মায়ানমারে পরিকল্পিত রোহিঙ্গা নির্মূল
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on November 17, 2018
- Bangla বাংলা, আর্ন্তজাতিক
- No Comments.
নির্মূল-প্রক্রিয়া পৌঁছেছে চুড়ান্ত পর্যায়ে
রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মায়ানমার সরকারের জিনোসাইড বা গণহত্যাটি কোন সাম্প্রতিক নৃশংসতা নয়। সেটি চলছে তিন দশকের বেশী কাল ধরে, এবং সুপরিকল্পিত এক ব্লু-প্রিন্টের অংশ রূপে। সম্প্রতি সেটি পৌঁছেছে তার চুড়ান্ত পর্যায়ে। বিশ্বের শক্তিবর্গ এ ঘৃন্যতম জিনোসাইডকে বন্ধ করা দুরে থাক, নিন্দা করতেও ব্যর্থ হয়েছে। সেটিই প্রকাণ্ড ভাবে ধরা পড়েছে গত ২৮ই সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে। সে বৈঠকটি কোনরূপ সিদ্ধান্ত ও মায়ানমারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব ছাড়াই শেষ হয়েছে। উক্ত বৈঠকে রোহিঙ্গাদের উপর হামলা ও তাদের নির্মূলের জন্য রাশিয়ার প্রতিনিধি মায়ানমারের সেনা চৌকির উপর রোহিঙ্গা আরাকান সালভেশন আর্মির হামলাকে দায়ী করেছে; এবং সমর্থন করেছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মায়ানমার সরকারের সকল নৃশংসতাকে। সমর্থন জানিয়েছে চীনও। এহেন নব্য ফাসিস্টদের সমর্থন করছে ভারত ও জাপানের মত দেশগুলিও -গণতন্ত্র নিয়ে যাদের প্রচণ্ড গর্ব। বিশ্বের প্রধান প্রধান শক্তিগুলি যে কতটা হৃদয়হীন, নীতিহীন ও নৈতীকতা শূণ্য -এ হলো তারই প্রমাণ। এরূপ নৈতীক শূণ্যতার কারণেই অতীতে এরা দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ভয়ানক গণহত্যা ও বর্ণবাদী নির্মূল উপহার দিয়েছে।
কোন ব্যক্তির বর্বরতা ও বিবেকহীনতা শুধু তারা কর্মের মধ্যে ধরা পড়ে না। ধরা পড়ে, অন্যের দুর্বৃত্তি ও বর্বরতাকে সমর্থণ করার মধ্য দিয়েও। তাই মায়ানমার সরকারের নৃশংসক বর্বরতার প্রতি সমর্থনের কারণে রাশিয়া, চীন ও ভারতীয় শাসক মহলের নিজস্ব নৃশংস রূপটিও আর গোপন থাকেনি । তাছাড়া অধিকৃত মুসলিম ভূমিতে তাদের নিজেদের নৃশংসতাটিও কি কম? প্রেসিডেন্ট পুটিনের হাত রক্তাক্ত চেচেন ও দাগিস্তানী মুসলিমদের রক্তে। আশির দশকে আফগানিস্তান এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে চেচনিয়ায় প্রচণ্ড ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর রাশিয়ার যুদ্ধ বিমানগুলি এখন হত্যা ও ধ্বংস-যজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে সিরিয়ার শহরগুলিতে। অপরদিকে চীন নিষ্ঠুর বর্বরতা চালাচ্ছে অধিকৃত জিনজিয়াংয়ে উইগুর মুসলিমদের উপর। তাদের মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ, ইবাদত-বন্দেগী ও কোরআন শিক্ষার উপরও চাপানো হয়েছে কঠোর বিধি-নিষেধ। বিগত ৭০ বছর যাবৎ কাশ্মীরে চলছে ভারতীয় অধিকৃতি এবং সে সাথে ভারতীয় সেনা বাহিনীর পক্ষ থেকে হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের যাঁতাকল। কোন অপরাধকে নিন্দা করার জন্য যা অপরিহার্য তা হলো নৈতীক বল। প্রশ্ন হলো, নিজ দেশে যারা মুসলিম-হত্যা ও নির্যাতনের সাথে জড়িত, তারা কি অন্যদেশের -বিশেষ করে মায়ানমার সরকারের জেনোসাইডকে নিন্দা করার নৈতীক বল রাখে? সম্প্রতি বৃহৎ শক্তিবর্গের নৈতীক বলের সে শূণ্যতাটিই প্রকট ভাবে ধরা পড়লো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে। ,
রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলমান কয়েক দশকের নৃশংস নিষ্ঠুরতা্য় তাদের জনসংখ্য দ্রুত কমেছে। ১৯৫২ সালে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ১২ লাখ। (সূত্রঃ জেনোসাইড ইন মায়ানমার, লন্ডনের কুইন মেরী ইউনিভার্সিটির গবেষণা।) ১৯৫২ সাল থেকে ২০১৭ সাল এ দীর্ঘ ৬৫ বছরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ন্যায় প্রতিটি মুসলিম দেশের জনসংখ্যা তিন থেকে চার গুণ বেড়েছে। কিন্তু কি বিস্ময়! বিগত ৬৫ বছরেও রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংখ্যা বাড়েনি, বরং দারুন ভাবে কমছে। ২০১৭ সালে এসে এখন বলা হচ্ছে তাদের সংখ্যা ১.১ মিলিয়ন তথা ১১লাখ। তাদের বিরুদ্ধে সরকার পবরিচালিত নির্মূল প্রক্রিয়া যে কত্টা সফল এ হলো তারই দলিল। নইলে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিশ্চিত ৩৬ লাখে পৌঁছতো। ফল দাঁড়িয়েছে, মুসলিম সংগরিষ্ঠ আরাকান বা রাখাইন এখন বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পরিণত হয়েছে। জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই এখন বৌদ্ধ। তবে নির্মূল-কর্ম এখন যেরূপ গতি পেয়েছে তাতে অচিরেই একটি আরাকান মুসলিম-শূণ্য এলাকায় পরিণত হবে। রোহিঙ্গা নির্মূল প্রক্রিয়াটি যে শধু গণহত্যার মাধ্যমে চলছে তা নয়। সেটি চলছে আরো কয়েকটি পথে। রোহিঙ্গাদের সংখ্যা যাতে না বাড়ে সে জন্য সরকা্রের পক্ষ থেকে চাপানো হয়েছে বিবাহের উপর নিয়ন্ত্রণ। বিবাহিতদের বাধ্য করা হচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে। অপরাধ হলো, দু’টির অধীক শিশু জন্ম দেয়াকে। সে সাথে বাধ্য করা হচ্ছে দেশত্যাগে। সুদুর সৌদি আরবেই বসবাস করছে দেড় লাখ। তারা সেখানে গিয়েছিল ষাটের দশকে। লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বাস মালয়েশিয়া।
জন্মহার কমানোর সাথে মায়ানমার সরকারের লক্ষ্য হলো মৃত্যুহার বাড়ানো। তাই রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষদের বঞ্চিত করা হচ্ছে চিকিৎসা-সেবা থেকে। মায়ানমারের কোন হাসপাতালে তাদের প্রবেশাধীকার নাই। ফলে তাদের মাঝে মৃত্যুর হার, বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যুর হার, মায়ানমারের অন্যান্য এলাকা থেকে অধীক। হাসপাতালের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখার পাশাপাশি তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে শিক্ষা থেকেও। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা দূরে থাক, রোহিঙ্গা মুসলিমগণ বঞ্চিত হচ্ছে এমন কি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকেও। সম্ভবতঃ তাদের ধারণা, দিন দিন দুর্বল হয়ে নির্মূল হওয়ার পথটি যাদের জন্য সরকারি নির্দিষ্ট তাদের আবার চাকুরি-বাকুরি, শিক্ষা ও চিকিৎসা-সেবার প্রয়োজন কি? লন্ডনের কুইন মেরী ইউনিভার্সিটির গবেষণায় প্রমাণ মেলেছে, আরাকানে মুসলিম নির্মূলকরণ প্রকল্প যেভাবে এ অবধি কার্যকর করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে তা মূলতঃ ৬টি পরিকল্পিত স্তরে। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ফায়ারস্টাইনের মতে প্রতিদেশে এটিই হলো জেনাসাইডের সনাতন পদ্ধতি। ৫টি স্তর পাড়ি দিয়ে মায়ানমারে সেটি পৌঁছেছে এখন সর্বশেষ স্তরে। সে স্তরগুলির বিবরণ হলো নিম্নরূপঃ
প্রথম স্তর: স্টিগমাটাইজেশন
যে কোন দেশে জেনোসা্ইড বা গণনির্মূলকরণ প্রকল্পের এটিই হলো প্রথম ধাপ। এ স্তরটিতে টার্গেট জনগোষ্টিকে নানা ভাবে ডি-হিউম্যানাইজড ও দেশের সকল ব্যর্থতার জন্য বলির পাঠা বানানো হয়। যেমন জার্মানীর সকল পরাজয় ও ব্যর্থতার জন্য হিটলার ইহুদীদের দায়ী করতো। একই অবস্থা মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসিলমদের। তাদের গায়ে ইচ্ছামত সর্বপ্রকার অপবাদ লেপন করা হচ্ছে। তাদেরকে চিত্রিত করা হচ্ছে কালো, কালার, কুৎসিত ও বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারি রূপে। পথে ঘাটে গরু-ছাগলের গলায় ছুরি চালালে তার বিরুদ্ধে কোন জনপদেই প্রতিবাদ উঠে না। কারণ, যাদের হত্যা করা হচ্ছে তারা তো পশু। তেমনি কাউকে মানব থেকে মানবেতর স্তরে নামাতে পারলে তাদের নির্মূলের বিরুদ্ধেও কেউ প্রতিবাদ করে না। তারা যে নির্মূলযোগ্য ও হত্যাযোগ্য সেটিই তখন সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। সে কাজটিই অতি পরিকল্পিত ভাবে হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে। অতীতে জার্মান থেকে ইহুদী, আমেরিকা থেকে রেড ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়া থেকে অ্যাবঅরিজিন এবং বসনিয়া থেকে মুসলিমদের নির্মূলের লক্ষ্যে তাদেরকেও এরূপ মানবেতর এক ঘৃণীত জীব রূপে চিত্রিত করা হয়েছিল। ডি-হিউম্যানাইজেশনের এ স্তরটি অতিক্রান্ত হলেই রাজনৈতীক দলের ক্যাডার, দেশের পুলিশ, সেনাসদস্য, সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তা, বিচার বিভাগের বিচারকগণও তখন নিজ নিজ ক্ষমতা নিয়ে নির্মূলের কাজে লেগে যায়। ১৯৭১য়ে তেমন একটি জঘন্য প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছিল বাংলাদেশে বসবাসকারি কয়েক লক্ষ অবাঙালী নারী, পুরুষ ও শিশু। ফলে অবাঙালী হত্যা, অবাঙালী নারী ধর্ষণ এবং তাদেরকে নিজ নিজ ঘর থেকে উৎখাত করে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ, রাজনৈতীক নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝে কোন রূপ প্রতিবাদ উঠেনি। গণহত্যার নায়কগণ প্রতিদেশেই এভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর আগে বিবেকের মৃত্যু ঘটায়। বাংলাদেশে তেমন একটি প্রক্রিয়া এখনও সুপরিকল্পিত ভাবে চলছে তাদের বিরুদ্ধে যারা একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। সেটি গভীর হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে দেয়া রায়কে আরো কঠোরতর করতে বাধ্য হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকগণও। বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামপন্থিদের নির্মূলে এ হলো ভারত ও ভারতীয় অর্থে প্রতিপালিত ইসলামের শত্রুপক্ষের অতি সুপরিচিত কৌশল। মায়ানমারে তেমন একটি নির্মূলমুখি পদ্ধতির শিকার হলো রোহিঙ্গা মুসলিমগণ।
দ্বিতীয় স্তর: হয়রানি,সহিংসতা ও সন্ত্রাস
যখন কোন সরকার একটি জনগোষ্ঠির নির্মূল চায়, তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের কর্মকে শুধু ঘৃণা সৃষ্টির মধ্যে সীমিত রাখে না। সেগুলি আরো সহিংস ও আরো বর্বরতর করে। তখন রাজনৈতীক দলের ক্যাডার, সরকারি প্রতিষ্ঠান সমুহ ও সরকারি কর্মচারিগণ পরিণত হয় তাদের বিরুদ্ধে নানারূপ হয়রানি, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের প্রচণ্ড হাতিয়ারে। তখন সরকারেরর সহয়তায় সে জনগোষ্ঠির নির্মূলের দাবি নিয়ে শহরে শহরে নির্মূল কমিটি গড়ে উঠে এবং তারা নির্মূলে সহিংস পথেও নামে –যেমনটি একাত্তরে বাংলাদেশে বিহারীদের বিরুদ্ধে নেমেছিল। মায়ানমারে আজ যে বার্মীজ জাতীয়তাবাদীগণ রোহিঙ্গাদের নির্মূলে নেমেছে তারাদের জন্ম ও বেড়ে উঠাটিও মূলত বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের ন্যায় একই রূপ সহিংস চেতনা নিয়ে। ফলে তারা আদর্শিক সহোদর হলো বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের। একারণেই বার্মীজ সরকার যখন রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলি একের পর জ্বালিয়ে দিতে ব্যস্ত, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সেটি নিন্দনীয় গণ্য হয়নি। তিনি সেটিকে নিন্দা করে কোন বিবৃতিও দেননি। বরং নিজের খাদ্যমন্ত্রীকে মায়ানমারে পাঠিয়েছিলেন সেখান থেকে চাউল কিনতে। এবং মায়ানমার সরকারকে প্রতিশ্রুতি দেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষ থেকে কোন সশস্ত্র লড়াই শুরু হলে বা্ংলাদেশের সেনাবাহিনী সেদেশের সরকারের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে লড়বে। মায়ানমার সরকারের এরূপ মুসলিম-নির্মূল নীতির প্রতি গভীর আশির্বাদ রয়েছে ভারত সরকারেরও। সেটি জানাতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছুটে যান মায়ানমারে। এবং ঘোষণা দেন, মুসলিমদের বিরুদ্ধে সকল নির্মূল কর্মে ভারত সরকার মায়ানমার সরকারের পাশে থাকবে। সম্প্রতি প্রচণ্ড মুসলিম বিদ্বেষী ভারতীয় সংগঠন আর. এস. এস.য়ের নেতাগণও মায়ানমারে ছুটেছিল একই কথা জানাতে।
মায়ানমারে রোহিঙ্গা-নির্মূলকামী সংগঠনগুলোর সংখ্যা অনেক। তবে তাদের মধ্যে প্রধান হলো ‘মা বা থা’ এবং ‘৯৬৯ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট’। রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলা হোক -তাতেও এসব সংগঠনের প্রচণ্ড আপত্তি। তাদের দাবি, রোহিঙ্গা বলে মায়ানমারে কোন জনগোষ্ঠি নাই। যারা আছে তারা হলো বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালী। অতএব দাবী, তাদের একমাত্র বাঙালীই বলতে হবে এবং বাংলাদেশেই তাদের ফিরে যেতে হবে। যেমন বাংলাদেশের নির্মূল কমিটির দাবি, সকল অবাঙালীদের পাকিস্তানে চলে যেতে হবে। জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন যখন তার বক্তৃতায় রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধেও এরা বিক্ষোভ করেছিল। রোহিঙ্গাদের এ ভয়াবহ বিপদ কালে তারা জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রীও রোহিঙ্গা গ্রামে পৌঁছতে বাধা দিচ্ছে। বাধা দিচ্ছে, বিদেশী কোন সাংবাদিককে ঢুকতেও। রোহিঙ্গা সমাস্যার সমাধান খুঁজতে জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনান যখন মায়ানমারে যান, তাঁর বিরুদ্ধেও তারা মিছিল করেছিল। মায়ানমারে ১৩০টির বেশী জাতিসত্ত্বা আছে। কিন্তু স্বীকৃতি নাই রোহিঙ্গাদের। শত শত বছর সে দেশে বসবাস করলে কি হবে, আইন করে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে। চিত্রিত হয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারি রূপে। তাদের দাবী, এ অবৈধদের থেকে তাদের বসত ভিটা্, ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি-জমা, চাকুরি-বাকুড়ি ছিনিয়ে নেয়া হোক। ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সেটি কার্যকরও করা হয়েছে।
তৃতীয় স্তর: আইসোলেশন ও পৃথকীকরণ
জাতিগত নির্মূলের এ হলো তৃতীয় পর্যায়। যতদিন পর্যন্ত সম্পূর্ণ নির্মূল বা দেশত্যাগে বাধ্য করার সুযোগ সৃষ্টি না করা যায়, ততদিন পর্যন্ত তাদের পলিসি হলো, চিহ্নিত জনগোষ্ঠিকে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি থেকে পৃথক করা। হিটলার সে লক্ষ্যেই ইহুদীর জন্য গড়েছিল কনসেন্ট্রেশন কাম্প। গ্যাস চেম্বার নিয়ে হত্যা করার পূর্ব পর্যন্ত সে ক্যাম্পগুলোর নানা রূপ কষ্ট, অপুষ্টি ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জন্য নিহত হওয়ার জন্য তাদেরকে প্রস্তুত করা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে একই নীতির প্রয়োগ করা হয় অবাঙালীদেরকে বিরুদ্ধে। তাদেরকে নিজ নিজ ঘর-বাড়ী থেকে উঠিয়ে মহম্মদপুরের জেনেভা কাম্পের ন্যায় কনসেন্ট্রেশন কাম্পগুলোতে নিয়ে যায়। তেমনি মিয়ানমারেও রোহিঙ্গাদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বহু কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। এরূপ নতুন নতুন ক্যাম্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে অথবা বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার জন্য কয়েক বছর পর পরই রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর ঘরবাড়িতে আগুণ দেয়া হয়। এবং সেসব ক্যাম্প ঘিরে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর ফাঁড়ি বসানো হয় যাতে সে ক্যাম্পের বন্দিদশা থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমগণ বাইরে আসতে না পারে বা কোথাও গিয়ে আবার যেন কোন আবাদী গড়ে না তুলে।
এরূপ আইসোলেশন বা পৃথকীকরণ হলো মানুষকে শক্তিহীন করার সফল প্রক্রিয়া। সংঘবদ্ধতা ও সমাজবদ্ধতার মধ্যেই একটি জনগোষ্ঠির শক্তি। আইসোলেশন বা পৃথককরণের মধ্য দিয়ে একটি জনগোষ্ঠির পারস্পারিক সংযোগ বিলীন করা হয়। এভাবে তাদের দুর্বল করা হয়। দেশের সামাজিক, রাজনৈতীক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শের অঙ্গণ থেকে তাদেরকে জোরপূর্বক বিচ্ছন্ন করা হয়। একারণে বস্তুবাসী রোহিঙ্গা মুসলিমগণ আজ নেতাশূণ্য ও সংগঠনশূণ্য। কোন মুসলিম সমাজে সংঘবদ্ধতা ও সমাজবদ্ধতা গড়ে তোলার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হলো মসজিদ। এটিই ইসলামের সনাতন সামাজিক ইন্সটিটিউশন। জমিনের উপর এটিই মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিষ্ঠান। সেটি ইসলাম ও মুসলিমের শত্রুদের অজানা নয়। ফলে প্রতিদেশেই ইসলামের শত্রুপক্ষ শুধু রাষ্ট্রের দখলদারিই হাতে নেয় না, দখলদারি প্রতিষ্ঠা করে এবং পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করে দেশের মসজিদগুলিও। রাশিয়া ও চীনে তাই হাজার হাজার মসজিদকে কম্যুনিষ্টগণ আস্তাবল বানিয়েছিল। একই ভাবে মায়ানমারে শত শত মসজিদকে ধ্বংস করা হয়েছে, অথবা সেগুলির দরজায় তালা লাগানো হয়েছে। মুসলিম নির্মূলকামী ‘মা বা থা’ এবং ‘৯৬৯ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট’এর নেতাগণ মসজিদকে বলে মুসলিমদের দুর্গ। তাই মসজিদকে তারা যেমন নিজেরা ধ্বংস করে, তেমনি সরকারেরর কাছেও দাবী করে সেগুলো দ্রুত বন্ধ করে দেয়ার। কোন চায়ের দোকানে বেশী মুসলিম জড়ো হলে তদন্ত শুরু হয়, সেটি মসজিদ কিনা।
চতুর্থ স্তর: পরিকল্পিত ও পর্যায়ক্রমীক দুর্বলীকরণ
রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্মূল করণে যে রোডম্যাপটি হুবহু অনুসরণ করা হচ্ছে তার একটি নৃশংস পর্যায় হলো, টার্গেট করে ক্রমান্বয়ে তাদেরকে দৈহীক, নৈতীক, অর্থনৈতীক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে দুর্বল ও নির্জীব করা। এজন্য তারা যেমন তাদেরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ঠাসাঠাসী করে জড়ো করে, তেমনি ক্যাম্পে রেখে তাদেরকে আলো-বাতাস, শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্মকর্ম, রাজনীতি, সমাজকর্ম ও পরস্পরে মেলামেশার ন্যায় অপরিহার্য বিষয়গুলো থেকেও বঞ্চিত করে। সে সাথে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় লাগাতর অপমান, অবমাননা, ও নির্যাতন। পরিকল্পিত ভাবে অপুষ্টি, মহামারি ও চিকিৎসাহীনতা তাদের জন্য নিত্য সহচর করা হয়। যেসব রোহিঙ্গাগণ এক সময় স্বচ্ছল গৃহস্থ্য, চাকুরিজীবী বা ব্যবসায়ী ছিল, তাদের ঘর-বাড়ি, দোকান-পাঠ ও চাকুরি-বাকুড়ি কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব বস্তিবাসী করা হয়েছে। যারা এক সময় মসজিদের ইমাম, স্কুল-কলেজের শিক্ষক বা রাজনৈতীক দলের নেতা ছিল তারা এখন নিঃস্ব বস্তিবাসী। তাদের যেমন শহরে প্রবেশাধীকার নেই, তেমনি নেই হাট-বাজার, হাসপাতাল, বিদ্যালয়ে প্রবেশের অধীকার। অধীকার নেই এমনকি মসজিদে যাওয়ার। বস্তির ঘরের আলো-বাতাসহীন স্যাঁত-সেঁতে মেঝেতে রোগাগ্রস্ত দুর্বল দেহ নিয়ে রাত-দিন শুয়ে থাকা ও ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া ছাড়া তাদের সামনে কোন বিকল্প পথ খোলা রাখা হয়নি। চাকু চালিয়ে জবাই করা বা বন্দুকের গুলিতে হত্যাই একমাত্র গণহত্যা নয়। গণহত্যার আরেক নৃশংস রূপ হলো এভাবে মৃত্যুর দিকে জোরপূর্বক ঠেলে দেয়া।
পঞ্চম স্তর: মূলোৎপাটন
এটি হলো টার্গেট জনগোষ্ঠি নির্মূলের চুড়ান্ত পর্যায়। এ পর্যায়ে শুরু হয় হয় হত্যা ও বলপূর্বক দেশ থেকে বহিস্কারের ন্যায় ভয়ানক নৃশংসতা। মায়ানমারে সেটিই এখন তীব্র রূপ ধারণ করেছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের মূলোৎপাটনের সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই অর্ধেকের বেশী রোহিঙ্গা মুসলিম গ্রামকে ইতিমধ্যেই মুসলিম শূণ্য করা হয়েছে। গ্রামগুলিতে আগুণ দিয়ে তাদের ঘর-বাড়ির চিহ্নপর্যন্ত বিলুপ্ত করা হয়েছে। শুধু ঘর-বাড়ীই নয়, মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির যা কিছু নিদর্শন -যেমন মসজিদ-মাদ্রাসা, সেগুলিকেও নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে বা হচ্ছে্। বিগত তিন সপ্তাহে ৫ লাখের বেশী রোহিঙ্গা মুসলিমকে মায়ানমার ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের ভাষায় এটিই হলো মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দ্রুত রিফিউজী-করণের ইতিহাস। যাদেরকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে তাদের ফেরত নেয়া তো দূরের কথা, প্রতিদিন অবশিষ্ঠ রোহিঙ্গাদেরও দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। এখনো যারা ঘর-বাড়ী ছাড়েনি, পরিকল্পিত ভাবে তাদের গ্রামগুলিতে গিয়ে সেনা হামলার ভয় দেখানো হচ্ছে। ফলে তারাও প্রাণ ভয়ে দ্রুত দেশ ছাড়ছে। প্রশ্ন হলো, এই যখন প্রতিবেশীদের আচরণ, তখন সে ভূমিতে রোহিঙ্গা মুসলিমগণ ভবিষ্যতে ফিরে যাওয়ার সাহসই বা পাবে কোত্থেকে? কারণ, কোন দেশে শুধু ঘরবাড়ির নির্মাণই বড় কথা নয়, সন্মান নিয়ে বাঁচার পরিবেশও তো জরুরী। সেটি কি কখনো আবার ফিরে আসবে? যাদের মন এতটা বিষপূর্ণ তাদের কি সামর্থ থাকে?
ষষ্ঠ স্তর: মুসলিম-মূক্ত আরাকান
গণহত্যার এটিই হলো সর্বশেষ স্তর। রোহিঙ্গা মুসলিম নির্মূলের প্রকল্পটি এ স্তরে পৌঁছলে আরকানে যে মুসলিম জনবসতি ছিল, মুসলিম শাসন ও সভ্যতা ছিল, এবং সেখানে যে শত শত মসজিদ ও মাদ্রাসা ছিল -তার কোন আলামতই আর থাকবে না। যেমন নেই সাতশত বছরের অধীক কাল মুসলিম শাসনে থাকা স্পেনে। অথচ মুসলিম শাসনামলে স্পেন ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি। সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল মুসলিম তাহজিব ও তমুদ্দন। বহু বিখ্যাত মুসলিম আলেম ও মনিষীর জন্ম হয়েছে স্পেনে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় বিদ্যার্জনের লক্ষ্যে ইউরোপের নানা দেশ থেকে ছাত্রগণ তখন স্পেনের শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভিড় করতো। অথচ সে দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নারী, পুরুষ, শিশুই শুধু বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, বিলুপ্ত হয়ে গেছে তাদের ঘর-বাড়ি, মসজিদ-মাদ্রাসা ও শিক্ষা-সংস্কৃতিও। মুসলিমদের সে অতীত ইতিহাস খুঁজতে এখন যাদুঘর ও লাইব্রেরীতে যেতে হয়। আরাকানে দ্রুত সেটিই হতে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, বিশ্বের ১.৬ বিলিয়ন মুসলিম কি রোহিঙ্গা মুসলিমদের তেমন একটি বিলুপ্তি-করণ প্রক্রিয়া নীরবে দেখবে? সেরূপ নীরবতা কি কখনো ঈমানের আলামত হতে পারে? ৩/১০/২০১৭
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018