অধ্যায় ৩৩:অধিকৃত ইতিহাস
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 29, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
দখলদারিটি মিথ্যার
বাংলাদেশে অধিকৃত অঙ্গণ শুধু দেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি নয়, বরং ইতিহাসের অঙ্গণ।ইতিহাসের উপর সে অধিকৃতিটি মিথ্যার এবং সেটি প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে একাত্তর থেকে।ফলে নির্ভরযোগ্য কোন ইতিহাসের গ্রন্থ নেই দেশটির নিজ জন্মের। যা আছে তা চরমঅসত্য ও পক্ষপাতদুষ্ট। ইতিহাসের এ অধিকৃত অঙ্গণে তিরিশ লাখ নিহত ও দুই বা তিন লাখ ধর্ষিতার ন্যায় অসংখ্য মিথ্যাকে স্থান দেয়া হয়েছে। এ অধিকৃত অঙ্গণে নিষিদ্ধ হয়েছে সত্যের প্রবেশ।মিথ্যাবৃত্তি পরিণত হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির মূল হাতিয়ারে। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সত্যের প্রবেশ রুখতে সর্বত্র পাহারায় বসানো হয়েছে অস্ত্রধারি রাজনৈতিক ক্যাডারদের।যেমনটি নমরুদ ও ফিরাউন বসিয়েছিল যথাক্রমে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ)র বিরুদ্ধে। বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে প্রবল প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রচণ্ড ফাসিবাদ। মিথ্যাচারীদের সত্যভীতি এতই প্রকট যে,তাদের বিধানে প্রতিষ্ঠিত মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়াটিই দণ্ডনীয় অপরাধ। তিরিশ লাখ নিহতের পক্ষে কোন নির্ভরযোগ্য দলিল নাই, যা আছে তা হলো মুজিবের ন্যায় এক স্বৈরাচারির উক্তি -যা তিনি যুদ্ধকালীন বাংলাদেশকে এক দিনের জন্য না দেখেই বলেছিলেন।সে ৯টি মাস তার অবস্থান ছিল হাজার মাইল দূরের পাকিস্তানে। অথচ এ মিথ্যার বিরুদ্ধে কথা বললে আদালতের সমন জারি হয়। একাত্তরের ডিসেম্বরে ভারতের সামরিক অধিকৃতির পর থেকে ইতিহাস লেখার নামে যা কিছু লেখা বা বলা হয়েছে -তা ভারতসেবীদের প্রতিষ্ঠিত মিথ্যাগুলিকে মেনে নিয়েই।ফলে তিরিশ লাখ নিহত বা দুই/তিন লাখ ধর্ষণের ন্যায় বিশাল মিথ্যার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ উঠেনি। ভারত যে একাত্তর পরবর্তী সামরিক অধিকৃতিকালে দেশের হাজার কোটি কোটি টাকার সম্পদ লুণ্ঠন করলো, মুক্ত বাণিজ্যের নামে দেশের তলা ধ্বসিয়ে দিল, লুণ্ঠনে লুণ্ঠনে উপহার দিল দুর্ভিক্ষ, তুলে নিল পদ্মা, তিস্তার ন্যায় বহু নদীর পানি তার পরও ভারতকে বন্ধু রূপে মান্যতা দেয়াই এ ইতিহাসের ছবক। এরূপ বিশাল বিশাল মিথ্যার প্রহরায় নামানো হয়েছে প্রশাসনের পুলিশ ও আদালতের বিচারকদের।
একাত্তরের ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ সাক্ষী বাংলাদেশের জনগণ। ফলে সঠিক ইতিহাস রচনায় জনগণের দায়বদ্ধতাটি বিশাল। সেটি সত্যের পক্ষে সাক্ষ্যদানে এবং ইতিহাসকে মিথ্যামুক্ত করায়। সত্যের পথই ইসলামের পথ। এটিই একমাত্র শান্তির পথ।মিথ্যার প্রচার ও প্রতিষ্ঠা শয়তানের পথ। মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পণে যা অনিবার্য হয় রক্তাত্ব সংঘাত ও অশান্তি।বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংঘাতের বীজটি তাই মিথ্যাদুষ্ট ইতিহাসে।এ অসত্য ইতিহাসের পাঠ জারি থাকলে দেশের রাজনীতিতে দিন দিন শুধু নাশকতাই বৃদ্ধি পাবে। ইতিহাসে লিপিবব্ধ হয় একটি জনগোষ্ঠির শত শত বছরের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ। সে অভিজ্ঞতা অর্জনে বিপুল অর্থ, শ্রম ও রক্ত ব্যয় হয় –কারণ দেশবাসীকে অনেক সময়ই সামনে এগুতে হয় রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়ে। সে অভিজ্ঞতায় যেমন স্বাধীনতার আনন্দ থাকে,তেমনি পরাধীনতার গভীর বেদনাও থাকে। থাকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিবৃত্ত। থাকে মিথ্যাচারী দুর্বৃত্তদের দুর্বৃত্তির কাহিনী। সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে যে ভয়ানক আযাব নেমে আসে –থাকে তারও বিবরণ। ইতিহাসের অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভ্রান্ত পথে নতুন করে অর্থ, শ্রম ও রক্তব্যয় থেকে বাঁচায়। দেখায় সাফল্যের পথ। ইতিহাসের জ্ঞান যে কত গুরুত্বপূর্ণ -সে শিক্ষাটি দিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালা। পবিত্র কোরআনে মানব জাতির অতীত ইতিহাস থেকে ভয়ংকর বিপদের পথগুলো তিনি বার বার তুলে ধরেছেন।বলা হয়েছে,“তোমাদের পূর্বেও বহু পরিস্থিতি অতিক্রান্ত হয়েছে,অতএব ভ্রমন করো জমিনের উপর এবং দেখো কি পরিণতি হয়েছিল তাদের -যারা মিথ্যাচারি ছিল।”–(সুরা আল-ইমরান ১৩৭)।কিন্তু যারা দেশ ও দেশবাসীর শত্রু -তাদের আচরণটি ভিন্নতর। সত্য ইতিহাস প্রকাশ পেলে তারা নিজেরাই অপরাধী রূপে চিত্রিত হয়। ফলে তারা ইতিহাসের শত্রু। ফলে তারা শুধু ভূমি বা সম্পদের উপর হামলা করে না,হামলা করে ইতিহাসের উপরও। স্রেফ রাজনীতি,সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষা ও অর্থনীতিই শুধু অধিকৃত হয় না, অধিকৃত হয় ইতিহাসও। ফলে বিলুপ্ত হয় দেশবাসীর সম্মিলিত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার, বিলুপ্ত হয় শত্রু-মিত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ধারণাও।
প্রতিটি মানবকে যেমন সফলতা থেকে শিখতে হয়, তেমনি শিখতে হয় ব্যর্থতা থেকেও। এরূপ লাগাতর শিক্ষালাভের মধ্যেই প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি। মিথ্যার আয়োজন তো সত্যকে আড়াল করার লক্ষ্যে, তা অসম্ভব করে ইতিহাস থেকে শিক্ষালাভকে।জনগণের পা তখন একই গর্তে বার বার পড়ে। তাই অর্থভাণ্ডার বা বিজ্ঞানের ভাণ্ডারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ইতিহাস-জ্ঞানের ভাণ্ডার। মহান আল্লাহতায়ালা তাই পবিত্র কোরআনে বিজ্ঞানের জ্ঞান দিয়ে ইতিহাসের জ্ঞান দিয়ে মানুষকে হিদায়েত করেছেন। এখানেই বাংলাদেশের বিশাল ব্যর্থতা। দেশটির ইতিহাসের ভাণ্ডারে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নানারূপ মিথ্যা। ফলে বিপুল ভাবে বাড়ছে জনগণকে অন্ধকারে নিক্ষেপের আয়োজন। শাপ-শকুন, গরু-বাছুড়,মুর্তি বা পাহাড়পর্বতগুলোকে দেবদেবীর আসনে বসাতে হলে বিশাল আকারে মিথ্যাচর্চা চাই। সে মিথ্যাচর্চার জন্য হাজার মন্দির-মন্ডপও চাই।চাই বহু লক্ষ মিথ্যাসেবী পুরোহিত। তেমনি ফিরাউনের ন্যায় স্বৈরাচারি দুর্বৃত্তদের পুঁজনীয় করতে হলে মিথ্যার প্রবল প্লাবন চাই। হাজার হাজার পদসেবী চাটুকারও চাই। তখন চাই সত্যের আলো নিভানোর লাগাতর আয়োজন। বাংলাদেশের ইতিহাসে মিথ্যার প্লাবনটি যে কতটা বিশাল -সেটি বুঝা যায় একাত্তর নিয়ে রচিত গ্রন্থগুলো পড়লে।সে সাথে লাগাতর আয়োজনটি একাত্তর নিয়ে সত্য বিবরণ তুলে ধরার বিরুদ্ধে।
স্বৈরাচারি দুর্বৃত্তদের হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ার বিপদটি তাই ভয়ানক। তখন জনগণের রাজনৈতিক অধিকারই শুধু লুণ্ঠিত হয় না,জনগণকে বঞ্চিত করা হয় ইতিহাসের পাতায় সত্যের পক্ষে সাক্ষ্যদান থেকেও। বাংলাদেশে তাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছ একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে সত্য অনুসন্ধান।একাত্তরে কতজন নিহত হলো -সে তথ্য কেউ সংগ্রহ করুক,সেটি তারা হতে দিতে রাজী নয়।কারণ, তাতে তিরিশ লাখের মিথ্যাটি বাঁচবে না। খুনি, সন্ত্রাসী ও চোর-ডাকাতের ন্যায় মিথ্যাচারী অপরাধীগণও চায় না,তাদের অপরাধগুলি জনসম্মুখে প্রকাশ পাক। চায় না, তাদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের আদালতে কেউ সাক্ষ্য দিক। এজন্যই কঠোর নিয়ন্ত্রন ইতিহাস রচনায়।কবরে পাঠানো হয় মানবাধিকারকে।ইতিহাস রচনায় অতীতেও একই রূপ নিয়ন্ত্রত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ব্রিটিশদের রচিত ইতিহাসে তাই নবাব সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী ও লর্ড ক্লাইভের অপরাধগুলি তুলে ধরা হয়নি। মুসলিম জাতিকে তাদের প্রকৃত বীরদের তারা জানতে দিতে রাজী নয়। এজন্যই ইতিহাসের নামে বিশাল আয়োজন নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে কলংকিত করার। এবং অপরাধী রূপে খাড়া করা হয়েছে শহীদ তিতুমীরের ন্যায় যারাই সে ঔপনিবেশিক অধিকৃতির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তাদের রচিত ইতিহাসে উল্লেখ নাই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নির্মম শোষণ ও শাসনের।ইংরেজ বেনিয়া শোষণের ফলে ১৭৬৯ থেকে ১৭৭৩ সাল অবধি (বাংলা ১১৭৬ সাল থেকে ১১৮০সাল)বাংলার বুকে যে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হলো,যার ফলে প্রায় একতৃতীয়াংশ বঙ্গবাসীর মৃত্যু ঘটলো -সে ইতিহাসের সঠিক বর্ণনা নেই। অথচ এটিই ছিল বাংলার সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা। সুজলা সুফলা বাংলার বুকে এটিই ছিল প্রথম দুর্ভিক্ষ -যার কারণ অতি নিষ্ঠুর ঔপনিবেশিক শোষণ। সাম্রাজ্যবাদীদের রচিত ইতিহাসে বর্ণনা নেই ভারতীয় জনগণের ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের। বর্ণনা নেই, বাংলার মসলিন শিল্পিদের আঙ্গুল কাটা ও কৃষকদের বলপূর্বক নীলচাষে বাধ্য করার।সে ইতিহাসে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ কাল চিত্রিত হয়েছে গৌরবকাল রূপে।ডাকাতদের মুখে ডাকাতির পেশাই সবচেয়ে বীরত্বমূলক,ডাকাত সর্দারই সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।অনুরূপ অবস্থা ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনকারীদের।
একই ভাবে সত্য বিবরণ লুকানো হয়েছে একাত্তরের ইতিহাসে।সেটি করা হয়েছে ইতিহাসে বাকশালী স্বৈরাচারিদের সন্মানজনক স্থান দেয়ার লক্ষ্যে।সে ইতিহাসে ভারতীয় শোষণের বিন্দুমাত্র বর্ণনা নাই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কিভাবে ভারত গেল -সে বিবরণও নাই। বিদেশী সাহায্যের মাঝে দেশটি কীরূপে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলিতে পরিণত হলো -সে বিষয়টিও তুলে ধরা হয়নি। বাংলাদেশী শিল্পকলকারখানাগুলো কিভাবে একের পর বন্ধ হয়ে গেল –ইতিহাসের পাঠ্য বই থেকে সেটি আদৌ জানার উপায়ই নেই। বর্ণনা নেই,১৯৭৪’য়ে দুর্ভিক্ষের। বর্ণনা নাই রক্ষিবাহিনীর বর্বরতার।বিবরণ নাই,কীরূপে বাংলাদেশের উপর ভারত ২৫ সালা দাসচুক্তি চাপিয়ে দিল। নাই আগরতলা ষড়যন্ত্রের খতিয়ান এবং নাই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার ষড়যন্ত্রের সাথে মুজিবের সংশ্লিষ্টতা কথা।অথচ ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা “র”এর ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকাকে বাদ দিয়ে কি বাংলাদেশের জন্মের কথা ভাবা যায়? ভারতীয় “র”এর কর্মকতাগণ এখন সে কথাটি জোরে শোরেই বলছে। এ ইতিহাসে বর্ণনা নাই,মুজিব কীরূপে সংসদীয় গণতন্ত্রকে কয়েক মিনিটের মধ্যে একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচারে পরিণত করলো। অথচ এ বিষয়গুলি বাংলাদেশের ইতিহাসের মামূলী বিষয় নয়। অতিগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলো না জানলে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসই অজানা থেকে যায়।এরূপ বিশাল অপূর্ণাঙ্গতা নিয়েই ভারতসেবী বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের হাতে রচিত হয়েছে একাত্তরের ইতিহাসে।
বিকৃত ইতিহাসের বিপদ
প্রতিদেশের রাজনীতিতেই নানা পক্ষ থাকে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নানারূপ অভিযোগও থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাড়তি যেটি আছে সেটি হলো প্রতিপক্ষ নির্মূলের এজেন্ডা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশের আদালত। সংসদে আইন নির্মিত হচ্ছে সে নির্মূল প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার লক্ষ্যে। ফলে দেশে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও গুমের সাথে বেড়েছে বিচারের নামে হত্যাকাণ্ড। প্রতিপক্ষ নির্মূলের সে রাজনৈতিক এজেন্ডা দখলে নিয়েছে ইতিহাস রচনার ন্যায় এ্যাকাডেমিক বিষয়কেও। ফলে রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণে ইচ্ছাকৃত ভাবে বিকৃত করা হচ্ছে ইতিহাস।এবং সে বিকৃত ইতিহাসকে ব্যবহার করা হচ্ছে কে শত্রু এবং কে মিত্র -সেটি চিহ্নিত করার কাজে। রাজনৈতিক শত্রুদের হত্যার কাজে ইতিহাসের বইয়ের পক্ষপাতদুষ্ট কাহিনীকে আদালতে দলিল রূপে ব্যবহার করছে। স্বৈরাচারি বাকশালীদের নাশকতাটি তাই স্রেফ দেশের প্রশাসন ও রাজনীতির অঙ্গণে সীমিত থাকেনি। সে নাশকতাটি ঘটেছে ইতিহাস পাঠেও। সে লক্ষ্যেই বিলুপ্ত করা হয়েছে বাঙালী মুসলিমদের ১৯৪৭-পূর্ব ঐতিহাস। ১৯৪৭য়ের হিরোদের একাত্তরে নির্মূল করার স্বার্থে সেটি জরুরী মনে করা হয়েছে। যেন বাঙালী মুসলিমের জীবনে স্বাধীনতার শুরু হয়েছে ১৯৭১’য়ে এবং সেটি একমাত্র ভারতীয়দের সামরিক হস্তক্ষেপের বদৌলতে। সে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার লক্ষ্যেই ১৯৪৭’য়ের ঐতিহাসিক মাইল ফলকটিকে ইতিহাস থেকেই গায়েব করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে যে ইতিহাস বিকৃতি -তার পিছনে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। সেটি হলো,ভারত সরকারের প্রতি বাংলাদেশীদের আনুগত্য ও দায়বদ্ধতা বাড়ানো। সে সাথে উদ্দেশ্য,নিজেদের কুৎসিত অপরাধগুলোকে আড়াল করা এবং সে সাথে রাজনীতির ময়দানে তাদের দখলদারিকে অব্যাহত রাখা।১৯৪৭’য়ে যারা উপমহাদেশের মুসলিমদের স্বার্থ ও স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় শত্রু রূপে চিহ্নিত হয়েছিল তারা হলো ভারতীয় বর্ণহিন্দুগণ।ঔপনিবেশিক শাসনের পাশাপাশি জমিদারের বেশে এরা বাঙালী মুসলিমদের ঘাড়ে শোষণ ও নির্যাতনের আরেকটি জোয়াল চাপিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর এরাই ভারতের শাসন ক্ষমতায় বসে। এ আগ্রাসী শক্তিটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর, মুসলিম শাসিত হায়দারাবাদ, গোয়া ও মানভাদাড়কে দখল করে নেয়।পরবর্তীতে সিকিমকেও ভারতভূক্ত করে। তারা অখণ্ড ভারতের অংশ রূপে দখলে নিতে চেয়েছিল বাংলাদেশকেও। বাঙালী মুসলিমদের একার পক্ষে সে বিশাল হিন্দু আগ্রাসনের মোকাবেলা করা অসম্ভব ছিল। বাঙালী মুসলিমগণ তাই অবাঙালী মুসলিমদের সাথে নিয়ে পাকিস্তান গড়ে। সেটিই ছিল বাঙালী মুসলিমদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দূরদর্শিতা। সেটি না হলে আজকের বাংলাদেশ কি বর্তমান মানচিত্র পেত? অথচ বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের রচিত ইতিহাসে বাঙালী মুসলিমের উনিশ শ’ সাতচল্লিশের সে দুরদর্শিতার কোন উল্লেখই নাই। বরং তাদের অনেকে পাকিস্তানের সৃষ্টিকেই অপ্রয়োজনীয় বলে।কারণ,সেটি না বললে তাদের রাজনৈতিক প্রভু দিল্লির শাসকগোষ্ঠি তথা উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সাতচল্লিশের বিজয় ও তাদের পরাজয়ের কাহিনীটিও সামনে এসে যায়। সে সাথে প্রকাশ পায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে বর্ণহিন্দুদের নাশকতার কথা। ফলে তাদের রচিত ইতিহাসের বই থেকে ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতার লড়াইকেই বাদ দিয়েছে। সাতচল্লিশের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা বললে ১৯৭১’য়ের বিচ্ছিন্নতা তো স্বাধীনতা বলা যায় না। ভারতের মর্যাদাও তাতে বাড়ানো যায় না। এটি এক বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক জালিয়াতি। কায়েদে আযমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান সৃষ্টিতে সফল হওয়ায় বর্ণহিন্দুদের আগ্রাসী প্রকল্প ১৯৪৭’য়ে ব্যর্থ হয়। তবে ১৯৪৭’য়ে ব্যর্থ হলেও তারা সফল হয়েছে একাত্তরে ।১৯৭১’য়ে বিজয়ের পর দিল্লির প্রতি অনুগত পক্ষটি ইতিহাসের নতুন পাঠ দেয়া শুরু করে;স্বাধীনতার কে শত্রু আর কে মিত্রের -সে ধারণাটাই পাল্টে দেয়ার কাজ শুরু করে।সে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতাগণ ইতিহাসের বইয়ে স্থান হারান।বাঙালীর একমাত্র স্বাধীনতা রূপে চিত্রিত হয় ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা।এবং স্বাধীনতার শত্রুর আসনে বসানো হয় ইসলামপন্থিদের। এবং বীর রূপে ঘোষিত হয় বাকশালী স্বৈরাচারিগণ।
বাংলাদেশের বুক থেকে ইসলাম ও ইসলামপন্থিদের নির্মূলের স্বার্থে তাদেরকে স্বাধীনতার শত্রু রূপে খাড়া করাটি ভারত ও ভারতসেবী বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের কাছে অতিশয় জরুরী ছিল। কারণ স্বাধীনতার বিরোধীতা করা যে কোন দেশেই বিশাল অপরাধ। তখন বিচারের নামে তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলানোর কাজটি সহজতর হয়।একাত্তরের ইতিহাসে এভাবে মিথ্যাকে সংযুক্ত করা হয়েছে ইসলামপন্থিদের রাজনীতি ও তাদের বেঁচে থাকাকে অসম্ভব করার স্বার্থে। সে মিথ্যাচারটি করতে গিয়ে অতিশয় সাধারণ বিষয়েও তারা ভূল করেছে।একটি দেশের স্বাধীনতা তো অর্জিত হয় পরাধীন অবস্থা থেকে। একটি স্বাধীন দেশ খণ্ডিত হতে পারে, তার দুটি অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হতেও পারে। একাত্তরে তো সেটিই ঘটেছে। বিচ্ছিন্নতার পূর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কি পরাধীন ছিল? বড় জোর বলা যেতে পারে, পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অঙ্গ ছিল। কিন্তু সে বিচ্ছিন্নতার বিরোধীতাকারিদেরকে কি স্বাধীনতার বিরোধী বলা যায়? প্রকৃত স্বাধীনতাটি তো অর্জিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। কারণ তখন ব্রিটিশ শাসনের পরাধীনতা থেকে মুক্তি ঘটে।১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ অবধি মেয়াদকে পূর্ব পাকিস্তানীদের পরাধীনতা বলাটি নিরেট মিথ্যাচার। মিথ্যাচারী হওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় প্রমাণ লাগে কি? বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির সবচেয়ে পুঁজি হলো এই বিরাট মিথ্যাচার। পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দীর বিখ্যাত উক্তিটি কি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ ভূলে গেছে? তিনি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮% স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয়ে গেছে? জনাব সোহরোওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পরাধীন দেশের কি কখনো ৯৮% স্বায়তবশাসন থাকে? আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান কী পঞ্চাশের দশকে পরাধীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন? ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট থেকে পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ রূপে সারা বিশ্বে স্বীকৃত। ১৯৭১’য়ের ১৬ই ডিসেম্বর অবধি একথাও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ছিল যে,পাকিস্তানের সংখ্যগরিষ্ঠ নাগরিক হলো বাঙালী। ফলে একটি স্বাধীন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সে দেশটিতে পরাধীন হয় কি করে? আর পরাধীন না হলে ১৯৭১’য়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয় কি করে?
অধিকৃত ইতিহাসের বিপদ
জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন শাখাতেই মিথ্যাদূষণ চলে না। বিজ্ঞানের সাথে মিথ্যার দূষণ হলে সেটি আর বিজ্ঞান থাকে না। মিথ্যাদূষণে ইতিহাসও আর ইতিহাস থাকে না; কেচ্ছাকাহিনীর বইয়ে পরিণত হয়। একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে বাংলাদেশে সেটিই বিপুল ভাবে হয়েছে। ইতিহাসের দুষিত ভাণ্ডার থেকে শিক্ষালাভের কিছু থাকে না, বরং থাকে পথভ্রষ্ট করার সামগ্রী। তাতে অসম্ভব হয় সভ্য মানুষ রূপে বেড়ে উঠা। মিথ্যাপূর্ণ ইতিহাসের পাঠ তাই যত অধীকই হোক তাতে দেশবাসীর জ্ঞান বা প্রজ্ঞা বাড়ে না,সামনে পথ চলায় সঠিক নির্দেশনাও পায় না। বরং দেশ তখন মিথ্যাচারী,স্বৈরাচারী,সন্ত্রাসী ও নানারূপ দুর্বৃত্ত উৎপাদনে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। দেশ তখন দুর্বৃত্তিতে প্রথম হয়। অতি স্বৈরাচারি দুর্বৃত্তগণও তখন রাজনীতিতে সমর্থণ পায়, এবং দেশের নেতা হওয়ার সুযোগ পায়।
দেশের ইতিহাসে শুধু সাফল্যের বর্ণনাই থাকে না, থাকে ব্যর্থতা এবং সে ব্যর্থতার কারণগুলির বিবরণও।বিজ্ঞানের পরীক্ষানিরীক্ষা হয় ল্যাবরেটরিতে। সে পরীক্ষার ফলাফলটি বিশুদ্ধ ভাবে লিপিবদ্ধ করে পেশ করাই বিজ্ঞানীদের কাজ। আগামী দিনের বিজ্ঞানীরা সে ফলাফল থেকে নতুন গবেষণার খোরাক পায়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এ ভাবেই লাগাতর সামনে এগুয়। কিন্তু মানুষের বিবেক, বিচারশক্তি,দর্শন, মতবাদ ও কাণ্ডজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ল্যাবরেটরিতে হয় না।সেটি হয় রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহের অঙ্গনে। আর সে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল লিপিবদ্ধ হয় ইতিহাসের পাতায়। সেখানে থাকে যেমন ব্যর্থতার কথা, তেমনি সফলতার কথাও। আগামী প্রজন্ম সাফল্যগুলো থেকে যেমন অনুপ্রেরণা পায়,তেমনি ব্যর্থতাগুলো থেকে পায় বাঁচার পথ।মানবসভ্যতা এভাবেই দিন দিন সভ্যতর হয়।বিজ্ঞানের নতুন আবিস্কারের পুরনো আবিস্কার মূল্য হারায়। কিন্তু ইতিহাসের প্রতিটি শিক্ষাই অমূল্য।সেটি কখনোই পুরনো হয় না, গুরুত্বও হারায় না। জান্নাতে হযরত আদম (আঃ) এর নিষিদ্ধ ফল খাওয়া,কাবিলের হাতে তার ভাই হাবিলের হত্যার ঘটনা -আজও তাই ভয়াবহ পরিণাম থেকে বাঁচতে পথ দেখায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার জ্ঞানের চেয়ে ইতিহাসের প্রজ্ঞা তাই অধীক গুরুত্বপূর্ণ।মহান আল্লাহতায়ালা তাই পবিত্র কোরআনে মানব-সৃষ্টির শুরু থেকে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার উদাহরণ বার বার পেশ করেছেন। এসেছে আদ-সামুদ জাতির কাহিনী, এসেছে বনি ইসরাইসহ নানা বিদ্রোহীদের কাহিনীও।কিন্তু সে ইতিহাসকে যখন মিথ্যায় ভরপুর হয়,তখন সে ইতিহাসের পথ দেখানোর সামর্থ্য থাকে না। তা থেকে শিক্ষা নেয়াটি তখন ক্ষতির কারণ হয়।এমন জাতির জীবনে শেখ মুজিবের ন্যায় বাকশালী স্বৈরাচারীয় যেমন বার বার আসে, তেমনি একাত্তরের ন্যায় সংঘাতময় পরিস্থিতিও বার বার সৃষ্টি হয়। এমন জাতি সামনে এগুয় না, বরং একই রূপ সমস্যার আবর্তে লাগাতর ঘুরপাক খায়। তাই দেশবাসীর দায়িত্ব শুধু দেশের সীমান পাহারা দেয়া নয়, পাহারা দিতে হয় দেশের ইতিহাসকেও। নইলে জায়গাজমির ন্যায় ইতিহাসের অঙ্গনও দুর্বৃত্তদের হাতে বার বার অধিকৃত হয়ে যায়। একাত্তরের ইতিহাস তো সে উদাহরণই পেশ করে।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018