বাঙালী মুসলিম চেতনায় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on November 14, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, ই-বুকস
- 1 Comment.
পাকিস্তানের উপনিবেশ তত্ত্ব
বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের দাবী, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল অবধি পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের একটি কলোনি বা উপনিবেশ মাত্র। এক্ষেত্রেও মিথ্যাচার কি কম হয়েছে? কিন্তু কিভাবে পাকিস্তানের উপনিবেশ রূপে বাংলাদেশের সে পরাধীনতাটি শুরু হলো সে বিবরণ তারা দেয় না। কীভাবেই বা পাকিস্তান একটি ঔপনিবেশিক দেশে পরিণত হলো সে বর্ণনাও তারা দেয় না। উপনিবেশ স্থাপনেও তো যুদ্ধ করতে হয়। ১৭৫৭ সালে বাংলাকে পরাস্ত করতে বহু হাজার ইংরেজ সৈন্য সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে পলাশীর রণাঙ্গণে এসেছিল।কিন্তু ১৯৪৭ সালে পূর্ববাংলা জয়ে এসেছিল কি কোন পাকিস্তানী সৈন্য? এসে থাকলে কোথায় হয়েছিল সে যুদ্ধটি? তেমনি ঔপনিবেশিক পরাধীনতার জন্যও তো পলাশীর পরাজয় লাগে। সে সাথে মীর জাফর লাগে। তখন কে ছিল সিরাজউদ্দৌলা, আর কে ছিল মীরজাফর? কীরূপে প্রতিষ্ঠা পেল সে ঔপনিবেশিক শাসন? ইতিহাসের এসবের কোন উত্তর নাই। তবে কী পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালীগণ স্বেচ্ছায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের পদতলে নিজেদেরকে পরাধীন দাস রূপে সঁপে দিয়েছিল?
কথা হলো, কলোনি বা উপনিবেশ বলতে কি বুঝায়-সেটি বুঝতে বাঙালীদের কি কোন বক্তৃতার প্রয়োজন আছে? ১৯০ বছর যাবত বাংলাদেশ ছিল ব্রিটিশের উপনিবেশ। এ দীর্ঘ ১৯০ বছরে এ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে কোন বাঙালী কি এক দিনের জন্যও গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী দূরে থাক কোন ক্ষুদ্র মন্ত্রীও হতে পেরেছে? কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে বলা হয় পাকিস্তানের জাতির পিতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনিই হন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান। তখন সে পদের নাম ছিল গভর্নর জেনারেল। প্রেসিডেন্ট খেতাবটি তখনও পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা পায়নি্, সেটি আসে ১৯৫৮ সালে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র তের মাসের মাথায় কায়েদে আযমের ইন্তেকাল ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পর গভর্নর জেনারেলের সে আসনে যিনি বসেন তিনি কোন পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান বা বেলুচ ছিলেন না। সে ব্যক্তিটি ছিলেন ঢাকার খাজা নাজিমুদ্দীন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনবার। লক্ষ্যণীয় হলো, অখন্ড পাকিস্তানের ২৩ বছরে কোন পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান বা বেলুচ তিন বার প্রধানমন্ত্রী হতে পারেনি, হয়েছে বাঙালীই। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীসভায় বহু সদস্য হয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানী। ১৯৫৮ সালে দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট রূপে ক্ষমতায় বসেন জেনারেল এসকেন্দার মীর্যা। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের।
পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনি বা উপনিবেশ ছিল এটি নেহায়েতই একাত্তর-পরবর্তী আবিষ্কার। পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠা পায় তখন রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রেসিডেন্ট না বলে বলা হত গভর্নর জেনারেল। শেখ মুজিব তার রাজনৈতিক জীবনে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মাঝে বৈষম্যের কথা বলেছেন; কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ ছিল এমন আজগুবি কথাটি তিনি একটি বারের জন্যও বলেননি।পাকিস্তানের ২৩ বছরের জীবনে রচিত শত শত নিবন্ধ,কবিতা,গল্প ও উপন্যাসেও এমন কথা একটি বারের জন্যও লেখা হয়নি।অথচ সাহিত্য হলো একটি দেশের চেতনার প্রতিচ্ছবি। সাহিত্যে মধ্য দিয়ে একটি জনগোষ্ঠীর চেতনা কথা বলে। ১৯৪৭ সালের পূর্বে বাংলাদেশসহ সমগ্র ভারত ছিল পরাধীন। ১৯৪৭ সালে আসে স্বাধীনতা।তাই ১৯৪৭-পূর্ব পরাধীন যুগের বাংলা সাহিত্যে দেখা যায় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ। সাহিত্যে ছিল বিদ্রোহের সুর। বহু কবিতা ও গানে ছিল পরাধীনতা শিকল ভাঙ্গার গান। সে বিদ্রোহের কারণেই কাজী নজরুল ইসলামকে জেলে যেতে হয়েছে। কিন্ত পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানী কবি সাহিত্যিকদের লেখনীতে সে ক্ষোভ এবং সে বিদ্রোহ কি নজরে পড়ে? শোনা যায় কি কোন শিকল ছেঁড়ার গান?
পাকিস্তান আমলে যে ক্ষোভটি নজরে পড়ে সেটি ছিল মূলত রাজনৈতিক ময়দানে। সেটির কারণ হলো, একদিকে যেমন স্বৈরাচারী শাসন ও দুর্নীতি পরায়ন রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার মোহ, তেমনি বিদেশী শত্রুর ষড়যন্ত্রের সাথে এসব স্বার্থপর রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতা। শেখ মুজিব জেলে গেছেন ও মামলায় জড়িয়েছেন, সেটি ভারতের সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্রে জড়িত হওয়ার কারণে। স্বৈরাচার নির্মূল বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। তিনি নিজেই ছিলেন ভয়ংকর স্বৈরাচারী -তা তো তিনি ক্ষমতায় যাওয়া মাত্র প্রমাণ করেছেন। ফলে স্বৈরাচার নির্মূলে তার সামান্যতম আগ্রহ থাকার কথা নয়। সেটি বার বার প্রমাণিতও হয়েছিল। সেটি যেমন ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের আয়োজিত গোল টেবিল বৈঠকের সময়,তেমনি ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনার বৈঠকে। তার ষড়যন্ত্রের মূল এজেন্ডাটি ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার,বিচ্ছিন্নতার লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জন ছিল না। বিচ্ছিন্নতা এবং স্বাধীনতা এক বিষয় নয়। একটি স্বাধীন দেশকে খন্ডিত করা হয় সে দেশকে দুর্বল করার জন্য, ক্ষুদ্র টুকরোগুলোকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার জন্য নয়। বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলোর তখন পরাধীনতা বাড়ে শক্তিশালী প্রতিবেশীর হাতে। আজকের বাংলাদেশ তারই নমুনা। এজন্যই বিচ্ছিন্নতার প্রকল্পটি ছিল একান্তই ভারতের। যারা জড়িত ছিলেন সে ষড়যন্ত্রের সাথে তার সে ষড়যন্ত্রের কথা পরবর্তীতে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। সে ষড়যন্ত্রগুলি হয়েছে পাকিস্তানের আজন্ম শত্রু ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে, মুজিবের নেতৃত্বে নয়। ১৯৭০’য়ের যুদ্ধটিও হয়েছে ভারতের নেতৃত্বে, মুজিব বা আওয়ামী লীগের কোন নেতার নেতৃত্বে নয়। পাকিস্তানের শত্রুরা তখন কাজ করেছেন ভারতীয় চরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তাদের মাঝে প্রচণ্ড ভাবে যে বিষয়টি তখন কাজ করেছিল সেটি হলো,যে কোন ভাবে ক্ষমতালাভ। একারণেই পাকিস্তানী আমলের মূল্যায়নে সে সময়ের কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে যতটা সততা দেখা যায় সেটি রাজনৈতিক মহলে ছিল না। সেরূপ সততা আদৌ ছিল না ভারতমুখী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝে।
ফলে পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কি ভাবতো সেটি জানতে হলে সে আমলের সাহিত্যের দিকে নজর দিতে হবে। ইতিহাস পাঠের নামে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের প্রচরণার জোয়ারে ভাসলে আসল সত্যটি অজানাই থেকে যাবে। অথচ আজ ইতিহাস পাঠের নামে বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মিথ্যার জোয়ারে ভাসানোর কাজটিই হচ্ছে। একাত্তরের পর ইতিহাস চর্চায় দখলদারি গেছে রাজনীতিবিদদের হাতে। এসব ভারতসেবী রাজনীতিবিদ ভারতের প্রতি তাদের দাসসুলভ চরিত্রকে আড়াল করতে পাকিস্তান আমলের সাহিত্য ধ্বংসে হাত দিয়েছে। এমন একটি অসৎ উদ্দেশ্যের কারণেই আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের ফ্যাসীবাদী সন্ত্রাস শুধু রাজনীতির ময়দানে সীমিত নয়,বরং তার প্রবল বিস্তার শিক্ষা,সাহিত্য ও ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রেও। তারা শুধু বিশ্ববিদ্যলয়ে মনোগ্রাম থেকে কোরআনের আয়াতকে সরিয়ে দেয়নি,লাইব্রেরী ও পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস থেকে বহু লেখকের বইও সরিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে তাদের যারা ভারতসেবী রাজনৈতিক প্রকল্পের সহযোগী নয়।
একাত্তরপূর্ব বাংলা সাহিত্যে স্বাধীনতার প্রসঙ্গ
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান ঔপনিবেশিক কলোনি ছিল না স্বাধীন দেশ ছিল এবং দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ও কবি-সাহিত্যিকগণ তা নিয়ে কি ভাবতো -সেটির পরিচয় মেলে সে আমলের বাংলা সাহিত্যে। সাহিত্যের মধ্য দিয়েই এভাবেই দেশের ইতিহাস জানা যায়। সাহিত্যের মাঝে এজন্যই স্বাধীনতা বা পরাধীনতা –জনগণের উভয় অবস্থারই বর্ণনা পাওয়া যায়। ভারতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাতা হলো লর্ড ক্লাইভ ও ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী।লর্ড ক্লাইভ ও তার কোম্পানীকে উদ্দেশ্য করে একখানি কবিতাও কি কেউ লিখেছে? ১৯০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রশংসা করে কোন মুসলিম কবি কি একটি কবিতাও লিখেছে? কারো প্রশংসায় কবিতা চর্চায় আবেগ ও অনুপ্রেরণা আসে অন্তরের গভীর ভালবাসা থেকে। অথচ সেরূপ গভীর ভালবাসার প্রমাণ মেলে পাকিস্তান ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতার স্মরণে লেখা অসংখ্য কবিতা ও প্রবন্ধে।
একাত্তরের পর মুজিবামলে অতি ক্ষোভ ও আক্রোশ নিয়ে লেখা হয়েছেঃ “ভাত দে, নইলে মানচিত্র খাবো” ইত্যাদি জাতীয় কবিতা। পাকিস্তানের ২৩ বছরে দেশটির মানচিত্র খাবার সাধ নিয়ে কেউ কি কবিতা লিখেছে? অথচ সেটি লেখা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই। যে দেশের সরকার দুর্ভিক্ষ ডেকে এনে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটায় -সে দেশের সরকার ও মানচিত্রের বিরুদ্ধে আক্রোশ জাগাই স্বাভাবিক। শেখ মুজিবের পিঠের চামড়া দিয়ে ঢোল বানানোর আক্রোশে বক্তৃতা দেয়া হয়েছে। সে সব বক্তৃতা দিয়েছে খোদ ছাত্রলীগের নেতারা, কোন রাজাকার নয়। কিন্তু পাকিস্তানের ২৩ বছরে বাংলা ভাষায একটি কবিতাও কি লেখা হয়েছে যাতে প্রকাশ পেয়েছে পাকিস্তান ও তার নেতা কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি ঘৃণা ও আক্রোশ।পাকিস্তান ভাঙ্গা হয়েছে,একাত্তরের পর বাংলাদেশের যেসব প্রতিষ্ঠানের সাথে জিন্নাহর নাম জড়িত ছিল সেখান থেকে তার নামও সরানো হয়েছে, কিন্তু সে আমলের কবিতা ও সাহিত্যকে কে নির্মূল করবে? বরং লক্ষণীয় হলো,কায়েদে আযমের প্রশংসায় বাংলা ভাষায় যত কবিতা লেখা হয়েছে তা বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক নেতার কপালে জুটেনি।
বাংলা কবিতায় কায়েদে আযম
পূর্ব পাকিস্তানকে যারা পাকিস্তানের উপনিবেশ ভাবেন সে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কায়েদে আযম মোহম্মদ আলী জিন্নাহ। তাঁকে উদেশ্য করে বাংলা ভাষায় যেসব কবিতারচিত হয়েছে তার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক।পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যারা প্রধানতম কবি ছিলেন তাদের মধ্য অন্যতম হলেন ফররুখ আহমদ,সুফিয়া কামাল,তালিম হোসেন,বেনজির আহমেদ, গোলাম মোস্তাফা, আ.ন.ম.বলজুর রশিদ, কাজী কাদের নেয়াজ, সিকান্দার আবু জাফর, শাহাদৎ হোসেন খান, বন্দে আলী মিয়া, সৈয়দ আলী আহসান,আশরাফ সিদ্দিকী,মাজহারুল ইসলাম, মুফাখখারুল ইসলাম, আবু হেনা মোস্তাফা কামাল, সৈয়দ এমদাদ আলী এবং আরো অনেকে। এসব কবিদের রচিত সাহিত্যে কায়েদে আযমকে নিয়ে যে চেতনা ও উপলদ্ধিটি ফুটে উঠেছে তার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছেন,
“তসলীম লহ,হে অমর প্রাণ!কায়েদে আজমজাতির পিতা!
মুকুট বিহীন সম্রাট ওগো!সকল মানব-মনের মিতা।
অমা-নিশীথের দৃর্গম পথে আলোকের দূত! অগ্রনায়ক!
সিপাহসালার!বন্দী জাতিরে আবার দেখালে মুক্তি-আলোক।”
-(মাসিক মাহে নও। ঢাকা,ডিসেম্বর ১৯৫৯)।
অন্য এক কবিতায় তিনি লিখেছেন,
“জাতির পতাকা-তলে একত্রিত সকলে তোমারে
স্মরণ করিছে বারে বারে,
তোমার আসন আজও সকলের হৃদয়ের মাঝে
তোমারে লইয়া ভরে আছে।
যুগে যুগে তুমি তব দানের প্রভায়
চিরঞ্জীব হয়ে র’বে আপনারী দিব্যি মহিমায়।
কায়েদে আজম। তবদান
মহাকাল-বক্ষ ভরি রহিবে অম্লান।”
-(মাসিক মাহে নও।ঢাকা,ডিসেম্বর ১৯৫৫)।
সুফিয়া কামাল আরেক কবিতায় লিখেছেন,
“হে সিপাহসালার! তব দৃপ্ত মনোরথে
ছুটাইয়া টুটাইয়া জিন্দানের দ্বার
আনিলে প্রদীপ্ত দীপ্তি ঘুচায়ে শতাব্দী অন্ধকার
মৃত্যু নাহি যে প্রাণের ক্ষয় নাহি তার দেয়া দানে
লভি আজাদীর স্বাদ,এজাতি-জীবন তাহা জানে
তোমার জনম দিনে,তোমার স্মরণ দিনে
কায়েদে আজম! তব নাম
কোটি কন্ঠে ধ্বনি ওঠে,কহে,লহ মোদের সালাম।”
–(পাক-সমাচার।ঢাকা ডিসেম্বর: ১৯৬৩)।
কায়েদে কাযমের সম্মানে কবি ফররুখ আহমদ লিখেছেন:
“সে ছিল দিলীর,শক্তিমান এই দুনিয়ায়,
তর্জনী-সংকেতে যাঁর কাঁপিয়াছে একদা হিমালা;
অন্ধ জুলমাত-ম্লান শর্বরী শ্রান্ত তমসায়
এনেছিল সহজে সে জীবনের তীব্র জ্যোতির্জ্বালা
শৃংখলিত জনতার সে নির্ভীক নিশান-বর্দার-
বহু দিন বহু বর্ষ নিজেরে জ্বালায়ে তিলে তিলে
দিয়ে গেছে অনির্বাণ আজাদীর বিচিত্র সম্ভারঃ
দিশাহারা জাতিকে সে নিয়ে গেছে মুক্তির মঞ্জিলে।
সে মুক্তি,আজাদী সেই প্রমূর্ত একক সাধনায়,
অদম্য,অনমনীয় যার মাঝে ছিল না সংশয়,
জাতিকে মঞ্জিলে এনে যদিও সে নিয়েছে বিদায়,
এ জাতির হৃদপিন্ডে রেখে গেছে আপন হৃদয়।
….
কায়েদের পথ চিনে বাঁচাবো এ পাক হুকুমত।
কলিজার খুন দিয়ে তিলে তিলে,কিম্বা এক সাথে
নির্ভীক জামাতবদ্ধ অকৃপণ রক্ত বিনিময়ে
বিজয়ী শত্রুর ‘পরে,অকম্পিত দুর্ধর্ষ সংগ্রামে
নেতার আদর্শ নিয়ে আজাদীর পূর্ণতার পথে
উদ্বুদ্ধ বাণীতে তার গ’ড়ে যাবো এ পাক ওতান,
বাঁচাবো মর্যাদা তার –যে মর্যাদা মহান পিতার
এ দেশের প্রতি পথ যার দীপ্ত স্মৃতির প্রতীক,
তার অসমাপ্ত কাজ আমাদের দায়িত্ব বিশাল।”
-(বার্ষিকী) নয়া সড়ক
(শাহেদ আলী সংকলিত, ১৯৮৯)
কায়েদে আজম স্মরণে সিকান্দার আবু জাফর লিখেছেন,
“ডোবেনি যে রবি,নেভেনি যে আলো
মুছিবে না কোন কালে,
এই কালে পৃথিবীর ভালে
জ্যোতি-প্রদীপ্ত উজ্বল সেই
সূর্য্যের প্রতিভাস
সে রচিয়া গেছে মৃত্যুবিহীন
আপনার ইতিহাস।
সে ছড়ায়ে গেছে মৃত্যুঞ্জয়ী
মহাজীবনের বীজ,
সে ফোটায়ে গেছে লক্ষ বুকের
তিমির সরসী নীরে
চির প্রভাতের আনন্দ সরসিজ।
মৃত্যু ‘অতীত জীবন তাহার
মৃত্যু সাগর তীরে
দিগন্তহীন সীমা বিস্তৃত জীবনের মহাদেশে
যুগ-যুগান্ত সে আসিবে ফিরি ফিরে।
বহু মৃত্যুর দিগন্ত হতে সে এনেছে কেড়ে
জীবনের সম্মান;
ক্ষয় নাহি তার নাহি তার অবসান।
অযুত মৌন কন্ঠ ভরিয়া নব জীবনের গান
ফোটা যে বারে বারে
মৃত্যু কি তারে স্তব্ধ করিতে পারে?
-(শাহেদ আলী সংকলিত,১৯৮৯)
আওয়ামী লীগ আমলের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং বাংলা এ্যাকাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক ডঃ মাযহারুল ইসলাম লিখেছেন,
“সহসা আলোর পরশ লাগালো
প্রাণে প্রাণে এক চেতনা জাগলো
আধার দুয়ার খুলে গেল সম্মুখে
কে তুমি হে নব-পথ-সন্ধানী আলোকদ্রষ্টা?
কে তুমি নতুন মাটির স্রষ্টা?
…
যে এনেছে বুক জুড়ে আশ্বাস
যে দিয়েছে সত্তা নিয়ে বাঁচবার বিশ্বাস
অগণন মানুষের হৃদয়-মঞ্জিলে
-সে আমার কাযেদে আজম
আমার তন্ত্রীতে যার ঈমানের একতার
শৃঙ্খলার উঠিছে ঝংকার
সুন্দর মধুর মনোরম।”-(শাহেদ আলী সংকলিত, ১৯৮৯)
ড. মাজহারুল ইসলাম অন্য এক কবিতায় কায়েদে আযম সম্পর্কে লিখেছেন,
“আঁধারের গ্লানিভরা জাতির জীবন
কোথাও ছিল না যেন প্রাণ স্পন্দন
মৃত্যু-তুহীন দিন গুণে গুণে এখানে ওখানে
শুধু যেন বারবার চলিষ্ণু পখের প্রান্তে ছেদ টেনে আনে
ম্লান পথ হয়ে ওঠে আরো ঘন ম্লান
আঁধারে বিলীন হলো মুক্তি-সন্ধান।
তারপর মৃত্যু-জয়ী সে এক সৈনিক
সৃষ্টির আনন্দ নিয়ে নেমে এলো আঁধারের পথে
চোখে মুখে অপূর্ব স্বপন
হাতে আঁকা অপরূপ নতুন দেশের রূপায়ন
এ মাটিতে সে এক বিস্ময়,
মৃত বুকে প্রাণ এলো
মুক্তির চেতনা এলো।
প্রাণ যাক তবু সেই স্বপ্ন হোক জয়
নির্বিকার ত্যাগের আহবান!
পথে পথে রক্তের আহবান।
-মাটির ফসল, -(শাহেদ আলী সংকলিত,১৯৮৯)
কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
“মুসলিম লীগের আন্দোলন যেরূপ গদাই-লস্করী চালে চলছিল, তাতে আমি আমার অন্তরে কোন বিপুল সম্ভাবনার আশার আলোক দেখতে পাইনি। হঠাৎ লীগ নেতা কায়েদে আজম যেদিন পাকিস্তানের কথা তুলে হুংকার দিয়ে উঠলেন -“আমরা ব্রিটিশ ও হিন্দু ফ্রন্টে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করব” সেদিন আমি উল্লাসে চীৎকার করে বলেছিলাম –হাঁ, এতোদিনে একজন ‘সিপাহসালার’ সেনাপতি এলেন। আমার তেজের তলোয়ার তখন ঝলমল করে উঠলো।”-(শাহেদ আলী সংকলিত,১৯৮৯)
বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক এবং ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনাব আবু হেনা মোস্তাফা কামাল কায়েদে আজমের সম্মানে লিখেছেন,
“প্রদীপ্ত চোখে আবার আকাশকে দেখলাম
পড়লাম এক উজ্বল ইতিহাসঃ
সে ইতিহাসের পাতায় পাতায় একটি সোনালী নাম…
আবার আমরা আমরা চোখ তুলে তাই দেখলাম এ আকাশ।
তোমাকে জেনেছি আকাশের চেয়ে বড়—
সাগরের চেয়ে অনেক মহত্তর—
কেননা ক্লান্ত চোখের পাতায় নতুন আলোর ঝড়
তুমি এনে দিলে।নতুন জোয়ার ছুঁয়ে গেল বন্দর।
-(মাসিক মাহে নও,ঢাকা ডিসেম্বর ১৯৫৩)
কবি বন্দেআলী মিয়া লিখেছেন,
“জাতির জনক –তোমারে সালাম!
পাক-ভারতের ইতিহাসে তোমার নাম লেখা রইলো।
লেখা রইলো কালের পাতায়,
শতাব্দীর অন্ধ কারাগারের দ্বার ঠেলে
হে জ্যোতির্ময়,পরাধীন মুসলিম জাহানে তুমি এলে।
তোমার আবির্ভাবে খসে পড়লো গোলামীর জিঞ্জির।”
-(মাসিক মাহে নও,ঢাকা, ডিসেম্বর ১৯৫৩)
কায়েদে আজমের মৃত্যুতে সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন,
“অনুর্বর প্রহরে আমার-প্রাণ দিলে সুর দিলে তুমি,
আমার মৃত্তিকালদ্ধ ফসলের ভিত্তিভূমি তুমি।
প্রতিকূল প্রহরের প্রবঞ্চনা ফিরে গেল অসীম কুন্ঠায়,
আসলাম দীপ্ত পথে খরতর সূর্যের আশায়।
তুমি সে সূর্যের দিন,তুমি তার আরম্ভের প্রভা,
সবুজের সমারোহ জীবনের দগ্ধ দিন
প্রাণের বহ্নিব মোহে জেগে উঠে নতুন সঙ্গীতে-
অপূর্ণ জীবন আজ পরিপূর্ণ হলো বন্ধু তোমার ইঙ্গিতে।
…
মানব কন্ঠে যে সুর জাগালে তুমি,
সে সুরে এবার তুলে কল্লোল আমার জন্মভূমি।
– নয়া সড়ক (বার্ষিকী),(সংকলনে শাহেদ আলী, ১৯৮৯)।
এমন কি প্রখ্যাত বামপন্থী তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কায়েদে আজমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যে কবিতাটি লিখেছিলেন সেটিও অনন্য। তার কিছু অংশ হলঃ
“তপস্যা শেষ,ভাঙ্গো আজ মৌনতা,
দুর্গের দ্বার খোলো বিনিদ্র দ্বারী,
শত্রুরা মূঢ়,সম্ভাষে স্বাধীনতা,
আমরা জয়ের সাগরে জমাবো পাড়ি,
আজকে এ-দেশ শুনেছে যে ব্রত কথা
সোনার খাঁচার সঙ্গে তাইতো আড়ি।”
সুকান্তের এ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ য়ের স্বাধীনতা পূর্বকালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। পরে ড. আনিসুজ্জামানের সংগ্রহে প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমীর ত্রৈ মাসিক সাহিত্য পত্রিকা “উত্তরাধিকার” এর শ্রাবন-আশ্বিন ১৩৯১ (জুলাই-আগস্ট) সংখ্যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক সময়ের চেয়ারম্যান মোহম্মদ মনিরুজ্জামান লিখেছেন কায়েদে আজমের জন্মদিন উপলক্ষে লিখেছেন,
“তুমি নেই,কি আশ্চর্য,তবু তুমি আছ-
এ অসীম বিস্ময়ে
চিনেছি আমার দেশ।অন্ধকারে
যেখানে জ্বালালে আলো,রাত্রির মিনারে
শোনালে সমুদ্র-বালী;সেই তাকে
যতই বাঁধুক বন্যা ঝড়-ঝঞ্ঝা যন্ত্রণার পাঁকে
সে শুধু প্রদীপ্ত মুখ,
দৃঢ়কন্ঠ উচ্চকিত।একাগ্র উৎসুক
আমি –ছিনেছি তোমাকে প্রতি শ্বাসের হাওয়ায়
মনে মনে
ঘাসের শিশিরে,মৃদু নক্ষত্রের রূপালি জীবনে
দেখিছি প্রোজ্বল হৃদয়ে।তাই
জন্মদিন প্রতিদিন,জেনেছি তোমারে।”
– মাসিক মাহে –নও,ঢাকা।ডিসেম্বর ১৯৫৬।
কায়েদে আজমের স্মরণে কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত লিখেছেন,
“দিকে দিকে উদ্যত নিশানা;
নব রাষ্ট্র জাতীয় চেতনা,
অবজ্ঞার অন্ধকারে লুপ্ত কোটি প্রাণ,
আজ তা’রা আপনার শৌর্যে আস্থাবান
অসীম সাহস বুকে, বাহুতটে আসে নব বল;
কর্মদীপ্ত পাকিস্তানে কোটি প্রাণ তরঙ্গ চঞ্চল।”
…
বনে বনে পাহাড়ে ও ঘাসে
আজাদী বন্যা এন যাদুদণ্ড দিয়ে
জাগালেন সুপ্তিমগ্ন পাষাণ-পুরীকে
এই বিংশ শতকের কোন যাদুকর!
নবরাষ্ট্র গঠনের অমোঘ আহবান!
-মাসিক দিলরুবা, (সংগ্রহে শাহেদ আলী, ১৯৮৯।
শিক্ষাবিদ, কবি ও গবেষক মোফাখখারুল ইসলাম কায়েদে আজমের মৃত্যুতে লিখেছেন,
“কায়েদে আজম! কায়েদে আজম! কে বলে মরেছ তুমি?
গুরু জিহাদের রণ-প্রস্তুতিতে হয়তো পড়েছ ঘুমি!
ঝড়-তুফানে ঝাপটা সয়েছ সারা রাত জেগে জেগে,
ভোরের পবনে ঢুলিয়া পড়েছ রাতের তন্দ্রাবেগে!
যাত্রা-ঘণ্টা তেমনি বাজিছে দূর পথে ঠুনঠুনি,
তোমার কন্ঠ সমান আবেগে আজো হেঁকে ওঠে শুনি!
আজো হেঁকে ওঠেঃ এক পা-ও নহে পিছুপানে কভূ নয়!
শাণিত জ্ঞানের তেগ হেনে চলো যেথা আছে সংশয়!
ছিলে সম্মুখে, এবার মোদের পশ্চাতে শুধু এলে,
তোমার মনের তাকত মোদের সমূখে দিতেছে ঠেলে।
তাই আজো চলি –আজো চলি তব পথ,
আমার যে নাই কাঁদিবার ফুরসৎ!
তুমি ত হুকুম করোনি এখনো থামিতে পথের মাঝে,
অশ্রু মছিয়া সমতালে তাই চলিতেছি রণ-সাজে।
এই ধরিলাম তোমার নিশান পুনঃ!
ঝঞ্ঝার বেগ, মৃত্যু-তুফান কোনো
নোয়াতে কখন পারিবে না এরে, পারিবে না লাজ দিতে;
আমরা রক্ত জিম্মা রহিল এর মান রক্ষিতে।”
-কাব্য বীথি, ১৯৫৪।
কায়েদে আজম স্মরণে কবি তালিম হোসেন লিখেছেন,
“জিন্দেগানীর মুক্তি দিশারী,হে জিন্দা মুসলিম!
তব রশ্মির সম্পাত আছে চাঁদ সিতারার পরে।
সে চাঁদ-সিতারা নিশান আমার –আলোকিত অন্তর,
গুমরাহা রাতে পথ হারাবো না-লহ এই নির্ভর।
জিন্দেগানীর মুক্তি দিশারী, হে জিন্দা মুসলিম!
রুদ্ধ আঁধার জিন্দারে দিলে আলোর তসলীম।
স্বেচ্ছা-বন্দী দীন আত্মারে দেখালে রাহে নাজাত,
মৃত্যু –তন্দ্র মুর্চ্ছাতুরের পিয়ালে আবহায়াত!
কার ইশকের পরশ ছোঁয়ালে, হে মোর আতশী সাকী?
নয়া জিন্দেগী তহুরা –নেশায় কোন মাশুকের লাগি
শত মৃত্যুর পারাইয়া আসি জীবনের ময়দানে-
বিজয় নিশান আধো-চাঁদ আঁকা নিশানের আহবানে।
…..
কোথা উড়ে যায় মৃত্যু-শংকা খুদীতে দৃপ্ত হয়ে
খুনের দরিয়া পাড়ি দিই আঁধি-তোফান মাথায় লয়ে।
অন্তরে লভি তোমার দিদার, বন্দরে বন্দরে
আলো-ঝলমল আকাশে আমার হেলালী নিশান ওড়ে।
-দিশারি (সংগ্রহে শাহেদ আলী, ১৯৮৯)
কবি বেনজির আহমদ লিখেছেন,
“হে কায়েদ নতুন দিনের,
এ-ও তব দান
মিথ্যার আঁধার টুটি আলোকের গান
এ-ও তব দান।
…
হে কায়েদ নতুন দিনের
মৃত্যু নহে তব অবসান,
জীবন্ত সূর্যের মতো বিশ্বের মানস লোকে
তুমিও যে মৃত্যু –জয়ী অমৃত-সন্তান।
-(কাব্য বীথি, ১৯৫৪)।
কায়েদে আজমের স্মরণে কবি ফজল শাহাবুদ্দীন লিখেছেন,
“তুমি এলে হে নাবিক,প্রভাতের পানপাত্র হাতে
আঁধারে মুখর হোল জীবনের প্রদীপ্ত শপথে
রাত্রির বন্দর থেকে মৌসমীর হাসিন ঊষায়।
অনেক ঝড়ের পর মুঠি মুঠি প্রভাতের আলো
বিদীর্ণ রাত্রির শেষে রক্ত বীজ মাঠেতে ছড়ালো।”
-মাসিক মাহে নও,ঢাকা,ডিসেম্বর ১৯৫৬।
কেন এ অকৃত্রিম ভালবাসা?
কায়েদে আযম মোহম্মদ আলী জিন্নাহরপ্রতি বাঙালী মুসলিমের এরূপ গভীর ভালবাসার সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। ব্রিটিশের গোলামী থেকে মুক্তি লাভই বাঙালী মুসলিমের প্রকৃত স্বাধীনতা ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সাথে সাথে তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল গোলামীর আরেকটি ভয়ংকর জিঞ্জির। সেটি আধিপত্যবাদি বর্ণ হিন্দুদের। ইংরেজের গোলামী থেকে মুক্তি পাওয়ার চেয়েও কঠিন ছিল অতি নিষ্ঠুর ও নির্দয় হিন্দুদের খপ্পর থেকে মুক্তি পাওয়া। ইংরেজদের আমলে মুসলিম নারী-পুরুষদের হত্যা, মসজিদ ধ্বংস ও মুসলিম নারীদের ধর্ষণের লক্ষ্যে হাজার হাজার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আয়োজন হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারতীয় রাজনীতির এটিই প্রবলতম সংস্কৃতি। হিন্দু নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস চাচ্ছিল ভারতীয় মুসলিমদের পরাধীনতার খাঁচাতে পুরতে।বাঙালী মুসলিমদের জন্য তাই অপরিহার্য ছিল ইংরেজ ও হিন্দু –উভয়ের গোলামী থেকে স্বাধীনতা লাভ। ১৯৪৭ সালে সেটিই সম্ভব হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।কায়েদে আযম মোহম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন সে আন্দোলনের মহান নেতা। গান্ধি না হলেও ভারত ব্রিটিশের শাসন থেকে স্বাধীনতা পেত। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন ছিল কায়েদে আযমের ন্যায় যোগ্য নেতৃত্ব -যিনি একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন বিশাল ভারতের নানা ভাষা, নানা অঞ্চল,নানা মজহাব ও নানা ফেরকার মুসলিমদের।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলার মুসলিমদের যে উপকারটি মোহম্মদ আলী জিন্নাহ করেছেন তা ইখতিয়ার মোহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের পর আর কেউ করেননি। মাতৃভাষার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন গুজরাটি। বেড়ে উঠেছেন করাচি ও মুম্বাইতে। এরপরও বাঙালী মুসলমানের ভাগ্য পরিবর্তনে যে কোন বাঙালীর চেয়ে এই অবাঙালী ব্যক্তির ভূমিকাটিই সবচেয়ে বড় ।নইলে বাঙালী মুসলমানের স্বাধীন ভাবে বেড়ে উঠার স্বপ্নটি নিছক স্বপ্নই থেকে যেত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাওয়াতে একমাত্র ঢাকা শহরে যে সংখ্যক ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, কৃষিবিদ, সামরিক অফিসার ও অন্যান্য শিক্ষিত পেশাজীবীদের বসবাস তা সমগ্র ভারতের ২০ কোটি মুসলিমের মাঝে নেই। ভারতের জনসংখ্যার ১৫% ভাগ মুসলিম, অথচ সরকারি চাকুরিতে তাদের অনুপাত শতকরা তিন ভাগও নয়। এ তথ্যটি এমনকি ২০০৬ সালে সাচার কমিটির ন্যায় দিল্লি সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও প্রকাশ পেয়েছে। ইখতিয়ার মোহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বঙ্গ-বিজয় করে মুক্তি দিয়েছিলেন পৌত্তলিকতার অভিশাপ থেকে।তিনি সন্ধান দিয়েছিলেন জান্নাতের পথের।দুর্বৃত্ত হিন্দু রাজার কুফুরি শাসন বিলুপ্ত করে তিনি সুযোগ করে দিয়েছিলেন বঙ্গভূমিতে প্রথম শরিয়তের আইন প্রতিষ্ঠার। এভাবে বাংলার বিশাল জনগোষ্ঠী সেদিন সুযোগ পেয়েছিল মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার। একই রূপ সুযোগ সৃষ্টি হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
পরাধীন জীবনে কি ন্যায় বিচার ও ন্যায্য হিস্যা আশা করা যায়?ভারতে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গাগুলোয় হাজার হাজার মুসলিম নিহত হয়, হাজার হাজার মুসলিম নারী তো ধর্ষিতা হয় -কিন্তু সে অপরাধে কি কারো শাস্তি হয়? দিন-দুপুরে ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংস হলেও পুলিশ সেটি রুখে নাই, কাউকে গ্রেফতারও করে নাই।এরপরও কি বুঝতে বাঁকি থাকে, হিন্দু ভারতে মুসলিমদের পরাধীনতা কতটা ভয়ংকর। মুসলিমদের জন্য ভারতের বুকে যা বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা হলো পরাধীনতার শিকল। ১৯৪৭’য়ে পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে মুক্তি না মিললে বাংলাদেশের মুসলিমদের অবস্থাও যে ভারতীয় মুসলিমদের মত হত -তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? অথচ বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের কাছে পাকিস্তানী আমলের সে স্বাধীনতা পরাধীনতা মনে হয়েছে। বরং স্বাধীনতা গণ্য হয়েছে মুসলিমের বঞ্চনা ও নির্যাতনের ভারতীয় মডেল। ১৯৪৭’য়ের ভারত বিভক্তির বেদনায় এখনো তারা কাতর। একাত্তরে বাঙালী মুসলিমের গলায় পরাধীনতার শিকল পড়ানোর জন্যই শেখ মুজিব ও তার সহচরগণ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ডেকে এনেছিলেন। তাজুদ্দীনের ৭ দফা এবং মুজিবের ২৫ সালা চুক্তি ছিল মূলত পরাধীনতার সনদ; বাংলাদেশের স্বাধীনতার নয়।বাংলাদেশের ইতিহাসে যাদেরকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে পেশ করা হচ্ছে তারা তো বাংলাদেশের বেরুবাড়ী ধরে রাখতে পারিনি। তিনবিঘা করিডোরও ফিরিয়ে আনতে পারিনি। পদ্মার পানিও আনতে পারিনি। ক্ষমতায়থাকা কালে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নাম নিজের নামে করা যায়। অর্থ দিয়ে মুর্তিও গড়িয়ে নেয়া যায়।এমন কি চাটুকরদের দিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীর উপাধীও নেয়া যায়। কিন্তু ভালবাসা নিংড়ানো কবিতাও কি লিখিয়ে নেয়া যায়?
অবাঙালীদের ঘৃনা করা ও বাংলাদেশীদের সকল ব্যর্থতার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করা –এটিই বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের চরিত্রের প্রধানতম দিক। অথচ বাঙালী মুসলিমের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে দুই জন ব্যক্তির দান সর্বাধিক -তাদের কেউই বাঙালী নন। তারা হলেন কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ এবং ইখতিয়ার মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। তাছাড়া বাঙালী মুসলিমের হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে যিনি বসে আছেন তিনিও বাংলাদেশ বা বাংলা ভাষার কেউ নন। তিনি হলেন মহান নবীজী, মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানব এবং অবাঙালী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তাই ভাষার নামে প্রাচীর গড়ে বাংলার মুসলিমদেরকে কি তাদের অবাঙালী আপনজনদের থেকে দূরে রাখা যায়? ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা ভূগোলের নামে বিভেদের দেয়াল গড়া ইসলামে এ জন্যই হারাম। অথচ সে জঘন্য হারাম কাজটি নিয়েই বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি। মুসলিমের বন্ধনটি হলো ঈমানের। পাকিস্তানী আমলে ভাষার নামে সে নিষিদ্ধ দেয়াল গড়ার কাজটি হয়নি। বরং সে দেয়াল ভাঙ্গার কাজটিই হয়েছিল। তাই অসংখ্য পিতামাতা অবাঙালী জিন্নাহর নামে নিজ সন্তানদের নাম রেখেছেন। জিন্নাহর স্মৃতিকে স্মরণীয় করতে দেশের মানুষ তার নামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়েছে। কোন হানাদার, দখলদার বা ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিষ্ঠাতার নামে কি সেটি হয়? কিন্তু যে বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের চেতনার মানচিত্রটি আগ্রাসী শক্তির হাতে অধিকৃত -তারা কি ইতিহাসের এ সত্য বিষয়গুলি বুঝবার সামর্থ্য রাখে? এরূপ মানসিক বিকলাঙ্গতা নিয়ে পাকিস্তানের ২৩ বছরকে উপনিবেশিক যুগ বলবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? আর সেটি না করলে বাঙালীর মনে হিন্দু ভারতের বন্দনাকে জায়েজ করা যায় কি করে?
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018
wo thank you .,,this word is too little for your post..sir amra new generation esob secret jante chai….pls continue your job…