অজ্ঞতার নির্মূল এবং ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ: হাতিয়ারটি পবিত্র কুর’আন

ফিরোজ মাহবুব কামাল

লড়াইয়ের শুরু কুর’আন দিয়ে

দেহ বাঁচাতে পানাহার চাই। নইলে মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি ঈমান বাঁচাতে চাই কুর’আনী জ্ঞান। নইলে অনিবার্য হয় ঈমানের মৃত্যু। অনাহারে মারা যাওয়াতে কেউ জাহান্নামে যাবে না। কিন্তু নিশ্চিত জাহান্নামে যাবে অজ্ঞতা তথা জাহিলিয়াত নিয়ে বাঁচার কারণে। অজ্ঞতাই মানবের সবচেয়ে বড় দুশমন -যা জাহেল ব্যক্তি লালন করে তার চেতনার ভূমিতে। অজ্ঞতা অসম্ভব করে সিরাতাল মুস্তাকীম চেনা এবং সে পথে পথ চলা। তাই মানুষকে শুধু অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহের লড়াই নিয়ে বাঁচলে চলে না, তাকে অবশ্যই বাঁচতে অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে। অর্জন করতে হয় কুর’আনী জ্ঞান। মানব জীবনে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। কারণ তাঁর ঈমান নিয়ে বাঁচা ও বেড়ে উঠাটি নির্ভর করে চেতনার ভূমি থেকে অজ্ঞতার নির্মূলের উপর। এ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সে নিজেকে জান্নাতের জন্য প্রস্তুত করে। ইসলামে এটি পবিত্র জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। নামাজ-রোজা এবং হজ্জ-যাকাত পালন করেও মানুষ ঘুষখোর, সূদখোর, চোরডাকাত, ভোটডাকাত ও স্বৈরাচারি খুনি হয় এবং নিজেকে জাহান্নামের পথে নেয় অজ্ঞতা নির্মূলের জিহাদ থেকে দূরে থাকার কারণে।

নবীজী (সা:)’র আমলে ইসলামের সর্বপ্রথম জিহাদটি কোন জালেম শাসক বা বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে ছিল না, সেটি ছিল নিজ মনের অজ্ঞতা তথা জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে। এটিই হলো জিহাদে কবিরা তথা বড় জিহাদ। পবিত্র কুর’আ’ন হলো সে জিহাদের মূল হাতিয়ার। তাই মহান আল্লাজহতায়ালার নির্দেশ: “জাহিদু বিহি জিহাদান কবিরা” অর্থ: “এই কুর’আন দিয়ে বড় জিহাদটি করো।” এটি হলো মুসলিমের বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। নবীজী (সা:)’ তাঁর ১৩ বছরের মক্কী জীবনে সাহাবাদের এ জিহাদের সৈনিকে পরিণত করেছেন। এবং সে জিহাদের ময়দান থেকেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব তৈরী করেছে। মু’মিনের জীবনে অস্ত্রের জিহাদের সুযোগ নাও আসতে পারে। কিন্তু তাকে প্রতিদিন ও প্রতিমুহুর্ত বাঁচতে হয় এ বড় জিহাদ নিয়ে। এ জিহাদে যে বিজয়ী হয়, একমাত্র সে ব্যক্তিই মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার নিরস্ত্র রাজনৈতিক জিহাদে এবং রণাঙ্গণের সশস্ত্র জিহাদে মুজাহিদে পরিণত হয়। এবং যে ব্যক্তি এ জিহাদে নাই -বুঝতে হবে সে বড় জিহাদে তথা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হতে ব্যর্থ হয়েছে। এরা নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করেও পরিণত হয় শয়তানের সৈনিকে। এরা খুনি, সন্ত্রাসী, চোরডাকাত ও ভোটডাকাত হয়। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে এরাই ইসলামকে পরিজিত এবং ফ্যাসিবাদ, জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় হারাম মতবাদকে বিজয়ী করে রেখেছে।  

জ্ঞানের বিপ্লবই মানুষের দর্শনে বিপ্লব আনে। দর্শনের বিপ্লব থেকে সৃষ্টি হয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব। সভ্য মানব, সভ্য সমাজ ও সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের শুরু বস্তুত এ বুদ্ধিবৃত্তিক তথা দর্শনের বিপ্লব থেকে। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের শুরু বস্তুত এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই। সেটি দেখা গেছে নবীজী (সা:)’র আমলেও।  মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজটি শুরু করেছিলেন এই কুর’আন দিয়েই। তাই কুর’আনের এরূপ প্রয়োগ মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। এজন্যই নবীজী (সা:)’র উপর তাঁর প্রথম হুকুমটি ছিল “ইকরা” তথা পড়ো। নির্দেশ এখানে পবিত্র কুর’আন পড়া এবং তা থেকে জ্ঞানার্জন করা। সিরাতাল মুস্তাকীমের এটিই হলো শুরুর দিক। তাই  এই কাজটি সঠিক ভাবে সমাধা না করে পূর্ণ ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠা এবং ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি কখনোই সফল হয় না। অতীতে বহু দেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ এ কারণেই ব্যর্থ হয়ে গেছে। সে ব্যর্থতার মূল কারণ, শুরুর কাজটি তারা শুরুতে করেননি। পাকিস্তান তার উদাহরণ। দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি সেক্যুলারিস্টদের হাতে অধিকৃত থাকায় প্রচণ্ড ফাঁকিবাজী থেকে যায় কুর’আন থেকে শিক্ষা নেয়ার ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে।

 

নবীজী (সা)’র মোজেজা

হযরত মূসা (আ:)’র মোজেজা ছিল, তাঁর হাতের লাঠিটি মাটিতে ফেললে সেটি স্বর্পে পরিণত হতো এবং নড়াচড়া করতো। তাঁর হাত বগলে রাখলে তা সাদা হয়ে বেরিয়ে আসতো। হযরত ঈসা (আ:)’র মোজেজা ছিল, তিনি মৃতকে জীবিত করতেন; দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মানুষকে সুস্থতা দিতেন। কিন্তু নবীজী (সা:)’র মোজেজা ছিল ভিন্নতর। তিনি মাত্র ২৩ বছরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব গড়েছেন এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রের। মানব গড়া ও রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ -এ দুটি বিশাল কাজ একত্রে চলেছে। উভয় অঙ্গণে নির্মিত হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বরেকর্ড। অতি স্বল্প সময়ে সে রাষ্ট্র বিশ্বশক্তির মর্যাদা পায়। নবীজী (সা:)’র এ সাফল্য নিজেই এক বিশাল মোজেজা। নবীজী (সা:)’র নির্মিত রাষ্ট্রের বুকে নির্মিত হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এটিই হলো নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত বা লিগ্যাসি। মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কল্যাণটি করেছে নবীজী (সা:)’র এ রাজনৈতিক অর্জন। তাঁর হাতে নির্মিত রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে জনগণকে জান্নাতে নেয়ার বাহনে। সে রাষ্ট্র নির্মিত না হলে পৃথিবীর বিশাল ভূ-ভাগ থেকে মিথ্যা ধর্ম, অসত্য দর্শন, জুলুম, অবিচার ও দুর্বৃত্তির নির্মূল হতো না। সত্য, সুবিচার ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার কাজটিও হতো না। এবং সম্ভব হতো না কোটি কোটি মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো। লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেও এতবড় কাজটি করা যেত না। যেমন আজ সেটি সফল হচ্ছে না ।        

 

সর্বশ্রেষ্ঠ দান পবিত্র কুর’আন

মানুব জাতির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান হলো পবিত্র কুর’আন। এ পবিত্র কিতাবই জান্নাতের পথ দেখায়। তাই যে ব্যক্তি কুর‌’আন বুঝে এবং দৃঢ় ভাবে তাঁর বিধানকে আঁকড়ে ধরে -একমাত্র সে ব্যক্তিই জান্নাতের পথে চলার হিদায়েত পায়। সে ঘোষণাটি এসেছে পবিত্র কুর’আনে। বলা হয়েছে:

وَكَيْفَ تَكْفُرُونَ وَأَنتُمْ تُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ ءَايَـٰتُ ٱللَّهِ وَفِيكُمْ رَسُولُهُۥ ۗ وَمَن يَعْتَصِم بِٱللَّهِ فَقَدْ هُدِىَ إِلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ ١٠١

অর্থ: “অতঃপর তোমরা কিরূপে প্রত্যাখান করবে সত্যকে যখন তোমাদের তেলাওয়াত করে শোনানো হয় কুর’আনের আয়াত এবং তোমাদের মাঝে রয়েছেন তাঁর রাসূল। এবং যে আল্লাহকে (তথা তাঁর প্রদর্শিত পথ কুর’আনকে) দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরে -সেই হিদায়েত পায় সিরাতাল মুস্তাকীমের পথে।” -(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০১)। উপরিউক্ত আয়াতে যা অতি সুস্পষ্ট করা হয়েছে তা হলো, কুর‌’আনের পথই হলো হিদায়েতের একমাত্র পথ। বাঁকি সকল পথই নেয় জাহান্নামে। তাই যে জান্নাতে পৌঁছতে চায় তাঁকে অবশ্যই শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরতে হয় পবিত্র কুর’আনকে। কুর’আনকে আঁকড়ে ধরার অর্থ: কুর’আনের শিক্ষাকে পদে পদে অনুসরণ করা। সেটিই হলো সিরাতাল মুস্তাকীম। তাই যে ব্যক্তি দূরে সরে পবিত্র কুর’আন থেকে, সে বিচ্যুৎ হয় জান্নাতের পথ থেকে। এমন ব্যক্তিরাই ধাবিত হয় জাহান্নামের দিকে। তাই যারা জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে চায় এবং তাদেরকে জান্নাতে নিতে চায় তারা জনগণের মাঝে কুর’আন বুঝার সামর্থ্য সৃষ্টি করে। মহান আল্লাহতায়ালা এজন্য নামাজ-রোজার ফরজ করার আগে কুর’আন থেকে জ্ঞান লাভকে ফরজ করেছেন।

 

বিজয় পেয়েছে শয়তানের এজেন্ডা

অপরদিকে শয়তান ও তার অনুসারীদের লক্ষ্য এবং স্ট্র্যাটেজি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের লক্ষ্য, মানুষকে জাহান্নামে নেয়া। সে লক্ষ্য পূরণে জনগণকে কুর’আন থেকে দূরে রাখাই তাদের মূল স্ট্র্যাটেজি। সে লক্ষ্যপূরণে তারা দেশের স্কুল-কলেজে কুর’আন শিক্ষা বন্ধ রাখে। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে শয়তান ও তার অনুসারীগণ এ ক্ষেত্রে বিপুল ভাবে বিজয়ী। দেশটির স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর বহু লক্ষ ছাত্র শিক্ষা সমাপ্ত করে বের হয়। কিন্তু তাদের অধিকাংশই কুর’আন বুঝতে অক্ষম।  প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তি কুর’আন পড়লো না এবং পড়লেও কুর’আনের কথাগুলি বুঝলো না -এমন ব্যক্তি কুর’আনের পথে চলবে কিরূপে? জাহান্নামের পথ থেকে সে বাঁচবে কিরূপে? এমন দেশে কি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে মুজাহিদ জুটে? তারা বরং শয়তানী বাহিনীর সৈনিক রূপে সে পবিত্র জিহাদকে প্রতিহত করতে ময়দানে নামবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?  

পবিত্র কুর’আন পথ দেখায় শুধু ঈমানদার ব্যক্তি ও তাঁর পরিবার গড়ায় নয়, ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণেও। পৃথিবী পৃষ্ঠে এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ইসলামী রাষ্ট্রের মূল এজেন্ডা হলো নাগরিকদের সিরাতাল মুস্তাকীম চিনতে ও সে পথে চলতে সাহায্য করা। সে সাথে জনগণের সামর্থ্য বাড়ায় মহান রাব্বুল আলামীন থেকে মাগফিরাত লাভে। সেটি জনগণের মাঝে কুর’আন শিক্ষা ও কুর’আনী বিধানের অনুসরণকে সহজতর করে।  সে সাথে মিথ্যা দর্শন ও মিথা ধর্মকে নির্মূল করে। এ পৃথিবীপৃষ্ঠে এ কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নাই। খাদ্যপানীয় সংগ্রহ ও গৃহনির্মাণের কাজটি জনগণ নিজেই করতে পারে। কিন্তু সুশিক্ষা দানের ন্যায় ফরজ কাজটির দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কারণ, এ কাজটি জীবিকা সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত একজন সাধারণ মানুষের দ্বারা হয়না। একাজটি প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের। এ কাজটি সুষ্ঠ ভাবে সম্পাদিত করার জন্য জনগণ রাষ্ট্রকে রাজস্ব দেয়। এ রাষ্ট্র কতটা সভ্য ও সুশীল হবে সেটি নির্ভর করে শিক্ষাদানের ফরজ কাজটি কতটা সফল ভাবে হয়েছে -তার উপর। একটি দেশে অবিচার, মিথ্যচার ও দুর্বৃত্তির প্লাবন দেখে নিশ্চিত বলা যায় সুশিক্ষা দানের কাজটি সঠিক ভাবে হয়নি। কোন রাষ্ট্রে এ কাজটি যথার্থ ভাবে না হলে জনগণ পথ হারায় এবং ধাবিত হয় জাহান্নামে দিকে। অনৈসলামী রাষ্ট্র তো সে কাজটিই করে। সেটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কুর’আনের জ্ঞানদানকে বিলুপ্ত বা সংকুচিত করে। পৃথিবীপৃষ্ঠে একাজের চেয়ে ভয়ংকর নাশকতার কাজ দ্বিতীয়টি নাই। অপরাধ এখানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জাহান্নামের আগুনে নেয়ার। অথচ বাংলাদেশের মত অনৈসলামী দেশগুলিতে সে নাশকতার কাজটিই অতি ব্যাপক ভাবে হয়। এবং সেটি জনগণের রাজস্বের অর্থে। ফলে এসব দেশে একজন ছাত্র তার ২০-২৫ বছরের শিক্ষা জীবন শেষ করে পবিত্র কুর’আনের একটি আয়াত বুঝার সামর্থ্য অর্জন না করেই। ফলে আদায় হয় না জ্ঞান শিক্ষার ফরজ। এমন কুর’আনী-জ্ঞানশূণ্য ছাত্ররা সিরাতাল মুস্তাকীমে চলবেই বা কিরূপে? জান্নাতের পথই বা সে কিরূপে পাবে?  

 

রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে শয়তানের হাতিয়ারে                                                                       

জান্নাতের পথটি শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দোয়া-দরুদের পথ নয়। এ পথ নানারূপ পেশাদারী, রাজনীতি, পরিবার পালন, প্রশাসন, বিচার-আচার, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধবিগ্রহের পথ। এসবের প্রতি অঙ্গণে এবং প্রতি মুহুর্তে কুর’আনী রোডম্যাপ অনুসরণ করতে হয়। অনৈসলামী রাষ্ট্রগুলি তার নাগরিকদের মাঝে সে পথে চলার সামর্থ্য যেমন সৃষ্টি করে না, তেমনি সে পথে চলার অধিকারও দেয় না। অনৈসলামী রাষ্ট্রে বসবাসের এটিই হলো সবচেয়ে বড় বিপদ। এমন রাষ্ট্রে জনগণ অনাহারে মারা না গেলেও বাঁচে ও বেড়ে উঠে জাহন্নামে পৌঁছার জন্য। মুসলিমদের গৌরব যুগে একটি মাত্র রাষ্ট্র ছিল। সে রাষ্ট্রটি যেহেতু ইসলামী ছিল, তার কল্যাণকর অবদান ছিল বিস্ময়কর। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহ নাগরিকদের কুর’আনী রোডম্যাপের উপর খাড়া করেছিল। সে ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণে বিশ্বের নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলের মানুষ জাহান্নামের পথ ছেড়ে জান্নাতের পথ পেয়েছিল।

