অধ্যায় তেরো: নীতিহীনতা ও আত্মঘাতী অনৈক্য
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 29, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
আত্মঘাতী নীতিহীনতা
পাকিস্তানের ব্যর্থতার জন্য দেশটির শত্রুরাই শুধু দায়ী নয়, দায়ী তারাও যারা দেশটির প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রেখেছে।অতিশয় আত্মঘাতী ছিল বহু পাকিস্তানপন্থি ও ইসলামপন্থির রাজনীতি। রোগী অনেক সময় মারা যায় রোগের কারণে নয়, চিকিৎস্যকের ভুল চিকিৎসার কারণেও। পাকিস্তানের ক্ষতিটা হয়েছে দুই ভাবেই। পাকিস্তানের মূলে সর্বপ্রথম যে কুড়ালটি আঘাত হানে তা হলো মুসলিম লীগ নেতাদের আভ্যন্তরীন কোন্দল।দেশের মেরুদণ্ডে আঘাত হেনেছে সুযোগসন্ধানী আমলা কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তা ও সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকগণ। দেশটির জন্য বিপদ বাড়িয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের নীতিহীনতা ও অযোগ্য নেতৃত্ব। কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর আর কোন নেতাই তেমন যোগ্যতা, সততা ও দুরদৃষ্টির পরিচয় দিতে পারেননি। জন্ম থেকেই পাকিস্তান অতি জটিল সমস্যার সম্মুখীন ছিল। দেশটির দুটি অংশ ১২০০ মাইলের দুরত্ব দিয়ে বিভক্ত ছিল। ছিল রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের বিষয়। ছিল নতুন সংবিধান তৈরীর বিশাল কাজ। ছিল ভারতের ন্যায় আগ্রাসী শক্তির লাগাতর হামলার হুমকী। প্রতিবেশী ভারত পাকিস্তানের সৃষ্টির যেমন বিরোধী ছিল,তেমনি প্রচণ্ড বিরোধী ছিল দেশটির বেঁচে থাকার বিরুদ্ধেও।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে হাজার হাজার কংগ্রেস কর্মী,হিন্দু উগ্রবাদী ও কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মী ১৯৪৭ সালের পরও থেকে যায় যারা পাকিস্তানের সৃষ্টির বিরোধীতা করেছিল। তারা ছিল ভারতের ট্রোজান হর্স। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল পাকিস্তানের দুর্বল মুহুর্তে মরণ-আঘাত হানার।একাত্তরে সে মোক্ষম সুযোগটিই তারা পেয়েছিল। তবে দেশ শয্যাশায়ী হলে রাজনৈতিক অসুস্থ্যতার শুরু কায়েদে আযমের মৃত্যুর পর পরই। মুসলিম লীগ নেতারা ছিল কলহে লিপ্ত। পূর্ব বাংলায় তখন মুসলিম লীগের খাজা নাযিম উদ্দীন গ্রুপ ক্ষমতায়। নেতৃত্বের সে লড়াইয়ে সোহরাওয়ার্দী পরাজিত হয়ে ভারতেই থেকে যান। কিন্তু তার সমর্থকগণ নীরবে বসে থাকেননি। বসে থাকেননি বাংলার আরেক নেতা ফজলুল হক। ফজলুল হক মুসলিম লীগের বিরোধীতা করতে গিয়ে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণ্ড মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু মহসভার সাথে আঁতাত করেছিলেন। তার এ অদ্ভূদ কাণ্ড পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাঁকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে। কিন্তু তারপরও তিনি ক্ষমতার মোহ ছাড়েননি। পরাজিতরা সব সময়ই ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার আশায় নতুন বন্ধু খোঁজে। তখন শত্রুর যে কোন শত্রুই পরম বন্ধুতে পরিণত হয়। নিজের রাজনৈতিক দুর্দিনে পাকিস্তানের আজন্ম কংগ্রেসী শত্রুদেরকেও তিনি বন্ধু রূপে গ্রহণ করেন।
এককালে যারা মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন যেমন ভাষানী, আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিব তারা ক্ষমতাসীন খাজা নাযিমুদ্দীনের মোকাবেলায় গড়ে তোলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। নানা বিপর্যয়ের মাঝেও নীতিবান মানুষেরা আপন নীতি নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকে। নীতি থেকে তারা হেলে না। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তো নীতিতে এরূপ অটল থাকায়। মার্কিন রাজনীতিতে যারা রিপাবলিকান বা ডিমোক্রাট এবং ব্রিটিশ রাজনীতিতে যারা কনজারভেটিভ বা লেবার সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সে নীতিতে তাঁরা আজীবন অটল থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাঙালী মুসলিম নেতাদের চরিত্রে যেটি সবচেয়ে ঠুনকো সেটি হলো রাজনৈতিক বিশ্বাস ও নীতি। বাংলার ঘন ঘন ঋতু পরিবর্তন বা বাঙালী রমনীর শাড়ী পরিবর্তনের ন্যায় তাদের রাজনৈতিক চরিত্রেও আসে দ্রুত পরিবর্তন। কখনও প্যান-ইসলামী, কখনো বাঙালী জাতীয়তাবাদী, কখনও সেক্যুলার, কখনও সমাজতন্ত্রি, কখনও বা একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচারি -এরূপ নানা রঙ্গে রঞ্জিত হয় তাদের রাজনীতি।এরূপ প্রচণ্ড নীতিহীনতাই তাদের নীতি।কোন নীতি নয়,ক্ষমতার মোহই তাদের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি।এসব নীতিহীন রাজনীতিদগণই পরিণত হয় পাকিস্তানের পরম শত্রুতে।বাইরের শত্রুরা শুধু কলকাঠি নেড়েছে মাত্র, কিন্তু দেশধ্বংসের বাকী কাজটি তারাই করেছে।
কংগ্রেসে দীক্ষা ও নাশকতা
বাংলার মাটিতে নীতিহীন রাজনীতির দুই বহুরূপী নেতা হলেন মাওলানা ভাষানী ও শেখ মুজিব। বাঙালী মুসলিমগণ আজ যে পর্যায়ে পৌছেছে তার জন্য বহুলাংশে দায়ী এই দুই নেতা। এ দুই নেতাকে না জেনে একাত্তরের ইতিহাস বুঝা তাই অসম্ভব। নিজেদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তারা বহুবার বহুরূপে হাজির হয়েছেন। শুরুতে উভয়ই মুসলিম লীগ করতেন। তখন ছিলেন প্রান-ইসলামি। ব্রিটিশ আমলে ভাষানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। আসামের রাস্তায় রাস্তায় লড়েছেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে।আসামের সিলেট পাকিস্তানভূক্ত হয়েছে তাদেরই চেষ্টায়। মুজিব লড়েছেন কলকাতার রাস্তায়। তখন তাদের মুখে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” শোভা পেত। তাদের উপস্থিতিতে “নারাযে তাকবীর, আল্লাহু আকবর” ছিল রাজপথের সবচেয়ে সোচ্চার স্লোগান। তখন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীগণ স্লোগান দিতেন, “পাকিস্তান কা মতলব কিয়া, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। আল্লাহ ছাড়া কোন প্রভু নাই সে কথাটিও তারা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিতেন। কিন্তু পরবর্তীতে এ দুই নেতাই সে নীতিতে অটুট থাকেননি। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে তারা দোষারোপ করেছেন, কিন্তু নিজেরাই বার বার বদলে গেছেন। কথা হলো, মহাপ্রভু মহান আল্লাহতায়ালাকে প্রভু মেনে নিলে তো বার বার নীতি বদলানো এবং মাও সে তুঙ বা গান্ধির অনুসারি হওয়ার প্রশ্ন উঠে না।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ভাষানী ও মুজিব -এই দুই নেতা মুসলিম লীগ ভেঙ্গে আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়েন। দলটি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন ভাষানী; কিছুদিন পর সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিব।পরে সে আওয়ামী মুসলিম লীগের মুসলিম শব্দটি তাদের ভাল লাগেনি, কারণ তাতে হিন্দুদের ভোট পেতে অসুবিধা হচ্ছিল। মুসলিম শব্দটিকে তারা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেন। দলে ভারি হওয়ার জন্য কংগ্রেসের নেতাকর্মীদেরই শুধু দলে টানেননি, কংগ্রেসের সেক্যুলার নীতিকেও তারা গ্রহণ করেন।আওয়ামী লীগের কাগমারি সম্মেলনে নিজেদের রাজনৈতিক ধর্মান্তরের বিষয়টি প্রকাশ করতে কংগ্রেসী নেতা গান্ধি ও সুভাষ বোসের নামে বিশাল তোড়ন নির্মাণ করেছিলেন। গান্ধির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর অর্থ তো তার অখণ্ড ভারত নীতির প্রতিও শ্রদ্ধা দেখানো। এরূপ রাজনৈতিক ধর্মান্তরের ফলে আওয়ামী লীগের লাভ হয়েছিল প্রচুর। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুগণ আওয়ামী লীগের স্থায়ী ভোটারে পরিণত হয়।
মুসলিম লীগের নীতি ছিল পাকিস্তান গড়া ও পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখা। কংগ্রেসী নীতি গ্রহণ করার পর এসব নব্য রাজনৈতিক কনভার্টদের নতুন কর্মসূচী হয় কংগ্রেসের মিশন পূরণ তথা পাকিস্তান ভাঙ্গা। মুসলিম লীগের প্যান-ইসলামিক নীতি তাদের কাছে সাম্প্রদায়িক মনে হয়। পূর্ব পাকিস্তান মনে হয় পাঞ্জাবীদের উপনিবেশ। ফলে পাকিস্তান বাঁচানোয় আগ্রহটি তাদের রাজনীতিতে ত্বরিৎ বিলুপ্ত হয়। তাই রাজনীতির শেষের পর্বটি তারা খেলেছেন পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে। ভাষানী নিজেকে পীর ও মাওলানা রূপে পরিচয় দিলেও দেশে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা বা ইসলামি নীতির বিজয় নিয়ে কোন কালেই কোন আগ্রহ দেখাননি। বাঙালী জাতীয়তাবাদে দীক্ষা নেয়ায় তাদের উভয়ের কাছে শত্রু গণ্য হয় ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা অবাঙালীগণ। ফলে একাত্তরে যখন বহু লক্ষ বিহারীকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে বস্তিতে পাঠানো হয় সে বর্বরতার নিন্দা মুজিব যেমন করেননি,ভাষানীও করেননি।বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা নিয়ে মুজিবের বহুবছর আগেই ভাষানী পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিদায়ী সালাম জানিয়েছিলেন।ভাষানীর কিছু ভক্ত সে কারণে মাঝে মধ্যে তাকে স্বাধীনতার ঘোষক এবং জাতির পিতা বানানোরও দাবি তোলে। পরবর্তীতে তিনি চীনের মাও সে তুঙয়ের নীতিতে দীক্ষা নেন এবং রাজনৈতিক আশ্রয় দেন নাস্তিক কম্যুনিষ্ট ও সমাজতন্ত্রিদের ।কাশ্মীরের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেয়ে তার কাছে বেশী গুরুত্ব পায় ভিয়েতনামীদের যুদ্ধ।তিনি সত্তরের নির্বাচনে অংশ নেননি, এভাবে আও য়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়টি সহজতর করেন।একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার মিশনটি সফল করতে আওয়ামী লীগ নেতাদের ন্যায় ভাষানীও ইন্দিরা গান্ধির মেহমানে পরিণত হন।
রাজনীতির নানা স্রোতে নানামুখি ভাসাটি ঈমানদারি নয়। বিশুদ্ধ ঈমান ও নীতি নিয়ে আমৃত্যু অটল থাকাটাই মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত বিধান। এটিই প্রকৃত ঈমানদারি। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে অতি প্রিয় হলো সেসব ঈমানদার ব্যক্তি যারা বিশ্বাস ও নীতিতে অটল। ঈমানের দাবী যে কেউ করতে পারে। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালা উপর ঈমানে যারা অটল একমাত্র তাদেরকেই তিনি সাচ্চা ঈমানদার বলেছেন। পবিত্র কোরআনে সে ঘোষণাটি এভাবে এসেছ,“একমাত্র তারাই ঈমানদার যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান আনলো এবং তারপর অটল থাকলো (অর্থাৎ কোনরূপ হেরফের করলো না) এবং জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করলো -ঈমাদের দাবীতে তারাই সাচ্চা।”–(সুরা হুজুরাত আয়াত ১৫)।ঈমানদার তাই অটল তার ধর্ম ও রাজনীতিতেও। তখন রাজনীতিতে প্রতিফলন ঘটে ঈমানদারির। তাই যে ব্যক্তি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” সে রাজনীতিতে চীনমুখি বা ভারতমুখি হয় না। সে আমৃত্যু ইসলামমুখি হয়। ইসলামের প্যান-ইসলামি নীতি পরিহার করে সেক্যুলার বা জাতীয়তাবাদীও হয় না। মুসলিম রাষ্ট্র ভাঙ্গাও তার নীতি হয় না। কিন্তু যারা নীতিহীন তাদের পক্ষে কোন একটি নীতিতে অটল থাকাটাই অসম্ভব হয়। সে চিত্রটাই বার বার দেখা গেছে ভাষানী,মুজিব এবং তাদের অনুসারিদের রাজনীতিতে।
গুরুত্ব হারায় শরিয়তের প্রতিষ্ঠা
মুসলিম রাজনীতির মূল লক্ষ্যটি হলো শরিয়তের প্রতিষ্ঠা।সে সাথে সুশাসন এবং মুসলিম স্বার্থের সুরক্ষা। রাজনীতি এখানে হাতিয়ার রূপে কাজ করে। এজন্যই মুসলিমের রাজনীতি স্রেফ রাজনীতি নয়, এটি পবিত্র জিহাদ। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য অমুসলিমদের ভোট প্রাপ্তিও যখন জরুরী হয়ে পড়ে তখন রাজনীতি থেকে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি বাদ পড়তে বাধ্য। কারণ ইসলামের প্রতিষ্ঠা, মুসলিম স্বার্থ রক্ষা এবং মুসলিমের গৌরব বৃদ্ধিতে অমুসলিম ভোটারদের আগ্রহ থাকার কথা নয়। ইসলামে অঙ্গীকার আছে এমন দলকে অমুসলিম ভোটারগণ ভোট দিবে সেটি কি আশা করা যায়? ফলে যারা অমুসলিমদের ভোট চায় তাদের নীতি বদলায়। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে অবিকল সেটিই ঘটেছে। ফলে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যেমন অসম্ভব ছিল, তেমনি অসম্ভব ছিল দেশটিকে বাঁচিয়ে রাখাও। স্রেফ হিন্দুদের মন জয়, নিজেদের ক্ষমতালাভ এবং ইসলামপন্থিদের পরাজয় সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দী, ভাষানী, আবুল মনসুর আহমদসহ আওয়ামী লীগ নেতাগণ যুক্ত নির্বাচন প্রথাকে মেনে নিতে পাকিস্তান সরকারকে বাধ্য করেন। এভাবে চাকু বসিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তানের আদর্শিক মেরুদণ্ডে। সে আঘাত নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে শক্ত ভাবে নিজ পায়ে দাঁড়ানো আর কোন কালেই সম্ভব হয়নি।
হিন্দুদের ভোট লাভের লক্ষ্যে মুসলিম প্রার্থীগণও হিন্দু এজেণ্ডাকে নিজেদের রাজনৈতিক এজেণ্ডা বানাতে পরস্পরে প্রতিযোগীতা করে। ফলে এক কালে যারা “পাকিস্তান কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” ধ্বনি তুলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যারা যোগ দিয়েছিল তারাই ইসলামের পক্ষ নেয়াকে সাম্প্রদায়িকতা বলে গালীগালাজ শুরু করে। ফলে অভাব দেখা দেয় ইসলাম ও অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ানোর লোকের। এরই পরিণতি হলো, লিয়াকত আলী খান প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে ইসলামী শাসনতন্ত্র নির্মাণের লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালে যে ২২ দফা ইসলামী মূল নীতি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল সেটি নিয়ে সামনে এগুনোর নেতা পাওয়া যায়নি। রাজনীতি তখন আর ইবাদত থাকেনি, পরিণত হয় নিছক ক্ষমতা দখলের নোংরা লড়ায়ে। এমন রাজনীতিতে শুরু হয় আল্লাহর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ও পাপাচার। বেগবান হয় সেক্যুলারিজম, সোসালিজম ও সর্বস্তরে দুর্নীতি। নীতি হয়ে পড়ে যে কোন ভাবে দলে ভারী হওয়া, নির্বাচনে বিজয় এবং ক্ষমতা লাভ। এমন সুবিধাবাদী নীতিতে কি কোন আদর্শভিত্তিক দেশ বাঁচে? যে প্যান-ইসলামিক চেতনার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে আদর্শের অনুসারিদেরই চরম শূন্যতা দেখা দেয় পাকিস্তানে। যে পাকিস্তানের জন্য যারা এক সময় রাস্তায় রাস্তায় লড়াই করেছিল, তারাই লড়াই শুরু করে কি করে পাকিস্তানকে দ্রুত কবরে পাঠানো যায়।
বিভেদের রাজনীতি
মুসলিম লীগের নীতিহীনতাও কম দুঃখজনক ছিল না। যতটা নীতি বিসর্জনে তারা রাজী ছিল, ক্ষমতা বা নেতৃত্ব ছাড়তে ততটা রাজী ছিল না। ক্ষমতাসীন মুসলিমের লীগের প্রাদেশিক প্রধান ছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ। প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জনাব নুরুল আমীন। তাদের মধ্যে লড়াই তখন তুঙ্গে। মাওলানা আকরাম খাঁর চেষ্টা ছিল আজীবন পদটা ধরে রাখা।স্রেফ নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে মুসলিম লীগের সাংগঠনিক প্রসার বা শক্তি সঞ্চয়কেও গুরুত্ব দেননি। জনাব নুরুল আমীনও তেমনি নিছক ব্যক্তিগত স্বার্থে মুসলিম লীগের অনেক নেতাকে মন্ত্রীত্ব দেননি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আসনে তখন খাজা নাজিমুদ্দীন। তিনিও জানতেন না কি করে আপোষ করতে হয়। তাই তিনিও দলে স্থান দেননি মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দীর অনুসারিদের।বিভেদের সংক্রামক জীবাণু ছিল ভাষানী ও সোহরাওয়ার্দীর মাঝেও। ফলে তারা উভয়ে মিলে যে আওয়ামী লীগ গড়লেন সে দলেও তারা একত্রে বেশী দিন থাকতে পারেননি। তুমুল লড়াই শুরু হয় ভাষানীর সাথে সোহরাওয়ার্দীর। আওয়ামী লীগ ছেড়ে ভাষানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গড়লেন। সেখানেও শুরু হলো বিভক্তি। চীনাপন্থি ও মস্কোপন্থিদের লড়াইয়ে এ দলটিও ভেঙ্গে গেল। এভাবে যে দলটিই ভাষানী গড়েছেন,সেখানে বিভেদও গড়েছেন। এমন বিভক্তির রাজনীতিতে কি দেশ বাঁচে?
এত বিভক্তির কারণ, রাজনীতি পরিণত হয়েছিল স্রেফ ক্ষমতা লাভের হাতিয়ারে।ক্ষমতার মোহে তারা নীতির উপর অটল থাকতে পারেননি। অথচ ইসলামে রাজনীতি হলো শরিয়ত প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম স্বার্থ রক্ষার কাজে পবিত্র যুদ্ধ তথা জিহাদ। রাজনীতি তাই নেক আমলের হাতিয়ার। অথচ ক্ষমতালোভীদের হাতে রাজনীতি পরিণত হয়েছিল ক্ষমতালাভ, অর্থলাভ ও যশলাভের ব্যবসায়।তাদের ছিল না আখেরাতের চিন্তা। ফলে রাজনীতিতে উপেক্ষিত হয়েছে জিহাদ তথা ইবাদতের প্রেরণা। উপেক্ষিত হয়েছে সে পবিত্র লক্ষে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার বুদ্ধিবৃত্তি। অথচ পাকিস্তান ছিল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের ফসল। এ আন্দোলনকে সফল করতে কাউকে একটি ঢিল বা তীরও ছুঁড়তে হয়নি।
শত্রু উৎপাদনের ইন্ডাস্ট্রী
জনগণকে দৈহিক ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে যেমন লক্ষ লক্ষ টন খাদ্য শস্য চাই, তেমনি তাদের মনের সুস্থতা বাঁচাতেও চাই লক্ষ লক্ষ বই। চাই লাগাতর জ্ঞানের জোগান। এবং ঈমানদার রূপে টিকিয়ে রাখতে চাই প্রচুর ইসলামি বই। ইসলামে জ্ঞানার্জন তাই নামায-রোযা, হজ-যাকাতের পূর্বে ফরয করা হয়েছিল। কোরআনের আগে আরবী ভাষায় কোন গ্রন্থ ছিল না। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই মুসলিম মনিষীগণ প্রচুর বই লেখেন,এবং গড়ে তুলেন জ্ঞানের বিশাল সমুদ্র। ভারতীয় মুসলমানদের সৌভাগ্য যে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিন গুলোতে এক ঝাঁক আলোকিত বুদ্ধিজীবী পেয়েছিল যারা আসন্ন হিন্দু আধিপত্যের ভয়াবহতা বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লামা ইকবাল, মাওলানা মহম্মদ আলী, আকরাম খাঁ এবং আরো অনেকে ছিলেন এ বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের অতি সংগ্রামী যোদ্ধা। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বুদ্ধিবৃত্তিক রণাঙ্গনে নতুন যোদ্ধা দেখা যায়নি।নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বাড়েনি ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিতে।ফলে জনগণ পুষ্টি পায়নি তাদের ঈমানে।
বরং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঘটেছে উল্টোটি। সরকার সেনাবাহিনী গঠনে ও কলকারখানা বৃদ্ধিতে মনযোগী হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির রণাঙ্গন দখলে গেছে সেক্যুলারিস্ট ও বামপন্থিদের হাতে। তাদের পক্ষ থেকে নানা ভাবে আয়োজন বাড়ানো হয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে। যে কোন আদর্শিক দেশই বিরুদ্ধ আদর্শকে দেশে প্রচার সুযোগ দেয়না। এটি নিজ দেহে বিষ ঢুকানোর মত। সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন এজন্যই পুঁজিবাদী বইয়ের প্রকাশ ও প্রচারের সুযোগ দেয়নি। সুযোগ দেয়নি ইসলামী জ্ঞান প্রচারেরও। অথচ পাকিস্তান সরকার ষাটের দশকে দেশের সকল শহরে বিশেষ করে রেল-স্টেশন ও স্টীমার ঘাটে চীন ও সোভিয়েত রাশিয়া থেকে প্রকাশিত মার্কসবাদী বইয়ের নামে মাত্র মূল্যে বিতরণের সুযোগ করে দেয়। এভাবে পরিকল্পিত ভাবে লাগাতর প্রাণনাশী জীবাণু ঢুকানো হয় মুসলিম উম্মাহর দেহে। ফলে দেশ জুড়ে শুরু হয় মার্কসবাদের জোয়ার, বিশেষ করে ছাত্রদের মাঝে। আর মার্কসবাদিরা কি ইসলাম, মুসলিম ও কোন ইসলামি রাষ্ট্রের বন্ধু হতে পারে? এভাবে পাকিস্তান তার নিজ ঘরে নিজের শত্রু উৎপাদনে ইন্ডাস্ট্রী খোলে। এটি সম্ভব হয় দেশের রাজনীতি এবং সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন সেক্যুলারিস্টদের ন্যায় ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে অধিকৃত হওয়ায়।
পাকিস্তানের ২৩ বছরে যে হারে কল-কারখানা ও রাস্তাঘাট গড়া হয়েছে বা কৃষির উন্নয়ন হয়েছে সে হারে ইসলামী পুস্তকের প্রকাশনা হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে কিছুটা হলেও পূর্ব-পাকিস্তানে সে তুলনায় তেমন কিছু হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের আরেকটি সুবিধা ছিল, সেখানে উর্দু মাতৃভাষা না হলেও উর্দুর বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ হয়নি। ফলে ঈমানের পুষ্টি জোগাতে সমৃদ্ধ উর্দু সাহিত্য থেকে জনগণ প্রচুর লাভবান হয়েছে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তান খণ্ডিত হওয়া থেকে বেঁচে গেছে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সে সামর্থ ছিল না।বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বাঙালী হিন্দুগণ গড়ে তুলেছিল নিজের সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটাতে, মুসলমানদের ঈমান বাড়াতে নয়।তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা এমন ছিল, মুসলিম লীগের নেতারা পত্রিকা বের করেছেন,আর সে পত্রিকা অধিকৃত হয়ে গেছে তাদের শত্রুপক্ষের হাতে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ ছিল মুসলিম লীগের নেতা নূরুল আমীনের পত্রিকা। দৈনিক পকিস্তান ছিল আইয়ুব খানের প্রতিষ্ঠিত প্রেসট্রাস্টের সরকারি পত্রিকা। ইংরাজী দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভারও ছিল পাকিস্তানপন্থির পত্রিকা। কিন্তু এগুলো দখল হয়ে যায় ইসলামের বিপক্ষ শক্তির হাতে।
আত্মঘাতী অনৈক্য
ইসলামপন্থি ও পাকিস্থানপন্থিগণ ব্যর্থ হয়েছেন একতার রাজনীতি করতে। একতা অন্যদের কাছে রাজনীতি, কিন্তু ইসলামে এটি ফরজ ইবাদত। রাজনীতি হলো, পরস্পরে আপোষ ও সমঝোতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার বিজ্ঞান। মুসলিম রাজনীতির সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ারটি হলো একতা। একতা ও সমঝোতার পথ বেয়েই আসে মহান আল্লাহতায়ালার রহমত। ১৯৪৭ সালের আাগে বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বিহার, আসাম, সীমান্ত প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশসহ সারা ভারতের মুসলমানেরা একতাবদ্ধ হয়েছিল বলেই তাদের উপর আল্লাহতায়ালার রহমত নেমে এসেছিল এবং সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান।সমাজতান্ত্রিক চেতনা ছাড়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাঁচে না। রাজার প্রতি আনুগত্য ছাড়া রাজতন্ত্র বাচেঁ না। তেমনি প্যান-ইসলামিক চেতনা ছাড়া পাকিস্তানের বেঁচে থাকাটিও অসম্ভব ছিল। কিন্তু সে হুশ মুসলিম লীগ নেতাদের ছিল না। যারা এদেশটির প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিল তারা সে অতি গুরত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়েও গাফলতি দেখিয়েছেন।
পাকিস্তানের ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল ১৯৪৬ সালের মতই আরেক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। পাকিস্তানপন্থিগণ সেটি বুঝতে না পারলেও তাদের শত্রুগণ ঠিকই বুঝেছিল। ফলে এ নির্বাচনে তারা একতাবদ্ধ হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নির্বাচন লড়েছিল তাদের সবার পক্ষ থেকে। কিন্তু একতাবদ্ধ হতে পারিনি পাকিস্থানপন্থি দলগুলি। রাজনীতির আকাশে যখন ঘন কালো মেঘ তখন মুসলিম লীগ বিভক্ত থেকেছে তিন টুকরোয়। জামায়াতে ইসলামি, নিজামে ইসলামি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এর মত ইসলামি দলগুলো একত্রিত হতে পারেনি। আলেমগণও নির্লিপ্ত থেকেছে। পাকিস্তানপন্থি সবগুলি দল একতাবদ্ধ হলে ৭০ য়ের নির্বাচনের রায় হয়ত ভিন্নতর হত। যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহর বড় বড় পরাজয়গুলি জনবল বা অর্থবলের কমতিতে হয়নি। হয়েছে অনৈক্যের কারণে। অনৈক্য বিনাশ ঘটায় সকল সামর্থ্যের।সত্তরের নির্বাচনে সেটিই নতুন করে প্রমানিত হয়েছে।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018