আসামে মুসলিম হত্যা এবং মানবতার মৃত্যু বাংলাদেশে

ফিরোজ মাহবুব কামাল

গত ২৩ সেপ্টেম্বর আসামের দারাঙ্গ জেলার ধোলপুর গ্রামে আসামের বিজিপি সরকারের পুলিশ দুইজন মুসলিম কৃষককে হত্যা করেছে। ঐ গ্রামে ঐদিন পুলিশ ব্রহ্মপুত্র নদীর চর থেকে বাঙালী বসতীদের উচ্ছেদে নামে। বিজিপি সরকারের অভিযোগ, চরের বাসিন্দারা বাংলাদেশ থেকে আগত এবং তারা বেআইনী ভাবে সেখানে জমি দখল করে বসতি গড়েছে। সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে, সেখান থেকে মুসলিমদের উচ্ছেদ করে সে জমি স্থানীয় আসামীদের মাঝে বিতরণ করবে। উচ্ছেদের প্রতিবাদে নেমেছিল স্থানীয় জনগণ। তাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। কিন্তু পুলিশ তাদের উপর গুলী চালায়। পুলিশের গুলীতে দুই জন নিহত হয়। এবং একপাল পুলিশের চোখের সামনে নিহত একজনের দেহের উপর এক নরপশু মনের আনন্দে লাফাতে থাকে। পুলিশ তাকে থামায়নি। লাশের উপর লাফানোর সে ছবি বিশ্বময় ভাইরাল হয়েছে।

এ বিবেকহীন বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে বহু হাজার দূরের আরব বিশ্বে। খবর বেরিয়েছে কাতার, কুয়েতসহ বেশ কিছু আরব দেশের জনগণ ভারতের ২৬টির বেশী পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে পশ্চিম বঙ্গের মুসলিমগণও। বেশ কিছু ভারতীয় পত্রিকাতে ও সোসাল মিডিয়ায় এ নিয়ে ধিক্কার উঠেছে। তবে বাওলাদেশও ইতিহাস গড়েছে। তবে সেটি এ বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নয়। বরং নীরবতার। ১৮ কোটি মানুষের এদেশটিতে মৃত্যু ঘটেছে মানবতার। বহু হাজার মাইল দূরের আরব জগতে জনগণে মাঝে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা শোনা গেলেও বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নামেনি। সরকারের পক্ষ থেকেও কোন নিন্দার বাণী শোনানো হয়নি। প্রতিবেশীর ঘরে আগুণ লাগলে বা মানুষ খুন হলেও পাশের ঘরের মৃত মানুষটি টের পায় না। বাংলাদেশের অবস্থা অবিকল তাই।

আসামের মুসলিমদের বিরুদ্ধে এরূপ হত্যাকান্ডের ঘটনা এই প্রথম নয়। অতি নৃশংস গণহত্যা ঘটেছিল ১৯৮৩ সালের ১৮ই ফেব্রেয়ারী তারিখে নওগাঁও জেলার নেলীতে। সরকারী হিসাব মতে সেদিন ১৪টি গ্রামের ২১৯১ জন মুসলিমকে হত্যা করা হয়। বেসরকারী হিসাব মতে নিহতদের সংখ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছি। হত্যার কারণ, অত্র এলাকায় লোক সভার একটি উপ নির্বাচন। আসামী ছাত্রদের সংগঠন All Assam Students Union (ASSU) দাবী করে ভোটার লিস্ট থেকে মুসলিমদের বাদ দিতে হবে। তাদের অভিযোগ মুসলিমগণ বাংলাদেশ থেকে অবৈধ প্রবেশকারী, অতএব তারা ভোট দিতে পারবে না। তখন আসামে ছিল কংগ্রসের সরকার। সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগুয়। বদলা নিতে এবং ভোটার কমাতে ১৪টি গ্রামে শুরু হয় নৃশংস গণহত্যা। হাজার হাজার স্থানীয় উপজাতীয়রা কয়েক ঘন্টার মধ্যে এ হত্যাকান্ড চালায়।

সে গণহত্যাকে নিয়ে পুলিশের খাতায় ৩১০টি ফৌজদারী মামলা হয়। কিন্তু ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি আসামীদের ছাত্রসংগঠন ASSU’র সাথে সমঝোতা চুক্তি করে এবং সকল মামলা তুলে নেয়। ফলে এতবড় গণহত্যা ঘটে যাওয়ার পরও কোন বিচার হয়নি এবং একজন খুনিরও শাস্তি হয়নি। ভারতের মুসলিমদের রক্তের দাম যে কত তুচ্ছ -ভারত সরকার সেদিন সেটিই প্রমাণ করেছিল।

নেলী গণহত্যার তদন্তে বিচারপতির তেওয়ারীর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন ঘটিত হয়। তেওয়ারী কমিশন ১৯৮৪ সালে ৬০০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট পেশ করে। উক্ত রিপোর্টের মাত্র তিনটি কপি রয়েছে। কিন্তু সে রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হয়নি। এবারের ঘটনার পরও তদন্ত কমিটি ঘটিত হয়েছে। তবে তদন্ত হচ্ছে যে ব্যক্তি লাশের উপর নাচলো তার ব্যাপারে। কিন্তু যে পুলিশগণ হত্যা করলো এবং যাদের চোখের সামনে এ বর্বরতা ঘটলো তাদের বিচার করতে নয়। এটাই ভারতীয় নীতি। মুসলিম নির্মূলের পর এভাবেই তদন্ত কমিটি ঘটিত হয়। কিন্তু তাতে যেমন কারো শাস্তি হয়না, তেমনি ভারতে মুসলিম নিধনের কাজও কমেনা।  বরং চেষ্টা হচ্ছে নাগরিকত্ব রেজিস্ট্রেশনের নামে বহু লক্ষ বাঙালী মুসলিমকে নাগরিকত্বহীন করার। এবং লক্ষ্য, গলাধাক্কা দিয়ে তাদের বাংলাদেশে পাঠানো। 

প্রশ্ন হলো, ভারতে কেন এতো মুসলিম নির্মূলের গণহত্যা? কারণ একটাই। ভারতের এ মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ছাড়া  দক্ষিণ এশিয়ার বুকে প্রতিবাদের করার কেউ নাই। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ভারতের পদলেহী গোলাম রাষ্ট্রে। মনিব খুনি, ধর্ষক বা ডাকাত হলেও, পালিত গোলাম তাকে কুর্ণিশ করে। হাসিনা তাই ৭৫টি গোলাপ দিয়ে মোদীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বাংলাদেশ নিজেই আরেক আসাম। আসামের মুসলিমগণ তবুও ভোট দিতে পারে, বাংলাদেশের মুসলিমদের তো সে স্বাধীনতাও নাই। যে নৃশংসতা নিয়ে আসামের নেলীতে গণহত্যা হয়েছে, একই রূপ নৃশংসতা নিয়ে গণহত্যা হয়েছে ২০১৩ সালে ৫মে শাপলা চত্ত্বরে। নেলীর গণহত্যা চালিয়েছে আসামী অমুসলিম উপজাতীয়রা, আর শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যা চালিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহনীর সদস্যরা।

এক বাঘ আরের বাঘের শিকার ধরা নিয়ে নিন্দা করে না। তেমনি যারা নিজেরাই খুনি তারা অন্য খুনীদের নিন্দা করে না। তাই ভারতে মসজিদ গুড়িয়ে দিলে বা মুসলিম বিরোধী গণহত্যা হলে বাংলাদেশ সরকারের মুখে প্রতিবাদ উঠেনা। প্রতিবাদের জন্য মানবতা লাগে। সুস্থ্য বিবেক লাগে। চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত ও গুম-খুন-সন্ত্রাস-ধর্ষণের নায়কদের সে বিবেক ও মানবতা থাকার কথা নয়। বাংলাদেশে যারা শাসন ক্ষমতায় তাদের সে বিবেকের মৃত্যু ঘটেছে অনেকে আগেই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে। তারাই বা কতটুকু বিবেকবান। মানবতা কতটুকু বেঁচে আছে তাদের হৃদয়ে? কলকাতার বুকে বাঙালী মুসলিমগণ যেরূপ বিক্ষোভ করলো, সেরূপ বিক্ষোভই বা কেন বাংলাদেশীদের পক্ষ থেকে হয়না? তাদের বিবেক যে বেঁচে আছে সে প্রমাণ কই? কোন বিবেকবান মানুষই কোন খুনির নিকট থেকে পণ্য কেনে না। তার সাথে মিতালী গড়ে না। এ কাজ তো আরেক খুনির। ভারতীয় পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হলো ভারত। বাংলাদেশীরা যদি ভারতে পণ্য বর্জন করতো তবে ধ্বস নামতো ভারতীয় অর্থনীতিতে।

শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু অস্ত্র দিয়ে হয় না, অর্থনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি দিয়েও হয়। কিন্তু সে যুদ্ধের জন্য সাহসী মন লাগে। জাগ্রত বিবেক লাগে। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সে বিবেক ও মন বেঁচে নাই বাংলাদেশীদের মাঝে। এমন এক মৃত বিবেকের মানুষের দেশে চোরডাকাত ও ভোটডাকাতগণ রাজা হয়। তখন প্রতিবেশী দেশের খুনিরাও বাজার পায়। এবং ভোটচোর যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রূপে গণ্য হয়, তেমনি গণতন্ত্রহত্যাকারী বাকশালী ফ্যাসিস্টও জাতির পিতা হয়। এরূপ কান্ড কি কোন সভ্য দেশে হয়? ৯/১০/২০২১।  

    

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *