অনৈসলামি রাষ্ট্রের অকল্যাণ

কেন এ অকল্যাণ?

দুর্বৃত্ত মানুষ যখন হাতে লাঠি বা চাকু পায় তখনই সে অঘটন ঘটায়। তাদের লক্ষ্য যে শুধু মানুষের ধনসম্পদ লুন্ঠন -তা নয়। তারা তো সমাজ ও রাষ্ট্রে একচ্ছত্র প্রভু হতে চায়। লুন্ঠনের পরিধিকে এভাবে তারা সমগ্র রাষ্ট্রময় করতে চায়। রাষ্ট্র যখন পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত ও প্রশাসনসহ তার প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে এমন দুর্বৃত্তের হাতে অধিকৃত হয় তখন সমগ্র দেশবাসীর জীবনে মহা-অকল্যাণ নেমে আসে। হত্যা,ধর্ষণ, চুরিডাকাতির ন্যায় নানারূপ অপরাধকর্ম তখন রাষ্ট্রের নীতি বা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায়। ফিরাউন-নমরুদের ন্যায় দুর্বৃত্তরা যখন রাষ্ট্রের উপর তাদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছিল তখন নিজেদেরকে শুধু রাজা রূপে নয়,খোদা রূপেও প্রতিষ্ঠা করেছিল। এমন দুর্বৃত্তকবলিত রাষ্ট্রে সত্য,সুশিক্ষা ও সুবিচার মারা পড়ে। এমনকি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ)র মত মহা মানবগণও সে সমাজে ভাল আচরণ পাননি। বরং তাদেরকেও নির্মম হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখনই হালাকু-চেঙ্গিজ-হিটলারদের ন্যায় দুর্বৃত্তদের হাতে গেছে তখনই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নির্মম নির্যাতন ও মৃত্যু নেমে এসেছে। মানব ইতিহাসের বড় বড় বিপর্যয়গুলো গ্রামগঞ্জে বাসকরা চোর-ডাকাতদের হাতে হয়নি। রোগ-ভোগ, মহামারি বা ঝড় তুফানের হাতেও হয়নি। বরং হয়েছে দুর্বৃত্তদের হাতে রাষ্ট্র যাওয়াতে। মানব জাতির সবচেয়ে বড় দুষমন হলো এসব দুর্বৃত্তরা।মহান আল্লাহতায়ালা তাই এরূপ দুর্বৃত্ত নির্মূলকেও বাধ্যতামূলক করেছেন। এবং নির্মূলের সে কাজকে পবিত্র জিহাদের মর্যাদা দিয়েছেন।

মুসলমানগণ আজ বিশ্বশক্তির মর্যাদা হারিয়ে পদে পদে পরাজয়ের যে গ্লানি বইছে সেটিও রোগ-ভোগ, ভূমিকম্প বা ঝড়তুফানের কারণে নয়। বরং মুসলিম রাষ্ট্রগুলো দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হওয়ায়। এবং সে বিপর্যয় যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তারই আধুনিক উদাহরণ হলো আজকের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ আজ পথে ঘাটে লাশ হচ্ছে, গুম হচ্ছে,ধর্ষিতা হচ্ছে এবং নানা ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। কিন্তু এ জন্য কি দেশের জলবায়ু বা ভূপ্রকৃতিকে দায়ী করা যায়? বরং মূল কারণঃ রাষ্ট্র অধিকৃত হয়েছে যে দুর্বৃত্তদের হাতে তারা।তাদের হাতে দেশের পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত ও প্রশাসনসহ সমগ্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে নির্যাতনের হাতিয়ারে। বনে জঙ্গলে মানুষ লাশ হলে বা ছিনতাইয়ের শিকার হলে যেমন বিচার হয় না, তেমনি বিচার হয় না বাংলাদেশেও। ফিরাউন-নমরুদ-হালাকু-চেঙ্গিজের আমলে মানুষ যেমন তাদের জানমালের নিরাপত্তা হারিয়েছিল,একই রূপ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে এদেশটিতেও।বাংলাদেশের মানুষের আজকের বড় দুষমন তাই যেমন রোগ জীবানূ নয়,তেমনি ঝড়-তুফান এবং চোরডাকাতও নয়। বরং সে ভয়ানক শত্রুটি হলো খোদ সরকার।

ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা রাষ্ট্রের শক্তি-সামর্থ ও গুরুত্বকে সঠিক ভাবে সনাক্ত করেছে। অন্য ধর্মে রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে দখলে নেয়ার নির্দেশ নেই। কিন্তু ইসলামে সে নির্দেশটি বার বার এসেছে। ইসলামের নবী তাই শুধু ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না, তিনি রাষ্ট্রের প্রধানও ছিলেন। এরূপ ভিন্নতর নির্দেশের কারণ, ইসলাম যে মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা থেকে এসেছে তাঁর মহান দৃষ্টি থেকে রাষ্ট্রের সে প্রবল ক্ষমতাটি গোপন থাকার কথা নয়। এজন্যই ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেককর্ম নফল নামায-রোযা বা দানখয়রাত নয়।মহল্লার ছিঁছকে চোর-ডাকাতদের ধরাও নয়। বরং দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রাষ্ট্রকে বাঁচানো। ইসলামে সেটি সর্বোচ্চ ইবাদত। ইসলামে সে চেষ্টাকেই জিহাদ বলা হয়েছে। নবীজী (সাঃ) ও তার সাহাবাদের জীবনে সবচেয়ে বড় কোরবানী দিতে হয়েছে সে জিহাদে। রাষ্ট্রকে নিজেদের দখলে রাখতে নবীজী (সাঃ)র শতকরা ৭০ ভাগ সাহাবী প্রাণ দিয়েছেন। একটি দেশ কতটা সভ্য রূপে গড়ে উঠবে সে ফয়সালাটি দেশের কলকারখানা, রাস্তাঘাট বা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা থেকে নির্ধারিত হয় না। বরং সেটি নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রকে ইসলামি করার কাজে কতটা জিহাদ হলো তা থেকে। যে দেশে সে জিহাদ নাই সে দেশ যে দুর্বৃত্তির সয়লাবে ভেসে যাবে সেটিই হলো নিয়ম। আর তারই প্রমাণ হলো আজকের বাংলাদেশ। আবর্জনা এমনিতে সরে না। সেটি সরানোর কাজ না হলে সমগ্র দেশ তখন আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়। বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছরে যত কলকারখানা, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল বা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে তা দেশটির সমগ্র ইতিহাসেও নির্মিত হয়নি। কিন্তু তাতে কি বাংলাদেশের মানুষের সভ্য মানুষ রূপে বেড়ে উঠাটি নিশ্চিত হয়েছে? বরং নির্মিত হয়েছে বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে কদর্যকর ইতিহাস। সেটি যেমন ভিক্ষার তলাহীন ঝুড়ির খেতাব পেয়ে তেমনি বিশ্বমাঝে ৫বার সবচেয়ে দুর্বৃত্তকবলিত দেশ রূপে প্রতিষ্টা পেয়ে।

 

যে পথে মহাবিপর্যয়

সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কলকারখানা,রাস্তাঘাট বা হাসপাতাল  গড়া নয়। বরং সেটি হলো সত্যিকার মানুষ গড়া। এ খাতে ব্যর্থ হলে অন্য খাতে যত সফলতাই আসুক তা দিয়ে সত্যিকার কল্যাণ আসে না। অথচ বাংলাদেশে এটিই হলো সবচেয়ে ব্যর্থ খাত। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যত চোরডাকাত, ব্যাংক-ডাকাত, ধর্ষক এবং সে সাথে রাজনীতি, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত ও প্রশাসনের অঙ্গণে দুর্বৃত্ত তৈরী হয়েছে তা কি গ্রামবাংলার নিরক্ষর মানুষের ঘরে পয়দা হয়েছে? এমন একটি দুর্বৃত্তকবলিত দেশে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর লোকেরা সরাকারি লেবাস পড়ে চুরিডাকাতি ও মানুষ খুনে নামে।ঢাকার শাপলা চত্বর তো এমন খুনিদের হাতেই রক্তাত্ব হয়েছে। তখন পেশাদার খুনিতে পরিণত হয় এমনকি আদালতের বিচারকগণও। তারা শত শত মানুষ খুন করে কলমের খোঁচায়।  মিশরে এমন এক বিচারক একদিনে ৬ শত মানুষের ফাঁসির নির্দেশ দিয়েছে ।একটি গাছ জন্মাতে হলেও সে গাছের প্রতি নিয়মিত পরিচর্যা চাই। গাছের গোড়ায় পানি ঢালার পাশাপাশি বেড়ে উঠার জন্য নিয়মিত প্রহরাও চাই।নিরাপদ পরিবেশও চাই। নইলে গাছের গোড়ায় দুষ্ট মানুষের হাত পড়ে। সে তুলনায় সমাজে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো মানুষগড়া।পিতামাতার ঘরে শিশু জন্ম নেয় বটে কিন্তু বেড়ে উঠে শিক্ষা, সংস্কৃতি,সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবেশে। শিশু মানবিক গুণে গড়ে তোলার কাজে পিতামাতার পাশে তাই রাষ্ট্র ও সমাজের লাগাতর সংশ্লিষ্টতাও চাই। নইলে অতি মহৎ ও আলেম ব্যক্তির ঘরেও অতিশয় দুর্বৃত্ত বেড়ে উঠে। রাষ্ট্র সে কাজটি করে উপযুক্ত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে। কিন্তু সেটি অসম্ভব হয় রাষ্ট্র দুর্বৃত্তদের হাতে গেলে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ খাতটিও তখন দুর্বৃত্তগড়ার কারখানায় পরিণত হয়। অনৈসলামিক রাষ্ট্রের এটিই হলো সবচেয়ে বড় বিপদ। ফলে যে ধর্ম মানবের কল্যাণ নিয়ে ভাবে সে ধর্ম রাষ্ট্রের দখলদারি কাদের হাতে থাকবে বা কোন আইন নিয়ে পরিচালিত হবে সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে নীরব থাকতে পারে না। ইসলামও থাকেনি। কোরআনের ছত্রে ছত্রে তাই সমাজ ও রাষ্ট্রপরিচালনা নিয়ে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। রয়েছে শরিয়তি আইন।

তাই ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিছক কোন ইসলামী দলের রাজনৈতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। কোন মৌলবাদী মুসলিমের রাজনৈতিক ভাবনাও নয়। বরং সেটি চান খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। শুধু মুসলিম ভূমিতে নয়, সমগ্র বিশ্বব্যাপী। তিনি চান, প্রতিটি মানুষ তাঁর অনুগত বান্দাহ রূপে বেড়ে উঠুক, এবং সমগ্র বিশ্ব তাঁর দ্বীনের আলোকে আলোকিত হোক। মানব জাতির মহাকল্যাণ তো একমাত্র এপথেই। মহান আল্লাহর সে মহান ইচ্ছাটি ছড়িয়ে আছে পবিত্র কোরআনে। মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সে পবিত্র ইচ্ছার সাথে পুরাপুরি একাত্ম হওয়া। এবং নিজের জানমালের বিনিয়োগ করা। মু’মিন ব্যক্তির ঈমান বৃদ্ধির সাথে সে বিনিয়োগটিও বাড়ে। তখন ভিড় বাড়ে জিহাদের ময়দানে। আর সে বিনিয়োগটি লোপ পায় ঈমান বিলুপ্ত হলে। তাই একটি দেশে ঈমানদার মানুষের সংখ্যা কীরূপ সেটি তো বুঝা যায় জিহাদের ময়দানে সে বিনিয়োগ দেখে, মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা দিয়ে নয়।তাছাড়া এমন বিনিয়োগ তো নবীজীবনের মহান সূন্নতও। সে সূন্নতের অনুসরণ ছাড়া জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচা যেমন যায় না, তেমনি রাষ্ট্রও প্রকৃত কল্যাণের পথে ধাবিত হয় না। মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানব। সে মহান সৃষ্টি জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হোক সেটি তিনি চান না। সে আগুন থেকে বাঁচানোর কাজকে ত্বরান্বিত করতেই মহান আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে হাজার হাজার নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। এবং চান,আগুন থেকে বাঁচানোর সে কাজে রাষ্ট্রও তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করুক।

 

ইসলামি রাষ্ট্র কেন অপরিহার্য?

জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর এ বিশাল কাজটি নিছক কিছু আলেম-উলামার কাজ নয়। কোরআন-হাদীসের কিছু জ্ঞান বিতরণ, অবসর সময়ে কিছু তাবলিগ, কিছু ওয়াজ-নসিহত বা কিছু দানখয়রাতের মাধ্যমে একাজ অসম্ভব। এ কাজটি যেমন অতি গুরুত্বপূর্ণ,তেমনি এর পরিধিও বিশাল। এ বিশাল কাজটি ইসলামের চর্চা ও ধর্মপালনকে মসজিদ-মাদ্রাসায় সীমিত রেখে সম্ভব নয়। ইবাদতকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখেও সম্ভব নয়। এ কাজটি অসাধ্য এবং অভাবনীয় হয়ে পড়ে যদি রাষ্টের ন্যায় মানব সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটি ইসলামের বিপক্ষশক্তি বা ইসলামে অঙ্গিকারহীন ব্যক্তিবর্গের হাতে যায়। নমরুদ, ফিরাউন, আবু লাহাব, আবু জেহলগণ ক্ষমতায় থাকলে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, ইসলামের অনুসারিদের পক্ষে প্রাণে বাঁচাই কঠিন হয়। তাদেরকে ক্ষমতায় রেখে সেটি সম্ভব হলে ইসলামের শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মহম্মদ (সাঃ) ও তাঁর সাহাবগণ কেন রক্তাত্ব যুদ্ধ-বিগ্রহে বিপুল অর্থদান, শ্রমদান এবং প্রাণদানের পথ বেছে নিলেন? এত কষ্ট, এত ত্যাগ ও এত রক্তপাতের পথ ছেড়ে কেন তিনি নিছক কোরআন পাঠ, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ, এবং নামায-রোযা-হজ-যাকাতে তাঁর কর্মকে সীমিত রাখলেন না?

মানুষকে জাহান্নামে নেয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার যেমন রাষ্ট্র, তেমনি সে আগুন থেকে বাঁচানোরও শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো রাষ্ট্র। তাই নবীজী (সাঃ) ও সাহাবাদের আমলে মুসলমানদের জানমালের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগটি হয়েছে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়; মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় নয়। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর আগে লক্ষাধিক নবী-রাসূল এসেছেন। তাদের সবারই ধর্ম ছিল ইসলাম। কিন্তু জাহান্নামের আগুন থেকে যত মানুষকে ইসলামের শেষনবী হযরত মহম্মদ (সাঃ) রক্ষা করেছেন তা অন্য কোন নবীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। অন্য কোন নবীর দ্বারা ইসলামের বিশ্বময় প্রচার এবং ইসলামী সভ্যতার নির্মাণও ঘটেনি। অনেক জ্ঞানি ব্যক্তিই মানুষে মানুষে সমতা, নারী স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার এবং শ্রেণীভেদ ও বর্ণবাদবিরোধী বড় বড় নীতি কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু কেউ কি তা নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন? কিন্তু নবীজী (সাঃ) পেরেছেন। এজন্য এমনকি বহু অমুসলিমও তাঁকে মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের মর্যদা দেন। মাইকেল হার্ট তাঁর বিখ্যাত বই “দি হানড্রেড”য়ে মানব ইতিহাসের একশত শ্রেষ্ঠ মানুষের মাঝে হযরত মহম্মদ (সাঃ)কে প্রথম স্থান দিয়েছেন তো সে বিচারবেোধেই।কিন্তু কীরূপে সম্ভব হলো নবীজী (সাঃ) র হাতে সে বিশাল বিপ্লবী কাজ? হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর এ সফলতার কারণ তাঁর ও তাঁর মহান খলিফাদের হাতে শুধু মহান আল্লাহর নাযিলকৃত হেয়ায়েতের গ্রন্থ পবিত্র কোরআনই ছিল না,ছিল বিশাল রাষ্ট্র ও তার প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলিও। কিন্তু আজ ঈমানদারদের ঘরে ঘরে পবিত্র কোরআন আছে, তাদের জীবনে নামায-রোযাও আছে। কিন্তু দখলে নাই রাষ্ট্র। নামাযী ও রোযাদারদের সংখ্যা বাড়িয়ে বা তাবলিগে জামায়াতের ইজতেমায় তিরিশ-চল্লিশ লাখের স্থলে কোটি কোটি মানুষের সমাবেশ বাড়িয়েও কি সে সফলতা জুটবে? ইসলামের বিজয় সাধনের পথে সেটি তো নবীজীর সূন্নত নয়। ইসলামের প্রতিষ্ঠা তো ইজতেমায় হয় না। নামাযী ও রোযাদারদের সংখ্যাবৃদ্ধিতেও হয় না। এজন্য তো রাষ্ট্রের উপর থেকে দুর্বৃত্তদের হটিয়ে ঈমানদারদের দখলদারিটা চাই। জিহাদ এ কাজে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

রাষ্ট্র ইসলামি হলে জাহান্নামের আগুন থেকে মানুষকে বাঁচানোর কাজে কোরআন-হাদীস, মসজিদ-মাদ্রাসা ও আলেম-উলামাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠানগুলোও দিবারাত্র কাজ করে। তখন দেশ জুড়ে যে বিশাল রাজপথটি দৃশ্যমান হয় সেটি সিরাতুল মুস্তাকীম; আল্লাহর অবাধ্যতার রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি নয়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তখন বিলুপ্ত করা হয় আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সকল পথ। বাঘ-ভালুককে জনপদে মূক্ত ছেড়ে দিয়ে কি সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া যায়? তেমনি আল্লাহর বিরুদ্ধাচারি লক্ষ লক্ষ সশস্ত্র বিদ্রোহীকে সর্বপ্রকার সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে জান্নাতের পথ রুখার অধিকার দিলে কি সাধারণ মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো যায়? সমগ্র আরব ভূমি, পারস্য, মিশর, মধ্য-এশিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব ভাগ জুড়ে সাধারণ মানুষের দলে দলে ইসলামের প্রবেশের যে জোয়ার শুরু হয় সেটি তো আল্লাহর শত্রুদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং সামরিক শক্তি ছিনিয়ে নেয়ার পর। তার আগে নয়। তাদের নির্মূলে অপসারিত হয়েছিল জান্নাতের পথে চলার সকল বাধা।

 

রাষ্ট্র যখন পথভ্রষ্টতার হাতিয়ার

রাষ্ট্রের দখলদারি যেখানেই কাফেরদের হাতে রয়ে গেছে সেখানেই ইসলামের গাড়ি আর সামনে এগুতে পারেনি। মানব পায়নি সিরাতুল মোস্তাকীম। রাষ্ট্রের বুক থেকে সে বাঁধা সরানো এবং ইসলামি রাষ্ট্রকে নিরাপদ করাটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে মক্কা বিজয়ের পর মহান আল্লাহতায়ালা কাফেরদের জন্য চার মাস সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। এ চার মাসের মধ্যে ইসলাম কবুল না করলে তাদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে হত্যার নির্দেশ দিযেছিলেন।-(সুরা তাওবাহ, আয়াত ২-৩)। কারণ, বিদ্রোহীদের অপতৎপরতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবাধে চলতে দিলে সে রাষ্ট্র বাঁচে না। ইসলামও তার মজবুত শিকড় নিয়ে সমাজ ও সংস্কৃতি নির্মানের সুযোগ পায় না। তাছাড়া আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের বিরুদ্ধে মক্কার কাফেরদের সশস্ত্র বিদ্রোহটি তো গোপন বিষয় নয়। নবীজী (সাঃ)র নবুয়তের প্রথম দিন থেকেই তারা ছিল ইসলাম ও ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সক্রিয় শত্রু। মদিনার সদ্য-প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র ইসলামি রাষ্ট্রকে সূতিকা ঘরে নির্মূল করতে তারা মক্কা থেকে মদিনায় গিয়ে বার বার হামলা করেছে। দেহের অভ্যন্তরে প্রাণনাশক জীবাণূ নিয়ে কোন দেহই সুস্থ্যতা পায় না, বাঁচেও না। তেমনি রাষ্ট্রও বাঁচে না যদি তার অভ্যন্তরে শত্রুরা বেড়ে উঠার সুযোগ পায়। তাই মক্কা বিজয়ের পর শত্রুদের আত্মসমর্পণ বা হত্যা –এ ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ ঘোষণা। ‌ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও তার সুরক্ষা যে মহান আল্লাহর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি কি এ কোরআনী হুকুমের পরও বুঝতে বাঁকি থাকে? সেটি না হলে খোদ মুসলিম ভূমিতেই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অসম্ভব হয়ে পড়ে ইসলামের বিজয়কে ধরে রাখা। অসম্ভব হয় প্রতিবেশী দেশের নির্যাতিত মুসলমানদের পক্ষ নেয়া বা তাদের সাহায্য করা। বাংলাদেশের মুসলমানগণ সে কারণেই পারছে না আরাকান, ভারত ও কাশ্মিরের নির্যাতিত মুসলমানদের পক্ষ নিতে। কারারুদ্ধ জিন্দানীরা ইচ্ছা করলেই পাশের জিন্দানীর বিপদে সাহায্য করতে পারে না। সে জন্য কারামূক্ত স্বাধীনতা লাগে। তেমনি অবস্থা অধিকৃত দেশের নাগরিকদের। বাংলাদেশ এখান ইসলামপন্থিদের জন্য জেলখানা, এখানে দখলদারিটি ইসলামের শত্রুপক্ষের। সরকারের ভূমিকা এখানে কারাপ্রশাসকের। ফলে তাদের দখলদারিতে বাংলাদেশের মুসলমানগণ আরাকান, কাশ্মির, ফিলিস্তিন বা ভারতের মজলুম মুসলমানদের পক্ষ নিবে সেটি কি ভাবা যায়? ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসলামের শত্রু পক্ষের মোড়লগণ কি বাংলাদেশের নাগরিকদের সে অধিকার দিবে? বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষিরা গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে চাওয়া আরাকানের মুসলমানদের প্রবেশ রুখতে তাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়বে ও তাদেরকে মায়ানমারে ফেরত পাঠাবে সেটা্ই স্বাভাবিক নয়।

 

আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের কাজটি যেমন সর্বসময়ের, তেমনি সে কাজের পরিধিও বিশাল। সেটি রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে জুড়ে। অপরদিকে শয়তান ও তার অনুসারিদের শক্তিও কম নয়। তাদের হাতে অধিকৃত হলো অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র ও সে সব রাষ্ট্রের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অধিকৃত সে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে হামলাও হচ্ছে লাগাতর। সে হামলা থেকে মুসলমানদের প্রতিরক্ষা দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বা দল নিতে পারে না। সে লক্ষ্যে মুসলমানদেরও ইসলামি রাষ্ট্র গড়তে হয়। সে রাষ্ট্রের দায়ভারও নিতে হয়।

 

সবচেয়ে বড় নিয়ামত

রাষ্ট্রের দায়িত্বটি শুধু জনস্বার্থে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা ও হাসপাতাল নির্মাণ নয়, বরং সর্ব-প্রকার ভ্রান্ত ধর্ম ও মতবাদের হামলা থেকে মুসলমানদের লাগাতর প্রতিরক্ষা দেয়া। এবং প্রতিরক্ষার সে যুদ্ধটিকে লাগাতর জারি রাখা। নইলে অসম্ভব হয় নাগরিকদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো। খোদ নবীজী (সাঃ) এবং খোলাফায়ে রাশেদার আমলে সে কাজটি লাগাতর করেছে রাষ্ট্র এবং সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। ফলে এমন দেশে জান্নাতের পথ খুঁজে পাওয়াটি তখন সহজ হয়ে যায়। অল্প বিদ্যা-বুদ্ধির মানুষগুলোও তখন জান্নাতে পৌঁছতে পারে। ইসলামি রাষ্ট্রের কারণেই আরবের নিরক্ষর বেদূঈনগণও তখন জন্ম থেকেই ঘরের সামনে ও চোখের সামনে সিরাতুল মুস্তাকীম দেখতে পেয়েছিল। সে পথে চলার ঈমানী সামর্থও পেয়েছিল। সেটি না হলে সাধারণ নাগরিক দূরে থাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকশ প্রফেসর, প্রবীন বুদ্ধিজীবী, পীর-দরবেশ, আলেম-উলামা এবং বড় বড় ডিগ্রিধারিরাও তখন পথভ্রষ্ট হয়। তারাও তখন পরিপক্ক দুর্বৃত্তে পরিণত হয়। সেটির প্রমাণ আজকের মুসলিম দেশগুলী। পৃথিবীতে মুসলিম রাষ্ট্র ও মুসলমানদের সংখ্যা বাড়লেও এসব মুসলিম দেশে সিরাতুল মোস্তাকীম গড়ে উঠেনি। ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি সংস্কৃতি এবং আল্লাহর নির্দেশিত শরিয়তি বিধানও প্রতিষ্ঠা পায়নি। শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ছাড়া কি সিরাতুল মোস্তাকীমে চলা যায়? শরিয়ত মোতাবেক পথ চলাই তো হলো সিরাতুল মোস্তাকীম। আর সে সিরাতুল মোস্তাকীমে চলাটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে নামাযের প্রতি রাকাতে সে জন্য “ইহদিনাস সিরাতুল মোস্তাকীম” বলে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হয়। মুমিনের জীবনে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোয়া যা শিখিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। এ দোয়া না পড়লে নামাযই হয় না। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম দেশে রাষ্ট্রীয় ভাবে যেটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেটি সিরাতুল মোস্তাকীম নয়, বরং সেটি সূদ, ঘুষ, সেক্যুলার রাজনীতি, মিথ্যাচর্চা, জুয়া, বেপর্দাগী, অশ্লিলতা, পতিতাবৃত্তি ও জাতীয়তাবাদের জাহিলিয়াতের ন্যায় পাপাচারকে আচার রূপে মেনে নেয়ার জাহান্নামমুখি এক ভয়ানক পথভ্রষ্টতা।

পরিপূর্ণ এক ইসলামি রাষ্টীয় বিপ্লবের ফলেই সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র জান্নাতমুখি হয়। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় জান্নাতমুখি এক চলন্ত জাহাজে, এবং রাষ্ট্রের নাগরিকগণ হয় সে জাহাজের যাত্রী। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এটিই হলো সবচেয়ে বড় নিয়ামত। রাষ্ট্রের বহু কাজই জনকল্যাণকর। এ জীবনকে আনন্দময় করার জন্য ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, কৃষি-শিল্প, পানি-বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যসেবা জরুরী হলেও সেগুলী অন্তহীন আখেরাতে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে পারে না। সে জন্য সিরাতুল মোস্তাকীম চাই, চাই সে পথে চলার আধ্যাত্মীক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বল। রাষ্ট্রের বড় দায়িত্ব হলো জনগণের মধ্যে সে সামর্থ সৃষ্টি করা। রাষ্ট্রের জিম্মাদারিতে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন দায়ভার নেই। রাষ্ট্র সে কাজটি করে আল্লাহর পথনির্দেশনা বা হেদায়েতের বাণীকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে। এ হেদায়েত বা পথনির্দেশনাই হলো মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। সে নেয়ামত বয়ে আনতেই আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবী পৃষ্টে তাঁর মহান ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) নেমে এসেছেন। নবীরাসূলগণের মূল কাজটি ছিল সে পথনির্দেশনাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া। মানব সমাজে এর চেয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই। একাজ জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচানোর। ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, কৃষি-শিল্প, পানি-বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যসেবার কাজ সে তূলনায় নস্যিতূল্য। শাসক বা রাষ্ট্রনায়কদের  সবচেয়ে বড় অবাধ্যতা এবং সবচেয়ে বড় অপরাধটি হলো সে দায়ভার এড়িয়ে যাওয়া। এ দায়ভার পালনে নবীজী (সাঃ) তাই অমুসলিম দেশগুলিকে আল্লাহর শত্রুমূক্ত করতে শুধু মোজাহিদদেরই পাঠাননি, কোরআনের শত শত শিক্ষকও পাঠিয়েছেন। মুসলমানদের পরাজয় এবং ইসলামের পথ থেকে দূরে সরা তখনই শুরু হয় যথন রাষ্ট্র শুধু রাজস্ব-সংগ্রহ, রাজ্য-বিস্তার ও নিজেদের ক্ষমতাপ্রয়োগে মনযোগী হয়, এবং দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সিরাতুল মোস্তাকীম গড়া থেকে। তখন গুরুত্ব হারায় জাহান্নামের পথ বন্ধ করে দেয়া এবং সে পথে ডাকা অপরাধীদের শাস্তি দেয়া। গুরুত্বপূর্ণ একাজগুলি আরো কঠিন হয়ে পড়ে মুসলিম দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে সেক্যুলারিস্টদের বিজয়ে। তখন রাষ্ট্রজুড়ে যে পথগুলি দৃশ্যমান হয় ও চোখ ধাঁধিয়ে দেয় তা হলো শয়তানের সৃষ্ট জাহান্নামের পথ। এরূপ পথের ভিড়ে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ দূরে থাক, এমনকি নবেল বিজয়ী মহাপন্ডিতগণও সত্যপথ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়।

 

সবচেয়ে বড় অপরাধ

অনৈসলামী রাষ্ট্রের অপরাধ অনেক। বর্বরতাও বহুবিধ। তবে সাধারণ মানুষের নজর থেকে সিরাতুল মুস্তাকীম বিলু্প্ত করা বা অদৃশ্য করাই এসব রাষ্ট্রগুলির সবচেয়ে বড় অপরাধ। সে অপরাধের কারণেই সাধারণ মানুষ জান্নাতের পথ খুঁজে না পেয়ে জাহান্নামমুখি হয়। এখানে রাষ্ট্র ও তার কর্মকর্তাগণ কাজ করে শয়তানের নিষ্ঠাবান খলিফা রূপে। এমন মহাপরাধীদের হাত থেকে জনগণকে বাঁচানোর লড়াই হলো ইসলামের শ্রেষ্ঠ ইবাদত তথা জিহাদ, এ ইবাদতে প্রাণ গেলে বিনা বিচারে জান্নাতপ্রাপ্তি ঘটে। অন্য কোন ইবাদত আজীবন অবিরাম করলেও সে পুরস্কারটি জুটে না। অপরদিকে যে দেশে শয়তানের এ খলিফাদের বিরুদ্ধে জিহাদ নেই সে দেশে প্রকৃত ইসলামও নাই। মানব জাতি মূলত দুটি পক্ষে বিভক্ত। একটি শয়তানের খফিফাপক্ষ অপর পক্ষে মহান আল্লাহর খফিফারা। এছাড়া তৃতীয় পক্ষ নাই। মানব জাতির ইতিহাসের সিংহ ভাগ জুড়ে মূলত এ দুই পক্ষের লড়াইয়ের ইতিহাস।

জান্নাতের পথ দেখানো ও জাহান্নামের আগুন থেকে মানুষকে বাঁচানোই ইসলামের মূল মিশন। সে কাজটি কোরআনের বানী একাকী করতে পারে না। শুধু মসজিদ-মাদ্রাসায় সেটি ঘটে না। সে কাজে সমগ্র রাষ্ট্র এবং তার সকল সামরিক ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, প্রচারমাধ্যমসহ সকল প্রতিষ্ঠানকে সর্বশক্তি দিয়ে অংশ নিতে হয়। নবীপাক (সাঃ)এর শাসনামলেই সেটিই ঘটেছিল। নবীজী (সাঃ)র আমলে সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে এমন কোন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ছিল না যা থেকে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্টা ও তার সুরক্ষায় সহয়তা নেননি। তাবুক যুদ্ধের সময় তো প্রত্যেক সামর্থবান মুসলমানের উপর মদিনা থেকে বহুশত মাইল দূরে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়াকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। নবীজী (সাঃ)র সে কাজে যারা সেদিন সহায়তা দেয়নি তাদেরকে আল্লাহতায়ালা ওহী যোগে মুনাফিক বলেছেন। তারা চিহ্নিত হয়েছে ইসলামের শত্রু রূপে। নবীজী (সাঃ)র সে সূন্নতকে অনুসরণ করেছিলেন খোলাফায়ে রাশেদা ও অন্যান্য খফিফাগণ। আজও কি মুসলমানদের পক্ষ থেকে এমন সহায়তা ছাড়া কোন দেশে ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজ বিপ্লব সম্ভব? সম্ভব কি শয়তানি শক্তিকে পরাজিত করা?

রাষ্ট্র ও তার সকল প্রতিষ্ঠানের উপর নিয়ন্ত্রন নেয়ার কাজটি  মু’মিনের জীবনে নিছক রাজনীতি নয়, বরং সেটি হলো তার জীবনে ধর্মীয় বাধ্য-বাধকতা। নইলে রাষ্ট্রে ইসলামী বিপ্লব আসে না। ইসলামে তাই এটি ফরয। মু’মিনের জীবনে এটি এক পবিত্র কর্ম। স্বয়ং নবীজী(সাঃ) সেটি করেছেন। সাহাবায়ে কেরামও সেটি নিষ্ঠার সাথে করেছেন। আজকের ঈমানদারগণও যে সেটি করবে সেটিই স্বাভাবিক। নইলে ঈমানদারি থাকে না। এছাড়া রাষ্ট্রকে জান্নাতমুখি করাও সম্ভব নয়। সম্ভব নয় জনগণের কাছে সিরাতুল মুস্তাকীমকে সহজলভ্য করা। এবং সম্ভব নয় কোরআনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার “লিইউযহিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি”র ইচ্ছাপূরন। তাই যারা রাষ্ট্রে ইসলামের প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব না দিয়ে স্রেফ নামায-রোযা-হজ-যাকাতের মধ্যে ধর্মপালন করে তাদের সে ধর্মপালনে প্রকৃত ঈমানদারি নাই। নবীজী (সাঃ)র সূন্নতও নেই। মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাপূরণেও তাদের আগ্রহ নেই। এমন মানুষেরা দৃশ্যতঃ ধার্মিক হলেও আসলে বিপথগামী।

 

ঈমানদারির অর্থঃ আত্মদানে চুক্তিবদ্ধ হওয়া

মুসলমান হওয়ার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। সে চুক্তিটি মহান আল্লাহর কাছে তাঁর জানমাল বিক্রির। কোরআনের ভাষায় এটি হলো বাইয়া অর্থাৎ বিক্রয়নামা। মু’মিন এখানে তাঁর জানমাল বিক্রয় করে মহান আল্লাহর কাছে। প্রতিদানে সে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে পায় জান্নাত। সে চুক্তিনামাটি পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে এভাবে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনের নিকট থেকে তার জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন, তাদের জন্য এর বিনিময়ে রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, নিধন করে এবং নিহত হয়।” –(সুরা তাওবাহ, আয়াত ১১১)। মুমিনের কাছ থেকে সে বাইয়াতনামাহ নিতে আল্লাহতায়ালা স্বয়ং পৃথিবীপৃষ্টে নেমে আসেন না। তার পক্ষ থেকে সে কাজটি করেন আল্লাহর নবী। নবীর অবর্তমানে সে বাইয়াতের কাজটি করে ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা। তাই বলা হয়, সাহাবাগণ যখন নবীর হাত ধরে বাইয়াত করতেন তখন সেখানে মুমিনের হাতের সাথে শুধু নবীজী (সাঃ)র হাতই থাকতো না। সে দু’টি হাতের উপর আরেকটি হাত থাকতো, এবং সেটি মহান আল্লাহর। অথচ সে বাইয়াত আজ পীর-দরবেশদের মুরিদ রূপে আনুগত্য জাহিরের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং বাদ পড়েছে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে জিহাদ এবং জানমালের কোরবানীর বিষয়। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের আমলে মুসলিম রাষ্ট্রে সৈন্য পালতে গ্রীক, রোমান বা পারসিকদের ন্যায় বড় বড় সেনানিবাস গড়তে হয়নি। বড় বড় কেল্লাও নির্মিত হয়নি। বরং প্রতিটি জনপদ ছিল সেনানিবাস, প্রতিটি ঘর ছিল কেল্লা। যুদ্ধের প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণাই যথেষ্ট হতো। চাষাবাদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ন্যায় যুদ্ধবিদ্ধাও তারা নিজ গরজে শিখতো। নিজ খরচে অস্ত্র কিনে, নিজ অর্থে যুদ্ধের রশদ সংগ্রহ করে এবং নিজের ঘোড়া বা নিজের উঠ নিয়ে শত শত মাইল দূরের রণাঙ্গনে গিয়ে হাজির হতো। সে যুদ্ধে প্রাণও দিত। ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ এবং মুসলিম ভূমি এভাবেই তখন সুরক্ষা পেত।

অথচ রাষ্ট্র যখন ইসলামের বিপক্ষ শক্তির হাতে অধিকৃত হয় তখন নিষিদ্ধ হয় ইসলামের সর্বোচ্চ ইবাদত এ জিহাদ। এসব রাষ্ট্রের শাসকগণ জিহাদীদের গণ্য করে নিজেদের প্রতিপক্ষ রূপে এবং নিষিদ্ধ করে আল্লাহর সাথে কৃত বাইয়াতের শর্ত্ব পালন। তখন আইন করে বন্ধ করা হয় ইসলামের নামে সংগঠিত হওয়া এবং শরিয়তের প্রতিষ্ঠার যে কোন উদ্যোগ। এভাবেই জনগণের জন্য দুরুহ করা হয় জান্নাতের পথে পথচলা। বরং সরকারি প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও বিচারব্যবস্থাসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান লিপ্ত হয় শয়তানের এজেণ্ডা সফল করায়। রাষ্ট্রীয় কর্মচারি, সেনাসদস্য ও পুলিশ তখন স্বৈরাচারি শাসকের নওকরে পরিনত হয়। ইসলাম, মুসলিম ভূমি ও মুসলমানের জানমাল বিপন্ন হলেও এমন রাষ্ট্রে তখন জিহাদ শুরু হয়না।

মুসলমানদের আজকের পরাজিত দশা এজন্য নয় যে মুসলিম দেশগুলোতে কোরআন-হাদীস বা মসজিদ মাদ্রাসার কমতি রয়েছে। বরং অতীতের তুলনায় মসজিদ মাদ্রাসার সংখ্যা হাজার গুণ বেড়েছে। নবীজী(সাঃ) শাসনামলে এমনকি খোলাফায়ে রাশেদার আমলেও কোন সাহাবার ঘরে একখানি পুরা কোরআন ছিল না। হযরত উসমান (রাঃ) খলিফা থাকা কালে পূর্ণাঙ্গ কোরআন পুস্তাকারে ছিল মাত্র ৪ খানি। অথচ আজ ঘরে ঘরে কোরআন মজিদ ও কোরআনের তাফসির। আর হাদীস গ্রন্থ? সে সময় কোন হাদীস গ্রন্থই ছিল না। অথচ আজ যে কোন ব্যক্তি বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাজার হাজার হাদীস পাঠ করতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক কালে হাদীসের সে রূপ শিক্ষা লাভে হাজার হাজার মাইলের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে নানা দেশের নানা স্থানে গিয়ে বিক্ষিপ্ত সাহাবা ও তাবে-তাবেয়ীনদের নিকট থেকে হাদীস শিখতে হতো।

 

মুসলমানদের আজকের পরাজয়ের মূল কারণটি অন্যত্র। সেটি ইসলামি রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি। কোরআন হাদীস আজ ঘরে ঘরে বেঁচে থাকলেও সমগ্র মুসলিম জাহানে ইসলামি রাষ্ট্র বেঁচে নাই। রাষ্ট্র অধিকৃত হয়ে গেছে ইসলামের শত্রু শক্তির হাতে। আজকের মুসলমানদের এটিই সবচেয়ে বড় বিপদ। চোর-ডাকাতদের হাতে ঘরবাড়ি অধিকৃত হলে এতবড় ক্ষতি হয় না। কারণ তখনও ঈমান বেঁচে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্র দুর্বৃত্ত জাহেলদের হাতে অধিকৃত হলে ঈমানকে বাঁচতে দেয়া হয় না। আর ঈমান বেঁচে থাকলে আল্লাহর শরিয়তের বিধানের এমন পরাজয়ে মুসলিম বিশ্বে জিহাদ কি অনিবার্য হতো না? শয়তানের খলিফাদের দখলদারির বিরুদ্ধে জিহাদ যে শুরু হয়নি সেটিই প্রমাণ করে ঈমান তার সুস্থ্যতা নিয়ে খুব একটা বেশী মানুষের মাঝে বেঁচে নাই।

 

শত্রুপক্ষের স্ট্রাটেজী

শয়তান ও তার অনুসারিগণ চায় না যে, রাষ্ট্র ও তার শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানসমূহ ঈমানদারদের হাতে পড়ুক। কারণ তাতে তাদের অস্তিত্বের সংকট। এজন্যই সেগুলোকে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে গছিয়ে দিতে চায়। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে মুসলিম ভূমি দীর্ঘকাল অধিকৃত থাকা কালে তারা সেটিকেই সুনিশ্চিত করেছে। মিশরে ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিনিধি লর্ড ক্রমার তাই বলেছিলেন, “মুসলিম দেশগুলিতে সেক্যুলার একটি শ্রেণী গড়ে না উঠা না পর্যন্ত তাদের অধিনত মুসলিম দেশগুলিকে স্বাধীনতা দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা।” আজও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের একই স্ট্রাটেজী। সে স্ট্রাটেজী নিয়ে আফিগানিস্তানকে আজও তারা অধিকৃত রেখেছে। সেক্যুলারিজমের মূল কথা ইহজাগতিক স্বার্থচেতনা নিয়ে বাঁচা। পারলৌকিক স্বার্থচেতনা এখানে কুসংস্কার ও পশ্চাদপদতা। সেক্যুলার মানুষ গড়তেই তারা শুধু সিনেমা ঘর, গানের স্কুল, নাট্যশালা ও স্টেডিয়ামই শুধু গড়ছে না, সেক্যুলার সেনাবাহিনী, প্রশাসন, আইন-আদালতও গড়ছে। তাই বাংলাদেশের মত দেশগুলি থেকে তাদের শাসনের অবসান ঘটলেও সেক্যুলারিষ্ট এজেন্ট প্রতিপালনের কাজ শেষ হয়নি। প্রতিটি মুসলিম দেশে ইসলামের বিপক্ষ শক্তিকে বলবান করতে কাফের শক্তির চলছে বিপুল বিনিয়োগ। সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে নাগরিকদের মনযোগ হঠাতেই রাষ্ট্রীয় খরচে বাড়ানো হচেচ্ছ নানা দিবস, নানা উৎসব, নানা রূপ খেলাধুলা ও নাচগানের মহা আয়োজন। অপরদিকে ইসলামচর্চা এবং ইসলামপন্থিদের রাজনীতির উপর লাগানো হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে জিহাদ বিষয়ক বইপত্র। এবং কারারুদ্ধ করা হচ্ছে ইসলামপন্থি নেতাকর্মীদের। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হয় ইসলামের শরিয়তী বিধানের বিরুদ্ধে ছাত্রশিক্ষকদের উত্তেজিত করতে। মুসলিম দেশগুলি ইসলামের শত্রুদের হাতে অধিকৃত হওয়ার কারণেই মুসলিম রাষ্ট্র এবং মুসলিম জনসংখ্যা বাড়লেও কোথাও আল্লাহর শরিয়তি বিধানের বিজয় সম্ভব হয়নি। ফলে সম্ভব হয়নি মহান আল্লাহর ইচ্ছাপূরণ। মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীনের সাথে এর চেয়ে বড় বেঈমানি আর কি হতে পারে? এমন বেঈমানি একমাত্র শয়তান ও তার মিত্রদেরই খুশি করতে পারে। কিন্তু তা নিয়ে সচেতনতা ও আত্মসমালোচনাই বা ক’জনের? আজকের মুসলমানদের ব্যর্থতা অনেক। তবে আল্লাহর হুকুমের সাথে বেঈমানির চেয়ে বড় ব্যর্থতা আছে কি? এ ব্যর্থতা তো নিশ্চিত জাহান্নামে নিয়ে পৌঁছায়।

মহান আল্লাহর নির্দেশের সাথে বেঈমানির শাস্তি নানা ভাবে আসে। সেটি শুধু পরাজয়ই আনে না, আযাবও আনে। মুসলিম ভূমিতে এজন্য শুধু বিভক্তিই আসেনি বা ইসরাইলেরই শুধু সৃষ্টি হয়নি, লাগাতর যুদ্ধ, রক্তপাত এবং দুর্ভিক্ষও এসেছে। এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। এ বিপদ এসেছে জাতিয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের হাতে। প্রশ্ন হলো, যে স্বাধীনতার নামে উসমানিয়া খেলাফতকে তারা ভাঙ্গলো সে স্বাধীনতা কি তাদের আদৌ এসেছে? বরং সৃষ্টি হয়েছে কাতার, কুয়েত, জর্দান, লেবানন, বাইরাইন, সৌদিআরব, ওমান, আমিরাতের মত এমন সব রাষ্ট্র যার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই, ঐতিহ্যও নাই। দেশগুলো শুধু নামে মাত্রই স্বাধীন। আসলে শাসিত হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অতি অনুগত দাসদের হাতে। অথচ দাসদের শাসন মুসলিম ইতিহাসে অতি পরিচিত। কিন্তু অতীতের সে দাসদের যেমন শক্তি ছিল, তেমনি স্বাধীনতা রক্ষার প্রবল ইচ্ছা ও সামর্থও ছিল। আজকের দাসদের ন্যায় তারা শক্তিহীন, পরাধীন এবং শত্রুশক্তির দাস ছিলেন না।

শুধু একখন্ড ভূগোল ও একটি পতাকা থাকলেই কি স্বাধীনতা থাকে? স্বাধীনতার সুরক্ষায় লোকবল, অর্থবল ও সামরিক বলও থাকতে হয়। থাকতে হয় স্বাধীনতারা সুরক্ষায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য একটি প্রবল দর্শন। ইসলাম তো সে দর্শনের বলটাই জোগায়। ২২টি আরব রাষ্ট্র এবং ৫৫টির উর্দ্ধে যে মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে সেগুলির কোনটির মাঝেও কি তা আছে? ইসলামি দর্শন বেঁচে না থাকলে সে আগ্রহও বেঁচে থাকে না। দেশগুলোর সামন্ত শাসকেরা বেঁচে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পুরাপুরি জিম্মি রূপে। কাতার, কুয়েত, বাইরান ও ওমানে যেভাবে মার্কিনীরা নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়েছে তাতে মনে হয় দেশগুলী যেন তাদেরই। বিজয় ও গৌরব তো মুসলিম ভূমি ভেঙ্গে ভেঙ্গে ক্ষুদ্রতর করাতে আসে না, রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও আসেনা। ভাষা, বর্ণ, ভূগোলের নামে মুসলিম দেশ ভাঙ্গা তো ইসলামের দুষমনদের কাজ। তেমন একটি খণ্ডিত মানচিত্র সৃষ্টির কাজে তো ইসলামের শত্রুরা নিজ অর্থ, নিজ রক্ত ও নিজ অস্ত্র ব্যয়ে প্রকাণ্ড যুদ্ধ লড়ে দিতেও রাজী। যেমন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্যে করেছে এবং ভারত করেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ভাঙ্গা ভূগোলে কোন বিশ্ব শক্তি গড়ে উঠেছে সে নজির সমগ্র মানব-ইতিহাসে নাই। সে জন্য বৃহৎ রাষ্ট্র চাই। সামরিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বলও চাই। মুসলিম অর্থই আল্লাহর সৈনিক। আর আল্লাহতায়ালা কি তাঁর সৈনিকদের মাঝে অনৈক্য চাইতে পারেন? তেমন অনৈক্যে কি তাঁর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা বাড়ে? বরং অনৈক্যে তো মহা বিপর্যয়, সে বিপর্যয় এড়াতেই মহান আল্লাহতায়ালাই তাঁর সৈনিকদের উপর একতাকে ফরজ ঘোষণা করেছেন। তারা বরং কোরআনে বর্নিত “বুনিয়ানুন মারসুস” তথা সীসাঢালা দেয়ালের মত অটুট হবে সেটাই মহান আল্লাহতায়ালার কামনা। একতার গুরুত্ব এমনকি কাফেরগণও বুঝে। কারণ তারাও তো বিজয় চায়। তাই বাঙালী-অবাঙালী, এবং নানা ভাষা ও নানা বর্ণে বিভক্ত ভারত তাই তার ভৌগলিক অখণ্ডতাকে সযন্তে ধরে রেখেছে। কিন্তু মুসলমানগণ তা পারেনি। সে বিভক্তি এনেছে জাতিয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টরা। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এটাই তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। মুসলিম উম্মাহর জীবনে তারা শুধু বিভক্তিই আনেনি, মুসলিম সভ্যতায় বিপর্যয়ও এনেছে। ফলে অসম্ভব হয়ে পড়েছে বিশ্বশক্তি রূপে পুণরায় মাথা তুলে দাঁড়ানো।

 

সবচেয়ে বড় বিপদটি

অনৈসলামিক রাষ্ট্রে বসবাসের বড় বিপদটি শুধু এ নয় যে, সেখানে মুসলমানগণ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়। বরং সবচেয়ে বড় বিপদটি হলো, মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাটি সেদেশে বিপদে পড়ে। ভয়ানক ভাবে ব্যর্থ হয় আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্বপালনে। ভূল পথে চলমান গাড়ীটি তা যত বিশাল,যত দামী বা যত উন্নত প্রকৌশলেরই হোক তাতে চড়ে বসাতে কি কোন কল্যাণ আসে? সেটি তো বরং ভ্রান্ত পথে নিয়ে যায়। ভারত, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার ন্যায় রাষ্ট্রগুলো বিশ্বশক্তিতে পরিনত হলেও তাতে কি সে রাষ্ট্রে বসবাসকারি মুসলমানদের কল্যাণ বাড়ে? বরং কোন মুসলিম দেশে এসব কাফের শক্তির দখলদারিতে তারা সৈনিকরূপে কাজ করে। মুসলমানদের কল্যাণ -সেটি যেমন এ দুনিয়ায় তেমনি আখেরাতে, নির্ভর করে মুসলমান রূপে বেড়ে উঠাতে। কিন্ত্র কোন অমুসলিম দেশে সেটি অতি দুরুহ হয়ে দাঁড়ায়। মুসলমানগণ আজকাল নিছক অর্থনৈতিক কারণে অমুসলিম দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। অথচ মুসলমানদের প্রয়োজনীয়তা নিছক অর্থনৈতিক নয়। সেটি যেমন আধ্যাত্মীক, তেমনি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক। সে প্রয়োজনটি অমুসলমানদের থেকে ভিন্নতর। ইসলামের আধ্যাত্মীক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে বেড়ে ব্যর্থ হলে তখন বিপন্ন পড়ে মুসলমান রূপে বেড়ে উঠার ন্যায় জীবনের মূল লক্ষ্যটি। তখন জীবনে বাঁচাটাই ব্যর্থ হয়। ভিন্ন ভাবে বেড়ে উঠার প্রয়োজনে মুসলমানের শিক্ষাগ্রত প্রয়োজনটিও অমুসলিমদের থেকে ভিন্নতর। মুসলমানদের খাদ্য-পাণীয়তে তেমন হালাল-হারামের বিষয় আছে তেমনি ভিন্নতা আছে তাদের শিক্ষার বিষয়েও। প্রয়োজনীয়তা রয়েছে শরিয়তের প্রতিষ্ঠারও। কারন শরিয়ত পালন ছাড়া ধর্ম পালনও পুরাপুরি হয় না। একারণেই ইসলামের শুরু থেকেই মুসলমানগণ কাফেরদের থেকে ভিন্নতর শুধু ইবাদতগাহই গড়েনি, ভিন্নতর রাষ্ট্রও গড়েছে। ভারত ভেঙ্গে মুসলমানগণ তাই পাকিস্তান গড়াকে অপরিহার্য মনে করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের রাষ্ট্রে পরিণত হলেও ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। ফলে দেশের জনগণ ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণও পায়নি। সে ভিশন নিয়ে আল্লামা ইকবাল পাকিস্তানের প্রস্তাবনা রেখেছিলেন তা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার মত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব পাকিস্তান কোন সময়ই পায়নি। এমনকি আলেমগণও মসজিদ ও মাদ্র্রাসার চারদেয়ালের বাইরে ইসলামের প্রতিষ্ঠা নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। তারাও দেশটিকে ইসলামি করার কাজে ময়দানে নেমে আসেনি। বরং তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই অতি সহজেই দেশটি জাতিয়তাবাদী, সমাজবাদী ও সেক্যুলারিস্ট শত্রুদের হাতে অধিকৃত হয়ে যায়।

অমুসলিম দেশে সংখ্যালঘু রূপে বসবাসকারি মুসলমানদের সংখ্যা আজ অনেক। তাদের পক্ষে সে সব দেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, হিসাবরক্ষক, কৃষিবিদ বা বিজ্ঞানী রূপে বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যালাভ জুটলেও মুসলমান রূপে বেড়ে উঠাটি বিপদে পড়ছে। সেটি ইসলামি জ্ঞানলাভ না হওয়ার কারণে। অথচ ইসলামি জ্ঞানলাভের দায়ভারটি মুসলমানদেরকে নিজ হাতে নিতে হয়। মুসলিম রাষ্ট্রে সে দায়িত্বটি সরকারের। বিদ্যাদান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের হাতিয়ার। মানুষের চরিত্রে মূল পরিবর্তনটি আসে তার চেতনায় পরিবর্তন থেকে। তাই চেতনার উপর নিজেদের দখলদারি বাড়াতে এজন্যই ইসলামের শত্রুপক্ষ মুসলিম ভূমিতে শত শত মিশনারি বিদ্যালয় খুলে। মুসলমানদের বিপদ তখনই বেড়েছে যখন তারা জ্ঞানার্জনের জন্য এসব মিশনারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে বা কাফের দেশে যাওয়া শুরু করেছে। খৃষ্টান ধর্মে ধর্মান্তর না হলেও এতে বেড়েছে ইসলাম থেকে দূরে সরার কাজ। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে অন্য ধর্মে দীক্ষা নেয়া আর ইসলাম থেকে দূরে সরার মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে? উভয়েই তো জাহান্নামে যাওয়াকে নিশ্চিত করে। ইসলাম থেকে দূরে সরার অর্থ তো সিরাতুল মোস্তাকীম থেকে দূরে সরা। মুসলিম নামধারি হয়েও এরূপ দূরে সরা লোকেরাই তো মুসলিম দেশে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে। হারাম পানাহারের ন্যায় হারাম শিক্ষালাভও যে ভয়ানক তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো তুরস্কের উসমানিয়া খেলাফত। জাতিয়তাবাদ, বর্ণবাদ, আঞ্চলিকতা, সেক্যুলারিজম –এসব মূলত পাশ্চাত্যের রোগ। এ রোগের প্রকোপে ইউরোপ বহু টুকরোয় বিভক্ত হয়েছে এবং বিভক্ত টুকরোগুলো শত শত বছর ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছে। অথচ এমন রোগ থেকে মুসলিম ভূমি ১৩ শত বছর মূক্ত থেকেছে। আরব¸ তুর্কী, কু্র্দি, মুর, আলবেনীয়, কোসোভান মুসলমানেরা তাই এক ভূ-খন্ডে শত শত বছর বসবাস করেছে। এক কাতারে শামিল হয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইও করেছে। কিন্তু তুর্কী ও অতুর্কী নাগরিগদের শিক্ষালাভের জন্য ইউরোপে পাঠানো হলো তখন তারা শুধু মদ্যপান,সূদ, বেপর্দাগী ও নাচগানের সংস্কৃতি নিয়েই ঘরে ফেরেনি। জাতিয়তাবাদ, বর্ণবাদ, আঞ্চলিকতা, সেক্যুলারিজমের সংক্রামক জীবাণূতেও তারা ভয়ানক ভাবে আক্রান্ত হয়েছে। তখন তারা ইসলামের পতাকা ফেলে দিয়ে এসব তুর্কী, আরব, কুর্দি জাতীয়তার পতাকা নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এমন একটি যুদ্ধে মুসলমানদের রক্তক্ষয় বাড়াতে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিল শত্রুপক্ষ। মক্কার শরিফ হোসেনদের ন্যায় অনেকেই সে অস্ত্র নিয়ে মুসলিম হত্যায় পাগল হয়ে উঠে। ফলে তুরস্ক উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে প্রায় তিরিশটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর এ রাষ্ট্রগুলো দ্রুত ইসলামের শত্রু পক্ষের হাতে অধিকৃত হলো; এবং অতি মিত্র হলো পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। এরা শরিয়তের প্রতিষ্ঠাই শুধু অসম্ভব করেনি, অসম্ভব করেছে বিশ্বশক্তি রূপে মুসলমানদের উত্থানেরও। একই রূপ জাতিয়তাবাদী ও সমাজবাদী সেক্যুলারিস্টগণ ব্যর্থ করে দিয়েছে উপমহাদেশের মুসলমানদের পাকিস্তান প্রজেক্ট। তারা কলেজ­-বিশ্ববি্দ্যালয়, প্রশাসন, রাজনীতি, সংস্কৃতি, মিডিয়াকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেছে আল্লাহ ও তাঁর শরিয়তি বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বাড়াতে।

 

জাহান্নামের জাহাজ

মুসলিম দেশগুলিতে আজ যে ভয়ানক বিপদ সেটি বাঁচিয়ে রেখেছে দেশগুলির সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা।এ শিক্ষা ব্যবস্থা রাষ্ট্রের অতি লোভী¸ চালাক ও দূর্নীতিপরায়নদের হাতে তুলে দেয় শিক্ষাদানের নামে স্বার্থশিকারের অত্যাধুনিক হাতিয়ার। এভাবে মানুষ পরিণত হয়েছে ভয়ানক শিকারি জীবে। দেশে দেশে তাদের হাতে যত রক্তপাত হযেছে তা বন্যপশুদের হাতেও হয়নি। তাদের জ্ঞান, মেধা ও শিক্ষালদ্ধ যোগ্যতার সবটুকুই ব্যয় হয় দুনিয়ার জীবনকে আরো ঐশ্বর্যময় করতে। অথচ তারাই হলো সবচেয়ে ব্যর্থ মানব। এবং ব্যর্থতার সে সার্টিফিকেটটি এসেছে মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেছেন, “বল (হে মুহাম্মদ), আমরা কি তোমাদেরকে বলে দিব কর্মের বিচারে কে সবচেয়ে ব্যর্থ? এরা হচ্ছে তারা যাদের জীবনের সকল প্রচেষ্ঠা নষ্ট হয়েছে এ দুনিয়ার জীবনের স্বাচ্ছন্দ বাড়াতে এবং ভাবে যে কর্মে তারা ভাল করছে। এরাই হচ্ছে তারা যারা আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকার করে এবং অস্বীকার করে পরকালে তার সাথে সাক্ষাতকেও অস্বীকার করে। তাদের কর্মকান্ড ব্যর্থ। এক আখেরাতের বিচারদিনে তাদের কর্মকে ওজনও করা হবে না। -(সুরা কাহাফ, আয়াত ১০৩-১০৫)। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা এমন ব্যর্থ মানুষদের সংখ্যাই বিপুল ভাবে বাড়িয়েছে।

শয়তান শুধু আল্লাহর দুষমন নয়, মানুষেরও সবচেয়ে বড় দুষমন। মহান আল্লাহতায়ারা পবিত্র কোরআনে সে সত্যটি বার বার শুনিয়েছেন। শয়তান শুধু হযরত আদম (আঃ) ও তাঁর বিবি হযরত হাওয়াকে জান্নাত থেকে বেরই করেনি, যাতে তার বংশধরগণ পুরণায় সে জান্নাতে ঢুকতে না পারে সে প্রকল্প নিয়েও দিবারাত্র কাজ করছে। একাজে শয়তানের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো রাষ্ট্র এবং সে রাষ্ট্রের সরকার, প্রশাসন ও সংস্কৃতি। সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা মূলত নাগরিকদের মহাক্ষতির সে শয়তানি প্রকল্প। এখানে লক্ষ্য, পরকাল ব্যর্থ করে দেয়া। অনৈসলামিক রাষ্ট্রের এটি এক ভয়ানক বিপদ। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় জাহান্নামের জাহাজে। সে জাহাজের যাত্রী হয় জনগণ। এবং সে জাহাজটির নির্মানে ব্যয় হয় জনগণের নিজ অর্থ, নিজ শ্রম ও নিজ মেধা। শয়তান এভাবেই কইয়ের তেলে কই ভাজে। প্রতি দেশে বেঈমানদের বড় কাজ হলো এ শয়তানী প্রকল্পকে সফল করা। অপর দিকে ঈমানদারদের উপর বড় দায়ভারটি হলো, এ শয়তানী প্রকল্পের বিরুদ্ধে সর্বভাবে রুখে দাঁড়ানো। নইলে তাদের পরকাল বাঁচে না। মুসলমানের জীবনে তো সেটাই জিহাদ। মুমিনের তাকওয়া তো সে সামর্থই বাড়ায়। পবিত্র কোরআনে তাই বলা হয়েছে, “যারা ঈমানদার তাঁরা জিহাদ করে আল্লাহর রাস্তায়, আর যারা কাফের তারা লড়াই করে শয়তানের রাস্তায়। সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; শয়তানের কৌশল অতিদুর্বল।” -(সুরা নিসা, আয়াত ৭৬)। মুসলিম রাষ্ট্রে শাসকের বড় দায়িত্বটি হলো জিহাদের দায়ভার পালনে মু’মিনদের সংগঠিত করা ও সর্বভাবে সহায়তা দেয়া। এভাবে শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে জিহাদকে লাগাতর জারি রাখা। এবং সেটি না হলে বুঝতে হবে নামে মুসলিম হলেও সরকার অযোগ্য ও দায়িত্বহীন। বরং কাজ করছে শয়তানের বন্ধু রূপে। অনৈসলামিক রাষ্ট্রে তো সেটিই ঘটে।

মাছের জন্য যেমন পানি, ঈমানদারের জন্য তেমনি হলো ইসলামি রাষ্ট্র। এ কারণেই অতীতে মুসলমানগণ যেখানে ঘর গড়েছে, সেখানে ইসলামি রাষ্ট্রও গড়েছে। সে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় ও প্রতিরক্ষায় যখনই ডাক পড়েছে তখন সকল মুসলমান ময়দানে নেমে এসেছে। জানমালের বিশাল কোরবানীও দিয়েছে। তাবুক যুদ্ধের সময় মুনাফিকগণ ছাড়া কোন সামর্থবান মুসলমান পুরুষ তাই ঘরে বসে ছিল না। অন্য কোন জাতির জীবনে এমন ইতিহাস একটি বারের জন্যও নির্মিত হয়নি। মুসলমানের জীবনে এটিই হলো সবচেয়ে বড় দায়িত্বশীলতা। কিন্তু অনৈসলামি রাষ্ট্রের প্রধান ষড়যন্ত্র হলো ঈমানদারের জীবন থেকে সে দায়িত্বশীলতাকে নির্মূল করা। মুসলমানের জীবনে যে এমন একটি দায়ভার আছে সেটিকেই নানা ভাবে ভূলিয়ে দেয়া। তাই যেখানে ইসলামি রাষ্ট্র নাই সেখানে মসজিদ-মাদ্রাসা, নামায-রোযা বাড়লেও সে দায়িত্বশীলতা বাড়ে না। এবং সে দায়িত্বশীলতা না থাকার কারণেই মুসলিম দেশগুলিতে আজ জাতি, গোত্র, ভাষা, ভূগোল, দল ও নেতার নামে যুদ্ধ ও রক্তপাত বাড়লেও বাড়েনি ইসলামি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই ও কোরবানি। সাহাবায়ে কেরামের ধর্মপালন থেকে আজকের মুসলমানের ধর্মপালনে এখানেই বড় পার্থক্য। ফলে মুসলমানদের রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়লেও সমগ্র ধরাপৃষ্ঠে একখানি ইসলামি রাষ্ট্রও নির্মিত হয়নি। ফলে কোথাও মহান আল্লাহর শরিয়তি বিধান যেমন প্রতিষ্ঠা পায়নি, তেমনি সে মহান বিধানটি সম্মানিতও হয়নি। বরং মুসলমানদের শ্রম, মেধা, অর্থ ও রক্তের কোরবানিতে বিজয়ীর বেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে জাতিয়তাবাদ, গোত্রবাদ, সমাজবাদ, পুঁজিবাদ, স্বৈরতন্ত্র, সেক্যুলারিজমের ন্যায় নানা নামের ও নানারূপের জাহিলিয়াত। এবং গৌরব বেড়েছে নানা দল, গোত্র ও নেতার। আল্লাহ ও তাঁর মহান দ্বীনের বিরুদ্ধে বড় বেঈমানি আর কি হতে পারে? মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর সরকারের কাজ হয়েছে সে বেঈমানিকে লাগাতর বাড়ানো। মুসলিম ভূমিতে অনৈসলামি রাষ্ট্রগুলো তো বেঁচে থাকে সে বেঈমানির উপর। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছাড়া এরূপ অবিরাম অকল্যাণ থেকে মুক্তি আছে কি? ২২/০৬/২০১২; দ্বিতীয় সংস্করণ ১০/০৫/২০১৪।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *