ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ কেন এতো অপরিহার্য?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

কেন নির্মিত হয়নি কোন ইসলামী রাষ্ট্র?

পবিত্র কুর’আন যে ইসলাম পেশ করে এবং মহান নবীজী (সা:) যে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছেন, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ছাড়া সে ইসলাম পালন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। যারা সেটিকে সম্ভব মনে করে, বুঝতে হবে তারা পুরাপুরি অজ্ঞ নবীজী (সা:)’র ইসলাম নিয়ে। এরা হলো সে সব ব্যক্তি যারা মনে করে ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত জীবনে পালনের বিষয়। নিজ গৃহে বা মসজিদের জায়নামাজের পালন করলেই চলে। এমন একটি ধারণার কারণেই তারা নিজ গৃহ বা মসজিদের বাইরে রাজনীতি, আদালত, প্রশাসন, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষাব্যবস্থায় ও সেনাবাহিনীতে ইসলামের স্থান দিতে রাজী হয়। অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলি এদের হাতেই অধিকৃত। তাদের যুদ্ধ তাই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের বিরুদ্ধে। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে জিহাদকে এরা সন্ত্রাস বলে। যেন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ সন্ত্রাসী ছিলেন। অথচ ইসলামের নির্দেশিত সকল ইবাদতের মধ্যে একমাত্র জামাতবদ্ধ নামাজ পালনের কাজটি হয় মসজিদের মেঝেতে বা ঘরের জায়নামাজে। মহান আল্লাহতায়ালার বাকি সবগুলি হুকুম যেমন শাসনতন্ত্রে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, আদালতে শরিয়তী আইনের বিচার,  নানা ভাষা ও নানা অঞ্চলের মুসলিমদের মাঝে প্যান-ইসলামিক ভাতৃত্ব, মিথ্যা-অবিচার-দুর্বৃত্তির নির্মূল, ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কুর’আন শিক্ষা, মুসলিম উম্মাহর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ প্রকল্প -এগুলি পালিত হয় মসজিদের বাইরে। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এ হুকুমগুলি পালিত না হলে কি কখনো ইসলাম পালন হয়? তখন তো বিদ্রোহের কান্ড ঘটে -যা ব্যক্তিকে কাফিরে পরিণত করে। তাই যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র নাই, বুঝতে হবে সেদেশে পূর্ণ ইসলাম পালন নাই এবং পূর্ণাঙ্গ মুসলিমও নাই।

মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন তেলাওয়াত, দোয়া-দরুদ ও তাসবিহ পাঠ নিয়ে বাঁচা নয়। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবদের ধর্মকর্ম কি শুধু এগুলি নিয়ে ছিল? তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, কাফির শক্তির নির্মূলের জিহাদ, আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার কাজগুলি কে করলো? প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তি দেশের আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নিল না, ভাষা-বর্ণ-গোত্র ও আঞ্চলিকতা-ভিত্তিক পরিচয়ের উর্দ্ধে ঊঠে নিজকে প্যান-ইসলামিক চেতনায় সমৃদ্ধ করলো না, দুর্বৃত্তদের নির্মূলের কাজে অংশ নিল না, সুবিচারকে প্রতিষ্ঠা দিল না, মুসলিম উম্মাহর জান-মালের সুরক্ষায় জিহাদ করলো না, এবং দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের দুর্দশা দূর করায় কোন উদ্যোগই নিল না  -সে ব্যক্তি  মুসলিম হয় কি করে? ঈমানদারই বা হয় কি করে? প্রকৃত মুসলিম তো একমাত্র সেই যে ইসলামের এ বিধানগুলিকে নিজ জীবনে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠায় জিহাদ নিয়ে বাঁচে। যার জীবনে সে জিহাদ নাই -সে আদৌ ঈমানদার নয়। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণাটি এসেছে সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا۟ وَجَـٰهَدُوا۟ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّـٰدِقُونَ ١٥

অর্থ: “মুমিন একমাত্র তারাই যারা ঈমান আনলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর এবং অতঃপর তার উপর আর কোনরূপ সন্দেহ পোষণ করলো না। এবং নিজেদের সম্পদ ও জান দিয়ে জিহাদ করলো আল্লাহর রাস্তায়। ঈমানের দাবীতে এই লোকগুলোই হলো সত্যবাদী।” –(সুরা হুজরাত, আয়াত ১৫)। এটিই হলো, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে দেয়া প্রকৃত ঈমানদারের সংজ্ঞা বা পরিচয়। যারা ঈমানদার হতে চায় তাদের উচিত উপরুক্ত আয়াতের সাথে নিজের জীবনকে মিলিয়ে দেখা। তাই যার জীবনে জিহাদ নাই সে নামাজী, রোজাদার ও হাজী হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত ঈমানদার নয়। সূদখোর, ঘুষখোর, মিথ্যাবাদী ও দুর্বৃত্ত স্বৈরাচারীগণও নামাজী, রোজাদার ও হাজী হতে পারে। কিন্তু তাদের জীবনে জিহাদ না থাকার কারণে তারা কখনোই ঈমানদার হতে পারে না -উপরুক্ত আয়াতটিতে তো সেটিই বলা হয়েছে। এজন্যই নবীজী (সা:)’র এমন কোন সাহাবী ছিলেন না যার জীবনে জিহাদ ছিল না। বরং অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। এবং জিহাদ থেকে দূরে সরা লোকদের নবীজী (সা:)’র যুগে মুনাফিক বলা হয়েছে।

জিহাদ তো তাদের জীবনেই অনিবার্য হয়ে উঠে যাদের জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তী আইন এবং তাঁর কুর’আনী হুকুমগুলিকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার প্রবল তাড়না থাকে। থাকে এসব কাজের মধ্য দিয়ে মাগফিরাত ও জান্নাত পাওয়ার তাড়না। এমন তাড়না থেকেই মুমিন ব্যক্তির জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদ অনিবার্য হয়ে উঠে। এ জিহাদে শহীদ হওয়াকে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন মনে করে। কিন্তু যার মধ্য সে তাড়না নাই এবং ধর্মকর্ম বলতে বুঝে স্রেফ নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, দোয়াদরুদ ও কুর’অআন পাঠ নিয়ে বাঁচা -তার জীবনে জিহাদ থাকার কথা নয়।  ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদও তার মধ্যে সৃষ্টি হয় না। মুসলিম বিশ্বে এমন ভন্ড মুসলিমের সংখ্যাই বেশী। তাই নির্মিত হচ্ছে না কোন ইসলামী রাষ্ট্র। এবং গড়ে উঠছে না ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদ।

অতীতে সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিম উম্মাহর উত্থানটি স্রেফ নামাজ-রোজা ও হ্জ্জ-যাকাতের কারণে ঘটেনি। বরং সেটি সম্ভব হয়েছে নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কারণে। পৃথিবীপৃষ্ঠে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হলো রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রটি ইসলামী হলে এবং সে রাষ্ট্রের ভূগোলে বৃদ্ধি ঘটলে মুসলিম উম্মাহর শক্তি, নিরাপত্তা ও ইজ্জত বাড়ে। অপর দিকে ভূগোল ক্ষুদ্রতর হলে শত্রুর হাতে সে মুসলিম দেশ অধিকৃত হয়। তখন অসম্ভব হয় সে অধিকৃত দেশে পূর্ণ ইসলাম পালন।  এজন্যই কোন মুসলিম দেশের ভূগোলের সুরক্ষা দেয়ার কাজটি পবিত্র জিহাদ। সে জিহাদ শহীদ হওয়ার রাস্তা খুলে দেয়। অপর দিকে হারাম হলো মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গা। এটি কবিরা গুনাহ। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব প্রতিটি ঈমানদারের। সে দায়িত্বটি কখনোই সেনাবাহিনীর মুষ্টিমেয় সংখ্যক সদস্যদের উপর নয়। ইসলামী রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো মুসলিম জনগণকে সাথে নিয়ে জিহাদ সংগঠিত করা। রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকদের দায়িত্ব হলো, সে জিহাদে নিজেদের জান, মাল, মেধা, শ্রম ও রক্তের বিনিয়োগ ঘটানো। ইসলামের গৌরব কালে রাষ্ট্রের খলিফাগণ তো সেটিই করেছেন। আর যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জিহাদ সংগঠিত হয়, সে রাষ্ট্রের উপর মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নানারূপ রহমত ও নিয়ামত নেমে আসে। এজন্যই ইসলামের গৌরবকালে শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ সংগঠিত করাটি খলিফাগণ নিজেদের ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করতেন।  অথচ আজ মুসলিম জীবনে সে জিহাদ নাই, ফলে প্রতিষ্ঠা পায়নি কোন ইসলামী রাষ্ট্র। এরই ফল হলো, মুসলিমদের সংখ্যা বিপুল ভাবে বাড়লেও তাদের শক্তি ও ইজ্জত একটুও বাড়েনি। বরং সেগুলি দারুন ভাবে কমেছে। জিহাদই হলো ইসলামকে বিজয়ী করার কাজে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত একমাত্র হাতিয়ার। অতি বিস্ময়ের বিষয় হলো, বহু মুসলিম এবং বহু ইসলামী দল জিহাদ ছাড়াই ইসলামকে বিজয়ী করার স্বপ্ন দেখেন। নবীজী (সা:) জিহাদের যে সূন্নত রেখে গেলেন তারা সে সূন্নত নিয়ে বাঁচে না। সে সূন্নতকে আজ সন্ত্রাস,উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ বলা হয়। এসবই হলো সেক্যুলারাইজেশন ও ডিইসলামাইজেশনের ফল।

 

নবীজী (সা)’র ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র

যেখানেই নবীজী (সা:)’র ইসলাম নিয়ে বাঁচার তাড়না, সেখানেই গড়ে উঠে ইসলামী রাষ্ট্র। কাফির বা মুনাফিক অধিকৃত দেশে কখনোই পূর্ণ ইসলাম পালনের কাজটি হয়না। নবীজী (সা:) যুগেও কাফির অধিকৃত মক্কায় সেটি সম্ভব হয়নি। কারণ, মক্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ কাফেরগণ সেটি হতে দেয়নি। পূর্ণ ইসলাম পালনের কাজটি সম্ভব করতেই ইসলামী রাষ্ট্রের যেমন ফরজ, তেমনি ফরজ হলো সে লক্ষ্যে নিরাপদ দেশে হিজরত। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সে কাজটি ত্বরান্বিত করতেই নবীজী (সা:) ও তাঁর সাথীদের উপর ফরজ করা হয় মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত।  সেদিন মদিনায় হিজরত না করলে অসম্ভব হতো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। তখন মুসলিমদের বাঁচতে হতো অপূর্ণাঙ্গ মুসলিম রূপে। এবং তাতে সম্ভব হতো না বিশ্ববাসীর সামনে পূর্ণ ইসলামকে তুলে ধরার কাজ। তখন মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা এবং কুর’আনী বিধান স্রেফ কুর’আনেই থেকে যেত।   

মহান নবীজী (সা:) ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁকে বেছে নেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমলকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজে। এ ক্ষেত্রে নবীজী (সা:)’র সাফল্য ছিল অভূতপূর্ব। সেটি ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং সে রাষ্ট্রে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব এবং শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা। সে ইসলামী রাষ্ট্রের কারণে প্রতিষ্ঠা পায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতি। সেটি হলো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল। প্রতিটি ঈমানদারের দায়িত্ব হলো, নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সে নেক আমলের সূন্নত নিয়ে বাঁচা। সে সূন্নত নিয়ে বাঁচার তাড়নাতেই সাহাবাগণ জন্ম দিয়েছিলেন খোলাফায়ে রাশেদা।  

মক্কা থেকে মদিনীয় হিজরতের বছরটি মুসলিম ইতিহাসে এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে হিজরী সাল গণনার শুরু হয় হিজরতের বছর থেকে।  লক্ষণীয় হলো, মদিনায় হিজরতের পর পরই নবীজী (সা:) ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেন এবং ১০টি বছর তিনি সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। সে রাষ্ট্রের কারণেই মুসলিম  উম্মাহর উদ্ভব ঘটে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তি রূপে। এবং নির্মিত হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তাই ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ হলো নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ লিগ্যাসি বা সূন্নত। তাই যে ভূমিতে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নাই, বুঝতে হবে সে ভূমিতে নবীজী (সা:)’র প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত ইসলাম বেঁচে নাই। ইসলামের নামে যা বেঁচে আছে তা হলো বিকৃত ও অপূর্ণাঙ্গ ইসলাম।    

আজ মুসলিমগণ যে ইসলাম নিয়ে বাঁচে সে ইসলামে ইসলামী রাষ্ট্রের কোন স্থান নাই। জিহাদেরও কোন স্থান নাই। জিহাদ তো তাদের জীবনে থাকে যাদের  জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তাড়না থাকে। তাড়না থাকে পূর্ণ ইসলামের প্রতিষ্ঠা দিয়ে বাঁচার। এবং তাড়না থাকে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হওয়ার। যারা শুধু নামাজ-রোজা ও হ্জ্জ-যাকাত পালন, পীর-মুরিদী ও তাবলিগ করাকে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম মনে করে তারা কেন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদে নামবে? নিজেদের জান-মালেরই বা কেন বিনিয়োগ করবে? অধিকাংশ মুসলিম ভূমি অধিকৃত হয়ে আছে স্বৈরাচারী রাজ-বাদশাহ, সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদীদের হাতে। নবীজী (সা:)’র যুগে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় বাধা আসতো কাফিরদের থেকে। কিন্তু আজ সে বাধা আসছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলির দখলদার স্বৈরাচারী শাসকদের থেকে এবং তাদের সমর্থক মুসলিমনামধারী স্তাবকদের থেকে।  ইসলামী রাষ্ট্র না থাকায় কুর’আনের দর্শন, শরিয়তী আইন, ইসলামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি, শিক্ষা নীতি, বিচার ব্যবস্থা, অন্যায়ের নির্মূল ও ন্যায় প্রতিষ্ঠারর জিহাদের ন্যায় ইসলামের মূল এজেন্ডাগুলি শুধু কিতাবেই রয়ে গেছে। ফলে অতীতে ইসলামী রাষ্ট্রের কারণে মুসলিমগণ যে শক্তি, বিশ্বজোড়া মর্যাদা ও নিরাপত্তা পেয়েছিল, আজকের মুসলিমগণ তা থেকে বঞ্চিত। তারা আজ বিভক্ত, শত্রুর হাতে অধিকৃত এবং গুম-ধর্ষণ-অপমানের শিকার।

 

ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ কেন ব্যর্থ হয়?

অসভ্য, বর্বর ও অপরাধী মানুষেরাও ঘর বাঁধে। তারাও শিকার ধরে, মাছ ধরে, ও পশু পালন করে। তাদের অনেকে চাষবাদ করে এবং বস্ত্র বুনে।  তবে এরূপ বহু কিছুতে সক্ষম হলেও তাদের অনেকেই রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পারে না। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ হাজার হাজার বছর যাবত রাষ্ট্র ছাড়াই বসবাস করেছে। তারা বসবাস করেছে গ্রোত্রীয় পরিচয় নিয়ে বা পরিচয় ছাড়াই। তাদের দ্বারা রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি হয়নি। কারণ, রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য শুধু পানাহারে বাঁচার সামর্থ্য থাকলে চলে না। সে কাজে লাগে সমৃদ্ধ চেতনা, দর্শন ও বিবেকবোধ। লাগে জান, মাল, মেধা, শ্রম ও সময়সহ সকল উচ্চতর মানবিক সামর্থ্যের বিনিয়োগ। কিন্তু অসভ্য, অজ্ঞ ও দর্শনহীন মানুষের সে সামর্থ্য থাকে না।

গুহা ও জঙ্গলেও আমৃত্যু বসবাস করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্র ছাড়া জান-মাল ও ইজ্জতের সুরক্ষা, সুশিক্ষা, আইনের শাসন, মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূল, সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা, এবং সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নিয়ে বসবাসের কাজটি হয় না। তাই সভ্য রাষ্ট্র -বিশেষ করে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণই হলো মানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম। সভ্য ও ভদ্র মানুষের পরিচয়ের মেলে কি ধরনের বাড়ীতে সে বসবাস করে তা দেখে। গৃহে দেয়াল নাই, ছাদ নাই, মেঝেতে দুর্গন্ধময় আবর্জনার স্তুপ -এমন গৃহের বাসিন্দাকে কখনোই কোন রূচিবান ব্যক্তি সভ্য, ভদ্র ও বিবেকমান মানব বলবে না। এমন গৃহের বাসিন্দকে বিশ্বের তাবত মানুষ অসভ্য, অভদ্র,বর্বর ও মানসিক দিক দিয়ে অসুস্থ বলবে।  তেমনি যে দেশে গুম, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, সন্ত্রাসের প্লাবন এবং শাসন ক্ষমতায় ভোটডাকাত দুর্বৃত্ত -সে দেশ কখনোই সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় না। সেটি এক বর্বর রাষ্ট্র। সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রের পরিচয় মেলে সে রাষ্ট্রের শাসক ও জনগণের ঈমান, বিবেক, দর্শন, চেতনা, শিক্ষা ও যোগ্যতার মান এবং রাষ্ট্রের বুক থেকে অবিচার ও দুর্বৃত্তির নির্মূল দেখে।  

জনগণ যত বেশী ঈমানদার, জ্ঞানবান, বিবেকবান ও সভ্যতর হয়, ততই বাড়ে উন্নত রাষ্ট্র-নির্মাণের তাড়না। তখন বাড়ে সে রাষ্ট্রের সামর্থ্যও। ইসলামের আগে আরবদের কোন রাষ্ট্র ছিল না। তাদের কোন শক্তি, প্রতিপত্তি ও ইজ্জত ছিল না। বহু হাজার বছর তারা কাটিয়েছে মরুর বুকে গোত্রীয় জীবনের কোন্দল, সংহিংসতা, অসভ্যতা ও বর্বরতা নিয়ে। মুর্তিপূজার সনাতন অজ্ঞতা ছিল তাদের ধর্ম । সেখানেো কোন সভ্য আইন ছিল না; আইনের শাসনও ছিল না। সেখানে দুর্বলের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা ছিল না। মানুষ হাটে বাজারে গরু-ছাগলের ন্যায় বিক্রি হতো। নারীদের কোন মর্যাদা ছিল না, জীবিত কবর দেয়া হতো কন্যা সন্তানদের। “জোর যার মুল্লুক তার” -জঙ্গলের এ নীতিই ছিল আরবদের নীতি। কিন্তু ইসলাম কবুলের পর এই আরব মুসলিমগণই নির্মাণ করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তারা প্রতিষ্ঠা পায় বিশ্বশক্তি রূপে। তাদের সে গৌরবের কারণ, তারা সফল হয়েছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে। এরূপ অতি উচ্চাঙ্গের মানবিক কাজটি অন্য কোন জাতির দ্বারা আর কোন কালেই হয়নি।  এরূপ কাজ কোটি কোটি মসজিদ, মাদ্রাসা বা পীরের খানকা গড়ে সম্ভব নয়। সেটি সম্ভব হয়েছিল একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার মধ্য দিয়ে। এবং সেরূপ একটি রাষ্ট্র নির্মাণই হলো মহান নবীজী (সা)’র সর্বমহান কর্ম। তার সে রাষ্ট্রটি কোন সেক্যুলার রাষ্ট্র ছিল না, সেটি ছিল পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্র নির্মাণের ফলে বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বাস্তবায়ন ঘটে। সে এজেন্ডাটি হলো: لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِ  অর্থাৎ সকল ধর্ম, সকল মতবাদ ও সকল জীবনদর্শনের উপর ইসলামের বিজয়। মহান আল্লাহতায়ালার সে এজেন্ডা বিজয়ী হওয়ার সুফল হলো ইসলামী রাষ্ট্রের কোটি কোটি মানুষ জাহান্নামের আগুনে পড়া থেকে উদ্ধার পায় এবং জান্নাতের পথ পায়। নবীজী (সা:)‌’য়ের নির্মিত  সে রাষ্ট্রের কারণে কোন দুর্বৃত্ব স্বৈরশাসক ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে কলুষিত করতে পারিনি। অথচ সেরূপ একটি রাষ্ট্র না থাকায় হযরত মূসা (আ:)’য়ের উপর তাওরাতে নাযিলকৃত শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। সে আইন কিতাবেই রয়ে গেছে। ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না পাওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে হযরত ঈসা (আ:)’য়ের দেয়া তাওহিদের শিক্ষাও। ধর্মের মাঝে পৌত্তলিকতা ঢুকিয়েছে খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষা নেয়া স্বৈরাচারী রোমান রাজা কন্সটানটাইন।     

মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণের কাজটি অতি সহজ। সূদখোর, ঘুষখোর, মিথ্যাবাদী ও নৃশংস স্বৈরাচারীরাও সেগুলি বিপুল সংখ্যায় গড়তে পারে। এমন কি বাংলাদেশের ন্যায় যে দেশটি দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্ব রেকর্ড গড়ে, সে দেশেও লক্ষ লক্ষ মসজিদ এবং হাজার হাজার মাদ্রাসার নির্মিত হয়। গুম, খুন, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতির প্লাবনে ডুবা এ দেশটিতে বহু কোটি নামাজী ও রোজাদার দেখা যায়। এমন দেশে তাবলিগের ইজতেমায় ২০ লাখ মানুষ জমায়েত হয়। কিন্তু তাদের মানবিক, চারিত্রিক ও ঈমানী শূণ্যতাটি প্রকট ভাবে ধরা পড়ে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের ব্যর্থতা থেকে। ঘুষখোর, সূদখোর, মিথ্যাবাদী, প্রতারক ও সেক্যুলার রাজনীতির দুর্বৃত্ত নেতা-কর্মীগণও নামাজী, রোজাদার ও হাজী  হতে পারে। কিন্তু তারা কখনোই রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদের মুজাহিদ হতে পারে না। কারণ  এ জিহাদ শুধু অর্থ ও সময়ের কুরবানী নয়, রক্ত ও প্রাণের কুরবানী চায়। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে তো সেই নামতে পারে, যে প্রকৃত ঈমানদার এবং নিজ নফসের বিরুদ্ধে জিহাদে বিজয়ী। নামাজী, রোজাদার ও হাজী তো ঘুষখোর, সূদখোর মিথ্যাচারী ও স্বৈরাচারী খুনী শাসকগণও হতে পারে। কিন্তু ঈমানদার হতে হলে  হৃদয়ে কুর’আনী জ্ঞানের নূর থাকতে হয়। নফসের বিরুদ্ধে জিহাদে তো সেই বিজয়ী হয় যার হৃদয়ে রয়েছে কুর’আনী জ্ঞানের অস্ত্র। পবিত্র কুর’আনে সে জিহাদের নির্দেশ এসেছে এভাবে: “জাহিদু বিহি জিহাদান কবিরা” অর্থ: “এই (কুর’আন) দিয়ে বড় জিহাদটি লড়ো”। তাই ঈমানদারকে শুধু মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস করলে চলে না, তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে হয় পবিত্র কুরআনে নাযিলকৃত আয়াতকেও । তাই বলা হয়েছে: فَـَٔامِنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَٱلنُّورِ ٱلَّذِىٓ أَنزَلْنَا ۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌۭ ٨

অর্থ,: “অতঃপর ঈমান আনো আল্লাহ, তাঁর রাসূল, সেই নূরের উপর (কুর’আনের উপর) যা আমি নাজিল করেছি; এবং তোমরা যা কিছু করো সে বিষয়ে আল্লাহ খবর রাখেন।” –(সুরা তাগাবুন, আয়াত ৮)।     

বদরের ময়দানে যে ৩১৩ জন যুদ্ধে নেমেছিলনে তাদের মধ্যে বেশীর ভাগ সাহাবী (মক্কার মোহাজির সাহাবীগণ) জিহাদে নামার পূর্বে মক্কায় ১৩ বছর পবিত্র কুর’আন দিয়ে বড় জিহাদটি লড়েছেন নিজের নফসের বিরুদ্ধে। এবং সেটি কুর’আনী জ্ঞানের অস্ত্র দিয়ে। এ জিহাদে যারা বিজয়ী হয়েছিল তাদেরই প্রথম সারিতে দেখা গেছে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে।  তারাই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন খোলাফায়ে রাশেদাকে। এরূপ পরিশুদ্ধ মুজাহিদ না থাকায় বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে লোকবল নাই। কারণ, এদেশে কোটি কোটি নামাজী ও রোজাদার থাকলেও নিজের নফসের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে এমন ঈমানদার নাই। ঘুষখোর, সূদখোর, মিথ্যাচারি নামাজী ও রোজাদারদের দিয়ে আর যাই  ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের পবিত্র জিহাদটি হয়না। এসব সেক্যুলারিস্ট দুর্বৃত্তগণ বরং ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজকে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসী বলে ঈমানদারদের উপর নির্যাতন করবে বা তাদেরকে হত্যা করবে -সেটিই স্বাভাবিক। মিশর ও বাংলাদেশের মত দেশে তো সেটিই তো অহরহ হচ্ছে। তারা বরং হাসিনার ন্যায় এক ভোটডাকাত দুর্বৃত্তকে ক্ষমতায় বসিয়ে মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী বলবে।

 

ইসলামী রাষ্ট্র: পৃথিবীপৃষ্ঠে মানবের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি     

পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে কল্যাণকর প্রতিষ্ঠানটি মসজিদ, মাদ্রাসা  বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সেটি হলো ইসলামী রাষ্ট্র। জনগণকে জান্নাতে নেয়ার এটিই হলো একমাত্র বাহন। কারণ, রাষ্ট্র সেটি করে শিক্ষা, কুর’আন-চর্চা ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধির মধ্য দিয়ে। কারণ, রাষ্ট্রের হাতে থাকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন, মিডিয়া, পুলিশ ও আদালত। এগুলি হলো শুধু রাষ্ট্রের বুক থেকে নয়, জনগণের মন থেকে আবর্জনা সরানোর হাতিয়ার। অপর দিকে অনৈসলামিক রাষ্ট্র হলো জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার হাতিয়ার। সেটি করে কুর’আন শিক্ষা, শরিয়ত ও জিহাদকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে। কাফির, মুনাফিক ও দুর্বৃ্ত্ত অধিকৃত এমন রাষ্ট্রই হলো পৃথিবী-পৃষ্ঠে মানবের হাতে সৃষ্ট সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সৃষ্টি। এমন রাষ্ট্রের নাশকতা কোভিড, ভূমিকম্প ও সুনামীর চেয়েও অধিক। কোভিড, ভূমিকম্প ও সুনামী মানুষকে জাহান্নামে নেয় না। কিন্তু  অনৈসলামিক রাষ্ট্র নেয়। এজন্যই এমন দুর্বৃত্ত অধিকৃত রাষ্ট্রের নির্মূলের জিহাদটি হলো সবচেয়ে বড় জিহাদ। সে জিহাদেরই অংশ হলো ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণের জিহাদ। এরূপ জিহাদে যারা অংশ নেয় একমাত্র তারাই হলো সত্যিকার ঈমানদার -যার ঘোষণা এসেছে সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে।

ঈমানদার হওয়ার দাবী একজন সূদখোর, ঘুষখোর, মদখোর এবং ফ্যাসিস্ট খুনিও করতে পারে। অথচ সুরা হুজরাতে মহান আল্লাহতায়ালার বয়ানে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হয়েছে তা হলো, যার মধ্যে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ নাই, তার মধ্যে ঈমানও নাই। এমন ব্যক্তি ঈমানের দাবী করলে বুঝতে হবে সে মুনাফিক। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত সে মুনাফিকি দূর করতে পারে না। আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার ৩০০ সহচর তাই নবীজী (সা)’র পিছনে নামাজ পড়েও মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচতে পারিনি।

ইবাদতের ধারণা নিয়েও কি বিভ্রান্তি কম? ইবাদত শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত নয়। মুসলিম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতগুলি মসজিদ ও জায়নামাজে হয় না, সেগুলি হয় মসজিদ ও জায়নামাজের বাইরে। ইবাদতের শুরু হয় সত্যের আবিষ্কার এবং সে সত্যকে বিজয়ী করার কাজে  লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। সেটিই হলো হযরত ইব্রাহীম (আ:)‌’য়ের সূন্নত।  সত্য আবিস্কারে সে প্রবল তাড়নার কারণেই হযরত ইব্রাহীম (আ:) মহান আল্লাহতায়ালাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। সত্যের আবিষ্কারের তাঁর সে বিরামহীন তাড়না মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এতোই ভাল লেগেছিল যে তিনি তাঁর সে কাহিনী পবিত্র কুর’আনে একাধিক বার বর্ণনা  করেছেন -যাতে মানুষ তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে।

বাঙালি মুসলিমদের লাগাতর নিচে নামা দেখে বলা যায়, সত্যের আবিষ্কার ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজটি তাদের দ্বারা হয়নি। তাদের ধর্মচর্চা নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের মধ্যেই সীমিত রয়ে গেছে। সেটি আর সামনে এগুয়নি। অথচ ইসলাম কীভাবে পালন করতে হয় সেটি নবীজী (সা:) পালন করে হাতে কলমে শিখিয়ে গেছেন। ইবাদত-বন্দেগীকে তিনি নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের মাঝে সীমিত রাখেননি। তিনি বাস্তবায়ীত করে গেছেন মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে। সে লক্ষ্যে পৌঁছতে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রকেও প্রতিষ্ঠা দিয়ে গে‍ছেন। নবীজী (সা:) কে পূর্ণ অনুসরণ করা ইসলাম ফরজ। যে ব্যক্তি নবীজী (সা:) অনুসরণ করে সেই অনুসরণ করে মহান আল্লাহকে -এ ঘোষণাটি এসেছে পবিত্র কুর’আনে। এবং যে অবাধ্য হয় নবীজী (সা:)’র, সে অবাধ্য হয় মহান আল্লাহতায়ালার। তাই নিজ জীবনে ইসলামের কতটুকু অনুসরণ হচ্ছে সে বিষয়টির বিচার করতে হয় নবীজী (সা:)’র ইসলাম পালনের সাথে মিলিয়ে। তাই কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি না হলে বুঝতে হবে নবীজী (সা:)’র অনুসরণের কাজটি হয়নি। তবে অবাধ্যতার এখানে শুধু নবীজী (সা:)’র নয়, বরং সেটি মহান আল্লাহতায়ালার। এরূপ অবাধ্যতা নিয়ে কি কোন মুসলিম এ দুনিয়ায় ও আখেরাতে কল্যাণ পেতে পারে?

যারা প্রকৃত ইসলাম অনুসরণ করতে চায় তারা সে ইসলামের সন্ধান পেতে পারে পবিত্র কুর‌’আনে, হাদীস গ্রন্থে ও মুসলিমদের অতীত ইতিহাসে। প্রকৃত ইসলামকে চেনা ও বুঝার কাজটি  শুধু লেখক, আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের কাজ নয়, এ দায়িত্ব প্রতিটি মুসলিমের। এবং সে কাজটি নামাজ-রোজার ন্যায় প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ। অথচ সে ফরজ কাজটি পালিত না হওয়ায় আজকের মুসলিমগণ ব্যর্থ হচ্ছে সঠিক ইসলামকে  খুঁজে পেতে ও অনুসরণ করতে। মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার শুরু এ অজ্ঞতা থেকে। ফলে তারা ব্যর্থ হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের গুরুত্ব বুঝতে। অথচ ইসলামকে চেনার কাজটি যথার্থ ভাবে হলে মুসলিমগণ জানতে পারতো মুসলিমগণ অতীতে কী করে বিস্ময়কর বিজয় পেল। তখন এটিও বুঝতো, কী করে তারা ইসলাম থেকে এতোটা দূরে সরলো? এবং কেনই বা তারা এতোটা অধঃপতিত হলো?

 

বাঙালি মুসলিমদের কৃত নাশকতা

ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ নিয়ে মুসলিমদের মাঝে প্রচেষ্টা অতীতে কম হয়নি। এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার ইতিহাসও প্রচুর। দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টাটি হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেদিন মুসলিম লীগের স্লোগান ছিল “পাকিস্তান কি মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাই ছিল মুহম্মদ ঘুরীর হাতে দিল্লি বিজয়ের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম প্রকল্প। সেটি ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এবং সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র নির্মাণের প্রকল্প। সে প্রকল্পে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি ছিল বাঙালি মুসলিমদের। মুসলিম লীগের জন্ম ঢাকায়। মুসলিম লীগের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলার বুকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ লড়াই (direct action) হয়েছিল কলকাতার রাজপথে। সেটি ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট তারিখে। সেটি বাঙালি মুসলিমদের দ্বারা। বস্তুত পাকিস্তান সৃষ্টিই ছিল বাঙালি মুসলিমদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম। কিন্তু সে পাকিস্তান প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ, বাঙালি মুসলিমগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে। মুসলিমের শক্তি ও গৌরব বৃদ্ধির বদলে বাঙালির বিজয় ও গৌরববৃদ্ধি তাদের রাজনীতির প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা পাকিস্তানের শত্রুতে পরিণত হয়। ইসলামের প্রতিষ্ঠা ছেড়ে তারা সেক্যুলারিস্ট হয়ে যায়। সেক্যুলারিস্ট হওয়ার অর্থ তো ইসলাম থেকে দূরে সরা। এটিই হলো শয়তানী শক্তির de-Islamisation প্রকল্প। অথচ পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি হওয়ার কারণে এ প্রকল্পকে সফর করার দায়িত্বটি বাঙালি মুসলিমদের উপরেই ছিল সর্বাধিক। মুসলিমদের লড়াইটি কখনোই মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গা নিয়ে নয়, বরং সেটিকে হতে হয় রাষ্ট্রের বুকে সুবিচার, সুনীতি ও ইসলামকে প্রতিষ্ঠা দেয়া নিয়ে। সেটিই তো মুসলিম জীবনের জিহাদ। সে দায়িত্বটি পালন না করে তারা বরং ভারতের ন্যায় একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রকে সাথে নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে পাকিস্তানের বিনাশে। বাঙালি মুসলিমদের সর্বকালের ইতিহাসে এটিই হলো সব চেয়ে বড় নাশকতার কান্ড। বাংলাদেশের ইসলামপ্রেমী আগামী প্রজন্ম বহুশত বছর পরে হলেও এ নাশকতার নায়কদের অবশ্যই আসামীর কাটগড়ায় খাড়া করবে।

মুসলিম দেশকে ক্ষুদ্রতর করাটি কোন কালেই কোন দেশে ঈমানদারের কাজ ছিল না, সব সময়ই সেটি ছিল ক্ষমতালোভী ভিতরের শত্রুদের কাজ।  এবং সেটি সংঘটিত হয়েছে বিদেশী শত্রুদের সাহায্য নিয়ে। এতে মুসলিমদের শক্তি কমে এবং বৃদ্ধি ঘটে শত্রুদের শক্তিতে। দক্ষিণ এশিয়ার বুকে একাত্তরে তো সেটিই হয়ে্ছে।  হিন্দুত্ববাদী ভারত তাই আজ এশিয়ার বুকে বৃহৎ শক্তি।  অথচ দুর্বল হয়েছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। শত্রুর নাশকতা যেমন ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গণে তেমনি ঈমান ও চারিত্রিক অঙ্গণে। ইসলামের শত্রুরা তাই শুধু পাকিস্তানকে ভেঙ্গেই থেমে থাকেনি, বাংলাদেশকে তারা পর পর ৫ বার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বৃত্তকবলিত দেশে পরিণত করেছে। এটিও কি কম নাশকতা?  শত্রুর হাতে অধিকৃত এদেশটিতে জনগণের রায় বা ভোটের কোন ইজ্জত নাই। নির্বাচনে সেটি ডাকাতি হয়ে যায় ভোটডাকাতদের হাতে। সে ডাকাতির অংশীদার হলো দেশটির পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, বিচারগণ। জনগণের রাজস্বের অর্থে প্রতিপালিত সরকারি কর্মচারিগণ পরিণত হয়েছে জনগণের শত্রুতে। রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্তায়নের হাতিয়ারে এবং সে সাথে জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার বাহনে।    

ই্সলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অতীতে বার বার ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, ইসলামের শত্রু শক্তি প্রবল এবং তারা একতাবদ্ধ। অপর দিকে মুসলিমগণ বিভক্ত। এবং বিনিয়োগ নাই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায়। অপর দিকে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রতিরোধে শত্রুদের রয়েছে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন। তারা মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে বাধা দেয়না। তাবলিগ জামায়াতের কাজে ও ইজতেমাতে বাধা দেয় না। বাধা দেয় না নামাজ, রোজা, হজ্জ,যাকাত পালনে। অথচ তাদের লক্ষ্য, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে প্রতিরোধ করা। সে লক্ষ্যে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে তারা সদা প্রস্তুত। কোন ইসলামী রাষ্ট্রকে সহ্য করতে তারা রাজী নয়। সে কথাটি প্রকাশ্যে বলেছে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।  মুসলিম বিশ্বের নৃশংস জালেম শাসকদের বিরুদ্ধেও এদের কোন শত্রুতা নাই। বরং সেসব জালেম শাসকদেরকে তারা ইসলাম রাষ্ট্র নির্মূলের যুদ্ধে পার্টনার রূপে গ্রহণ করে।  শয়তান ও তার অনুসারিরা জানে মুসলিমদের শক্তির উৎস কোথায়। ইসলামী রাষ্ট্র মানেই পূর্ণাঙ্গ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার সহায়ক পরিবেশ। এবং তেমন একটি রাষ্ট্র দুর্গে পরিণত হয় মুসলিম উম্মাহর বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠার। তাই শয়তানী শক্তি সেটি হতে দিতে রাজী নয়। মুর্সলিম হওয়ার অর্থই হলো শত্রুশক্তির এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় খাড়া হওয়া -যেমন গৌরব যুগের মুসলিমগণ খাড়া হয়েছিলেন রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় তৎকালীন দুটি বিশ্বশক্তির বিরুদ্ধে।

 

নিশ্চিত সফলতা ও নিশ্চিত ব্যর্থতার পথ

প্রকৃত ঈমানদার কখনোই দমে যাওয়ার বা হতাশ হওয়ার পাত্র নয়। হতাশা ইসলামে নিষিদ্ধ। ঈমানদারের দেহে যতক্ষণ প্রাণ থাকে ততক্ষণ ঈমানও থাকে। এবং যতক্ষণ ঈমান থাকে ততক্ষণ জিহাদও থাকে। যে কোন পরাজয়ের পর বিজয়ের আশা নিয়ে ঈমানদার আবারো ময়দানে নামে। ক্ষেতের ফসল বার বার প্লাবনে ভেসে গেলেও কৃষক কখনোই চাষাবাদ ছেড়ে দেয় না। নতুন আশা ও নতুন ভরসা নিয়ে চাষাবাদে নামে; আবারো ফসল বুনে। তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হলেও তাতে ঈমানদার কখনোই থেমে যায় না। সে আবারো ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে নামে। 

যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক মুমিনের জান ও মালের বিনিয়োগ কখনোই ব্যর্থ যায় না। নিজের অর্থ, শ্রম ও রক্তের কুরবানী মধ্য দিয়ে সে জান্নাতের মূল্য পরিশোধ করে মাত্র। সে বিনিয়োগ তাকে যোগ্যতর করে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের জন্য । ঈমানদার তাই proces oriented, result oriented নয়। যুদ্ধে বিজয়ী করার দায়টি মহান আল্লাহতায়ালার। ঈমানদারের কাজ হলো বিজয়ের লক্ষ্যে লাগাতর জিহাদ চালিয়ে যাওয়া। বিজয়ী হওয়াতে তাই কোন বাড়তি সওয়াব নাই, সওয়াব মেলে স্রেফ জিহাদে লাগাতর সক্রিয় থাকার পুরষ্কার রূপে। ঈমানদার তাঁর ঈমানী দায়িত্ব পালন করে মাত্র, ফলাফল কী হবে তা নিয়ে সে ভাবে না। সে তো পুরস্কার পায় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে নিজ জান-মালের কতটা বিনিয়োগ হলো -তা থেকে। তাই যারা জান্নাত চায় তারা জিহাদে বিনিয়োগ বাড়ায়।  আর ঈমানদারদের বিনিয়োগ বাড়লে ইসলাম রাষ্ট্রও নির্মিত হয়। তাই কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত না হলে বুঝতে হবে জনজীবনে বিনিয়োগের কমতি রয়ে গেছে। জান ও মালের বিনিয়োগে যে বিশাল কমতি -সেটির কারণ হলো ঈমানের কমতি। আর ঈমানী কমতির কারণ হলো কুর’আনী জ্ঞানের কমতি। কুর’আনী জ্ঞানই দেয় ঈমানের পুষ্টি। সে জ্ঞানের অভাবে ঈমান মারা যাবে সেটিই তো স্বাভাবিক।

ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতার মূল কারণ হলো কুর‌’আন সাথে তাদের সম্পর্কহীনতা। অথচ ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে নবীজী (সা:)ও তাঁর সাহাবাদের বিশাল সাফল্যের মূল কারণ হলো কুর’আনের সাথে তাদের গভীর ও অটুট সম্পর্ক। কুর’আনের প্রতিটি বানীকে তারা বুঝেছেন ও অনুসরণ করেছেন। পবিত্র কুর’আনই হলো জান্নাতের একমাত্র রোডম্যাপ; এটিই তো সিরাতাল মুস্তাকীম। তারা বিজয় পেয়েছেন সে পথ অনুসরণ করেই। বিজয়ের এ ছাড়া ভিন্ন পথ নাই। এটিই তো নিশ্চিত সাফল্যের পথ। কারণ, এ পথ যারা অনুসরণ করে একমাত্র তারা নিশ্চিত আল্লাহতায়ালার সাহায্য নামিয়ে আনে। অথচ আজকের মুসলিমগণ ব্যর্থতার ইতিহাস গড়েছে কুর’আন না বুঝে ও কুর’আনের পথ অনুসরণ না করে। তারা মুসলিম হতে চায়, বিজয় চায় এবং সে সাথে জান্নাত পেতে চায় কুর’আন না বুঝে এবং কুর’আনের বানী অনুসরণ না করেই। এটি তো নিশ্চিত ব্যর্থতার পথ। সে সাথে জাহান্নামের পথও। কারণ, এ পথ তো আল্লাহতায়ালার আযাব নামিয়ে আনার পথ। আজকের মুসলিমগণ কি সে পথই অনুসরণ করছে না?  ০৮/১০/২০২৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *