ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 যে কল্যাণ ইসলামী রাষ্ট্রের

কিছু সংখ্যক পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ ছাড়া প্রতিটি মানুষের থাকে অসামান্য দৈহিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আর্থিক সামর্থ্য। সে সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে একজন ব্যক্তি সোনার খনির চেয়েও অধিক সৃষ্টিশীল ও অধিক মূল্যবান হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশে পরিণত হয়েছে তেল বা সোনার খনির কারণে নয়, বরং অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষের কারণে।  মাইক্রোসফ্টের মালিক বিল গেটস একা যত সম্পদ সৃষ্টি করেছে তা বহু তেলের খনিও সৃষ্টি করতে পারিনি। তাই দেশের সম্পদ বাড়াতে হলে জনগণের মাঝে সৃষ্টিশীলতা বাড়াতে হয়। জনগণের মাঝে সে সামর্থ্য সৃষ্টির দায়িত্বটি রাষ্ট্রের। তাই যারা উন্নত রাষ্ট্র গড়তে শিখেছে তারাই সমর্থ হয়েছে সম্পদের প্রাচুর্য্য আনতে। দায়িত্ববান রাষ্ট্র গড়াই হলো মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম। কোন দেশে চরম দারিদ্রতা দেখে বুঝা যায়, সে দেশের মানুষ ব্যর্থ হয়েছে দায়িত্ববাদ রাষ্ট্র গড়তে।

তাঁবুতে বা গুহাতে বসে মানুষ কখনোই তাঁর প্রতিভায় বা যোগ্যতায় উৎকর্ষ আনতে পারে না; তখন জীবন শেষ হয় তাঁবুতে বা গুহাতে দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে। অপর দিকে গোত্রবাদী ও স্বৈরাচারী শাসনের যাঁতাকলে পড়লে মানুষ সামনে এগুনোর পথ পায় না। এমন সমাজে আজীবন বাঁচতে হয় বন্ধাত্ব ও দারিদ্রতা নিয়ে। জনগণের প্রতিভা ও সামর্থ্য নিঃশেষ হয় স্বৈরশাসকের প্রাসাদ নির্মাণে ও তার ভোগের আয়োজনে সমৃদ্ধি আনতে। শাসকের নিরাপত্তা দিতে এবং তার কর্তৃত্ব ও রাজ্য বাড়াতে বার বার যুদ্ধ করতে হয়। সে যুদ্ধে প্রাণও দিতে হয়। এমন রাজ্যের রাজারা নমরুদ ও ফিরাউনের নয় ভগবানে পরিণত হয়। জনগণকে বাঁচতে হয় তাদের পূজা দিয়ে। এমন রাজ্যে জনগণকে শিক্ষিত করা এবং তাদের সামর্থ্য বাড়ানো সরকারের প্রায়োরিটিতে থাকে না। থাকে না কোন সভ্য আইন ও আইনের শাসন। গোত্রপতি বা স্বৈরাচারী শাসকের ইচ্ছাই আইন গণ্য হয়। আইনের উর্দ্ধে থাকে ক্ষমতাধর সামন্তগণ। তারা গুম, খুন, চুরি-ডাকাতি ও ধর্ষণ করলে শাস্তি পেতে হয় না। দুর্বৃত্ত-শাসিত এমন রাষ্ট্রে নিষ্পাপ শিশুদেরকে জালেম শাসকের পাহারাদার সৈনিকে পরিণত করা হয়। একারণেই স্বৈরশাসিত রাষ্ট্রগুলি সৃষ্টিশীল মানুষ ও সভ্য সমাজ নির্মাণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা।  

নবীজী (সা:) যখন তাঁর মিশনের শুরু করেন তখন আরবে কোন রাষ্ট্র ছিল না। সমগ্র আরব জগত ছিল বহু শত গোত্রে বিভক্ত। সাধারণ মানুষ ছিল গোত্রপতিদের গোলাম। প্রতিটি গোত্র ছিল উম্মুক্ত জেলখানা। গোত্রপতিদের ইচ্ছাপূরণে বছরের পর যুদ্ধ করতে হতো, সে যুদ্ধে প্রাণও দিতে হত। গোত্রে গোত্রে একবার যুদ্ধ শুরু হলে সে যুদ্ধ সহজে শেষ হতো না। যুদ্ধে হেরে গেলে গোত্রের নারীদের দাসী এবং পুরুষদের দাস হতে হতো। সে অবস্থা থেকে বাঁচতে বিজয়ী পক্ষকে বিপুল অর্থ ও উঠ-ভেড়া দিতে হতো। ছিল না কোন শিক্ষাব্যবস্থা। অসহায় বৃদ্ধ, পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ মানুষদের জন্য ছিল না কোন সামাজিক সহায়তার বিধান। চুরি-ডাকাতি ও গুম-খুনের বিচার ছিল না; অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার জন্য কোন আইন-আদালত ছিল না। শত শত বছর ধরে এই ছিল আরবদের অবস্থা। এমন এক প্রেক্ষাপটে নবীজী (সা:) প্রতিষ্ঠা দেন ইসলামী রাষ্ট্রের। সমগ্র আরব ইতিহাসে এমন রাষ্ঠ্রের প্রতিষ্ঠা ছিল এক অভুতপূর্ব মহা বিপ্লবের বিষয়।  ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য তিনি কারাবন্দী আরববাসীর জন্য জেলের দরজা খুলে দেন। প্রতিষ্ঠা দেন স্বাধীনতা, সমতা ও সুবিচারের। এই একটি মাত্র ঘটনাতে আরব বিশ্বজুড়ে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে প্রতিভা, যোগ্যতা ও নেক আমলের। যে আরবী ভাষার কুর’আনের পূর্বে কোন বই ছিল না, সামান্য কিছুকালের মধ্যে সে আরবী ভাষা সমগ্র বিশ্ব মাঝে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত হয়। বিপ্লবের জোয়ার শুরু হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায। এসবই ছিল অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর।

সমগ্র মানব ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুফলটি অতি বিশাল ও অভূতপূর্ব। ইসলাম ধর্মের দ্রুত বিস্তার, মুসলিমদের জানমালের নিরাপত্তা, বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিমদের উত্থান, এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপের বিশাল ভূ-ভাগ থেকে দুর্বৃত্ত শক্তির নির্মূল এবং মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা -এসবই হলো ইসলামী রাষ্ট্রের অবদান। এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না পেলে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর বিধানসমূহ শুধু কিতাবেই থেকে যেত। লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে সেগুলির কোনটাই অর্জন করা যেত না। যেমন আজ সম্ভব হচ্ছে না। তাই এই পৃথিবী পৃষ্ঠে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণকর্মটি হলো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ জগতে আর কোন কালেই হয়নি। এবং যারা একাজে নিজেদের জান, মাল, সময় ও মেধার বিনিয়োগ করেছেন -নবীজী (সা:) তাদেরকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলেছেন। ইসলামী রষ্ট্র নির্মাণের এ কাজকে এজন্যই ইসলাম জিহাদের তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

ইসলামী রাষ্ট্র শুধু রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও বসবাসের পরিবেশকেই দূষণমুক্ত করে না, বরং আবর্জনা সরায় জনগণের মনের ভূবন থেকেও। মনের সে আবর্জনাগুলি হলো মিথ্যা ধর্ম, মিথ্যা মতবাদ এবং অসত্য দর্শন ও ধ্যান-ধারণা। মানবের মনের ভূবন এসব বুদ্ধিবৃত্তিক আবর্জনার দখলে গেলে রাজনীতি, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, কর্ম ও আচরণে বাড়ে সীমাহীন দুর্বৃত্তি; তখন বিলুপ্ত হয় সৎকর্ম ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার তাড়না। তখন জুলুম, দুর্বৃত্তি ও পাপাচারের বিস্তারে রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুলি হাতিয়ারে পরিণত হয়। ফলে যে ঈমানদার বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার তাড়না নিয়ে, তাঁকে শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত প্রতিষ্ঠা দিলে চলে না। তাকে দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠার কাজও করতে হয়। সে জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাও দিতে হয়। মু’মিনের সে কাঙ্খিত এজেন্ডা ও কর্মসাধনা নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার বয়ান হলো:

ٱلَّذِينَ إِن مَّكَّنَّـٰهُمْ فِى ٱلْأَرْضِ أَقَامُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُا۟ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَمَرُوا۟ بِٱلْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا۟ عَنِ ٱلْمُنكَرِ ۗ وَلِلَّهِ عَـٰقِبَةُ ٱلْأُمُورِ

অর্থ: “আমি যখন তাদেরকে জমিনের উপর প্রতিষ্ঠা দান করি, তখন তারা নামাজের প্রতিষ্ঠা দেয়, যাকাত আদায় করে, এবং সৎকর্মের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকর্মের নির্মূল করে; আর সকল কর্মের পরিনাম আল্লাহর ইখতিয়ারে।” –(সুরা  হাজ্জ, আয়াত ৪১)।

সৎকর্মের নির্দেশ এবং অসৎকর্মের নির্মূলের কাজটি মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা বাড়িয়ে হয় না, সেটি বেশী নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করেও হয় না। সে কাজের মূল হাতিয়ারটি হলো ইসলামী রাষ্ট্র। কারণ, রাষ্ট্রের হাতে থাকে পুলিশ, আদালত, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগের বৈধ অধিকার। মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার মোহাদ্দেস, সুফি-দরবেশ ও পীরদের হাতে সে ক্ষমতা থাকে না। তাছাড়া যে কাজে রাষ্ট্রের প্রধান ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনসমূহ উদ্যোগ নেয় -সে কাজে সরকারী কর্মচারীদের সাথে সাধারণ জনগণও রাজস্ব দিয়ে, শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে সংশ্লিষ্ট হয়। সে কাজটি তখন সমগ্র দেশবাসীর কাজে পরিণত হয়। এজন্যই যারাই পুঁজিবাদ, কম্যুনিজম, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, রাজতন্ত্রের ন্যায় কোন রাজনৈতিক দর্শনকে প্রতিষ্ঠা দিতে চায় -তারাও  সে কাজে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও তার শক্তিকে কাজে লাগাতে রাষ্ট্রকে দখলে নেয়। সেটি সম্ভব না হলে নিজেরা ভিন্ন একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়। নবীজী (সা:)কে তাই ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে হয়েছিল। নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর তাঁর নিষ্ঠাবান সাহাবাগণ তাঁর সে সূন্নতকে শুধু বাঁচিয়েই রাখেননি, সে রাষ্ট্রকে একটি বিশ্বশক্তিকে পরিণত করেন।  সাহবাদের পর মুসলিমগণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের যেখানেই বসতি গড়েছে, সেখানেই তারা শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়েছে। এবং যখনই বিলুপ্ত হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র, তখন থেকেই মুসলিমগণ বঞ্চিত হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ থেকে।  

 

অনৈসলামিক রাষ্ট্রের নাশকতা                                                         

অনৈসলামিক রাষ্ট্রের নাশাকতাটি বিশাল ও ভয়ানক। রাষ্ট্রের সমগ্র প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোটি তখন জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার বাহনে পরিণত হয়। শয়তানী শক্তিবর্গ সে কাজটি করে দু’টি উপায়ে। এক). স্কুল-কলেজে কুর’আন শিক্ষা, আদালতে শরিয়তী আইন ও মুসলিম জীবনে জিহাদকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে। এভাবে অসম্ভব করে সিরাতাল মুস্তাকীম চেনা ও সে পথে চলা। দুই). মিথ্যা ধর্ম, মিথ্যা মতবাদ, মিথ্যা দর্শন ও মিথ্যা ধ্যানধারণার প্রচার দিয়ে। এভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়া হয় জাহান্নামের পথ। কাফির, মুনাফিক ও দুর্বৃত্ত জালেমদের অধিকৃত এমন রাষ্ট্রই হলো পৃথিবী-পৃষ্ঠে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সৃষ্টি। এমন রাষ্ট্রের নাশকতা কোভিড, ভূমিকম্প, সুনামী ও হিংস্র পশুদের চেয়েও অধিক। কোভিড, ভূমিকম্প, সুনামী ও হিংস্রপশুগণ মানুষকে জাহান্নামে নেয় না। কিন্তু  অনৈসলামিক রাষ্ট্র নেয়। এজন্যই শরিয়তের আইনে গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলো অনৈসলামিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় অংশ নেয়া এবং সে রাষ্ট্রের সুরক্ষায় সৈনিক হওয়া। যুদ্ধ এখানে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। ফলে এমন দুর্বৃত্ত-অধিকৃত রাষ্ট্রের নির্মূলের জিহাদটি হলো মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণ কর্ম। তবে সে নির্মূল কর্মের মাঝে মুসলিম জীবনের মিশন শেষ হয়না। তাকে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে নামতে হয়। এবং এ জিহাদ হলো মুসলিম জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। এবং জিহাদ হলো, সেরূপ একটি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের পর সেটিকে প্রতিরক্ষা দেয়া। এরূপ জিহাদে যারা নিজেদের জান ও মালের বিনিয়োগ করে একমাত্র তারাই হলো সত্যিকার ঈমানদার -যার ঘোষণা এসেছে সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। এবং যারা সে জিহাদে থেকে দূরে থাকে -তারা হলো কাফির বা মুনাফিক।  এমন মুনাফিক নবীজী (সা:)’র যুগেও ছিল। সেরূপ মুনাফিকের নমুনা হলো আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার ৩০০ সহচর।

মুসলিম বা ঈমানদার হওয়ার দাবী সূদখোর, ঘুষখোর, মদখোর, মিথ্যাবাদী এবং ফ্যাসিস্ট খুনিও করতে পারে। অথচ সুরা হুজরাতে মহান আল্লাহতায়ালার বয়ানে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হয়েছে তা হলো, যার মধ্যে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ নাই, বুঝতে হবে তার মধ্যে ঈমানও নাই। এমন বেঈমান ব্যক্তি ঈমানের দাবী করলে বুঝতে হবে সে নিরেট মুনাফিক। এমন ব্যক্তি নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত যতই পালন করুক -তা দিয়ে কখনো মুনাফিকি দূর হয় না। আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার ৩০০ সহচর তাই নবীজী (সা)’র পিছনে নামাজ পড়েও মুনাফিক হওয়া থেকে নিজেদের বাঁচতে পারিনি।

ইবাদতের ধারণা নিয়েও কি মুসলিমদের মাঝে বিভ্রান্তি কম? ইবাদত শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন নয়। মুসলিম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতগুলি মসজিদ ও জায়নামাজে হয় না, সেগুলি হয় মসজিদ ও জায়নামাজের বাইরে। ইবাদতের শুরু হয় সত্যের আবিষ্কার এবং সে সত্যকে বিজয়ী করার কাজে  লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। সেটিই হলো হযরত ইব্রাহীম (আ:)‌’য়ের সূন্নত।  সত্য আবিস্কারে তাঁর ছিল বিরামহীন তাড়না; এবং সে তাড়নার কারণেই হযরত ইব্রাহীম (আ:) মহান আল্লাহতায়ালাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। সত্যের আবিষ্কারের তাঁর সে প্রবল তাড়নাটি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এতোটাই ভাল লেগেছিল যে, তিনি হযরত ইব্রাহীম (আ:)‌’র সে সত্যান্বেষী কাহিনীকে পবিত্র কুর’আনে একাধিক বার বর্ণনা  করেছেন -যাতে মানুষ তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে।  অথচ শয়তান ও তার অনুসারীগণ চায় মুসলিমগণ তাদের ধর্মকর্ম মসজিদের জায়নামাজে সীমিত রাখুক এবং রাষ্ট্র ও সমাজের বাদ বাকি সমগ্র অঙ্গণকে তাদের জন্য ছেড়ে দিক।

 

 

কেন ব্যর্থ হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ?

বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে ব্যর্থতা দেখে নিশ্চিত বলা যায়, কুর’আনী সত্যের আবিষ্কার ও কুর’আনী সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজটি তাদের দ্বারা আদৌ হয়নি এবং এখনো হচ্ছে না। তাদের ধর্মচর্চা স্রেফ নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, দোয়া-দরুদের মধ্যেই সীমিত রয়ে গেছে। সেটি আর সামনে এগুয়নি। যে পবিত্র কুর’আন হলো মুসলিম জীবনের রোডম্যাপ, সে রোডম্যাপটি বুঝার কাজও হয়নি। সে রোডম্যাপটিও কিতাবেই রয়ে গেছে। পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমগণ নবীজী (সা:)কে পথপ্রদর্শক রূপে বিশ্বাস করলেও তাঁর প্রদর্শিত পথের অনুসরণের কাজটিও তাদের দ্বারা হয়নি।  অথচ ইসলাম কীভাবে পালন করতে হয় এবং দেশের রাজনীতি, শিক্ষাসংস্কৃতি, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থায় মুসলিমের করণীয় কি -সেটি শেখানোই ছিল নবীজী (সা:)’র মূল মিশন। সে বিষয়টি তিনি হাতে কলমে শিখিয়ে গেছেন। ইবাদত-বন্দেগীকে তিনি নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দোয়া-দরুদের মাঝে সীমিত রাখেননি। বরং মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে তিনি পূর্ণ প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছেন। সে লক্ষ্যে পৌঁছতে তিনি ও তাঁর সাহাবাদের বিপুল অর্থ, শ্রম ও রক্ত ব্যয় করে ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা দিতে হয়েছে।  নবীজী (সা:) নিজে ১০টি বছর সে রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন। অথচ মুসলিমগণ তাঁর সে রাষ্ট্র নির্মাণ ও রাষ্ট্র পরিচালনের ঐতিহ্য থেকে কোন শিক্ষাই নেয়নি। ফলে গাদ্দারীটি এখানে নবীজী (সা:)’র শিক্ষার সাথে।  

নবীজী (সা:) কে প্রতি পদে পূর্ণ অনুসরণ করা ইসলাম ফরজ। যে ব্যক্তি অনুসরণ করে নবীজী (সা:)কে, সেই অনুসরণ করে মহান আল্লাহকে -এ ঘোষণাটি এসেছে পবিত্র কুর’আনে।  সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা নিসার ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

  مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ ٱللَّهَ ۖ وَمَن تَوَلَّىٰ فَمَآ أَرْسَلْنَـٰكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًۭا

অর্থ: ‍“যে আনুগত্য করলো রাসূলকে সে তো আনুগত্য করলো আল্লাহকে, এবং (আপনার আনুগত্য থেকে) যে মুখ ফিরিয়ে নিল, হে রাসূল, আমি তাদের উপর আপনাকে তত্ত্বাবধায়ক রূপে প্রেরণ করিনি।” –(সুরা নিসা, আয়াত ৮০)। উপরিউক্ত আয়াতে যা ঘোষিত হয়েছে সেটিই একমাত্র বার্তা নয়, অপর যে অঘোষিত বার্তাটি দেয় তা হলো: যে ব্যক্তি অবাধ্য হলো নবীজী (সা:)’র, সে অবাধ্য হলো মহান আল্লাহতায়ালার। তাই মুসলিম জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নবীজী (সা:)’র ইসলাম পালনের সাথে নিজের ইসলাম পালনকে মিলিয়ে দেখতে হয়; এবং প্রতিক্ষণ বিচার করতে হয়, কতটুকু অনুসরণ হচ্ছে নবীজী (সা:)’র এবং কতটুকু হচ্ছে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা। নবীজী (সা:) যে পথে চলেছেন সেটিই হলো কুর’আনের পথ। এ পথকে বলা হয় সিরাতাল মুস্তাকীম। সে পথে শুধু নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ছিল না, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদও ছিল। সে রাষ্ট্রে ছিল আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। ছিল অন্যায় ও দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আজকের মুসলিমগণ যে নবীজী (সা:)’র অনুসৃত সিরাতাল মুস্তাকীমের পথে নাই -সে প্রমাণ তো প্রচুর। আজ মুসলিম বিশ্বের কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র নাই; কোথাও আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নাই। মুসলিম বিশ্বের এ চিত্রটিই কি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না, মুসলিমদের দ্বারা নবীজী (সা:)’র অনুসরণের কাজটি আদৌ হচ্ছে না। এবং তারা নাই সিরাতাল মুস্তাকীমের উপর। আর যারা সিরাতাল মুস্তাকীমে নাই -তারা কি জাহান্নামের যাত্রী নয়? যারা ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে নাই অথচ দাবী করে আশেকে রাসূল রূপে -তাদের দাবী যে কতটা ভূয়া, সেটি বুঝতেও কি বাকি থাকে? তবে এখানে অবাধ্যতা শুধু নবীজী (সা:)’র নয়, বরং সেটি মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধেও। এরূপ অবাধ্যতা নিয়ে কেউ কি দুনিয়ায় ও আখেরাতে কল্যাণ পেতে পারে?

যারা প্রকৃত ইসলামকে জানতে চায় এবং সে ইসলামকে অনুসরণ করতে চায়, তারা সে ইসলামের সন্ধান পেতে পারে পবিত্র কুর‌’আন, হাদীস গ্রন্থ ও মুসলিমদের অতীত ইতিহাস থেকে। প্রকৃত ইসলামকে চেনা, বুঝা ও অনুসরণের কাজটি  শুধু লেখক, আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের কাজ নয়, এ দায়িত্ব প্রতিটি মুসলিমের। এটিই হলো মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কাজটি নামাজ-রোজার ন্যায় প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ। অথচ সে ফরজ কাজটি পালিত না হওয়ায় আজকের মুসলিমগণ ব্যর্থ হচ্ছে সঠিক ইসলামকে  খুঁজে পেতে ও অনুসরণ করতে। মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার শুরু এ অজ্ঞতা থেকে। ফলে তারা ব্যর্থ হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের গুরুত্ব বুঝতে। এটি এক ভয়ানক জাহিলিয়াত। এরূপ জাহিলিয়াত নিয়ে ঈমানদার হওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব হলো সভ্য মানব হওয়া ও সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণে অংশ নেয়া।  এই জন্যই ইসলামে সর্বপ্রথম যে ইবাদতটি ফরজ করা হয় সেটি জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে জিহাদ। জিহাদ এখানে  নিজেকে জ্ঞানবান করার।  উপরের উঠার জন্য এটিই হলো মুসলিম জীবনের প্রথম সিঁড়ি। অথচ আজকের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি এখানেই। তারা উপরে উঠার চেষ্টা করেছে সে প্রথম সিঁড়িটিতে পা না রেখেই। ফলে তারা প্রচণ্ড হোঁচট খাচ্ছে শুরুতেই। এবং আদৌ হচ্ছে না উপরে উঠার কাজটি। অথচ জ্ঞানার্জনের জিহাদটি যথার্থ হলে মুসলিমগণ জানতে পারতো, মুসলিমগণ অতীতে কী করে বিস্ময়কর বিজয় পেল। তখন এটিও বুঝতো, কী করে তারা ইসলাম থেকে এতোটা দূরে সরলো? এবং কেনই বা তারা এতোটা অধঃপতিত হলো?

 

ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে ব্যর্থতা ও বাঙালি মুসলিম জীবনে নাশকতা

ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ নিয়ে মুসলিমদের মাঝে প্রচেষ্টা অতীতে কম হয়নি। এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার ইতিহাসও প্রচুর। সমগ্র বিশ্বমাঝে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সংখ্যাটি দক্ষিণ এশিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠিটি বাঙালি মুসলিম। দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টাটি হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেদিন মুসলিম লীগের স্লোগান ছিল “পাকিস্তান কা মতলব কিয়া? -লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। অর্থ: পাকিস্তানের লক্ষ্য কি? সেটি হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এর অর্থ সার্বভৌমত্ব হবে একমাত্র লা-শারিক মহান আল্লাহতয়ালার। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাই ছিল সুলতান মুহম্মদ ঘুরীর হাতে দিল্লি বিজয়ের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্যান-ইসলামিক মুসলিম প্রকল্প। সেটি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র নির্মাণের প্রকল্প। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি রেখেছিল বাঙালি মুসলিম -সেটি ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বুকে অবিভক্ত বাংলাই ছিল মুসলিম লীগের প্রধান ঘাটি। কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষিত “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”য়ের প্রত্যক্ষ লড়াইটি (direct action) হয়েছিল রক্তাক্ত রূপ কলকাতার রাজপথে। সেটি ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট তারিখে। সেদিন মুসলিম লীগের গড়ের মাঠ’য়ের সমাবেশ থেকে ঘরে ফেরা মুসলিমদের উপর কংগ্রেসী ও হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের হামলা হয়। সে হামলায় ৫ হাজারের বেশী মুসলিম শহীদ হয়েছিলেন। তাদের সে রক্তদানের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিই পাল্টে যায়। এ ঘটনার পর পরই কংগ্রেস নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ও ব্রিটিশ সরকার মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাব ত্বরিৎ মেনে নেয়। অথচ এর আগে তারা মানতে আদৌ রাজী হয়নি।

বস্তুত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাই ছিল বাঙালি মুসলিমদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম। তিনজন বাঙালি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু সে পাকিস্তান প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যায়। অথচ পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি হওয়ার কারণে দেশটিকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রকল্পকে সফল করার সর্বাধিক দায়িত্বটি ছিল বাঙালি মুসলিমদের উপরে। অথচ বাঙালি মুসলিমগণ সে দায়িত্ব পালনে দারুন ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর রাজনীতির মাঠ দখলে নেয় ইসলাম থেকে দূরে সরা সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তবাদী ও বামপন্থীদের হাতে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী ন্যাশন্যাল পার্টি (ন্যাপ)। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পিছনে ভিশন বা প্রবল ভাবনা ছিল ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে সিভিলাইজেশনাল রাষ্ট্র নির্মাণের। লক্ষ্য ছিল, পৃথিবীর মানচিত্রে শক্তিশালী মুসলিম শক্তি রূপে বেড়ে উঠা নিয়ে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তবাদী ও বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবীগণ সেরূপ একটি ইসলাম ভিশনের শত্রুতে পরিণত হয়। তাদের চেতনা থেকে বিলুপ্ত হয় ইসলামের প্রতি অঙ্গীকার। তারা পরিণত হয় ভারতের হিন্দুত্ববাদ এবং চীন ও সোভিয়েত রাশিয়ার কম্যুনিস্ট ধারার রাজনীতির সেবকে। তাদের হাতে বাঙালি মুসলিমদের জীবনে ঘটে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে ভয়ানক বিচ্যুতি -যার পরিণাম বাঙালি মুসলিমগণ আজও ভুগছে। দেশটিতে গণতন্ত্র আজ মৃত, নির্বাচনের নামে হয় ভোটডাকাতি এবং শাসনক্ষমতা অধিকৃত হয়েছে ভারতসেবী নৃশংস ফ্যাসিস্টদের হাতে।  বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ভারতের একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে। বাংলাদেশের উপর তেমন একটি দখলদারী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই ভারত ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন করে এবং দেশকে অনুগত সেবাদাসদের হাতে তুলে দেয়।

মুসলিমদের লড়াইটি কখনোই মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গা নিয়ে হয় না; সেটি ইসলামে হারাম। তাদেরকে লড়াই হতে হয় রাষ্ট্রের বুকে সুবিচার, সুনীতি ও ইসলামের প্রতিষ্ঠা দেয়া নিয়ে। সেটিই মুসলিম জীবনের জিহাদ। একদিকে পাকিস্তান যেমন সামরিক স্বৈরাচারীদের দখলে যায়, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে আগ্রহ হারায় বাঙালি মুসলিম নেতাগণ। ফলে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি সাধনে যুদ্ধ শুরু হয় উভয় পক্ষ থেকে। স্বৈরাচার, দুর্বৃত্তি ও বৈষম্য নির্মূলের লড়াই ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের সেক্যুলার, জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী দলগুলি পাকিস্তান ভাঙ্গার লড়াইকে তীব্রতর করে। নেতারূপে গ্রহণ করে শেখ মুজিবের ন্যায় ভারতসেবী এবং গণতন্ত্রের দুশমন এক ফ্যাসিস্টকে। প্যান-ইসলামিক ধারার রাজনীতির বদলে তারা জন্ম দেয় ট্রাইবাল ধারার রাজনীতি। মুসলিমের শক্তি, বিজয় ও গৌরব বৃদ্ধির বদলে তাদের রাজনীতির প্রায়োরিটি হয় বাঙালির বিজয় ও গৌরববৃদ্ধি। কুর’আনী বিধানকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার ন্যায় ফরজ ইবাদতকে তারা সাম্প্রদায়িক বলে এবং দীক্ষা নেয় সেক্যুলারিজমে। অথচ সেক্যুলারিস্ট হওয়ার অর্থ, ইসলাম থেকে দূরে সরা; আখেরাতের ভাবনা ছেড়ে  পার্থিব স্বার্থ উ‌দ্ধারের তাড়না নিয়ে বাঁচা। সেক্যুলারিস্ট বাঙালি মুসলিমদের চেতনার ভূমিতে তখন প্রবল বিজয় পায় ভারতপন্থীদের de-Islamisation project ও হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প।  শেখ হাসিনার আমলে এসে সেটি মুর্তি নির্মাণ, মুর্তিপূজা ও ভারতসেবার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।  

মুসলিম দেশের ভূগোল ক্ষুদ্রতর করার বিপদটি অতি ভয়ানক। তাতে মুসলিমদের শক্তি কমে এবং পরাজয় ও পরাধীনতা বাড়ে।  স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়ার খরচটা বিশাল,  ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সে সামর্থ্য থাকে না। তাই  মুসলিম দেশের ভূগোল-বৃদ্ধি একটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত; এটি জিহাদ।  গৌরব যুগের মুসলিমগণ ভূগোল বাড়াতে অসংখ্য জিহাদ লড়েছেন। তাদের অর্থ, শ্রম ও রক্তত্যাগের বদৌলতেই মুসলিমগণ পরিণত হয় বিশ্বশক্তিতে। ইসলামে এমন প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগই হারাম যাতে মুসলিম উম্মাহর শক্তিহানী হয়। সে সাথে এমন প্রতিটি উদ্যোগই পবিত্র ইবাদত যাতে মুসলিম উম্মাহর শক্তিবৃদ্ধি হয়। মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গায় শক্তিহানী হয় বলেই ইসলামে এটি হারাম এবং সেটি গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ও দেশটি সুরক্ষা দেয়ার কাজটি ছিল জিহাদ। কিন্তু সে দেশটির ভূগোল ভাঙ্গার কাজটি ছিল ইসলামের শত্রুপক্ষের তথা অমুসলিমদের। তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে ভারত বিশাল বাহিনী নিয়ে ময়দানে নামে। ঈমানদারের পরিচয় হলো তারা কখনোই মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গে না, বরং বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাদের লড়াইটি হয় যেমন দুর্বৃত্ত শাসকের নির্মূলে, তেমনি মুসলিম দেশের ভূগোল বাচাঁতে। অথচ বাঙালি মুসলিমদের একটি বড় অংশ ১৯৭১’য়ে সে ঈমানী দায়িত্ব পালন না করে ভারতের ন্যায় একটি আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানের বিনাশে যুদ্ধ শুরু করে। বাঙালি মুসলিমদের সর্বকালের ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে বড় নাশকতার কান্ড। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে সে নাশকতার অপরাধে নেতৃত্ব দিয়েছিল ইসলাম থেকে দূরে সরা ন্যাশনালিস্ট, কম্যুনিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীগণ। অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং রাজনৈতিক সহায়তা দিয়েছিল হিন্দুত্ববাদী ভারত।

লক্ষণীয় হলো, একাত্তরের সে নাশকতার কাজে কোন ইসলামী দল, কোন ইসলামী বুদ্ধিজীবী, কোন আলেম ও কোন হাক্কানী পীর জড়িত হননি। বাংলাদেশের বুকে দেরীতে হলেও ইসলামের জোয়ার এক দিন আসবেই এবং সেক্যুলারিজমের জাহিলিয়াত দূর হবেই। বহুশত বছর পরে হলেও একাত্তরের নাশকতার নায়কদের অবশ্যই আসামীর কাটগড়ায় খাড়া হতে হবে। তখন বিচার হবে, কেন তারা হিন্দুত্ববাদী ভারতের সাথে জোট বাঁধলো? কেন তারা ভারতের অর্থ নিয়ে, তাদের খাদ্য খেয়ে এবং তাদের অস্ত্র নিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে ভাঙ্গলো? পাকিস্তান তো শুধু পাঞ্জাবী, পাঠান বা সিন্ধুদের ছিল না, সে দেশটি তো বাঙালি মুসলিমদেরও ছিল। গৃহে নেকড়ে বা চোর-ডাকাত ঢুকলে সেগুলি তাড়াতে হয়। এবং ঘর বাঁচাতে হয়। সে গুলি তাড়ানোর বাহানায় গৃহে আগুন দিলে তো মাথা গুঁজার নিরাবপদ স্থান থাকে না। ইসলামে এজন্যই জালেম শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরজ করেছেন এবং মুসলিম দেশ ভাঙ্গাকে হারাম করেছেন। তাছাড়া হারাম করেছেন কোন পৌত্তলিক কাফিরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করাকে। সে নির্দেশ এসে সুরা আল ইমরানের ২৮ নম্বর আয়াতে এবং মুমতেহানার ১ নম্বর আয়াতে।

যেদিন থেকে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তির শুরু, সেদিন থেকে শক্তিহানী, পরাজয় ও শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃতিরও শুরু।  মুসলিম বিশ্ব আজ ৫০টির বেশী রাষ্ট্রে বিভক্ত। মুসলিম উম্মাহকে ক্ষুদ্রতর করার কাজটি কখনোই ঈমানদারদের কাজ ছিল না, সব সময়ই সেটি ছিল ইসলাম থেকে দূরে সরা ক্ষমতালোভী ভিতরের শত্রুদের কাজ।  সব সময়ই ঘরের এ শত্রুরা সে বিভক্তি সংঘটিত করেছে বিদেশী কাফির শত্রুদের সাহায্য নিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ১৯৭১ সালে সেটি হয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের সাহায্য নিয়ে। সেরূপ বিভক্তি মধ্যপ্রাচ্যে ১৯১৭ সালে সংঘটিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে। সে বিদেশী শত্রুরাই অখণ্ড আরব ভূমিকে ২২টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে রেখেছে। এরূপ বিভক্তির ফলে আরব মুসলিমগণ আজ শক্তিহীন, ইজ্জতহীন এবং বিদেশী শক্তির গোলাম। ফলে ৪০ কোটি আরব মুসলিমের সামর্থ্য নাই ৬০ লাখ ইসরাইলী ইহুদীর সামনে মাথে তুলে দাঁড়ানোর। একই ভাবে বিশ্বের সর্ববৃহ্ৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ভারত আজ অপ্রতিদ্বন্দ্বী বৃহৎ শক্তি। এ বিপদ থেকে বাঁচাতেই সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা বিভক্তিকে হারাম করেছেন। অথচ শয়তান এবং তার গোত্রবাদী, জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলারিস্টগণ অনুসারীগণ চায় অবিকল উল্টোটি। প্রতিটি ভাষা, প্রতিটি বর্ণ ও প্রতিটি এলাকার মানুষের মাঝেই কিছু জালেম ও দুর্বৃত্ত থাকে, কিন্তু তাদের কারণে বিভক্তি গড়া জায়েজ নয়। বরং ফরজ হলো তাদের নির্মূল করা। কিন্তু শয়তানের খলিফাদের কাজ হলো খুঁজে খুঁজে ভাষা, বর্ণ ও এলাকা ভিত্তিক বিভক্তির সূত্রগুলি বের করে রক্তাক্ত সংঘাতের জন্ম দেয়া। এমন বিভক্তি ভয়ানক আযাব ডেকে আনে -যার প্রতিশ্রুতি শোনানো হয়েছে সুরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। শয়তানের অনুসারী এ বিষাক্ত কীটদের কারণেই মুসলিম বিশ্ব আজ ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে।

ভারতসেবী বাঙালিদের হাতে শুধু পাকিস্তানই দুর্বল হয়নি,  ভয়ানক ভাবে দুর্বল হয়েছে বাংলাদেশও। সর্বোপরি দুর্বল হয়েছে উমপহাদেশের মুসলিম ও মুসলিম উম্মাহ। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেনের মতে ভারত-মুসলিম  সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মত। বাংলাদেশ এখানে ভারতের বধু। একাত্তরে বাংলাদেশের মাটিতে ভারতীয় সৈন্যদের প্রবেশের পর থেকেই বাংলাদেশ নিয়মিত ধর্ষিতা হচ্ছে ভারতীয়দের হাতে। ভারত ও ভারতসেবীদের নাশকতা যেমন ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গণে, তেমনি দেশবাসীর ঈমান, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও চারিত্রিক অঙ্গণে।  ভারতসেবী বাঙালি সেক্যুলারিস্টগণ শুধু পাকিস্তান ভেঙ্গেই থেমে থাকেনি, বাংলাদেশকে তারা পর পর ৫ বার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বৃত্তকবলিত দেশে পরিণত করেছে। এটিও কি কম নাশকতা? শত্রু-অধিকৃত দেশে স্বাধীনতা হারায় সেদেশের জনগণ; তখন তাদের রায়ের বা ভোটের ইজ্জত থাকে না। তাদের ভোট ডাকাতি হয়ে যায় ভোটডাকাতদের হাতে। বাংলাদেশে তো সেটিই হচ্ছে। এদেশে ভোডাকাতিতে অংশ নেয় দেশের পুলিশ, RAB, বিজিবি, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, নির্বাচনী কমিশন ও বিচার বিভাগ। জনগণের রাজস্বের অর্থে প্রতিপালিত এসব সরকারি কর্মচারিগণ পরিণত হয়েছে জনগণের শত্রুতে এবং ক্ষমতাসীন দুর্বৃত্তদের সেবকে। অসম্ভব করা হয়েছে সুশাসন ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্তায়নের হাতিয়ারে এবং সে সাথে জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার বাহনে।   

ইসলামের শত্রু-শক্তির জনবল, অর্থবল ও অস্ত্রবল বিশাল। তারা বিশ্বব্যাপী একতাবদ্ধ। অপর দিকে মুসলিমগণ বিভক্ত। তাদের অর্থ, শ্রম ও রক্তের বিনিয়োগ নাই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায়। জনগণের রাজস্বের অর্থ এবং দেশের সামরিক শক্তির বেশীর ভাগ ব্যয় হয় স্বৈরাচারী শাসকের গদী বাঁচাতে। অথচ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রতিরোধে শত্রু-শক্তির বিনিয়োগটি বিশাল; তাদের রয়েছে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন। তারা মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে বাধা দেয়না। বাধা দেয় না তাবলিগ জামায়াতের তাবলিগে ও ইজতেমাতায়। এবং বাধা দেয় না নামাজ, রোজা, হজ্জ,যাকাত পালনে। কিন্তু যে কোন মূল্যে প্রতিরোধ করতে চায়, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে । সে লক্ষ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে এবং সে রাষ্ট্রের উপর হাজার হাজার টন বোমা ফেলতে তারা সদা প্রস্তুত। ইসলামী রাষ্ট্রকে সহ্য করতে তারা যে আদৌ রাজী নয় -সে কথাটি প্রকাশ্যে বলেছে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।  মুসলিম বিশ্বের নৃশংস জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কোন শত্রুতা নাই। বরং সেসব জালেম শাসকদেরকে তারা ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ প্রতিহত করার যুদ্ধে পার্টনার রূপে গ্রহণ করে। শয়তান ও তার অনুসারীরা জানে, মুসলিমদের শক্তির উৎস মসজিদ-মাদ্রাসা নয়, সেটি হলো ইসলামী রাষ্ট্র। ইসলামী রাষ্ট্র মানেই মুজাহিদ তথা পূর্ণাঙ্গ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার সহায়ক পরিবেশ। তেমন একটি রাষ্ট্র দুর্গে পরিণত হয় মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে তোলার লক্ষ্যে। তাই শয়তানী শক্তি কখনোই সেটি হতে দিতে রাজী নয়। অথচ মুর্সলিম হওয়ার অর্থই হলো শত্রুশক্তির এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় খাড়া হওয়া -যেমন গৌরব যুগের মুসলিমগণ খাড়া হয়েছিলেন রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় তৎকালীন দুটি বিশ্বশক্তির বিরুদ্ধে। মুসলিমগণ যখনই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে লিপ্ত হয় – মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তাদের জন্য যে প্রতিশ্রুতিটি দেয়া হয়েছে সেটি নিশ্চিত বিজয়ের। বলা হয়েছে,

وَلَا تَهِنُوا۟ وَلَا تَحْزَنُوا۟ وَأَنتُمُ ٱلْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ

অর্থ: “তোমরা হীনবল হয়োনা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়োনা।  বিজয় তোমাদের জন্যই -যদি তোমরা মু’মিন হও।” –(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১৩৯)।  উপরিউক্ত এ আয়াত থেকে যে বিষয়টিই প্রতীয়মান হয় সেটি হলো, মুসলিমদের পূর্ণ মনযোগ ও সকল প্রচেষ্টা হতে হবে সত্যিকার ঈমানদার তথা মু’মিন হওয়ায়। মু’মিন তো সেই যার মধ্যে রয়েছে পূর্ণ ঈমান। আর মু’মিন হওয়ার কাজটি যথার্থ হলে, তারা অবশ্যই পাবে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত বিজয়। কিন্তু মুসলিমদের মূল ব্যর্থতাটি হলো মু’মিন হওয়াতে। এ ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নিয়েছে তাদের সকল ব্যর্থতা। সে ব্যর্থতাটি প্রকট ভাবে ধরা পড়ে তাদের মাঝে ভৌগলিক বিভক্তি দেখে এবং বিভক্ত ভূগোল বাঁচানোর যুদ্ধে তাদের বিশাল বিনিয়োগ দেখে। অথচ তাদের মনে যদি শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকতো তবে বিভিন্ন ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতার নামে গড়ে উঠা মুসলিম বিশ্বের বিভক্ত ভূগোল দেখে তার মনে মাতম উঠতো এবং তৎক্ষনাৎ  শুরু করতো বিভক্তির দেয়াল ভাঙ্গার জিহাদ। শুধু তাই নয়, মু’মিন বা ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠার বিশাল ব্যর্থতাটি বুঝা যায় তাদের মাঝে জিহাদশূণ্যতা দেখে। ঈমানদার হওয়ার দাবী সূদখোর, ঘুষখোর, মিথ্যাবাদী ও স্বৈরাচারী জালেমও করতে পারে। তারা নামাজী, রোজাদার এবং হাজীও হতে পারে। কিন্তু তারা  ঈমানদার হতে পারে না -যদি না তাদের মধ্য আল্লাহতায়ার দ্বীন, তাঁর সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর শরিয়তী আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জিহাদ না থাকে। পবিত্র কুর’আনে সে কথাটি সুস্পষ্ট করা হয়েছে সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতের ন্যায় আরো বহু আয়াতে। এই জন্যই প্রশ্ন উঠে, ইসলামকে বাদ দিয়ে যারা সেক্যুলারিজম, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, স্বৈরতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতি করে তারা কি কখনো ঈমানদার হতে পারে?         

 

নিশ্চিত সফলতা ও নিশ্চিত ব্যর্থতার পথ

বাধা-বিপত্তি যতই আসুক, প্রকৃত মু’মিন কখনোই দমে যায় না; হতাশও হয় না। হতাশ হওয়া ইসলামে হারাম। সে নির্দেশটিই এসেছে উপরিউক্ত আল-ইমরানের ১৩৯ নম্বর আয়াতে। ঈমানদারের দেহে যতক্ষণ প্রাণ থাকে, ততক্ষণ ঈমানও থাকে। যতক্ষণ ঈমান থাকে ততক্ষণ জিহাদও থাকে। এবং জিহাদের সাথে সব সময় বিজয়ের আশাও থাকে। যুদ্ধে যে কোন পরাজয়ের পর বিজয়ের আশা নিয়ে ঈমানদার আবারো ময়দানে নামে। ক্ষেতের ফসল বার বার প্লাবনে ভেসে গেলেও কৃষক কখনোই চাষাবাদ ছেড়ে দেয় না। নতুন আশা ও নতুন ভরসা নিয়ে সে আবার চাষাবাদে নামে; আবারো ফসল বুনে। তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হলেও তাতে ঈমানদার কখনোই থেমে যায় না। নতুন আশা ও নতুন উদ্যম নিয়ে সে আবারো নামে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে। 

রণাঙ্গণে জিহাদের ফলাফল যাই হোক, মুমিনের জান, মাল, মেধা ও শ্রমের বিনিয়োগ কখনোই ব্যর্থ হয়না। প্রতিদান এ জীবনে না পেলেও আখেরাতে সেটি সুনিশ্চিত। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয়তম হওয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম তো তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার পথে অর্থ, শ্রম ও রক্তের কুরবানী; এভাবেই ঈমানদার নিজেকে যোগ্যতর করে মাগফিরাত ও জান্নাত লাভে। এজন্যই এ জীবনে ঈমানদারের দায়, সকল মনযোগ আল্লাহতায়ালার পথে সর্বসামর্থ্যের বিনিয়োগে; বিজয়ী করার দায়টি মহান আল্লাহতায়ালার। ঈমানদারের কাজ, তাঁর ঈমানকে শক্তিশালী করা এবং বিজয়ের লক্ষ্যে লাগাতর জিহাদ চালিয়ে যাওয়া।  ঈমানে পুষ্টি জোগায় ও ঈমানকে শক্তিশালী করে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। সে কথাটি বলা হয়েছে সুরা আনফালের ২ নম্বর আয়াতে।

وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ ءَايَـٰتُهُۥ زَادَتْهُمْ إِيمَـٰنًۭا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ‍

অর্থ:‍ “এবং যখন তাদেরকে  ‍কুর’আনের আয়াত পড়ে শুনানো হয় তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং আল্লাহর উপর তারা ভরসা করে।” তবে ঈমান বৃদ্ধির এ কাজটি না বুঝো তেলাওয়াতে হয় না। সে জন্য জরুরি হলো পবিত্র কুর’আন বুঝার সামর্থ্য। এমন কি তরজমা পড়ে সে কাজটি যথার্থ রূপে হয় না। কুর’আন বুঝার কাজটি সঠিক ভাবে হয় একমাত্র কুর’আনের ভাষা জানার মাধ্যমে।  

বিজয় যেহেতু মহান আল্লাহতায়ালার দান, ফলে যুদ্ধে জয়ী হওয়াতে কোন বাড়তি সওয়াব নাই। সওয়াব মেলে নিজ শ্রম, মেধা, অর্থ ও রক্তের বিনিয়োগের পুরষ্কার রূপে। ঈমানদার তাই ফলাফল নিয়ে ভাবে না; ভাবে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার কাজে তার পক্ষ থেকে কতটা বিনিয়োগ হলো -তা নিয়ে। তাই যারা জান্নাত চায়, তারা জিহাদে বিনিয়োগ বাড়ায়।  আর ঈমানদারদের বিনিয়োগ বাড়লে সে দেশে ইসলামী রাষ্ট্রও নির্মিত হয়। তাই কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত না হলে বুঝতে হবে, আল্লাহতায়ালার পথে জান, মাল, মেধা ও শ্রমের বিনিয়োগে দারুন কমতি রয়ে গেছে। আর সে বিনিয়োগে কমতির কারণ, জনগণের ঈমানের কমতি। আর ঈমানের কমতি থাকার মূল কারণ হলো, কুর’আনী জ্ঞানের কমতি। পানির অভাবে যেমন ফসল মারা যায়, তেমনি ঈমান মারা যায় কুর’আনী জ্ঞানের অভাবে। এজন্যই জ্ঞানশূণ্য জাহেল ব্যক্তিদের কখনো জিহাদে দেখা যায় না। তাদের দেখা যায় বরং ইসলামের শত্রুপক্ষের শিবিরে। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে এমন জাহেলদের সংখ্যাটি বিশাল। ফলে দেশ অধিকৃত ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে।

ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতার মূল কারণ, পবিত্র কুর‌’আনের সাথে তাদের সম্পর্কহীনতা। অথচ ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের কাজের শুরুই হয়েছিল কুর’আনের সাথে সম্পর্ককে অটুট করার মধ্য দিয়ে। কুর’আনের প্রতিটি বাণীকে তারা যেমন বুঝেছেন, তেমনি অনুসরণও করেছেন। পবিত্র কুর’আন তাদের কাছে গণ্য হয়েছে জান্নাতের একমাত্র রোডম্যাপ তথা সিরাতাল মুস্তাকীম রূপে। যারা এ পথ অনুসরণ করে একমাত্র তারাই তো পায় মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুত সাহায্য। এ ছাড়া বিজয়ের ভিন্ন পথ নাই। তারা প্রতিশ্রুত বিজয় পেয়েছেন সে পথ অনুসরণ করেই। অথচ আজকের মুসলিমগণ সে পথে নাই। তারা ইতিহাস গড়েছে কুর’আন না বুঝে শুধু তেলাওয়াতে এবং কুর’আনের পথ অনুসরণ না করে। তারা মুসলিম হতে চায়, বিজয় চায় এবং সে সাথে পরকাল জান্নাতও চায় কুর’আন  না বুঝে এবং কুর’আনের বাণী অনুসরণ না করে। এটি তো নিশ্চিত ব্যর্থতার পথ। সে সাথে মহান আল্লাহতায়ালার আযাব নামিয়ে আনার পথও। অথচ সে পথটি অনুসরণ করে চলছে আজকের মুসলিমগণ। ০৮/১০/২০২৩

One Responseso far.

  1. Fazlul Aziz says:

    যূক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্বৃদ্ধি সম্ভব হতো না যদি একান্নটি রাষ্ট্র যুক্ত না হয়ে আলাদা আলাদা একান্ন রাষ্ট্র হিসাবে নিবন্ধিত থাকতো।

    অফারটি দেশ নিয়ে গঠিত ভারত ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে আর সাতন্যটি আলাদা আলাদা মুসলিম দেশ গুলো দ্রুত গতিতে অবক্ষয় ও ধংসের দিকে ধাবিত। পশ্চিমা সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিতরা‌ মুলত কাফের দেশের সাব–কন্ট্রাকটার এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর স্থলাভিষিক্ত হয়ে দেশগুলোকে ফ্ল্য্যগ-বিশিষ্ট–জেলখানায় পরিণত করে জেল-দারোগার ভুমিকায় নিয়োজিত। নেতানিয়াহু একবার বিবিসি নিউজ প্রোগ্রামে পিএলও‌ কে আডিএফ-এর সাব কন্ট্রাকটার বলে উপহাস করেছিল। আসলে অধিকাংশ মুসলিম দেশের শাসকগোষ্ঠীরা জেল–দারোগার সাব কন্ট্রাকটারীর চাকরগিরির কাজেই নিয়োজিত। আমরা সব কয়েদি আর মুমিনরা সব ফাঁসির আসামি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *