অধ্যায় দশ: মুক্তিযুদ্ধে ইসলামশূণ্যতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 29, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
সংকট ইসলামশূণ্যতার
বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে সবচেয়ে বড় সংকটটি ছিল আদর্শের। সেটি ইসলামশূণ্যতার। যে কোন মুসলিমের জন্য এটি এক বিশাল সমস্যা। ঈমানদারদের জন্য এ যুদ্ধে অংশ নেয়ার কোন জায়েজ পথ খোলা রাখা হয়নি। ঈমানদারদের জন্য প্রতিটি খাদ্যকে যেমন সম্পূর্ণ হালাল হতে হয়,তেমনি প্রতিটি যুদ্ধকেও বিশুদ্ধ জিহাদ হতে হয়। নইলে সে যুদ্ধে প্রাণ দূরে থাক একটি পয়সা, একটি ঘন্টা বা একটি মুহুর্তের বিনিয়োগও জায়েজ হয় না। মুসলমানের জান-মাল ও প্রতিটি সামর্থ্যই মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া নিয়ামত। ব্যক্তির উপর মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অর্পিত এটি আমানতও। ব্যক্তি এখানে ট্রাস্টি বা রক্ষক মাত্র, মালিক নয়। প্রতিটি আমানত কীরূপ ব্যয় হলো সে হিসাবটি প্রকৃত প্রভূ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আখেরাতে দিতে হবে। তাই মুসলিম মাত্রই যুদ্ধে প্রাণ দিবে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার পথে; নইলে সে মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের পথে -যা পরকালে জাহান্নাম প্রাপ্তিকে সুনিশ্চিত করবে।তাই ঈমানদারের প্রতিটি প্রচেষ্টা ও যুদ্ধকে হতে হয় ইসলামকে প্রতিষ্ঠা দেয়া বা মুসলিম ভূমিকে প্রতিরক্ষা দেয়ার স্বার্থে। ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা কোন সেক্যুলার লক্ষ্যে নয়। কারণ, মুসলিমের কাছে একমাত্র হালাল বা কোরআন-নির্ধারিত মতবাদটি হলো ইসলাম;জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, সেক্যুলারিজম বা কম্যুনিজম নয়।তাই মু’মিনের জানমাল ও সামর্থ্যের উপর ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন মতবাদ ও ধর্মের অধিকার থাকে না।
ঈমানদার হওয়ার অর্থ, নিজের জানমাল ও শক্তি-সামর্থ্য কোথায় এবং কার স্বার্থে বিনিয়োগ হলো -সর্বমুহুর্তে সে জবাবদেহীতার চেতনা নিয়ে বাঁচা। ইসলামের বিজয়ে সে কতটা ভূমিকা রাখলো –মু’মিনের জীবনে মূল যিকর বস্তুত সেটিই।যার মধ্যে সে যিকর নাই,বুঝতে হবে তার মধ্যে ঈমানও নাই। মানব রূপে জন্ম নেয়ার এটিই বিশাল দায়ভার, এ দায়ভার পশুর থাকেনা। যে মানব সন্তানের মাঝে সে দায়ভার নাই,মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে তাকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলেছেন। মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি আমানতের উপর একমাত্র অধিকার তাঁর; ফলে প্রতিটি মুসলিমকে একমাত্র তাঁর নির্দেশিত পথে সে আমানতের ব্যয় নিয়ে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। নইলে সেটি পরিণত হয় ভয়ানক খেয়ানতে। এমন প্রতিটি খেয়ানতই কবিরা গুনাহ -পরকালে যা কঠিন শাস্তিকে অনিবার্য করে। তাই মু’মিন ব্যক্তির ঈমানী দায়ভার হলো,মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত প্রতিটি আমানতকে সর্বপ্রকার খেয়ানত থেকে বাঁচানো। এটিই প্রকৃত ঈমানদারী। তাই জীবনের প্রতি পদে, প্রতিটি কর্মে, প্রতিটি যুদ্ধে এবং রাজনীতির প্রতিটি অঙ্গনে মুসলিম ও ইসলামের কল্যাণের বিষয়টিকে সবার শীর্ষে রাখতে হয়। এমন এক মহৎ লক্ষ্যের কারণেই প্রতিটি মুসলিম রাজনীতিবিদই ইসলামের মুজাহিদ;এবং তার প্রতিটি যুদ্ধই পবিত্র জিহাদ। সে জিহাদে নিহত হলে প্রত্যেকেই শহিদ। মু’মিনের চেতনার এ ভূমি কি তাই জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম বা সমাজবাদের ন্যায় মতবাদ দ্বারা অধিকৃত হতে পারে? হয়নি একাত্তরেও। মুক্তিযুদ্ধের পিছনে যে দর্শনটি কাজ করেছিল,মু’মিনের চেতনা-রাজ্যে প্রবেশের সে সামর্থ্য তার ছিল না।
একাত্তরের মুক্তি যুদ্ধের দর্শনগত ভিত্তি ছিল ইসলামের বদলে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ। এর রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করে ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য সেক্যুলার বাংলাদেশ নির্মাণ। যুদ্ধটির প্রশিক্ষণ, অর্থ ও অস্ত্রের জোগানদার ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্তিপূজারী অধ্যুষিত ভারত। সে যুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিল তাদেরকে ভারত যে শুধু আশ্রয় দিয়েছিল তাই নয়, তাদের রাজনৈতিক অভিভাবক রূপেও আবির্ভূত হয়েছিল। কাফেরদের রাজনীতির মূল এজেন্ডা তো ইসলাম ও মুসলিমের ক্ষতিসাধন। যেখানেই তারা মুসলিমের সামান্যতম স্বার্থ দেখে,তারা তার বিরোধীতা করে। ভারতীয় হিন্দুগণ তাই শুরু থেকেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিল। এবং কখনোই চায়নি দেশটি বেঁচে থাকুক। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা মুসলিম-বিরোধী ভারতের কোলে গিয়ে উঠে। প্রশ্ন হলো, এমন একটি কাফের নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধে ও কাফেরদের নেতৃত্বে জান ও মালের বিনিয়োগ কি জায়েজ? মহান আল্লাহতায়ালা কি তাতে খুশি হন? একাত্তরে এ প্রশ্নটি ছিল প্রতিটি ঈমানদারের। এ বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালার কঠোর হুশিয়ারিটি হলো, “মু’মিনগণ যেন মু’মিনগণ ব্যতীত কাফিরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে ব্যক্তি এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না…।”–(সুরা আল ইমরান,আয়াত ২৮)। পবিত্র কোরআনে আরো বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না…।”–(সুরা মুমতাহানা আয়াত ১)। একাত্তরে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করলেও তাদের কাছে মহান আল্লাহতায়ালার এ কঠোর নির্দেশনামা কোনরূপ গুরুত্বই পায়নি। বরং পবিত্র কোরআনের নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই ছিল তাদের রাজনীতি। ফলে ভারতীয় কর্তা ব্যক্তিদের নিছক বন্ধু রূপে নয়, প্রভু রূপে গ্রহণ করেছিল। এবং সেটি ছিল নিছক গদির লোভে। ইসলাম ও মুসলিমের স্বার্থ এখানে গুরুত্ব পায়নি। ইসলামী চেতনাধারির কাছে বিষয়টি এতোটাই দৃষ্টুকটু ও হারাম গণ্য হয়েছিল যে তাদের একজনও ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়নি, এবং ভারতের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে অংশও নেয়নি। একাত্তরে সেটি ছিল চোখে পড়ার মত বিষয়।
জিহাদ বনাম মুক্তিযুদ্ধ
আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেরাও কখনো একাত্তরের যুদ্ধকে জিহাদ বলে দাবী করেনি। যারা নিজেদেরকে একাত্তরের চেতনার ঝান্ডাবাহি মনে করে, তারা আজও সেটি বলে না। বরং তাদের ভাষায় এ যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল ইসলামী চেতনা ও সে চেতনা-নির্ভর পাকিস্তানের ধ্বংস করে একটি সেক্যুলার বাংলাদেশ নির্মাণ। এটিকেই তারা একাত্তরের চেতনা বলে দাবী করে। এ বিষয়গুলি একাত্তরে ইসলামী দলগুলির নেতাকর্মী ও আলেমদের কাছে অজানা ছিল না। এমন যুদ্ধে একজন ঈমানদার ব্যক্তি তাই অংশ নেয় কি করে? কেনই বা বিনিয়োগ করবে তার মহামূল্য জীবন? মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া মহান আমানতটি একজন ঈমানদার তো একমাত্র সে যুদ্ধেই বিনিয়োগ করবে যে যুদ্ধটিকে শতকরা শত ভাগ বিশুদ্ধ জিহাদ এবং সংঘটিত হয় একটি মুসিলম দেশের প্রতিরক্ষায় এবং মুসলিম উম্মাহ শক্তিবৃদ্ধিতে। এ বিষয়গুলিকে সামনে রেখেই তৎকালীন নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও কিশোরগঞ্জের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আতাহার আলী এবং আরো বহু আলেম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়াকে হারাম বলেছেন। যুদ্ধকালীন ৯ মাসের পত্রিকাগুলো খুললে সে সময়ের প্রসিদ্ধ আলেমদের এরূপ অভিমত বহু নজরে পড়বে। তারা বরং জিহাদ বলেছেন পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে লড়াই করাকে। একাত্তরে চোখে পড়ার মত বিষয়টি হলো, কোন একজন বিজ্ঞ আলেমও পাকিস্তান ভাঙ্গাকে জায়েজ বলেননি। দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ আলেমদের সে অভিমতকেই গ্রহণ করে নেয়। তারই প্রমাণ, ইসলামী জ্ঞানশূণ্য ও ইসলাম প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারশূণ্য বহু আওয়ামী লীগ কর্মী, বামপন্থী ক্যাডার ও নাস্তিক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও কোন একজন আলেম, মাদ্রাসার কোন ছাত্র, পীরের কোন মুরিদ এবং ইসলামী দলের কোন নেতা বা কর্মী ভারতে যায়নি এবং মুক্তিযুদ্ধেও যোগ দেয়নি। তারা বরং রাজাকার হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধকে তাই বাঙালী-অবাঙালীর যুদ্ধ বলাটি নিরেট মিথ্যা। এটি ছিল একটি আদর্শিক সংঘাত। তাই জেনারেল মানেক শ’, জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং জেনারেল জ্যাকবের ন্যায় বহু হাজার ভারতীয় অমুসলিম অবাঙালী যেমন বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে লড়েছে, তেমনি বহু হাজার বাঙালী পূর্ব পাকিস্তানীরাও লড়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী পাঞ্জাবী, পাঠান ও বেলুচী মুসলিমদের সাথে। ভাষার বিভেদ ও আঞ্চলিকতা তাদের মাঝে কোন দেয়াল খাড়া করেনি। অথচ বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টদের রচনায় এ যু্দ্ধটিকে নিছক বাঙালীর বিরুদ্ধে পাঞ্জাবীর যুদ্ধ বলে রটনা করা হয়েছে। অথচ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জেনারেল নিয়াজী –এ দুই জনের কেউই পাঞ্জাবী ছিলেন না, তারা ছিলেন পাঠান।
জিহাদ বলতে একমাত্র সে যুদ্ধকেই বুঝায় যা লড়া হয় একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার লক্ষ্যে এবং তাঁরই নির্দেশিত পথে। কোন দল, জাতি, বর্ণ, ভাষা বা ভূগোল ভিত্তিক স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে নয়। অর্থদান, শ্রমদান, প্রাণদান কোন জাতির ইতিহাসেই নতুন কিছু নয়। অসংখ্য যুদ্ধ যুগে যুগে কাফের, ফাসেক, মুনাফিকগণও লড়েছে। আজও লড়ছে। বিপুল অর্থ, শ্রম ও রক্ত তারাও ব্যয় করে। কিন্তু তাদের সে ত্যাগ ও কোরবানী হলো আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে। ফলে তা হলো আমানতের খেয়ানত। সেক্যুলার দলের হাতে তাই কোন দেশ অধিকৃত হলে সেখানে সে খেয়ানতটাই প্রচণ্ড ভাবে বাড়ে। তখন যুদ্ধ হয় এবং বিপুল অর্থ ও রক্তের ব্যয়ও হয়।কিন্তু সেগুলি হয় ভাষা, ভূগোল, দল, গোত্র, বর্ণ ও শ্রেণী স্বার্থের নামে। তাতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায় না,আর ইসলাম প্রতিষ্ঠা না পেলে কি মুসলিমের কল্যাণ হয়? তাতে খুশি হন কি মহান আল্লাহতায়ালা? অধিকাংশ মুসলিম দেশে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে তো মূলত এপথে। আওয়ামী লীগও তেমনি নিজেদের গদীর স্বার্থে এবং সে সাথে ভারতকে খুশি করতে গিয়ে জাতিকে এক প্রচণ্ড খেয়ানতের দিকে ধাবিত করেছে। কথা হলো, মহান আল্লাহর দরবারে তাদের জবাবটি কি হবে?
আপোষে অনাগ্রহ
বাঙালী মুসলিমের বহু ব্যর্থতাই অতি প্রকট ভাবে ধরা পড়ে একাত্তরে। তবে মূল ব্যর্থতাটি ধরা পড়ে ইসলামী চেতনা ও প্যান-ইসলামীক ভাতৃত্ব নিয়ে বেড়ে না উঠায়। প্রকাশ পায় আপোষে অনাগ্রহ। বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণ আজও সে রোগ থেকে মুক্তি পায়নি। বরং দিন দিন তা আরো প্রকটতর হয়েছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেক্যুলারিস্টগণ জনগণ ভাষা ও অঞ্চলের পরিচয়কেও জীবনের বড় পরিচয় গণ্য করে। ছুঁড়ে ফেলে দেয় মুসলিম ভাতৃত্বের পরিচয়। অথচ ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা অঞ্চলের ভিত্তিতে যে বন্ধন গড়ে উঠে সেটি প্রাক-ইসলামিক নিরেট জাহেলিয়াত তথা অজ্ঞতা। ইসলামের আগমন ঘটে এমন জাহিলিয়াতকে নির্মূল করতে, পরিচর্যা দিতে নয়। প্রশ্ন হলো, ঈমানদারের জীবনে এমন জাহিলী পরিচয় গুরুত্ব পায় কি? পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশটি হলো মু’মিনকে বাঁচতে হবে পরস্পরে ভাইয়ের পরিচয় নিয়ে, শত্রু রূপে নয়। ভাতৃসুলভ সম্পর্কের ভিত্তি হতে হবে ঈমান, ভাষাভিত্তিক বা অঞ্চলভিত্তিক বন্ধন নয়। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ হতেই পারে। মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হলো সেগুলো নিয়ে ইসলাহ বা আপোষ করা।
সভ্য দেশে হাজার হাজার বিবাদের প্রতিদিন মীমাংসা হয় কোনরূপ যুদ্ধ বা সংঘাত ছাড়াই। মুসলিমদেরও উচিত,মীমাংসার পথ খুঁজে বের করা এবং নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ পরিহার করা। এটি এক ঈমানী দায়ভার। এর মধ্যেই তো বুদ্ধিমত্ততা। মুসলিমদের মাঝে প্রতিটি যুদ্ধই ভাতৃঘাতি। এমন যুদ্ধ স্রেফ কাফের শত্রুদের কামনা হতে পারে, মুসলিমের নয়। মু’মিন ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইদের সাথে শুধু নামাযে দাঁড়ায় না, সমস্যা দেখা দিলে অধীর আগ্রহ ভরে আপোষেও বসে। এমন রাজনীতি দেশে যুদ্ধের বদলে শান্তি ও উন্নয়ন আসে। সমস্যা দেখা দেয় তখন যখন মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন পালনে আগ্রহ লোপের সাথে সাথে মুসলিম ভাইয়ের সাথে বিবাদে মীমাংসার আগ্রহটিও লোপ পায়; এবং সে বিবাদকে অজুহাত বানিয়ে কাফেরদের নেতৃত্বে মুসলিম ভাইয়ের হত্যায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নামা হয়। আপোষে আগ্রহ লোপের কারণ, মহান আল্লাহতায়ালার ভয় না থাকা। মু’মিন তো সেই, যার মাঝে প্রতিক্ষণ কাজ করে মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্যতা থেকে বাঁচার ভয়। সে ভয়ের কারণে মু’মিন ব্যক্তি যেখানেই মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশনা দেখে, অধীর আগ্রহে সেটিকেই আঁকড়ে ধরে। ইসলামী চেতনাশূণ্য সেক্যুলারিস্টদের মনে সে ভয় থাকে না, ফলে আগ্রহ থাকে না ধর্মীয় বিধান পালনে। ফলে জনগণ যতই ইসলামশূণ্য হয়,সমাজ বা রাষ্ট্র ততই বিবাদপূর্ণ ও সংঘাতপূর্ণ হয়। সেটি যেমন ১৯৭১’য়ে পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছিল, তেমনি একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশেও হচ্ছে। একই কারণে জাহিলিয়াত যুগের আরবদের মাঝেও লাগাতর কলহ-বিবাদ ও যুদ্ধ ছিল। অথচ মীমাংসার পথেই মহান আল্লাহতায়ালার বিশেষ রহমত আসে -পবিত্র কোরআনে যা বার বার বলা হয়েছে। নিজেদের বিবাদ নিজেরা না মিটিয়ে মুসলিম ভূমিতে অমুসলিমদের ডেকে এনে যুদ্ধ শুরু করা কোন মুসলিমের কাজ নয়। এটি তো শত্রুরা চায়। এ পথে আসে কঠিন আযাব। আসে অপমান। দুঃখজনক হলো, ইসলামী চেতনাশূণ্য আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ও তার সঙ্গিগণ সজ্ঞানে আযাবের পথটিই বেছে নিয়েছিলেন। আপোষের পথটি ছেড়ে তারা ভারতীয় উস্কানিতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পথটি বেছে নেন। ২৩ শে মার্চের ঢাকা বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জনাব ভূট্টো উভয়ই ৬ দফা মেনে নিয়েছিলেন।-(Sisson and Rose, 1990]। কিন্তু শেখ মুজিব নিজেই তার ৬ দফাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছেন। ৬ দফার বদলে তিনি এমন দাবি পেশ করেন -যার উপর জনগণ থেকে তিনি সত্তরের নির্বাচনে কোনরূপ ম্যান্ডেট নেননি। তার এ নীতিহীনতায় দেশে শান্তি আসেনি, এসেছে যুদ্ধ। আর যুদ্ধ কোন দেশেই একাকী আসে না। সাথে আনে ধ্বংস ও মৃত্যু। এবং যুদ্ধ শেষ হলেও আযাব শেষ হয়না। বাংলাদেশে লাগাতর আযাব এসেছে দুর্ভিক্ষ, সন্ত্রাস, ভিক্ষার ঝুলির অপমান, স্বৈরাচারের দুঃশাসন ও সীমাহীন দূর্নীতি রূপে।সে সাথে এসেছে অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ময়দানে ভারতীয় অধিকৃতি।এবং সে অধিকৃতি থেকে বাংলাদেশের জনগণের আজও মুক্তি মিলেনি।
শূন্যতা ঈমানী বন্ধনের
মহান আল্লাহতায়ালা,চান মুসলিমগণ ভাতৃত্বের বন্ধনটি গড়ে তুলুক ঈমানের ভিত্তিতে; ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা আঞ্চলিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়। একাত্তরে বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ সে ঈমানী বন্ধন সৃষ্টিত ব্যর্থ হয়েছে। তাদের কাছে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাটি গুরুত্ব পায়নি। বাঙালী জাতীয়তার নামে আওয়ামী লীগ ধরেছিল এমন এক পথ যা মহান আল্লাহতায়ালার প্রদর্শিত পথ নয়। সেটি ছিল জাহিলিয়াতের তথা ইসলামপূর্ব অজ্ঞতার পথ। বরং উনিশ শ’ সাতচল্লিশে যে চেতনায় অবাঙালীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার মুসলিমগণ পাকিস্তান নির্মাণ করেছিল -সেটিই ছিল ইসলামী পথ। মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনায় ইসলাম যে কতবড় নৈতিক বিপ্লব এনেছিল এবং ইস্পাতসম মজবুত দেয়াল গড়েছিল সে পরিচয়টি হযরত আবু বকর (রাঃ)পাওয়া যায় হযরত আবু বকর (রাঃ) এর উক্তি থেকে। ইসলাম গ্রহণের পর একবার’য়ের পুত্র তাঁকে বলেছিলেন,“আব্বাজান, বদরের যুদ্ধে আমি তিন বার আপনাকে আমার তরবারির সামনে পেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আমার শ্রদ্ধেয় পিতা। শৈশবে আপনার কত স্নেহ-আদর পেয়েছি। সেটি প্রতিবার মনে পড়ায় আঘাত না করে প্রতিবারই সরে দাঁড়িয়েছি।” শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন, “পুত্র, যদি তোমাকে একটি বার তরবারির সামনে পেতাম, নিশ্চিত দুই টুকরা করে ফেলতাম।”
হযরত আবু ওবাইদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) ছিলেন প্রসিদ্ধ সাহাবী। তিনি ছিলেন আশারায়ে মোবাশ্বেরা; অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বেই তিনি জান্নাতপ্রাপ্তির সুখবর শুনেছিলেন। নবীজী (সাঃ) তাঁকে “আমিন” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন মুসলিম উম্মাহর বিশ্বস্ততার প্রতীক। তাঁকে হযরত ওমর (রাঃ) সিরিয়া অভিযানে তাকে রোমান বাহিনী বিরুদ্ধে সেনাপতি রূপে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন সিরিয়ায় প্রথম মুসলিম গভর্নর। সে বিশাল সিরিয়া প্রদেশ ভেঙ্গে আজ সিরিয়া, জর্দান, লেবানন, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন –এ ৫টি দেশ। মৃত্যুর সময় হযরত ওমর (রাঃ) বলেছিলেন, আজ যদি আবু ওবাইদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) জীবিত থাকতেন তবে তাঁকেই খলিফা নিযুক্ত করতাম। সে প্রসীদ্ধ সাহাবীর পিতা মুসলমান হননি। বরং বদর যুদ্ধে কাফের বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে মুসলমানদের নির্মূলকল্পে অস্ত্র ধরেছিলেন। হযরত আবু ওবাইদুল্লাহ (রাঃ) তাঁর পিতাকে সে যুদ্ধে নিজ হাতে হত্যা করেছিলেন। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি এর চেয়ে বিশ্বস্ততা আর কি হতে পারে? তাঁর এক ভাই বদরের যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল।এক আনসারি তাকে রশি দিয়ে বাঁধছিলেন। হযরত আবু ওবাইদুল্লাহ (রাঃ) সে আনসারি সাহাবী বল্লেন, “ওকে শক্ত করে বাঁধ। তার মা অর্থশালী, অনেক মুক্তিপণ আদায় করতে পারবে।” তাঁর কথা শুনে তার ভাই বললো, তুমি আমার ভাই; আর তুমি এরূপ কথা বলছো?” হযরত আবু ওবাইদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, “না, তুমি আমার ভাই নও; আমার ভাই তো ঐ আনসারি যে তোমাকে বাঁধছে।” ঈমানের বন্ধন বন্ধুত্ব ও শত্রুর সংজ্ঞাটি এভাবেই ভিন্নভাবে চিহ্নত করে।
যুদ্ধের ময়দানে হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর নিজ কাফের পুত্রকে হত্যার যে অভিব্যক্তিটি প্রকাশ করেছেন এবং হযরত আবু ওবাইদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) তাঁর নিজ কাফের পিতাকে যেরূপ হত্যা করেছেন -তা হলো সাচ্চা ঈমানদারী। সে ঈমানদারীতে কোন রূপ সংশয় বা অপূর্ণতা ছিল না। অপর দিকে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর পুত্র যা বলেছেন সেটি ছিল জাহেলিয়াত। জাহেল ব্যক্তি ভাষা, বর্ণ, ভৌগোলিকতা, পরিবার বা গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক খোঁজে। জাতীয়তাবাদ তাই আধুনিক নয়, বরং অতি সনাতন জাহেলিয়াত। প্যান-ইসলামীক চেতনার বিরুদ্ধে এটি হলো মারাত্মক ব্যাধি। মুসলমান রাষ্ট্রগুলিতে বিভেদ ও ভাঙ্গন ছাড়া এটি আর কোন কল্যাণটি করেছে? যেখানে এরূপ জাতীয়তাবাদী জাহেলিয়াতের বিকাশ ঘটেছে সেখানেই একাত্তরের ন্যায় আত্মঘাতি রক্তপাতও ঘটেছে। এক রাষ্ট্র ভেঙ্গে জন্ম নিয়েছে বহু রাষ্ট্র। এ ভাবে মুসলিম বিশ্বজুড়ে বেড়েছে ক্ষুদ্রতা। ক্ষীণতর হয়েছে বিশ্বশক্তি রূপে মুসলমান উম্মাহর উত্থানের সম্ভাবনা। অপর দিকে যেখানেই ইসলামের মৌলিক শিক্ষার বিকাশ ঘটেছে সেখানেই বেড়েছে প্যান-ইসলামীক চেতনা। তখন নানা ভাষাভাষী মুসলমানের মাঝে একতাও গড়ে উঠেছে। ১৯৪৭-পূর্ব ভারতীয় মুসলিমেদের মাঝেও সেটিই হয়েছিল। ফলে বাঙালী, বিহারী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি,বেলুচী, পাঠান, গুজরাতী -সবাই কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে এক রাষ্ট্রের নির্মাণও করেছে। বাঙালী মুসলিমগণ সেদিন ভারত থেকে আসা ভাইদের জন্য সর্বপ্রকার সহায়তা দিয়েছে। এমন ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নামিয়ে আনে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত নিয়ামত।সে নিয়ামতের বরকতেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় হিন্দু কংগ্রেসের যৌথ বিরোধীতার মুখে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। নইলে নিরস্ত্র ও পশ্চাদপদ মুসলমানদের পক্ষে কি সম্ভব হত সে রাষ্ট্রের নির্মাণ? সুলতান মুহম্মদ ঘোরির হাতে দিল্লি বিজয়ের পর উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা; এবং সবচেয়ে বড় বিজয়।
দায়ী কি স্রেফ পশ্চিম পাকিস্তানীরা?
পাকিস্তান গড়ার পিছনে উচ্চতর ভিশন ছিল। শুধুমাত্র উপমহাদেশের মুসলিমদের কল্যাণে নয়, দেশটির প্রতিষ্ঠা কালে গুরুত্ব পেয়েছিল সারা পৃথিবীর মজলুম মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণে শক্তিশালী ভূমিকা নেয়ার বিষয়টিও। কিন্তু সে ভূমিকা পালনে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদের কি সাহায্য করবে, দেশটি নিজেই টিকে থাকতে পারেনি। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ায় মৃত্যু ঘটেছে একটি বিশাল স্বপ্নের –যা দেখেছিল উপমহাদেশের মুসলিমগণ। তবে সে ব্যর্থতার জন্য কি শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীগণ দায়ী? পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানী হওয়ায় সে ব্যর্থতার জন্য বেশী দায়ী হলো পূর্ব পাকিস্তানীরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে অনেকে পাকিস্তানের ক্রিকেট এবং হকির টিমে সংখ্যানুপাতিক হারে পূর্ব পাকিস্তানী খেলোয়াড় নেয়ার দাবী তুলেছে। কিন্তু সে জন্য যে ভাল খেলোয়াড় হওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে -সে বিষয়টি ক’জন অনুভব করেছে? এরূপ ব্যর্থতা সর্বক্ষেত্রে। ঠিকমত খেলেনি কোন খেলাই। রাজনীতির ময়দানে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের সদস্যগণ তো সংসদের ভিতরে খুনোখুনিও করে বসে। নিহত হয় ডিপুটি স্পীকার শাহেদ আলী। পশ্চিম পাকিস্তানে তখন ৪টি প্রদেশ ছিল, কিন্তু কোন প্রদেশের সংসদে কি এমন খুনোখুনি হয়েছে?
বিবাদ ও বিভক্তির সূত্রগুলো খুঁজে খুঁজে বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ সেগুলিকে শুধু রাজনীতিতেই কাজে লাগায়নি, তা নিয়ে দাঙ্গাও সৃষ্টি করেছে। অবাঙালীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে ও তাদের বিনিয়োগে রোধে বাঙালী-অবাঙালী দাঙ্গা সৃষ্টি করেছে আদমজী জুটমিলে। পুঁজি চায় শিল্পাঙ্গণে নিরাপত্তা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পরিবেশও বিনষ্ট করেছে। ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথে যে গতিতে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প কারখানার প্রতিষ্ঠা শুরু হয়েছিল সেটিও দ্রুত কমিয়ে দিতে সমর্থ হয়। অথচ দাঙ্গার সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র ছিল করাচি। সেখানে সিন্ধি, মোহাজির, পাঠান, পাঞ্জাবী, আফগান, বাঙালী –এরূপ নানা ভাষাভাষি বিপুল সংখ্যক মানুষের বসবাস। মুসলিম বিশ্বের আর কোন শহরে এতো ভিন্নতা নাই। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো কসমোপলিটন হওয়া, তথা নানা ভাষাভাষী মানুষের সাথে শান্তিপূর্ণ বসবাসে অভ্যস্থ হওয়া। বিভক্তির দেয়াল ভেঙ্গে একাকার হওয়াই তো মুসলিম সংস্কৃতি। কিন্তু বাঙালী মুসলিমগণ সে কসমোপলিটন মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারিনি, বরং গড়েছে বিভক্তির দেয়াল। ফলে বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে এক ভাষা ও এক বর্ণের ট্রাইবাল দেশ রূপে। ফলে কয়েক লক্ষ বিহারী বাংলাদেশে নিরাপত্তা পায়নি। প্রাণ বাঁচাতে এসেও বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশাধিকার পায়নি প্রতিবেশী মজলুম রোহিঙ্গাগণ। তাদের নৌকাগুলোকে সাগরে ভেসে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এমন স্বার্থপর মানসিকতা কি মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য আনে? করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালা তো তাদেরই সাহায্য করেন যারা তাঁর বিপন্ন বান্দাদের সাহায্য করে। -(হাদীস)। আরো বিপদ হলো, এরূপ চেতনাগত ও চারিত্রিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের মাঝে আত্মচিন্তা বা আত্মসমালোচনাও নাই। বরং বিপুল আয়োজন সে রোগকে আরো তীব্রতর করায়। নিজ রোগ নিয়ে রোগীর নিজের ভাবনা না থাকলে সর্বশ্রষ্ঠ প্রেসক্রিপশনই বা কি কল্যাণ করতে পারে? অথচ সে প্রেসক্রিপশনটি তো সর্বরোগের মুক্তিদাতা মহান আল্লাহতায়ালার।
মানব-সন্তান উন্নত মানবতা পায় উন্নত দর্শনের গুণে;ভাষা বা জলবায়ুর গুণে নয়। দর্শনই দেয় চিন্তা, চেতনা ও চরিত্রে পরিশুদ্ধি। সে দর্শনটি তাই বিশুদ্ধ ও উন্নত হওয়া জরুরী। সমগ্র মানব ইতিহাসে মুসলিমগণ শ্রেষ্ঠ এজন্য যে তাদের হাতে রয়েছে শ্রেষ্ঠ জীবন দর্শন -যা এসেছে মহাজ্ঞানী মহান রাব্বুল আলামীন থেকে। কিন্তু ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হলে সে শ্রেষ্ঠত্ব থাকে না। ইসলামের গৌরব যুগে মুসলিমগণ ইসলামী আদর্শ ও প্যান-ইসলামীক ভাতৃত্বের পথ ধরেই মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়েছিলেন এবং সেসাথে বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছিলেন; জাতীয়তা বা সেক্যুলারিজমের মাধ্যমে নয়। মুসলিমদের সে গৌরবময় অতীত ইতিহাস থেকে বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ কোন শিক্ষাই নেয়নি। মানব-ইতিহাসে সর্বপ্রথম যে মিশরীয়গণ কাগজ আবিষ্কার করেছিল,নবীজীর (সাঃ) জন্মের কয়েক হাজার বছর আগে যারা ভাষা ও ভাষালিপির জন্ম দিয়েছিল এবং পিরামিডের ন্যায় বিস্ময়কর ইমারত গড়েছিল -তারাও ইসলামের সন্ধান লাভের সাথে সাথে নিজ ভাষা,নিজ সংস্কৃতি ও নিজ সনাতন বিশ্বাসকে কবরস্থ করেছিল। মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান কোরআনী জ্ঞান থেকে সমৃদ্ধ হওয়ার স্বার্থে তারা আরবী ভাষাকে নিজেদের ভাষা রূপে গ্রহণ করেছিল। একই পথ ধরেছিল সুদান, লিবিয়া, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, মৌরতানিয়াসহ সমগ্র উত্তর আফ্রিকার জনগণ। সে আমলের মুসলিমগণ বিশ্বশক্তি ও বিশ্বসভ্যতা রূপে প্রতিষ্ঠা পায় তো এভাবেই। শত শত নদী যেমন সাগরে মিশে বিশালতা দেয়, মুসলিম উম্মাহও তেমনি নানা জনগোষ্ঠীর মিলনে বিশালতা পায়। ইসলামী উম্মাহর মূল দর্শন তো এটিই।
বিভক্তি ও ভাতৃঘাতী সংঘাতই আজকের মুসলিমদের প্রধানতম রোগ যা তাদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে এবং সামর্থ কেড়ে নিয়েছে মাথা তুলে দাঁড়ানোর। এক ভাষা, এক বর্ণ, এক ধর্ম ও এক অখণ্ড ভূগোল হওয়া সত্ত্বেও আরবগণ ২২ টুকরোয় বিভক্ত। তাতে বিশ কোটির বেশী আরব এতটাই শক্তিহীন হয়েছে যে অর্ধকোটি ইহুদী তাদের মাথার উপর বিজয়ী শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। শক্তি একতার মাঝে;পাকিস্তান আজও তার উত্তম দৃষ্টান্ত। একাত্তরে পাকিস্তান খণ্ডিত হলেও প্যান-ইসলামী চেতনার দিক দিয়ে অবশিষ্ঠ পাকিস্তান আজও সমগ্র মুসলিম বিশ্বে অনন্য। পৃথিবীর ৫৭টি মুসলিম দেশের মাঝে পাকিস্তানই সবচেয়ে শক্তশালী দেশ। কারণ, এটিই একমাত্র দেশ যেখানে পাঞ্জাব, সিন্ধু, খায়বর-পাখতুন’খা ও বেলুচিস্তান -এ চারটি প্রদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষি ১৯ কোটি মানুষ এক অভিন্ন রাষ্ট্রের পতাকা তলে বসবাস করছে। অথচ পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশই আলাদা রাষ্ট্র নির্মাণের সামর্থ রাখে। আলাদা হলে প্রত্যেকটির আয়োতন বিশ্বের শতকরা ৭০ ভাগ রাষ্ট্রের আয়োতনের চেয়ে বড় হত। দেশটির ৪টি প্রদেশের মাঝে দু’টির আয়োতন বাংলাদেশের চেয়ে বড়। তারপরও তারা একতাবদ্ধ আছে। দেশটি তার জন্ম থেকেই ভারতীয়, রোহিঙ্গা, আফগানসহ নানা দেশের মুসলিমদের নিজ দেশের নাগরিক রূপে বরণ করে নিয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে ৩০ বছরেরও বেশীকাল ধরে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল ৩০ লাখের অধীক আফগান মোহাজির। রাশিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১০ বছরের লড়াইয়ে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে পাকিস্তানের নাগরিকগণ।আফগানিস্তানের জিহাদে বহু হাজার পাকিস্তানী শহীদ হয়েছে।দেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককেও প্রাণ দিতে হয়েছে। দেশটির সরকার ও নাগরিকগণ আজও সহায়তা দিয়ে যাচেছ ভারতীয় অধিকৃতির বিরুদ্ধে। নানারূপ ব্যর্থতার পরও এটি কি কম অর্জন? অথচ বাংলাদেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ও বিহারী মোহাজির নিদারুন অবহেলা ও দুর্দশার শিকার।
প্রতিবন্ধকতা বুদ্ধিবৃত্তিতে
বাঙলী সেক্যুলারিস্টদের মূল রোগটি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতার। এমন প্রতিবন্ধকতার কারণে লোপ পেয়েছে নিজেদের ব্যর্থতাগুলি নিয়ে চিন্তা ভাবনার সামর্থ। সে ব্যর্থতাগুলোকে স্বচোখে দেখেও তা নিয়ে তারা গর্ব করে। এজন্যই তাদের প্রচণ্ড গর্ব মুজিবের ন্যায় বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যর্থ ও অপরাধী ব্যক্তিকে নিয়ে। যে ব্যক্তির দুঃশাসন একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ উপহার দিল, নারীদের বাধ্য করলো জাল পড়তে,চাপিয়ে দিল একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার, হত্যা করলো ৩০ হাজারের বেশী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, দেশকে পরিণত করলো ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি -তাকেই তারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বলে। বাংলার সমগ্র ইতিহাসে আর কোন শাসকের হাতে এতো বড় ভয়ানক দুর্যোগ কি কখনো এসেছে? একই রূপ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতার কারণে একাত্তরের ব্যর্থতাগুলোও এসব বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তদের নজরে পড়েনি। বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা তাদেরকে শুধু বিবেকহীনই করেনি, অতিশয় ভীরুও বানিয়েছে। ফলে কাশ্মীরে ভারতীয় জুলুমবাজীর বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। ভারতে শত শত মুসলমান খুন হয়,মহিলাগণ ধর্ষিতা হয় এবং ধর্ষণের পর আগুণে নিক্ষিপ্ত হয়।সে নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে প্রবল প্রতিবাদও হয়।কিন্তু নিরব থাকে বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্ট সরকার ও মিডিয়া। মিয়ানমারে নির্মূলের মুখে পড়েছে সেদেশের রোহিঙ্গা মুসলিমগণ। সে বর্বরতার বিরুদ্ধেও তারা নিরব। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের পক্ষ থেকে প্রতিবেশী দেশের মজলুমদের প্রতি এই কি দায়িত্বপালনের নমুনা? আগ্রহ যেন হাত পেতে স্রেফ নেয়ায়, দেয়াতে নয়। অথচ জুলুমের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদটি স্রেফ রাজনীতি নয়, এটি গভীর ঈমানী দায়বদ্ধতা। ব্যক্তির বিবেক সুস্থ ও ইসলামি জ্ঞানে পরিপুষ্ট হলে জুলুমের বিরুদ্ধে সে ব্যক্তি প্রতিবাদী হবেই। সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরুর পূর্বে সমগ্র বিশ্বে উদ্বাস্তুদের সর্ববৃহৎ আবাসস্থল ছিল পাকিস্তান। (সূত্রঃ জাতিসংঘ রিপোর্ট)। বর্তমানে সেটি তুরস্ক। দেশটি প্রতিষ্ঠার পরপরই প্রায় ৭০ লাখ ভারতীয় আশ্রয় নিয়েছিল। আশীর দশকে আশ্রয় পেয়েছে ৩০ লাখ আফগানী। একাত্তরে বাঙালী-অবাঙালী রক্তাক্ষয়ী সংঘাতের পরও বহুলক্ষ বাঙালী আজ পাকিস্তানে বসবাস করছে। এসব বাঙালীদের অধিকাংশই পাকিস্তানে গেছে একাত্তরের পর। নানা ব্যর্থতার পরও প্যান-ইসলামীক চেতনা যে দেশটিতে এখনও বেঁচে আছে এ হলো তার নজির।
একাত্তর নিয়ে যেসব লেখালেখি হয়েছে তাতে বাঙালীর দুর্বলতাগুলো তুলে ধরা হয়নি। বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সেটি সম্ভবও নয়। ফলে এ হিসাব কখনই নেয়া হয়নি, বাঙালী মুসলিমগণ হাত পেতে বিশ্ব থেকে যতটা নিয়েছে, ততটা দিয়েছে কি? দিয়েছে কি এক কালের নিজ দেশ পাকিস্তানের শিল্প, বাণিজ্য, সাহিত্য, শিক্ষা ও প্রতিরক্ষার উন্নয়নে? এমন কি খেলাধুলায়? অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তাদের দেয়ার দায়িত্বটাই কি অধিক ছিল না? তাদের থেকে সেটিই কি পাকিস্তানের পাওনা ছিল না? আদমজী, বাওয়ানী, দাউদ, ইস্পাহানীদের ন্যায় অবাঙালীরা এসে কেন পূর্ব পাকিস্তানে এসে শিল্পায়ন করবে? তারা তো ছিল সংখ্যালঘু। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বপাকিস্তানীদের কি পুঁজি, যোগ্যতা ও কারগরি দক্ষতা নিয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানী ভাইদের শিল্পায়নে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল না? পশ্চিম পাকিস্তানী সৈনিকেরা এসে কেন চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা পাহারা দিবে? অথচ ২৩ বছরের পাকিস্তানী আমলে সেটাই হয়েছে। এমনকি চোরাকারবারি রোধে ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ব্যর্থতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন জিওসি জেনারেল ওমরাও খানের কাছে সীমান্ত পাহারায় সেনাবাহিনী নিয়োগের অনুরোধ করেছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান।-(আতাউর রহমান খান, ২০০০)। বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের মনে এসব ব্যর্থতা নিয়ে কখনো কি কোন আত্মজিজ্ঞাসা উদয় হয়েছে? নিজেদের ব্যর্থতার কারণ ও তার প্রতিকারের চেষ্টা না করে তারা বরং দুর্বলতা ও দোষ অন্বেষণ করেছে অন্যদের। আর এটিই হলো সকল যুগের সকল ব্যর্থ ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর চিরাচরিত খাসলত। প্রো-এ্যাকটিভ না হয়ে তারা বরং রিয়াকটিভ হয়। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার মহলটি আজও সে অসুস্থ চেতনারই পরিচর্যা দিচ্ছে।
বিভক্তি যে কারণে অনিবার্য হলো
বাঙালী বুদ্ধিীজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবদ্ধকতার মূল কারণটি বাঙালী জাতিয়তাবাদ। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ব্যক্তির দেখবার ও ভাবনার ভূবনে বিভক্তির বিশাল দেয়াল খাড়া করে। সেটি ভাষা, ভূগোল ও বর্ণের ভিত্তিতে। বিবেকে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তখন দেয়ালের ওপারে অন্যদের যেমন দেখা যায় না, তেমনি তাদের নিয়ে ভাবাও যায় না। ফলে ভাববার ও দেখবার জগত তখন অতি সীমিত হয়ে যায়। মানব জীবনে এর চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবদ্ধকতা আর কি হতে পারে? তাই বাঙালী জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিদের চেতনারাজ্যে বিহারীদের জন্য যেমন স্থান নেই, তেমনি স্থান নেই কাশ্মীরী ও রোহিঙ্গাদের জন্যও। স্থান নেই স্বদেশী ইসলামপন্থীদের জন্যও। এরূপ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবদ্ধকতায় ডঃ শহিদুল্লাহ তৎকালীন বাঙালী মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ যে কতটা আক্রান্ত হয়েছিল তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক। সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক জনাব থেকে। তিনি লিখেছেন,“আমরা হিন্দু মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো টি নেই।” (বদরুদ্দীন উমর, ১৯৭০)। এই হলো, ডঃ শহীদুল্লার বুদ্ধিবৃত্তি ও ইসলামী জ্ঞানের দশা! তিনি ঈমানী পরিচয়ের চেয়ে বেশী সত্য বানিয়ে দিলেন বাঙালী পরিচয়কে! পৌত্তলিক হিন্দুদের ন্যায় প্রকৃতিকেও তিনি মা বলেছেন।তাহলে বংকিম চন্দ্রের বন্দেমাতরম বা মাতৃবন্দনা থেকে তার পার্থক্য কোথায়? প্রশ্ন হলো এটি কি ঈমানের পরিচয়? অথচ তিনি বাঙালী মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের শিরোমণি।
মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে ব্যক্তির দৈহিক গঠনে আঞ্চলিকতার প্রভাবের কি আদৌ গুরুত্ব আছে? আদৌ গুরুত্ব পায় কি তার বর্ণ ও ভাষাভিত্তিক পরিচয়? তা নিয়ে কি বড়াই করা চলে? সেখানে গুরুত্ব পায়তো ঈমানদারী ও নেক আমল। গুরুত্ব পায় কে কতটা সাচ্চা মুসলিম -সেটি। কোন ভাষার,কোন দেশের,কোন বর্ণের বা কোন আকৃতির -তা নিয়ে পরকালে কোন বিচার বসবে না। কথা হলো, আখেরাতে যার মূল্য নেই সেটি ইহকালেই বা গুরুত্ব পায় কি করে? ঈমানদার ব্যক্তি কেন তার নিজের সময়, সম্পদ ও মেধা সেটির পিছনে খরচ করবে? ভাষা বা বর্ণের পরিচয়টি তাই গুরুত্বের দিক দিয়ে প্রথম হয় কী করে? ঈমানদার তো বাঁচবে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার লক্ষ্যে। ফলে মু’মিনের জীবনে তো সেটিই গুরুত্ব পায় যা মহান আল্লাহতায়ালার কাছে গুরুত্ব রাখে এবং পরকালের মুক্তিতে যা অপরিহার্য। ঈমানদারীর অর্থ তো বাঁচবার প্রতি মুহুর্তে এবং জীবনের প্রতি কর্মে এরূপ পরকাল সচেতনতা। আর এর বিপরীতে যেটি, তা হলো ইহজাগতিকতা বা সেক্যুলারিজম। সেক্যুলারিজমে ব্যক্তি ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতা গুরুত্ব পায় এবং গুরুত্ব হারায় ধর্মের প্রতি অঙ্গীকার।
বাংলাদেশের মুসলিম রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ যে কতটা বিভ্রান্ত এবং ইসলামের মৌল দর্শনে যে কতটা অজ্ঞ ও অঙ্গীকারশূন্য -বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের গুরুতুল্য ব্যক্তি জনাব ড.শহিদুল্লাহর উপরের উদ্ধৃতি হলো তারই সুস্পষ্ট নমুনা। ফলে কায়েদে আযম মোহম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর নিজ ভাষা, নিজ বর্ণ, নিজ মাজহাব ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে যেরূপ নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন, বাঙালী জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা ও বুদ্ধিজীবীগণ তা পারেনি। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে পাকিস্তানকে গড়ে তোলার বৃহত্তর দায়িত্ব ছিল বাঙালীদের উপরই। অথচ তারা আত্মসমর্পণ করেছেন ভাষাভিত্তিক ক্ষুদ্রতা, বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতার কাছে। পাকিস্তানের উন্নয়নে তারা কি দিয়েছ বা তাদের কি করণীয় -সেটি তাদের কাছে আদৌ গুরুত্ব পায়নি। বরং গুরুত্ব পেয়েছে কি পায়নি -তা নিয়ে। সমৃদ্ধ পাকিস্তান গড়তে ২৩ বছরে বাঙালীগণ কি দিয়েছে -তা নিয়ে কোন প্রশ্ন নাই। সে বিশলা ব্যর্থতা নিয়ে বাংলাদেশের মুসলিম বুদ্ধিজীবী মহলে সমান্যতম আত্মসমালোচনাও নেই। বরং আছে শুধু অন্যদের উপর দোষারোপ।
পাকিস্তানের মূল সমস্যাটি তাই ভৌগলিক ব্যবধান ছিল না। ভাষা, বর্ণ, খাদ্য, পোষাক-পরিচ্ছদের ভিন্নতাও নয়। বরং সেটি ছিল চেতনাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৈষম্য ও অসমতা। চেতনাগণ সে ভিন্নতার কারণেই বাঙালী মুসলিমগণ অবাঙালী মুসলিমদের সাথে একাত্ম হতে পারিনি। ফল ছিটকে পড়েছে মুসলিম শক্তি রূপে বেড়ে উঠার নানা ভাষাভাষি মুসলিমের সম্মিলিত মিশন থেকে। খাদ্য, পোষাক-পরিচ্ছদ বা ভাষাগত ভিন্নতা কি ভারতে কম? বরং সেটি বিশাল। ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব প্রান্তের দ্বীপটি থেকে পশ্চিম প্রান্তের দ্বীপের দূরত্ব ঢাকা-লাহোরের দূরত্বের চেয়েও অধিক। পাঞ্জাব থেকে বাংলাদেশের দূরত্বের চেয়েও অধিক হলো ভারতের পূর্ব সীমান্তের অরুনাচল প্রদেশ থেকে গুজরাটের দূরত্ব। ভারতে বিস্তর ভেদাভেদ ভাষার ক্ষেত্রেও। কিন্তু সে জন্য কি প্রশাসনে কোন অসুবিধা হচ্ছে? বাঙালীর ১৯০ বছরের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল ইংল্যান্ডের সাথে। তাতেও কি প্রশাসনে কোন সমস্যা দেখা দিয়েছে? তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, শক্তিশালী মুসলিম শক্তি রূপে বেড়ে উঠার বিকল্প কি ক্ষুদ্রতর ও দুর্বলতর বাংলাদেশ? ক্ষুদ্রতর হওয়ার পথ বেছে নেয়ায় ভারতকে খুশি করা যায়, তা নিয়ে মুজিবের ন্যায় বাকশালী স্বৈরাচারীকেও ক্ষমতায় বসানো যায়। কিন্তু সে পথে কি মহান আল্লাহতায়াকেও খুশি করা যায়? তিনি তো চান মুসলিম উম্মাহর মাঝে ঐক্য। বিভক্তি ও ক্ষুদ্রতার মাঝে যে মহান আল্লাহতায়ার ভয়ানক আযাব –সেটি তো মহান আল্লাহতায়ার হুশিয়ারি। (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৫ দ্রষ্টব্য)।
প্রশ্ন হলো, নিছক অবাঙালী হওয়ার কারণে কোন মুসলিম ব্যক্তি কি মুসলমানের দুশমন হতে পারে? দুশমন হওয়ার জন্য কি ভাষা বা বর্ণই মূল? স্বভাষী, স্বদেশী, এমনকি প্রতিবেশীও তো পরম দুশমন হতে পারে। নবীজীকে (সাঃ)কে যারা হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল তারা শুধু আরবই ছিল না, বরং ছিল তাঁর নিকটতম আত্মীয়, স্বগোত্রীয় এবং অতি নিকটতম প্রতিবেশী। অথচ নবীজী(সাঃ)র সাহায্যে যারা অর্থ ও নিজ প্রাণসহ সর্বস্ব দানে এগিয়ে এসেছিলেন তারা ছিলেন দূরবর্তী মদিনার মানুষ। তাঁর পাশে প্রাণপণে দাঁড়িয়েছিলেন রোমের শোহাইব, আফ্রিকার বেলাল এবং ইরানের সালমান। এটিই ইসলামের বিশ্বভাতৃত্ব। কিন্তু ভাষা, বর্ণ বা অঞ্চলভিত্তিক সংকীর্ণতা নিয়ে কি অতি কাছের ভিন্ ভাষী মুসলিমদের সাথেও একত্রে রাজনীতির সামর্থ্য আসে? ঘরের পাশে বসবাসকারি নিরপরাধ বিহারী ব্যক্তিটিও তখন শত্রু ও হত্যাযোগ্য বিবেচিত হয়। একাত্তরে সে অপরাধে বহু লক্ষ বিহারী মুসলিমের শুধু ঘরবাড়িই কেড়ে নেয়া হয়নি, বহু হাজার বিহারীর প্রাণও কেড়ে নেয়া হয়েছে। বহু অবাঙালী নারীর সম্ভ্রমও কেড়ে নেয়া হয়েছে। একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার মূল কারণটি তাই বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের এরূপ চেতনাগত প্রতিবদ্ধকতা এবং সে সাথে অবাঙালী বিরোধী ভয়ানক অপরাধ-প্রবনতা।তা থেকেই জন্ম নেয় চরম পাকিস্তান বৈরী মনোভাব। ৬ দফা মেনে নিয়েও তাই অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচানো যায়নি। পাকিস্তানের বিভক্তি ও একাত্তরের বিপর্যয় বুঝতে হলে বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের এ বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
গ্রন্থপঞ্জি
- বদরুদ্দীন উমর,১৯৭০;পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, মাওলা ব্রাদার্স, বাংলা বাজার, ঢাকা-১।
- Sisson, Richard and Leo Rose (1990): War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, University of California; Berkeley.
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
- সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018