অবহেলা মহান আল্লাহতায়ালার দিকে ডাকায়
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on October 6, 2021
- Bangla Articles, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমলের প্রসঙ্গ
মানব-কল্যাণে সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমলটি কাউকে হাজার কোটি টাকার অর্থদানে হয় না। প্রাসাদ গড়ে দেয়াতেও হয় না। সেটি হয় মহান আল্লাহতায়ালার পথে ডাকায় তথা জান্নাতের পথে নেয়ায়। তখন সে মানুষটি রক্ষা পায় বহু হাজার কোটি বছরেও শেষ হবার নয় এমন এক অনন্ত কালের জাহান্নামের আগুন থেকে। সে পায় অসীম কালের জন্য জান্নাত। সে জান্নাতের এক বর্গগজ ভূমিও কি হিমালয়ের সমান স্বর্ণ দিয়ে কেনা যায়? জান্নাতে কোন মৃত্যু নাই। কোন রোগ-ব্যাধি এবং দুঃখ-বেদনাও নাই। সকল প্রকার অভাবেরই সেখানে অভাব। মানুষ যা চাইবে, সেখানে তাই পাবে। সে এক অনন্ত চাওয়া-পাওয়ার জায়গা। যে জান্নাত পায়, সেই পায় প্রকৃত সফলতা। মানুষের জন্য সে বিশাল কল্যাণের কাজটি করতেই যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ এসেছেন।
নবী-রাসূলগণ কাউকে সম্পদ দেননি। কাউকে চাষাবাদ, বিজ্ঞান বা ব্যবসা-বাণিজ্যও শেখাননি। বরং মানুষকে তাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণটি করছেন জান্নাতের পথ দেখিয়ে। মানবের এরূপ কল্যাণ কোন রাজা-বাদশাহ বা অন্য কোন ব্যক্তিই করেনি। সে মহা জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যই নবী-রাসূলগণ সমগ্র মানবকুলে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। মহান নবীজী (সা:)’র পর আর কোন নবী বা রাসূল এ পৃথিবীপৃষ্ঠে আসবেন না। কিন্তু মানব-কল্যাণের সর্বশ্রেষ্ঠ সে কাজটি করতে হয় নবীজী (সা:)’র উম্মত রূপে পরিচয়দানকারী প্রতিটি মুসলিমকে। তাই ঈমানদারের কাজ শুধু কুর’আন তেলাওয়াত, নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত নিয়ে বাঁচা নয়, বরং মহান আল্লাহতায়ার পথে ডাকার সূন্নত নিয়ে বাঁচা।
অথচ পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমগণ সর্বশ্রেষ্ঠ সে সওয়াবের কাজটিতে আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছে। পবিত্র কুর’আন বদলায়নি। বদলায়নি মহান নবীজী (সা:)’র সূন্নত। কিন্তু ভয়ানক ভাবে বদলে গেছে মুসলিম। বদলে গেছে নেক আমলের ধারণা। কাউকে কিছু অর্থ দান, কিছু বস্ত্রদান, কিছু চিকিৎসা বা পানাহার দিয়েই অনেকে ভাবে, বিশাল নেক আমল করা হয়ে গেছে। যেন শেষ হয়েছে দায়িত্ব পালন। প্রশ্ন হলো, নিজের অমুসলিম প্রতিবেশী, সহকর্মী বা সহপাঠি যে জাহান্নামের আগুনের দিকে ধাবিত যাচ্ছে –সেটি দেখে কি কোন বিবেকমান মানুষ নিষ্ক্রীয় ও নীরব থাকতে পারে? এটি তো নিরেট বিবেকহীনতা। অথচ কি বিস্ময়! চোখের সামনে কোটি কোটি মানুষ জাহান্নামের দিকে ধেয়ে চলছে। সে ভয়ানক কান্ডটি দেখেও তাদের বাঁচানো নিয়ে মুসলিমদের মাঝে কোনরূপ ব্যতি-ব্যস্ততা ও পেরেশানী নাই। বিবেকে কোন দংশন বা জাগরণও নাই। যেন তারা কিছুই দেখিনি। এটি কি কম অপরাধ? এটি তো কোন শিশুকে চোখের সামনে পানিতে পড়তে দেখেও উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে না পড়ার মত অপরাধ। অথচ এ কাজে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের ভূমিকাটি ছিল অবাক করার মত। জনগণকে জাহান্নামের পথ থেকে ফেরাতে নবীজী (সা:) মক্কার গলিতে গলিতে, বিভিন্ন জনপদের মহল্লায় মহল্লায় দিনের পর দিন উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরেছেন। কাছে বসিয়ে মূর্তিপূজা নিয়ে বাঁচার ভয়ানক বিপদের কথা শুনিয়েছেন। যারা ছিল ঘোরতর শত্রু সেসব কাফের সর্দারদের নিজ ঘরে দাওয়াত দিয়ে ভাল ভাল খাবার খাইয়ে দ্বীনের কথা বুঝিয়েছেন। মক্কার পথে পথে এবং শহরের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পথিকদের আল্লাহতায়ালার পথে ডেকেছেন। সে কাজে গালি খেয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন এবং আহত ও রক্তাত্ব হয়েছেন। তায়েফবাসীদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত গিয়ে লেলিয়ে দেয়া গুন্ডাদের বর্ষিত পাথরের আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছেন। কিন্তু মানুষকে আল্লাহতায়ালার পথে ডাকার কাজে এক দিনের জন্যও ক্ষ্যান্ত দেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি মিশন জারি রেখেছেন। আগুনে আটকে পড়া মানুষকে বাঁচাতে গেলে নিজেও আগুনের তাপ সইতে হয়, অনেক সময় নিজেও পুড়তে হয়। এই ভাবেই তো ঈমানদার ব্যক্তি মৃত্যুর আগেই নিজেকে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয়তর করে এবং রহমত ও মাগফিরাত লাভের যোগ্য রূপে গড়ে তোলে। এভাবেই সে রোজ হাশরের বিচার দিনে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর আগেই জান্নাতের মূল্য পরিশোধ করে। এটিই হলো নবীজী(সা)’র মিশন -যা নানা বিরোধীতার মুখে বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে বিজয়ী করেছে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে।
নবীজী (সা:)র নসিহত, “সামার্থ্য থাকলে তোমরা আমার একটি বাণীকেও অন্যদের কাছে পৌঁছে দাও।” এবং বিদায় হজ্জের খোতবায় তিনি বলেছিলেন, “আপনারা যারা এখানে উপস্থিত আছেন তাদের দায়িত্ব হলো যারা এখানে নাই তাদের কাছে দ্বীনের বাণীকে পৌঁছে দেয়া।” পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম, “আতিয়ুল্লাহা ওয়া আতিয়ুররাসূল।” অর্থ: পালন করো আল্লাহর হুকুম এবং রাসূলের হুকুম।” নবীজী (সা:)’র হুকুম পালনে তাঁর অনুগত সাহাবাগণ ইসলামের দাওয়াত নিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। সর্ব-সামর্থ্য দিয়ে মানুষকে জাহান্নামে আগুন থেকে বাঁচানোই তাদের জীবনের মিশন হয়ে দাঁড়ায়। সাহাবাদের যুগ শেষ হবার পর সে কাজে নামেন তাদের অনুসারী তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনগণ। নবীজী (সা:)’র মিশন নিয়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের নানা দেশের, নানা জনপদের ও নানা ভাষার মানুষের কাছে তাঁরা পৌঁছেছেন। বহু কষ্ট সয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন বহু পাহাড়-পর্বত, নদীনালা, সাগর ও মরুভূমি। খুব কম সংখ্যক সাহাবী, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের জন্ম ভূমিতে। বরং তাদের মৃত্যু হয়েছে বহু শত বা বহু হাজার মাইল দূরের বিভিন্ন জনপদে। অথচ ইসলামকে বিজয়ী করার কাজটি পৃথিবীর কোন দেশেই সহজ ছিল না। পৌত্তলিকগণ পৌত্তলিকতা ছাড়া দূরের কথা, দেব-দেবীর বিরুদ্ধে কথা শুনলেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিত। ইসলামের গৌরব কালে লাগাতর যুদ্ধ করেই মুসলিমদের প্রতি কদম সামনে এগুতে হয়েছে। তাদের রক্ত ঝরেছে বিশ্বের নানা দেশের নানা জনপদে। আজ সে ঝুঁকি নাই। কোন দেশেই ইসলামের দাওয়াত নিয়ে নামলে কাউকে নিহত বা নির্যাতিত হতে হয় না। কিন্তু ক’জন ইসলামের পক্ষে মুখ খুলছে, ক’জন কলম ধরছে এবং ক’জন মানুষের দোয়ারে দোয়ারে হাজির হচ্ছে?
দাওয়াতের নির্দেশ পবিত্র কুর’আনে
মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের দিকে কাউকে ডাকার ইসলামী পরিভাষা হলো “দাওয়াত”। দাওয়াত এসেছে “দায়া” ক্রিয়া পদ থেকে -যার অর্থ কাউকে কোন কিছুর দিকে ডাকা বা আহবান করা। যারা ডাকে তাদেরকে বলা হয় দায়ী। আল্লাহতায়ালার পথে ডাকার অর্থ স্রেফ আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এবং নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাতের ন্যায় ইসলামের কিছু বিধানের প্রতি ডাকা নয়, বরং ইসলামের পূর্ণ প্যাকেজের প্রতি ডাকা। ইসলামের সে পূর্ণ প্যাকেজে যেমন নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাত, তাসবিহ-তাহলিল আছে, তেমনি আছে পবিত্র কুর’আন-হাদীস শিক্ষা, ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়ত, হুদুদ, অন্যায়ের নির্মূল, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, মুসলিম ঐক্য, শুরা ভিত্তিক শাসন, জিহাদ, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দাওয়াতের গুরুত্ব দিয়ে সুরা আল-ইমরানের ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে যা মানবকে ডাকবে কল্যাণের দিকে (তথা ইসলামী বিধানের দিকে), হুকুম দিবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার এবং নির্মূল করবে দুর্বৃত্তিকে। এবং তারাই হলো সফলকাম।” উপরুক্ত আয়াতে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হয়েছে তা হলো, মুসলিম জীবনের সফলতা আসে দাওয়াতের কাজে লিপ্ত হওয়াতে। ইসলামের প্রচার বাড়লে সুনীতি প্রতিষ্ঠা পায় এবং নির্মূল হয় দুর্বৃত্তি। দাওয়াতের কাজে লিপ্ত থাকাতে দায়ীর ঈমান, আমল ও চরিত্র দিন দিন পরিশুদ্ধ ও পবিত্র হয়, যেমন তরবারী ধারালো হয় সেটির নিয়মিত ব্যবহারে। নইলে মরিচা ধরে। মুমিনের জীবনে এই জন্যই লাগাতর লড়াই থাকতে হয়, সেটি যেমন দাওয়াতের ময়দানে তেমনি জিহাদের ময়দানে।
একাকী মুসলিম হয়ে কোন একটি গুহায়, ঘরে বা তাঁবুতে একাকী বাস করা যায়; কিন্তু তাতে সমাজ ও রাষ্ট্র ইসলামী হয় না। তখন যেমন রাষ্ট্রের বুকে শরিয়ত ও হুদুদের প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়না, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র এবং সভ্যতাও গড়া যায় না। একটি শিশুকেও একাকী মুসলিম রূপে গড়ে তোলা যায় না। তাকে মুসলিম করতে একটি ইসলামী পরিবারের সাথে ইসলামী মহল্লা ও ইসলামী সমাজ লাগে। লাগে ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী সংস্কৃতি। সর্বোপরি লাগে ইসলামী রাষ্ট্র। সেটি না থাকাতে অতীতে এমন কি নবীর ঘরেও দুর্বৃত্ত কাফের গড়ে উঠেছে। যেমন সেটি মহান নবী হযরত নূহ (আ:)’র ক্ষেত্রে হয়েছে। তাই মহান নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের পথ হলো ইসলামী সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র গড়া। তাই একাকী নয়, সংখ্যায় ও দলে বাড়তে হয়। সে জন্যই অন্যদের ইসলামের দিকে আনতে হয়। দাওয়াতের গুরুত্ব এজন্যই অত্যাধিক। তাছাড়া একাকী জান্নাতের পথে চলার মধ্যে থাকে চরম স্বার্থপরতা। এমন স্বার্থপরতা ইসলাম বিরোধী। মুসলিম হতে হলে জনদরদী হতে হয়। এমন এক দরদী চেতনার কারণেই ঈমানদার ব্যক্তি অন্যদের জাহান্নামে আগুন থেকে বাঁচাতে ও তাদেরকে জান্নাতের যাত্রী করতে নিজের জানমাল ও সর্ববিধ সামর্থ্যের বিনিয়োগ করে। একাজে এমন কি যুদ্ধও করে। ইসলাম রাষ্ট্র ও সভ্যতার গড়ার আবশ্যকতা এজন্যই ইসলামে অপরিসীম। তখন দাওয়াতের কাজে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও তার শিক্ষা ব্যবস্থা, মিডিয়া ও প্রকাশনা সহায়ক শক্তি রূপে কাজ করে। মুসলিম জীবনে জিহাদ এজন্যই অনিবার্য হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের এরূপ একটি সামগ্রীক মিশন নিয়ে বাঁচাই তো নবীজী (সা)’র শ্রেষ্ঠ সূন্নত।
মুসলিমদের আজকের পতনের মুল কারণ, নবীজী (সা:)’র সে মহান বিপ্লবী সূন্নত মুসলিমদের মাঝে বেঁচে নাই। গাড়ীর ইঞ্জিন খুলে রেখে তার সিটে বা গায়ে রং লাগালে সে গাড়ী চলে না। তেমনি অবস্থা আজকের মুসলিমদের। ইসলামের প্রচার, লাগাতর জিহাদ, জিহাদীদের নেতৃত্ব ও শাসন এবং শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই মুসলিমগণ বিশ্বশক্তি রূপে গড়ে উঠেছিল। এগুলোই হলো মুসলিম সভ্যতার ইঞ্জিনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অথচ সে ইঞ্জিন সরানো হয়েছে মুসলিম উম্মাহর দেহে থেকে। মুসলিমগণ ব্যস্ত টুপি, পাগড়ি, আলখেল্লা, পীরের আস্তানা, প্রাসাদসম মসজিদ-মাদ্রাসা ও দরগার চমক বাড়ানো নিয়ে। খোলাফায়ে রাশেদার আমলে খেলাফতভুক্ত হয় ইরাক, সিরিয়া ও মিশরের ন্যায় প্রদেশগুলির উর্বর কৃষিভূমি। তৎকালীন বিশ্বের মাঝে এ তিনটি এলাকা প্রসিদ্ধ ছিল উন্নত মানের চাষাবাদ ও প্রাচুর্যের জন্য। পারসিক ও রোমান সম্রাটদের বড় বড় প্রাসাদ নির্মিত হয়েছে এবং তাদের জৌলুস বেড়েছে এসব প্রদেশের কৃষকদের দেয়া রাজস্বের অর্থে। কিন্তু এ অর্থ দিয়ে খোলাফায়ের রাশেদার খলিফাগণ কোন প্রাসাদ গড়েননি। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৫০ গুণ বৃহৎ রাষ্ট্রের শাসক হওয়ার পূর্বে যে ঘরটিতে তারা বাস করতেন, শাসক হওয়ার পরেও তারা সে ঘরেই থাকতেন। সাধারণ মানুষের মতই তাঁরা রাস্তায় ও হাটে বাজারে পায়ে হেঁটে চলাফেরা করতেন। মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাযের ইমামতি করতেন। তাঁরা রাষ্ট্রকে গড়ে তুলেছেন মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম ওয়েলফেয়ার স্টেট (জনকল্যাণমুলক রাষ্ট্র) রূপে। ফলে সেদিন কাউকেই রাস্তায় ভিক্ষায় নামতে হয়নি। রাষ্ট্র তখন ইসলামের শো’কেসে পরিণত হয়েছিল। দলে দলে মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছে সে ইসলাম দেখে। ইসলামী রাষ্ট্র এভাবেই সেদিন দাওয়াতের কাজে সফল হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। ফলে তখন নামাযে ডাকতে তাবলিগ জামায়াতের ন্যায় মানুষের ঘরে ঘরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। সে কাজ রাষ্ট্র করেছে। বিশ্ব জুড়ে ইসলামের যত প্রচার তার সিংহ ভাগ তো সে আমলেই হয়েছে। শয়তান ও তার অনুসারীগণ সেটি বুঝে। তাই পুণরায় কোথাও কোন রাষ্ট্রকে ইসলামের শো’কেস হতে দিতে তারা রাজী নয়। সাবেক মার্কন প্রসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাই বলেছিলেন, কোন ইসলাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলে সেটিকে বোমা মেরে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হবে।
দাওয়াতের ব্যাপারে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা এসেছে সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “হে রাসূল, পৌঁছে দিন আপনার রবের পক্ষ থেকে যা কিছু আপনার কাছে নাযিল হয়েছে তার সব কিছুই। এবং সে কাজ যদি আপনি না করেন, তবে তো (ব্যাপার এরূপ হলো যে) তাঁর বার্তা পৌছানোর কাজটিই আপনি করলেন না। (সুতরাং আপনি কুর’আনের বাণী পৌঁছানোর কাজ চালিয়ে যান) আল্লাহ আপনাকে (প্রতিপক্ষ) মানুষদের থেকে সুরক্ষা দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদের হিদায়েত দেন না।” উপরুক্ত আয়াতে ঘোষিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সমুদয় বাণী জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়াই নবী-রাসূলদের জীবনের মূল মিশন। সে কাজই যদি না হয় তবে রাসূল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়। সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই সুস্পষ্ট করা হয়েছে উপরুক্ত আয়াতে। নবীজী (সা:)’র উম্মত রূপে একাজই হলো প্রতিটি মুসলিমের মূল মিশন। সেকাজটি না হলে দায়িত্বই পালিত হয়না। তখন গাদ্দারী হয় অর্পিত দায়ভারের সাথে। তাই কোন মুসলিমকে তাঁর ধর্ম-কর্ম স্রেফ নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিলে সীমিত রাখলে চলে না। তাকে অবশ্যই দাওয়াতের কাজে নামতে হয়। একারণেই নবীজী(সা:) যুগে প্রতিটি মুসলিম যেমন নামাযী ছিলেন, তেমনি ছিলেন “দায়ী ইলাল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহর পথে আহবানকারী। অথচ সে পরিচয়টি নিয়ে আজকের মুসলিমগণ বাঁচে না। তারা বাঁচে শুধু নামাযী, রোযাদার বা হাজীর পরিচয় নিয়ে।
জিহ্বা: নেক আমলের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার
মানুষের জিহ্বা তথা কথা বলার সামর্থ্যটি মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত অতি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি বান্দার উপর অর্পিত অতি গুরুত্বপূর্ণ আমানতও। এ হাতিয়ারটি অসত্য, হিংসা, কুৎসা ও গালিগালাজের ন্যায় পাপের পথে যেমন ব্যবহৃত হতে পারে, তেমনি হতে পারে সত্যের বিজয়েও ব্যবহৃত। জিহ্বাকে শেষাক্ত পথে ব্যবহার করেছেন নবী-রাসূলগণ। মানব জীবনের সবচেয়ে মহামূল্যবান নেক কর্মগুলি অর্থ দিয়ে হয় না, বরং হয় উত্তম কথা দিয়ে। কথার মধ্য দিয়েই মানুষের চেতনার ভূবনে বিপ্লব আসে। পরিবর্তন আসে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসে। কথা দিয়ে ব্যক্তিকে যেমন ভাল কাজে উৎসাহিত করা যায়, তেমনি প্রাণ দানেও অনুপ্রাণীত করা যায়। তখন জনগণের মাঝে আত্মত্যাগে ও নীতি-নৈতিকতায় বিপ্লব আসে। নবী-রাসূলগণ তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করেছেন তাদের জিহ্বা দিয়ে। তেমনি যুগে যুগে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ও কু-কর্মে চালিত করার নয় সবচেয়ে ক্ষতিকর কাজগুলোও হয়েছে জিহ্বা দিয়ে। তখন জিহ্বা পরিণত হয় শয়তানের হাতিয়ারে। ঈমানদার ব্যক্তি তাঁর জিহ্বাকে কাজে লাগায় সত্যের পক্ষে ও মিথ্যার বিপক্ষে সাক্ষ্য দানে। এবং সত্যের পক্ষে এরূপ সাক্ষ্যদানই হলো মু’মিনের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সে সাক্ষ্যদানে মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা যে কতটা খুশি হন –তারই ঘোষণা দিয়েছেন সুরা হা-মীম সিজদাহ’র ৩৩ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “কথার দিক দিয়ে তাঁর চেয়ে উত্তম আর কে হতে পারে যে তার কথা বলার সামর্থ্যকে ব্যয় করে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকার কাজে, এবং নেক আমল করে এবং বলে নিশ্চয়ই আমি মুসলিমদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত।”
পবিত্র কুর’আন: দাওয়াতের মূল হাতিয়ার
মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন “মাওয়াজেতুল হাসানা” তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ওয়াজ তথা নসিহতের কিতাব রূপে। এ কিতাবের সমগ্র ওয়াজটি হলো মহান মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার। এবং কাঙ্খিত শ্রোতা হলো বিশ্বের প্রতিটি নর ও নারী। এ ওয়াজের মাধ্যমেই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর মানব সৃষ্টির সাথে কথা বলেন। এবং জানিয়ে দেন, প্রতিটি মানব সন্তানকে তিনি কীরূপ দেখতে চান। ফলে মানব জাতির জন্য এর চেয়ে উত্তম ওয়াজ আর কি হতে পারে? তাই নবীজী (সা:) তাঁর জুম্মার খোতবাগুলোতে নিজের কথা বেশী বলতেন না, বলতেন পবিত্র কুর’আনে বর্ণিত মহান আল্লাহতায়ালার কথা। অথচ আজ হচ্ছে উল্টোটি; কুর’আনের কথার বদলে ওয়াজের বক্তাগণ নিজেদর কিসসা-কাহিনী শুনাতেই বেশী উৎসাহী। হয়তো ভাবেন, কুর’আনের চেয়ে তাদের কিসসার আছড়ই বেশী। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ: “ফাযাক্কির বিল কুর’আনি মাই ইয়াখাফু ওয়ায়ীদ।”-(সুরা ক্বাফ, আয়াত ৪৫)। অর্থ: “ ((হে রাসূল), যারা ভয় করে আমার সাবধানবাণীর, তাদেরকে সাবধান করুন এই কুর’আনকে দিয়ে।” সুরা মুদাচ্ছির বলা ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “হে রাসূল, খাড়া হয়ে যান, সাবধান করুন (এই কুর’আনকে দিয়ে)।” সুরা মুদাচ্ছিরের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ওয়া মা হিয়া ইল্লা যিকরা লিল বাশার।” অর্থ: “মানব জাতির জন্য সাবধান বাণী ছাড়া এই কুর’আন আর কিছুই নয়।” একই বয়ানের পুনরুক্তি করে আবার হুশিয়ার করা হয়েছে সুরা মুদাচ্ছিরের ৫৫ ও ৫৬ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “কাল্লা ইন্নাহু তাযকিরাহ। ফা’মান শা’য়া যাকারাহ। অর্থ: “না (হে রাসূল), এই কিতাব হলো হুশিয়ারী। যার ইচ্ছা সে (এ কিতাব পাঠ থেকে) হুশিয়ার হবে।
দাওয়াতে ব্যাপারে কোন আপোষ নাই। বিচলিত হওয়ারও কোন অবকাশ নাই। পবিত্র কুর’আনে যা বলা হয়েছে, ঈমানদারকে মনযোগী হতে হয় সে বার্তাগুলোকে মানুষে কাছে অবিকল পৌছে দিতে। এবং ডাকতে হয় স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর নির্দিষ্টকৃত দ্বীন ইসলামের দিকে। নিজের কথা, দলের কথা, নেতার কথা বা পীরের কথা দিয়ে কুর’আনীর বাণীর সাথে ভেজাল সৃষ্টি করা যাবে না। অন্য কোন মতবাদের সাথে ইসলামের সংমিশ্রনও ঘটানো যাবে না। তাই ইসলামী সমাজতন্ত্র বলে যেমন কিছু নাই, তেমনি ইসলামী বা মুসলিম জাতীয়তাবাদ বলেও কিছু নাই। ইসলাম একমাত্র ইসলামই। কুর’আনী এজেন্ডার সাথে কোন দলীয় এজেন্ডাও জোড়া যাবে না। তাই সুরা শুরার ১৫ নম্বর আয়াতে নবীজী (সা:)কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, “অতঃপর (হে নবী), আপনি এই দ্বীন (ইসলামের) প্রতি দাওয়াত দিন। এবং তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করবেন না। বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি বিশ্বাস করি সেটিকেই।”
দাওয়াতের শক্তি ও কৌশল
মানব সভ্যতার সবচেয়ে মূল্যবান ও সবচেয়ে কল্যানকর কর্মটি যেহেতু মহান আল্লাহাতায়ার দিকে ডাকা, তাই এ গুরুত্বপূর্ণ কর্মটিকে সর্বাঙ্গ সুন্দর ও সফল করার আয়োজনটিও হতে হয় সর্বসামর্থ্য দিয়ে। এ পবিত্র কর্মটি কখনোই অজ্ঞ, অভদ্র, অশিষ্ঠ ও চরিত্রহীনের কাজ নয়। এখানে সমাবেশ ঘটাতে গভীর কুর’আনী জ্ঞানের সাথে অতি উত্তম আচরণ, চেতনা, কর্ম ও চরিত্রের। দায়ীকে হতে তাঁর বক্তব্য পেশে অতি সাহসী, আপোষহীন, অক্লান্ত, অনঢ়, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। উঠতে হয় সকল প্রকার প্রলোভনের উর্দ্ধে। এরূপ সবগুলো গুণই ছিল নবীজী (সা:)’র মাঝে। তিনিই ছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ দায়ী। নবীজী (সা)’কে তাঁর মিশন থেকে ফেরানোর জন্য মক্কার কাফেরগণ বিপুল অর্থ, নেতৃত্ব ও সুন্দরতম নারীর প্রস্তাব দিয়েছিল। তাঁকে নিজেদের রাজা রূপে কবুল করতেও রাজী ছিল। সেসব প্রলোভনের জবাবে নবীজী (সা:) বলেছিলেন, “যদি এক হাতে সূর্য এবং আরেক হাতে চন্দ্র এনে দাও তবুও আমার মিশন থেকে পিছুপা হবো না।” তার সত্যবাদীতা নিয়ে এমনকি তাঁর শত্রুগণও কোনরূপ সন্দেহ করতো না। বড় বড় নীতি কথা ইতিহাসে বহু দার্শনিক, লেখক, চিন্তাবিদ ও ধর্মীয় গুরু বলেছেন। কিন্তু নবীজী (সা:)ই হলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি যা বলতেন তা নিজে করে দেখাতেন। তাঁর কর্ম ও চরিত্রের মাঝে পবিত্র কুর’আন দেখা যেত। সে কথাটি বলেছেন নবীজী (সা:)’র জীবনসঙ্গিনী হযরত আয়েশা (রা:)।
সেদিন আরবের সে অসুস্থ্য ও অসভ্য সমাজে ইসলামে দাওয়াত দেয়াটি সহজ ছিল। সহজ ছিল না সে অসভ্য মানুষদের সভ্য, ভদ্র ও ঈমানদার বানানো। মানুষ যে শুধু মূর্তিপূজার নিমজ্জিত ছিল তাই নয়; চুরি-ডাকাতি, রাস্তাঘাটে রাহাজানী, লুটতরাজ, মদপান, ব্যাভিচার তাদের সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। তারা এতোই নিষ্ঠুর ছিল যে নিজের কন্যাকে জীবিত কবর দিত। গোত্রে গোত্রে ছিল বছরের পর বছর ধরে চলা রক্তাত্ব সংঘাত। ছিল প্রচণ্ড বর্ণভেদ ও গোত্রভেদ। সে অসভ্য মানুষদের গোত্রীয় গর্ব ও অহংকার ছিল সীমাহীন। নিজেদের অতীত কীর্তি নিয়ে তারা গৌরবগাঁথা তথা কাসিদা গাইতো। সমগ্র সমাজ বিস্ফোরিত হতো তাদের দেবতা ও মূর্তির বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে। নবী-রাসূল সন্মদ্ধে তাদের ধারণা ছিল, তাঁদের থাকতে হবে অলৌকিক ক্ষমতা। তাঁদের আগে পিছে চলবে ফিরেশতা, তাঁদের জন্য পানাহার নাযিল হবে আসমান থেকে। তাঁদের থাকবে অঢেল সম্পদ। পাথর থেকে পানির প্রবাহ, অন্ধ মানুষকে দৃষ্টিদান, মৃত মানুষকে জীবিত করার মত অলৌকিক ঘটনা ঘটবে নবীদের চোখের ইশারায়। ভাবতো, পূর্ণগ্রন্থ্য রূপে পবিত্র কুর’আন নেমে আসবে আসমান থেকে। অথচ মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে এই অজ্ঞ ও অসভ্য মানুষদেরকেই নবীজী (সা:) মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবে পরিণত করেছিলেন। তাদের হাতে শুরু হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মাণের কাজ। তাঁরা দ্বীনের বিজয়ে জিহাদে নেমেছেন। ইসলামের প্রচারে আমৃত্যু “দায়ী ইলাল্লাহ”তে পরিণত হয়েছেন। নিজেরা জান্নাতের পথের সন্ধান পেয়ে মনের আনন্দে ঘরে বসে থাকেননি; বরং নিজেদের সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ করেছেন পৃথিবীর নানা কোনের মানুষদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে। সে লক্ষ্যে নিজেদের ঘরবাড়ী, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আপনজন ছেড়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে অপরিচিত মানুষের মাঝে ঘর বেঁধেছেন। তাঁরা সবই করছেন স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা পূরণে। নবীজী (সা:)’র সেসব আত্মত্যাগী সাহাবীদের মেহনতের বরকতেই আজ মুসলিমদের সংখ্যা বিশ্বে ১৫০ কোটির বেশী।
নবীজী (সা:)র অভূতপূর্ব সাফল্যের মূল কারণ ছিল তাঁর ঈমানী বল, মধুর আচরণ, নিরেট সততা, দরদী মন ও বিরামহীন প্রচেষ্ঠা। মানব দলে দলে জাহান্নামের অগুনের দিকে ছুটছে এবং তাদের ফেরানো যাচ্ছে না –এটিই হলো একজন হৃদয়বান মানুষের কাছে দুঃসহ যাতনার বিষয়। মানবের এ ভয়ানক বিপদ নবীজী (সা:)কে গভীর দুঃখ দিত। এ নিয়ে সব সময়ই তিনি অতিশয় চিন্তিত ও বিষন্ন থাকতেন। নবীজী (সা:)’র মনের সে মানবদরদী চিত্রটি তুলে ধরেছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। সুরা শু’আরা’র ৪ নম্বর আয়াতে তিনি বলেছেন, “(হে মহম্মদ), আপনি কি এই ভাবনায় নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবেন যে, মানুষ তোমার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছে না।”
যে কোন বিবেকবান ব্যক্তিই কোন শিশুকে নদীতে পড়তে দেখে তাকে বাঁচাতে নিজেও নদীতে ঝাঁপ দেয়। সেটিই মানবতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। সেরূপ না করাটাই গুরুতর অপরাধ। সেরূপ নিষ্ক্রীয়তা একমাত্র বিবেকের মৃত্যুতেই সম্ভব। তাই অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ নয়, গভীর মমত্ব ও ভালবাসা নিয়ে তাদেরকে জাহান্নামের ইন্ধন থেকে বাঁচানো কাজে লাগতে হয়। দয়াময় আল্লাহতায়ালার দরবারে দোয়া করতে হয় তাদের কল্যাণ চেয়ে। এটিই মহান নবীজী (সা:)’র সূন্নত। বস্তুত ব্যক্তির ঈমান দেখা যায় একজন জাহান্নামের যাত্রীকে বাঁচানোর কাজে তাঁর সময় ও সামর্থ্যের বিনিয়োগ দেখে। ঈমান যতই গভীরতর হয়, ততই বাড়ে এ দায়িত্ববোধ ও মমত্ববোধ। মুনাফিকদের সে গরজ থাকে না। মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে ইসলামের পথে এরূপ ডাকাই হলো সবচেয়ে বড় কাজ। পথহারা মানুষের প্রতি এরূপ দরদ, মমত্ব ও ভালবাসাই হলো দাওয়াতের কাজে সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার। নানা দেশ, নানা বর্ণ ও নানা ভাষার মানুষকে একমাত্র এমন মানুষেরা আপন করে নিতে পারে। ঈমানদারের মনের এ আকুতি তার কর্ম ও আচরণে দেখা যায়। সেটিই সুস্পষ্ট দেখা যেত নবীজী (সা:)’র মাঝে। তাঁর সে বিশিষ্ট গুণ যে কোন বিবেকমান মানুষকেই আকৃষ্ট করতো। মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটি মাটিতে বসে চাকরদের সাথে একত্রে একই রূপ খানা খেতেন। ঘুমুতেন খেজুর পাতার মাদুরের উপর। অথচ তিনি শুধু নবীই ছিলেন না, ছিলেন একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানও। যায়েদ বিন হারিস (রা:)’র ন্যায় নিজের ক্রীতদাসকে তিনি দিয়েছিলেন সন্তানের মর্যাদা। সালমান ফারসীর ন্যায় একজন ইরানী দাসকে দিয়েছেন পরিবারে সদস্যের (আহলে বায়েত)’র মর্যাদা। হযরত বেলাল (রা:) এক সময় ক্রীতদাস ছিলেন। নবীজী (সা:) তাঁর মর্যাদা এতোটাই বাড়িয়েছেন যে হযরত আবু বকর (রা:)কে তিনি বলেছেন, “যে বেলাল (রা:)কে অসন্তুষ্ট করবে সে আল্লাহতায়ালাকেও অসন্তুষ্ট করবে।”
মুসলিমগণ যেদেশে বা যে জনপদে নবীজী (সা)’র সূন্নত ও তাঁর গুণাবলীর নিয়ে হাজির হয়েছেন সেখানেই জনগণের মাঝে ইসলাম গ্রহণে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা ছিলেন কুর’আনী আলো (নূর)’র জ্বলন্ত মশাল। বাতি যেমন অন্ধকার ছড়ায়, তেমনি নূরের মশাল জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা সরায়। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজ মুসলিম। তারা মুসলিম হয়েছে সেখানে আগমনকারী আরব ব্যবসায়ীদের ঈমান, আমল ও চরিত্র দেখে। কোন মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে অধিকৃত হওয়ার কারণে নয়। ইসলামের পক্ষে দাওয়াত দিয়েছে আরব ব্যবাসায়ীদের কর্ম ও চরিত্র। অথচ ভারতের দিল্লিতে প্রায় ৭ শত মুসলিম শাসন থাকলেও ইসলামের প্রচার তেমনটি হয়নি। কারণ, সেখানে মুসলিমগণ শাসকের রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে, “দায়ী ইলাল্লাহ”র রূপ ধরে আসেনি। তাছাড়া শাসক রূপে তাদের চেতনায় ছিল অধিক রাজস্ব লাভের ফিকর। তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি হিন্দু প্রজাদের জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচানোর ন্যায় গুরুতর বিষয়টি। ভারতের অমুসলিমগণ মুসলিম হলে জিজিয়া ট্যাক্স বন্ধ হয়ে যাবে -সে কারণে ইসলাম প্রচারের কাজে স্বৈরাচারী বাদশাহদের আগ্রহ ছিল না। ইসলাম প্রচারে যা কিছু হয়েছে সেটি হয়েছে সুফি দরবেশদের দ্বারা। বাংলায় ইসলামের দ্রুত প্রসারের কারণ, এলাকাটি ছিল দিল্লির শাসকদের থেকে দূরে। বাংলার জনগণ শাসক মুসলিমের চেয়ে দায়ী মুসলিমদের রূপটি দেখেছিল। ফলে তারা সেদিন অন্ধকারের মাঝে আলোর সন্ধান পেয়েছিল।
দাওয়াতের কাজে কেন এতো ব্যর্থতা?
আজকের মুসলিমদের দাওয়াতে ব্যর্থতার মূল কারণ, তাদের মাঝে বেঁচে নাই ঈমানের কাঙ্খিত মান। জন্ম নেয়নি ঈমানী দায়িত্ববোধ। এবং বেড়ে উঠেনি নবীজী (সা:)’র চরিত্রের আলোকে তাদের চরিত্র। তাদের অল্প-স্বল্প যা ঈমান তা বড় জোর নামাযে বা পীরের দরবারে নেয় বটে, কিন্তু দ্বীনের দায়ীতে পরিণত করে না। জিহাদেও নেয় না। এমনকি ইসলামের পক্ষে ভোটদানেও অনুপ্রাণিত করে না। নদীতে সামান্য কিছু পানি থাকলেই সে নদীতে নৌকা চলে না। সে তলানীতে ঠেকা পানি ক্ষেতের ফসলে পৌঁছে না। মাঠঘাটে প্লাবন আনার জন্য প্রয়োজন, সর্বপ্রথম নদীর বুকে প্লাবন আনা। সে সামর্থ্য মরা নদীর থাকে না। তেমনি দুর্বল ঈমানের নামাযীদের পক্ষেও সম্ভব নয় যে, সমাজের বুকে তারা ইসলামের জোয়ার আনবে। আজকের মুসলিমদের বিবেকহীনতার মাত্রা এতোটাই গভীর যে, কোটি কোটি মানুষকে জাহান্নামের আগুণের দিকে ধাবিত হতে দেখেও তাদের হৃদয়ে সাড়া জাগে না। এমন মৃত বিবেকের কারণেই অমুসলিমদের দোয়ারে তারা দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে হাজির হয় না। চেতনায় ইসলাম যে বেঁচে নাই -এ হলো তারই লক্ষণ। বাঙালী মুসলিমগণ ইসলামের দাওয়াত পেয়েছে অবাঙালী দায়ীদের থেকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ইসলামের সে জোয়ার বাংলাতে এসেই থেমে গেছে। বাঙালী মুসলিমগণ ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর সে মিশনকে বাংলার বাইরে নিতে পারিনি। ইসলামের মিশনের সাথে এই হলো বাঙালী মুসলিমদের গাদ্দারী।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব পার্শ্বে ভারতের ৭টি রাজ্য। এ ৭টি রাজ্যের বেশীর ভাগ জনগণই অহিন্দু। তাদেরকে খৃষ্টান বানানো কাজে ইউরোপ, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইত্যাদি নানা দেশ থেকে হাজার হাজার খৃষ্টান পাদ্রী ধর্মপ্রচারে এসেছে। অথচ কোন বাঙালী মুসলিম এ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে ইসলামের প্রচার গেছে তার কোন প্রমাণ নাই। খৃষ্টানদের তাবলিগের ফলেই এই ৭টি রাজ্য পরিণত হয়েছে খৃষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায়। এই ৭টি রাজ্যের সমুদয় আয়োতন বাংলাদেশের চেয়ে বৃহত্তর। আজ হোক, কাল হোক, এ এলাকায় প্রতিষ্ঠা পাবে স্বাধীন খৃষ্টান রাষ্ট্র -যা হবে বাংলাদেশের চেয়ে বৃহৎ এবং পাশ্চত্য বিশ্বের সাহায্য নিয়ে সংকট সৃষ্টি করবে বাংলাদেশের নিরাপত্তার অঙ্গণে। নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় নিজেদেরই। এ জন্য লক্ষ্য হয়, নিজ দেশের পাশে সমচেতনার মানুষের বসবাস। কিন্তু বাঙালী মুসলিমগণ সে লক্ষ্যে কোন দায়িত্বই পালন করেনি। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এক মুসলিম দেশ রূপে। নিজেদের বিপদ লাঘবে বাঙালী মুসলিমগণ কোন চেষ্টাই করেনি। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা জুড়ে হিন্দু বাঙালীর সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি। তাদের মাঝেই বা ইসলামের বাণী পৌঁছানোর কাজ কতটুকু হয়েছে? অথচ তাদের বসবাস বাঙালী মুসলিমের একান্ত প্রতিবেশী রূপে। প্রতিবেশীর হক কতটুকু আদায় করেছে বাঙালী মুসলিমগণ। অথচ ইসলামে প্রতিবেশীর হক আত্মীয়ের চেয়ে কম নয়। রোজ হাশরের বিচার দিনে এ দায়িত্বহীনতার জবাব দিতে হবে না? পবিত্র কুর’আন শুধু নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাতের হুকুমই দেয় না, দেয় প্রতিবেশীর ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছা দেয়ার হুকুমও। কিন্তু সে হুকুম পালনে বাঙালী মুসলিমদের মাঝে আগ্রহ কই? তারা বাঁচছে সে হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিয়ে। কথা হলো এরূপ বিদ্রোহীদের কি মহান আল্লাহতায়ালা জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করবেন?
ধর্মকর্ম পালনের ক্ষেত্রেও আজকের মুসলিমদের মাঝে ঢুকেছে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা। তাই ভাবনা নেই অন্যদের মুসলিম করায়। আগ্রহ নাই অমুসলিমদের কাছে ইসলামের আলো পৌঁছিয়ে দেয়ায়। তাবলিগ জামায়াত তাদের কাজকে সীমিত রেখেছে মুসলিমদের স্রেফ নামাযে ডাকাতে। ইসলামের অন্যান্য খুঁটি তথা সমগ্র ইসলাম নিয়ে তাদের ভাবনা নাই। তাই অমুসলিমদের ঘরের দুয়ারে তারা হাজির হয়না। পীরগণ ব্যস্ত মুরীদের সংখ্যা বাড়ানো নিয়ে। তাদের লক্ষ্য, কি করে বার্ষিক ওরশের আয়োজনকে জমকালো করা যায় -তা নিয়ে। যেসব ইসলামী দল রাজনীতির ময়দানে, তাদের এজেন্ডা দলীয় ক্যাডার বৃদ্ধি, ভোট বৃদ্ধি ও নির্বাচনে আসনবৃদ্ধি নিয়ে। সে সাথে দলীয় তহবিলে উপার্জন বৃদ্ধি নিয়ে। অমুসলিমদের ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া তাদেরও এজেন্ডা নয়। ফলে অমুসলিমদের উদ্দেশ্যে কোন দাওয়াতী বই লেখা দূরের কথা, একখানী প্রচারপত্রও এ দলগুলো বিতরণ করেনি। আল্লাহতায়ালার দ্বীনের পথে ডাকার বদলে সব দল, সব পীর, সব জামায়াত ডাকছে নিজ নিজ দলীয় এজেন্ডার দিকে। সমগ্র ইসলামের দিকে ডাকা নিয়ে কারো কোন ভাবনা নাই। মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা হওয়ার বদলে অধিকাংশ মুসলিম পরিণত হয়েছে জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারজিম, ব্যক্তিতন্ত্র, রাজতন্ত্র, দলতন্ত্রের খলিফাতে। তারা কাজ করছে অমুসলিমদের থেকে নবীজী (সা:)’র ইসলামকে আড়াল করার কাজে। ইউরোপ-আমেরিকায় যারা মুসলিম হচ্ছে -তারা মুসলিম হচ্ছে পবিত্র কুর’আন পড়ে, মুসলিমদের দেখে নয়। কারণ মুসলিমদের মাঝে ভেজাল ঢুকলেও কুর’আন রয়ে গেছে শতভাগ বিশুদ্ধ।
সৈয়দ জামাল উদ্দীন আফগানী এরূপ বদলে যাওয়া মুসলিমদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “মেঘ যেমন সূর্যকে আড়াল করে, মুসলিমগণ তেমনি আড়াল করে রেখেছে ইসলামকে।” এভাবে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের পথে মূল বাধাটি সৃষ্টি হচ্ছে খোদ মুসলিমদের পক্ষ থেকেই। কোন আধুনিক আবু জেহেল ও আবু লাহাব ইসলামের প্রচার রুখতে রাস্তা রুখছে না। নবীজী (সা:)’র মিশন থেকে দূরে সরার কারণে ৫ শত বছর আগে পৃথিবীর যতটুকু ভূ-ভাগ জুড়ে ইসলাম প্রসার পেয়েছিল, ইসলামে সেখানেই থেমে আছে। কোন নতুন দেশেই ইসলামের প্রসার ঘটেনি। বরং ৭ শত বছরের মুসলিম শাসনের পর স্পেন ও পর্তুগালের মত দেশ থেকে ইসলাম বিলুপ্ত হয়েছে। এবং ভারত, চীন, রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অধিকৃত ভূমিতে ইসলাম বেঁচে আছে নিছক নিভু নিভু প্রদীপের ন্যায়। এ বিপর্যের কারণ, দ্বীনের প্রচারে নবীজী (সা) ও তাঁর সাহাবাদের গুরুত্বপূর্ণ সূন্নতটি মুসলিম ভূমিতে মারা পড়েছে বহু আগেই। মুসলিমদের মূল ব্যর্থতাটি এখানে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হওয়ায়। আরো বিপদের কারণ, এ নিদারুন ব্যর্থতা নিয়ে মুসলিমদের চেতনার ভূমিতেও কোন চিন্তা-ভাবনা নাই? লন্ডন, ০৬/১০/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018