সে আমলের একটি মাত্র ইসলামী রাষ্ট্র তার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি নিয়ে মানব জাতির যে বিশাল কল্যাণটি করেছিল -তা আজকের ৫০টির বেশী মুসলিম রাষ্ট্র তার ১৫০ কোটির অধিক মুসলিম জনসংখ্যা নিয়েও করতে পারছে না। এসব রাষ্ট্রের শাসকগণ সবাই মিলে মুসলিম উম্মাহর ভৌগলিক সীমানাকে এক ইঞ্চিও বাড়াতে পারিনি। শুধু তাই নয়, বহু মুসলিম ভূমিকে তারা কাফির শক্তির হাতে তুলে দিয়েছে। বহু মুসলিম দেশের মানচিত্রকে তারা খণ্ডিত ও সংকুচিত করেছে। এরা খেলাফতকে বাঁচাতে পারিনি। সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকেও বাঁচাতে পারিনি। কাফিরদের সাহায্য নিয়ে যেমন খেলাফত ও পাকিস্তানকে ভেঙ্গেছে, তেমনি এক আরব ভূমিকে ২২ টুকরোয় খণ্ডিত করেছে। মুসলিম ভূমিকে ক্ষুদ্রতর করা নিয়েই তাদের বিজয় উৎসব। সে বিভক্তিকে বাঁচানো নিয়েই তাদের সকল রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও রণপ্রস্তুতি। এভাবে এক দিকে যেমন বাড়িয়েছে নিজেদের গুনাহ’র অংক, তেমনি আনন্দ ও বিজয় বাড়িয়েছে ব্রিটিশ, ফরাসী, মার্কিন ও ভারতীয়দের ন্যায় শত্রুশক্তির। অথচ ইসলামে একতা গড়া ফরজ এবং বিভক্তি গড়া হারাম। হারাম-হালালের সে বিধানকে তারা পদদলিত করেছে। এসব স্বার্থান্বেষী দুর্বৃত্ত শাসকদের একটিই এজেন্ডা, সেটি যে কোন উপায়ে ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত থাকা। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বিজয়, শরিয়তের প্রতিষ্ঠা, মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতা এবং মুসলিম নর-নারীর ইজ্জত ও জান-মালের সুরক্ষা -এসব নিয়ে ইসলামশূণ্য এই শাসকদের কোন ভাবনা নাই।   

মুসলিম উম্মাহর আজকের বিশাল ব্যর্থতার মূল কারণ, মুসলিম রাষ্ট্রগুলির কোনটিই ইসলামী নয়। অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রই ফ্যাসিবাদী শাসক,  স্বৈরাচারী রাজা-বাদশাহ ও জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের হাতে অধিকৃত। এ শাসকগণ নিজেরাই হাইজ্যাক করেছে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব এবং বিলুপ্ত করেছে তাঁর শরিয়তী আইন। প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তাদের নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও আইন। তাদের ঘোষিত এজেন্ডাটি কখনোই রাষ্ট্রকে সিরাতাল মুস্তাকীমে পরিচালানো করা নয়। বরং সে পথে চলা তাদের কাছে সেকেলে ও পশ্চাদপদতা গণ্য হয়। সেরূপ এক ভ্রষ্ট দর্শন ও বিচার নিয়ে তারা নিজেরাই ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। মুসলিম দেশবাসীকে তারা ইসলাম থেকে দূরে সরাচ্ছে এবং জাহান্নামের পথে ধাবিত করছে। ফলে এ রাষ্ট্রগুলি নামে মুসলিম হলেও পরিণত হয়েছে শয়তানের এজেন্ডা পূরণের হাতিয়ারে। পৃথিবী পৃষ্ঠে এর চেয়ে অধিক নাশকতার কাজ আর কি হতে পারে? এটি তো কোটি কোটি মানুষকে জাহান্নামের আগুনে ফেলার নাশকতা। অথচ আজকের মুসলিম শাসকগণ দিবারাত্র ব্যস্ত সে নাশকতার কাজে। তাদের কারণে অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রই আজ ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য অতি অরক্ষিত ও বিপদজনক ভূমি। ফলে প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার মুসলিম অমুসলিম দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। মুসলিমদের জন্য এর চেয়ে বড় অপমানের কাজ আর কি হতে পারে?  

 

কুর’আনের সাথে ছিন্ন-বন্ধন এবং বিচ্যুতি সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে

সিরাতাল মুস্তাকীমে চলার কাজের শুরুটি পবিত্র কুর’আন ও হাদীস থেকে জ্ঞানার্জন দিয়ে। এ মাইল-ফলক অতিক্রম না করে তথা পবিত্র কুর’আনের শিক্ষা আত্মস্থ ও অনুসরণ না করে জান্নাতের চলা ও সেখানে পৌঁছা অসম্ভব। তখন অসম্ভব হয় তাকওয়া-সমৃদ্ধ মানব সৃষ্টি। এবং অসম্ভব হয় ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। অথচ মুসলিমদের দ্বারা শুরুর সে কাজটিই হচ্ছে না। কুর’আনী জ্ঞানদানের সে বিশাল কাজটি নিছক বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের সামর্থ্য বাড়িয়ে হয় না। সে জন্য অপরিহার্য হলো, পবিত্র কুর’আন থেকে সরাসরি জ্ঞান-লাভ এবং কর্ম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে জ্ঞানের পূর্ণ প্রয়োগ। কুর’আনই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাথে মানবের একমাত্র যোগসূত্র। কুর’আনের মাধ্যমেই তিনি মানুষের সাথে কথা বলেন। ফলে একমাত্র কুর’আনী বিধান অনুসরণের মাধ্যমেই তাঁর সাথে মজবুত সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। তখন সে গভীর যোগসূত্রটি কাজ করে তাঁর থেকে সাহায্য নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ তো এ পথেই অগ্রসর হয়েছিলেন। ফলে তারা যেমন তাঁর সাহায্য পেয়েছেন, তেমিন বিজয়ও পেয়েছেন। অথচ যারা দূরে সরে পবিত্র কুর’আন থেকে, তারা দূরে সরে মহান আল্লাহতায়ালা থেকেও। তখন দূরে সরে সিরাতাল মুস্তাকীম থেকেও।  সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুৎ হওয়ার আলামত তো বহু। সেটি যেমন মুসলিম ভূমিতে ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়তী বিধান ও মুসলিম ঐক্য না থাকা, তেমনি মুসলিমদের মাঝে অজ্ঞতা, অবিচার, অসত্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদ না থাকা ।  

চিন্তাশীলতা ইসলামে পবিত্র ইবাদত। এটি নবীজী (সা:)’র হাদীস। প্রকৃত ঈমানদারের প্রতিটি কথা, কাজ, লেখনি, বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতির মধ্যে কাজ করে তাঁর গভীর চিন্তাশীলতা। সে চিন্তাশীলতা থেকেই ব্যক্তির জীবনে আসে নৈতিক বিপ্লব। নিছক মুসলিমের ঘরে জন্ম নেওয়ার কারণে সেটি আসে না। যার মধ্যে সে চিন্তাশীলতা নেই, তার পক্ষে অসম্ভব হয় প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। চিন্তাশূণ্য ব্যক্তির সংখ্যা যে সমাজে অধিক, সে সমাজে অসম্ভব হয় ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি। তাই মুসলিমের  সামনে মাত্র দু’টি পথ। এক). চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল নৈতিক মানব রূপে বেড়ে উঠা। দুই). চিন্তাশূণ্য গরু-ছাগল হওয়া। আর গরু-ছাগল তো বেড়ে উঠে জবাই হওয়ার জন্য। তখন তাদের গর্দানে যেমন ধারালো ছুরি চলে, তেমনি মাথার উপর বর্ষিত হয় ড্রোন, মিজাইল ও বোমা। গরু-ছাগলের ন্যায় তাদেরও প্রতিবাদের ভাষা থাকে না। প্রতিরোধের সামর্থ্যও থাকে না। কুর’আনী রোডম্যাপ থেকে দূরে সরার কারণে মুসলিমগণ পৌঁছেছে এই করুণ পরিণতির গহ্বরে। অথচ এমন করুণ পরিণতির হুশিয়ারি মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে বার বার শুনিয়েছেন। পরিতাপের বিষয় হলো, সে কঠোর হুশিয়ারিতে তারা কর্ণপাত করেনি। আরো বিপদ হলো, সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে দূরে সরা এই লোকদের জন্য এর চেয়েও ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষা করছে আখেরাতে।  সেটি জাহান্নামের লেলিহান আগুন।

 

মানব যেভাবে মহামানব হয়

মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা নৈতিক মানব রূপে বেড়ে উঠার উপর জোর দিয়েছেন। তাই বার বার জোর দিয়েছেন চিন্তাশীলতার উপর। ব্যক্তির চিন্তাশীল মন হলো ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধি আনার পাওয়ার হাউস। দেয় বিস্ময়কর সৃষ্টিশীলতা। ব্যক্তির ঈমানে ও আমলে উঠানামা ঘটে এ পাওয়ার হাউস সচল ও বিকল হওয়ার কারণে। ব্যক্তির জীবনে বিস্ময়কর মূল্যসংযোজন বা ভ্যালু-এ্যাড করে তার এই চিন্তা-ভাবনা। সে আত্ম-উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি অবিরাম সচল থাকলে মানুষ ফেরেশতাদের চেয়েও উঁচু স্তরে পৌঁছতে পারে। তখন মানব পরিণত হয় মহামানবে। মহান আল্লাহতায়ালা তো এমন মানুষদের নিয়েই ফেরেশতাদের মহলে গর্ব করে থাকেন। যে কারণে তিনি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবকে সৃষ্টি করেছিলেন -সে এজেন্ডাটি তো এভাবেই সফল হয়। এজন্যই নবীপাক (সা)’র হাদীস: “আফজালুল ইবাদাহ তাফাক্কুহ।” অর্থ: উত্তম ইবাদত হলো চিন্তাভাবনা করা। চিন্তা-ভাবনার প্রক্রিয়া বন্ধ হলে মানুষ নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করেও দুর্বৃত্ত হয়। সূদখোর, ঘুষখোর, প্রতারক, খুনি, স্বৈরাচারী, জনগণের ভোটচোর, সম্পদচোর ও ভোটডাকাত হয়। 

চিন্তাশীল সৎ মানুষ সৃষ্টিতে সুবিশাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় লাগে না। বিশাল আকারের মাদ্রাসাও লাগে না। কুঁড়ে ঘরে বসবাস করেও সেটি সম্ভব। সে সৃষ্টিশীল কাজটি সবুজ প্রকৃতি, ধুসর মরু, নীল আকাশ, মূক্ত আকাশের দিকে তাকিয়েও ঘটে। এসবের মাঝে মহান আল্লাহতায়ালার অতি শিক্ষণীয় আয়াত তথা নিদর্শনের সন্ধান মেলে। নবীজী (সা:)’র আমলে তো সেটিই হয়েছে। সে আমলে কোন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। কিন্তু জ্ঞানের উৎপাদনে প্রতিটি মুসলিমের মনের ভূবনটি প্রকান্ড পাওয়ার হাউসে পরিণত হয়েছিল। ফলে সমগ্র মানব ইতিহাসে মানব চরিত্রে ও কর্মে সবচেয়ে বেশী মূল্য সংযোজন হয়েছিল সে সময়। সে মূল্য সংযোজনের ফলে আরবের অসভ্য মানুষগুলো ফেরেশতাদের চেয়েও উপরে উঠতে পেরেছিলেন। তারাই জন্ম দিয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সভ্যতার। সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে তাঁরাই হলো সর্বাধিক গর্বের। গৌরব যুগের সে মুসলিমগণ শুধু রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিরই জন্ম দেয়নি, জ্ঞানের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভান্ডারও গড়ে তুলেছিলেন। কুর’আনের আগে আরবী ভাষায় কোন লিখিত বই ছিল না। সে আরবী ভাষাকে তারা সমকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষাতে পরিণত করেন। এর মূলে ছিল তাদের চিন্তশীল সৃষ্টিশীলতা। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে আজকের ব্যর্থতার কারণ, তারা ব্যর্থ হয়েছে এরূপ চিন্তাশীল মানব সৃষ্টিতে। অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র আজ অধিকৃত স্বৈরশাসকদের হাতে। তারা চিন্তাশীলতার শত্রু। কারণ, চিন্তাশীলতা স্বাধীনতা চায়। অথচ স্বৈরশাসকগণ সে স্বাধীনতার শত্রু।  তারা জানে, জনগণকে স্বাধীনতা দিলে তাদের স্বৈরশাসন বাঁচেনা। ফলে স্বৈরশাসকগণ শুধু ইসলামেরই শত্রু নয়, তারা শত্রু হলো গণতন্ত্র, মানব-উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও।  

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না পাওয়ায় মুসলিমগণ আজ পথ হারিয়েছে। তারা তেল, গ্যাস, চা, পাট, তুলা ও বস্ত্রের গায়ে মূল সংযোজন নিয়ে ব্যস্ত। সরকারের প্রায়োরিটির তালিকায় গুরুত্বই হারিয়েছে মানব-উন্নয়ন। খোদ মানব হয়েছে চরম অবমূল্যায়নের শিকার। অর্থাৎ দিন দিন মূল্য কমছে মানুষের। সরকার নিজেই যেখানে ক্ষমতালোভী ও স্বার্থান্বেষী দুর্বৃত্ত, সেখানে সরকারি উদ্যোগে প্লাবন আনা হয়েছে দুর্বৃত্তিতে। কারণ দুর্বৃত্ত সরকার তার ডাকাত বাহিনীতে আরো লোকবল চায়। আর সেটি সবচেয়ে বেশী বেশী হয়েছে বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে। অথচ ইসলামে দুর্বৃত্তি নির্মূল ও সুবিচারের কাজটি অতি পবিত্র ইবাদত। এটি জিহাদ। অথচ বাংলাদেশে চুরিডাকাতি, ব্যাংকলুট, বিদেশে অর্থপাচার, ট্রেজারী থেকে বিদেশী মুদ্রা লুট, প্রকল্পের অর্থলুট -এগুলি করছে সরকারি দল ও প্রশাসনের লোকজন। এতে ফল দাঁড়িয়েছে, দুর্বৃত্তিতে দেশটি বিশ্বের সকল দেশকে ছাড়িয়ে ৫ বার প্রথম হয়েছে। চারিত্রিক ধ্বস ও ইসলাম থেকে দূরে সরার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে? এটি সম্ভব হয়েছে ব্যক্তির চেতনা থেকে পরকালে জবাবদেহীতার ধারণা বিলুপ্ত বা দুর্বল হওয়ার কারণে। চিন্তাশূণ্যতার এই হলো ভয়ানক পরিণাম। সেটি ঘটেছে রাষ্ট্র ও সমাজ সেকুলারাইজড হওয়ার কারণে। শিক্ষাদানের নামে চিন্তাশূণ্য গোলাম বানানোর যে প্রক্রিয়া ব্রিটিশগণ চালু করেছিল, বাংলাদেশে আজও সে ঔপনিবেশিক ধারা অব্যাহত রয়েছে। সেকুলারাইজড করার নামে তারা মুসলিমদের ইসলাম থেকেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। বিলুপ্ত করেছে আল্লাহতায়ালার কাছে জবাবদেহীতার ভয়। এভাবে সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে যেমন বিচ্যুত করেছে, তেমনি অচল করে দিয়েছে সুচিন্তা ও সত্য-উপলব্ধি করার সামর্থ্য। সেকুলারিজমের মূল বিপদ তো এখানেই।

                              

শত্রুশক্তির স্ট্র্যাটেজি: ইসলাম থেকে জনগণকে দূরে সরানো

পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের মূল স্ট্র্যাটেজি মুসলিমদেরকে নাস্তিক বানানো বা মুর্তিপূজায় ফিরিয়ে নেয়া নয়, বরং দ্রুত সেকুলারাইজড করা তথা ইসলাম থেকে দূরে সরানো। অর্থাৎ সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে দূরে সরানো। একাজে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের পার্টনার রূপে বেছে নিয়েছে মুসলম দেশের স্বৈরাচারী সেক্যুলারিস্ট সরকারকে। এমন কি তথাকথিত ইসলামী দলগুলোকে। যারা ইসলামী বিপ্লবের সত্যিকার সৈনিক, শত্রুদের এ কৌশলকে অবশ্যই বুঝতে হবে এবং তাদের কাজের শুরু হতে হবে সেকুলারাইজেশনের এ প্রকল্পের কার্যকর মোকাবেলার মধ্য দিয়ে। দেশে শুধু বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ইতিহাস-ভূগোলের চর্চা বাড়িয়ে মুসলিমদের ঈমান বাঁচানো যায় না। বাঁচানো যায় না দুর্বৃত্তি থেকেও। এ বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো মহান আল্লাহর দেওয়া প্রেসক্রিপশনে ফিরে যাওয়া। সে প্রেসক্রিপশনটির নিছক পাঠে নয়, মনোযোগী হতে হবে তা থেকে ঔষধ সেবনেও। একমাত্র এ পথেই মুসলিম মনে গড়ে উঠে সকল মিথ্যা মতবাদ ও মিথ্যা ধর্মের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ ক্ষমতা তথা ইম্যুনিটি। তখন প্রচণ্ড দুর্বৃত্তি, উলঙ্গতা ও অশ্লিলতাপূর্ণ সমাজে বসবাস করেও ঈমানদার ব্যক্তি ঈমান হারায় না।  নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ তো সে কুর’আনী প্রেসক্রিপশনের সাহায্য নিয়েই সে আমলের অতি নিরেট সেকুলারিজমের মোকাবেলা করেছিলেন। অথচ সে যুগের সেকুলারিষ্টগণ ছিল আজকের সেকুলারিষ্টদের চেয়েও কট্টোর।

সেকুলারিজমের আভিধানিক অর্থ পার্থিব স্বার্থচেতনা নিয়ে বাঁচা। এ মতবাদটির মোদ্দাকথা রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ময়দানকে পরকালীন জীবনের ভাবনা থেকে দূরে রাখা। সেকুলারিস্টগণ তাই তাদের দৈহিক, আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যের সবটুকু খরচ করে পার্থিব কল্যাণ সাধনের তাড়নায়। অন্তহীন আখেরাতের প্রসঙ্গটি  তাদের হিসাব-নিকাশ থেকেই বাদ পড়ে যায়।  এরাই হলো সমাজের সবচেয়ে ব্যর্থ মানুষ। কারণ যে অনন্ত অসীম আখেরাতে তাদের মূল বসবাস -সেখানে তাদের পাওয়ার কিছু থাকে না। এদের সম্মন্ধে মহান আল্লাহতায়ালার নিজের ভাষ্যটি হলো:

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِٱلْأَخْسَرِينَ أَعْمَـٰلًا ١٠٣

ٱلَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا ١٠٤

অর্থ: “বলুন হে মহম্মদ! তোমাদের কি বলে দিব, আমলের দিক দিয়ে কারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত? এরাই হলো তারা যাদের সমগ্র প্রচেষ্টা পণ্ড হয় পার্থিব জীবনের ভাবনায় এবং তারা মনে করে কর্মপ্রচেষ্টায় তারা ভালই করছে।“ –(সুরা কাহাফ, আয়াত ১০৩-১০৪)।  

অথচ ইসলাম মানুষকে পরকালমুখী করে। সেটিই তো শেষ ঠিকানা। এবং সেটি এক অন্তহীন কালের জন্য -যেখানে কোন রোগ-ভোগ ও মৃত্যু নাই। তাই মহান আল্লাহতায়ালা চান, ব্যক্তির পার্থিব সকল কর্ম ও ভাবনাগুলো নিয়ন্ত্রিত হোক জান্নাতপ্রাপ্তীর ভাবনা থেকে। সেটিই তো সঠিক বুদ্ধিমত্তা। এরূপ আখেরাতের ভাবনা থেকেই ঈমানদারের জীবনে অবশ্যই জিহাদ চলে আসে। চলে আসে রাষ্ট্রদখল এবং সে রাষ্ট্রে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী বিধান প্রতিষ্ঠার তাড়না। কারণ, সেটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার একমাত্র পথ। তখন সৃষ্টি হয় মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদে শহীদ হওয়ার প্রেরণা। সেটি গণ্য হয় সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম রূপে। তখন ঈমানদারের সকল প্রচেষ্টা ও বাঁচা-মরার লক্ষ্য হয় স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা। মহান আল্লাহতায়ালার খুশিই তাঁর নিজের খুশিতে পরিণত হয়। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালার পথে লড়াই ঈমানদারের আমৃত্যু মিশনে পরিণত হয়। তখন বিপদে পড়ে সেকুলারিষ্টদের কায়েমী স্বার্থ। ইসলামপন্থীদের সাথে সেকুলারিস্টদের মূল বিরোধ তো এখানেই। ব্যক্তিজীবনে সেক্যুলারিস্টদের সবাই যে আখেরাতকে অবিশ্বাস করে তা নয়, বহু সেক্যুলারিস্ট নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতও পালন করে। তবে তাদের সমস্যা হলো, আখেরাতের কল্যাণের ভাবনা থেকে তাদের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও স্বেচ্ছাচারি জীবন-উপভোগ নিয়ন্ত্রিত হোক -সেটি তারা চায় না। তারা ব্যর্থ হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা সাথে একাত্ম হতে।  

বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে মুসলিমদের এতো নিচে নামার মূল কারণ, তাদের মাঝে চিন্তাশীলতার অভাব। চিন্তাশীলতার অভাব হলে, বার বার পূর্ণ কুর’আন পাঠ করেও কুর’আন থেকে শিক্ষাগ্রহণের কাজটি হয় না। কারণ খাদ্য-পানীয় গ্রহনে যেমন সুস্থ জিহ্বা লাগে, কুর‌’আন থেকে শিক্ষা গ্রহণে তেমনি চিন্তাশীল মন লাগে। চিন্তাশীলতার সামর্থ্য না থাকলে কর্ম, চরিত্র ও রাজনীতিতে বিপ্লব আসা দূরে থাক, সামান্য পরিবর্তনও আসে না। পবিত্র কুর’আনের এমন পাঠকগণ অফিসে বসে ঘুষ খায়, মানুষকে ধোকা দেয়, মিথ্যা বলে, চিহ্নিত দুর্বৃত্তকে ভোট দেয়, হিন্দুত্ববাদী শত্রুর দালালকে নেতা বানায়, ভোটচোর ও ভোটডাকাতকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলে এবং আগ্রাসী কাফের রাষ্ট্রকে বন্ধুরাষ্ট্র রূপে গ্রহণ করে। বাংলাদেশে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পক্ষ থেকে তো সেটিই হচ্ছে।  নির্বাচন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তখন ইসলামের প্রতিরোধে হাতিয়ারে পরিণত হয়। একজন কাফের, মুনাফিক এবং ফাসেকও কুর’আন পড়তে পারে। কিন্তু বিশুদ্ধ কুর’আন পাঠের সে সামর্থ্য কি হিদায়েত-লাভের সামর্থ্য সৃষ্টি করে? সেটি করে না বলেই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে তারা আগ্রহী হয়না। সে কাজের জন্য তো চাই কুর’আন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও সে সাথে কুর’আনী নির্দেশের অনুধাবনের সামর্থ্য। এজন্য চাই, কুর’আনের ভাষায় কুর’আনকে বুঝার জ্ঞান। এবং সে সাথে চাই কুর’আনের বয়ান নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনার অভ্যাস। কুর’আনের অনুবাদ পড়ে তা থেকে আত্ম-বিপ্লব এবং সে সাথে রাষ্ট্র-বিপ্লবের প্রেরণালাভ প্রায় অসম্ভব। যিনি নিবিষ্ট মনে কুর’আন পাঠ করেন তাঁর বর্ণনা মহান আল্লাহপাক দিয়েছেন এভাবে:

إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ ءَايَـٰتُهُۥ زَادَتْهُمْ إِيمَـٰنًۭا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ

অর্থ: “একমাত্র মু’মিন তারাই যাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয় যখন তাদের সামনে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন কুর’আনের আয়াত পাঠ করে শোনানো হয়, তখন তাদের ঈমানে বৃদ্ধি ঘটে এবং তারা ভরসা করে প্রতিপালকের উপর।“-(সুরা আনফাল, আয়াত ২)। উপরিউক্ত আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা প্রকৃত ঈমানদারের মনের অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন, ঈমানদার একমাত্র তারাই যাদের মন আল্লাহর নামের স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে ভয়ে কেঁপে উঠে এবং কুর’আনের আয়াত শোনা মাত্রই তাদের ঈমান বেড়ে যায়। ভয়ে কেঁপে উঠার কারণ, জাহান্নামের আগুনের ভয় এবং বিচার দিনে সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহতায়ালার সামনে দাঁড়িয়ে নিজ আমলের জবাবদেহীতার ভয়। সুরা আনফালের উপরিউক্ত আয়াতটি অতিশয় ভীতিকর।  হযরত হাসান বাসরী (রহ:)কে একবার এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি কি ঈমানদার? সুরা আনফালের এই আয়াতটির বরাত দিয়ে তিনি বলেছিলেন, এ আয়াতটির কথা মনে পড়লে নিজের ঈমান নিয়ে সন্দেহ হয়।  

প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তি কুর’আনের আয়াতগুলির অর্থই বুঝে না এবং জানে না রোজ হাশর ও জাহান্নামের পরিচয়, তার মন কি ভয়ে কেঁপে উঠে? সে তো অন্ধ ও বধির ব্যক্তির ন্যায়। অন্ধ ও বধির ব্যক্তির সামনে আল্লাহতায়ালার নামের যিকির বা জাহান্নামের বর্ণনা যত বারই পাঠ করা হোক না কেন, তাতে তার মন ভয়ে কেঁপে উঠবে না। বধির হওয়ার কারণে মহান আল্লাহতায়ালার নামের যিকির ও কুর’আনের বাণী তো তার মগজেই ঢুকে না। আর মগজে না ঢুকলে তা ভয়ই বা সৃষ্টি করবে কিরূপে? মনের গভীরে আল্লাহতায়ালার ভয় তথা তাকওয়া সৃষ্টির জন্য তাই জরুরি হলো কুর’আন বুঝার সামর্থ্য। এজন্য সে সামর্থ্য অর্জন করা ইসলামে ফরজ। সে সামর্থ্য না থাকায় বহু নামাজী, বহু রোজাদার, বহু হাজী, বহু পীর এবং বহু মোল্লা-মৌলভী প্রচণ্ড ভাবে ব্যর্থ হয় প্রকৃত ঈমানদার হতে। আর যে ব্যক্তি ঈমানদার হতে ব্যর্থ হয় সে কি একাত্ম হতে পারে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে? এবং যে দেশে এরূপ ব্যর্থ মুসলিমের সংখ্যা অধিক, সে দেশে কি কখনো ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত হয়? কারণ এ কাজে তো এমন ঈমানদার চাই যারা শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতই পালন করে না, আল্লাহতায়ালার পথে তারা নিজেদের অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্ত বিনিয়োগে রাজী।    ২৭/০৬/২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *