিমগণ পেত বিশ্বের দরবারে সম্মানজনক পরিচিতি। পেত বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ। কিন্তু পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে হারিয়ে গেছে সেসব স্বপ্ন। এখন প্রতিটি দিন ও প্রতিটি রাত বাঁচতে হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী ভারতের ভয় নিয়ে। ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্র হওয়ার এই তো বিপদ। বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে এটিই হলো বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারায় ভেসে যাওয়া অপরাধী লোকদের সবচেয়ে বড় নাশকতা। ১৯/০৪/২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *