অনৈসলামী রাষ্ট্রের অকল্যাণ এবং অনিবার্য কেন ইসলামী রাষ্ট্র?
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on February 8, 2021
- Bangla Articles, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
অকল্যাণ কেন অনৈসলামী রাষ্ট্রে?
রোগব্যাধীর নাশকতা নিয়ে কারোই কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় বড় নাশকতাগুলো রোগব্যাধীর কারণে হয় না। সেটি হয় রাষ্ট্র অসুস্থ্যু ও অকল্যাণকর হলে। তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। কোটি কোটি মানুষের জীবনে দুর্যোগ ও অশান্তি নেমে আসে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, গণহত্যা, জাতিগত ও বর্ণগত নির্মূল, স্বৈরাচার, যুদ্ধবিগ্রহ ও বিশ্বযুদ্ধের যে ভয়াবহ নাশকতা –তা তো অসুস্থ্য ও অকল্যাণকর রাষ্ট্রের কারণেই। বস্তুত মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক বিপর্যয়গুলো গ্রামগঞ্জে বাস করা চোর-ডাকাতদের হাতে হয়নি। রোগ-ভোগ, মহামারি বা ঝড়-তুফানের হাতেও হয়নি। বরং হয়েছে ঘাতক মতবাদ ও নৃশংস দুর্বৃত্তদের হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত হওয়াতে। বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধে এ দুর্বৃত্ত শ্রেণী সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। ধ্বংস করেছে শত শত নগর-বন্দর। বিনাশ ঘটিয়েছে বহু ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ।
তাই মানব জাতির সবচেয়ে বড় দুষমন হলো দুর্বৃত্ত-অধিকৃত রাষ্ট্র। রাষ্ট্র তখন অপরাধ কর্মের হাতিয়ার পরিণত হয়। পরিণত হয় দুর্বৃত্তায়নের ইন্ডাস্ট্রীতে। তখন রাষ্ট্রীয় নীতি হয় জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, জাতিগত নির্মূল, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের ন্যায় মানবতা বিধ্বংসী মতবাদ। রাষ্ট্রের রোগমুক্তি ছাড়া তাই ব্যক্তির বা জনগণে মুক্তি সম্ভব নয়। তাই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কোর’আনে শুধু মানবকে পথ দেখাননি, পথ দেখিয়েছেন রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধিরও। এ জন্যই নবীজী (সা:) শুধু নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিল শেখাননি; শিখিয়েছেন কি ভাবে কল্যাণকর রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হয় –মানব সভ্যতার সবচেয়ে ব্যহবহুল সে প্রকল্পটিও। রাষ্ট্র নির্মাণের সে জটিল ও গুরুত্বপুর্ণ কাজটি হাতে কলমে শেখানোর প্রয়োজনে তিনি নিজে বসেছেন রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে। এটি নবী জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূন্নত। মুসলিমগণ তাদের গৌরব কালে যেরূপ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিল –তার মূলে ছিল এই ইসলামী রাষ্ট্র, স্রেফ মসজিদ মাদ্রাসা নয়। এ রাষ্ট্র যে শুধু দুনিয়াতে কল্যাণ দেয় -তা নয়। কাজ করে জান্নাতে নেয়ার বাহন রূপেও। এবং যে ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল নবীজী (সা:) খাড়া করেছিলেন তার বাইরে যত রকমের রাষ্ট্র -তা সবই অনৈসলামী। পৃথিবী পৃষ্ঠের উপর বিরাজমান সকল বিপর্যের কারণ হলো এ অনৈসলামী রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রগুলো শুধু এ দুনিয়ার জীবনে অশান্তি বাড়ায় না, কাজ করে জাহান্নামে নেয়ার বাহন রূপে। তাই মানবের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর কাজটি কাউকে পানাহার দেয়া বা ঘরবাড়ী গড়ে দেয়া নয়, বরং অনৈসলামী রাষ্ট্রের নির্মূল ও ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ইসলাম এ কাজকে পবিত্র জিহাদের মর্যাদা দিয়েছে।
ব্যক্তির ন্যায় রাষ্ট্রও কল্যাণকর বা অকল্যাণকর হয় আদর্শের গুণে। অনৈসলামী রাষ্ট্র তো তাই -যেখানে ইসলামী আদর্শের কোন স্থান নাই্। আর রাষ্ট্রে ইসলামী আদর্শ না থাকলে আদর্শিক শূণ্যতা বিরাজ করে না; সেখানে কাজ করে অনৈসলামী তথা শয়তানী আদর্শ। পবিত্র কোর’আনে আদর্শের বিভাজনটি দ্বিভাগে: হক ও বাতিলের তথা ইসলাম ও অনৈসলামের। তৃতীয় কোন আদর্শিক পক্ষের স্থান ইসলামে নাই। ইসলাম ভিন্ন সকল আদর্শই অনৈসলামী। আর যে ইসলাম নিয়ে বাঁচে তাকে অবশ্যই বাঁচতে হয় সুবৃত্তি নিয়ে। এবং হারাম গণ্য হয় দুর্বৃত্তি নিয়ে বাঁচা। দুর্বৃত্তির পথটি হলো শয়তানের পথ তথা অনৈসলামের পথ। এমন অনৈসলামী পথে শান্তি আসবে -সেটি বিশ্বাস করাই হারাম। এমন বিশ্বাসে গাদ্দারী হয় মহান আল্লাহতায়ালার প্রদর্শিত পথের সাথে। তাছাড়া অনৈসলামী পথে চলার বিপদটি অতি ভয়ানক। সে পথের অনুসারিগণ হাতে অস্ত্র পেলে অঘটন ঘটায়। তাদের লক্ষ্য শুধু ধনসম্পদ লুন্ঠন নয়; বরং সেটি রাষ্ট্রের উপর একচ্ছত্র প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার। উদ্দেশ্যটি এখানে লুন্ঠনের পরিধিকে রাষ্ট্রময় করা। দেশের পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী, আদালত ও প্রশাসনসহ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানগুলি যখন দুর্বৃত্ত কর্মে হাতিয়ারে পরিণত হয়। তখন জনজীবনে নেমে আসে মহা-অকল্যাণ। অবিচার, অত্যাচার, সন্ত্রাস, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হত্যা ও গণহত্যার ন্যায় নানারূপ অপরাধ কর্ম তখন রাষ্ট্রের নীতি বা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায়। ফিরাউন-নমরুদের ন্যায় দুর্বৃত্তগণ যখন রাষ্ট্রের উপর তাদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছিল তখন নিজেদেরকে শুধু রাজা রূপে নয়, খোদা রূপেও প্রতিষ্ঠা করেছিল। এমন দুর্বৃত্তকবলিত রাষ্ট্রে সত্য, সুশিক্ষা, সুনীতি ও সুবিচার মারা পড়ে। এমনকি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ)র মত মহামানবগণও সে সমাজে ভাল আচরণ পাননি। বরং তাদেরকেও নির্মম হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখনই হালাকু-চেঙ্গিজ-হিটলারদের ন্যায় দুর্বৃত্তদের হাতে গেছে তখনই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নির্মম নির্যাতন ও মৃত্যু নেমে এসেছে।
মুসলিমগণ আজ বিশ্বশক্তির মর্যাদা হারিয়ে পদে পদে পরাজয়ের যে গ্লানি বইছে -সেটিও রোগ-ভোগ, ভূমিকম্প বা ঝড়-তুফানের কারণে নয়। বরং মুসলিম রাষ্ট্রগুলো দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হওয়ায়। এ ব্যর্থতা রাজনৈতিক। এবং সে বিপর্যয় যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তারই আধুনিক উদাহরণ হলো আজকের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ আজ পথে ঘাটে লাশ হচ্ছে, গুম হচ্ছে, ধর্ষিতা হচ্ছে এবং নানা ভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশের জলবায়ু বা ভূপ্রকৃতিকে দায়ী করা যায় না। বরং মূল কারণটি হলো, রাষ্ট্র অধিকৃত হয়েছে নৃশংস দুর্বৃত্তদের হাতে। তাদের হাতে দেশের পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত ও প্রশাসনসহ সমগ্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে নির্যাতনের হাতিয়ারে। রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে জঙ্গলে। জঙ্গলে আদালত থাকে না। আইনও থাকে না। ফলে জঙ্গলে মানুষ লাশ হলে বা ছিনতাই হলে বিচার হয় না। তেমনি বিচার হয় না বাংলাদেশেও। ফিরাউন, নমরুদ, হালাকু ও চেঙ্গিজের আমলে মানুষ যেমন জানমালের নিরাপত্তা হারিয়েছিল, একই রূপ অবস্থা এ দেশে। বাংলাদেশের মানুষের বড় দুষমন তাই রোগজীবাণু, ঝড়-তুফান বা চোরডাকাত নয়; শত্রু এখানে খোদ রাষ্ট্র ও তার সরকার।
রাষ্ট্রের শক্তি ও গুরুত্ব
ইসলামই একমাত্র ধর্ম -যা রাষ্ট্রের শক্তি-সামর্থ্য ও গুরুত্বকে সঠিক ভাবে সনাক্ত করেছে। এবং মানব সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী এ প্রতিষ্ঠানটির পরিশুদ্ধিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। অন্য ধর্মে রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে দখলে নেয়ার নির্দেশ নেই। কিন্তু ইসলামে সে কাজে অর্থ ও জানের বিনিয়োগে বার বার নির্দেশ এসেছে। ইসলামের নবী তাই শুধু ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না, রাষ্ট্রীয় প্রধানও ছিলেন। এরূপ ভিন্নতর নির্দেশের কারণ, মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা থেকে গোপন নয় রাষ্ট্রের প্রবল ক্ষমতাটি। ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেক কর্মটি তাই নফল নামায-রোযা বা দান-খয়রাত নয়। মহল্লার চোর-ডাকাতদের ধরাও নয়। বরং দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রাষ্ট্রকে বাঁচানো। ইসলামে সেটি সর্বোচ্চ ইবাদত। ইসলামে সে প্রচেষ্টাকেই জিহাদ বলা হয়। নবীজী (সাঃ) ও তার সাহাবাদের জীবনে সবচেয়ে বড় কোরবানী দিতে হয়েছে সে জিহাদে। রাষ্ট্রকে নিজেদের দখলে রাখতে নবীজী (সা:)’র শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবী শহীদ হয়েছেন।
একটি দেশ কতটা সভ্য রূপে গড়ে উঠবে সে ফয়সালাটি দেশের কলকারখানা, ক্ষেতখামার, রাস্তাঘাট বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা থেকে নির্ধারিত হয় না। বরং সেটি নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রকে ইসলামি করার কাজে কতটা জিহাদ হলো -তা থেকে। জিহাদ হলো ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধির লক্ষে এক লাগাতর প্রক্রিয়া। লক্ষ্য, দুর্নীতির নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। তাই যে দেশে সে জিহাদ নাই, সে দেশে আসে দুর্বৃত্তির সয়লাব। সে প্রমাণও দেখা যায় বাংলাদেশ। আবর্জনা এমনিতে সরে না। সেটি সরানোর কাজ না হলে সমগ্র দেশ তখন আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়। সে সরানোর কাজটিই করে জিহাদ। রাষ্ট্র ইসলামী হলে জিহাদ তখন জনজীবনের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায় –যেমনটি হয়েছিল সাহাবাদের জীবনে। বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছরে যত কলকারখানা, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল বা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে -তা দেশটির সমগ্র ইতিহাসেও নির্মিত হয়নি। কিন্তু তাতে কি বাংলাদেশের মানুষের সভ্য রূপে বেড়ে উঠাটি নিশ্চিত হয়েছে? নির্মূল হয়েছে কি দুর্নীতি? বরং নির্মিত হয়েছে বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে কদর্যকর ইতিহাস। সেটি হলো দুর্নীতিতে বিশ্বমাঝে ৫ বার প্রথম হওয়ার খেতাব।
ব্যর্থ রাষ্ট্রের নাশকতা
ব্যর্থ রাষ্ট্রের নাশকতাটি ভয়াবহ। সে ব্যর্থতাটি প্রকট ভাবে দেখা যায় মানব গড়ার ক্ষেত্রে। যে কোন সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কলকারখানা, রাস্তাঘাট বা হাসপাতাল গড়া নয়। বরং সেটি হলো সৎ ও সভ্য মানুষ গড়া। এ খাতে ব্যর্থ হলে অন্যখাতে যত সফলতাই আসুক -তা দিয়ে সত্যিকার কল্যাণ আসে না। অথচ বাংলাদেশে এটিই হলো সবচেয়ে ব্যর্থ খাত। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উৎপাদন বাড়িয়েছে চোরডাকাত, ব্যাংক-ডাকাত ও ধর্ষকের। এবং বিপুল সংখ্যায় দুর্বৃত্ত জুগিয়েছে শুধু রাজনীতির অঙ্গণেই নয়, বরং পুলিশবাহিনী, সেনাবাহিনী, আদালত এবং প্রশাসনে। এসব দুর্বৃত্তগণ সরকারি লেবাস পড়ে চুরিডাকাতি ও মানুষ খুন করে। ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বর তো এমন সরকার প্রতিপালিত খুনিদের হাতেই রক্তাত্ব হয়েছে। আদালতের বিচারকগণও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে খুন করছে কলমের খোঁচায়। এমন সহিংস দুর্বৃত্তিতে রেকর্ড গড়েছে মিশরের এক বিচারক। একদিনে সে ৬ শত সরকার বিরোধীদের ফাঁসির নির্দেশ দিয়েছে।
একটি গাছ জন্মাতে হলেও সে গাছের প্রতি নিয়মিত পরিচর্যা চাই। গাছের গোড়ায় পানি ঢালার পাশাপাশি বেড়ে উঠার জন্য নিয়মিত প্রহরাও চাই। নিরাপদ পরিবেশও চাই। নইলে গাছের গোড়ায় দুষ্ট মানুষের হাত পড়ে। সে তুলনায় সমাজে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো মানুষগড়া। পিতামাতার ঘরে শিশু জন্ম নেয় বটে, কিন্তু সে শিশু বেড়ে উঠে শিক্ষা, সংস্কৃতি,সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবেশে। শিশু মানবিক গুণে গড়ে তোলার কাজে পিতামাতার পাশে তাই রাষ্ট্র ও সমাজের লাগাতর সংশ্লিষ্টতাও চাই। নইলে অতি মহৎ ও আলেম ব্যক্তির ঘরেও অতিশয় দুর্বৃত্ত বেড়ে উঠে। রাষ্ট্র সে সৃষ্টিশীল কাজটি করে উপযুক্ত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে। কিন্তু সেটি অসম্ভব হয় রাষ্ট্র দুর্বৃত্তদের হাতে জিম্মি হলে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ খাতটিও তখন দুর্বৃত্তগড়ার কারখানায় পরিণত হয়। অনৈসলামিক রাষ্ট্রের এটিই হলো সবচেয়ে বড় বিপদ। ফলে ইসলামের ন্যয় যে ধর্মটি মানবের কল্যাণ নিয়ে ভাবে, সেটি রাষ্ট্রের দখলদারি কাদের হাতে থাকবে বা কোন আইন নিয়ে পরিচালিত হবে -সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কখনোই নীরব থাকতে পারে না। কোরআনের ছত্রে ছত্রে তাই সমাজ ও রাষ্ট্রপরিচালনা নিয়ে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। রয়েছে শরিয়তী আইন।
কেন ইসলামি রাষ্ট্র?
ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি কোন ইসলামী দলের রাজনৈতিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। কোন মৌলবাদী মুসলিমের রাজনৈতিক ভাবনাও নয়। বরং সে প্রকল্পটি খোদ মহান আল্লাহতায়ালার। শুধু মাত্র মুসলিম ভূমিতে নয়, সমগ্র বিশ্বব্যাপী। তিনি চান, প্রতিটি মানুষ তাঁর অনুগত বান্দাহ রূপে বেড়ে উঠুক, এবং সমগ্র বিশ্ব তাঁর দ্বীনের আলোকে আলোকিত হোক। মানব জাতির মহাকল্যাণ তো একমাত্র এ পথেই। মহান আল্লাহর সে মহান ইচ্ছাটি ছড়িয়ে আছে পবিত্র কোর’আনে। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সে পবিত্র এজেন্ডার সাথে পুরাপুরি একাত্ম হওয়া। এবং সে লক্ষ্য অর্জনে জানমালের বিনিয়োগ করা। মু’মিন ব্যক্তির ঈমান বৃদ্ধির সাথে সে বিনিয়োগটিও বাড়ে। মহান আল্লাহতায়ালার চান না যে, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হোক। জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর কাজকে ত্বরান্বিত করতেই মহান আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে হাজার হাজার নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। এ কাজে এ পৃথিবী পৃষ্ঠে রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী কোন প্রতিষ্ঠান নাই। তিনি চান, জনগণকে আগুন থেকে বাঁচানোর কাজে রাষ্ট্র তার দায়িত্বটি পালন করুক। এবং তাঁর খলিফা রূপে কাজ করুক রাষ্ট্রপ্রধান। খোলাফায়ে রাশেদার আমলে তো –সেটিই হয়েছে।
জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর এ বিশাল কাজটি কিছু আলেম-উলামার কাজ নয়। কোরআন-হাদীসের কিছু জ্ঞান বিতরণ, অবসর সময়ের তাবলিগ, কিছু ওয়াজ-নসিহত বা কিছু দানখয়রাতের মাধ্যমেও এ বিশাল কাজ সম্ভব নয়। এ কাজটি যেমন অতি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বিশাল। এ বিশাল কাজটি ইসলামের চর্চা ও ধর্মপালনকে মসজিদ-মাদ্রাসায় সীমিত রেখে সম্ভব নয়। ইবাদতকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখেও সম্ভব নয়। এ কাজটি অসাধ্য এবং অভাবনীয় হয়ে পড়ে যদি রাষ্টের ন্যায় মানব সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটি ইসলামের বিপক্ষশক্তি বা ইসলামে অঙ্গিকারহীন ব্যক্তিবর্গের হাতে যায়। নমরুদ, ফিরাউন, আবু লাহাব, আবু জেহলদের হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত থাকলে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, ইসলামের অনুসারিদের পক্ষে প্রাণে বাঁচাই কঠিন হয়। তাদেরকে ক্ষমতায় রেখে সেটি সম্ভব হলে ইসলামের শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মহম্মদ(সা:) ও তাঁর সাহাবগণ কেন রক্তাত্ব যুদ্ধ-বিগ্রহে বিপুল অর্থদান, শ্রমদান এবং প্রাণদানের পথ বেছে নিলেন? কেন ধর্মকর্ম নিছক কোরআন পাঠ, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ, এবং নামায-রোযা-হজ-যাকাতে সীমিত রাখলেন না?
মানুষকে জাহান্নামে নেয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার যেমন রাষ্ট্র, তেমনি সে আগুন থেকে বাঁচানোরও শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো রাষ্ট্র। তাই নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের আমলে মুসলিমদের জানমালের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগটি হয়েছে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। হযরত মুহাম্মদ (সা:)’র আগে লক্ষাধিক নবী-রাসূল এসেছেন। তাদের সবারই ধর্ম ছিল ইসলাম। কিন্তু জাহান্নামের আগুন থেকে যত মানুষকে ইসলামের শেষনবী হযরত মহম্মদ (সা:) রক্ষা করেছেন তা অন্য কোন নবীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। অন্য কোন নবীর দ্বারা ইসলামের বিশ্বময় প্রচার এবং ইসলামী সভ্যতার নির্মাণও ঘটেনি। অনেক জ্ঞানি ব্যক্তিই সমতা, নারী স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার এবং শ্রেণীভেদ ও বর্ণবাদবিরোধী বড় বড় নীতি কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু কেউ কি তা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন? কিন্তু নবীজী (সা:) পেরেছেন। এজন্য এমনকি বহু অমুসলিমও তাঁকে মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের মর্যদা দেন। মাইকেল হার্ট তাঁর বিখ্যাত বই “দি হানড্রেড”য়ে একশত শ্রেষ্ঠ মানুষের মাঝে হযরত মহম্মদ (সা:)কে প্রথম স্থান দিয়েছেন তো সে বিচারবেোধেই। কিন্তু কীরূপে সম্ভব হলো নবীজী (সা:)’র হাতে সে বিশাল অর্জন? হযরত মুহাম্মদ (সা:)’র এ সফলতার কারণ তাঁর ও তাঁর মহান খলিফাদের হাতে শুধু আল্লাহর দেয়া হেয়ায়েতের গ্রন্থ পবিত্র কোর’আনই ছিল না, বিশাল রাষ্ট্র ও তার প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলিও ছিল। কিন্তু আজ ঈমানদারদের হাতে কোরআন আছে, তাদের জীবনে নামায-রোযাও আছে। কিন্তু রাষ্ট্র নেই। তাবলিগের ইজতেমায় শুধু তিরিশ-চল্লিশ লাখ নয়, কোটি কোটি মানুষের সমাবেশ বাড়িয়েও কি সফলতা জুটবে? সেটি তো নবীজীর সূন্নত নয়। ইসলামের প্রতিষ্ঠা তো ইজতেমায় হয় না। নামাযী ও রোযাদারদের সংখ্যাবৃদ্ধিতেও হয় না। এজন্য তো রাষ্ট্রের উপর থেকে দুর্বৃত্তদের হটিয়ে ঈমানদারদের দখলদারিটা চাই।
রাষ্ট্র ইসলামি হলে জাহান্নামের আগুন থেকে মানুষকে বাঁচানোর কাজে কোরআন-হাদীস, মসজিদ-মাদ্রাসা ও আলেম-উলামাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠানগুলোও দিবারাত্র কাজ করে। তখন দেশ জুড়ে যে বিশাল রাজপথটি দৃশ্যমান হয় সেটি সিরাতুল মুস্তাকীম; আল্লাহর অবাধ্যতার রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি নয়। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তখন বিলুপ্ত করা হয় আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সকল পথ। বাঘ-ভালুককে জনপদে মূক্ত ছেড়ে দিয়ে কি সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া যায়? তেমনি আল্লাহর বিরুদ্ধাচারি লক্ষ লক্ষ সশস্ত্র বিদ্রোহীকে সর্বপ্রকার সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে জান্নাতের পথ রুখার অধিকার দিলে কি সাধারণ মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো যায়? সমগ্র আরব ভূমি, পারস্য, মিশর, মধ্য-এশিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব ভাগ জুড়ে সাধারণ মানুষের দলে দলে ইসলামের প্রবেশের যে জোয়ার শুরু হয় -সেটি তো আল্লাহর শত্রুদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং সামরিক শক্তি ছিনিয়ে নেয়ার পর। তার আগে নয়। তাদের নির্মূলে অপসারিত হয়েছিল জান্নাতের পথে চলার সকল বাধা।
রাষ্ট্র: পথভ্রষ্ট করার হাতিয়ার
রাষ্ট্রের দখলদারি যেখানেই কাফেরদের হাতে রয়ে গেছে সেখানেই ইসলামের গাড়ি আর সামনে এগুতে পারেনি। মানব পায়নি সিরাতুল মোস্তাকীম। রাষ্ট্রের বুক থেকে সে বাঁধা সরানো এবং ইসলামি রাষ্ট্রকে নিরাপদ করাটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে মক্কা বিজয়ের পর মহান আল্লাহতায়ালা কাফেরদের জন্য চার মাস সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। এ চার মাসের মধ্যে ইসলাম কবুল না করলে তাদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে হত্যার নির্দেশ দিযেছিলেন।-(সুরা তাওবাহ, আয়াত ২-৩)। কারণ, বিদ্রোহীদের অপতৎপরতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবাধে চলতে দিলে সে রাষ্ট্র বাঁচে না। ইসলামও তার মজবুত শিকড় নিয়ে সমাজ ও সংস্কৃতি নির্মানের সুযোগ পায় না। তাছাড়া আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের বিরুদ্ধে মক্কার কাফেরদের সশস্ত্র বিদ্রোহটি তো গোপন বিষয় নয়। নবীজী (সাঃ)র নবুয়তের প্রথম দিন থেকেই তারা ছিল ইসলাম ও ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সক্রিয় শত্রু। মদিনার সদ্য-প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র ইসলামি রাষ্ট্রকে সূতিকা ঘরে নির্মূল করতে তারা মক্কা থেকে মদিনায় গিয়ে বার বার হামলা করেছে। দেহের অভ্যন্তরে প্রাণনাশক জীবাণূ নিয়ে কোন দেহই সুস্থ্যতা পায় না, বাঁচেও না। তেমনি রাষ্ট্রও বাঁচে না যদি তার অভ্যন্তরে শত্রুরা বেড়ে উঠার সুযোগ পায়। তাই মক্কা বিজয়ের পর শত্রুদের আত্মসমর্পণ বা হত্যা –এ ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ ঘোষণা। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও তার সুরক্ষা যে মহান আল্লাহর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি কি এ কোর’আনী হুকুমের পরও বুঝতে বাঁকি থাকে? সেটি না হলে খোদ মুসলিম ভূমিতেই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অসম্ভব হয়ে পড়ে ইসলামের বিজয়কে ধরে রাখা। অসম্ভব হয় প্রতিবেশী দেশের নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষ নেয়া বা তাদের সাহায্য করা। বাংলাদেশের মুসলিমগণ সে কারণেই পারছে না আরাকান, ভারত ও কাশ্মিরের নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষ নিতে। কারারুদ্ধ জিন্দানীরা ইচ্ছা করলেই পাশের জিন্দানীর বিপদে সাহায্য করতে পারে না। সে জন্য কারামূক্ত স্বাধীনতা লাগে। তেমনি অবস্থা অধিকৃত দেশের নাগরিকদের। বাংলাদেশ এখান ইসলামপন্থিদের জন্য জেলখানা, এখানে দখলদারিটি ইসলামের শত্রুপক্ষের। সরকারের ভূমিকা এখানে কারাপ্রশাসকের। ফলে তাদের দখলদারিতে বাংলাদেশের মুসলিমগণ আরাকান, কাশ্মির, ফিলিস্তিন বা ভারতের মজলুম মুসলিমদের পক্ষ নিবে -সেটি কি ভাবা যায়? ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসলামের শত্রু পক্ষের কর্তাব্যক্তিগণ কি বাংলাদেশের নাগরিকদের সে অধিকার দিবে?
আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের কাজটি যেমন সর্বসময়ের, তেমনি সে কাজের পরিধিও বিশাল। সেটি রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে জুড়ে। অপরদিকে শয়তান ও তার অনুসারিদের শক্তিও কম নয়। তাদের হাতে অধিকৃত হলো অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র ও সে সব রাষ্ট্রের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অধিকৃত সে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে হামলাও হচ্ছে লাগাতর। সে হামলা থেকে মুসলিমদের প্রতিরক্ষা দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বা দল নিতে পারে না। সে লক্ষ্যে মুসলিমদেরও ইসলামি রাষ্ট্র গড়তে হয়। সে রাষ্ট্রের দায়ভারও নিতে হয়।
সবচেয়ে বড় নিয়ামত
রাষ্ট্রের দায়িত্বটি শুধু জনস্বার্থে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা ও হাসপাতাল নির্মাণ নয়, বরং সর্ব-প্রকার ভ্রান্ত ধর্ম ও মতবাদের হামলা থেকে মুসলিমদের লাগাতর প্রতিরক্ষা দেয়া। এবং প্রতিরক্ষার সে যুদ্ধটিকে লাগাতর জারি রাখা। নইলে অসম্ভব হয় নাগরিকদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো। খোদ নবীজী (সাঃ) এবং খোলাফায়ে রাশেদার আমলে সে কাজটি লাগাতর করেছে রাষ্ট্র এবং সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। ফলে এমন দেশে জান্নাতের পথ খুঁজে পাওয়াটি তখন সহজ হয়ে যায়। অল্প বিদ্যা-বুদ্ধির মানুষগুলোও তখন জান্নাতে পৌঁছতে পারে। ইসলামি রাষ্ট্রের কারণেই আরবের নিরক্ষর বেদূঈনগণও তখন জন্ম থেকেই ঘরের সামনে ও চোখের সামনে সিরাতুল মুস্তাকীম দেখতে পেয়েছিল। সে পথে চলার ঈমানী সামর্থও পেয়েছিল। সেটি না হলে সাধারণ নাগরিক দূরে থাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকশ প্রফেসর, প্রবীন বুদ্ধিজীবী, পীর-দরবেশ, আলেম-উলামা এবং বড় বড় ডিগ্রিধারিরাও তখন পথভ্রষ্ট হয়। সেটির প্রমাণ আজকের মুসলিম দেশগুলী। পৃথিবীতে মুসলিম রাষ্ট্র ও মুসলিমদের সংখ্যা বাড়লেও এসব মুসলিম দেশে সিরাতুল মোস্তাকীম গড়ে উঠেনি। ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি সংস্কৃতি এবং আল্লাহর নির্দেশিত শরিয়তি বিধানও প্রতিষ্ঠা পায়নি। শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ছাড়া কি সিরাতুল মোস্তাকীমে চলা যায়? শরিয়ত মোতাবেক পথ চলাই তো হলো সিরাতুল মোস্তাকীম। আর সে সিরাতুল মোস্তাকীমে চলাটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে নামাযের প্রতি রাকাতে সে জন্য “ইহদিনাস সিরাতুল মোস্তাকীম” বলে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হয়। মুমিনের জীবনে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোয়া যা শিখিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। এ দোয়া না পড়লে নামাযই হয় না। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম দেশে রাষ্ট্রীয় ভাবে যেটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেটি সিরাতুল মোস্তাকীম নয়, বরং সেটি সূদ, ঘুষ, সেক্যুলার রাজনীতি, মিথ্যাচর্চা, জুয়া, বেপর্দাগী, অশ্লিলতা, পতিতাবৃত্তি ও জাতীয়তাবাদের জাহিলিয়াতের ন্যায় পাপাচারকে আচার রূপে মেনে নেয়ার জাহান্নামমুখি এক ভয়ানক পথভ্রষ্টতা।
পরিপূর্ণ এক ইসলামি রাষ্টীয় বিপ্লবের ফলেই সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র জান্নাতমুখি হয়। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় জান্নাতমুখি এক চলন্ত জাহাজে, এবং নাগরিকগণ হয় সে জাহাজের যাত্রী। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এটিই হলো সবচেয়ে বড় নিয়ামত। রাষ্ট্রের বহু কাজই জনকল্যাণকর। এ জীবনকে আনন্দময় করার জন্য ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, কৃষি-শিল্প, পানি-বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যসেবা জরুরি হলেও সে গুলো অন্তহীন আখেরাতে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে পারে না। সে জন্য সিরাতুল মোস্তাকীম চাই, চাই সে পথে চলার আধ্যাত্মীক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বল। রাষ্ট্রের বড় দায়িত্ব হলো জনগণের মধ্যে সে সামর্থ্য সৃষ্টি করা। রাষ্ট্র সে কাজটি করে আল্লাহর পথনির্দেশনা বা হেদায়েতের বাণীকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে। এ হেদায়েত বা পথনির্দেশনাই হলো মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। সে নেয়ামত বয়ে আনতেই আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবী পৃষ্টে তাঁর মহান ফেরেশতা জিবরাইল (আ:) নেমে এসেছেন। নবীরাসূলগণের মূল কাজটি ছিল সে পথনির্দেশনাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া। মানব সমাজে এর চেয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই। কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়ভারও নাই। ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, কৃষি-শিল্প, পানি-বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যসেবার কাজ সে তূলনায় নস্যিতূল্য। শাসক বা রাষ্ট্রনায়কদের সবচেয়ে বড় অবাধ্যতা এবং সবচেয়ে বড় অপরাধটি হলো সে দায়ভার এড়িয়ে যাওয়া। এ দায়ভার পালনে নবীজী (সাঃ) তাই অমুসলিম দেশগুলিকে আল্লাহর শত্রুমূক্ত করতে শুধু মোজাহিদদেরও পাঠাননি, কোর’আনের শত শত শিক্ষকও পাঠিয়েছেন। মুসলিমদের পরাজয় এবং ইসলামের পথ থেকে দূরে সরা তখনই শুরু হয় যথন রাষ্ট্র শুধু রাজস্ব-সংগ্রহ, রাজ্য-বিস্তার ও নিজেদের ক্ষমতাপ্রয়োগে মনযোগী হয়, এবং দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সিরাতুল মোস্তাকীম গড়া থেকে। তখন গুরুত্ব হারায় জাহান্নামের পথ বন্ধ করে দেয়া এবং সে পথে ডাকা অপরাধীদের শাস্তি দেয়া। গুরুত্বপূর্ণ একাজগুলি কঠিন হয়ে পড়ে রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে সেক্যুলারিস্টদের বিজয়ে। তখন রাষ্ট্রজুড়ে যে পথগুলি দৃশ্যমান হয় ও চোখ ধাঁধিয়ে দেয় তা শয়তানসৃষ্ট জাহান্নামের পথ। এরূপ পথের ভিড়ে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ দূরে থাক, এমনকি নবেল বিজয়ী পন্ডিতগণও সত্যপথ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়।
ইসলামী রাষ্ট্র: কেন একমাত্র পথ?
অনৈসলামী রাষ্ট্রের অপরাধ অনেক। বর্বরতাও বহুবিধ। তবে সাধারণ মানুষের নজর থেকে সিরাতুল মুস্তাকীম বিলু্প্ত করা বা অদৃশ্য করাই এসব রাষ্ট্রগুলির সবচেয়ে বড় অপরাধ। সে অপরাধের কারণেই সাধারণ মানুষ জান্নাতের পথ খুঁজে না পেয়ে জাহান্নামমুখী হয়। এখানে রাষ্ট্র ও তার কর্মকর্তাগণ কাজ করে শয়তানের নিষ্ঠাবান খলিফা রূপে। এমন মহাপরাধীদের হাত থেকে জনগণকে বাঁচানোর লড়াই হলো ইসলামের শ্রেষ্ঠ ইবাদত তথা জিহাদ, এ ইবাদতে প্রাণ গেলে বিনা বিচারে জান্নাতপ্রাপ্তি ঘটে। অন্য কোন ইবাদত আজীবন অবিরাম করলেও সে পুরস্কারটি জুটে না। অপরদিকে যে দেশে শয়তানের এ খলিফাদের বিরুদ্ধে জিহাদ নেই সে দেশে প্রকৃত ইসলামও নাই। মানব জাতি বিভক্ত মূলত দুটি পক্ষে। এক). শয়তানের খফিফাদের পক্ষ; দুই). মহান আল্লাহর খফিফাদের পক্ষ। এছাড়া তৃতীয় পক্ষ নাই। মানব জাতির ইতিহাসের সিংহ ভাগ জুড়ে মূলত এ দুই পক্ষের লড়াইয়ের ইতিহাস।
জান্নাতের পথ দেখানো ও জাহান্নামের আগুন থেকে মানুষকে বাঁচানোই ইসলামের মূল মিশন। সে কাজটি করে কোর’আনের জ্ঞান। তবে জ্ঞানদানের সে কাজটি শুধু মসজিদ-মাদ্রাসায় সম্ভব নয়। সে কাজে সমগ্র রাষ্ট্র এবং তার সকল সামরিক ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, প্রচারমাধ্যমসহ সকল প্রতিষ্ঠানকে সর্বশক্তি দিয়ে অংশ নিতে হয়। নবীপাক (সা:)’র শাসনামলেই সেটিই ঘটেছিল। নবীজী (সা:)’র আমলে সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে এমন কোন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ছিল না -যা থেকে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্টা ও সুরক্ষায় সহয়তা নেননি। তাবুক যুদ্ধের সময় তো প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিমদের উপর মদিনা থেকে বহুশত মাইল দূরে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়াকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। নবীজী (সা:)’র সে কাজে যারা সেদিন সহায়তা দেয়নি তাদেরকে আল্লাহতায়ালা ওহী যোগে মুনাফিক বলে চিহ্নিত করেছেন। তারা ঘোষিত হয়েছে ইসলামের শত্রু রূপে। নবীজী (সা:)’র সে সূন্নতকে অনুসরণ করেছিলেন খোলাফায়ে রাশেদা ও অন্যান্য খফিফাগণ। আজও মুসলিমদের পক্ষ থেকে এরূপ সামগ্রীক সহায়তা ছাড়া কোন দেশে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব? সম্ভভ কি শয়তানি শক্তির কোয়ালিশনকে পরাজিত করা?
প্রতিটি মুসলিম জীবনেই রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে। তেমনি একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য অপরিহার্য মুসলিম রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিরও। রাষ্ট্রের এজেন্ডা নিয়ে মুসলিম রাষ্ট্র ও মুসলিম নাগরিকের মাঝে পূর্ণ সমন্বয় তথা compatibility না থাকলে সে রাষ্ট্র মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর হয় না। বরং অকল্যাণ ডেকে আনে। মু’মিনের উপর তাই ফরজ শুধু নিজে মুসলিম হওয়া নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমূহকে মুসলিম করা। এর অর্থ: পৃথিবী পৃষ্ঠে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা পূরণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিয়োজিত করা। একমাত্র তখনই রাষ্ট্র কোর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার “লিইউযহিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি” (সকল ধর্মের উপর ইসলামের বিজয়)’র এ এজেন্ডাটির সাথে একাত্ম হয়। এজন্যই মুসলিমদের রাষ্ট্র কখনোই সেক্যুলার, জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী, গ্রোত্রবাদী, সমাজতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী হতে পারে না। এমন রাষ্ট্রের এজেন্ডা হয় শয়তানের এজেন্ডা পূরণ এবং জনগণকে জাহান্নামে নেয়া। ফলে এরূপে রাষ্ট্রে বসবাসের বিপদটি ভয়ানক।
এজন্যই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির উপর ইসলামী বিধানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্রেফ ঈমানদারের রাজনীতি নয়, বস্তুত সেটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা। সে এজেন্ডা নিয়েই নবীজী (সা:) রাষ্ট্রীয় প্রধানের আসনে বসেছেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। সে অভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন খোলাফায়ে রাশেদা। প্রশ্ন হলো, নবীজী (সা:) ও খোলাফায়ে রাশেদার অনুসৃত সে পথ থেকে ভিন্ন পথ আছে কি? একমাত্র সে পথটিই তো প্রমাণিত হয়েছে সমগ্র মানব ইতিহাসে সবচেয়ে সফল পথ রূপে। ফলে যারা তেমন একটি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব না দিয়ে স্রেফ নামায, রোযা, হ্জ্ব ও যাকাতের মধ্যে ধর্মপালনকে সীমিত করে -তাদের সে ধর্মপালনে পূর্ণ ঈমানদারী নাই। নবীজী (সা:)’র সূন্নত পালনেও নেই। এবং আগ্রহ নেই মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাপূরণে। এমন মানুষেরা দৃশ্যতঃ ধার্মিক মনে হলেও আসলে যে বিপথগামী –তা নিয়ে সন্দেহ আছে কী? ১ম সংস্করণ ২২/০৬/২০১২; ২য় সংস্করণ ০৮/০২/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018