অধ্যায় পনেরো: ঘরের শত্রুর নাশকতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 29, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
বিষাক্ত রাজনীতি
আওয়াম লীগের অনেক নেতা পাকিস্তানকে তার প্রতিষ্ঠা থেকেই মেনে নিতে পারেননি। যদিও তারা একসময় মুসলিমের লীগের নেতা ছিলেন, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন এবং মন্ত্রীরূপে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও সংহতি রক্ষায় পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে মহান আল্লাহতায়ালার নামে কসম খেয়েছেন। পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে তাদের মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল, বিষাক্ত বিষও ছিল। তারা বিশ্বাস করতেন, পাকিস্তান হলো ১৯৪০ সালের গৃহীত লাহোর প্রস্তাবের সাথে গাদ্দারীর ফসল। এ ধরণের নেতাদের বিষপূর্ণ মনের পরিচয় পাওয়া যায় এ গ্রুপের প্রধান বুদ্ধিজীবী জনাব আবুল মনসুর আহমদের লেখায়। তিনি লিখেছেনঃ “মুসলিম লীগ ৪৬ সালে নির্বাচনে ৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের উপর ভোট নিয়া নির্বাচনে জিতিবার পরে গুরুতর ওয়াদা খেলাফ করিলেনঃ লাহোর প্রস্তাবে বর্ণিত পূর্ব-পশ্চিমে দুই মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের বদলে পশ্চিম-ভিত্তিক এক পাকিস্তান বানাইলেন।”-(আবুল মনসুর আহম্মদ, ১৯৮৯)। অর্থাৎ তার মতে অতি অপরাধ হয়েছে অখণ্ড এক বৃহৎ পাকিস্তান বানিয়ে। পাকিস্তানকে বলেছেন পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক পাকিস্তান। এসব কথা তারা প্রকাশ্যে বলতেন এবং বইয়ের পাতায় লিখতেন। তাদের মনের গভীরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের বিষ যে কত গভীর ছিল তা এ থেকেই অনুমেয়।
পাকিস্তান-এর প্রতি এরূপ গভীর ক্ষোভ নিয়ে কেঊ কি সে দেশের মঙ্গল করতে পারে? অথচ জনাব আবুল মনসুর আহম্মদ নিজে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী হয়েছেন। কথা হলো, তাদের মত ব্যক্তিবর্গ যে মন্ত্রী হয়েছেন সেটি কি নিছক ক্ষমতার মোহে ও আখের গুছানোর তাগিদে? এটা ঠিক, লাহোর প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার পাকিস্তান ভুক্তির কথা ছিল না। কিন্তু তিনি নিজের মতটা প্রমাণ করার তাগিদে ইচ্ছা করেই আরেকটি ঐতিহাসিক সত্যকে গোপন করেছেন। সে সত্যটি হলো, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানভুক্ত করা হয় অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের মুসলিম সদস্যদের ভোটে। কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহ বা অন্য কোন অবাঙালী নেতা বাঙালী মুসলমানদের উপর সে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি। পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক পাকিস্তান বানানো লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রও হয় নাই। সিদ্ধান্তটি নেয়া হয় ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের দিল্লি সম্মেলনে। সেখানে বাংলার পাকিস্তান ভুক্তির পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দী এবং সে প্রস্তাবটি বিপুল ভোটে গৃহীত হয়। আবুল মনসুর আহম্মদের সে বিষয়টি জানা থাকার কথা। তাছাড়া জনাব সোহরাওয়ার্দী নিজেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি জনাব মনসুর আহম্মদের নেতাও ছিলেন।
তবে আবুল মনসুর আহমদের মত বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের চেতনায় মূল রোগটি হলো, তারা ইসলামের পুণর্জাগরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। তারা চাইতেন না,মুসলিমগণ আবার বিশ্বশক্তি রূপে তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাক। আর সে বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেতে হলে তো বৃহৎ ভূগোল চাই। অথচ বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের চেতনার ক্ষুদ্র ভূবনে বাঙালী ছাড়া অন্যভাষী মুসলিমের স্থান ছিল না। তাই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে বিশ্বের মানচিত্রে যেভাবে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হলো তাতে খুশি হতে পারেনি। বরং প্রচণ্ড বিষণ্ণ হয়েছেন এ জন্য যে, মুসলিম লীগের দিল্লি সম্মেলনে কেন লাহোর প্রস্তাবে সংশোধনী আনা হলো। মনের ক্ষেদে সে সিদ্ধান্তের কথাটি আবুল মনসুর আহমদ ইচ্ছা করেই ভূলে গেছেন। পাকিস্তানের বড্ড বদ নসিব যে এমন ক্ষুদ্র ও সীমিত চেতনার মানুষগুলো পাকিস্তানে নেতা ও মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। এরাই ছিল পাকিস্তানের ঘরের শত্রু। জনগণের ভূল হলো, তারা লুকিয়ে থাকা এসব ঘরের শত্রুদের চিনতে ভূল করেছে।
চেতনায় ইসলামশূণ্যতা
পাকিস্তানের সংহতিতে বিশ্বাসের জন্য যেটি অপরিহার্য ছিল সেটি হলো প্যান-ইসলামীক চেতনা। মনের ভুবনটি এমন চেতনায় সমৃদ্ধ না হলে তার কাছে অপর ভাষা ও অপর দেশের মুসলমান নিতান্তই বিদেশী গণ্য হয়। অনেক সময় শত্রুও মনে হয় –যেমনটি বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের ক্ষেত্রে ঘটেছে। অথচ একজন মুসলিম অন্য এক মুসলিম ভাইকে মনে করবে সেটিই মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ঈমানদারকে সেভাবেই চিত্রিত করেছেন। এরূপ চেতনাতেই পৃথিবীর বুকে নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মুসলিমদের মাঝে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় মজবুত দেয়াল সৃষ্টি হয়। এ চেতনা নিয়েই তারা একত্রে রাষ্ট্র নির্মাণ করে, রাজনীতি করে এবং প্রয়োজনে শত্রুর বিরুদ্ধে একত্রে যুদ্ধও করে। মুসলিম উম্মাহ মাঝে এমন একতা মহান আল্লাহতায়ালার কাছে যে কতটা প্রিয় সেটির ঘোষণা এসেছে পবিত্র কোরআনে এভাবেঃ “ইন্নাল্লাহা ইউহিব্বুল্লাযীনা ইউকাতিলুনা ফি সাবিলিল্লাহি সাফফান কা আন্নাহুম বুনিয়ানুন মারসুস”। অর্থঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা সে সব লোকদের ভালবাসেন যারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে সীসা ঢাকা দেয়ালের ন্যায় অটুট একতা নিয়ে।”
তাই কোন মুসলিমকে ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন বর্ণ ও ভিন্ন এলাকার মুসলিমদের সাথে স্রেফ জায়নামাজে একত্রে দাঁড়ালে চলে না, তাকে রাজনীতি ও জিহাদের ময়দানেও একই জামাতে লড়াই করতে হয়। এটিই মুসলিমের ঈমানদারী। আরব, তুর্কী, কুর্দী, মিশরী, মুর, ইরানী শত শত বছর যে ভূগোলের আওতায় বসবাস করলো এবং একই রণাঙ্গণে জিহাদ করলো -তা তো সে শিক্ষার কারণেই। এটিই প্যান-ইসলামীক চেতনা। মুসলিমের ঈমান থেকে এ চেতনাকে কখনোই পৃথক করা যায় না। যখনই মুসলিম উম্মাহ সে চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তখনই এসেছে ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল-ভিত্তিক বিচ্ছিন্নতা, সংঘাত ও বিভক্তি। এবং বিভক্তি ও সংঘাত কখনোই একাকী আসে না। সাথে আনে লাগাতর পরাজয়, অধিকৃতি ও অপমান। আজকের বাংলাদেশ এবং সে সাথে বিভক্ত মুসলিম বিশ্ব তো সে পরাজয় ও অপমানেরই সাক্ষী।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই আওয়ামী লীগ গঠিত হয়েছিল এমন লোকদের দিয়ে যাদের অধিকাংশই ছিল আবুল মনসুর আহমদের ন্যায় সেক্যুলার চেতনার। তাদের কেউবা জাতীয়তাবাদী, কেউবা বামপন্থী, কেউবা সোসালিস্ট, কেউবা হিন্দু এবং কেউবা নাস্তিক। দলটির মুসলিম সদস্যদের অধিকাংশই ছিলেন ইসলামী জ্ঞানে অজ্ঞ। সেক্যুলারিস্টদের কাছে প্যান-ইসলামী তথা বিশ্ব-মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনাটি হলো সাম্প্রদায়িকতা। তাদের দৃষ্টিতে সামাজিক বা রাজনৈতিক বন্ধন গড়ার ভিত্তিটি হবে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল বা সামাজিক শ্রেণীভেদ –এবং কখনোই ইসলাম নয়। ফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে প্যান-ইসলামী তথা বিশ্ব-মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনাটি ঘৃনীত, নিষিদ্ধ ও বর্জনীয় গণ্য হয়। ফলে দেশে ইসলামী চেতনার প্রসারের বিরুদ্ধে তারা এতটা আপোষহীন ও প্রতিহিংসা পরায়ন। শেখ মুজিব তাই ক্ষমতায় আসা মাত্রই ইসলামী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করেন। মুজিব-কণ্যা হাসিনাও সে পথে চলেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় ভোটপ্রাপ্তি এবং সে সাথে ক্ষমতালাভ। সেটি পাকিস্তানের অস্তিত্ব বা মুসলিম স্বার্থের সাথে প্রতারণা করে হলেও। এমন একটি লক্ষ্য সামনে রেখেই তারা আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি কেটে দেয়। দলের নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা অমুসলিম, কম্যুনিস্ট, সোসালিস্ট, নাস্তিক ও অন্যান্য ইসলামবিরোধীদের কাছে স্পষ্টতর করে দেয়, ইসলামী চেতনা বা মুসলিম স্বার্থের প্রতি তাদের কোন অঙ্গীকার নেই। এতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান,মুনাফিক ও নাস্তিকদের ভোট পাওয়ার পথটি পরিষ্কার হয়ে যায়।
রাজনীতিতে ভারতমুখীতা
ক্ষমতার মোহে আওয়ামী লীগ শুধু হিন্দু ভোটের দিকেই শুধু ঝুঁকেনি, ঝুঁকেছে হিন্দুস্থানের দিকেও। হিন্দু ভোটপ্রাপ্তির জন্য ভারতমুখীতা অপরিহার্যও ছিল। কারণ হিন্দুগণ পাকিস্তানের রাজনীতিতে কাদের ভোট দিবে সেটি নির্ধারিত হত দিল্লি থেকে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে নয়। কারণ, তাদের কান আকাশবানীর দিকে। ক্ষমতার মোহ এভাবেই আওয়ামী লীগের নীতিতে লাগাতর পরিবর্তন আনে এবং দলটিকে পুরাপুরি দিল্লিমুখি করে। অপরদিক পরিকল্পিত ভাবেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ ঘৃণা সৃষ্টি করে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা ও জনগণের বিরুদ্ধে। কারণ হিন্দুদের ভোট ও হিন্দুস্থানের সাহায্য পাওয়ার জন্য এটিও জরুরী ছিল। প্রবাদ আছে, হিন্দুগণ মুসলিম হলে শুরুতে বেশী বেশী গরুর গোস্ত খায়। তেমনি মুজিবের ন্যায় যেসব নেতাকর্মী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয় তারাও বেশী ভারত বন্দনায় লিপ্ত হয়। ভারতের নেতানেত্রী, ভারতের ছায়াছবি, ভারতের বুদ্ধিজীবী, ভারতের বইপুস্তক -সবই তাদের আছে প্রশংসার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তবে মুজিবের জন্য সেটি বেশী জরুরী ছিল। কারণ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গিরূপে ১৯৪৬’য়ে কলকাতায় তার ভূমিকা ভারতীয়দের কাছে অজানা ছিল না। ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে মুজিব ও তার অনুসারিগণ এরূপ ভারত বন্দনা তাই বেশী বেশীই করেছে। তাদের কাছে যা কিছু পাকিস্তানী তাই ঘৃনার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের গোপন ঘরোয়া মিটিংগুলোতেই শুধু নয়, আওয়ামী লীগের নেতা ও বুদ্ধিজীবীগণ পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সে ঘৃণা প্রকাশ করতেন নিজেদের লেখনীতে। নিজেদের লেখনীতে বা বক্তৃতায় পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে “পশ্চিমা” বলে উল্লেখ করতেন। এভাবে প্রকাশ পেত তাদের মনে লুকানো বিষপূর্ণ ঘৃণা। এটি যে সাধারণ কর্মীদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, তাতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাগণও।
আওয়ামী লীগ শিবিরে বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানের গুরু ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। এমন ঘৃণা অহরহ প্রকাশ পেত তার লেখনিতে। অথচ মুসলিম হিসাবে অপর মুসলিমকে -তা যে ভাষা, যে বর্ণ বা যে ভূগোলেরই হোক তাকে “ভাই” বলে সম্বোধন করা শুধু ইসলামী আদবই নয়, ঈমানী দায়বদ্ধতাও। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে মুসলিমদের একে অপরের ভাই রূপে চিত্রিত করেছেন। সে ভাইয়ের উপহাস করাকে হারাম করেছেন এবং হারাম করেছেন এমন নামে ডাকা -যা তার নিজের কাছে অপছন্দনীয়। (সুরা হুজরাত, আয়াত ১১। ফলে মহান আল্লাহতায়ালার উপর যার সামান্যতম ঈমান আছে সে কি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রতি অবজ্ঞা বা উপহাস করতে পারে? ঈমানদার ব্যক্তির মাঝে তার মুসলিম ভাইটির প্রতি সম্মানজনক সম্বোধনের আদব শুধু তার সংস্কৃতি নয়, ঈমানের পরিচয়ও। কিন্তু ইসলামী চেতনাশূণ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ সে আদবটুকুও দেখাতে পারেননি। আবুল মনসুর আহমেদের নিজের লেখা “আমাদের দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর”য়ে এমন ঘৃণাবোধের প্রকাশ ঘটেছে অসংখ্য বার। আওয়ামী লীগ কর্মীরা অবাঙালীদের অহরহই “ছাতু” বলতো, আর আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন “পশ্চিমা”। এটিই হলো স্বভাবসুলভ আওয়ামী শালীনতা বা ভদ্রতা! কিন্তু সেরূপ ঘৃনা তারা ভারতীয় অবাঙালীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ করেননি।
ইংল্যান্ডে কালো ব্যক্তিকে কালো বা নিগার বলা ফৌজদারী অপরাধ। এটি চিত্রিত হয় রেসিজম বা বর্ণবাদ রূপে। কোন মন্ত্রী কালোদের বিরুদ্ধে এরূপ শব্দের প্রয়োগ করলে তার মন্ত্রীত্ব থাকে না। ইসলাম এরূপ বর্ণবাদকে হারাম ও অপরাধ ঘোষণা দিয়ে চৌদ্দ শত বছর আগেই। ছাতু বলা বা পশ্চিমা বলাতে কি কোন পশ্চিম পাকিস্তানী খুশি হতে পারেন? অথচ অওয়ামী-বাকশালী নেতা-কর্মীগণ অবাঙালীদের বিরুদ্ধে এরূপ ঘৃণাকে শুধু মুখের কথা,দলীয় অফিস বা কেতাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, সে তীব্র ঘৃণাকে অবাঙালীদের জানমালের উপরও প্রয়োগ করেছে। এ লক্ষ্যে তারা আদমজী জুট মিলে অবাঙালী নিধনে দাঙ্গা বাধিয়েছে। দাঙ্গা বাধায় সাধারণতঃ দুর্বৃত্ত প্রকৃতির অপরাধীরা। কোন রাজনৈতিক দল ও তার নেতারা সেটি ভাবতেও পারে না। কারণ,রাজনীতি তো মানব কল্যাণের ব্রত। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাজনীতিকেও দাঙ্গা, সন্ত্রাস ও ঘৃণা ছড়ানোর হাতিয়ারে পরিণত করেছিল। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙালীদের পুঁজি বিনিয়োগের পথ তারা বন্ধ করে দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানী বিনিয়োগকারীগণ তখন বুঝতে পারে, যে দেশে তাদের জান ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নেই -সেদেশে তাদের পুঁজি নিরাপত্তা পাবে কি করে? ফলে যে দেশটি দ্রুত শিল্পোন্নয়নে সমগ্র তৃতীয় বিশ্বে রেকর্ড গড়ছিল, পরিকল্পিত ভাবে সেখানে স্থবিরতা আনা হলো। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ৬০’য়ের দশকে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শিল্পোন্নয়নের উপর একটি প্রচ্ছদ-নিবন্ধ ছেপেছিল। সে নিবন্ধে দুইটি দেশকে তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নমুখী দেশ রূপে চিহ্নিত করেছিল। দেশ দু’টির একটি হলো কোরিয়া এবং অপরটি পাকিস্তান। যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পাকিস্তান সে অগ্রগতির ধারা ধরে রাখতে পারিনি, কিন্তু কোরিয়া এগিয়ে গেছে। ভারত কখনোই পাকিস্তানের এরূপ দ্রুত শিল্পোন্নয়ন চায়নি। কারণ শিল্পোন্নয়ন হলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিও বাড়ে। পাকিস্তানের জন্ম থেকেই যারা দেশটির বিনাশে আগ্রহী তারা কি শিল্পোন্নয়ন সহ্য করতে পারে? ফলে পাকিস্তানের শিল্পধ্বংসে ভারত তার বিশ্বস্থ্ ট্রোজান হর্সদের ময়দানে নামিয়ে দেয়।ফলে অবাঙালী-বিরোধী দাঙ্গার নামে দেশের শিল্প ও অর্থনীতি বিনাশে যুদ্ধ শুরু হয়।সেটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিলে। পাটজাত দ্রব্যের আন্তর্জাতিক বাজারে পাকিস্তানই ছিল ভারতের মূল প্রতিদ্বন্দি। তাই নিশ্চিত বলা যায়, ভারত ও তার ট্রোজান হর্সগণ যুদ্ধের ক্ষেত্র নির্বচনে ভূল করেনি।
রাজনীতিতে আত্মঘাত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মঘাতের ইতিহাসটি বহু পুরানো।সেটির শুরু মীর জাফরের আমল থেকেই।সে আত্মঘাতই বাংলার রাজনীতিতে বার বার ফিরে এসেছে।একাত্তরের পর দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে শেখ মুজিব ভারতের জন্য প্রতিযোগিতামুক্ত নিরাপদ বাজার সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে পাটশিল্পের আন্তর্জাতিক বাজারটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানী পাটের। কিন্তু মুজিব আমলে সেটিকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়। দেশী শিল্প ধ্বংসের কাজটি বাঙালী সেক্যুলারিস্টগন শুরু করেছিল পাকিস্তান আমল থেকেই। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২০ বছরের মধ্যে বাঙালী মুসলিমদের মাঝে প্রশাসন,অর্থনীতি,শিক্ষাদীক্ষা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অধীক অগ্রগতি সাধিত হয়।ভারতের পশ্চিম বাংলার চেয়ে তা ছিল তূলনামূলক ভাবে অনেক বেশী। কিন্তু সে উন্নয়নের সাথে বাঙালীদের মাঝে অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রত্যাশা।সে প্রত্যাশা পূরণ করার সহজ পথ সামনে ছিল না,আর তাতে বৃদ্ধি পায় অধৈর্য্যশীল বাঙালীর মাঝে দ্রুত রাজনৈতিক অস্থিরতা।সে অস্থিরতার কারণে অবস্থা এমন দাঁড়ায়,নিজেদের যে কোন দুরাবস্থার জন্য তারা পশ্চিম পাকিস্তানকে দায়ী করা শুরু করে।
দেশবিভাগের পূর্বে ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনে বেশ কিছূ অভিজ্ঞ মুসলিম প্রশাসক,অর্থনীতিবিদ ও শিল্পপতি ছিল। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই ছিলেন অবাঙালী। ব্রিটিশ প্রশাসনের বাইরেও অনেকে ছিলেন হায়দারাবাদের নিজাম,ভূপালের রানী ও অন্যান্য ভারতীয় মুসলিম অঙ্গরাজ্যের অভিজ্ঞ প্রশাসনিক কর্মচারি।কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী রাজনীতিবিদ ও কর্মচারিগণ চাইতো না,তাদের অফিস আদালত ও প্রশাসনে ভারত থেকে আসা এসব অবাঙালীগণ নিয়োগ পাক।ফলে তাদের বেশীর ভাগই পশ্চিম পাকিস্তানে বসতি স্থাপন করে,এতে সে এলাকায় দক্ষ জনশক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।বাঙালীদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয় পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পকলকারখানায় অবাঙালীদের শ্রমিক রূপে কাজ করার বিরুদ্ধেও।এরূপ বর্ণবাদী ঘৃনা পশ্চিম পাকিস্তানের কোন শিল্প এলাকায় কখনোই দেখা দেয়নি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে অবাঙালী ব্যবসায়ী ও পুঁজি বিনিয়োগকারিগণ চিত্রিত হন লুটেরা রূপে।লক্ষণীয় হলো,বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যেসব কোরিয়ান,জাপানী ও ইউরোপীয়গণ বাংলাদেশে শিল্পকারখানা স্থাপন করেছে এবং সেসব কারখানা থেকে শত শত কোটি ডলার উপার্জন করে নিচ্ছে।নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় কোম্পানীগুলোও। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ এরূপ ঘৃণা ছড়ায় না।তাদের ঘৃণাটি ছিল শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে।কারণ,ভারত সেটিই চাইতো।অথচ পাঞ্জাব,সিন্ধু,বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে সেরূপ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ঘৃণা ও অস্থিরতা দেখা দেয়নি।ফলে পুঁজি নিরাপত্ত পায় পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে;এতে শিল্পোন্নয়নের ধারা সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের তূলনায় বেগবান হয়।পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব থেকেই পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম এ দুইটি অংশের মাঝে যে বিশাল বৈষম্য ছিল,সেটি ১৯৪৭ সাল থেকে কমতে শুরু করেছিল।কারণ পূর্ব পাকিস্তানেও বিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।কিন্তু আওয়ামী লীগের বর্ণবাদী ও আত্মঘাতি নীতিতে যখন বিভিন্ন শিল্প এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ ও দাঙ্গা শুরু হয়,সে বৈষম্য আবার বৃদ্ধি পেতে থাকে।
অর্থনীতিতে শুধু পুঁজির জোগান হলেই উন্নয়ন হয় না।সে জন্য অপরিহার্য হলো সামাজিক পুঁজি।সে সামাজিক পুঁজিটি হলো রাজনৈতিক অঙ্গণে দায়িত্বশীল নেতৃত্ব,স্থিতিশীলতা ও শিষ্ঠাচার,এবং সে সাথে সামাজিক শৃঙ্খলা,জনগণের মাঝে ভাতৃত্ববোধ,ন্যায়পরায়ণতা ও শ্রদ্ধাবোধ।চাই শ্রমিকের কর্মকুশলতা,সততা ও দায়িত্বশীলতা। জনগণের মাঝে ঘৃণা,সন্ত্রাস,চাঁদাবাজি বা দাঙ্গার কালচার প্রসার পেলে সে সামাজিক পুঁজিটি ত্বরিৎ বিলুপ্ত হয়।এভাবে সামাজিক পুঁজি বিলুপ্ত হলে সে দেশ থেকে পুঁজি ও বিনিয়োগকারিগণ দ্রুত পলায়ন শুরু করে।তখন বাধাগ্রস্ত হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন।ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে পূর্ব পাকিস্তানে মূলত সেটিই ঘটেছিল।আর তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।এবং তাদের সাথে যোগ দেয় উগ্র বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নিস্টগণ।এরূপ পরিস্থিতির কারণে অবাঙালী প্রশাসকদের মনে ধারণা জন্মে,অনভিজ্ঞ পূর্ব পাকিস্তানীরা নিজেরা কোন কিছু করতে না পারলে অন্যরা এসে সেটি করে দিক -সেটিও তারা চায় না।
প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্বের বিরুদ্ধে বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের মন-মগজ যে কতটা বিষর্পূণ তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক। তখন ইয়াহিয়া খানের আমল। পাকিস্তান সরকারের নীতি নির্ধারকগণ অবশেষে উপলদ্ধি করেন, যে প্যান-ইসলামী চেতনার ভিত্তিতে উপমহাদেশের বাঙালী, বিহারী, গুজরাতি, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান ও অন্যান্য ভাষাভাষি মুসলিমগণ যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল -সে চেতনাটিই দ্রুত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে বড় বিপদ এখানেই। প্যান-ইসলামী চেতনার অভাবে ভয়ানক শত্রু বেড়ে উঠছে নিজ ঘরেই। পূর্ববর্তী সরকারগুলোতে যারা ছিলেন তাদের অধিকাংশ ছিলেন মনে প্রাণে সেক্যুলার। তারা এসেছিলেন দেশের র্যাডিক্যাল সেক্যুলার ইনস্টিটিউশনগুলি থেকে। সেগুলি হলো ব্রিটিশের গড়া সেনাবাহিনী, সরকারি প্রশাসন ও জুডিশিয়ারি। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইসলামের কোন প্রভাব শুরুতেই ছিল না। ফলে ইসলামী চেতনার বিকাশে এসব সেক্যুলারিস্টগণ কোন কাজই করেনি। ইসলামী চেতনার উপর তাদের নিজেদেরও কোন বিশ্বাস ছিল না। ব্রিটিশগণ ১৯৪৭সালে দেশ ছাড়লেও দেশ অধিকৃত হয় যায় তাদের হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেক্যুলারিস্টদের হাতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও চলছিল ব্রিটিশ প্রণীত সেক্যুলার শিক্ষানীতির উপর। ফল দাঁড়ায়, পাকিস্তানের ন্যায় একটি আদর্শিক রাষ্ট্র তার প্রশাসন ও রাজনীতি চালাতে প্যান-ইসলামীক চেতনাসমৃদ্ধ জনশক্তি পেতে ব্যর্থ হয়।
পাকিস্তানের ঘরের দরজায় যখন ভয়ানক বিপদ, দেশটি তখন দু’টুকরো হওয়ার পথে। তখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত কিছু ব্যক্তি অনুধাবন করেন, দেশের মূল রোগটি শিক্ষা ব্যবস্থায়। দেশের চলমান শিক্ষা-ব্যবস্থা ও তার পাঠ্যবই ছাত্রদের মনে ইসলামী চেতনার সৃষ্টি বা বৃদ্ধিতে কোন পুষ্টিই জোগাচ্ছে না। বরং উল্টোটি করছে। ইতিমধ্যে দেশ ছেয়ে গেছে ভারতীয়, রুশ ও চীনা বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকায়। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত ঘিরে ভারত বসিয়েছে অনেকগুলি শক্তিশালী রেডিও সম্প্রচারকেন্দ্র। এ্যায়ার মার্শাল নূর খান তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। নতুন প্রজন্ম যাতে ইসলামী চেতনা ও পাকিস্তানের ইতিহাস নিয়ে সম্যক ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠে সে লক্ষ্যে তিনি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। দেশের ইতিহাস নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে সরকার স্কুলের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করে“পাকিস্তানঃ ইতিহাস ও কৃষ্টি” নামে একটি বই। কিন্তু এতে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ। তাদের দাবী, স্কুলের ছাত্রদেরকে সে বইটি পড়তে দেয়া যাবে না।এর অর্থ দাড়ায়,ছাত্রদের নিজ দেশের ইতিহাস পড়তে দিতেও তাদের আপত্তি। ছাত্র লীগ নূর খান শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক প্রতিবাদ সভা ডাকে। সেখানে প্রধান বক্তা ছিলেন শেখ মুজিবর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি। তিনে বলেন, “নূর খান শিক্ষানীতির লক্ষ্য, এ দেশে প্যান-ইসলামীক চিন্তাধারার বিকাশ। বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনার বিরুদ্ধে এটি এক গভীর ষড়যন্ত্র। তাই ছাত্র লীগ এ শিক্ষানীতি মেনে নিবে না। এ শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে আমাদের দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।” (লেখক সে মিটিংয়ে শ্রোতা রূপে উপস্থিত ছিলেন)।
ফ্যাসিবাদীর মুখে ইসলাম
উগ্র জাতীয়তাবাদেরই অপর নাম ফ্যাসীবাদ। সংযুক্ত পাকিস্তানের শেষের দিন গুলোতে উগ্র বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের সন্ত্রাস শুরু হয় দেশের ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে। ফ্যাসীবাদীদের পক্ষ থেকে শুধু যে রাজনৈতিক সভাসমিতেই হামলা হয়েছিল তা নয়, হামলা হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানেও। কারণ, তাদের ধারণা, প্যান-ইসলামী চেতনা আর জাতীয়তাবাদী চেতনা এক সাথে চলতে পারে না। তাদের ভয়, প্যান-ইসলামী চেতনা প্রবলতর হলে বাঙালী জাতীয়তাবাদ বিলুপ্ত হবে। ফলে তারা রাজী ছিল না ইসলামী চেতনাধারীদের অস্তিত্বকে সহ্য করতে। তাদের নির্মূলে ফ্যাসীবাদী সন্ত্রাসীগণ অস্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে। সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে প্যান-ইসলামী চেতনার ধারকদের বিরুদ্ধে। ছাত্র লীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন সম্মিলিত ভাবে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছে নূর খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে। দুইটি ছাত্র সংগঠনেরই অভিন্ন অভিযোগ, এ শিক্ষানীতি ছাত্রদের মাঝে ইসলামী আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার বাড়াতে চায়। অভিযোগ, এটি বাঙালীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। অতএব সিদ্ধান্ত নেয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তা হতে দেয়া যাবে না। বাঙালী সেক্যুলার মহলটি এভাবে জানিয়ে দেয়, পাকিস্তানের জন্মের ইতিহাস জানায় তাদের সামান্যতম আগ্রহ নাই। সে বছরই (১৯৬৯ সালে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রের পক্ষ থেকে (টিএসসি) নূর খান শিক্ষানীতির উপর আলোচনা সভার আয়োজন হয়। সেখানে ছাত্র লীগ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ আরো অনেক ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররা নিজ নিজ অভিমত তুলে ধরে। নিজ মত তুলে ধরেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জনাব আব্দুল মালেকও। তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা শহর শাখার সভাপতি। তার বক্তব্য ছিল, দেশের নতুন শিক্ষা নীতিতে ইসলামী ধ্যান-ধারণায় প্রসারে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে এবং মুসলিম ছাত্রদের প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার কাজে শিক্ষানীতির মাধ্যমে সহায়তা দিতে হবে। কিন্তু তার সে বক্তৃতা শান্তিপূর্ণ ভাবে শেষ করতে দেয়া হয়নি। তাঁর বক্তৃতা চলা কালে চেয়ার ভেঙ্গে হামলা শুরু করে ছাত্র লীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা। জনাব আব্দুল মালেক সে হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে সেখান থেকে প্রস্থান করছিলেন। শুধুমাত্র নিজ মত তুলে ধরার কারণে এই নিরস্ত্র মেধাবী ছাত্রকে সোহরাওয়ার্দী উদ্দানে (সাবেক রেস কোর্স ময়দান) নৃশংস ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সে সময় ঢাকার বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানটি যে কতটা সন্ত্রাস-কবলিত ছিল -এ হলো তার নজির। বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ যে কতটা ফ্যাসিস্ট ও সন্ত্রাসী, সেদিন সে স্বাক্ষর তারা রেখেছিল।
ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসে শুধু যে আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছিল তা নয়, চরম ভাবে আক্রান্ত হয়েছিল দেশের সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী মহল। ফলে এতোবড় একটা হত্যাকাণ্ড দিনদুপুরে সংঘটিত হওয়ার পরও তা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্যুলার বু্দ্ধিজীবী মহলে ও মিডিয়াতে তেমন আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি। ভাবটা এমন, ঢাকাতে যেন কিছুই ঘটেনি এবং তারা কিছুই দেখেনি। অবশেষে ফ্যাসিস্ট পক্ষই বিজয়ী হয়। পাঠ্য তালিকা থেকে সে নতুন বইটিকে সরকার তুলে নিতে বাধ্য হয়। মরণাপন্ন রোগী খাদ্য ও চিকিৎসা গ্রহণেও আগ্রহ হারায়। চেতনার ক্ষেত্রে তেমনই একটি শোচনীয় দুরাবস্থা ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারদের। পাকিস্তান তখনও তাদের দেশ। কিন্তু সেদেশের সৃষ্টি ও কৃষ্টির ইতিহাস জানাটাও তাদের কাছে অপ্রিয় হয়ে পড়েছিল। অথচ এরাই পাকিস্তানের বেতারে ইসলামী দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চার জন্য জিদ ধরেছিল। কথা হলো, নিজ দেশে এতো শত্রু থাকতে সে দেশ ভাঙ্গতে কি বিদেশী শত্রুর প্রয়োজন হয়?
গ্রন্থপঞ্জি
আবুল মনসুর আহম্মদ,১৯৮৯; আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর,পঞ্চম সংস্করণ,সৃজন প্রকাশনী লিমিটেড,করিম চেম্বার ৫ম তলা,৯৯ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা,ঢাকা ১০০০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018