অধ্যায় চার: বাঙালী নির্মূল ও গণহত্যার প্রসঙ্গ
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 30, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
যুদ্ধ কি বাঙালীর বিরুদ্ধে পাঞ্জাবীর?
বাংলাদেশের সেক্যুলারিষ্টদের পক্ষ থেকে একাত্তরের সংঘাতকে দেখা হয়েছে বর্ণবাদী জাতিয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এ লড়াইকে বলা হয়েছে বাঙালীর সাথে পাঞ্জাবীর লড়াই। আসলেই কি তাই? নুরুল আমীন, ডা. অব্দুল মোত্তালেব মালেক, আব্দুর সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী র ন্যায় হাজার হাজার ব্যক্তি, মুসলিম লীগ, পিডিপি, জামায়াতে ইসলামী, নিজামে ইসলামীর ন্যায় বহু সংগঠন, রাজাকার বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্য যে পাকিস্তানের পক্ষে লড়লো -সে তথ্য কি তারা ভূলে গেছেন। অপর দিকে সকল পশ্চিম পাকিস্তানীরাও কি পাঞ্জাবী ছিল? খোদ জেনারেল ইয়াহিয়া খানও পাঞ্জাবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাঠান। পাকিস্তান আর্মির পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডার ছিলেন আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। তিনিও ছিলেন পাঠান। ঢাকার কমাণ্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব। তিনিও ছিলেন পাঠান। একাত্তরের যুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের কমাণ্ডারদের মধ্যে পাঞ্জাবী ছিলেন জেনারেল জগতজিৎ সিং অরোরা। এবং তিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর। ফলে একাত্তরের যুদ্ধ পাঞ্জাবীর সাথে বাঙালীর যুদ্ধ হয় কি করে? একাত্তরের মিথ্যাচারিদের মিথ্যাচারটি এখানেও। বস্তুত এটি ছিল একটি রাজনৈতিক লড়াই। অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষের লোকদের সাথে বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লড়াই। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক্ষেত্রেও মিথ্যাচার হয়েছে; প্রকৃত সত্যটি তুলে ধরা হয়নি।
পশু রূপে ইয়াহিয়া
বাংলাদেশের ইতিহাসে অতি কুৎসিত ভাবে চিত্রিত করা হয়েছে ইয়াহিয়া খানকে। পোষ্টারে তাকে বড় বড় দাঁত ও শিংওয়ালা পশুর ন্যায় এঁকে সারা বাংলাদেশের দেয়ালে দেয়ালে লাগানো হয়েছে। পশু রূপে চিত্রিত করা হয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যদের। অপরদিকে সর্বকালের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে চিত্রিত করা হয়েছে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ নিয়েও কি কম মিথ্যাচার! যে পাকিস্তানী সৈন্যদের শেখ মুজিব ও তাঁর ভক্তরা পশু রূপে চিত্রিত করেছেন তারা ২৫ মার্চ তারিখে তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তার গায়ে সেদিন তারা একটি আঁচড়ও দেয়নি। দেহে কোন আঘাতের চিহ্ন না নিয়েই তিনি ফিরে এসেছিলেন পাকিস্তানের জেল থেকে। অথচ সে সময় পাকিস্তানীদের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল একজন গাদ্দার তথা বিশ্বাসঘাতক রূপে। যুদ্ধকালীন ৯ মাস মুজিবের পরিবার ঢাকা শহরেই নিরাপদে বসবাস করেছে। পাকিস্তান সরকার মুজিব পরিবারের জন্য মাসিক ভাতারও ব্যবস্থা করেছে। অপর দিকে শেখ মুজিব –যাকে চিত্রিত করা হয় জাতির পিতা রূপে, তাঁকে ও তাঁর পরিবারে সদস্যদের নিহত করেছে মুক্তিবাহিনীর সেসব বাঙালী সদস্যরা যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছে। শেখ মুজিব শুধু একা নয়, ৪ লাখেরও বেশী সামরিক ও বেসামরিক বাঙালী নাগরিক পাকিস্তান থেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরেছেন। তাদের ঘরবাড়ীর উপর হামলা হয়েছে বা বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারীদের ন্যায় তাদের বস্তিতে পাঠানো হয়েছে -সে প্রমাণ একটিও নাই। তা হলে সত্যটি কি দাঁড়ালো?
মার্কিন গবেষক ও প্রফেসর Richard Sisson এবং Leo Rose এর অভিমত, ইয়াহিয়া খান আন্তরিক ভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার প্রতিকারে আন্তরিক ছিলন।-(Sisson & Rose, 1990)। বাংলাদেশের ইতিহাসে ইচ্ছাকৃত ভাবেই অবিচার হয়েছে তাঁর মূল্যায়নে। একথা অস্বীকারের উপায় নেই, তিনিই একমাত্র পাকিস্তানী রাষ্ট্রপ্রধান যিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈষম্য ও অবিচারকে মনেপ্রাণে স্বীকার করে নেন এবং প্রতিকারেরও ব্যবস্থা করেন। একমাত্র তিনিই এক রাষ্ট্রনায়ক যিনি এক ব্যক্তি এক ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের শতকরা ৫৬ ভাগ সদস্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত করার বিধান প্রণোয়ন করেন। এর ফলে বিশ্বের সর্ব বৃহৎ মুসলিম দেশের শাসনক্ষমতার উপর বাঙালী মুসলমানদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার এই প্রথম সুযোগ আসে। ফলে সুযোগ আসে পাকিস্তানের উপর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্ব এবং সে সাথে বিশ্ব-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার। ইয়াহিয়া খানের নেয়া এ নতুন পদক্ষেপের কারণে ভূট্টোর ন্যায় পশ্চিম পাকিস্তানের বহু সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি তাঁর উপর খুশি ছিলেন না। ১৯৫৬ সালের সংবিধান তৈরী কালে দুই প্রদেশের নেতাগণ বহু দর কষাকষি করে এক কক্ষ বিশিষ্ঠ জাতীয় সংসদে সমতার বিধানটি মেনে নেন। এবং শর্তরূপে বিলুপ্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশ ও সংসদের উচ্চ পরিষদ। কারণে উচ্চ পরিষদে পূর্ব বাংলার একটি প্রদেশের তূলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশের অধীক প্রতিনিধিত্ব ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের বহু নেতার অভিযোগ ছিল, ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের মিজরটি শাসনের পদদলে সঁপে দিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা জনাব সহরোয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন স্বায়ত্বশাসনের দাবী তুলেছিলেন মাওলানা ভাষানী। তাঁর সে দাবীর জবাবে জনাব সহরোওয়ার্দী বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়্ত্ত্বশাসন দেয়া হয়ে গেছে। ইয়াহিয়া খানই একমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান যিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনে পূর্ব পাকিস্তানীদের দ্রুত প্রমোশন দিয়ে ইসলামাবাদে কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারিয়েটে সমতা আনার আন্তরিক চেষ্টা করেছিলেন। লন্ডন এবং নিউয়র্কের দূতাবাস গুলোতে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা তখন প্রায় অর্ধেকে পৌঁছে যায়।-(সাজ্জাদ হোসেন, ১৯৯৩)। বাঙালী মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুজিবের বড় অপরাধ, তিনি তাদেরকে পাকিস্তানের মত বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন, -যা আজ পারমাণবিক শক্তিও বটে। এবং সঁপে দিয়েছেন ভারতের চরণতলে। সেটি নিছক ক্ষমতার লোভে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়া খান হঠাৎ একাত্তরের ২৫ মার্চে নাযিল হননি। পূর্ব পাকিস্তানের সাথে তার সম্পৃক্ততা ছিল বহু বছরের। তিনি তাঁর কর্ম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় পূর্ব পাকিস্তানে কাটিয়েছেন। তখন বাঙালীদের সাথে কীরূপ ছিল তাঁর আচরণ? বাংলাদেশের ইতিহাসের বড় অজ্ঞতা হল, যে ব্যক্তিকে বাঙালীর সবচেয়ে বড় শত্রু রূপে চিহ্নিত করা হয় তাঁর সম্মদ্ধেও তাদের ইতিহাস জ্ঞান অতি সামান্য। অজ্ঞতার গভীরতা এতোটাই প্রকট যে তার মত একজন পাঠানকেও বলা হয় পাঞ্জাবী। এক সময় তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমাণ্ডার ছিলেন। তখন নির্দেশ দিয়েছিলেন,“তাঁর বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে কোনরূপ বিদ্বেষ ছড়ানো যাবে না।সেটি কেউ করলে তাঁর অধিনে তার চাকুরি থাকবে না।” একবার সে অভিয়োগ উঠেছিল ২জন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারের বিরুদ্ধে। তিনি সাথে সাথে তাদেরকে তাঁর বাহিনী থেকে ট্রান্সফার করেছিলেন।–(শর্মিলা বোস, ২০১১)। তাছাড়া শেখ মুজিবের নির্বাচনী বিজয়ের পর ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের সামনে শেখ মুজিবকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী রূপে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
মুজিবের প্রলোভন ও ফায়দালাভ
মজার ব্যাপার হল, শিল্পি কামরুল হাসান যে ব্যক্তির ছবি হিংস্র পশু রূপে এঁকে সারা দেশব্যাপী প্রচার করে,শেখ মুজিব তাকেই এক সময় পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।-(GW Chowdhury, 1974)।অবশ্য মুজিবের সে প্রস্তাবের পিছনে রাজনৈতিক কুমতলব ছিল। সে প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়া খানের সরকার থেকে শেখ মুজিব সন্ত্রাসের অবাধ লাইলেন্স পেয়েছিলেন। নির্বাচনি বিজয়ের জন্য একটি সামরিক সরকারের সহযোগিতা মুজিবের কাছে অতি জরুরী বিবেচিত হয়েছিল। এবং মুজিব সে সহায়তা যথাযথ পেয়েছিলেনও। মুজিবের লক্ষ্য ছিল, যে কোন রূপে নির্বাচনি বিজয়। সে লক্ষ্যেই তিনি সামরিক সরকারের সাথে সখ্যতা গড়েন।
তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন এ্যাডমিরাল আহসান। এ্যাডমিরাল আহসানের বাসভবনে গিয়ে ছুটির দিনে আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেন নিয়মিত আডডা দিতেন। এ তথ্য দিয়েছিল বিলেতে অধ্যয়নরত এ্যাডমিরাল আহসানের কণ্যা। (সূত্রঃ লেখকের বন্ধু যিনি বিলেতের একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতেন। এ্যাডমিরাল আহসানের কণ্যা তাকে জানায়,“কামাল আংকেল আমাদের বাসায় ছুটির দিনে প্রায়ই আসতেন ও পিতার সাথে আড্ডা দিতেন।”) ফলে নির্বাচনি বিজয়ের আগেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের গুন্ডাবাহিনী দেশের রাজপথ দখলে নিয়ে নেয়। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের গুন্ডাদের হামলায় অন্যান্য দলগুলির শত শত নির্বাচনি জনসভা পন্ড হয়ে গেছে। খোদ ঢাকাতে এ দলগুলি কোন বড় আকারের জনসভাই করতে পারিনি। শেখ মুজিবের সন্ত্রাসী ক্যাডারগণ ঢাকার পল্টন ময়দানে ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ, নুরুল আমীন সাহেবের পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টি (পিডিপি) এবং জামায়াতে ইসলামীর জনসভা তছনছ করে দিয়েছিল। অথচ পল্টন ময়দানটি দেশের প্রত্যন্ত কোন জেলা শহরে নয়, সেটি গভর্নর হাউসের সামনেই। আওয়ামী লীগের সে সন্ত্রাস দেখেও তৎকালীন গভর্নর আহসান না দেখার ভান করেছেন। এবং কোন ব্যবস্থা নেননি। ১৯৭০ য়ের ১৮ই জানুয়ারি পল্টন ময়দানে জামায়াতে ইসলামীর জনসভায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের গুন্ডাগণ মফস্বল থেকে আগত তিন জন জামায়াত কর্মীকে হত্যা করে এবং শত শত কর্মীকে আহত করে। কিন্তু সে অপরাধে তৎকালীন সামরিক সরকার কোন হামলাকারিকেই গ্রেফতার করেনি। অথচ হামলার সময় পল্টন ময়দানে বহু পুলিশ উপস্থিত ছিল। তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকার শেখ মুজিবের গলার রশি যে কতটা ঢিল ছেড়ে দিয়েছিল এ হলো তার নমুনা।
গণহত্যার সংজ্ঞা ও প্রকৃত নায়ক
একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা গণহত্যার অপরাধে অপরাধী। এ অভিযোগে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও কিছু বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কয়েক জন শীর্ষনেতাকে ফাঁসিও দেয়া হয়েছে। আরো কয়েকজন ফাঁসির হুকুম নিয়ে মৃত্যুর দিন গুনছেন। গণহত্যার এ অভিযোগ গুরুতর। তাই এর উপর বিষদ গবেষণা হওয়া উচিত, এবং বস্তুনিষ্ঠ বিচার হওয়া উচিত সে অভিযোগ কতটা সত্য। ইংরাজীতে যাকে বলা হয় জেনোসাইড বাংলা ভাষায় সেটিই গণহত্যা। তারও একটি নিজস্ব সংজ্ঞা রয়েছে এবং সেটি বেঁধে দিয়েছে জাতিসংঘ। United Nations Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide of 1948 গণহত্যার যে সংজ্ঞাটি নির্ধারিত করেছে তা হলঃ “Genocide means any of the following acts committed with intent to destroy, in whole or in part, a national, ethnical, racial or religious group as such:
- Killing members of the group,
- Causing serious bodily and mental harm to members of the group,
- Deliberately inflicting on the group conditions of life calculated to bring about its physical destruction in whole or in part,
- Imposing measures intended to prevent births within the group,
- Forcibly transferring children of the group to another group.
তাই শুধু হত্যা হলেও সেটি গণহত্যা হয়না। সে হত্যার মাঝে কোন একটি জাতি, বর্ণ, ধর্ম ও গোত্রের লোককে সমূলে বা আংশিক ভাবে বিলুপ্ত করার মটিভ বা উদ্দেশ্য থাকতে হয়। তখন সে বিলুপ্তকরণ প্রক্রিয়া থেকে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধদেরও রেহাই দেয়া হয় না। হিটলারের আচরণ যেমনটি ছিল সেদেশের ইহুদীদের বিরুদ্ধে। ফলে ইহুদী নারী, শিশু ও বৃদ্ধও সে গণহত্যা থেকে রেহাই পায়নি। যে খুনের বিচারে তাই শুধু লাশ দেখলে চলে না, খুনের মটিভও দেখতে হয়। প্রশ্ন হল, বাঙালীদের নির্মূল করার কোন মটিভ বা পরিকল্পনা কি পাকিস্তানী সরকার বা সেনাবাহিনীর ছিল? থাকলে তারা ডাঃ আব্দুল মোত্তালেব মালেকের ন্যায় বাঙালীকে কেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর বানাবে? জনাব মালেকের কাবিনেটের সকল মন্ত্রীই ছিলেন বাঙালী। বাঙালীদের গভর্নর ও মন্ত্রী করলে কি বাঙালী নির্মূলের কাজ সহজ হয়? জেনারেল ইয়াহিয়ার বিদায়ের পর জুলফিকার আলী ভূট্টো যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হলেন, তখন জনাব নুরুল আমীনের ন্যায় একজন বাঙালীকে কেনই বা তারা ভাইস প্রেসিডেন্ট বানালো? তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে কবর দেয়া হয়েছে কায়েদে আযমের কবরের পাশে। যারা বাঙালীদের নির্মূল করতে চায় তারা একজন বাঙালীকে এরূপ সম্মান দিবে কেন?
একাত্তরে জনাব ভূট্টোর সাথে বাঙালী শাহ আজিজুর রহমান এবং সিলেটের জনাব মাহমুদ আলীকেই বা কেন জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলতে পাঠানো হল? তাছাড়া লক্ষাধিক রাজাকারের হাতেই বা কেন পাকিস্তানী সরকার অস্ত্র তুলে দিল? বাঙালীর উপর এমন বিশ্বাস কি নির্মূলের চেতনা থেকে কি গড়ে উঠে? হিটলার কি কোন ইহুদীকে কোন একটি জার্মান প্রদেশের গভর্নর বা মন্ত্রী বানিয়েছে? কোন একজন ইহুদীর হাতে কি অস্ত্র তুলে দিয়েছে?জার্মানের দূত রূপে কোন ইহুদীকে বিদেশে পাঠিয়েছে? বরং তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হয়েছে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার জন্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোন গ্রামে গিয়ে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করেছে সে প্রমাণ নেই। অনেক স্থানে পাকিস্তান আর্মির উপর হামলার অভিযোগে যুবকদের গ্রেফতার বা হত্যা করা হলেও নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের তারা বেছে বেছে ছেড়ে দিয়েছে। -(শর্মিলা বোস, ২০১১)। অথচ ভারত ও তার সহচর আওয়ামী রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ তাদের বক্তৃতা ও লেখনিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে হিটলারের বাহিনীর সাথে তুলনা করে। এবং বলে জার্মানীতে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যে হলোকাস্ট বা গণহত্যা ঘটেছে, একাত্তরে সেটিই ঘটেছে বাঙালীদের বিরুদ্ধে। এটি হল জার্মানীর হলোকাস্টে নিহত ইহুদীদের প্রতি যে চরম অবমাননা এবং হিটলারের নৃশংস বর্বরতাকে যে খাটো করে দেখা -সে হুশ কি এসব বুদ্ধিজীবীদের আছে?
গণহত্যার অভিযোগ ও ভারতীয় এজেন্ডা
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল পাকিস্তানকে আসন্ন বিভক্তি থেকে বাঁচানোর যুদ্ধ। সেনাবাহিনীর সদ্স্য রূপে এটি ছিল তাদের দায়বদ্ধতা। তাদের হাতে অকাট্য প্রমাণ ছিল, একাত্তরের যুদ্ধটি ভারত সরকারের সৃষ্ট,এবং সেটির ব্যাপক প্রস্তুতি চলছিল একাত্তরের বহু পূর্ব থেকেই। ভারতীয় সাংবাদিক অশোক রায়না তার Inside RAW তে সে ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরেছেন। এবং তুলে ধরেছেন ভারতের সে ষড়যন্ত্রের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের দীর্ঘ সংশ্লিষ্টতার কথা। আগরতলা ষড়যন্ত্র যে সত্য ছিল সেটি নিয়ে আজ আর কোন দ্বিমত নেই। খোদ আওয়ামী লীগ নেতারাই সেটির সত্যতা এখন স্বীকার করেন। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে একাত্তরের যুদ্ধটি যে ভারতীয় ষড়যন্ত্রমূলক হামলা থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর যুদ্ধ ছিল, সে দাবীকে মিথ্যা বলা যায় কি করে? ফলে একাত্তরের যুদ্ধকে পাঞ্জাবীদের বাঙালী নির্মূলের যুদ্ধ বলার কোন যুক্তি থাকে কি? তাছাড়া পাঞ্জাবীদের তেমন একটি লক্ষ্য থাকলে সেটির শুরু একাত্তর থেকে হবে কেন? সে জন্য সত্তরের নির্বাচন দেয়ার প্রয়োজনই বা হবে কেন? নির্বাচন দিলে কি নির্মূলের কাজ সহজ হয়? নির্মূলের লক্ষ্য থাকলে সে কাজ তো ১৯৪৭ সাল থেকেই তারা শুরু করতে পারতো। একাত্তরে পাকিস্তান আর্মিতে যত বাঙালী অসিসার ও সেপাই ছিল ১৯৪৭’য়ে তো তার দশভাগের একভাগও ছিল না। বাঙালীর নির্মূলই যদি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লক্ষ্য হয়ে থাকে তবে ইয়াহিয়া খান এক ব্যক্তি এক ভোটের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের জাতীয় পরিষদে ৫৬% আসন দিয়ে সমগ্র পাকিস্তানের উপর শাসনের বৈধ অধিকার দিলেন কেন? পাকিস্তান সরকারের তেমন একটি উদ্যোগকে কি বাংলার মাটি থেকে বাঙালী নির্মূলের পরিকল্পনা বলা যায়? কোন সুস্থ মানুষ কি সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্মূলের কথা ভাবতে পারে? এটি কি বিবেচনায় আনা যায়? অথচ সে অভিযোগ তোলা হয়েছে ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল পূর্ব পাকিস্তানি। ফলে সে দেশের মাটি থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নির্মূলের এমন উদ্ভট কথা কি কোন সুস্থ মানুষের কল্পনাতে আসে? চিন্তাশূণ্য কিছু দাস চরিত্রের মানুষই শুধু সেটি ভাবতে পারে। দাসদের সমস্যা হল, চিন্তা-ভাবনার ন্যায় জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তারা প্রভুর উপর ছেড়ে দেয়। সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রভু, পুরোহিত বা বুদ্ধিজীবীগণ যদি শাপ-শকুন, নদ-নদী, পাহাড়-পর্ব্বত ও গরুবাছুরকে দেবতা বললে, তারাও তাই বলে। ফিরাউন-নমরুদের সময় সাধারণ মানুষের মাঝে ধর্মের নামে নিরেট মিথ্যা কথাগুলোও বিপুল গ্রহণ-যোগ্যতা পেয়েছিল তেমন একটি চেতনাশূণ্যতা ও বিবেকশূণ্যতার কারণেই। একই কারণে বাংলাদেশেও বিপুল গ্রহণ যোগ্যতা পেযেছে তিরিশ লাখের কিসসা। এ মিথ্যাটিকে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও ছাত্র, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও আইনবিদ, সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ, পত্রিকার সম্পাদক ও কলামিস্ট এবং নিরক্ষর কৃষক বা অন্ধ ভিখারির মাঝে কোন পার্থক্য নাই। কোন একটি মিথ্যা কথা কিছু লোক বার বার বলা শুরু করলে এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না হলে সে মিথ্যা ছেয়ে যায় সমগ্র দেশব্যাপী। তখন সে মিথ্যার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ দলিল তালাশ করে না এবং বিবেকবুদ্ধিকেও কাজে লাগায় না। সে উদ্ভট মিথ্যাটি তখন সত্য রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। সে মিথ্যার বিরুদ্ধে কথা বললেই তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস শুরু হয়। মিথ্যার শক্তি যে কত প্রবল হতে পারে -এ হল তার নমুনা। অতীতে নবী-রাসূলদেরও এমন মিথ্যাপাগলদের মোকাবেলা করতে হয়েছে। আজকের সমাজেও মিথ্যার প্রচারক আবু লাহাব এবং আবু জেহেলগণ যে কতটা প্রবল ভাবে বেঁচে আছে বাংলাদেশ হল তারই প্রমাণ। গরুরাও যে ভারতে দেবতার সম্মান পায় তা তো মিথ্যার প্রতি প্রবল আসক্তির কারণেই। শশানবাসী উলঙ্গ সন্যাসী আর হিন্দু বিজ্ঞানী, বিচারক, বুদ্ধিজীবী বা প্রফেসরের মাঝে এ আদিম মিথ্যাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কি কোন পার্থক্য আছে? হয়তো কোন কালে কোন অজ্ঞ ব্যক্তি তার আদিম অজ্ঞতা নিয়ে শাপ-শকুন-গরু, নদ-নদী ও পাহাড়-পর্বতকে দেবতা রূপে প্রচার করেছিল, এবং সেগুলির পূজাকে ধর্ম বলেও আখ্যায়ীত করেছিল। সে সময়ে তার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ না হওয়ায় আজ সেটি শত কোটি মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে তিরিশ লাখের কিসসা নিয়ে মূলত সেটিই ঘটেছে। মুজিব না জেনে ও না বুঝে যা উচ্চারণ করেছে বাঙালীগণ সেটিরই প্রচারে নেমেছে। শর্মিলা বোস এটিকে “gigantic rumour” তথা এক বিশাল গুজব বলে আখ্যায়ীত করেছেন।
বিহারী বিরোধী গণহত্যা
সত্য হল, একাত্তরে প্রকৃত গণহত্যার শিকার হল বিহারীরা। জাতিসংঘ যেভাবে গণহত্যাকে সংজ্ঞায়ীত করেছে বিহারীদের ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে। অগণিত শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা সে গণহত্যা থেকে বাঁচেনি। সে গণহত্যার সাক্ষী বহু বাঙালী। সে গণহ্ত্যার বিররণ নিয়ে বিহারীগণও বই লিখেছে। তারা মারা যায় দুটি পর্বে। প্রথম পর্বটি শুরু হয় পহেলা মার্চ থেকে। তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সবটুকু জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের শাসন। সেটি চলতে থাকে সেনাবাহিনীর পুনঃনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত, অর্থাৎ এপ্রিলের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৬ ই ডিসেম্বরে। এবং সেটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পর। দ্বিতীয় পর্বের হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনটি চলে প্রথম পর্বের চেয়েও বেশী কাল ধরে। সেটি সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। প্রথমপর্বে ঢাকা শহরের মীরপুর, মোহম্মদপুর, উত্তর বঙ্গের সৈয়দপুরের ন্যায় বিহারী সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলি হত্যাকাণ্ড ও লুঠতরাজ থেকে বাঁচলেও দ্বিতীয় বারে বাঁচেনি। এবার হয় তাদের হত্যা করা হয়, নতুবা ঘরবাড়ী, সহায়-সম্পদ কেড়ে নিয়ে বস্তিতে পাঠানো হয়। খুলনা শহরে তেমন একটি হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ দিয়েছেন শর্মিলা বোস। “১৯৭২ সালের ১০ই মার্চ খুলনা জুটমিলের বিহারী শ্রমিকদের নিউ টাউন কলোনীতে বাঙালীরা ঘেরাও করে। সকাল ১১টা থেকে শুরু করে দুপুর ১টা অবধি সেখানে অবস্থানরত বিহারী পুরুষ,নারী ও শিশুদের হত্যা করার কাজ। বেঁচে যাওয়া বিহারীদের কাছ থেকে শর্মিলা বোস জানতে পারেন, কয়েক হাজার বিহারীকে সেখানে হত্যা করা হয়। সে হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয় শহীদ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। বহু বিহারীদের ঘেরাও করা হয় খুলনার ওল্ড টাউন কলোনীতেও। কিন্তু সেখানকার ম্যানেজার জনৈক রহমান সাহেব তাদেরকে হত্যা না করে রিফিউজী ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। -(শর্মিলা বোস, ২০১১)।
জাতিসংঘ কর্তৃক সংজ্ঞায়ীত জেনোসাইড বা গণহত্যাটি যে বাঙালীদের দ্বারা ঘটেছে -সে প্রমাণ প্রচুর। তার কিছু বিবরণ পাওয়া যায় শর্মিলা বোস থেকে। বাঙালীদের হামলা থেকে খুলনা, শান্তাহার, চট্টগ্রাম, বাহ্মনবাড়িয়া, সৈয়দপুর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, পাকশীর ন্যায় নানা শহরে বিহারী নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা যেমন রেহাই পায়নি, তেমনি রেহাই পায়নি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ঘরবাড়ী। মীরপুর, মোহম্মদপুর, ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানীসহ ঢাকা শহরের যেখানেই অবাঙালীদের বাড়ীঘর ছিল সেগুলো থেকে তাদের বলপূর্বক নামিয়ে দখল নিয়েছে বাঙালীরা। আসল মালিকদের হয় হত্যা করা হয়েছে অথবা বস্তিতে পাঠানো পাঠিয়েছে। যারা অতি ভাগ্যবান তারা সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে বেঁচেছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের ঢাকার অভিজাত এলাকায় আজ যে বিশাল বিশাল বাড়ী সেগুলো কি তাদের জমিদারি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকুরি-বাকুরি থেকে অর্জিত পয়সা থেকে কেনা? তাদের ক’জনের সেরূপ ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকুরি ছিল? আজও একটি জরিপ চালালে তাদের বিশাল বিশাল ঘরবাড়ির মালিক হওয়ার মূল রহস্যটি বেরিয়ে আসবে। একটি জনগোষ্টির বিরুদ্ধে যখন গণহত্যা হয় তখন তো এগুলোই ঘটে। যারা হামলার শিকার তারা প্রাণ হারায়, ইজ্জত হারায়, ঘরবাড়ী ও ব্যবসা-বাণিজ্যও হারায়। জার্মানীর ইহুদীদের সাথে তো সেটিই ঘটেছিল। প্রাণ বাঁচাতে তাদের দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। আর তাদের ঘরবাড়ী ও ব্যবসা বাণিজ্যের দখল নিয়েছিল জার্মানারা। একই রূপ নির্মম নৃশংসতা ঘটেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অবাঙালী নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশুদের সাথে। পাঞ্জাবীদের দ্বারা বাঙালীর বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালিত হলে শুধু বাঙালীর প্রাণনাশই হতো না, তাদের ঘরবাড়ী, ব্যাবসা-বাণিজ্য, চাকুরি-বাকুরিও হারাতে হতো। সেগুলো না হলে তো জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা হয় কি করে? কিন্তু ক’জন বাঙালীর ক্ষেত্রে সেটি ঘটেছে? বরং সেদিন তো অধিকাংশ বাঙালী নিজ নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, নিজ ঘরে থেকেছে, অফিসে গেছে এবং অনেকে মন্ত্রীও হয়েছে! শেখ মুজিবের নিজের বাড়ীটিও তো সেদিন অক্ষত থেকেছে।
সত্যের বিরুদ্ধে নাশকতা
একাত্তরের যুদ্ধে বিস্তর প্রাণহানী ও সম্পদহানী হয়েছে। কিন্তু এ বিপুল হানাহানির মাঝে যেটি সবচেয়ে বেশী মারা পড়েছে সেটি হল সত্য। সে মৃত সত্যগুলো কবরস্থ হয়েছে ইতিহাসের বইয়ে। আর সত্যের বিরুদ্ধে সে নাশকতাটি ঘটেছে বাংলাদেশের সেক্যুলার রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও ইতিহাস রচনাকারিদের হাতে। তবে দেশের চরিত্রহীন রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচারকে বিজয়ী করার স্বার্থে সেরূপ সত্যবিনাশ অনিবার্যও ছিল। কারণ, সূর্য অস্ত না গেলে রাতের আঁধার জেঁকে বসতে পারে না। তেমনি সত্যকে দাফন না করলে দেশ মিথ্যার প্লাবনে ডুবে না, তাতে মিথ্যুকদেরও নাম যশ বাড়ে না। একাত্তরের লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা। বিজয়ের পর তারা শুধু দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনই দখলে নেয়নি, দখলে নিয়েছে ইতিহাস রচনার ন্যায় একাডেমিক বিষয়ও। আওয়ামী শাসনামলে সরকারি অর্থে সরকারি লোকদের লাগানো হয়েছিল ইতিহাস রচনার কাজে। ফলে যা রচনা হয়েছে সেটি আর ইতিহাস থাকেনি। পরিণত হয়েছে দলীয় প্রশংসা-গাঁথায়। এককালে স্বৈরাচারী রাজা-বাদশাহগণ দরবারে কবি ও ইতিহাস লেখক প্রতিপালন করে তাদের দ্বারা একাজটিই করাতো। বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চার নামে সে কাজটিই হয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের সামরিক এ্যাকশনের সিদ্ধান্তটি ছিল নিতান্তই সামরিক বাহিনীর। দেশের পাকিস্তানপন্থী এবং ইসলামপন্থী দলগুলো সে এ্যাকশনের সাথে সংশ্লিষ্ঠ ছিল না। সে রাতে যা ঘটেছে তা যেমন দুঃখজনক, তেমনি অনাকাঙ্খিত। কিন্তু সামরিক বাহিনীর সে এ্যাকশনের সাথে অতিরঞ্জিত মিথ্যার সংমিশ্রন ঘটিয়ে পরবর্তীতে ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসনের ন্যায় ভয়ানক অপরাধকে জায়েজ করা হয়।ঐ রাতে যা ঘটেছে তা নিয়ে সত্য বেরিয়ে আসা উচিত। কিন্তু সেটি হয়নি। বরং গুজবকে বেশী বেশী প্রচার করা হয়েছে। প্রকৃত সত্যকে ইচ্ছা করেই সেদিন আবিস্কার করা হয়নি। কারণ, তারা জানতো প্রকৃত সত্যকে মিথ্যা গুজবের ন্যায় কখনোই এতোটা বীভৎস করা যায় না। পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে বাঙালী নির্মূলের অভিযোগটি সত্য হলে সেটি তো ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট থেকেই শুরু হওয়া উচিত ছিল। নির্মূলের শুরু ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ থেকে কেন? এক রাতে ঢাকা শহরের ৬০ হাজার মানুষ হত্যার যে তথ্য পেশ করা হয় তাদেরই বা পরিচয় কোথায়? কোন আবাসিক হল ও কোন মহল্লা থেকে কতজন হত্যা করা হয়েছিল -সে হিসাবটি কোথায়? এতো বিশাল সংখ্যক মানুষের লাশ গেল কোথায়?কোন বদ্ধ ভূমিতে ফেললেও তাদের হাড্ডি পাওয়া যেত। গণনাও করা যেত। আওয়ামী লীগ বহু বছর ক্ষমতায় থেকেছে, কিন্তু সে পরিসংখ্যান কি দিতে পেরেছে?
নব্বইয়ের দশকে বসনিয়ায় নিহত হাজার হাজার মুসলমানের লাশ বর্বর সার্ব বাহিনী মাটিচাপা দিয়েছিল। কিন্তু সেগুলি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়নি। প্রতিটি লাশকে তারা সনাক্ত করেছে, তাদের নাম ঠিকানা বের করে আপনজনদের তা জানিয়েছে। কিন্তু ঢাকায় সে ৬০ হাজার মানুষের কবর মেলেনি, হাড্ডিও মেলেনি। একাত্তরে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যা সর্বসাকূল্যে ৬০ হাজারের অর্ধেক তথা ৩০ হাজারও ছিল না। তবে কি পাক বাহিনী তাদের সবাইকে হত্যা করেছিল? আর কোথায় হিন্দুদের বসতি যেখান থেকে খুঁজে খুঁজে হিন্দুদের হত্যা করেছিল? পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের পক্ষে কি সম্ভব ছিল এক রাতে বেছে বেছে হাজার হাজার হিন্দু হত্যা করা? বলা হয়, একাত্তরে এক কোটি মানুষকে ভারতে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার মাঝে এক কোটিকে ভারতে যেতে বাধ্য করা হলে প্রতি ৮ জনের মাঝে কমপক্ষে একজনকে ভারতে যেতে হয়। যে গ্রামে ৮ শত মানুষের বাস সে গ্রাম থেকে কম পক্ষে ১০০ জনকে ভারতে যেতে হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ হাজার গ্রামের প্রতি গ্রামে সে হারে ভারত-গমন ঘটতে হবে, নইলে এক কোটির সংখ্যা কি পূরণ হওয়া কি সম্ভব? কোন গ্রাম থেকে কেউ ভারতে না গেলে পরবর্তী গ্রামটি থেকে দ্বিগুণ হারে যেতে হবে। অথচ বাংলাদেশে এমন গ্রামের সংখ্যা তো হাজার হাজার যেখান থেকে একজনও একাত্তরে ভারতে যায় নি।
গ্রন্থপঞ্জি
- Sisson, Richard and Leo Rose (1990): War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, University of California; Berkeley.
- Bose, Sarmila, 2011: Dead Reckoning: Memories of the 1971 Bangladesh War, Hurst & Company, London.
- W. Chowdhury, 1974: The Last Days of United Pakistan, C. Hurst & Company, London.
- ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন,১৯৯৩;একাত্তরের স্মৃতি,নতুন সফর প্রকাশনী ৪৪,পুরানা পল্টন দোতালা,ঢাকা, ১০০০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018