অধ্যায় এগারো: পাকিস্তানের ব্যর্থতা ও বাঙালীর হিস্যা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 29, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
বাঙালীর ব্যর্থতা
এ নিয়ে দ্বিমত নেই, পাকিস্তান বহু ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়ছে। কিন্তু সে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কি শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীরা? তাতে পূর্ব পাকিস্তানীদের হিস্যা কতটুকু? দেশের সাফল্যের ন্যায় ব্যর্থতার দায়ভারও তো জনগণের। অথচ বাঙালীদের মাঝে প্রবল প্রবনতাটি হলো, পাকিস্তানের সকল ব্যর্থতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঘাড়ে দোষ চাপানো। নিজেদের ব্যর্থতা দিকে তারা নজর দিতে রাজী নয়। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬% ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানী। ফলে নানারূপ ব্যর্থতা থেকে দেশকে বাঁচানোর সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানীদের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সমগ্র পাকিস্তানের শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের অগ্রগতিতে সংখ্যার অনুপাতে অংশ নেয়া দূরে থাক, এমনকি নিজ প্রদেশের নিজস্ব রাজনীতিতেও তারা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের মত পূর্ব পাকিস্তানে চারটি প্রদেশ ছিল না। নানা ভাষা, নানা অঞ্চল ও নানা বর্ণের বিভক্তিও ছিল না। কিন্তু যেটি ছিল তা হলো ক্ষমতালোভীদের আত্মঘাতি রাজনীতি। আর রাজনীতিতে আত্মঘাত থাকলে সে দেশের ধ্বংসে কি বিদেশী শত্রুর প্রয়োজন পড়ে? সে আত্মঘাতি রাজনীতির কারণে বাঙালী পূর্ব পাকিস্তানীগণ নিজেদের ঘর গোছাতেই চরম ভাবে ব্যর্থ হয়। ফলে পশ্চিম পাকিস্তান যেখানে কৃষি, শিল্প ও শিক্ষায় দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে, পূর্ব পাকিস্তান সেখানে আত্মঘাতি রাজনীতির গভীরে লাগাতর ডুবতে থাকে। বড় কিছু করা দূরে থাক, খেলাধুলার ন্যায় হালকা বিষয়েও তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। বিপদের আরো কারণ, সে বিশাল বিশাল ব্যর্থতা ও আত্মঘাতি রাজনীতি নিয়ে বাঙালী রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝে কোন আত্মজিজ্ঞাসা বা আত্মসমালোচনাও হয় নাই। নিজেদের ত্রুটিগুলোর দিকে নজর না দিয়ে তাদের প্রধান কাজটি হয় অবাঙালীদের ত্রুটি তালাশ।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থপরতা ও বালখিল্যতার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন আওয়ীম লীগ, শেরে বাংলার কৃষক শ্রমিক প্রজা পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, গণতন্ত্রি দল ও খেলাফতে রাব্বানী পার্টি ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তভাবে নির্বাচন করে। নির্বাচনে তারা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করে বিপুল ভাবে বিজয় লাভ করে। ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৮টি আসন তারা লাভ করে। কিন্তু বিজয়ের পর পরই নেতারা লিপ্ত হয় আত্মঘাতি লড়াইয়ে। অঙ্গদলগুলি একে অপরের শত্রু মনে করতে থাকে। প্রত্যেক দলই চেষ্টা করে, অপরদলের নেতাদের কিভাবে ক্ষমতার মঞ্চ থেকে দূরে রাখা যায়। যুক্তফ্রন্টের পার্লামেন্টারী নেতা ছিলেন শেরে বাংলা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে তাকেই সরকার গঠন করতে বলা হয়। ১৯৫৪ সালের ২রা এপ্রিল তিনি প্রথম মন্ত্রীসভা গঠন করেন মাত্র তিনজন মন্ত্রী নিয়ে। বাদ দিয়েছিলেন যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দল সোহরাওয়ার্দী ও ভাষানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগকে। তিনজন মন্ত্রীর মধ্যে একজন ছিল তার ভাগিনেয় সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া। এটি কি কম স্বজনপ্রীতি? সরকার গঠনের প্রায় দেড় মাস পর ১৫ই মে তিনি মন্ত্রীসভায় আওয়ামী লীগের সদস্যদের শামীল করেন। এরপর শেরে বাংলার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনে আওয়ামী লীগ। এরপর শেরে বাংলাকেও সরতে হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হন শেরে বাংলার দল থেকেই জনাব আবু হোসেন সরকার। ১৯৫৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর তাঁকেও যেতে হয়। ক্ষমতায় আসেন আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান। তার ভাগ্যেও সরকারে থাকা বেশী দিন সম্ভব হয়নি। তাকে সরিয়ে ১৯৫৮ সালের ১৯শে জুন আবার ক্ষমতায় আসেন আবুল হোসেন সরকার। এবার তিন দিন পর ২২ জুন তারিখে আবার তাঁকেও সরতে হয়। -(সা’দ আহম্মদ, ২০০৬)।
এভাবে পূর্ব পাকিস্তানীরা সমগ্র পাকিস্তানের কি নেতৃত্ব দিবে, দারুন ভাবে ব্যর্থ হয় নিজ প্রদেশের রাজনীতিতে। ঘন ঘন সরকার গঠন ও ভাঙ্গা দেখে ভারতীয় নেতারা তখন ব্যঙ্গ করে বলতো,ভারতীয় রমনীরা যে রূপ শাড়ী বদল করে ঢাকায় তেমন সরকার বদল হয়। যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদলগুলির মাঝে সংঘাত এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে প্রাদেশিক পরিষদের মধ্যেই তারা খুনোখুনী করে। পরিষদের ডিপুটি স্পীকার জনাব শাহেদ আলীর মাথায় গুরুতর ভাবে আঘাত করে। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান। স্পীকারের অনুপস্থিতিতে সেদিন তিনিই সভাপতিত্ব করছিলেন। উল্লেখ্য, সেদিন প্রাদেশিক সংসদের সে খুনোখুনির জলসায় কোন অবাঙালী ছিল না, কোন পশ্চিম পাকিস্তানী বা পাঞ্জাবী আমলা বা সেনাকর্মকর্তাও ছিল না। এ খুনোখুনির কাণ্ডটি ঘটেছিল প্রকৃত অর্থেই সম্পূর্ণ বাঙালী ঘটনা, যা ঘটে বাঙালী সদস্যদের হাতে। যেহেতু বাঙালীর সকল দূর্ভোগের জন্য পাঞ্জাবীদের দায়ী করা হয়, এ বিষয়টি এজন্যই লক্ষ্য করার মত। আরো দুঃখজনক হলো, এ হত্যকাণ্ডটি ঘটেছিল প্রকাশ্য দীবালোকে, অথচ তার কোন বিচার বিভাগীয় তদন্ত সে সময়ের যুক্তফ্রন্ট সরকার করেনি। ফলে এ গুরুতর অপরাধের জন্য কারো কোন শাস্তি হয়নি, কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি। সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে সঠিক সাক্ষী দেয়ার জন্যও কোন ব্যক্তি এগিয়ে আসেননি। অথচ কোন সভ্য দেশে মানুষ খুন হবে এবং তার বিচার হবে না -সেটি কি আশা করা যায়? এ নীতি তো জঙ্গলবাসী ডাকাতদের। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা দেশটিকে যে কতটা মগের মুল্লুকে পরিণত করেছিল -এ হলো তার নমুনা।
কালিমা লেপনের রাজনীতি
অতি উদ্ভট ও লজ্জাজনক বিষয়, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে প্রাদেশিক পরিষদের স্পীকারকে পাগল রূপে ঘোষণা দিয়েছিল। যেন ভোট দিয়ে একজন মানুষকে পাগলও বানানো যায়! এই হলো তাদের সংসদীয় গণতন্ত্র। পাকিস্তানের গণতন্ত্র চর্চা তাদের কাছে যে কতটা তামাশায় পরিণত হয়েছিল -এ হলো তার নমুনা। সত্তরের দশকে শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ একই ভাবে কালিমা লেপন করেছিল বাংলাদেশের মুখে। বহু দলীয় পার্লামেন্টারী পদ্ধতির ওয়াদা দিয়ে নির্বাচন করে কয়েক মিনিটের মধ্যে একদলীয় প্রেসেডেন্ট পদ্ধতি চালু করে। এ নিয়ে সংসদে আলোচনা করার প্রয়োজনও বোধ করেনি। এরূপ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা জনগণ থেকে ম্যান্ডেট নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। দেশ পরিচালনায় এতোটাই অযোগ্যতার পরিচয় দেয় যে, দেশের জন্য অর্জন করে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির খেতাব।
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী নাগরিকগণ দেখেছে, অনেক অবাঙালী তাদের পুঁজি ও মেধা বিনিয়োগ করছে পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু নিজেরা পশ্চিম পাকিস্তানে একখানি কারখানাও নির্মাণ করেনি। নিজেদের সীমানাও যথাযথ পাহারা দিতে পারেনি। সে ব্যর্থতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত সেদিন পরিণত হয়েছিল চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্য। কি প্রশাসন, কি রাজনীতি, কি পার্লামেন্টারী বিতর্ক, কি সীমান্ত প্রতিরক্ষা, কি শিল্পায়ন – সব কিছুতে বাঙালীর ব্যর্থতা শুধু একাত্তর-পরবর্তী বিষয়ই নয়,ষোল কলায় বিকশিত হয়েছিল পাকিস্তানী আমলেও। সব সময়ই সকল ব্যর্থতার দায়ভার অন্যদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্ঠা হয়েছে সর্বাত্মক ভাবে। পাকিস্তান আমলে প্রচণ্ড অহংকার চেপেছিল এ নিয়ে, সমগ্র পাকিস্তানে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ রূপে তাদের দায়ভার যে অন্য সবার চেয়ে বেশী -সে বিষয়টি তাদের রাজনীতিতে গুরুত্বই পায়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে তো যোগ্যতা লাগে না, কিন্তু যোগ্যতা লাগে দায়িত্ব পালনে। একটি ট্রেনের অর্ধেক বগি যদি সামনে ছুটে আর অর্ধেক যদি পিছনের দিকে ধেয়ে যায়,সে ট্রেন তো দুই টুকরো হবেই। পশ্চিম পাকিস্তানীদের তাড়না ছিল দ্রুত পারমানবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মুসলিম দেশে পরিণত হওয়ায়। আর বাংলাদেশীগণ ছুটেছে ভারতের আঁচলের নীচে থেকে দ্রুত তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি বা দুর্নীতিতে বিশ্বে অন্ততঃ ৫ বার প্রথম হওয়ায়। অতিশয় রুঢ় ও অপ্রিয় হলেও এটিই যে সত্য -তার প্রমাণ তো ইতিহাস।
শুরু থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে ব্যর্থতাটি প্রকট ভাবে দেখা দেয় তা হলো, একটি শাসনতন্ত্র তৈরীর ব্যর্থতা। অবশেষে সে কাজে সফলতা আসে ১৯৫৬ সালে। সেটি অবাঙালী প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে। অথচ সে সময়ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা আদৌ সহায়ক ছিল না। সে সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা জনাব অলি আহাদ তার বই “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫” তে লিখেছেন, “১৯৫৬ সালে প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তান মুসলিম লীগ, শেরে বংলা এ,কে,ফজলুল হকের নেতৃত্বে পরিচালিত যুক্তফ্রন্টভুক্ত কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (আব্দুস সালাম খান পরিচালিত),সিডিউল কাষ্ট ফেডারেশন, পাকিস্তান কংগ্রেস, ইউনাইটেড প্রোগেসিভ পার্টি ও গণতন্ত্রী দলভুক্ত সদস্যবৃন্দের সমবেত ভোটে সংবিধান গৃহীত হয়। কিন্তু জনাব সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সদস্যবৃন্দ প্রতিবাদে গণ-পরিষদ হল হতে “ওয়াক আউট করে ও চূড়ান্তভাবে গৃহীত শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষরদানে বিরত থাকে।” -(অলি আহাদ)। স্বাক্ষর না করার কারণ,পূর্ব পাকিস্তানকে পর্যাপ্ত স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়নি। অথচ এই সোহরাওয়ার্দীই যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন তখন সে কথা সম্পূর্ণ ভূলে যান। ১৯৫৭ সালের ১৪ই জুন ঢাকার পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেন, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। আর তাঁর গণতান্ত্রিক মানসিকতার কথা? আওয়ামী লীগে তখন চরম অভ্যন্তরীণ বিরোধ। জনাব সোহরাওয়ার্দী তখনও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব ভাষানীর সাথে তাঁর বিরোধ তখন তুঙ্গে। বিষয়, পররাষ্ট্র নীতিসহ আরো বেশ কিছু বিষয়। মন্ত্রীত্ব বনাম এসব সাংগাঠনিক মতবিরোধ সম্পর্কে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জনাব সোহরাওয়ার্দী বলেন, “আওয়ামী লীগ আবার কি? আমিই আওয়ামী লীগ।” অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বিস্ময়করভাবে অবলীলাক্রমে বলেন, “আমিই আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো।”-(অলি আহাদ)।
আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা
রাজনীতি ও গণতন্ত্র চর্চায় আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার শুরু স্রেফ মুজিব আমল থেকে নয়। বরং বহু পূর্ব থেকেই। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে আওয়ামী লীগের বড্ড অহংকার। কিন্তু সেটি কি আদৌ সত্য? আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকেই কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৪৭ সালের ৫ই আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারী পার্টি বৈঠকে খাজা নাজিমুদ্দীন ৭৫-৩৯ ভোটে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পরাজিত করে পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নির্বাচিত হন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী এ পরাজয় সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেননি। সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয়, এটি ষড়যন্ত্র। তিনি ও তাঁর সদস্যগণ নিজ দলের গণতান্ত্রিক রায়ের প্রতিও যে কতটা গোস্বা হয়েছিল এ হলো তার নমুনা। মনের দুঃখে প্রথমে তিনি ভারতে থেকে যাওয়ার মনস্থ্য করেন। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে তিন কোন স্থান পাননি। পরে পাকিস্তানে আসেন, তবে ঢাকাতে নয়। তিনি কোলকাতা থেকে সরাসরি লাহোর অভিমুখে রওনা দেন। কথা হলো, গণতান্ত্রিক রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাহীন এমন নেতাদের হাতে কি গণতন্ত্র চর্চা নিরাপদ হয়? গণতন্ত্রের রায়কে তারা তখনই মানতে রাজী,যখন সেটি নিজেদের পক্ষে যায়। জনাব সোহরাওয়ার্দীর মাঝে সেরূপ অসুস্থ চেতনার উদাহরণও কি কম? ১৯৫৩ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মহাম্মদ যখন জনাব খাজা নাজিম উদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করেন তখন তার সে অগণতান্ত্রিক, অন্যায় ও অবৈধ পদক্ষেপকে জনাব সোহরাওয়ার্দী পল্টনে জনসভা ডেকে সমর্থন জানান। অথচ তখন দেশের গণপরিষদে জনাব নাজিম উদ্দিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন ছিল। বরখাস্ত করার আগে জনাব গোলাম মুহম্মদ প্রধানমন্ত্রী জনাব নাজিম উদ্দিনকে সংসদে সেটি প্রমাণেরও সুযোগ দেননি। লক্ষ্যণীয় হলো, জনাব সোহরাওয়ার্দীই পাকিস্তানের রাজনীতিতে মুজিবের ন্যায় পাকিস্তানের আজন্ম শত্রুদের পুনর্বাসিত করেন।
দেখা যাক, পাকিস্তানী আমলে শেখ মুজিবের গণতন্ত্র চর্চার নমুনা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়। যুক্তফ্রন্টের শরীক দল ছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৫৬’য়ের সেপ্টম্বরে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার মন্ত্রী হন। তখন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আতাউর রহমান খান। শেখ মুজিব তখন আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অধিবেশনে গৃহীত গঠনতন্ত্রের ৬৬ ধারা মোতাবেক শেখ মুজিবের উপর অবশ্য পালনীয় ছিল যে মন্ত্রী হওয়ার সাথে সাথে দলীয় পদ থেকে ইস্তাফা দিবেন। উক্ত ধারায় সুস্পষ্ট ছিল যে, অন্যথায় এক মাস পরে উক্ত কর্মকর্তার পদ শূন্য বলে গণ্য হবে। দলের অন্যান্য মন্ত্রী যেমন আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহম্মদ ও খয়রাত হোসেন দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করলেও মুজিব তা করেননি। -(অলি আহাদ)।
মানুষের আসল চরিত্র ধরা পড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তার আচরণে। এমন কি অতিশয় দুর্বৃত্তরাও দুর্বৃত্তির বিশাল কাণ্ডটি জনসম্মুখে ঘটায় না। কারো বাড়ীতে আগুন লাগা দেখে অতি ডাকাত প্রকৃতির ব্যক্তিও মহল্লার অন্যদের সাথে মিলে সেটি নেভাতে যায়। কারণ এটি বিশাল ব্যাপার। এ কাজে এগিয়ে না আসলে তার বিবেকহীন পশু চরিত্রটি জনসম্মুখে প্রকাশ পায়। সমাজে কেউ কি এরূপ বিবেকহীন রূপে চিত্রিত হতে চায়? কিন্তু খুঁটিনাটি বিষয়ে দুর্বৃত্তরা ততটা সতর্ক থাকে না বলেই তাদের আসল চরিত্র ক্ষুদ্র বিষয়ে বেরিয়ে আসে। তাই ব্যক্তির গুনাগুণ যাচায়ে উত্তম উপায় হলো মামুলী বিষয়ে তার আচরণটি দেখা। যারা বড় মাপের নেতা, তাদের পক্ষে মাঠ পর্যায়ে নেমে কর্মীদেরকে পয়সা দিয়ে নিজের নামে প্লাকার্ড লিখতে বলার সময় হয় না। এমন কাজে তাদের রুচীও থাকে না। কিন্তু শেখ মুজিব এমন তুচ্ছ কাজেও ময়দানে নেমেছেন। সে কাজে ঢাকা থেকে ভৈরবের ন্যায় মফস্বলের শহরে ছুটে গেছেন। তার উদাহরণ দেয়া যাক। আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ও শেখ মুজিবের অতি ভক্ত আব্দুর রউফ তার বইতে লিখেছেন,“১৯৫০ সালে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ভৈরবে। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। আওয়ামী লীগের জনসভা উপলক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে তখন ভৈরবে। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা আসবেন। তাই আমরা সবাই একই সাথে প্রচুর উৎসাহ আর দারুণ উদ্বেগের মধ্যে কাজ করে চলেছি। কলেজ হোস্টেলে হলো আমাদের কাজের প্রধান কেন্দ্র। একদিন পোস্টার লেখা, প্লাকার্ড বানানো আর অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার মুহুর্তে এক দীর্ঘাদেহী সুদর্শন যুবক ঢুকলেন রুমে। … মুজিব ভাইকে কাছে পেয়ে আমাদের সকলের কাজের উৎসাহ কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ..যাওয়ার সময় ছাত্রকর্মী হায়দারের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, “তোরা কিছু খেয়ে নিস”। ..যেতে যেতে তিনি হেসে আমাদেরকে বললেন,“তোরা এতো পোস্টার-প্লাকার্ড বানাচ্ছিস, তোদের মুজিব ভাইয়ের নামে কি একটাও করবি না।” ইঙ্গিতেই কাজ হয়েছিল। জনসভার দিন দেখা গেল মওলানা ভাষানীর নামে প্লাকার্ড ছিল, শেখ মুজিবের নামে তার থেকে কম ছিল না, জিন্দাবাদ ধ্বনিও তার নামে কম দেয়া হয়নি।”-(আব্দুর রউফ, ১৯৯২)। এই হলো মুজিবের চরিত্র। নিজের ইমেজ তৈরীতে মেধা নয়, যোগ্যতাও নয়, এরূপ নীচু মানের সস্তা পথ বেছে নিয়েছিলেন।
পণ্ড হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শেষ সুযোগ
শেখ মুজিব ও ভাষানীর ন্যায় ব্যক্তিদের আত্মঘাতি রাজনীতিই সামরিক শাসন দ্বিতীয়বার ডেকে এনেছিল ১৯৬৯ সালে। সে সময় শাসন ক্ষমতায় ছিল আইয়ুব খান। তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের উভয় প্রদেশে শুরু হয় চরম গণ-আন্দোলন। আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। তখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হত ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের ভোটে। আইয়ুব খান এর নাম দিয়েছিলেন মৌলিক গণতন্ত্র। সম্মিলিত বিরোধী দলের দাবী ছিল, সকল প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং পার্লামেন্টারী পদ্ধতির শাসন। আইয়ুব খান এ দুটি দাবী মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব দাবী করে বসলেন,৬ দফাও মেনে নিতে হবে। নির্বাচনে যাওয়ার ধৈর্য্য তাঁর ছিল না। অথচ ৬ দফা নিয়ে বিরোধী দলগুলি মধ্যে ঐকমত্য ছিল না। ফলে আইয়ুব খানেরও সেটি মেনে নেয়ায় আগ্রহ ছিল না। ফলে সৃষ্টি হলো চরম রাজনৈতিক অচলাবস্থা। অথচ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নেয়া হয়েছিল সম্মিলিত বিরোধীদলের জোট পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক মুভমেন্ট (PDM)এবং DAC আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। নইলে শেখ মুজিবসহ বহু আওয়ামী লীগ নেতা তখন জেলে ছিলেন। তখন আওয়ামী লীগের একার পক্ষে তেমন জোরদার অন্দোলন গড়ে তোলাও সম্ভব ছিল না। অথচ আওয়ামী লীগ সম্মিলিত বিরোধী দলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পিছন থেকে চাকু ডুকিয়ে দেয়। পরের বছরেই প্রমাণ হলো, পাকিস্তানের জন্য এটিই ছিল গনতন্ত্রের শেষ ট্রেন। মুজিবের কারণে সেটিও হাতছাড়া হয়ে যায়। দেশ আবার নিক্ষিপ্ত হলো অস্থিতিশীল অবস্থায়। এমন অবস্থায় একমাত্র বিদেশী শত্রুরাই খুশি হয়। আর পাকিস্তানের জন্য এমন শত্রুর অভাব ছিল না। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট এবং ইসরাইল তেমন একটি অবস্থার জন্য পূর্ব থেকেই অপেক্ষায় ছিল। আইয়ুব চলে গেলেন কিন্তু জাতি ব্যর্থ হলো শান্তিপূর্ণ ভাবে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যেতে। ক্ষমতায় এলো আরেক সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ফলে পরের দিনগুলি আরো রক্তাত্ব হলো। তাই এ করুণ পরিণতির জন্য শুধু কি সামরিক বাহিনীকে দায়ী করা যায়?
ভাষানীর আত্মঘাতি রাজনীতি
সত্তরের নির্বাচনে মাওলানা ভাষানী ও তার দল চীনপন্থী ন্যাপ অংশ নেয়নি। তাতে তার নিজের দলের যেমন কল্যাণ হয়নি, তেমনি কল্যাণ হয়নি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেরও। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নির্বাচনের অংশ না নিলে কি দলের অস্তিত্ব থাকে? পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেখ মুজিবের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন ভাষানী। ভাষানীই ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে বনিবনা না হওয়ায় তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়েন। সোহরাওয়ার্দী পরে ভারত থেকে এসে দলটিতে যোগ দেন। পররাষ্ট্র নীতি ও স্বায়ত্বশাসন নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সাথে মাওলানা ভাষানীর বিরোধ শুরু হয় ও পরে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গড়ে তোলেন। দলটির নেতাকর্মীদের অনেকে প্রকাশ্যে ন্যাপ করলেও গোপনে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সম্পর্ক খারাপ হয় ১৯৬২ সাল থেকে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছিল ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তান ভারতকে সহায়তা দিক –বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তরপূর্ব চীন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশে। চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের খাতিরে আইয়ুব খান চীনাপন্থী কম্যুনিস্টদের উপর থেকে হুলিয়া তুলে নেন। এবং যারা জেলে ছিল তাদেরকে মুক্তি দেন। প্রতিদানে মাওলানা ভাষানী ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুবের প্রতিদ্বন্দী সর্বদলীয় বিরোধীদলীয় প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনি প্রচারনা থেকে দূরে থাকেন। আন্তর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধ এভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকে দারুন ভাবে প্রভাবিত করে। সত্তরের নির্বাচন কালে দলটি প্রধান পাঁচটি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বৃহত্তম উপদলটি ছিল দলটির সেক্রেটারি ছিলেন নোয়াখালীর মহম্মদ তোহা ও যশোরের আব্দুল হকের। নির্বাচন নিয়ে চীনপন্থী কম্যুনিস্টদের কোনরূপ আগ্রহই ছিল না, তাদের অনেকেই মার্কসবাদী লেলিনবাদী সন্ত্রাসের পথ ধরে। বিভক্ত দল নিয়ে নির্বাচনী বিজয়ে কোন সম্ভাবনা না দেখে মাওলানা ভাষানী নির্বাচনই বয়কট করেন। দাবী তুলেন, ভোটের আগে ভাত চাই। শুরু করেন “জ্বালাও পোড়াও”‘য়ের আন্দোলন। তার এরূপ অগণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রচণ্ড লাভবান হয় শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবের যা জনপ্রিয়তা ছিল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার চেয়ে অনেক বেশী সিট অর্জন করে। ফলে দেশের রাজনীতি পুরাপুরি হাইজ্যাক হয়ে যায় শেখ মুজিবের হাতে। একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির ব্যাপারেও ন্যাপ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। দলের প্রবীন নেতা রংপুরের মশিউর রহমান যাদু মিয়া এবং যশোরের আব্দুল হক অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নেন। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকে তারা এলাকায় ভারতীয় সাম্রাজ্যের বিস্তার বলে আখ্যায়ীত করে। নোয়াখালীর মহম্মদ তোয়াহার ন্যায় অনেকেই আবার পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নেন। তবে নির্বাচন থেকে দূরে থাকায় একাত্তরে যুদ্ধ শুরুর আগে বা পরে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাওলানা ভাষানীর তেমন গুরুত্ব থাকেনি। একাত্তরে তিনি ভারতে আশ্রয় নেন, এবং সাথে সাথে গৃহবন্দির শিকার হন। একাত্তরের পর দেশে ফিরেও তিনি তার ভাঙ্গা দলকে আর জোড়া লাগাতে পারেনি। ফলে তার মৃত্যুর আগেই তার রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটে। তার জীবদ্দশাতেই ন্যাপের নেতাকর্মীগণ তাকে ছেড়ে দলে দলে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি’তে যোগ দেয়। কাজী জাফেরের ন্যায় অনেকে স্বৈরাচারী এরশাদের দলেও যোগ দেয়। রাশাদ খান মেননে ন্যায় অনেক আবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে মিশে গেছে।
শেরে বাংলার বিভ্রাট
দেখা যাক,তৎকালীন শীর্ষ নেতাদের নীতি ভ্রষ্টতার আরো কিছু বিষয়। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ১৯৫৪ সালের ৩০শে এপ্রিল তারিখে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালে কলকাতায় এক সংবর্ধনা সভায় অত্যন্ত আবেগজড়িত বলেন, “রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে বিভক্ত করা যেতে পারে, কিন্তু বাঙালীর শিক্ষা, সংস্কৃতি আর বাঙালিত্বকে কোন শক্তিই কোনদিন ভাগ করতে পারবে না।”-(সা’দ আহম্মদ, ২০০৬)। তিনিই ভুলেই গেলেন, ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোরের মিন্টো পার্কে মুসলিম লীগের সম্মেলনে তিনিই পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। তখন পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে কায়েদে আযমের মূল যু্ক্তিটি হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের রাজনৈতিক বিবাদ ছিল না, বরং সেটি ছিল দুটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক, আদর্শিক, শিক্ষাগত ও জীবনলক্ষ্যের ভিন্নতা। বাঙালী রূপে বেড়ে উঠার বিষয়টিই মুসলমানদের জীবনে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়, বরং তাদের রাজনীতির মূল এজেন্ডা হলো নিজ দেশে মুসলমান রূপে বেড়ে উঠার বিষয়টি নিশ্চিত করা। আম গাছের জলবায়ুগত প্রয়োজনটি আঙ্গুর গাছ থেকে ভিন্নতর, তেমনি একজন মুসলমানের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত পরিবেশটি একজন অমুসলিম থেকে ভিন্নতর। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনটি দেখা দিয়েছিল এ ভিন্নতর প্রয়োজনটি মেটাতে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পিছনে এটিই ছিল মূল দর্শন বা ফিলোসফিকাল কনসেপ্ট। এ বিষয়টিই কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহ তার বক্তৃতায় বার বার তুলে ধরেছিলেন। ভারতীয় মুসলিমদের সে ধর্মীয় ও আদর্শগত প্রয়োজনটি মেটানোর তাগিদেই পাকিস্তানের জন্ম হয়। ভারতের সাধারণ মুসলিমগণ কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহর সে যুক্তিটি বুঝলেও শেরে বাংলা যে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন -সেটি ধরা পড়ে তার বক্তৃতায়। প্রশ্ন হলো, এমন বিভ্রান্তিকর চেতনা নিয়ে কি তিনি ইসলামের নামে অর্জিত পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের নেতা হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতে পারেন? এমন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়ার জন্যই পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাঁর স্থান অতি সংকীর্ণ হয়ে যায়। কলিকাতায় দেয়া তাঁর ভাষণের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের এক সময়ের বাঙালী প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ আলী বোগড়া পর্যন্ত তাঁকে ভারতের দালাল বলেছেন। এরূপ বিভ্রান্তিকর চেতনার কারণে তাঁকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো এমনকি অনেক বাঙালী মুসলিম নেতাও বিপদজনক মনে করতেন। ফল দাঁড়ালো, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করলেন। তবে শেরে বাংলা ফজলুল হকের বিভ্রান্তি শুধু কলকাতায় দেয়া বক্তব্যেই সীমিত ছিল না। এর পূর্বেও তিনি অতি বিভ্রান্তিকর চেতনার স্বাক্ষর রেখেছিলেন মুসলিম বিদ্বেষী চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল হিন্দু মহাসভার সাথে স্বাধীনতা-উত্তর অবিভক্ত বাংলার কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। তখন তিনি কোমর বেঁধে লেগেছিলেন, মুসলিম লীগকে ক্ষমতায় যাওয়া থেকে ঠ্যাকাতে।
সোহরাওয়ার্দীর অভিনব তত্ত্ব
দেখা যাক আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কুশলতা ও মুসলিম প্রীতির নমুনা। ১৯৫৬ সালে যখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী; তখন ইসরাইল, বৃটেন ও ফ্রান্স একযোগে মিশরের উপর হামালা করে। হামলার কারণ, মিশর সরকার সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেছিল। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব সে হামলার নিন্দা করে। নিন্দা করে এমনকি তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। প্রবল ভাবে নিন্দা করে ভারত। এমনকি সে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিনীদের চাপেই অবশেষে সে যুদ্ধ থেমে যায়। হামলাকারি ইসরাইল, ব্রিটেন ও ফ্রান্স তখন লেজগুটিয়ে সুয়েজ খাল এলাকা থেকে পালাতে বাধ্য হয়। মিশরের সরকার ও জনগণ অধীর আগ্রহে তাকিয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের দিকে। অথচ সে সময় আওয়ামী লীগ নেতা ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সিদ্ধান্তটি ছিল সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত। তিনি সে আগ্রাসনের নিন্দা না করে বলেছিলেন, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মোকাবিলার শক্তি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নাই। তখন তিনি অভিনব সূত্র শুনান, “শূণ্যের সাথে শূণ্যের যোগে শূণ্যই হয়।” এভাবে তিনি রাজনীতিতে পাটিগণিতের যোগবিয়োগের অংক নিয়ে আসেন। অথচ মুসলমান যত দুর্বলই হোক তাদের মধ্যে একতা গড়া ও একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া নিছক রাজনীতি নয়, পাটিগণিতের অংকও নয়, এটি পবিত্র ইবাদত। সে লক্ষ্যে কাজ করা প্রতিটি মুসলমানের উপর নামায-রোযার ন্যায় ফরয। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর চেতনায় তার লেশ মাত্র ছিল না। সাম্রাজ্যবাদীদের হামলার নিন্দা করার জন্য যে ন্যূনতম মূল্যবোধ দরকার সেটুকুও তিনি দেখাতে পারেননি। তাঁর এ নীতির ফলেই আরব বিশ্বের সাথে বিশেষ করে মিশরের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের দারুন অবনতি ঘটে। আজও সে অবনতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। দেশটি এরপর থেকে ভারতমুখি হয়। আওয়ামী লীগের আত্মঘাতি রাজনীতির পাশাপাশি ব্যর্থ পররাষ্ট্র নীতির এ হলো এক নমুনা।
গণতন্ত্র বিনাশে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র-প্রীতি নিয়ে আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৫৪ সালের কথা । মোহাম্মদ আলী বোগড়া তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রেসিডেন্ট না বলে ব্রিটিশ আমলের খেতাব অনুযায়ী গভর্নর জেনারেল বলা হত। পার্লামেন্টকে বলা হত গণপরিষদ। গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা ছিল তিনি ইচ্ছা করলে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বোগড়া গভর্নর জেনারেলের এ ক্ষমতা রহিত করে গণপরিষদে একটি বিল আনেন। বিল চূড়ান্ত বিবেচনার জন্য গণপরিষদে পেশ করার পর প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে গণপরিষদে সেটি পাশও হতে যাচ্ছিল। পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তখন গভর্নর জেনারেল ছিলেন প্রাক্তন আমলা জনাব গোলাম মোহম্মদ। প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে গভর্নর জেনারেল এ বিল আইনে পরিণত হওয়ার আগেই ২৩শে অক্টোবর গণপরিষদই ভেঙ্গে দেন।
তখন গোলাম মহম্মদকে সহয়তা দেন সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল আইউব খান। পাকিস্তানী গণতন্ত্র চর্চার বিরুদ্ধে এটি ছিল গুরুতর ছুরিকাঘাত। এরপর গণতন্ত্রচর্চা পাকিস্তানে তার হৃত স্বাস্থ্য আর ফিরে পায়নি। সে সময় গণপরিষদের মূল দায়িত্বটি ছিল শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। এটিই ছিল পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ। কিন্তু সে কাজটি সমাধা করার সময় পায়নি। তখন পাকিস্তানের গণপরিষদের স্পীকার ছিলেন ফরিদপুরের মৌলবী তমিজ উদ্দীন খান। তিনি আদালতে গভর্নর জেনারেলের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সে মামলায় সিন্ধুর হাইকোর্টে তিনি জিতলেও সুপ্রিম কোর্টে হেরে যান। সুপ্রিম কোর্টের এ রায়টি পাকিস্তানের বিচার-ইতিহাসে আজও বিতর্কিত। কিন্তু গভর্নরের সে অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের প্রতি অতি দ্রুত সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। তখন দলটির নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। “দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী করাচি থেকে এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শাখার সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান ঢাকা হতে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে গভর্নর জেনারেলের অগণতান্ত্রিক কাজকে সমর্থণ করেন। শেখ মুজিব তখন জেলে, তিনি তখন দলের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সেক্রেটারি। ঢাকার সেন্ট্রাল জেল থেকে শেখ মুজিব টেলিগ্রাম যোগে পাকিস্তান গণপরিষদের অন্যায় ও অবৈধ বিলুপ্তিকে স্বাগত জানান। এমনকি গোলাম মোহাম্মদের এই বিধি বহির্ভূত অন্যায় ফরমানের পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষে আতাউর রহমান ঢাকা থেকে এবং মাহমুদুল হক ওসমানি করাচি থেকে বিদেশে অবস্থানরত শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও লন্ডনে অবস্থানরত মওলানা ভাসানীর সমীপে গমন করেন।…. ১৪ই নভেম্বর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের ঢাকা আগমন উপলক্ষে পদচ্যুত মুখ্যমন্ত্রী ও রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণের সুস্পষ্ট ঘোষণাকারী শেরে বাংলা এ,কে,ফজলুল হক ও জনাব আতাউর রহমান খান ঢাকা বিমান বন্দরে স্বৈরাচারী গভর্নর জেনারেলকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলেন। বিমান বন্দরে তাঁহাকে কে মাল্যভূষিত করবেন এই সমস্যায় জর্জরিত দুই নেতাকে উদ্ধার করলেন গভর্নর জেনারেল স্বয়ং। অর্থাৎ তিনি শেরে বাংলা ও আতাউর রহমান খানের দুই হাত একত্রিত করিয়া যুগপাৎ মাল্যদানের সুযোগ করিয়া দিয়া উভয়েরই ধন্যবাদার্হ হইলেন।”-(অলি আহাদ)
গ্রন্থপঞ্জি
- সা’দ আহম্মদ।আমার দেখা সমাজ ও রাজনীতির তিনকাল (বৃটিশ–ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশ),ঢাকা:খোশরোজ কিতাব মহল,২০০
- অলি আহাদ।জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫,ঢাকা:বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড।
- আব্দুর রউফ।আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও আমার নাবিক জীবন,ঢাকা:প্যাপিরাস প্রকাশনী, ১৯৯২।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018