অধ্যায় তেইশ: ভারতের পরিকল্পিত যুদ্ধ ও এজেন্ডা

 অসত্য দাবী

বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীর অবদান নিয়ে বহু কিছুই লেখা হয়েছে। সেগুলির বেশীর ভাগই তাদের নিজেদের লেখা। এ ময়দানে নিরপেক্ষ ইতিহাসবিদ নেই। ফলে ইতিহাসের সবগুলি গ্রন্থই তাদের বিজয় গাঁথা। তাদের দাবীর বস্তুনিষ্ঠ সমীক্ষা আজও হয়নি। শেখ মুজিবের ক্ষমতায় থাকা কালে সেটি সম্ভবও ছিল না। সে সময় যা সম্ভব ছিল তা শুধু শেখ মুজিব ও তার সাথীদের প্রশংসা গীত। তবে এনিয়ে কোন বিরোধ নেই, মুক্তিবাহিনীর বহু হাজার সদস্য একাত্তরে ভারতে গিয়েছিল এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে ট্রেনিং নিয়েছিল। ট্রেনিং শেষে তাদের কাজটি ছিল মূলত নাশকতামূলক। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার শক্তি তাদের ছিল না। ফলে বেশী মনযোগী হয়েছে পাকিস্তানপন্থী নিরস্ত্র ব্যক্তিদের হত্যায় এবং দেশের সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসে। তাদের নাশকতাটি ছিল রেল লাইন, রেলওয়ে ব্রিজ, কালভার্ট ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি ধ্বংসে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহতদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার, মুসলিম লীগের লিডার, রাজনীতি সচেতন আলেম এবং ইসলামপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক নেতা। অনেকে নিহত হয়েছে স্রেফ দীর্ঘ দিন থেকে চলে আসা পারিবারীক গোলযোগের কারণে। তারা বহু কালভার্ট, ব্রিজ ও রেল লাইনের ধ্বংস করতে সমর্থ হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক বাহনীর সাথে তাদের সরাসরি দ্বি-পাক্ষিক যুদ্ধ খুব কমই হয়েছে। প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টিতে তাদের সে হামলাগুলি কতটুকু সফল ছিল?

মুক্তিবাহিনীর দাবী, স্বাধীন বাংলাদেশ তাদেরই সৃষ্টি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকা স্থান পেয়েছে পাদটিকায়। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকও সেরূপ দাবীতে পরিপূর্ণ। স্কুলের পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি প্রতি বছর একই দাবী বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় ১৬ই ডিসেম্বর এবং ২৬ শে মার্চে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এসব কথা বলে, নিছক নিজেদের ভাবমূর্তিকে বড় করে তুলে ধরার লক্ষ্যে। তাছাড়া এসব দাবী ছাড়া তাদের সাফল্যের পক্ষে তেমন প্রমাণ নাই। কথা হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের ৯ মাসের যুদ্ধে যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়ে থাকে তবে ভারতের বিশাল সামরিক বাহিনী সীমান্তে কি করল? মুক্তিবাহিনীর হাতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ভারতের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণার প্রয়োজনটাই বা দেখা দিবে কেন? ভারতীয় জেনারেল মানেক শ‌`‌ ফিল্ড মার্শাল খেতাবটি পেলেন কি কোন যুদ্ধ না লড়েই?

মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করেছিল একাত্তরের ৯ মাস জুড়ে। কিন্তু সে ৯ মাসের যুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি দূরে থাক, মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সেনা বাহিনীকে কোথাও পরাজিত করতে পারিনি। কোন একটি জেলা শহর বা থানা শহর থেকেও তারা পাক বাহিনীকে হটাতে পারিনি। স্থানে স্থানে তাদের যুদ্ধ হয়েছে রাজাকারদের সাথে। রাজাকারদের হটিয়ে তারা একটি থানাও দখলে নিতে পারিনি। কিন্তু এ ব্যর্থতা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণ নিরব। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর পরাজয়টি তখন শুরু হয় যখন লক্ষ লক্ষ সৈন্য নিয়ে ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। সে দিনটি কারো কারো মতে ১৯৭১’য়ের ৩রা ডিসেম্বর। কারো কারো মতে -যেমন দুইজন মার্কিন গবেষষক Sission এবং Rose লিখেছেন সেটি ২১শে নভেম্বর।-(Sission and Rose, 1990)। ভারতের বিশাল স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী এ যুদ্ধ করে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। তাদের বহু হাজার সৈন্য এ যুদ্ধে হতাহত হয়। যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৬ই ডিসেম্বর-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।

 

ভারতীয়দের দাবী

প্রশ্ন হলো, ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ও ইতিহাসবেত্তাগণও কী একাত্তর নিয়ে একই রূপ ভাবেন, যেভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস বইতে পড়ানো হয় বা আওয়ামী-বাকশালীগণ যেভাবে দাবী করে থাকেন? এ প্রসঙ্গে ভারতীয়দের রায় যে ভিন্নতর সে প্রমাণ অনেক। উদাহরণ দেয়া যাক। একাত্তরের যুদ্ধে ভারতীয় সেনা বাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল ম্যানেক শ`। তিনি মারা যান ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে। তার মৃত্যু উপলক্ষে ২৭/০৮/০৮ তারিখে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। উক্ত নিবন্ধের শিরোনাম ছিলঃ Manek Shaw: A Soldier Who Created a Nation, অর্থঃ ম্যানেক শ` একজন সৈনিক যিনি একটি জাতির জন্ম দিয়েছেন। ভারত জুড়ে এটি ছাপা হয়েছে। সারা দুনিয়ার মানুষ সেটি ইন্টারনেট মারফত পড়েছে। এর অর্থ দাঁড়ালো কি? এ নিবন্ধে বুঝানো হয়েছে, বাংলাদেশে যে নতুন জাতিসত্ত্বার সৃষ্টি হয়েছে তার জনক জেনারেল ম্যানেক শ`। এখানে কোন ঘোরপ্যাঁচের আশ্রয় নেয়া হয়নি। এই একটি মাত্র নিবন্ধই একটি প্রবল বিশ্বাস ও চেতনা তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট। এ নিবন্ধটি প্রচার করা হয়েছে কোন ব্যক্তি বা কোন অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নয়, বরং প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার ন্যায় একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান থেকে। যারা বলে, বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবর রহমান, তাদের মাথায় তো এতে বাজ পড়ার কথা। কিন্তু সেটি হয় নি। আওয়ামী বাকশালীরা এতে একটুও বিক্ষুব্ধ হয়নি, বরং নিরবে হজম করেছে। তাদের আত্ম-সম্মানে এতে একটু আঁচড়ও লাগেনি। এ নিবন্ধের বিরুদ্ধে কোনরুপ প্রতিবাদও করেনি। প্রশ্ন হলো, একাত্তরে মুক্তি বাহিনীর প্রকৃত সফলতা কতটুক? তাদের সামর্থ্যই বা ছিল কতটুকু? তাদের কি সামর্থ্য ছিল, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার?

ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধে নামার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়, পাক-বাহিনীর পরাজিত করার সামর্থ্য মুক্তি-বাহিনীর ছিল না। পাক-বাহিনীর পরাজয় শুরু হয়েছে ৩রা ডিসেম্বরে ভারতীয় স্থল, বিমান ও নৌ-হামলা শুরুর পর। আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম ও আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধ থেকে এখানেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বড় পার্থক্য। ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বের এক নম্বর বিশ্ব-শক্তিকে পরাজিত করেছিল। অন্যরা সাহায্য দিলেও এ যুদ্ধে কোন দেশের সরাসরি যুদ্ধে নামার প্রয়োজন পড়েনি -যেমনটি একাত্তরে ভারত নেমেছিল। আফগানিস্তানের মুজাহিদগণ আরেক বিশ্বশক্তি সোভিয়েত রাশিয়াকে শুধু পরাজিতই করেনি, দেশটিকে ৯ বছরের যুদ্ধে এতোটাই কাহিল করেছিল যে তার পক্ষে বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়েছিল। সে পরাজয়ের পর বিশ্বের মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়া। সে মৃত দেশটি থেকে জন্ম নিয়েছে ডজন খানেক স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ভিয়েতনামের প্রায় দ্বিগুণ, আর আফগানিস্তানের তুলনায় চারগুণ। তা হলে, পাক-বাহিনী কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার সেনাবাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী ছিল? অথচ সে সময় বাংলাদেশে মাত্র ৪৫ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য ছিল। যে ৯০ হাজার বন্দিকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের প্রায় অর্ধেক ছিল বেসামরিক পাকিস্তানী। আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লাখ। বাংলাদেশে পাক বাহিনীর যে অস্ত্র ছিল আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর অস্ত্র ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী ও অনেক উন্নত।

 

প্রতিরোধের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা

পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর বিজয় যে অসম্ভব ছিল, সেটি বুঝতে ভারত সরকারের বেশী দিন লাগেনি। তারা গ্রামের নিরস্ত্র ও প্রতিরক্ষাহীন বহু হাজার পাকিস্তানপন্থি মানুষকে হত্যা করতে পেরেছে। কিন্তু তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তেমন কোন সফলতা অর্জন করতে পারেনি। লক্ষণীয় হলো, একমাত্র ভারত, সোভিয়েত রাশিয়া ও কিছু অমুসলিম রাষ্ট্র ছাড়া কোন মুসলিম রাষ্ট্রই পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ভারত পরিচালিত যুদ্ধকে সমর্থন দেয়নি। পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, দেশের সকল ইসলামী সংগঠন ও সকল ইসলামী ব্যক্তিত্ব। আলেমরা ইসলামের নামে অর্জিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে হারাম ঘোষণা দেয়। আর পাকিস্তানের পক্ষের যুদ্ধকে বলে জিহাদ। ফলে হাজার হাজার বাঙালী যুবক রাজাকার রূপে পাকিস্তান বাঁচানোর লড়াইয়ে যোগ দেয়। তাদের এ কাজে কেউ বাধ্য করেনি। রাজাকার শব্দটি মূলত ফারসী ভাষার, এর অর্থ স্বেচ্ছাসেবক। এ বাহিনীতে তারা যোগ দিয়েছিল আধিপত্যবাদী ভারতীয় ষড়যন্ত্র থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর তাগিদে, বেতনের লোভে নয়। একজন রাজাকারের পিতার সাথে লেখকের সাক্ষাৎ হয় কুমিল্লার  চাঁদপুরে। মাথায় টুপি, লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পরিহিত মধ্যম বয়সী তিনি এক সাধারণ মুসল্লি। বলছিলেন, “আমার এক ছেলে রাজাকার ছিল। সে শহীদ হয়ে গেছে। আরেক ছেলে আছে। তাঁকেও ইনশাল্লাহ রাজাকারে নাম লেখাবো।” তাঁর ছেলে যে রাজাকার ছিল এবং সে শহীদ হয়ে গেছে এটি ছিল তাঁর জন্য গর্বের। মুক্তিবাহিনী চারিদিকে পরাস্ত হচ্ছিল এদের হাতে।

সেপ্টম্বর অক্টোবরের মধ্যে লক্ষাধিক যুবক রাজাকার ও আলবদর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। আলিয়া ও খারেজী মাদ্রাসার ছাত্রদের পাশে যোগ দিচ্ছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পীর সাহেবদের মুরীদ এবং অরাজনৈতিক অথচ ধর্মীয় পরিবারের সদস্য। তাদের সবাই উজ্জীবিত ছিল প্যান-ইসলামী চেতনায়। একাত্তরের সংঘাত তখন সুস্পষ্ট এক আদর্শিক সংঘাতে রূপ নিয়েছিল। সত্তরের নির্বাচনে ইসলামপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর শোচনীয় পরাজয়ের বড় কারণ, তাদের অনৈক্য। ফলে সে সময়ে পাকিস্তানপন্থী বহু দিকপালও পরাজিত হন। তাদেরই একজন খান আব্দুস সবুর। অনৈক্যের কারণে আব্দুস সবুর খান ১৯৭০’য়ে নির্বাচনে জিততে পারেননি। ইনি একাত্তর পরবর্তী নির্বাচনে খুলনা জেলার তিনটি আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। অথচ মুজিব সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করেছিল, এবং কত কুৎসিত ভাবেই না চিত্রিত করেছিল! একাত্তরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন সে অনৈক্যও দূর হয়।

 

গুরুর নসিহত ও শেখ মুজিব

ভারতীয় হামলা যে বাঙালী মুসলিমদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে তা নিয়ে অনেকেরই কোনরূপ সংশয় ছিল না। সে পরিণতির কথা মুজিবকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর এক সময়ের রাজনৈতিক গুরু জনাব আবুল হাশিম। জনাব আবুল হাশিম ছিলেন ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগের বাংলা প্রদেশ শাখার সেক্রেটারি। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব জনাব আবুল হাশিমের সংস্পর্শে আসেন। সত্তরের নির্বাচনে মুজিবের বিজয়ের পর জনাব আবুল হাশিম তাঁকে কি বলেছিলেছেন সে বিবরণ শোনা যাক একজন প্রত্যক্ষদর্শী থেকে। “নির্বাচনের পর পরই আমি আবুল হাশিমের বাসায় বসা। হঠাৎ দেখি মুজিব এবং জহিরুদ্দীন (আওয়ামী লীগের নেতা ও ১৯৭০ এর নির্বাচনে মোহম্মদপুর-ধানমন্ডি এলাকা থেকে নির্বাচিত এমএনএ) হাশিম সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছেন। বোধ হয় নির্বাচন জিতে সৌজন্য সাক্ষাত করতে এসেছিলেন তাঁরা। হাশিম সাহেব বললেন, ‍‍‌‌‌‌‍‍‌‌‌‍‍“মুজিব, আমি শুনেছি কাইয়ুম ও দৌলতানার মুসলিম লীগ তোমাকে ভুট্টোর বিরুদ্ধে সমর্থন দিতে রাজি হয়েছে। খেলার মাঠে ভাল দল কখনও মারা মারি করে না।…তোমার প্রতি আমার অনুরোধ তুমি প্রোভোকেশনে যাবে না। আমি দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছি। আমি জানি তোমাকে অসৎ পরামর্শ দেয়ার লোকের অভাব নেই। আশাকরি তুমি সেটা থেকে দূরে থাকবে। তুমি তো জানো আমি (পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান থেকে) এখানে এসেছি সর্বহারা মুহাজির হয়ে। পশ্চিম বঙ্গে আমার সবই ছিল। ওখানে থাকতে পারিনি। আমার আত্মীয়-স্বজনেরাও ওখানে অনেকে আছে। যতদূর জানি তাদের অবস্থা ভাল না। তুমি নিজেও পাকিস্তান আন্দোলন করেছ। হয়তো পাকিস্তান পেয়েও আমাদের অনেকের অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। তা সত্ত্বে এ দেশ আমরাই তৈরি করেছি। আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় এটা আরো সুন্দর হবে।” -(ইব্রাহিম হোসেন, ২০০৩)। কিন্তু যে ব্যক্তি পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করছেন ১৯৪৭ সাল থেকেই এবং বহু বছর আগেই জড়িত হয়ে পড়েছেন ভারতীয় র‌`য়ের সাথে তার উপর জনাব আবুল হাশিমের মুরব্বী-সুলভ নসিহত কি কাজ দেয়? শেখ মুজিব নিয়ে শেরে বাংলা জনাব ফজলুল হকের মন্তব্যটি প্রনিধানযোগ্য। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনী বিজয়ের পর যুক্তফ্রন্টের পার্লামেন্টারী নেতা শেরে বাংলা মুজিবকে বদমেজাজী ও অপরিণত বুদ্ধীর বলে প্রাদেশিক মন্ত্রী সভা নিতে রাজী হননি। অবশেষে সহরোওয়ার্দীর প্রবল চাপে মন্ত্রী করতে রাজী হন।মন্ত্রী পরিষদ গঠনের সময় শেখ মুজিব শেরে বাংলার মুখের উপর বৃদ্ধাঙ্গুলি নেড়ে নেড়ে কটুক্তি করেছিলেন। শেরে বাংলা তাতে অতি দুঃখ করে বলেছিলন, “যে ছেলে আশি বছরের বুড়োকে বেইজ্জত করতে দ্বিধা করিনি, সে এদেশের সম্ভ্রম ভুলুণ্ঠিত করতে দ্বিধা করবে না –এটা তোমরা দেখে নিও।” –(সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ,২০০৪)।

 

প্রেক্ষাপট ভারতীয় হামলার

ভারতীয় ষড়যন্ত্র নিয়ে জনাব আবুল হাশিমের ন্যায় অনেকের মনে যে প্রবল আশংকা ছিল, একাত্তরের পর সেটিই সত্য প্রমাণিত হয়। মুজিবের রাজনীতিতে ভারতমুখীতা এবং ভারতীয় সৈন্যদের পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে ডেকে আনার ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে আশংকা দিন দিন তীব্রতর হচ্ছিল ইসলামী চেতনা সম্পন্ন প্রতিটি ব্যক্তির মাঝে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ভারতে আশ্রয় এবং ভারতী সেনাবাহিনীর হাতে মুক্তিবাহিনী গঠনের পর থেকে সে আশংকা আরো তীব্রতর হয়। পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থীগণ তখন বুঝতে শুরু করে এখন আর বিভক্ত থাকার সময় নয়। ফলে ১৯৭০’য়ের নির্বাচন কালে যেসব পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থীদের মাঝে ঐক্যস্থাপন অসম্ভব ছিল সেটিই ১৯৭১’য়ে অতি সহজসাধ্য হয়ে যায়। দেশের প্রতি জেলায় প্রতি থানায় ও প্রতি ইউনিয়নে সবাই মিলে তারা একত্রে শান্তি কমিটি গড়ে তোলে। নিজ নিজ দলের কর্মীদের তারা রাজাকার হতে উৎসাহিত করে। এমনকি বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী ভারতীয় ষড়যন্ত্রের বিপদ বুঝতে পারে। ভারতে অবস্থানকালে বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীর সুযোগ মিলে ভারতীয় মুসলিমদের সাথে মিশবার। অনেকের জীবনে সেটিই ছিল প্রথমে ভারত-গমন। দেখতে পান, অধিকাংশ ভারতীয় মুসলিম পাকিস্তানের কোন অমঙ্গল দেখতে রাজী ছিল না। পাকিস্তানের কারণে অন্ততঃ দেশটির ১৫ কোটি মুসলিম ভারতীয় হিন্দুদের নির্যাতন থেকে অন্তত মুক্তি পেয়েছে -সেটি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীগণ না বুঝলেও ভারতীয় মুসলিমগণ বুঝতো। ফলে পাকিস্তান ভাঙ্গার সাথে জড়িত থাকার কারণে ভারত সরকারের হিন্দু কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যত আপ্যায়নই পাক, তারা ছিল সেদেশের নির্যাতিত মুসলিমদের ঘৃনার পাত্র। সেটি ছিল সমগ্র ভারত জুড়ে। চিকিৎস্যক রূপে ইরান অবস্থান কালে এক কাশ্মীরী মুসলিম সার্জন লেখককে বলেন,একাত্তরে ১৬ই ডিসেম্বরে কাশ্মীরের ঘরে ঘরে মুসলিমগণ কেঁদেছে। সে অবস্থা ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে।

অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী বিরূপ অভিজ্ঞতা নিয়ে ভারত থেকে ফিরে আসে। আরো অনেকে ফিরে আসার প্রস্ততিও নিচ্ছিল। কেউ কেউ ডাঃ মালেক মন্ত্রীসভার মন্ত্রীও হয়। খোন্দকার মোশতাক আহম্মদসহ অনেকে ভারত থেকে ফিরে আসার পরিকল্পনা করছিলেন। চীনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলিরও অনেকে তখন পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় ষড়যন্ত্রের বিরোধীতা শুরু করে। এদের মধ্যে ছিলেন যশোরের আব্দুল হক এবং রংপুরের মশিউর রহমান। আব্দুল হক পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির আওয়ামী পরিকল্পনাকে তিনি ভারতীয় আগ্রাসন রূপে দেখতেন। তিনি বাংলাদেশ সৃষ্টির এতোটাই বিরোধী ছিলেন যে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও নিজ দলের নাম বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি না রেখে পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিষ্ট পার্টি রাখেন। অপর দিকে মুক্তি বাহিনীর মধ্যেও দ্রুত হতাশা বাড়ছিল। একাত্তরে দেশে প্রচণ্ড বন্যা হয়েছিল। এতে জুন-জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস অবধি মুক্তিবাহিনীর যথেষ্ট সুবিধা হয়েছিল। রাতে কোথাও হামলার চালানোর পর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সহজেই বিল, হাওর ও নদীর চরে আশ্রয় নিতে পারতো। কিন্তু অক্টোবর-নভেম্বরে পানি নেমে যাওয়ায় তাদের বিপদ বাড়ছিল। ফলে চরম হতাশা নেমে আসছিল মুক্তিবাহিনীর মধ্যে। ইতিমধ্যে রাজাকার বাহিনী প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়েও সংগঠিত হয়ে গেছে।  সে সময়ের হতাশা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর পাবনা সদর থানার এক সদস্য লেখককে বলে,“একাত্তরের বন্যার সময় আমরা নৌকা নিয়ে থাকতাম পদ্মার চরে। চারিদিকে পানি আর পানি। সেখানে রাজাকার বা পাক-বাহিনীর পক্ষে পৌঁছা সম্ভব ছিল না। কিন্তু নভেম্বরে যখন পানি নেমে যেতে লাগল তখন আমাদেরও বিপদ বাড়তে লাগল। ঘন ঘন রাজাকারদের হামলা শুরু হলো। কতদিন আর পালিয়ে পালিয়ে থাকা যায়? দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। আর কোন দিন বাড়ীতে ফিরতে পারবো কিনা -সে দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হত না।” ডিসেম্বরে ভারতের হামলায় তাদের শেষ রক্ষা করেছে। নভেম্বরের শুরুতেই ভারতের বুঝতে বাঁকী থাকেনি, ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের মোক্ষম সুযোগটি দ্রুত হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ভারত সে সুযোগ ছাড়তে রাজী ছিল না। ভারতের পক্ষ থেকে সরাসরি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর এটিই মূল কারণ।

 

লক্ষ্য অধীনস্থ বাংলাদেশ

ভারতের লক্ষ্য স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ছিল না। লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দেশটিকে দুর্বল করা; এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানী ভূমিতে ভারতের পদানত এক বাংলাদেশের জন্ম দেয়া। শুধু একাত্তরে নয়, আজও বাংলাদেশ সে অভিন্ন নীতিতেই কাজ করছে। শেখ মুজিব নিজে যাই বলুক, ভারত ভালই জানতো, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে স্বাধীনতা ভোগ করে তা ভারতের পশ্চিম বাংলার মানুষ ভোগ করে না। এটিও জানতো, ১৯৪৭-এর পর ঢাকায় যে উন্নয়ন হয়েছে তা কোলকাতার মানুষ চোখেও দেখেনি। কোলকাতায় যা হয়েছে তা ১৯৪৭-এর পূর্বে। কারণ, ১৯১১ সাল অবধি এ শহরটি সমগ্র ভারতের রাজধানী ছিল। ভারতের লক্ষ্য,শুধু পাকিস্তান বা বাংলাদেশকে দুর্বল করা নয়। মূল লক্ষ্যটি, উপমহাদেশের মুসলিম শক্তির কোমর ভেঙ্গে দেয়া। ভারতের লক্ষ্য যদি স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলাদেশের নির্মাণ হত, তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাদবাকী অস্ত্র-শস্ত্র, যানবাহন ও সম্পাদ নিজেরা না নিয়ে বাংলাদেশে রেখে যেত। কিন্ত ভারত তা করেনি। দরিদ্র বাংলাদেশীদের সুখ-শান্তি তাদের কাম্য হলে হাজারো মাইল ব্যাপী সীমান্ত খুলে দিয়ে সীমাহীন লুন্ঠন করত না। সরকারি ভাবে শত শত কোটি টাকার জাল নোট ছেপে পঙ্গু করত না বাংলাদেশের অর্থনীতি। তারা শুধু পাকিস্তানের মেরুদণ্ডই ভাঙ্গেনি, মেরুদণ্ড ভেঙ্গেছে বাংলাদেশেরও। বাংলাদেশ যেভাবে ভিক্ষার তলাহীন আন্তর্জাতিক ঝুড়িতে পরিণত হলো, তার জন্য শুধু শেখ মুজিব ও তার দলীয় দুর্বৃত্তরাই শুধু দায়ী নয়। সবচেয়ে বেশী দায়ী ভারতীয় দুর্বৃত্তগণ।

পাত্রের তলার ন্যায় একটি দেশের তলা হলো তার সীমান্ত। চোরাচালানের মারফত দেশের সম্পদ হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে সেদেশের শক্ত প্রহরাধীন সীমান্ত। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে দেশের সীমান্ত রক্ষায়। অনেকে পাকা দেয়াল বা কাঁটা তারের বেড়াও স্থাপন করে। দেশের তলা ছিদ্র হলে বা খুলে যাওয়াতে লাভ হয় প্রতিবেশীর, বাংলাদেশের তলা খসে পড়াতে দেশের সম্পদ সরাসরি গিয়ে উঠে ভারতে। কারণ ভারতই হলো বাংলাদেশের প্রতিবেশী। মুজিবামলে বস্তুত সেটিই ঘটেছে। দেশের সম্পদ ও বিদেশের দেয়া খয়রাতি মালামাল তখন বাংলাদেশের নিজ ভাণ্ডারে থাকেনি। খাদ্যশস্য বিপুল ভাবে ভারতে যাওয়াতে দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়।১৯৭৩-৭৪’য়ের সে দুর্ভিক্ষ বহু লক্ষ বাংলাদেশী মারা যায়। ১৯৭১’য়ের ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে ১৯৭২’য়ের কিছু কাল বাংলাদেশ ছিল ভারাতীয় সেনাদের দ্বারা অধিকৃত। তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে ভারতীয় সেনাদল লুটপাটের অবাধ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। সমগ্র দেশটাকে তারা মনে করে যুদ্ধজয়ের গণিমত। ভারতীয় সেনাবাহিনী তখন ইচ্ছামত ব্যাংক-বীমা, সরকারি গুদাম ও অফিস-আদালত, সেনানিবাস ও কলকারখানায় প্রবেশ করে এবং খুঁজে খুঁজে নিয়ে যায় অর্থ, সম্পদ, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কলকারখানার যন্ত্রাংশ-যা পাকিস্তানে আমলের ২৩ বছরে জমা হয়েছিল। একাত্তরে ভারতের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরুর অন্যতম কারণ তো ছিল এরূপ পরিকল্পিত লুটপাট।

 

সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি বাংলাদেশের

ভারতের জন্য যুদ্ধটি ছিল এক ঢিলে দুই পাখি শিকার। পাকিস্তানকেও যেমন খণ্ডিত ও দুর্বল করতে পেরেছে, তেমনি অবাধ লুন্ঠনের মাধ্যমে দুর্বল করার সুযোগ পেয়েছে অধিকৃত বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের জন্য এটি ছিল অপূরণীয় মহাক্ষতি। বাংলাদেশ আজও সে ক্ষতি পুরণ করতে পারিনি। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অব্যবহৃত হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র-শস্ত্রই শুধু নিয়ে যায়নি, নিয়ে গেছে তৎকালীন সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার সামরিক-বেসামরিক গাড়ী, রেলগাড়ীর ইঞ্জিন ও বগি, সামুদ্রিক জাহাজ এবং ব্যাংকে গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রা। এমনকি সরকারী অফিস, সেনাবাহিনীর মেস, সরকারি রেস্ট হাউস থেকে তারা ফ্যান, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার পর্যন্ত নিয়ে যায়। ভারতীয় বাহিনীর লুণ্ঠন প্রসঙ্গে মুক্তিবাহিনীর নবম সেক্টরের কমান্ডার মেজর (অবঃ) এম.এ. জলীল লিখেছেন, “সে লুন্ঠন ছিল পরিকল্পিত লুন্ঠন,সৈন্যদের স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ নয়।সে লুন্ঠনের চেহারা ছিল বীভৎস বেপরোয়া।সে লুন্ঠন একটি সচেতন প্রতিক্রিয়ারই ধারাবাহিক কর্মতৎপরতা। মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধিপতি হিসেবে আমি সেই ‘মটিভেটেড’ লুন্ঠনের তীব্র বিরোধিতা করেছি- সক্রিয় প্রতিরোধও গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি।লিখিত ভাবেও এই লুন্ঠনের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন,কর্ণেল ওসমানী এবং ভারতীয় পূর্ব অঞ্চলের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল অরোরার কাছে চিঠিও পাঠিয়েছি।তাজউদ্দীন সাহেবের পাবলিক রিলেশন অফিসার জনাব তারেকই আমার সেই চিঠি বহন করে কলকাতায় নিয়েছিলেন।১৭ই ডিসেম্বর রাতেই সেই বিশেষ চিঠিখানা পাঠানো হয়েছিল।খুলনা শহরে লুটপাটের যে তান্ডব নৃত্য চলেছে তা তখন কে না দেখেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক সেই লুটপাটের খবর চারিদিক থেকে আসা শুরু করে।পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক পরিত্যাক্ত কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক গাড়ী,অস্ত্র,গোলাবারুদসহ আরো অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ‘প্রাইভের কার’ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি,তখনই কেবল আমি খুলনা শহরের প্রাইভেট গাড়িগুলো রিকুইজিশন করে খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে হেফাযতে রাখার চেষ্টা করি।এর পূর্বে যেখানে যে গাড়ী পেয়েছে সেটাকেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সীমান্তের ওপারে।যশোর সেনানিবাসের প্রত্যেকটি অফিস এবং কোয়ার্টার তন্ন তন্ন করে লুট করেছে।বাথরুমের ‘মিরর’ এবং অন্যান্য ফিটিংসগুলো পর্যন্ত সেই লুটতরাজ থেকে রেহাই পায়নি।রেহাই পায়নি নিরীহ পথযাত্রীরা।কথিত মিত্র বাহিনীর এই ধরনের আচরণ জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল।-(মেজর এম. এ. জলিল)।এরূপ লুণ্ঠন যে শুধু খুলনা ও যশোর শহরে হয়েছে তা নয়,প্রতিটি জেলা শহর,প্রতিটি মহকুমা শহর,প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট ও প্রতিটি শিল্প এলাকায় হয়েছে।কিন্তু সেসব স্থানে কোন মেজর জলিল ছিল না,ফলে সে বিবরণ নিয়ে কোন বই লেখা হয়নি।একাত্তরের ইতিহাসের কোন গ্রন্থেও সে বীভৎস লুণ্ঠনের কাহিনী স্থান পায়নি।বাংলাদেশের তৎকালীন তাজউদ্দীন সরকার ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ তখন সে ভারতীয় লুণ্ঠন স্রেফ নিরবে দেখেছে,কোন প্রতিরোধ খাড়া করেনি।সামান্যতম প্রতিবাদও করেনি।বরং সে লুণ্ঠন কালে তারা বিজয় উৎসব নিয়ে মেতেছে।

সে ভারতীয় লুন্ঠনের ফল দাঁড়ালো,একাত্তরের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে কোন ট্যাংক ছিল না,বিমান বাহিনীর হাতে কোন বিমান বা হেলিকপ্টারও ছিল না,নৈ-বাহিনীতে কোন যুদ্ধ জাহাজও ছিল না।কোন সমুদ্রগ্রামী জাহাজ ছিল না শিপিং লাইনে।ভারতীয় লুণ্ঠনে অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড এতোটাই ভেঙ্গে পড়ে যে,দেশ দ্রুত একটি দুর্ভিক্ষের দিকে ধাবিত হয়।অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি রিফারেন্ডামের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা দেশ অধিকৃত হত না। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদের কোনটাই তখন ভারতে যেত না।কিন্তু সে পথে ভারত এগুতে দেয়নি।বাংলাদেশের মেরুদণ্ড ভাঙ্গার স্ট্রাটেজীকে সামনে রেখেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দেয়া রিফারেন্ডামের প্রস্তাব মানেননি।কারণ,সেটি হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হতো না।তাতে প্রতিষ্ঠা পেত না ভারতীয়দের লুটের রাজত্ব। তাতে পঙ্গু এবং মেরুদন্ডহীন বাংলাদেশ সৃষ্টির ভারতীয় প্রকল্প বাস্তবায়ীত হতো না।প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানতেন,ভারতের সাথে যুদ্ধ করে অখণ্ড পাকিস্তানকে বাঁচানো যাবে না।বাঁচানো যাবে না ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকৃতি হওয়া থেকেও।কারণ,যুদ্ধ যখন দরজার সামনে,তখনও পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিল না।ইয়াহিয়া খানের পুরা শাসনকালটি কেটেছে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলির মাঝে রাজনৈতিক নিষ্পত্তি নিয়ে।তাই তিনি চাচ্ছিলেন,ভারতীয় সেনা প্রবেশের ভয়ানক ক্ষতি থেকে অন্ততঃ পূর্ব পাকিস্তানীরা বেঁচে যাক।তাই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির কাছে তিনি রেফারেন্ডামের প্রস্তাব রেখেছিলেন।–(Chowdhury, G.W. 1974)।কিন্তু ভারত যখন যুদ্ধ চাপিয়েই দিল,তখন সে যুদ্ধ লড়া ছাড়া দেশের প্রেসিডেন্ট রূপে তার কাছে ভিন্ন কোন রাস্তা ছিল না।

অথচ রিফারেন্ডামের মাধ্যমে স্বাধীন হলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বহু এ্যাসেটেরই ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ পেত।ভাগে পাওয়া যেত পিআইএ’য়ের অনেকগুলি বিমান,শিপিং লাইনের অনেকগুলি বড় বড় জাহাজ,বিমান বাহিনীর বহু ফাইটার জেট,নেভীর নেভাল শীপ এবং সামরিক অস্ত্রের বিশাল হিস্যা। পাওনা নিয়ে তখন দর কষাকষি করা যেত।পাওয়া যেত পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের গচ্ছিত আমানতের শত শত কোটি টাকার হিস্যা।তা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে আরেক শক্তিশালী দেশ রূপে গড়ে তোলার সামর্থ্য বাড়তো।কিন্তু তা নিয়ে মুজিবের আগ্রহ ছিল না। তার প্রয়োজন ছিল স্রেফ গদি।সেটি যদি দেশকে ভিক্ষার ঝুলি করেও হয়।তাছাড়া ভারতও সেটিই চাইতো।ভারত কখনোই চায়নি,তার পূর্ব সীমান্তে আরেকটি শক্তিশালী পাকিস্তান গড়ে উঠুক।ভারত আজও চায় না,বাংলাদেশ শক্তিশালী সামরিক বাহিনী,বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর অধিকারি হোক।প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে বাংলাদেশ সরকার চীন থেকে কয়েকখানি মিগ ২১ কেনার চুক্তি করেছিল।আর তাতেই প্রবল প্রতিবাদ উঠেছিল ভারতে। ভারতীয় পত্র-পত্রিকা বিশেষ করে “ইন্ডিয়া টুডে” সে মিগ ক্রয়কে ভারতের বিরুদ্ধে হুমকী বলে আখ্যায়ীত করেছিল।তাদের প্রশ্ন,বাংলাদেশ যুদ্ধ বিমান দিয়ে কি করবে? তাদের মনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন,বাংলাদেশ আলাদা মানচিত্র দিয়েই বা কি করবে? লক্ষ্য যখন সেক্যুলার বাঙালী রূপে বেড়ে উঠা তখন সে সুযোগ তো সীমান্ত তুলে দিলে বাড়বে।সেজন্য তো আলাদা দেশ এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী,নৌবাহিনী বা বিমান বাহিনী লাগে না।পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের বাঙালী রূপে বেড়ে উঠায় কি কোন কমতি আছে?

একাত্তরের বড় অর্জনটি হলো যুদ্ধে বিধ্বস্ত ও লুণ্ঠিত বাংলাদেশ।প্রতিপক্ষকে ভাতে মারবো,পানিতে মারবো এ আস্ফালন নিয়ে যু্দ্ধে নামলে তখন আলাপ আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তখন একমাত্র যুদ্ধ করা,হত্যা করা, গ্রেফতার করা ও ছিনিয়ে নেয়ার রাস্তাটিই খোলা থাকে। সম্পদ ভাগাভাগীর শান্তিপূর্ণ পথটি তখন চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই একাত্তরের যুদ্ধশেষে পাকিস্তানের কাছে সম্পদ ভাগের দাবী জানাোনর আর কোন বৈধ পথই খোলা ছিল না। সেরূপ কথা মুখের আনার পরিবেশও ছিল না। অথচ সে সুযোগটি ছিল ১৯৪৭ সালে। দিল্লির ট্রেজারি, রিজার্ভ তহবিল ও কেন্দ্রীয় সরকারের এ্যাসেট থেকে তখন পাকিস্তানে হিস্যা পেয়েছিল। একাত্তরের যুদ্ধে তাই সর্বভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এবং সেটি হয়েছে ভারতীয় পরিকল্পনার অংশ রূপে। সে যুদ্ধে ভারত বিশ্বের বুকে শক্তিশালী রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়। অপরদিকে পাকিস্তানের পরাজয় হলেও দেশটিকে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলিতে পরিণত হতে হয়নি। সে দেশে দুর্ভিক্ষও আসেনি। কোন নারীকে সে দেশে জালপড়া বাসন্তি হতে হয়নি। (বাসন্তি ছিল উত্তর বঙ্গের এক দরিদ্র মহিলা যে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে কাপড়ের অভাবে মাছ ধরা জাল পড়তে বাধ্য হয়েছিল যা সে সময় পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশের সমগ্র ইতিহাসে এটি ছিল এক লজ্জাজনক ঘটনা)। কিন্তু সকল রূপ দুরাবস্থাই জুটেছে বাংলাদেশের ভাগ্যে।

লক্ষ্যণীয় হলো, একাত্তরের ইতিহাস যারা লিখেছেন তারা একাত্তরে যু্দ্ধে বাংলাদেশের এসব ব্যর্থতা ও বঞ্চনা নিয়ে কিছুই লেখেননি। বরং দস্যুচরিত্রের ভারতকে চিত্রিত করা হয়েছে অকৃত্রিম বন্ধু রূপে। আর ভারতের কাছে নতজানু নেতাকে বানানো হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। ভারতীয় সৈনিকগণ যখন লুণ্ঠনে লিপ্ত, মুক্তিবাহিনীর লোকেরা সে লুণ্ঠন না রুখে বরং নিজেরাও লুণ্ঠনে নেমেছে। মেজর আব্দুল জলিলের ন্যায় তারাও রুখে দাঁড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ভারতে যাওয়া থেকে বাঁচানো যেত। মেজর আব্দুল জলিল খুলনা এলাকায় লুণ্ঠন রুখতে গিয়ে সেনাবাহিনীর চাকুরি হারিয়েছিলেন। মুক্তি বাহিনীর লুণ্ঠনের শিকার হয় দেশের অর্থ ভাণ্ডারই শুধু নয়, বহু হাজার অবাঙালী (বিহারী)পরিবার এবং তৎকালীন পাকিস্তানপন্থী নেতাকর্মী ও রাজাকারদের পরিবারও। ফলে এসব লুণ্ঠনকারিরা রাতারাতি বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে যায়। রাজনীতি ও অর্থনীতির অঙ্গনে এভাবে সৃষ্টি হয় ভয়ানক এক দানব শ্রেণী। বাংলাদেশ মূলত আজও সে দানবদের হাতে অধিকৃত। তাদের সম্পদের আজও হিসাব নিলে সে বীভৎস লুণ্ঠনের প্রচুর প্রমাণ মিলবে। এবং প্রচুর প্রমাণ মিলবে একাত্তরের বহু নৃশংস নাশকতার।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *