অধ্যায় পঁয়ত্রিশ:সাতচল্লিশের অর্জন ও একাত্তরের অর্জন

মূল্যায়নে ব্যর্থতা

বাঙালী মুসলিমের নিদারুন ব্যর্থতাটি যেমন সাতচল্লিশের স্বাধীনতার মূল্যায়নে,তেমনি একাত্তরের বিচারে। একাত্তর নিয়ে বাংলা ভাষায় বহুবই লেখা হলেও খুবই কম লেখালেখি হয়েছে সাতচল্লিশের অর্জন নিয়ে। অথচ ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের পর বাঙালী মুসলিমের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হলো ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতা লাভ। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের হাতে স্বাধীনতা লুণ্ঠিত হবার পর এটিই ছিল বাংলার মুসলিম ইতিহাসে প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। সাতচল্লিশের সে স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা না বলার কারণটি নিরেট অজ্ঞতা ও রাজনৈতিক বিবেকহীনতা। এর পিছনে যেমন বিচারবোধ নাই, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক সততাও নাই। বরং আছে বাংলার মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জনকে অস্বীকারের চেষ্টা। বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বস্তুত এটিই হলো সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি। যারা দেশটিকে দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্বের শীর্ষে পৌঁছে দিল, তাদের সে দুর্বৃত্তিটি যে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও বিশাল ভাবে হবে না -সেটিই বা কীরূপে আশা করা যায়? দেশে যখন দূর্নীতির প্লাবন আসে তখন প্লাবনের পানির ন্যায় সেটিও সর্বত্র প্রবেশ করে। রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, প্রশাসন, পরিবার ও আইন-আদালতের ন্যায় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও তখন মিথ্যাচারের প্লাবন আসে।

উনিশ শ’ সাতচল্লিশের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা না বলার কারণটি শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি নয়, বরং এর পিছনে রয়েছে নিরেট স্বার্থপরতা। রয়েছে ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের বিরুদ্ধে গভীর ঈর্ষা। ঈর্ষার কারণ, সাতচল্লিশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক শেখ মুজিব ছিলেন না। আওয়ামী লীগের হাতেও সেটি ঘটেনি। আওয়ামী বাকশালীদের নীতি হলো, ইতিহাসের যে ঘটনায় শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ নাই, বাঙালীর ইতিহাসে সে ঘটনার কোন গুরুত্ব থাকতে পারে না –তা যত গুরুত্বপূর্ণই হোক। ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতার নেতা ছিলেন কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ফলে সে স্বাধীনতাকে স্বাধীনতার বললে বাঙালীর ইতিহাসে অবাঙালী কায়েদে আযমের জন্যও স্থান ছেড়ে দিতে হয়। একজন অবাঙালীকে বাঙালীর ইতিহাসে স্থান দেয়া তো বাঙালী জাতীয়তাবাদের নীতি নয়। সেটি স্বৈরাচারের নীতিও নয়। স্বৈরাচারীরা সর্বক্ষেত্রেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা ও অধিকৃতি চায়। স্বৈরাচারের থাবা পড়ে তাই বুদ্ধিবৃত্তি, চেতনা ও ইতিহাসের অঙ্গণেও। এজন্যই স্বৈরাচারী শাসকগণ পরিকল্পিত ভাবে জনগণের স্মৃতি বিলুপ্তি ঘটায়; এবং সেকাজে ব্যবহার করে ইতিহাসের গ্রন্থকে। তাই যে বাঙালী মুসলিমগণ এক কালে দেশের নগর-বন্দর ও গ্রামগঞ্জে ১৪ই আগস্টের দিনে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি তুলে মিছিল করতো, জিন্নাহর নামে কবিতা লিখতো, এমন কি নিজ সন্তানের নাম জিন্নাহ রাখতো -তাদেরকে সাতচল্লিশের সে স্মৃতি ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা বললে শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার জনক বা জাতির পিতা বলার সুযোগ থাকে না। যুক্তি থাকে না, শেখ মুজিব ও তার বাকশালী ক্যাডারদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বলার। এবং দলিল থাকে না, বাংলার ইতিহাস থেকে কায়েদে আযম ও মুসলিম লীগকে বিলুপ্ত করার। তবে এরূপ স্মৃতি বিলুপ্তি ঘটানোর পিছনে ভারতের স্বার্থটিও বিশাল। বাংলাদেশীদের মন থেকে ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতা ভূলিয়ে দিতে না পারলে ১৯৭১’য়ের যুদ্ধে বিজয় ও স্বাধীনতা এনে দেয়ার জন্য তাদের মনে ভারতের কৃতিত্ব বাড়ে না। ভারতের কাছে তখন অনাগত ভবিষ্যতের জন্য নতজানু দায়বদ্ধ করার দলিলও থাকে না। থাকে না, সে দায়বদ্ধতার বাহানায় ভারতকে নানারূপ সুযোগ-সুবিধা দানের পক্ষে যুক্তি। একাত্তরকে নিয়ে এভাবে নানা ষড়যন্ত্র বাঙালী মুসলিমদের আষ্টেপিষ্টে ঘিরে ধরেছে।তাই পরিকল্পিত ভাবেই ইতিহাসের বইয়ে ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা রূপে স্থান দেয়া হয়নি। ১৯৪৭’য়ের স্মৃতিকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে সবটুকু জুড়ে তাই ১৯৭১’য়ের স্মৃতি। এটি যেমন ভারতীয় প্রকল্প, তেমনি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের প্রকল্প। এরূপ নিরেট স্বার্থপরতার কারণে অতিশয় কুৎসিত দুর্বৃত্তি ঘটেছে শুধু ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নয়, বরং দেশের সর্বস্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় ও বুদ্ধিবৃত্তিতে।

 

সাতচল্লিশের অর্জন

ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের পর বাঙালী মুসলিমের জীবনে ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতা অর্জনটি যে সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল -তার পিছনে অসংখ্য যুক্তি। যে স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে বাঙালীর এতো গর্ব –সাতচল্লিশের স্বাধীনতা না এলে সেটিও কি সৃষ্টি হত? তখন বাঙালী মুসলিমের অবস্থাটি হতো অবিকল ভারতীয় মুসলিমদের মত। ভারতে প্রায় ২০ কোটি মুসলিমের বাস -যা বাংলাদেশের বা পাকিস্তানের জনসংখ্যার চেয়ে বেশী। কিন্তু তাদের জীবনে বিগত ৬৮ বছরেও কি স্বাধীনতা এসেছে? তাদের জীবনে শিক্ষাদীক্ষা ও অর্থনীতিতে উন্নয়ন দূরে থাক, জানমালের নিরাপত্তাটুকুও তো বাড়েনি। একমাত্র ঢাকা শহরে যতজন মুসলিম ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, কৃষিবিদ, আইনবিদ, হিসাবরক্ষক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সামরিক অফিসার, সরকারি ও বেসরকারি চাকুরিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারির বসবাস, ভারতের ২০ কোটি মুসলিম কি তার অর্ধেকও তৈরী করতে পেরেছে? বাঙালী মুসলিমের এ অর্জনটি ১৯৪৭য়ে পাকিস্তান সৃষ্টির কারণে। তাদের সংখ্যা তো করাচী বা লাহোরের মত শহরে আরো বেশী। এমন কি সেক্যুলার মানদন্ডেও তো বাঙালী মুসলিমদের এ অর্জনটি বিশাল। ভারতের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ১৫ ভাগ মুসলিম হলে কি হবে সরকারি চাকুরিতে তারা শতকরা মাত্র ৩ ভাগের কাছাকাছি। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানের মুসলিমগণ –সে সাথে বাঙালী মুসলিমগণ যতটা দ্রুত সামনে এগুনোর সুযোগ পায় -ভারতের মুসলিমগণ কি সেটি কল্পনা করতে পারে? যে সুযোগটুকু ভারতীয় মুসলিমগণ ইংরেজ আমলে পেত সেটুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছে। বরং হিন্দু গুণ্ডাদের হাতে তাদের জান-মাল আজ জিম্মি। সেদেশে গরুর জীবনে নিরাপত্তা আছে; কিন্তু সে নিরাপত্তা ভারতীয় মুসলিমের নেই। তাদের শুধু প্রভু বদল হয়েছে, কিন্তু গোলামী থেকে আদৌ মুক্তি মেলেনি। শাসকের আসনে বসেছে ইংরেজদের বদলে উগ্র মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক হিন্দুগণ।

তবে মুসলিমগণ রাষ্ট্র গড়ে কি শুধু বৈষয়িক প্রয়োজনে? বরং পরিপূর্ণ ইসলাম পালন ও ইসলামী শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশের প্রয়োজনে। সেটি নিজ তাহজিব-তমুদ্দন ও শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠার প্রয়োজনে। অমুসলিম দেশে মুসলিম জনসংখ্যা যত বেশীই হোক -সে সামর্থ্য কি তাদের সৃষ্টি হয়? এজন্যই অমুসলিম দেশে মুসলিমের সংখ্যা যত অধীকই হোক সেখানে মুসলিম সভ্যতা নির্মিত হয় না। সে জন্য তো রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটে নিষ্ঠাবান মুসলিমের বসার প্রয়োজন হয়। সে যুক্তিতেই মুসলিমগণ ১৯৪৭’য়ে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে। এজন্যই নিশ্চিত বলা যায়, মুহম্মদ ঘোরির হাতে দিল্লি বিজয়ের পর ভারতের সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে পাকিস্তানের সৃষ্টিই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর পাকিস্তানের সৃষ্টিতে বাঙালী মুসলিমের অবদানটি ছিল ভারতের অন্য যেন এলাকার মুসলিমদের চেয়ে অধিক। মুসলিম  লীগের জন্ম হয়েছিল ঢাকায়; এবং মুসলিম লীগের মূল রাজনৈতিক ঘাঁটিটি ছিল বাংলায়। বাঙালী মুসলিমদের রক্তদান ও সক্রিয় অংশগ্রহনের কারণেই প্রতিষ্টা পায় তৎকালীন বিশ্বে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। সে দেশটির দুইবার রাষ্ট্রপ্রধান ও তিনবার প্রধানমন্ত্রীর পদেও বসেছিল বাংলার মুসলিম। বাংলার মুসলিম ইতিহাসে এটিই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এর আগে অন্যদেশ শাসন দূরে থাক, নিজ দেশের শাসনক্ষমতায় বসার সুযোগও তারা পায়নি। বাংলার পাল রাজাগণ বাঙালী ছিল না, সেন রাজারাও বাঙালী ছিল না। বাংলার সুলতানগণও বাঙালী ছিল না। অথচ ১৯৪৭’য়ের পর বাঙালী মুসলিম বাংলাদেশের চেয়ে ৫ গুণ বৃহৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পায়। পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে বাংলার মুসলিম ভূমিতে যত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পকলকারখানা নির্মিত হয়েছে তা দেশেটির সমগ্র ইতিহাসের কোন কালেই হয়নি। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে সুযোগ এসেছিল মুসলিম বিশ্বে এবং সে সাথে বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আদায়ের। বাঙালী মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে এটিই হলো প্রকৃত স্বর্ণযুগ। বাঙালী মুসলিমগণ আর কোন কালেই সে সুযোগ পায়নি। অথচ সেক্যুলারিস্টদের রচিত গ্রন্থে সাতচল্লিশের সে বিশাল অর্জন নিয়ে কোন বক্তব্য নাই।

ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা হলো, যেখানেই মুসলিমের বেড়ে উঠার সম্ভাবনা, সেখানেই শয়তানি শক্তির ঘোরতর ষড়য্ন্ত্র। বাঙালী মুসলিমের সে সুদিন শত্রুদের ভাল লাগেনি। বাংলার মুসলিম ভূমিকে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি ও ভারতের অধিকৃত ভূমি রূপে দেখাতেই তাদের আনন্দ। ফলে শুরু হয় লাগাতর ভারতীয় ষড়যন্ত্র। শেখ মুজিব ছিলেন সে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ, দেশের স্বাধীনতার নয়। বাঙালী মুসলিমদের পরাধীন করা ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠনের ভারতীয় প্রকল্প ১৯৪৭ সালে সফল হয়নি, কিন্তু সেটিই সফল হয় ১৯৭১ সালে। কারণ, ১৯৪৭’য়ে তারা নিজেদের প্রকল্প বাস্তবায়নে মুজিব বা আওয়ামী লীগকে পায়নি। কিন্তু একাত্তরে পেয়েছে। তাছাড়া সাতচল্লিশের মুসলিমগণ চিন্তা-চেতনায় একাত্তরের চেয়ে ভিন্নতর ছিল। তখন তাদের মাঝে ছিল  ইসলামের প্রতি গভীর অঙ্গীকার।তারই প্রমাণ, বলকান যুদ্ধে খলিফার সাহায্যে বাঙালী মুসলিমগণ ঘরে ঘরে মুষ্টির চাউলের হাঁড়ি বসিয়েছিল। তাদের মাঝে ছিল ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে অন্য ভাষা ও অন্য দেশের মুসলিমদের সাথে একাত্ম হওয়ার গভীর আগ্রহ। অথচ সে সময়ও তাদের সামনে বাঙালী জাতিয়তাবাদের রাজনীতি ছিল। ছিল স্বদেশীদের সন্ত্রাস; ছিল কংগ্রেসী সেক্যুলারিস্ট ও কম্যুনিস্টদের রাজনীতি। কিন্তু তারা সে রাজনীতি সজ্ঞানে বর্জন করেছিলেন। বরং ইসলামের প্রতি অঙ্গিকারের রাজনীতিতে অবাঙালী মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেমেছিলেন। পাকিস্তানের সৃষ্টি ছিল মূলত ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ রাজনীতির বিজয়। এদেশটির জন্ম এবং বেঁচে থাকার পিছনে ইসলামই ছিল একমাত্র শক্তি। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র সেক্যুলার বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের বড় সাফল্য হলো,দেশটির প্রাণশক্তি জোগানোর মূল শিকড়কেই তারা ধ্বসিয়ে দিয়েছে। ইসলাম থেকে দূরে সরার সে পেক্ষাপটে আসে ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে। সে নির্বাচনে আসে ভারতের বিশাল বিনিয়োগ। ভারতীয় অর্থ, ভারতীয় বেতার ও হিন্দু ভোট –এসবই ছিল মুজিবের পিছনে। সে বিশাল ভারতীয় বিনিয়োগের ফলেই আওয়ামী বাকশালীগণ ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে সফল হয় পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের নিজেদের ভারতমুখি নৌকায় তুলতে। ফলে অসম্ভব হয় পাকিস্তানের বেঁচে থাকা। সিকিমের নির্বাচনে লেন্দুপ দর্জির বিজয়ে যেমন সে দেশটির স্বাধীনতাই বিলুপ্ত করে, তেমনি মুজিবের বিজয় বিলুপ্ত করে ১৯৪৭ সালে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল। এবং দেশটিকে তুলে দেয় ভারতের কোলে। সাধারণ নির্বাচনও যে শত্রুর হাতে ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার রূপে ব্যবহৃত হতে পারে -এ হলো তার নজির। বাঙালী মুসলিমের ইতিহাসে এটি এমন এক বিশাল ব্যর্থতা যা শত শত বছর পরও বার বার আলোচিত হবে।

 

শুরুটি একাত্তরে নয়

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু একাত্তরে এবং সেটি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে –এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ের এক বিশাল মিথ্যা। এ মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে ১৯৪৭’য়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে যেমন উপেক্ষা করা হয়েছে, তেমনি উপেক্ষিত হয়েছে তিতুমীরের জিহাদ, বাংলার ফকির বিদ্রোহ, হাজি শরিয়াতুল্লাহর ফারায়েজী আন্দোলনের ন্যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাস। বাঙালী মুসলিমের জীবনে স্বাধীনতার লড়াইয়ের শুরু সেদিন থেকেই যেদিন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে সে স্বাধীনতা লুণ্ঠিত হয়েছিল। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের উপর কাফের শক্তির অধীনতা কবুল করে নেয়াটাই হারাম। পবিত্র কোরআনের সে বিধানটি সে যুগের ঈমানদারগণও বুঝতো। তাই ধর্মপ্রাণ বাঙালী মুসলিমগণ হাতের কাছে যা পেয়েছে তা দিয়েই সাধ্যমত স্বাধীনতার লড়াইটি চালু রেখেছে। এটি স্রেফ যুদ্ধ ছিল না, ছিল পবিত্র জিহাদ। মুজাহিদগণ সে যুদ্ধটি লড়েছেন কখনো অস্ত্র হাতে, কখনো দর্শন ও বিদ্যাবু্‌দ্ধি দিয়ে,কখনো বা ভোটে। ইংরেজ ও তাদের মিত্র হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে হাজী তিতুমীর সে লড়াই শুরু করেছিলেন বাঁশের কেল্লা গড়ে। সে জিহাদে তিনি নিজে শহীদ হয়ে গেছেন। সে আমলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও হিন্দু জমিদারদের কাছে তিনিও মৌলবাদি সন্ত্রাসী ভিন্ন অন্য কিছু ছিলেন না। কাফের শক্তির ক্রীড়ানক হওয়া কোন কালেই মুজাহিদদের রীতি নয়। তারা কাফের দেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয় না, তাদের অস্ত্র কাঁধে নিয়ে যুদ্ধেও নামে না। কারণ কাফেরদের অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্বে যে যুদ্ধটি হয় সেটি নিতান্তই কাফেরদের যুদ্ধ, তা কখনোই মুসলিমের পবিত্র জিহাদ হয় না। একাত্তরের যুদ্ধটি একারণেই ছিল নির্ভেজাল ভারতীয় যুদ্ধ। তাই সে যুদ্ধে বহু বাঙালী জাতীয়তাবাদী, সমাজবাদী, নাস্তিক যোগ দিলেও কোন আলেমকে অংশ নিতে দেখা যায়নি। অথচ মুসলিম ইতিহাসের প্রতিটি জিহাদে বিপুল সংখ্যায় দেখা গেছে হাজী তিতুমীরের ন্যায় আলেমদের।

প্রকৃত মুসলিমের কাজ নিছক প্রাণে বাঁচা নয়; স্রেফ রাষ্ট্র নির্মাণও নয়। তার বাঁচা, যুদ্ধ করা ও রাষ্ট্র নির্মাণের মধ্যেও পবিত্র মিশন থাকে। সেটি ইসলামকে বিজয়ী করা ও মহান আল্লাহতায়ালার নামকে বড় করার মিশন। ইসলামী আদর্শ নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো এবং সে সাথে সামনে এগুনোর লড়াইটি তাই মু’মিনের জীবনে প্রতি মুহুর্তের। পরাধীন দেশে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গণ জুড়ে পরিপূর্ণ ইসলাম পালন ও ইসলামের প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব? অথচ মুসলিমকে তো বাঁচতে হয় সে মিশন নিয়ে। মু’মিনের জীবনে স্বাধীনতার লড়াই এজন্যই এক বিরামহীন লড়াই। এ লড়াইটি স্রেফ মানচিত্র গড়া নয়, বরং শয়তানী শক্তির অধিকৃতি থেকে আল্লাহর ভূমিকে মূক্ত করার। শত্রুর অধিকৃত ভূমিতে কি শরিয়ত প্রতিষ্ঠা করা যায়? হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত ভেঙ্গে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এজন্যই অপরিহার্য ছিল। এমন লড়াইয়ে আত্মনিয়োগের মধ্য দিয়েই প্রতি মুহুর্তে পরীক্ষা হয় ব্যক্তির ঈমানের -তথা আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে তার নিজ অঙ্গিকারের। এরূপ অবিরাম লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ শাসনামলে স্বাধীনতার লক্ষ্যে সবচেয়ে সফল যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। তবে সেটি সশস্ত্র যুদ্ধ ছিল না; ছিল রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। এক পক্ষে ছিল সেক্যুলার ভারতীয় জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস ও তার মিত্ররা। তাদের লক্ষ্য ছিল,ভারতীয় জাতীয়তার পরিচয় নিয়ে এক অখণ্ড ভারত নির্মাণ। ভারতের মুসলিমগণ সে কংগ্রেসী প্রকল্প বর্জন করে।  কারণ তারা বুঝতেো, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু শাসনাধীনে শরিয়তী প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। আর শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ছাড়া কি ইসলাম পালন হয়? ফলে বোধগম্য কারণেই সে পথটি মুসলিমদের ছিল না। এর বিপরীতে ছিল প্যান-ইসলামী চেতনা -যার ভিত্তিতে ভারতের নানা ভাষাভাষি মুসলিমগণ একতাবদ্ধ হয়েছিল তাদের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার। সেটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশে আজ হোক কালো হোক শরিয়ত প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগটি সব সময়ই জীবন্ত থাকে। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলীতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে মূল বাধাটি আসে সেক্যুলারিস্টদের পক্ষ থেকে। কিন্তু অমুসলিম দেশে প্রবল প্রতিপক্ষ রূপে খাড়া হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ কাফের জনগোষ্ঠী।

১৯৪৭’য়ে বিজয়ের কারণ, ভারতীয় মুসলিমগণ সেদিন প্রায় প্রতি প্রদেশেই আলোকিত কিছু নেতা পেয়েছিল –যারা অন্ততঃ মুসলিম হওয়ার রাজনৈতিক দায়বব্ধতা বুঝতেন। তারা বুঝতেন নিজেদের মাঝে বিভক্তির ভয়াবহ বিপদ। হিন্দুদের রাজনৈতিক অভিলাষ এবং মুসলিম বিরোধী সহিংস ঘৃণাও তাদের অজানা ছিল না। জুটেছিল আল্লামা ইকবালের ন্যায় ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ বড় মাপের দার্শনিক নেতা। জুটেছিল মাওলানা মহম্মদ আলীর ন্যায় শক্তিশালী কলম যোদ্ধা। মিলেছিল সারা ভারতব্যাপী নেতৃত্বদানের জন্য কায়েদে আজমের ন্যায় দুরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। ক্ষমতার মোহ তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারিনি। তাদের মনে ছিল উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য গভীর কল্যাণ-চিন্তা। ভাষা, বর্ণ, গোত্র, প্রাদেশিকতা ও আঞ্চলিকতার পরিচয় তাদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল খাড়া করতে পারিনি। বরং ক্ষুদ্রতার সে দেয়ালগুলি ভেঙ্গে তারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঈমানের গভীর বন্ধন তথা একতা। সে একতা এবং মুসলিম কল্যাণে নেতাদের সে গভীর অঙ্গীকারই পৃথিবী পৃষ্টে নামিয়ে এনেছিল মহান করুণাময় আল্লাহতায়ালার সাহায্য। মহান আল্লাহর মেহেরবানীতেই সেদিন সম্ভব হয়েছিল বিনাযুদ্ধে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের নির্মাণ। অথচ মুসলিম বিশ্বে তখন বিভক্ত ও ক্ষুদ্রতর হওয়ার বাতিক। সে অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তখন প্রবেশ করেছে মুসলিম বিশ্বে। অভিন্ন ধর্ম, অভিন্ন ভাষা ও অখণ্ড ভূগোলের মুসলিম দেশ আরব ভূমি তখন বিভক্ত হয়েছে ২২ টুকরায়।ভেঙ্গে গেছে বিশাল উসমানিয়া খেলাফত। মুসলিম বিশ্বের ঠিক সে বিষাদপূর্ণ দিনে ভারতীয় উপমহাদেশের নানা ভাষার ও নানা বর্ণের মুসলিমগণ ১১ শত মাইলে বিভক্ত ভূ-খণ্ড নিয়ে একটি অভিন্ন দেশ গড়েছিল। এটি ছিল ভারতীয় মুসলিমদের বিশাল ও বিস্ময়কর অর্জন। মুসলিম বিশ্বে এ ছিল একতার মডেল। সেদিন এ নতুন রাষ্ট্রটির নির্মাণ কাজটি শুরু হয়েছিল নিতান্তই শূন্য হাতে। শুরুর সে দিনগুলিতে লক্ষ লক্ষ নিঃস্ব ও ছিন্নমূল উদ্বাস্তু প্রাণ বাঁচাতে ছুটে এসেছিল ভারত থেকে। সেদিনের সে দুর্দিনে মিলেনি কোন বিদেশী সাহায্য। তারপরও পাকিস্তান সেদিন তলাহীন ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত হয়নি। নেমে আসেনি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সেদিন উচ্ছিষ্ট খোঁজায় কোন ক্ষুদার্ত ব্যক্তিকে কুকুরের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়নি এবং কাপড়ের অভাবে কাউকে জাল পড়তে হয়নি।অথচ এসবই হয়েছে মুজিবামলে –যদিও তখন হাজার হাজার কোটি টাকার বিদেশী সাহায্য জুটেছিল। মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য এলে চরম বিপদের দিনেও মুসলিম জনগণ ইজ্জত নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় ও বিজয়ী হয়। অথচ সে ইজ্জত বা গৌরব একাত্তর-পরবর্তীতে বাড়েনি।

 

বাঙালী মুসলিমের ব্যর্থতা

বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যদের দোষত্রুটি, অবিচার ও অনাচার নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। রাজনীতিতে বেড়েছে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপূর্ণ গালিগালাজ -বিশেষ করে বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে, এবং সে সাথে বাঙালী পাকিস্তানপন্থিদের বিরুদ্ধে। যেন বাংলাদেশের সকল ব্যর্থতার জন্য একমাত্র তারাই দায়ী। কিন্তু আলোচনা নেই বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের বড় বড় ব্যর্থতা,নীতিহীনতা ও চারিত্রিক কদর্যতা নিয়ে। কেন তারা একাত্তরে ভারতীয় লুটেরাদের লুণ্ঠন থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ও সম্পদ বাঁচাতে ব্যর্থ হলো -ইতিহাসে সে আলোচনাও নাই। হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্য লাভের পর কেন দেশে দুর্ভিক্ষ এলো এবং কেন সে দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা গেল –তা নিয়েও কোন বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা নাই। লক্ষ লক্ষ বিহারীদেরকে নিজ ঘর থেকে বের করে সেগুলো দখল নেয়া এবং তাদেরকে গৃহহীন করা কি মানবতা? জাতিসংঘের আইনে এটি তো যুদ্ধ-অপরাধ। বহুলক্ষ বাঙালী এ যুদ্ধ-অপরাধের সাথে জড়িত। কিন্তু একজনের বিরুদ্ধেও কি সামান্যতম কোন শাস্তি হয়েছে? কোন সভ্যদেশে চোর-ডাকাত,খুনি ও সন্ত্রাসীদের সাথে কি এমন আচরণ করা হয়? একাত্তর নিয়ে বহু গ্রন্থ, বহু প্রবন্ধ, বহু গল্প-উপন্যাস ও বহু নাটক লেখা হয়েছে। কিন্তু কোথাও কি বিহারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এতোবড় অপরাধ নিয়ে কোনরূপ নিন্দাবাক্য উচ্চারিত হয়েছে? এই কি বাঙালী মুসলিমের চেতনার মান? বাংলাদেশ থেকে শুধু অবাঙালী মুসলিমগণই শুধু নয়, হিন্দুগণ যে লাখে লাখে দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি দিচ্ছে -তা তো বাঙালীর চরিত্র ও চেতনার মান এতো নীচে নামার কারণে। হিন্দুদের সাথে দেশ ছাড়ছে এমন কি বাঙালী মুসলিমও।একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় ৪ লাখ বাঙালী ছিল; সেখানে তারা বস্তিতে বসবাস করতো না। তাদের দখলে  ঘরবাড়ী ছিল, গাড়ি ও অর্থসম্পদও ছিল। কিন্তু তাদের কাউকে কি ঘর থেকে নামিয়ে বস্তিতে বসানো হয়েছে বা তাদের সহায়সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়েছে? অথচ পশ্চিম পাকিস্তানীদের অনেকেরই আপনজন পূর্ব পাকিস্তানের নানা স্থানে বাঙালীদের হাতে নিহত হয়েছিল। বিহারীদের সাথে কীরূপ আচরণ করা হয়েছে –তার সাক্ষী শুধু বিহারীরা নয়, লক্ষ লক্ষ বাঙালীও। কিন্তু বাঙালীর রচিত একাত্তরের ইতিহাসের বইয়ে তার উল্লেখ নাই। প্রশ্ন হলো, এসব বস্তিবাসী বিহারীদের স্মৃতিতে বাঙালীর পরিচয়টি কীরূপ লিপিবদ্ধ হবে? রোজ হাশরের বিচার দিনে কি এ অপরাধের জবাব দিতে হবে না? নিজেদের চারিত্রিক কদর্যতা,ব্যর্থতা ও দুর্বলতাগুলো নিজেরা আবিস্কারে ব্যর্থ হলেও সেগুলি কি ইতিহাসে অনাবিস্কৃত থাকে? সেগুলির আবিস্কারে তখন অন্যরা নামে। যারা নামে তাদের ধারণাই বা মিথ্যাচারের এসব নায়কদের নিয়ে কীরূপ হয়? মিথ্যাচারীকে সম্মান দেখানো কি কোন সৎ ও সভ্য মানুষের রীতি? মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের নিয়ে শর্মিলা বোসের এক সময় উচ্চ ধারণা ছিল। কিন্তু সেটি ধ্বসে যায় বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে একাত্তর নিয়ে গবেষণায় নামার পর।তিনি বিস্মিত হয়েছেন একাত্তর নিয়ে লেখা বইয়ে অতিরঞ্জিত মিথ্যা দেখে।

নিজেদের চারিত্রিক রোগগুলি আবিস্কারে ব্যর্থ হলে তাতে নাশকতাটি বরং দিন দিন তীব্রতর হয়।ফলে ভয়ানক রূপ নেয় বিপদ।দেহের ক্যান্সার নিয়ে অজ্ঞতায় চিকিৎসায় আগ্রহ থাকার কথা নয়। ক্যান্সারের রোগী তখন দ্রুত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। একই কারণে রোগ তীব্রতর হয় নৈতিক রোগের ক্ষেত্রেও।তখন গড়ে উঠে দ্রুত অব্ক্ষয়ের তথা নিচে নামার সংস্কৃতি। চোরগণ ডাকাত হয়, এবং ডাকাতেরা নৃশংস খুনি হয় তেমন নীচে নামার কারণে।একই কারণে দুর্বৃত্ত অধিকৃত দেশও দ্রুত নিচে নামে। এরূপ দ্রুত নামার কারণেই বাংলাদেশ দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্বরেকর্ড গড়েছে।সভ্য ও সফল মানুষেরা তাই অন্যের দোষ তালাশ বাদ দিয়ে নিজেদের দোষত্রুটি প্রথমে তালাশ করে এবং সেগুলি দূর করার প্রাণপণ চেষ্টা করে। একাজে ইতিহাসের বইয়ের গুরুত্বটি বিশাল। ইতিহাস নিয়ে যাদের গবেষণা তাদের কাজ শুধু নিজেদের বিজয়ের কাহিনীগুলি তুলে ধরা নয়, বরং বড় বড় ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতাগুলিও চিহ্নিত করা এবং পাঠকদের সামনে সেগুলি তুলে ধরা। ইতিহাস রচনায় সবাইকে তাই অতিশয় সত্যনিষ্ঠ হতে হয়। কিন্তু সে কাজ যখন চাটুকার স্তাবকদের হাতে জিম্মি হয় -তখন সেটি হয় না। ইতিহাসের বইগুলো তখন সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির প্রচারপত্রে পরিণত হয়। ইতিহাস রচনার নামে তখন ভয়ানক দুর্বৃত্তি ঘটে।অতিশয় রুঢ় হলেও সত্য, বাংলাদেশে সেটিই ঘটেছে।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে বাঙালী মুসলিমের ঘাড়ে যে বিশাল দায়ভার অর্পিত হয়েছিল,তারা ব্যর্থ হয়েছে সেটি পালনে।সত্য হলো,সে দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত,পেশাগত ও রাজনৈতিক সামর্থ্যও তাদের ছিল না।ইতিহাসের এ বাস্তব বিষয়টি অপ্রিয় হলেও অতিশয় সত্য।বাঙালী হিন্দুদের জীবনে রেনেসাঁ এসেছিল;এবং সেটি এসেছিল পাকিস্তান সৃষ্টির ৫০-৬০ বছর আগেই। ব্যনার্জি,চ্যাটার্জি,মুখার্জি,দাস,বোস,ঘোষ বা ঠাকুরেরা তখন সমগ্র ভারতের বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতির আকাশের প্রধান তারকা। কিন্তু তাদের মাঝ কোন বাঙালী মুসলিম ছিল না।অধিকাংশ বাঙালী মুসলিমের হাতে তখনও লাঙ্গল বা তাঁত। বাংলার বাঙালী মুসলিমের জীবনে রেনেসাঁ কখনোই ব্রিটিশ আমলে আসেনি।শুরু হয়েছিল একমাত্র পাকিস্তান সৃষ্টির পর।কিন্তু সে সত্যটি বহু বাঙালী মেনে নিতে রাজী নয়।ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রশাসন,সামরিক বাহিনী ও শিল্পকারখানায় বাঙালী মুসলিমদের লোকবল অবাঙালী মুসলিমদের তূলনায় ছিল অতি নগণ্য।পূর্ব বাংলার বেশীর ভাগ মুসলিম ছিল কৃষিজীবী।এজন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরা দায়ী ছিল না;দায়ী ছিল ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন। শিক্ষিত জনসম্পদ গড়ার কাজে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের নজর পড়ে স্রেফ হিন্দুদের উপর।মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার উন্নয়নে তারা তেমন কিছুই করেনি।১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে বিজয় লাভের পর থেকেই ব্রিটিশদের মনযোগ ছিল স্রেফ লুণ্ঠনে। তারা তখনও ভেবে উঠতে পারিনি ভারতের মত বিশাল দেশ সামান্য কয়েক হাজার ইংরেজ বেনিয়ার শাসন ১৯০ বছরেরর জন্য স্থায়ী হবে। ফলে তাদের সে লুণ্ঠনে ডাকাতদের ন্যায় প্রচণ্ড তাড়াহুড়া ছিল। লুণ্ঠনের স্বার্থে প্রয়োজন পড়েছিল নির্যাতন মূলক শাসনের। এমন দুঃশাসন ও নিষ্ঠুর শোষনে যে কোন দেশেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসে;এবং সেটি বাংলাদেশেও এসেছিল।বাংলার এক তৃতীয়াংশ জনগণ সে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায়। সেটিই হলো বাংলার ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মনন্তর। শুরু থেকেই মুসলিমগণ চিহ্নিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের মূল শত্রু রূপে।সম্ভাব্য মুসলিম হামলার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শাসনের বিশ্বস্থ পাহারাদার রূপে বেছে নেয় হিন্দুদের। রাজধানী স্থাপন করে হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলার কলকাতায়।এবং লাগাতর অবহেলিত হয় পূর্ব বাংলা। ব্রিটিশদের এজেন্ডা ছিল, শিক্ষাদীক্ষায় ও সামাজিক ভাবে বাংলার মুসলিমদের দ্রুত নিচে নামানো ও লাগাতর দুর্বল রাখা।সে লক্ষ্যে তাদের কৌশলটি ছিল,বাঙালী মুসলিমদের অশিক্ষিত ও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল রাখা। ফলে মুসলিম শাসনামলে বাংলার বুকে যে হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল -সেগুলোকে তারা বন্ধ করে দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বহনের জন্য মুসলিম শাসকের পক্ষ থেকে যে বিপুল পরিমান লাখেরাজ তথা করমূক্ত জমি বরাদ্দ ছিল -ব্রিটিশ সরকার সেগুলিও কেড়ে নেয়। ১৮৫৭ সালের সিপাই বিদ্রোহের পর ব্রিটিশের নজর পড়ে উত্তর ভারতের দিকে –কারণ সে এলাকাতে ছিল বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র। ব্রিটিশ প্রশাসনে বাঙালী হিন্দুদের একচেটিয়ে আধিপত্যের মোকাবেলায় তারা উক্ত এলাকার মুসলিমদের প্রশাসনে আনা শুরু করে। ফলে প্রয়োজন পড়ে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম জনসম্পদ গড়ে তোলার। কিন্তু পূর্ব বাংলার প্রতি অবহেলা থেকেই যায়। পূর্ব বাংলার প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের অবহেলার প্রমাণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটে ১৯২১ সালে। অথচ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটে ১৮৮২ সালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৬ সালে অথচ লাহোরে কিং এডওয়ার্ড মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা ঘটে ১৮৬০ সালে। ভারতে শিক্ষিত মুসলিম জনসম্পদ গড়ে তোলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়। সেটি প্রতিষ্ঠা পায় উত্তর ভারতে ১৮৭৮ সালে। এটি ছিল তৎকালীন ভারতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়।এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর বাংলার চেয়ে অধিক লাভবান হয় উত্তর ভারত,পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের মুসলিমগণ। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ পূর্ব পাকিস্তানভূক্ত এলাকার চেয়ে শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার অধিক সুযোগ পায়।

সামরিক ক্ষেত্রেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে ব্রিটিশের গড়া বৈষম্যটি ছিল বিশাল। ব্রিটিশ আমল থেকেই সমগ্র ভারতের বুকে সবচেয়ে বড় ক্যান্টনমেন্টটি ছিল রাওয়ালপিন্ডিতে।সেটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫১ সালে।কারণটিও সহজে অনুমেয়। ভারতের উপর অধিকাংশ হামলাগুলো হয়েছে খাইবার গিরিপথ দিয়ে।সেটি রুখতেই ব্রিটিশের এ বিশাল আয়োজন।রাওয়ালপিন্ডি শহরটির বেশীর ভাগ জুড়ে ক্যান্টনমেন্ট।ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের বুকে সামরিক স্টাফ কলেজটি ছিল বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটায় –যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৫ সালে।এ কলেজের ছাত্রদের মধ্য থেকে গ্রেট ব্রিটেন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের বহু নামকরা জেনারেল এবং সামরিক বাহিনীর প্রধান সৃষ্টি হয়েছে; এবং তাদের মাঝে ৮ জন ফিল্ডমার্শাল পর্যায়েও পৌছেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’ এবং ব্রিটিশ ফিল্ডমার্শাল মন্টেগুমারী –যার হাতে পরাজিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত জার্মান ফিল্ড মার্শল রোমেল,এরাও ছিলেন এ কলেজেরই ছাত্র। সে তুলনায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা? ব্রিটিশ আমলে সমগ্র পূর্ব বাংলায় উল্লেখযোগ্য কোন সামরিক স্থাপনাই গড়া হয়নি।না কোন সামরিক কলেজ,না কোন ক্যান্টনমেন্ট। আসলে সামরিক দিক দিয়ে ব্রিটিশদের কাছে পূর্ব বাংলা কোন গুরুত্বই পায়নি।সে শূণ্যতার কথাটি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান উল্লেখ করেছেন তার গ্রন্থ “ফ্রেণ্ডস নট মাস্টার্স”য়ে।১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল অফিসার কমান্ডিং রূপে তিনি নিয়োগ পান।তিনি লিখেছেন,“There was hardly any army: only two infantry battalions with five companions between them. At headquarters there was no table, no chair, and no stationary –we had virtually nothing at all; not even any map of East Pakistan.” (Khan, M A; 1967). অনুবাদঃ “(১৯৪৮সালে পূর্ব পাকিস্তানে)উল্লেখযোগ্য কোন সেনাদলই ছিলত না।ছিল পদাতিক বাহিনীর মাত্র দুইটি বাটেলিয়ন যাতে ছিল ৫ কোম্পানী সৈন্য।সেনা হেডকোয়ার্টারে কোন টেবিল,কোন চেয়ার এবং কোন স্টেশনারিও ছিল না।বাস্তবে কিছুই ছিল না।এমনি পূর্ব পাকিস্তানের একটি মানচিত্রও ছিল না।” কিন্তু এ বিশাল শূণ্যতার জন্য বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ থেকে দোষারোপ করা হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে,ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নয়।আরো প্রশ্ন হলো,এরূপ সামরিক শূণ্যতা নিয়ে পূর্ব বাংলা যদি ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন হত -তবে কি ভারতীয় আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেত? হায়দারাবাদ ও কাশ্মীরকে ভারতভূক্ত করতে ভারতকে যুদ্ধ করতে হয়েছে।কিন্তু পূর্ব বাংলায় কি কোন যুদ্ধের প্রয়োজন পড়তো? কয়েক শত সৈন্য ও কিছু পুরাতন রাইফেল নিয়ে কি ভারতের মোকাবেলা করা যেত? পূর্ব বাংলার মুসলিমদের সৌভাগ্য যে,মুসলিম লীগ নেতাগণ কাশ্মীরের শেখ আব্দুল্লাহর ন্যায় রাজনৈতিক দিক দিয়ে বোধশূণ্য ছিলেন না।ফলে পূর্ব বাংলা কাশ্মীরের ন্যায় অধিকৃত হওয়া থেকে সে যাত্রায় বেঁচে যায়।পাকিস্তানী আমলের ২৩ বছরে সামরিক জনশক্তি গড়ে তোলায় যে অগ্রগতি হয় সেটি কি বাংলার বুকে আর কোন কালে হয়েছে? ঢাকা,কুমিল্লা,যশোর,চট্টগ্রাম,রাজশাহী,সৈয়দপুর,ময়মনসিংহ ও সিলেটে গড়া হয় বড় বড় ক্যান্টনমেন্ট বা সামরিক স্থাপনা।প্রশ্ন হলো,সামরিক খাতে পাকিস্তানী ২৩ বছরে যা যোগ হয়েছে,বাংলাদশ সৃষ্টির ৪৪ বছরে তার অর্ধেকও কি হয়েছে?

পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানীদের রাজনৈতিক ব্যর্থতাটিও ছিল অতি প্রকট। দলীয় কোন্দল, দল ভাঙ্গা, দলগড়া ও অন্যদলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বাঙালীদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।পাকিস্তানের পরিবর্তে অনেকের মনে বাড়ে প্রচণ্ড ভারতপ্রেম। ইসলামের পরিবর্তে বাড়ে মার্কসবাদ, লেলিনবাদ ও মাওবাদের প্রতি আসক্তি। বাড়ে সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের প্রতি প্রেম। অনৈসলামিক মতাদর্শের এরূপ নাশকতা ও উপদ্রব পশ্চিম পাকিস্তানে দেখা দেয়নি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভাবে বিজয়ী হয়। কিন্তু তাদের বিজয়ে পাকিস্তান লাভবান হয়নি। লাভবান হয়নি পূর্ব পাকিস্তানও। তারা ব্যর্থ হয় পূর্ব বাংলার রাজনীতি সুষ্ঠ ভাবে চালাতে। ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদের মেঝেতে তারা প্রকাশ্য দিবালোকে খুনোখুনি করে বসে। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ ডিপুটি স্পীকার শাহেদ আলীকে হত্যা করে। সেটি ছিল নির্ভেজাল বাঙালী ঘটনা। কোন অবাঙালীর উপস্থিতি সেখানে ছিল না। বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ এতোটাই আত্মকেন্দ্রীক ক্ষুদ্র চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে,পূর্ব বাংলার ক্ষুদ্র মানচিত্রটাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। বৃহৎ পাকিস্তানের রাজনীতির দিকে নজর দেয়ার সময় তাদের ছিল না। পাকিস্তানী বা মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার বদলে বাঙালী রূপে বেড়ে উঠাই তাদের কাছে বেশী গুরুত্ব পায়। এমন ক্ষুদ্র চিন্তা ও সংকীর্ণ মনের রাজনীতিতে কি মহান আল্লাহতায়ালা খুশি হন? জুটে কি তাঁর রহমত? মুসলিমের ঈমানী দায়ভার তো ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতার সীমানা ভেঙ্গে অন্য মুসলিম ভাইদের সাথে একাত্ম হওয়া। এটিই তো ইসলামের বিশ্বভাতৃত্ব। ১৯৪৭ সালের আগে উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির সেটিই ছিল মূল ধারা। কিন্তু বাঙালী মুসলিমগণ সে প্যান-ইসলামীক ধারায় স্থির থাকতে পারিনি। এটি হলো বাঙালী মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয় ও ছিল রাজনীতির ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রচণ্ড পথভ্রষ্টতা।সেটি ছিল দ্রুত নিচে নামার পথ। সে পথ ধরলে ভিক্ষার ঝুলি ও সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের অপমান অর্জনে কি সময় লাগে?

এমন এক ভয়ানক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক পথভ্রষ্টতার কারণে বাঙালী জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের কাছে মুসলিম উম্মাহর অংশ রূপে বেড়ে উঠাটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তারা বরং দ্রুত হিন্দু ভারতের কোলে ভিড়তে থাকে।সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের যুদ্ধে সে ভারতমুখি ধারাটিই ষোলকলায় পূর্ণ হয়। এটিই ছিল ইসলামে অঙ্গীকারহীন হওয়ার সবচেয়ে অনিষ্টকর পরিণতি। মুসলিম সমাজে তখন মীর জাফরগণ জন্ম নেয় –যারা শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখে, মুসলিম উম্মাহর নয়। মুসলিম দেশে এরাই ইসলামের শত্রুপক্ষের বিজয় আনে। ইসলামের শত্রুপক্ষ তো মুসলিম ভুমিতে ইসলামে অঙ্গীকারশূন্য এরূপ ব্যক্তিদেরই খোঁজে। ১৯৪৭’য়ে উপমহাদেশের মুসলিমগণ যেরূপ ঐক্যের পরিচয় দিয়েছিল তাতে ইসলামের শত্রুপক্ষের মনে ভয় ঢুকেছিল। কীরূপে সে ঐক্যে ফাটল ধরানো যায় -তা নিয়ে ভারত সরকার ও তার  গুপ্তচর সংস্থার প্রচেষ্টা ছিল বহুদিনের। ভারতীয়দের দীর্ঘ দিনের এ খায়েশ -শেখ মুজিবের অজানা ছিল না। মুজিব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি এবং চেতনায় সেক্যুলারিস্ট ও বাঙালী জাতীয়তাবাদী। ফলে ভারতের জালে ধরা খাওয়ার জন্য তার প্রস্তুতিতে কোন কমতি ছিল না। মুসলিম ভূমিতে নিজ স্বার্থের পাহারাদার রূপে শুধু ভারত নয়, তাবত শত্রু শক্তি ইসলাম থেকে দূরে সরা এমন রেডিমেড ব্যক্তিদেরই খোঁজে।

ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধতাই হলো ঈমানের পরিচয়; কিন্তু সেক্যুলারিস্টদের কাছে সেটি গণ্য হয় সাম্প্রদায়ীকতা রূপে।সেক্যুলারিস্ট হওয়াটি তাই ঈমানশূন্যতার সাইনবোর্ড। মুসলিম রাজনীতিবিদদের গলায় এমন সাইনবোর্ড দেখে ইসলামের শত্রুগণ তাদের পিছনে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবে -সেটিই স্বাভাবিক। ভারতীয়দের কাছে শেখ মুজিবের বাজারদরটি এজন্যই ছিল বিশাল। তাদের কাছে ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে মোক্ষম হাতিয়ার। সে আন্দোলনের নেতা হওয়ার কারণে ভারতের সর্বপ্রকার সাহায্য প্রাপ্তি শেখ মুজিবের জন্য অতি সহজ হয়ে যায়। মুজিব না চাইলেও ভারত সেটি নিজ গরজে দিত। আওয়ামী লীগের আন্দোলন তখন শুধু মুজিব বা আওয়ামী লীগের আন্দোলন থাকেনি, ভারতীয়দের কাছে সেটি তাদের নিজস্ব যুদ্ধে পরিণত হয়। একাত্তরের যুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী ভারতীয় দখলদারির ইতিহাস মূল্যায়ণে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ড্রাইভার নেশামূক্ত ও সুস্থ হলে যাত্রীদের সবাই মাতাল বা নেশাগ্রস্ত হলেও বাস নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে।অথচ চালকের আসনটি মাতালের হাতে অধিকৃত হলে যাত্রীদের দোয়া-দরুদ ও তছবিহ পাঠে লাভ হয় না;দুর্ঘটনা বা পথ হারানোটি তখন অনিবার্য হয়। মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তথা রাজনীতির চালকের আসনে তাই ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের সংরক্ষণে আপোষহীন ঈমানদার ব্যক্তিকে বসানোর বিকল্প নেই। ইসলামে অঙ্গীকারহীন সেক্যুলারিস্টদের হাতে ইসলাম ও মুসলিমের স্বার্থ বাঁচে না; তারা সহজেই শত্রুর এজেন্টে পরিণত হয়। তখন অপূরণীয় মহা বিপর্যয় নেমে আসে দেশ ও দেশবাসীর জীবনে।তখন অসম্ভব হয় সিরাতুল মোস্তাকিমে চলা;এবং কঠিন হয় মুসলিম স্বার্থের সংরক্ষণ।রাজনীতিতে আত্মঘাতি সংঘাত ও যুদ্ধ তখন অনিবার্য হয়ে উঠে। ১৯৭১’য়ে মুজিবের ন্যায় ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য ব্যক্তির হাতে নেতৃত্ব যাওয়াতে তো সেটিই হয়েছে। রাজনীতির অঙ্গণ তখন অধিকৃত হয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদী, সেক্যুলারিস্ট, সমাজবাদি, কম্যুনিস্ট ও নাস্তিকদের হাতে। ইসলাম এবং মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকারকে সাম্প্রাদায়িকতা বলে সেটিকে তারা আঁস্তাকুড়ে ফেলেছে। স্রেফ পাকিস্তানের বিভক্তি নিয়ে তারা খুশি ছিল না, বরং ভারতীয়দের সাথে মিলে ইসলামের এ বাঙালী শত্রুগণ চেয়েছিল দেশটির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি। পাকিস্তানের কোন প্রান্তে দেশটির সংহতির বিরুদ্ধে ধ্বনি উঠলে তাদের মনে আনন্দের হিল্লোল উঠে। কিন্তু পাকিস্তান বেঁচে আছে, তাদের সাধটি তাই অপূর্ণই রয়ে গেছে। দেশটি যে এখনো মুসলিম বিশ্বে একমাত্র পারমানবিক শক্তি ও সবচেয়ে শক্তিশালী মুসলিম দেশ রূপে বেঁচে আছে -সেটিও তাদের চক্ষুশূল। পাকিস্তান এখন তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু এখন আক্রোশ গিয়ে পড়ছে একাত্তরে যারা অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচাতে কাজ করেছিল -তাদের উপর।ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধে নামাকে তারা এখন যুদ্ধাপরাধ বলছে। চিহ্নিত কাফেরদের সাথ সুর মিলিয়ে ইসলামি রাষ্ট্র ও মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় যে কোন উদ্যোগকে বলছে তারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ।

মুসলিমদের কল্যাণ কি শুধু একখানি পৃথক রাষ্ট্র নির্মাণে? বরং সে রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটে চাই ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ ও ইসলামের প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ চালক। এক্ষেত্রে আপোষ চলে না। ইসলামী আদর্শের উপর পুরাপুরি প্রতিষ্ঠিত না করলে সে রাষ্ট্র মুসলিমদের জন্য আদৌ কল্যাণকর হয় না। আজ মুসলিম বিশ্বজুড়ে যে ভয়ানক বিপর্যয় তা কি সম্পদে বা জনসম্পদের কমতিতে? সে ব্যর্থতাটি ইসলামী নীতি মেনে না চলায়। চৌদ্দশত আগে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রটি নির্মিত হয় তখন সে রাষ্ট্রের প্রধান কর্ণধার রূপে বসেছেন খোদ নবীজী (সাঃ)। নবীজী(সাঃ)র ইন্তেকালের পর বসেছেন খোলাফায়ে রাশেদাগণ। এটিই তো মুসলিম জীবনে রাজনীতির রোডম্যাপ। ঈমানদারের দায়বদ্ধতা হলো, সে রোডম্যাপকে প্রতিযুগে ও প্রতিদেশে অনুসরণ করা। বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার ৯১% ভাগ মুসলিম। অথচ দেশটির রাজনীতিতে সে রোডম্যাপ অনুসরণ করা হয়নি। বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় বসেছে মুজিবের ন্যায় ইসলামে অঙ্গীকারহীন একজন ব্যক্তি। মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশকে বাদ দিয়ে দেশ শাসনে ভারতের নীতি ও নির্দেশকে তিনি গুরুত্ব দেন।এমন অধিকৃত রাষ্ট্র থেকে বাঙালী মুসলিম কি কোন কল্যাণ কামনা করতে পারে? জন্মের পর থেকেই তাই দেশটি চলছে ভয়াবহ অকল্যাণের পথে।

 

পরাজয় বুদ্ধিবৃত্তিতে

মাছের ন্যায় মানবের পচনটিও তার মগজে -তথা বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে পরাজয় আসে সে বুদ্ধিবৃত্তিক পচনের পথ ধরে।আন্দামান, নিকোবার ও পাপুয়া নিউগিনির ন্যায় অনেক দেশের বনে-জঙ্গলে বহু মানব সন্তান পশুর ন্যায় উলঙ্গ থাকে, ঝোপঝাড় ও গুহায় বাস করে।সেটি নিছক বুদ্ধিবৃত্তিতে বেড়ে না উঠার কারণে, দৈহিক প্রতিবন্ধকতার কারণে নয়। বাঙালী মুসলিমের জীবনেও সবচেয় বড় বিপর্যয়টি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয়। সে গভীর বিপর্যয়টি বাঙালী মুসলিমের জীবনে শুধু আগ্রাসী ভারত ও একাত্তরের যুদ্ধই ডেকে আনেনি, বরং এনেছে লাগাতর নীচে নামার চারিত্রিক ও সাংস্কৃতিক দুর্গতি। বাংলাদেশ যে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বের সকল দেশকে পিছনে ফেলে ৫ বার প্রথম হয়েছে -সেটি দেশের জলবায়ু বা ভূমির কারণে নয়, সেটির মূল কারণ এ বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্গতি। বিপর্যয়টি চরম আকারর ধারণ করে বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের হাতে নেতৃত্ব যাওয়ায়।মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র সূন্নত হলো, মানবের মাঝে তিনি মানবতা ও অর্পিত খেলাফতের দায়িত্ব নিয়ে বেড়ে উঠার সামর্থ্যটি সৃষ্টি করেন বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থতা বাড়িয়ে। সেটি করেন হিদায়েত ও তাঁর নাযিলকৃত ওহীর জ্ঞান দিয়ে। তাই পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার প্রথম নির্দেশটি নামায-রোযা বা হজ-যাকাতকে ফরজ করতে নাযিল হয়নি। সেটি হয়েছে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করতে। পবিত্র কোরআনের প্রথম শব্দটি তাই “ইকরা” অর্থাৎ “পড়” বা জ্ঞানার্জন কর। “ইকরা” তথা পড়ার হুকুমটি তাই স্রেফ মহান নবীজী (সাঃ)র প্রতি নয়, বরং নবীজী(সাঃ)র মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতির প্রতি। তাগিদ এখানে পবিত্র কোরআনের জ্ঞান অর্জনের প্রতি।

মহান আল্লাহতায়ালা “ইকরা” তথা পাঠের নির্দেশ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, মুসলিম রূপে এবং সে সাথে সভ্য মানুষ রূপে বেড়ে উঠতে হলে শুরু করতে হয় কোরআনী জ্ঞানার্জনের সিঁড়ি বেয়ে। পবিত্র কোরআনের জ্ঞান দিয়েই মুসলিম জীবনের আমৃত্য জিহাদ, সেটি মিথ্যা ও অজ্ঞতার নির্মূলে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর জীবনে তাই সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি হয় বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গনে। এ যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়েই জনগণের মনের ভূবনে এবং সে সাথে রাজনীতির অঙ্গণে ইসলামের জন্য ক্ষেত্র তৈরী হয়। নবীজী (সাঃ)র সাহাবীগণ তাই শুধু সশস্ত্র মুজাহিদই ছিলেন না, উচ্চতর আলেমও ছিলেন। ফলে সে আমলে যত আলেম গড়ে উঠেছে, আর কোন আমলেও তা হয়নি। পাকিস্তান আমলে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে বাঙালী মুসলিমদের মূল ব্যর্থতাটি মূলতঃ জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে। পশুপালন, মৎস্য পালন বা পোষাক উৎপাদন বাড়িয়ে বড় জোর পানাহার, পোষাকপরিচ্ছদ বা বাসস্থানে পরিবর্তন আনা যায়। কিন্তু তাতে কি উচ্চতর মানব হওয়া ও মহান অল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে বেড়ে উঠার কাজটি সুনিশ্চিত হয়? ইসলামের শত্রুগণ মুসলিমের শক্তির মূল উৎসটি জানে;বাংলাদেশের বুকে তাদের হামলাটি তাই চিংড়ির ঘেড়, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি,ধানের ক্ষেত বা গৃহভৃত্য রূপে নারী-রপ্তানীর বিরুদ্ধে নয়।বরং সে সবের উন্নয়নে তারা অর্থ দেয়,প্রযুক্তি দেয় এবং প্রশিক্ষণও দেয়।তাদের আক্রমণের মূল টার্গেট তো কোরআনী জ্ঞান।সেজন্যই কোরআনের তাফসির, জিহাদ বিষয়ক বই ও ইসলামী সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে এতো কড়াকড়ি। ফলে বাংলাদেশে ইসলামের শত্রুপক্ষ যে স্রেফ শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি বা প্রশাসনে দুর্গতি এনেছে না তা নয়;অসম্ভব করেছে পবিত্র কোরআনের জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠা। ফলে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা কোন কাফেরের পক্ষ থেকে আসে  না, সে প্রবল বাধাটি আসে তথাকথিত মুসলিমদের পক্ষ থেকে!

বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে ব্যর্থতাটি স্রেফ বাঙালী জাতীয়বাদী সেক্যুলারিস্টদের নয়।ইসলামপন্থীদের ব্যর্থতাটিও এ ক্ষেত্রে বিশাল। উর্দু সাহিত্যে আন্তর্জাতিক মানের বহু ইসলামী মনিষী জন্ম হলেও বাঙালী মুসলিমদের মাঝে তা হয়নি। কোরআনী জ্ঞানের নিদারুন অপুষ্টিতে কোটি কোটি বাঙালী মুসলিমের জীবনে ইসলামী চেতনা তাই নিরবে মারা পড়েছে। বুদ্ধিবৃত্তির খালি ময়দানটি সহজে দখলে নিয়েছে ইসলামের শত্রু পক্ষ। আর বুদ্ধিবৃত্তির ময়দান শত্রুপক্ষের হাতে অধিকৃত হলে কি রাজনীতির উপর দখলদারি থাকে? বস্তুত বুদ্ধিবৃত্তিক পরাজয়ের পথ বেয়েই আসে রাজনৈতিক পরাজয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে বিজয়ের ফল; তাই এ লড়ায়ে কাউকে যুদ্ধে নামতে হয়নি, একটি তীরও কাউকে ছুঁড়তে হয়নি। তেমনি দেশটির পরাজয়ও ঘটেছে বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে; সেটি একাত্তেরর যুদ্ধের বহু আগেই। বুদ্ধিবৃত্তিক সে বিপর্যয়টি সবচেয়ে ভয়ানক ভাবে আঘাত হেনেছিল বাঙালী মুসলিমের জীবনে। তাই একাত্তরে শুধু পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীই পরাজিত হয়নি, পরাজয় ঘটেছে ইসলামী দর্শন, মূল্যবোধ ও চেতনার। সেটি বাঙালী মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানে। একাত্তরে এমন দ্বিমুখি পরাজয় পশ্চিম পাকিস্তানে হয়নি। কারণ,বুদ্ধিবৃত্তির রণাঙ্গনে সেখানে অসংখ্য যোদ্ধা ছিল। তাই ইতিহাসের বিষয় শুধু যুদ্ধবিগ্রহ ও রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের কাহিনী নয়। তাতে থাকে বুদ্ধিবৃত্তিক জয়-পরাজয়ের কাহিনীও। অথচ একাত্তরের ইতিহাসে বাঙালী মুসলিমের এ বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয় নিয়ে কোন বক্তব্য নাই।

 

একাত্তরের অর্জন

একাত্তরের বিশাল অর্জন রূপে পেশ করা হয় স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে। কিন্তু কোথায় সে স্বাধীনতা? কোথায় সে গণতন্ত্র? ইন্দিরা গান্ধির সাথে মুজিবের স্বাক্ষরিত ২৫ সালা দাসচুক্তি কি স্বাধীনতার দলিল? স্বাধীনতা কি কখনো দাসচুক্তিতে আসে? মুজিবের একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার কি গণতন্ত্র? ১৯৫৪ সালে ও ১৯৭০ সালে পাকিস্তান আমলে যে ধরণের নির্বাচন হয়েছিল -সেরূপ একটি নির্বাচনও কি মুজিবামলে হয়েছে? হাসিনার আমলেও কি হয়েছে? কোথায় সে বাকস্বাধীনতা? সকল বিরোধী পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল নিষিদ্ধ করার নাম কি বাকস্বাধীনতা? অপর দিকে অরক্ষিত বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতাই বা কতটুকু? ভেড়ার স্বাধীনতা আর সিংহের স্বাধীনতা কি এক? ভেড়ার ঘাস খাওয়ার স্বাধীনতা থাকে শুধু মোটা তাজা হয়ে জবাই হওয়ার জন্য। তেমনি বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ, পোষাক তৈরী, পশু পালন এবং ধান-পাট-মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাটুকু স্রেফ ভারতীয় পণ্যের খরিদদার হওয়ার জন্য।ভারতীয় পণ্যের জন্য বাংলাদেশের বাজার সে জন্যই সব সময় উম্মুক্ত রাখতে হয়।ভারতকে চলাচলে সুবিধা দিতে করিডোরও দিতে হয়।ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে এরূপ স্বাধীনতায় কি কমতি ছিল? কিন্তু স্বাধীনতার সে তালিকায় শরিয়ত প্রতিষ্ঠার স্বাধীনতা নেই। মূক্ত ভাবে কোরআন প্রচারের স্বাধীনতাও নেই। ইসলামের বিজয়ে অঙ্গীকার নিয়ে দলগড়া বা রাজনীতি করার স্বাধীনতা নাই। স্বাধীনতা নেই মজলুল কাশ্মীরী বা ভারতের মুসলিমদের পক্ষে কথা বলার। এই হলো একাত্তরের অর্জিত স্বাধীনতা। অথচ শরিয়তের প্রতিষ্ঠা এবং তা মেনে চলা প্রতিটি ঈমানদারের উপর বাধ্যতামূলক। এখানে আপোষ চলে না। আপোষ হলে সে আর মুসলিম থাকে না; মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সে ব্যক্তি কাফের, জালেম ও ফাসেকে পরিণত হয়। সে ঘোষণাটি মহান আল্লাহতায়ালার; সেটি এসেছে সুরা মায়েদার ৪৪,৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে। কিন্তু বাংলাদেশের আদালতে কোথায় সে শরিয়তী বিধান। জনগণের আছে কি শরিয়ত প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে সংগঠিত হওয়ার অধিকার? যে দেশে ইসলাম ও মুসলিমের পক্ষ নেয়াটি এভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়,সে দেশকে স্বাধীন বলা যায়?

ভাষাভিত্তিক জাতীয়তায় ভিত্তিতে বাংলাদেশের নির্মাণকেই একাত্তরের বড় অর্জন রূপে পেশ করা হয়। সে লক্ষ্যেই যুদ্ধ লড়া হয় একাত্তরে। কিন্তু এমন রাষ্ট্র নির্মাণে প্রাণের কোরবানী কি ইসলামে আদৌ বৈধ? মহান নবীজী বা তাঁর সাহাবাগণ কি কখনো ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা আঞ্চলিকতার নামে রাষ্ট্র নির্মাণ করেছেন? পরকালের বিচার দিনে সেটি কি কোন বিচার্য বিষয় হবে? বরং মহান আল্লাহতায়ালা তো ব্যক্তিকে ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও ভৌগলিক বিভক্তির দেয়াল ডিঙ্গিয়ে অন্য ভাষা, অন্য বর্ণ ও অন্য ভুগোলের মুসলিমের সাথে মিলনের নির্দেশ দেন। নবীজী ও সাহাবাগণ যে রাষ্ট্র নির্মাণ করেন তাতে ভাষা, বর্ণ বা আঞ্চলিকতার কোন দেয়াল ছিল না। ১৯৪৭’য়ে সমগ্র উপমহাদেশে সেটিই ঘটেছিল। তাই সাতচল্লিশের মুসলিম রাজনীতিতে যা ঘটেছিল সেটিই কি অধিক সভ্যতর, অধিক মানবিক ও ইসলামী নয়? বিভক্তির দেয়াল ভাঙ্গার রাজনীতিই তো মুসলিমের রাজনীতি। দেয়াল ভাঙ্গার সে সামর্থ্যটুকু না থাকাটা শুধু ঈমানী অসামর্থ্যতাই নয়, প্রচণ্ড নৈতিক অসামর্থ্যতাও। এটি তো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের তথা কুফরির পথ। অথচ সে পথেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানীদের ধাবিত করেছেন শেখ মুজিব। এরূপ নৈতিক অসুস্থতায় কোন মুসলিম দেশ কি কখনো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক সুস্থতা পায়? অসুস্থ দেহ সবসময়ই রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সামর্থ্য হারায়। দুর্বল দেহে তখন নানা রোগের জীবাণু বাসা বাঁধে। এরূপ অসুস্থ চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয়ের দেশে বড় বিপদটি আসে বিদেশী শক্তির অধিকৃতি রূপে।পাকিস্তানের বাদবাকি অংশে তথা সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাবী,সিন্ধি,পাঠান,বেলুচ ও উর্দু ভাষীরা এখনো এক অখণ্ড ভূখণ্ডে বসবাস করছে।অথচ ভাষা,বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে দেশটির বুকে বিভক্তির দেয়াল খাড়া হতে পারতো।সৃষ্টি হতে পারতো অন্তত আরো ৫টি দেশ।সে ৫টি দেশের প্রত্যেকটির আয়োতন সুইজারল্যান্ড,বেলজিয়াম,ইসরাইল,কোরিয়া,কাতার,কুয়েত,লেবাননের ন্যায় বিশ্বের প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ রাষ্ট্রের চেয়ে বড় হতো।ভৌগলিক আয়োতনে বাংলাদেশের চেয়ে বৃহৎ হতো পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তান।কিন্তু বিভক্তির সে পথে তারা যায়নি। ফলে ৫৭টি মুসলিম দেশের মাঝে পাকিস্তানই হলো সবচেয়ে শক্তিশালী মুসলিম দেশ।ভারতকে সমীহ করে তাদের চলতে হয় না;এবং করিডোরও দিতে হয় না।কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে বাংলাদেশীদের ন্যায় কোন পাকিস্তানীকে মরতে হয় না।

লন্ডনের প্রখ্যাত দৈনিক পত্রিকা The Guardian গত ৮/১২/২০১৫ তারিখে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট মার্টিন শুলজ (Martin Schulz)’এর একটি বক্তব্য ছাপে যা প্রথমে ছেপেছিল জার্মানীর পত্রিকা Die Welt। মিস্টার শুলজ বলেন: “The European Union is in danger, and no one can say whether the EU will still exist in 10 years’ time. If we want it, we’ll have to fight for it very hard.” He said the alternative to the EU would be a “Europe of nationalism, a Europe of borders and walls. That would be horrific, because such a Europe has repeatedly led in the past to catastrophe.”  অনুবাদঃ “ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এখন বিপদের মুখে। কেউই বলতে পারে না, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন আগামী ১০ বছর পরও বেঁচে থাকবে। যদি আমরা এটিকে চাই তবে সে জন্য আমার কঠিন লড়াই করতে হবে। তিনি বলেন, ইউরোপীয়ান ইউনীয়নের বিকল্প হলো জাতীয়তাবাদের ইউরোপ, সেটি সীমান্ত রেখা ও দেয়াল দিয়ে বিভক্ত ইউরোপ। সেটি হবে ভয়ংকর। কারণ অতীতে তেমন একটি বিভক্ত ইউরোপ বার বার বিপর্যের দিকে ধাবিত করেছে।” মার্টিন শুলজ মুসলমান নন। নিজ ভাষা, নিজ বর্ণ ও নিজ ভূগোলের দেয়াল ভাঙ্গা ও অন্যদের সাথে একতাবদ্ধ হওয়াটি তার উপর ধর্মীয় ভাবে ফরজ নয়। কিন্তু তারপরও তিনি ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের পক্ষে জোড়ালো বক্তব্য রেখেছেন। সে কথাটি বলেছেন জাতীয়তাবাদের নামে বিভক্ত ইউরোপীয় দেশগুলো অতীতে যেরূপ বার বার ধ্বংসাত্মক যু্দ্ধে নেমেছে -সে ভয়াবহ বিপদ থেকে বাঁচানোর তাগিদে। বিভক্তির যাতনা ভয়ানক। একমাত্র দুটি বিশ্বযুদ্ধেই সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিহত হয়েছে। বীভৎস ধ্বংস নেমে এসেছে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে। মার্টিন শুলজ ইউরোপীয়দের সে বিপদেরই হুশিয়ারী শুনিয়েছেন তার বক্তব্যে। বিভক্তির এ বিপদ ভারতীয় হিন্দুগণও বুঝে। তাই বাঙালী, বিহারী, পাঞ্জাবী, গুজরাতি, মারাঠী এরূপ নানা ভাষার হিন্দুগণ অখণ্ড ভারতের মানচিত্রে বসবাস করাকে অতি জরুরী মনে করে। কিন্তু সে সামান্য বুঝ মুজিবের ছিল না; মুজিব চরিত্রের সেটিই সবচেয়ে দুর্বল দিক। নাই তার অনুসারি ভারতসেবী বাঙালী জাতীয়তাবাদীদেরও।

বিভক্তির ভয়াবহ নাশকতা থেকে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজ দল মুসলিম উম্মাহকে বাঁচাতে চান। তাই বিভক্তির দেয়াল গড়াকে তিনি হারাম করেছেন। বিভক্তির পথে যারা নামে তাদের জন্য শুধুই দুনিয়াতেই, পরকালেও রয়েছে জাহান্নামের কঠিন আযাব। (সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০৫)।বাংলাদেশে একাত্তরে যুদ্ধ এলো, সে যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হলো, যুদ্ধপরবর্তী ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এলো, সে দুর্ভিক্ষে লক্ষাধিক মানুষ নিহত হলো, দেশবাসী বিশ্বজুড়ে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির বদনাম কুড়ালো –এগুলিকে কি মহান আল্লাহতায়ালার রহমত বলা যায়? পাকিস্তানের ব্যর্থতা অনেক। কিন্তু সফলতাও কি কম? বহু ব্যর্থতার মাঝে পাকিস্তানই একমাত্র মুসলিম দেশ যে দেশে পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পশতু, বেলুচ ও উর্দু –এ ৫টি ভিন্ন ভাষার ১৮ কোটি মানুষ একই অখণ্ড মানচিত্রে একত্রে বসবাস করছে। বিশ্বের আর কোন মুসলিম দেশ কি প্যান-ইসলামীক ভাতৃত্বের এরূপ ইতিহাস গড়তে পেরেছে?

পাকিস্তানের সাফল্যের কারণ, বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের হাতে যে বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মঘাত পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল, সেরূপ আত্মঘাতি বিপর্যয় থেকে পশ্চিম পাকিস্তান বেঁচে যায়। সেখানে আগ্রাসী ভারত তার নিজ এজেন্ডা বাস্তবায়নে কোন মুজিব বা আওয়ামী লীগ পায়নি। ফলে সে দেশের সীমান্তে বার বার যুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও দেশটি ভারতীয় বাহিনীর হাতে অধিকৃত হয়নি। বেঁচে যায় বিভক্তি থেকেও। লুণ্ঠিত হয়নি ভারতের হাতে দেশটির অস্ত্রভাণ্ডার, অর্থভাণ্ডার ও কলকারখানা –যেমনটি একাত্তরে বাংলাদেশে হয়েছে। ফলে পাকিস্তান বাংলাদেশের ন্যায় ভিক্ষার আন্তর্জাতিক তলাহীন ঝুলিতে পরিণত হয়নি। সে দেশটিতে কোন কালেই দুর্ভিক্ষ আসেনি, বাকশালী স্বৈরাচারও প্রতিষ্ঠা পায়নি। বরং বাংলাদেশের তুলনায় বহুপথ এগিয়ে গেছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়। এখন আন্তর্জাতিক ভাবেই স্বীকৃত যে, সে দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার আছে।কোন রাজনৈতিক নেতাকে সে দেশে ফাঁসীতে চড়তে হয় না। এমন কি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং দেশটিকে খণ্ডিত করার সাথে জড়িত থাকা সত্ত্বেও মুজিবকে ফাঁসীতে ঝুলতে হয়নি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে যে সত্যটি কখনোই বলা হয়নি তা হলো, ১৯৪৭ সালে যে বিশাল বৈষম্য নিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ১৯৭১’য়ে এসে তা অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১’য়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে বিভক্ত দু’টি দেশের মাঝে বৈষম্য আবার দ্রুত বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ ধাবিত হয় ভারতীয় লুণ্ঠন, দুর্ভিক্ষ,তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি ও দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে প্রথম হওয়ার দিকে। ফলে পাকিস্তান যেখানে পারমানবিক শক্তি, অরক্ষিত বাংলাদেশ সেখানে ভারতের নানা রূপ ষড়যন্ত্রের জালে আষ্টেপিষ্টে বন্দী। দেশটিকে ভারতীয়দের জন্য করিডোর দিতে হয় বুকের মাঝখান দিয়ে। অথচ সে বন্দীদশাকেই বলা হচ্ছে স্বাধীনতা। ক্যান্সার রোগীকে তার রোগের ডায়োগনসিস বলাতে বিষন্ন হয় বটে,কিন্তু সে সত্য কথাটি বলাতে সে ব্যক্তি ডাক্তারকে শত্রু ভাবে না।তার দিকে অস্ত্র হাতে ধেয়েও আসে না। কিন্তু অথচ অতিশয় সত্য কথাটি বলায় শত্রু বলে ধেয়ে আসে ভারতসেবী বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ। ভারতীয় অধিকৃতি, বাকশালী স্বৈরাচার, নৈতিক দুর্গতি ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়সহ বাংলাদেশের সকল ব্যর্থতার কারণটি যে ইসলামশূণ্য একাত্তরের ভারতসেবী চেতনা  –সে প্রকাণ্ড সত্যটি মেনে নেয়ার নৈতিক বল তাদের নেই।

 

বিশাল প্রাপ্তি ভারতের

একাত্তরের অর্জনটি যেমন গণতন্ত্র নয়, তেমনি বাঙালীর স্বাধীনতাও নয়।বরং এটি নিরেট ভারতীয় অধিকৃতি ও ভারতের সেবাদাসদের শাসন।আর অধিকৃত দেশে কি স্বাধীনতা থাকে? ফলে পূর্ব পাকিস্তানে যে গণতন্ত্র ছিল এবং ১৯৫৪ ও ১৯৭০’য়ে যে মানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল,সে গণতন্ত্র ও সে নির্বচনের কথা বাংলাদেশ সৃষ্টির ৪৫ বছর পর ২০১৬ সালের বাংলাদেশে কি ভাবা যায়? দেশের জনগণ যখন স্বাধীন ভাবে কথা বলতে বা সংগঠিত হতে পারে না -সে দেশে আবার স্বাধীনতা কিসের? পাকিস্তান ভাঙ্গাটিই একাত্তরের একমাত্র অর্জন। এবং সেটি ছিল ১৯৪৭ সাল থেকে ভারতীয়দের এজেন্ডা। ফলে একাত্তরের বিশাল প্রাপ্তিটি ভারতের। একাত্তরের বিজয় তাই ভারতের বিজয়। তবে ভারতের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতসেবী বাকশালী শিবিরে উৎসবের কারণটিও সহজে বোধগম্য। কারণ একাত্তরের ভারতীয় বিজয় তাদের দিয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নির্মূল ও তাদের ব্যবসা-বানিজ্য ও সহায়সম্পদ লুণ্ঠনের স্বাধীনতা। দিয়েছে অবাঙালীদের শত শত কোটি টাকার ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানার দখলদারির স্বাধীনতা।স্বাধীনতা পেয়েছে দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার উপর ডাকাতির।তারা এতটাই স্বাধীন যে, পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে না,আদালতেও তোলে না; বরং পাহারা দেয়। ফলে যেসব আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভিটায় একাত্তরের পূর্বে টিনের ঘর ছিল না তাদের এখন গুলশান, বনানী, ধানমন্ডিতে বিশাল বিশাল বাড়ি। তারা এখন বড় বড় দোকান-পাট ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক। মালিক হয়েছে পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের। তারা বিশাল বিশাল বাড়ি কিনেছে ও বিপুল অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স গড়েছে বিদেশেও।

ভারতও নিজ এজেন্ডা পূরণে বাংলার মাটিতে এমন সুযোগ আর কখনোই পায়নি। একাত্তরের যুদ্ধজয়ের পর অবাধে লুণ্ঠন করতে পেরেছে পাকিস্তান আর্মির অব্যবহৃত বহু হাজার কোটি টাকার অস্ত্র, আর্মি জিপ ও সাঁজোয় গাড়ি। পেয়েছে সেনানিবাস, সরকারি ভবন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান লুণ্ঠনের অবাধ সুযোগ। পেয়েছে ভারতীয় পণ্যের জন্য প্রায় ১৬ কোটি মানুষের অধিকৃত বাজার। এর চেয়ে ছোট বাজার দখলে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এদেশে এসে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ভারত পেয়েছে দেশের অভ্যন্তর দিয়ে বিনাশুল্কে ভারী যানবাহন পাড়াপাড়ের অবাধ সুযোগ –যা বাংলাদেশ বহু চেষ্টা করেও পাচ্ছে না নেপাল বা ভূটানে যেতে। করিডোর না পেলে বাংলাদেশের উত্তর দিয়ে হাজার মাইল ঘুরে যেতে হত। এভাবে পেয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে নিরাপদ পথে পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার। পেয়েছে পদ্মা, তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারার ন্যায় বহু নদীর পানি তুলে নেয়ার সুযোগ। এভাবে বাংলাদেশকে কিছু না দিয়েই তারা পেয়েছে অনেক। তবে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটি হলো, তারা পেয়েছ ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে বাঙালী মুসলিমদের ভারতীয় সংস্কৃতিতে দীক্ষা দানের সুযোগ। ফলে চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতিতে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী এখন বহু ভারতীয়দের চেয়েও ভারতীয়। পাকিস্তান আমলে উর্দু বর্জন করলেও এখন তারা সানন্দে হিন্দি বলে। ভারতীয় সংস্কৃতির কাছে এরূপ আত্মসমর্পণের ফলে দেশের উপর ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকৃতিও সহনীয় হয়ে উঠেছে। হয়তো সেদিন দূরে নয় যখন বাংলাদেশের সীমান্ত বিলুপ্তিও সহনীয় হয়ে উঠবে। তেমন একটি ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে ভারতের বিশাল বিনিয়োগ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও সীমান্ত ঘিরে দেশটির হাজার হাজার সাংস্কৃতিক সৈনিক দিবারাত্র কাজ করছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত তার নিজের দখলদারিটা যে কোন ভাবেই হোক বহাল রাখতে চায়। কারণ, ভারত তার নিজ দেশের নিরাপত্তার জন্য সেটি অনিবার্য ভাবে। কাশ্মীরের ন্যায় বাংলাদেশও ভারতের অবিচ্ছেদ্দ্য অঙ্গ -এ কথা দিল্লির শাসকগণ প্রকাশ্যে না বল্লেও বাংলাদেশ যে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বলয়ের অবিচ্ছেদ্দ্য অঙ্গ -সে কথা খোলাখোলীই বলে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ অবধি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যেরূপ পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত ছিল -সেটি ভারতের কাছে অসহ্য ছিল। ভারতীয় প্রভাবমূক্ত স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ছিল ভারতের পেটের মধ্যে বিষফোঁড়া –যা যে কোন বিপদ ঘটাতে পারতো। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ৭টি প্রদেশে। ভারত তেমন নাজুক অবস্থা পুনরায় হতে দিতে চায় না। এজন্যই একাত্তরে বাংলাদেশের উপর যে প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা পায়, ভারত সেটিকেই যে কোন মূল্যে বহাল রাখতে চায়। সে লক্ষ্যে চায়, ঢাকার বুকে ভারতের অনুগত একটি পুতুল সরকার। গণতান্ত্রিক নির্বাচন হলে ভারতসেবী বাকশালীদের পরাজয় যে সুনিশ্চিত –ভারতীয় শিশুগণও সেটি বুঝে। ফলে সেরূপ একটি নির্বাচন হতে না দেয়াই ভারতের নীতি।

ভারত চায়, বাংলাদেশে অধিকৃত কাশ্মীর স্টাইলের নির্বাচন। কাশ্মীরে বহুবার নির্বাচন হয়েছে; কিন্তু তাতে কাশ্মীরীদের জনমত কখনোই গুরুত্ব পায়নি। ফলে মুক্তি মেলেনি ভারতীয় অধিকৃতি থেকে।তেমন নির্বাচন বাংলাদেশেও বার বার হবে, কিন্তু সেসব নির্বাচনের পরও রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তির উপর ভারতীয় দখলদারি বলবৎ থাকবে। সে দখলদারি বাঁচাতে ক্ষমতায় থাকবে ভারতসেবী বাকশালীগণ। সেরূপ জাল নির্বাচনের ধারা প্রথম শুরু করেছিলেন শেখ মুজিব। এখন সে ধারাই অব্যাহত রেখেছেন শেখ হাসিনা। একটি জাল নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে কীরূপে ক্ষমতায় থাকা যায় -২০১৪ সালে হাসিনা সেটি প্রমাণও করেছে। ২০১৪ সালের ন্যায় প্রতিটি জাল নির্বাচনকে বৈধতা দিবে ভারত। আন্তর্জাতিক মহলে সেটি গ্রহণযোগ্য করার জন্য ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ বিশ্বময় সুপারিশও করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ই্উরোপীয়ান ইউনিয়ন এবং রাশিয়াসহ বিশ্বের অধীকাংশ দেশই ভারতের ন্যায় বৃহৎ দেশের সাথে সুসম্পর্ক চায়।তাদের কাছ ৩৫ কোটি মানুষের অখণ্ড পাকিস্তানের যে গুরুত্ব থাকতো তা ১৬ কোটি বাংলাদেশীর নাই। তাই বাংলাদেশে কি হচ্ছে তা নিয়ে ভারতকে তারা নারাজ করবে না। বরং বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের মতামতকে তারা অধীক গুরুত্ব দিবে। ফলে আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের শত্রু যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রগণ, তেমনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মূল শত্রু হলো ভারত  ও তার বাকশালী মিত্রগণ। তারা শত্রু বাংলাদেশের স্বাধীনতারও। সেটি সত্যটি শুধু আজ নয়; ১৯৪৭ সালেও শতভাগ সত্য ছিল। এমনকি শতভাগ সত্য ছিল ১৯৭১’য়েও। শত্রু না হলে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিস্তর সম্পদ লুটে কেন দুর্ভিক্ষ উপহার দিবে কেন? এটি কি বন্ধুর কাজ? কোন স্বাধীন দেশের প্রতি প্রতিবেশী দেশের আচরণ কি কোন কালেও এমনটি হয়? কাশ্মীরের বুকে ভারতীয় দখলদারি পাহারা দিচ্ছ ৬ লাখ ভারতী সৈন্য। বিশ্বের আর কোন দেশের বুকে মাথাপিছু এত সৈন্য নাই। তবে বাংলাদেশের বুকে ভারতীয় দখলদারি পাহারা দেয়ার জন্য ভারতীয় সৈন্যের প্রয়োজন সামান্যই।কারণ, ভারতের পক্ষে সে যুদ্ধটি লড়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত এমন বাংলাদেশীদের সংখ্যাটি বিশাল।এবং সে সংখ্যাটি বাড়ানোর তাগিদে ভারতীয় র’এজেন্টদের লক্ষ্যভূমি শুধু রাজনীতির অঙ্গন নয়, বাংলাদেশের সেনা বাহিনীও।বাংলাদেশের মাটিতে বিপুল ভাবে বাড়ানো হয়েছে ভারতীয় ট্রোজান হর্সদের সংখ্যা। এসব ট্রোজান হর্সগণ যেমন বিশাল সফলতা দেখিয়েছে ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে অসংখ্য মুসল্লী হত্যায়,তেমনি পিল খানায় ৫৭ জন অফিসার হত্যায়।তবে এসব ট্রোজান হর্সদের আস্তানা শুধু রাজনীতি,পুলিশ,র‌্যাব ও সেনাবাহিনীতে নয়;বরং দেশের মিডিয়া, প্রশাসন ও আদালতে।বাঙালী মুসলিমদের জীবনে তাই আজ গুরুতর সংকট। যে সংকটের শুরুটি একাত্তরে; সে সংকট এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে।

বাংলার স্বাধীনতা ব্রিটিশের হাতে অস্তুমিত হয় ১৭৫৭ সালে।সে লুণ্ঠিত স্বাধীনতা ১৯০ বছর পর ১৯৪৭’য়ে উদ্ধার হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ১৯৭১’য়ে বাংলার মুসলিম ভুমি ভারতের হাতে যেভাবে আবার অধিকৃত হলো -তা থেকে কবে মুক্তি মিলবে? ১৯৭২’য়ে ভারত তার সামরিক বাহিনীকে অপসারণ করলেও তার বিশাল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ট্রোজান হর্সদের অপসারণ করেনি। বাংলাদেশ জুড়ে তো এখন তাদেরই দখলদারি। ভারতের পক্ষে ভারতীয় পত্রপত্রিকা যা লেখে তার চেয়ে বেশী লেখে বহু বাংলাদেশী পত্রপত্রিকা। এরা ভারতীয়দের চেয়েও ভারতীয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ন্যায় স্বৈরচারি শাসককে হঠাতে ১০ জন মানুষেরও প্রাণ যায়নি। তার আগেই আইয়ুব খান পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এখন হাজার হাজার মানুষের প্রাণদানেও ভারতসেবী স্বৈরশাসককে সরানো সম্ভব নয়। কারণ, ভারত সেটি হতে দিতে রাজী নয়। নিজ দেশের নাগরিকদের রক্তপাত বন্ধে আইয়ুব খানের  যে ভাবনা ছিল, সে ভাবনা ভারতীয়দের নাই। ভারতের সেবাদাস বাঙালী জাতীয়তাবাদীদেরও নাই। ভারত সরকার কাশ্মীরে যে নীতির প্রয়োগ করছে সে নীতিই প্রয়োগ করছে বাংলাদেশে। দিল্লির কর্মকর্তাদের বিঘোষিত নীতি, “বাংলাদেশকে আর কখনোই ভারতীয় রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না।” অর্থাৎ বাংলাদেশকে বাঁচতে হবে ভারতের নজরদারীর অধীনে থেকেই। মুজিব সেটি মেনে নিয়েছিলেন। সেটি মেনে নিয়েই তিনি ২৫ সালা দাসচুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। হাসিনাও মেনে নিয়েছেন। তাই ভারত যাই চাচ্ছে তাই বিনা প্রতিবাদে দিয়ে দিচ্ছেন। বিনিময়ে হাসিনা পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিরোধীদের গুম, খুন ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার ভারতীয় লাইসেন্স।

 

পরাধীনতার পথ

কথা হলো, আগ্রাসী শক্তির সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সামর্থ্য না থাকলে কি স্বাধীনতা থাকে? সে শক্তি কি বাংলাদেশের আছে? পরাধীনতা তাই বাংলাদেশকে ঘিরে ধরেছে। স্বাধীনতা কখনোই দুর্বলদের জন্য নয়, সেজন্য শক্তি বাড়াতে হয়। আর শক্তি বাড়াতে হলে ভূগোল বাড়াতে হয়। সবাইকে তখন যু্দ্ধের প্রস্তুতি নিতে হয়, প্রয়োজনে যুদ্ধের ময়দানেও নামতে হয়। গড়ে তুলতে হয় অস্ত্রের ভাণ্ডার। ভারতের সামনে স্বাধীনতা বাঁচাতে পাকিস্তানকে তাই পারমানবিক বোমা, দূরপাল্লার মিজাইল,বোমারু বিমান ও ট্যাংক নিজ দেশে বানানো শিখতে হয়েছে। এসব বিলাসীতা নয়, বরং স্বাধীন ভাবে বাঁচার অপরিহার্য খরচ। মহান আল্লাহতায়ালা চান তার সৃষ্ট পৃথিবীতে তার দ্বীনের বিজয়। চান মুসলিম উম্মাহর ইজ্জত। আর সে বিজয় ও ইজ্জত দুর্বলদের হাতে আসে না। সেটি শক্তি বলে অর্জনের বিষয়। মুসলিম দেশের ভূগোল বাড়াতে ও প্রতিরক্ষা দিতে নবীজীর সাহাবাদের শতকরা ৭০ ভাগের বেশী শহীদ হয়েছেন।শক্তি বাড়ানোর তাগিদেই মহান নবীজী (সাঃ) তাই সাহাবাদেরকে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানি কন্সটান্টিনোপল (আজকের ইস্তাম্বুল) দখলে নেয়ার নসিহত করেছিলেন। এটি ছিল তাঁর দূরদৃষ্টি ও স্ট্রাটেজিক ভিশন। তেমন একটি লক্ষ্য নিয়েই ইখতিয়ার মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী মাত্র ১৭ জন সৈনিক নিয়ে সুদূর তুর্ক ভূমি থেকে বাংলায় ছুটে এসেছিলেন। বাংলার কোটি কোটি মানুষ মুসলিম হওয়ার সুযোগ পেয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট এ বঙ্গিয় ভূমি থেকে তাঁর বিদ্রোহীদের শাসন নির্মূল হওয়ার কারণেই। এটিই হলো পবিত্র কোরআনে বার বার ঘোষিত “জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ” তথা মহান আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদ। এ জিহাদ একাকী লড়া যায় না। মহান আল্লাহতায়ালা তাই ফরজ করেছেন নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলের মুসলিমদের মাঝে ঐক্যকে। তাই ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের নামে গড়ে উঠা দেয়াল ভাঙ্গার যুদ্ধই হলো মু’মিনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। সে দেয়াল ভাঙ্গার অঙ্গীকার নিয়েই ১৯৪৭ সালে বাঙালী মুসলিমগণ অবাঙালী মুসলিমদের সাথে একতার বন্ধন গড়েছিল। কিন্তু ১৯৭১’য়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টগণ ধরেছিল ভিন্ন পথ –সেটি ভূগোল ভাঙ্গা ও সে ভাঙ্গা ভূগোলের উপর দেয়াল গড়ার। সে সাথে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর পথ।যে বিজয় ১৯৪৭’য়ে অর্জিত হয়েছিল ভারত তা মুজিব ও তার অনুসারিদের কাঁধে অস্ত্র রেখে ছিনিয়ে নিয়েছে।ইসলামের বিপক্ষ শক্তির হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ার বিপদটি ভয়াবহ।পরাধীন দেশে তখন তখন ছিনতাই হয় পরিপূর্ণ কোরআনী জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠা ও পূর্ণ ধর্ম-পালন।তাই ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনে শুধু মুসিলম ভূগোলই অধিকৃত হয়নি, বিপদে পড়েছিল সাচ্চা ঈমানদার রূপে বাঁচা।বিলুপ্ত হয়েছিল শরিয়ত পালনের স্বাধীনতা। পরিকল্পিত শিক্ষানীতির মাধ্যমে বিলুপ্ত করা হয়েছিল জিহাদের ধারণা। জিহাদ চিত্রিত হয়েছিল সন্ত্রাস রূপে। বাঙালী মুসলিমদের জন্য একই রূপ বিপদ বেড়েছে একাত্তরের পর। ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠার জন্য অপরিহার্য যে কোরআনী জ্ঞান,সে জ্ঞানার্জন অসম্ভব করা হয়েছে।ইসলামকে শিখতে হবে ইসলামবিরোধী সরকারের নির্ধারিত পাঠ্যসূচী অনুসারে। সে পাঠ্যসূচীতে জিহাদ যেমন সন্ত্রাস, তেমনি নিষিদ্ধ হলো শরিয়তের আইন ।

দেশ বিভক্ত হলে যেমন শক্তি বাড়ে না,তেমনি স্বাধীনতাও বাড়ে না;বরং তা বিলুপ্ত হয়। তার উদাহরণ যেমন কাতার, কুয়েত, বাহরাইনের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরব দেশ, তেমনি বাংলাদেশও। শত্রুর সামনে পারমানবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তানের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সামর্থ্য আছে বলেই বাংলাদেশের চেয়ে তারা বহুগুণ স্বাধীন। তারা আগ্রাসী ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে। কামানের জবাব কামান দিয়ে দেয়।আনবিক বোমার জবাবে আনবিক বোমা ফেলার হুমকি দেয়। স্বাধীনতা রক্ষার এছাড়া ভিন্ন পথ আছে কি? পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে সে স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ ছিল বাঙালী মুসলিমদেরও। সে সুযোগটি পেতেই ১৯৪৭’য়ে বাঙালী মুসলিমগণ পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু সে স্বাধীনতা লুণ্ঠিত হয়েছে উনিশ শ’ একাত্তরে। বছর ঘুরে মার্চ বা ডিসেম্বর এলেই মাসভর যে উৎসব হয় -সেটি মূলত লুণ্ঠিত স্বাধীনতার বেদনা ভূলাতে। এটি আওয়ামী বাকশালীদের এক অভিনব কৌশল। স্বাধীনতা দিবসের নামে অন্য কোন সভ্য দেশে এরূপ মাসব্যাপী উৎসব হয় না। তবে বিজয়ের আসল উৎসবটি হয় দিল্লির শাসক মহলে। কারণ, একাত্তরের ফসল একমাত্র তারাই পুরাপুরি ঘরে তুলেছে। বাংলাদেশীদের জন্য যা বরাদ্দ তা হলো বাকশালী স্বৈরাচার, তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি, ১৯৭৪য়ের দুর্ভিক্ষ, অধিকৃত ভারতীয় বাজার, পিলখানায় অফিসার হত্যা, শাপলা চত্বরে মুসল্লী হত্যা, ভারতের জন্য করিডোর, সীমান্ত জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া এবং সে বেড়ায় ঝুলা বাংলাদেশীদের লাশ। পাকিস্তানী আমলের ২৩ বছরে এরূপ অপমান কি পূর্ব পাকিস্তানীদের জীবনে একদিনের জন্যও এসেছে? শুধু এতেই শেষ নয়, আরো কঠিন দুর্যোগ যে সামনে আছে -তা নিয়েও কি সন্দেহ আছে? বাঙালী মুসলিমের জীবনে এ এক নতুন পরাধীনতা। বাংলাদেশের ভারতসেবী রাজনীতিবিদ, পত্রপত্রিকা ও বুদ্ধিজীবীদের কাজ হয়েছে এ নতুন পরাধীনতাকে স্বাধীনতার লেবেল লাগিয়ে গ্রহনযোগ্য করা এবং তা নিয়ে উৎসবে অভ্যস্থ করা। ভারত দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর উপর আঘাত হানলে তাদের কাজ হয়েছে বড় জোর মলম লাগানো –যাতে আঘাতের বেদনাকে ভূলিয়ে দেয়া যায়। স্বাধীনতা ও একাত্তরের চেতনা বলতে তারা এটুকুই বোঝে।

 

দায়ভার ইতিহাস বাঁচানোর

গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি মাত্রই নিজে মৃত্যুবরণ করে জীবতদের জন্য অমূল্য শিক্ষা রেখে যায়। তাতে থাকে সে প্রাণনাশী অসুস্থতা থেকে বাঁচার প্রজ্ঞা। বিশাল চিকিৎসা শাস্ত্র গড়ে উঠেছে তো সে প্রজ্ঞার ভিত্তিতেই। এরূপ জ্ঞানদান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে না। কারণ, কিছু শেখাতে সেখানে কেউ প্রাণ দেয় না। তেমনি অসুস্থ জাতিও তার প্রতিটি পরাজয়,বিপর্যয় বা ধ্বংসের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রেখে যায় সমগ্র মানব জাতির জন্য। ইতিহাসের এরূপ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বহু ছবক রেখেছেন সমগ্র মানব জাতির জন্য। তাই ইতিহাস থেকে জ্ঞানদান মহান আল্লাহতায়ালার অতি মহান সূন্নত। একাত্তরকে ঘিরেও তেমনি গভীর বেদনা ও ব্যর্থতার পাশাপাশি বহু শিক্ষাণীয় বিষয়ও আছে। তবে দুঃখজনক হলো, ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়াই হলো মানব জাতির আরেক ইতিহাস। নানারূপ ব্যর্থতা ও বিপর্যয় এজন্যই মানব জাতির শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়;ফলে একই গর্তে বার বার পড়ে। একাত্তরের ন্যায় পলাশীর পরাজয়ের ইতিহাসেও ছিল বহু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়। কিন্তু সে ইতিহাসের পাঠ ক’জন নিয়েছে? পলাশীর পরাজয় থেকে শিক্ষা নিলে মুসলিমদের জীবনে কি বার বার পলাশী আসতো? বার বার অধিকৃত হতো কি মুসলিম ভূমি? ইংরেজ অধিকৃত ভারতে পরিকল্পিত ভাবেই পলাশীর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার কাজটি হতে দেয়া হয়নি। শত্রুগণ চায় না,ইতিহাস থেকে মুসলিমরা শিক্ষা নিক। তারা তো চায়,পলাশীর পরাজয়টি মুসলিম জীবনে বার বার ফিরে আসুক এবং মীর জাফরগণ বার বার সুযোগ পাক মুসলিম দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার।তাই পরিকল্পিত ভাবে কলংকিত করা হয়েছে সিরাজুদ্দৌলার চরিত্র;সে সাথে ইতিহাস থেকে আড়াল করা হয়েছে ক্লাইভের দুর্বৃত্তিকে।তবে সিরাজুদ্দৌলাকে হত্যাযোগ্য প্রমাণিত করার জন্য তাঁর চরিত্রহনন ইংরেজদের কাছে প্রয়োজনীয়ও ছিল।

প্রতিটি পরাজয়ে যেমন শত্রুপক্ষ থাকে, তেমনি শত্রুপক্ষের সাথে সহচর রূপে বিশ্বাসঘাতকও থাকে। সেটি যেমন ১৭৫৭ সালের পলাশীতে ছিল, তেমনি একাত্তরেও ছিল। একাত্তরের শত্রু তো তারাই যারা ১৯৪৭’য়ে বাঙালী মুসলিমের স্বাধীনতার শত্রু ছিল; এবং এখনো স্বাধীনতার শত্রু। এরাই বাঙালী মুসলিমের স্বাধীনতার ভবিষ্যতের শত্রু। একাত্তরে ভারতীয় বাহিনীর হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ায় বিশ্বাসঘাতকগণ কলংকিত হওয়া থেকে বেঁচে গেছে। বরং কলংকিত হয়েছে তারা যারা ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতার চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের অনেকেরই ফাঁসীতে ঝুলানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। তাই পলাশীর বিজয়ী পক্ষের ন্যায় একাত্তরের বিজয়ী পক্ষটিও চায় না, একাত্তরের ইতিহাস থেকে বাঙালী মুসলিমগণ শিক্ষা নিক। চায় না, মীর জাফরদের প্রকৃত চেহারা জনগণের সামনে উন্মোচিত হোক। তাই পরিকল্পিত ভাবে চলছে ইতিহাস বিকৃতির কাজ। ইতিহাসের নামে রটনা করা হচ্ছে মিথ্যা কিসসা কাহিনী। লক্ষ্য, একাত্তরের অপরাধীদের আসল চেহারাকে গোপন করা এবং তাদেরকে মহান ব্যক্তি রূপে খাড়া করা। দায়িত্ব তাই শুধু এ অপরাধীদের হাত থেকে দেশ বাঁচানো নয়, ইতিহাস বাঁচানোও। কারণ ইতিহাস না বাঁচালে ইতিহাসের মহামূল্যবান শিক্ষাও বাঁচবে না। তাতে বাঙালী মুসলিমের জীবনে বার বার আসবে পলাশী ও একাত্তর। তখন পালে পালে সৃষ্টি হবে মীর জাফর। এবং বাড়বে শত্রুশক্তির অধিকৃতি। এতে বিপন্ন হবে মুসলিম রূপে বাঁচা ও বেড়ে উঠা। আর মুসলিম রূপে বেড়ে উঠতে ব্যর্থ হলে অনন্ত অসীম পরকালীন জীবনেও কি কোন কল্যাণ জুটবে? মুসলিম ভূমি ইসলামের বিপক্ষ শক্তির হাতে অধিকৃত হওয়ার বিপদ তো এ জন্যই ভয়াবহ। এজন্যই সে অধিকৃতি ঠেকাতে মুসলিম দেশের সীমান্তে সামান্য সময়ের পাহারাদানকে নবীজী (সাঃ) সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম বলেছেন।শত্রু শক্তির অধিকৃতির সে বিপদটি স্রেফ ইহকালীন নয়,ভয়ানক বিপদ বাড়ায় আখেরাতেও। একাত্তরে তেমনি এক ভয়াবহ বিপদ বাঙালী মুসলিমদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। তবে সেটি বুঝার জন্য জরুরী হলো একাত্তরের সঠিক ইতিহাস পাঠ। তবে ইতিহাস পাঠ থেকে শিক্ষালাভের জন্য চাই কোরআনী জ্ঞানসমৃদ্ধ মন;ওহীর জ্ঞানশূণ্য সেক্যুলার মন নিয়ে তা থেকে শিক্ষালাভ অসম্ভব।কারণ মন যা জানে না, চোখও তা দেখতে পায় না। অজ্ঞ ব্যক্তির জ্ঞানের ভাণ্ডারে এজন্যই কিছুই যোগ হয় না। তাই দেখার সামর্থ্যের জন্য চাই মনের সামর্থ্য।এবং মনের সামর্থ্য বৃদ্ধির সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল কোরআনী জ্ঞান। নইলে পশুপাখি,গাছপালা, চন্দ্র-সূর্য্য, পাহাড়-পর্বতের ন্যায় অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে বসবাস করেও স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস জন্মে না।ফলে হিদায়েতও জুটে না। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কোরআনী জ্ঞানের প্লাবন আসার কারণেই মুসলিম জাহানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপ্লব এসেছিল। এবং বিপুল সংখ্যায় বেড়েছিল হিদায়েতপ্রাপ্ত মানুষ। কিন্তু মনের সে সামর্থ্য বাড়ানোর আয়োজন বাংলাদেশে কতটুকু? বরং বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা তো উল্টো –সেটি কোরআনী জ্ঞান থেকে দূরে সরানোর কাজ। ফলে বিপুল সংখ্যায় বাড়ছে অজ্ঞ ও পথভ্রষ্ট মানুষ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *