আমার কোভিড অভিজ্ঞতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on November 24, 2020
- Bangla Articles, আমার স্মৃতিকথা
- 7 Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
মহাদয়াময় মহান আল্লাহতায়ালার অপরিসীম মেহেরবানী যে তিনি আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। নিজের কোভিড অভীজ্ঞতা নিয়ে আজ যেরূপ অন্যদের সামনে আমার কথাগুলি তুলে ধরছি সে সামর্থ্যটি তো একমাত্র তারই দেয়া। অতি সত্য কথা হলো, করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালা আমাকে একটি নতুন জীবন দান করেছন। আমি দয়াময় রা্ব্বুল আলামীনের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। গত এপ্রিলের ২৫ তারিখে আমাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতাল থেকে বের হই ১৭ই সেপ্টম্বর। মোট ১৪৬ দিন থাকি হাসপাতালে। এর মধ্যে ১২০ দিন থাকি আই.সি.ইউ’তে। এতো দীর্ঘদিন আই.সি.ইউ’তে থাকার ইতিহাস অতি বিরল। আমাকে চিকিৎসা করা হয় কোভিড রোগী হিসাবে। কোভিড রোগ সাধারণতঃ তিন প্রকারের হয়ে থাকে। এক). ম্রিদু (mild) মাত্রার; দুই). মাঝারি (moderate) মাত্রার; তিন). গুরুতর (severe) কোভিড। আমার ক্ষেত্রে শুরু হয় ম্রিদু মাত্রা নিয়ে। প্রথমে শুকনো কাশি দেখা দেয়। এরপর রাতে জ্বর ও কাঁপুনি। পরে রূপ নেয় গুরুতর কোভিডে। শতকরা ৯০ ভাগ কোভিডের ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। রোগীকে হাসপাতালে নিলেও দ্রুত বিদায় দেয়া হয়। কিন্তু বাঁকি শতকরা ১০ ভাগের ক্ষেত্রে রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। রোগীকে অক্সিজেন দেয়া লাগে, অনেককে আই.সি.ইউ (intensive care unit)’তে ভর্তি করা লাগে। এদের মধ্য থেকে অনেকে মারা যায়। আমি ছিলাম শেষাক্ত গ্রুপের একজন।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মাত্র একদিন আগে আমার হাসপাতাল কর্মস্থল থেকে বিকালে লন্ডনের বাসায় ফিরি। সেদিন ব্যস্ত মটরওয়েতে ঘন্টায় ৭০ মাইল বেগে বিরামহীন তিন ঘটা গাড়ি চালিয়েছিলাম। আমি সেখানে মেডিসিনের কনসাল্টেন্ট হিসাবে কাজ করতাম। ফিরার পথে তেমন কোন অসুবিধাই মনে হয়নি। রাতে ভালই ঘুম হলো। পরের দিন সকালেও ভাল ছিলাম। বিকালে দুর্বলতা অনুভব করতে থাকলাম। কাশিও হচ্ছিল। গায়ে জ্বর ছিল না। কোভিড নিয়ে সমস্যা হলো রোগটি নীরবে দেহে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। রোগী জানতে পারে না যে সে মহাবিপদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিকেলে আমার মনে হলো, আমার অক্সিজেন লেবেল দেখা উচিত। কোভিডের প্রধান লক্ষণ হলো, রক্তের অক্সিজেন লেবেল নীচে নামিয়ে আনে। বাসায় অক্সিজেন মাপার কোন যন্ত্র ছিল; আমার ছেলে সেটি দ্রুত বাজার থেকে কিনে আনে। দেখা গেল আমার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৮৬%। স্বাভাবিক মাত্রা হলো ৯৪-৯৮%। বুঝতে পারলাম, দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে এবং অক্সিজেন নিতে হবে। আমার যে কোভিড হয়েছে তা নিয়ে আর কোন সন্দেহই থাকলো না। সাথে সাথে এ্যাম্বুলেন্স ডাকা হলো।
আমার এক ছেলে এবং ৪ মেয়ে। এক মেয়ে কাছে থাকে। অন্যদের খবর দেয়া হলো। তারা কাছেই থাকতো; তাড়াতাড়ি চলে এলো। ইতিমধ্যে আমার ইমেল লিস্টে যাদের নাম ছিল সবাইকে বার্তা দিলাম যে আমি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছি। আমি তাদের কাছে দোয়ার আবেদন করলাম। আমার ইমেল তালিকায় অনেক নেকবান্দাহ আছেন এবং তারা আমাকে ভালবাসেন। আমার বিশ্বাস ছিল, এ খবর পাওয়া মাত্র তারা আমার জন্য রাব্বুল আলামীনের কাছে আন্তরিক ভাবে দোয়া করবেন। এবং দোয়াই ছিল ভরসা।
১০ মিনিটের মধ্যেই এ্যাম্বুলেন্স এসে গেল। প্যারামেডিকগণ আমার অক্সিজেন চেক করে দেখলো অক্সিজেন লেবল অনেক নীচে। সাথে সাথে অক্সিজেন দেয়া শুরু করলো। এবার আমাকে এ্যাম্বুলেন্সে নেয়ার পালা। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের মুখ তখন অত্যন্ত বিবর্ণ। লন্ডনে শত শত মানুষ তখন কোভিডের কারণে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। ফলে চারিদিকে কোভিড ভীতি। তাই কোভিডে আক্রান্ত হওয়াটি মামূলী বিষয় নয়। আবার ঘরে ফিরবো কি না তা নিয়ে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক। সবাইকে বিদায় জানালাম; এ্যাম্বুলেন্স দ্রুত রওয়ানা দিল হাসপাতালের দিকে। সাথে কারো হাসপাতালে যাওয়ার অনুমতি নেই, তাই একাকী যেতে হলো।
আমার বাসা থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী হলো কিং জর্জ হাসপাতাল। সেখানেই আমাকে নেয়া হলো। দেখি কোভিড রোগীদের জন্য আলাদা গেট। আমাকে নেয়া হয় এ্যাকসিডেন্ট ও ইমার্জেন্সী বিভাগের রিসাসিটেশন রুমে। সেখানে আবার অক্সিজেন মাপা হলো। দ্রুত এক্স-রে করা হলো এবং ব্লাড পরীক্ষার জন্য রক্ত নিল। প্রথমে অক্সিজেন দেয়া শুরু হয় সাধারণ মাস্ক দিয়ে। পরে CPAP (continuous positive airway pressure) লাগানো হয়। আমি তখনও সজ্ঞান এবং স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছি। CPAP সহ্য করা সহজ নয়। আমি একসময় লন্ডনের হাসপাতালে রেসপিরেটরী মেডিসিনের রেজিস্টার ছিলাম। বুঝতে পারলাম, কেন অনেক রোগী CPAP লাগানোর চেয়ে মরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করতো। আমাকে কতক্ষন CPAP’য়ের উপর রাখা হয়েছিল তা আমার জানা।
প্রথম রাতটি আদৌ ভাল কাটেনি। উপড় হয়ে শুয়ে বহু কষ্ট সয়ে অক্সিজেন নিতে হয়েছে। যতক্ষন হুশ ছিল ভেবেছি, আর কত ঘন্টা এভাবে আমাকে কষ্ট সইতে হবে? এভাবে দিনের পর দিন থাকা তো অসম্ভব। ইতিমধ্য একজন ডাক্তার এসে বললেন, আমাকে ভিন্টিলেটরের উপর রাখাটি জরুরী। তিনি আমার সম্মতি চান। আমি সাথে সাথে সম্মতি জানিয়ে দিলাম। বুঝতে বাঁকি থাকলো না, আমার অবস্থা অতি গুরুতর। ভিন্টিলেটর হলো কোভিড চিকিৎসার সর্বশেষ স্তর। তখন মনে হলো, আমার বেঁচে থাকা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। এখন যে পৃথিবীটা দেখছি সম্ভবতঃ এটিই শেষ দেখা।
ভিন্টিলেটরের কথা শুনে মনের ভিতরে হতাশা ও বেদনাটি অতি গভীর হলো। আমার জীবনে একটি স্বপ্ন ছিল। মনে হচ্ছিল, স্বপ্নটি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। অথচ স্কুল জীবন থেকে সে স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছি। আমি স্বপ্ন দেখতাম পশ্চাদপদ, পরাজিত ও অপমানিত মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে কিছু করার। আমি বিশ্বাস ছিল, মুসলিম উম্মাহর অভাব সম্পদে নয়, লোকবলে নয়, ভূগোলেও নয়। সেটি জ্ঞান। জ্ঞানই মানুষকে দেয় শক্তি, বিজয় ও ইজ্জত। আদম (আঃ) জ্ঞানের বলেই ফিরেশতাদের সাথে প্রতিযোগিতায় জিতেছিলেন এবং তাদের সিজদা পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়েছিলেন। আদম (আঃ) সে জ্ঞান পেয়েছিলেন মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। তাই জ্ঞানদান মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। মহান নবীজী (সাঃ)কেও তাই নামায-রোযা দিয়ে তাঁর মিশন শুরু করতে বলেননি। শুরু করেছেন ইকরা তথা পড় ও জ্ঞানবান হও –এদিয়ে। তাই আমার স্বপ্ন ছিল, শেখা ও শেখানোর রাজ্যে কিছু কাজ করা। জ্ঞান বিতরণের কাজে লেখনীকে বেছে নেয়া।
লেখনীর শক্তি যে কত প্রচণ্ড –সেটি আমি ছোট বেলা থেকেই অনুভব করেছি। বহুবই আমার শরীরে তখন শিহরণ তুলেছে। সেসব বই পড়ে আমি চেয়ারে বসে থাকতে পারতাম না। তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হতো আমার মনের ভূবনে। সভ্য সমাজ বা সভ্যতা কখনোই ভাল পানাহারের কারণে সৃষ্টি হয় না; সেটি হয় ভাল বইয়ের কারণে। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম, হায়! আমি যদি তাদের মত লেখক হতে পারতাম। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, ডাক্তারী, ইঞ্জিনীয়ারিং –এরূপ নানা পেশায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড়। কিন্তু একটি জাতি কতটা মানবিক গুণাবলী নিয়ে বেড়ে উঠবে -সেটি নির্ভর করে সে জাতির মাঝে কতজন জ্ঞান বিতরণের কাজে তথা লেখালেখিতে নিয়োজিত হলো তার উপর। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে আমি বেছে নিয়েছিলাম সন্মানজনক উপার্জন ও মানব খেদমতের হাতিয়ার রূপে। কিন্তু বাঁচার মূল লক্ষ্যটি ছিল মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা। এবং সে লক্ষে লেখালেখির ময়দানে তাঁর একজন একনিষ্ট সৈনিক রূপে যুদ্ধ করা। তাই কলম বেছে নিয়েছিলাম সে যুদ্ধে হাতিয়ার রূপে। লেখালেখির কাজে নিজের সামর্থ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে উর্দু, ফার্সি এবং আরবী ভাষা শেখার চেষ্টা করেছি। বিগত তিরিশ বছরের বেশী কাল ধরে সে স্বপ্ন নিয়ে বহুশত প্রবন্ধ লিখেছি। সেগূলির সবই ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকা, জার্নাল ও ওয়েব সাইটে। বহুদিন ধরেই ভাবছিলাম এ লেখাগুলিকে দীর্ঘ আয়ু দিতে হলে বই আকারে প্রকাশ করতেই হবে। সেগুলি তখন আমার জন্য সাদকায়ে জারিয়া হবে। ভাবছিলাম, আগামী এক বছরের মধ্যেই কয়েক খানি বই প্রকাশ করবো। তাই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পূর্বে গভীর রাত জেগে জেগে আমার সে প্রবন্ধগুলির এডিটিং করছিলাম। কিন্তু কোভিড যেন আমার সব স্বপ্ন চুরমার করে দিল। সে বেদনাটি আমাকে খুবই কষ্ট দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এখন মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ফিরে যাওয়ার পালা। দুঃখ হচ্ছিল, আমি তো ফিরে যাচ্ছি এক রকম খালি হাতে। আফসোস হচ্ছিল, সাদকায়ে জারিয়ার কিছুই রেখে যেতে পারলাম না। মহান আল্লাহতায়ালা আমাকে যা দিয়েছেন তা তো ওপারে পাঠাতে পারলাম না। সে এক করুণ বেদনা। ওপারে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মাত্র, এমন মুহুর্তেই কোভিডের হামলা। পরে ভাবলাম, আমি তো স্রেফ স্বপ্নই দেখতে পারি। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার সামর্থ্য তো আমার হাতে নাই। আমাকে নিয়ে তো মহান আল্লাহতায়ালার নিজস্ব পরিকল্পনা আছে। আমি যে তাঁর সৈনিক -সেটি মহান আল্লাহতায়ালা ছাড়া আর কে ভাল জানেন? তিনি তো আমার নিয়েত জানেন। অতএব আমার কাজ মহান আল্লাহতায়ালার পরিকল্পনার কাছে আত্মসমর্পণ করা। নিজেকে শান্তনা দিচ্ছিলাম এভাবে। এরূপ ভাবনার মধ্যেই হারিয়ে গেলাম।
কখন আমাকে ভিন্টিলেটরের উপর নেয়া হলো আমার তা জানা নাই। ভিন্টিলেটর কখনোই সজ্ঞান মানুষের উপর লাগানো যায় না। রোগীকে অজ্ঞান করতে হয়। আমাকে কখন অজ্ঞান করা হয় –সেটিও বুঝতে পারিনি। অজ্ঞান অবস্থায় কখন কি হয়েছে তা একটুও টের পায়নি। একবার চোখ খুলে দেখি আমার ছেলে আমার পাশে বসা। তার মুখে হাঁসি। সম্ভবতঃ তখন আমার মুখেও হাঁসি ছিল। কারণ, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর এই প্রথম পরিবারের কাউকে দেখছি। কনসাল্টেন্ট তাকে ডেকে এনেছে আমাকে দেখে যাওয়ার জন্য। সে আমাকে প্রশ্ন করলো, কতদিন আমি হাসপাতালে আছি। আমি বল্লাম, এক দিন বা দুই দিন। সে বল্লো তুমি আড়াই মাস বেহুশ ছিলে। আরো বল্লো, আমার অবস্থা নাকি খুবই খারাপ ছিল, ডাক্তার খুবই সমস্যায় পড়েছিল আমার অক্সিজেন লেবেল কাঙ্খিত মাত্রায় আনতে। একসময় ১০০% অক্সিজেনও দিতে হয়েছে। তখনও বুঝতে পারিনি যে, আমি আই.সি.ইউতে।
পরে আমার স্ত্রী ও ছেলে থেকে জানতে পারি, আই.সি.ইউ’র ডাক্তারগণ আমার ব্যাপারে খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিল। তারা ভেবেছিল, আমি আর বাঁচবো না। গত রামাদ্বানের মাঝামাঝি সময়ে অবস্থা এতোই খারাপ হয়ে যায় যে, ডাক্তার বাসায় ফোন করে আমার স্ত্রীকে তাড়াতাড়ি শেষদেখা দেখার জন্য হাসপাতালে আসতে বলে। তবে করুণাময় মহান আল্লাহর রহমতে সে সময় অবস্থা আর খারাপ হয়নি। কিন্তু তার ২ সপ্তাহ পর ঈদুল ফিতরের দিন অবস্থা আবার খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তারদের পক্ষ থেকে আমার পরিবারের প্রতি ডাক আসে শেষ দেখা দেখে আসার জন্য। মহান আল্লাহতায়ালার অপার মেহেরবানী যে, সেবারও রক্ষা পেয়ে যাই্। পরের দিন ডাক্তার ফোনে আমার ছেলেকে জানায়, “সুখবর আছে, তোমার আব্বার শরীর ভালোর দিকে।” এরপর আমি ধীরে ধীরে সুস্থ্য হতে থাকি। উল্লেখ্য হলো, হাসপাতালের কনসাল্টেন্ট ও নার্সগণ আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে বেশ ভাল ব্যবহার করেছেন। আই.সি.ইউ’য়ের টিম আমার জন্মদিনও পালন করেছে। এবং তার ছবি NHS (National Health Service) ওয়েব সাইটে দিয়েছে। সে ছবি আমার বন্ধুগণ বিলেত, বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশ থেকে দেখেছে।
আমার জ্ঞান ফিরে আসার পর আই.সি.ইউ’য়ের কনসাল্টেন্ট ও নার্সগণ আমার অবস্থার বর্ণনা শুনানে শুরু করেন। আমি যেহেতু ডাক্তার তাদের সেসব বলার বেশ আগ্রহও ছিল। তারা সবাই বলতো, এটি অলৌকিক ব্যাপার যে আমি বেঁচে গেছি। সত্য হলো, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এরূপ অলৌকিক কিছু ঘটানো কোন ব্যাপারই নয়। আমি স্বচোখে আমার ফুসফুসের সিটি স্কান দেখেছি। ফুসফুসের যে অবস্থা দেখেছি তাতে সত্যই বেঁচে যাওয়াটি আমার কাছে অলৌকিকই মনে হয়েছে। আমার দুটি ফুসফুসেই নিউমোনিয়া হয়েছিল। সে সাথে দুই ফুসফুসেই ইম্বোলিজম হয়েছিল; সে সাথে পানিও জমেছিল। আমার কিডনি ফেল করায় ডায়ালাইসিস দিতে হয়েছিল। ফুসফুসে ইম্বোলিজম হওয়াতে হার্টও ফেল করেছিল। সে সাথে লিভারেও দোষ দেখা দিয়েছিল। অথচ কোভিড হওয়ার আগে আমি সুস্থ্য ছিলাম। আমার ফুসফুস, কিডনি, হার্ট, লিভার –এসব কিছুই পুরাপুরি সুস্থ্য ছিল।
হুশ ফেরার পরও আমি দুই মাস হাসপাতালে ছিলাম। পরিবারের কাউকে আসতে দিত না। ভিডিও মারফত সাক্ষাৎ করানো হতো। বেহুশ অবস্থায় আমার শরীরের উপর কীরূপ বিপদ গেছে তা বুঝতে পারিনি। কিন্তু যখন হুশ ফিরলো তখন শুরু হলো নতুন সমস্যা। এমন রাতও গেছে যে একটি মিনিটও ঘুমাতে পারিনি। জীবনে কোনদিন ঘুমের বড়ি খেতে হয়নি। কিন্তু তখন ঘুমের বড়ি না খেলে ঘুমই হতো। আবার ঘুম হলে নানা রূপ স্বপ্ন দেখতাম। হ্যালুসিনেশন হতো। আমার বাম হাতে কোন শক্তি ছিল না। খাড়া হওয়া দূরে থাক, বসে থাকতে পারতাম না। পাঁচ মিনিট বসে থাকলেই হাঁপিয়ে উঠতাম। অক্সিজেন দেয়া লাগতো। ফিজিওথেরাপিস্টগণ কাজ শুরু করলো। বাচ্চাকে হাটা শেখানোর ন্যায় আমাকে হাটা শেখানো শুরু করলো। দুই চার কদম হাটতে পারলে ফিজিওথেরাপিস্টরা বাহবা দিত। পাশে হুইল চেয়ার ও অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে তারা প্রস্তুত থাকতো আমাকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য। প্রায় দুই মাস এ রকম ফিজিওথেরাপির দেয়ার পর আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে সমর্থ হলাম। তখন তারা বল্লো, আমি এখন বাসায় ফিরতে পারবো।
হাসপাতালের দিনগুলিতে আমি বিচ্ছিন্ন হয়েছিল দুনিয়ার জগত থেকে। সে মুহুর্তে তীব্রতর হয়েছিল আখেরাতের ভাবনা। আমি মৃত্যুকে অনেক কাছে থেকে দেখেছি। নড়বড়ে পায়ে দাঁড়িয়েছিলাম এপার ও ওপারের মাঝে এমন এক খাড়া পর্বত চুড়ার উপর যে সামান্য ধাক্কা দিলেই অনন্ত অসীম পরকালে গিয়ে পড়তাম। সেখান থেকে আর ফিরে আসা যেত না। আমার শরীরের কোভিড যে কোন সময় আরো খারাপ রূপ নিতে পারতো। এ পার্থিব জীবন কতই না ভঙ্গুর! করোনার ন্যায় কত অসংখ্য অদৃশ্য প্রাণনাশী শত্রুর মাঝে আমাদের বসবাস। অথচ এর বিপরীত এক মৃত্যহীন জীবন রয়েছে পরকালে। সেখানে কোন করোনা নাই। জান্নাতে স্থান পেলে সামান্যতম ব্যাথা-বেদনাও নাই। অথচ সে পরকাল নিয়ে ভাবনাই নাই। এর চেয়ে বড় বেওকুফি আর কি হতে পারে? জান্নাতের পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার চেয়ে বুদ্ধিহীনতাই বা কি হতে পারে?
সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, জীবন ও মৃত্যুর ফয়সালাটি কখনোই জমিনের উপর হয় না। সেটি হয় আসমানে। ফয়সালা নেন একমাত্র আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালা। সেখানে কারো অংশীদারিত্ব চলে না। পবিত্র কোর’আনে তাই বলা হয়েছে “মা আসাবা মিম মুসিবাতিন ইল্লা বি ইযনিলিল্লাহ” –(সুরা তাগাবুন, আয়াত ১১)। অর্থঃ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদই তোমাদের স্পর্শ করতে পারে না। তাই কোন প্রাণনাশী ভাইরাস বা জীবাণু মৃত্যু ঘটাতে পারে না -যদি না সে সিদ্ধান্তটি মহান আল্লাহতায়ালার হয়। তবে এক্ষেত্রে দোয়ার শক্তি বিশাল। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দার দোয়া শুনেন এবং জবাবও দেন। সে কথাটি পবিত্র কোর’আনে বার বার বলা হয়েছে। বলা হয়েছে “ফাজকুরুনী, আজকুরুকুম”। অর্থঃ তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করবো। এবং মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণে যাওয়া তথা তাঁর সাহায্য পাওয়ার উত্তম মাধ্যম হলো দোয়া।
মহান আল্লাহতায়ালা আমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে অনেক কিছু জানার সুযোগ করে দিয়েছেন। মারা গেলে কিছুই জানতে পারতাম না। আমি কোন বিখ্যাত ব্যক্তি নই; অন্যদের সাথে আমার যে সংযোগ -সেটি শুধু লেখনীর মাধ্যমে। কিন্তু অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছি জেনে যে, হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন দেশে আমার জন্য দোয়া করেছেন। লন্ডনের বিভিন্ন মসজিদে আমার জন্য সমবেত ভাবে দোয়া করা হয়েছে। ইন্টারনেটে জুম বৈঠক করে দোয়া করা হয়েছে একাধিক বার। দোয়ার মজলিস বাংলাদেশেও হয়েছে। সূদুর কানাডাতেও দোয়া হয়েছে। কেউ কেউ আমার জন্য সাদাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ চোখের পানি ফেলেছেন। এসবই শুনেছি অন্যদের থেকে। বিশাল মনের অধিকারি এসব ভাইবোনদের বেশীর ভাগকে আমি কোনদিন দেখিনি। তাদের এ বিশাল মনের পরিচয় জেনে আমি অত্যন্ত অভিভূত হয়েছি। এমনটি কোনদিনই ভাবতে পারিনি। ভালবাসা কেনা যায় না। ভালবাসা দেখানোর সামর্থ্যও সবার থাকে না। ফলে যারা সেদিন আমার প্রতি ভালবাসা দেখিয়েছেন তারা নিঃসন্দেহে মহৎ গুণের অধিকারী। আমি তাদের প্রতি গভীর ভাবে কৃতজ্ঞ। মহান আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়ই তাদেরকে প্রতিদান দিবেন। ইসলামী ভাতৃত্ববোধ যে মুসলিমদের মাঝে এখনো বেঁচে আছে -এ হলো তারই নমুনা। নানা হতাশার মাঝে এটিই বিশাল আশার পথ দেখায়। গভীর ভাবে আমাকে অনুপ্রেরণাও জোগায়। মুসলিমগণ যখন ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠে তখন হিংসার বদলে এরূপ দোয়ার সংস্কৃতিই প্রবলতর হয়। মানুষ তো এভাবেই একে অপরের প্রতি কল্যাণমুখি হয়। ২৪/১১/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018
We prayed to Allah SWT for your comfort and speedy and, complete recovery in our Zoom Dua Mehfil.
We prayed for you.
We express our gratitude to Allah SWT for returning you to us.
We pray to Allah SWT to give you good health and strength to carry on writing for humanity and for what is just and right.
With best regards.
Dr. Hasanat Mohammad Husain
MBE,
Convenor,
Voice for Justice World Forum
Assalamu alaikum.
Dear Dr. Hasanat,
I am highly grateful for dowa. InshAllah will give the reward for your dowa.
Thanks again.
Firoz Mahboob Kamal
Assalamu Alaikum.
Thanks for the inspirational blog.
Assalamu alaikum,
Very sad to hear. May be Allah SWT cleansed your sins if there were any.
May Allah SWT keep you healthy and allow to write more for the people of darkness and show them right path.
Thanks
Aftab Sheikh
USA
আসসালামুয়ালিকুম। একটু দেরিতে হলেও আপনার সুন্দর আর মূল্যবান লেখাটা পড়ার সৌভাগ্য হলো। আল্লাহ্সুবাহান্নাহ আমাদের কখন কিভাবে পরীক্ষা করেন আর রহমত দান করেন তা তিঁনিই ভালো জানেন। আমাদের সাধারণের পক্ষে সব অনুভূতি বা অভিজ্ঞতার কথা সুন্দরভাবে প্রকাশ করা সহজ হয়না, আল্লাহ আপনাকে সেই শক্তি দিয়েছেন। আপনি যে আপনার অভিজ্ঞতা আর সেইসাথে মূল্যবান কিছু কথা সবার জন্য তুলে ধরেছেন তার জন্য ধন্যবাদ। অনেক ভালো ভালো কথার মধ্যে “… একটি জাতি কতটা মানবিক গুণাবলী নিয়ে বেড়ে উঠবে -সেটি নির্ভর করে সে জাতির মাঝে কতজন জ্ঞান বিতরণের কাজে তথা লেখালেখিতে নিয়োজিত হলো তার উপর ” কথাটি খুব ভালো লাগলো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রহমত দান করুন।
আস্সালামু আলাইকুম।
ডা. কাশেম আলী ভাই প্রথম জেদ্দায় আমাদেরকে আপনার কোভিড আক্রান্তের খবর দেন। তখনি আমরা আপনার জন্য অনেক দুআ করেছি। মক্কায় গিয়েও আল্লাহর কাছে দুআ করেছি। আল্লাহর কি ইচ্ছা!
যে কাশেম আলী ভাই আপনার অসুস্থতার খবর দিলেন, দুআ চাইলেন তিনি নিজে করোনা আক্রান্ত হয়ে দুনিয়া ছেড়ে মা’বুদের কাছে চলে গেলেন।
আল্লাহ গাফুরুর রাহীম ডা. কাশেম আলী ভাইকে মাফ করে দিয়ে জান্নাতে দাখিল করুন। আলহামদুলিল্লাহ, সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ, তিনি যে আপনাকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
ওয়ালাইকু আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
প্রিয় ভাই শাহিদ আল ইসলাম,
ডা. কাশেম আলী আমার একান্ত আপন জন ছিলেন। আমি জানি, আমার জন্য উনি অনেক বেশী দোয়া করেছেন। ফোনে আমার সন্তানদের থেকে নিয়মিত খবর নিতেন। আমি তখন অজ্ঞান। আমি জানতে পেরেছি আপনারাও আমার জন্য বহু দোয়া করেছেন। দয়াময় আল্লাহতায়ালা আপনাদের দোয়া কবুল করেছেন এবং আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। আমি আপনাদের প্রতি অতি কৃতজ্ঞ। আশাকরি আল্লাহতায়ালা আপনাদের পুরস্কার দিবেন।
কাশেম অসুস্থ হয়েছেন যেনে উনার জন্য দোয়া করেছিল। উনি যখন হাসপাতালে তখন উনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। উনার বুকের এক্সরে দেখেছি। এক্সরে দেখে এতো খারাপ মনে হয়নি। কিন্তু সবই আল্লাহর ইচ্ছা। দোয়া করি দয়াময় উনাকে জান্নাত দিন এবং উনার পরিবারকে ছবর দান করুন। আমীন। ফিরোজ মাহবুব কামাল