ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ কেন এতো অপরিহার্য?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ইসলামের এজেন্ডা ও নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান                                                         

ইসলামের লক্ষ্য শুধু মানব সন্তানদের মুসলিম ও মু’মিন বানানো নয়, বরং যে রাষ্ট্রের বুকে তাদের বসবাস -সে রাষ্ট্রের পূর্ণ ইসলামিকরণ। কারণ রাষ্ট্রকে ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত রেখে সে রাষ্ট্রে মুসলিম ও মু’মিন রূপে বেড়ে উঠার কাজটি শুধু কঠিনই হয় না, সেটি অসম্ভব হয়। তখন অসম্ভব হয় পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানার্জন এবং পূর্ণ ইসলাম পালন। অথচ পানাহারের অভাবে যেমন দেহ বাঁচে না, তেমনি কুর’আনী জ্ঞানের অভাবে ঈমান বাঁচে না। তখন সে অজ্ঞ ব্যক্তিটি কাফির হতে বাধ্য হয়।  এমন অজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে সিরাতাল মুস্তাকীম খুঁজে পাওয়া যেমন অসম্ভব হয়, তেমনি অসম্ভব হয় সে পথে চলা।

রাষ্ট্রের হাতে শুধু একটি ভৌগলিক মানচিত্র ও পতাকা থাকে না, থাকে প্রশাসন, আইন-আদালত, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সেনাবাহিনী। প্রতিটি রাষ্ট্রেই শাসকগোষ্ঠি সৃষ্টি করে একটি প্রবল ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্রোত। প্রবল স্রোতের উজানে সাঁতরানোর সামর্থ্য অধিকাংশ মানুষেরই থাকে না। বিশেষ করে যারা নারী, শিশু ও শারিরীক দিক দিয়ে দুর্বল। ফলে স্রোতের টানে তাদেরকে ভেসে যেতে হয়। তাই রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন যখন খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষা নেয় তখন সে রাজ্যের প্রজাগণ তাদের পূর্বের ধর্মে স্থির থাকতে পারিনি; সবাইকে খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষা নিতে হয়েছে। একই কারণে ফিরাউনের রাজ্যের সবাইকে ফিরাউনকে খোদা বলতে হয়েছে। তেমনি রাশিয়া কম্যুনিস্টদের হাতে অধিকৃত হলে মুসলিমগণ ভেসে গেছে কম্যুনিজমের স্রোতে।

অনৈসলামিক রাষ্ট্রের ভয়াবহ বিপদটি হলো, সে রাষ্ট্রে মুসলিমকে বাস করতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর র্শরিয়তী আইনকে বাদ দিয়েই। অথচ মুসলিম হওয়ার জন্য শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করাই যথেষ্ট নয়, বরং বাধ্যতামূলক হলো শরিয়তী আইন পালন। শরিয়তী আইন পালিত না হলে ইসলাম পালনের কাজটি হয়না। যারা ব্যর্থ হয় শরিয়ত পালনে, পবিত্র কুর’আনে তাদেরকে কাফির, জালিম ও ফাসিক বলা হয়েছে। সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ আয়াতে। এবং শরিয়ত পালনের সে কাজটি সম্ভব হয় একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলে। এজন্যই মুসলিমকে শুধু ঘর গড়লে ও পানাহারের আয়োজন করলে চলে না, তাকে ইসলামী রাষ্ট্রও নির্মাণ করতে হয়। তাই নবীজী (সা:) ও তারা সাহাবাদের জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ দেখা গেছে।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                               

ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত হলে সে রাষ্ট্র শুধু শরিয়তী আইনকেই নিষিদ্ধ করে না, রাষ্ট্রকে বরং জাহান্নামে নেয়ার বাহনে পরিণত করে। রাষ্ট্রই হলো পৃথিবী পৃষ্ঠের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এবং প্রতিটি রাষ্ট্রে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হলো তার শাসক। শাসকের হাতে থাকে রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, আইনপ্রণয়ন, মিডিয়া, পুলিশ ও সেনাবাহিনী -তথা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার সকল হাতিয়ার। এজন্যই রাষ্ট্রকে জাহান্নামের বাহনে পরিণত করা শাসকশক্তির জন্য সহজ হয়ে যায়। ফিরাউন ও নমরুদ তাই নিজেদের খোদা রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছিল। এজন্যই ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি মসজিদ-মাদ্রাসার নির্মাণ নয়, সেটি ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। ইসলামে এটি জিহাদ। রাষ্ট্র তখন জনগণকে জান্নাতে নেয়ার বাহনে পরিণত হয়। তখন দেশের কোটি কোটি মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর কাজটি সহজ হয়ে যায়।  এর চেয়ে অধিক কল্যাণকর্ম এ পৃথিবী পৃষ্ঠে দ্বিতীয়টি নাই। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ কাজটি না করা হলে মসজিদ-মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশ ভরে ফেললেও কোন লাভ হয়না। তখন সে রাষ্ট্রে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা ও স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা পেলেও জান্নাতের উপযোগী মানুষ গড়ার কাজটি হয়না। বরং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় জাহান্নামের উপযোগী মানুষ। ফলে এমন দেশে চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, ব্যাংক লুট, ট্রেজারী লুট,গণহত্যা ও দুর্বৃত্তিতে প্লাবন আনতে লোকের অভাব হয়না। সেটির জাজ্বল্যমান প্রমাণ হলো আজকের বাংলাদেশ। এদেশটিতে যেরূপ বিপুল সংখ্যক মসজিদ-মাদ্রাসা, তা বিশ্বের আর কোন দেশে নাই। তাবলিগ জামায়াতের এতো অনুসারীও অন্য কোন দেশে নাই। কিন্তু দেশটি দুর্নীতিতে এ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়েছে। এভাবে দুর্বৃত্ত রূপে বেড়ে উঠার লড়াইয়ে হারিয়ে দিয়েছে এমন কি পৌত্তলিক কাফিরদেরও। এখনো বাংলাদেশ দুর্বৃত্তিতে প্রথম ১০টি দেশের মাঝে একটি। অতএব এতো মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে লাভ কি হলো? বিশাল বিশাল বিশ্ব-ইজতেমা করেই বা কি লাভ? অথচ মুসলিমের ঈমানী দায়ভার হলো তারা ইতিহাস গড়বে মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূলে এবং সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠায়।

প্রশ্ন হলো, মিথ্যা ও দুর্বৃত্তি থেকে মানুষকে বাঁচানোর কাজটি না হলে কি জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর কাজ হয়? যারা অবাধ্য শরিয়তী আইনের এবং বিশ্বে প্রথম হয় দুর্বৃত্তিতে -তাদেরকে কি রাব্বুল আলামিন জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করবেন? দুর্বৃত্তদের জন্য যা প্রস্তুত করা হয়েছে সেটি তো জাহান্নাম। এজন্যই নবীজী (সা:) তাঁর ১৩ বছরের মক্কী জীবনে মক্কায় একটি মসজিদও নির্মাণ করেননি, বরং প্রস্তুতি নিয়েছেন ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে। মক্কার বুকে তাঁর সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ ছিল আগামী দিনের ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক, প্রশাসক, বিচারক, জেনারেল, ফকিহ, মুফাচ্ছির, শিক্ষক নির্মাণে। প্রয়োজনীয় যোগ্য লোকবল থাকায়, মদিনায় হিজরতের সাথে সাথে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ শুরু করতে তাকে কোন সংকটে পড়তে হয়নি।  সে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কেন্দ্র রূপে গড়ে তোলেন মসজিদে নববী। নবীজী (সা:) নিজে ১০টি বছর সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। সে রাষ্ট্রকে নবীজী (সা:)’র সূন্নতের উপর বাঁচিয়ে রাখেন খোলাফায়ে রাশেদা।

 

উপেক্ষিত হয়েছে নবীজী (সা:) সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত

মুসলিমদের আজকের বিপর্যয়ের মূল কারণ, তারা নবীজী (সা:) থেকে ওজু-মেছওয়াক, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের বিধান শিখলেও শিখেনি কিরূপে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হয় সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। ফলে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে উপেক্ষিত হয়েছে নবীজী (সা:)’র রাষ্ট্র নির্মাণের সূন্নত।  অথচ ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণই হলো নবীজী (সা:)’র জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত -যা মুসলিমদের বিশ্বব্যাপী ইজ্জত, শক্তি ও নিরাপত্তা দিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তার শরিয়তী আইনের। নবীজী (সা:) আর কোন উদ্দ্যেশে এতো শ্রম ব্যয়, এতো অর্থ ব্যয়, এতো সময় ব্যয়  এবং এতো যুদ্ধ করেননি -যা করেছেন রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে। একাজে তিনি নিজে আহত হয়েছেন। অথচ রাষ্ট্র নির্মাণ ও রাষ্ট্র পরিচালনের ক্ষেত্রে নবীজী (সা:)’র দীর্ঘকালীন সূন্নতকে বাদ দিয়ে মুসলিমগণ অনুসরণ করছে কাফির, ফাসিক ও মুশরিকদের হারাম রীতি-নীতিকে। ফলে রাষ্ট্র নির্মাণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে সিরাতাল মুস্তাকীম অনুসরণ করতে। এটিই হলো নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলাম থেকে আজকের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি এবং তাঁর সূন্নতের সাথে সবচেয়ে বড় গাদ্দারি। আর সে গাদ্দারির খেসারত দিচ্ছে যেমন স্বাধীনতা হারিয়ে, তেমনি জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা হারিয়ে।

নবীজী (সা:)’র সূন্নতের সাথে গাদ্দারির নমুনা হলো, ৫০টির বেশী মুসলিম ভূমির কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ না করে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী, ফ্যাসিবাদী, রাজতন্ত্রী ও সেক্যুলার রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রগুলি পরিণত হয়েছে শয়তানের হাতিয়ারে। ফলে এসব রাষ্ট্রগুলির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সশস্ত্র যুদ্ধটি সংঘটিত হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের প্রতিরোধে। এভাবে মুসলিম প্রজাদের রাজস্বের অর্থ ব্যয় হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে। এভাবে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্রগুলির জনগণও। স্বৈরাচারী শাসকদের দখলদারীর কারণে মুসলিম ভূমিতে আজ অসম্ভব হলো মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা। মুসলিম উম্মাহর মাঝে সংঘাতপূর্ণ বিভক্তির জনকও তারাই। প্যান-ইসলামিক একতার বদলে তারা গড়েছে ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিকতার নামে বিভক্তির দেয়াল। দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ বিলুপ্ত করে তারা যুদ্ধ শুরু করেছে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামের বিরুদ্ধে। এসব তথাকথিক মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামী রাষ্ট্র বা শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠার দাবী তোলাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেটিকে তারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বলে। সেটিকে অপরাধ দেখিয়ে নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করা, কারাবন্দী করা ও তাদের উপর দৈহিক নির্যাতন করা মুসলিম রাষ্ট্রের স্বৈর শাসকদের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও বৈচারিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।       

অথচ মাছের জন্য যেমন পানি, মুসলিমদের জন্য তেমনি হলো ইসলামী রাষ্ট্র। সহায়ক পরিবেশ না পেলে এমন কি উদ্ভিদও বাঁচে না; তেমনি বাঁচে না কোন ধর্ম বা আদর্শও। ইসলামের জন্য সে সহায়ক শক্তি জোগায় ইসলামী রাষ্ট্র। এজন্যই মদিনায় হিজরতের পর ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ শুরু করতে নবীজী (সা:) একটি দিনও বিলম্ব করেননি। এটিই নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত। এটিই হলো ইসলামের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রজেক্ট। মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে মালের কুরবানী থাকলেও তাতে জানের কুর’বানী দিতে হয় না, কিন্তু অর্ধেকের বেশী সাহবা শহীদ হয়ে গেছেন ইসলামী রাষ্ট্রের  নির্মাণে ও সে রাষ্ট্রের সুরক্ষায়। কারণ, এখানে রক্তাক্ত যুদ্ধটি সরাসরি শয়তানী শক্তির সাথে। হিংস পশু কবলিত জঙ্গলে বসবাস করা কখনোই সভ্য মানুষের কাজ নয়, সে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। তেমনি ভয়ানক বিপদ হলো কাফির অধিকৃত রাষ্ট্রে বসবাসের। বিপদ এখানে জাহান্নামের ট্রেনে যাত্রী হওয়ার। হিংস্র পশু কাউকে জাহান্নামে নেয় না, কিন্তু সে ভয়ানক কাজটি করে কাফিরদের শাসিত রাষ্ট্র। সেটি করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, মিডিয়া ও রাজনীতির মাধ্যমে সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে দূরে সরানোর মধ্য দিয়ে। এ ভয়াবহ বিপদ থেকে বাঁচাতেই ইসলামের বিধান হলো, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে সর্বশক্তির বিনিয়োগ করা। কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত হলে সত্বর সে রাষ্ট্রে হিজরত করা। কাফির অধিকৃত ভূমিতে বসবাসকারী মুসলিমদের উপর হিজরত তখন ফরজ হয়ে যায়। মদিনার বুকে তেমনি একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন মহান নবীজী (সা:) । পরবর্তীতে সে রাষ্ট্র বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয় এবং জন্ম দেয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার। এরূপ একটি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ফলে মুসলিমদের জান, মাল, ইজ্জতই শুধু সুরক্ষা পায়নি, সুরক্ষা পেয়েছে তাদের ইসলামী আক্বিদা-বিশ্বাসও।

এ পৃথিবী পৃষ্ঠে হযরত আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মহম্মদ (সা:) অবধি লক্ষাধিক নবী-রাসূল এসেছেন। তারা সবাই মহান আল্লাহতায়ালার ওহীর বাণীকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ করেছেন। কিন্তু নবীজী (সা:)’র সাফল্য এক্ষেত্রে অনন্য। ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠাকে তিনি ব্যক্তি পর্যায়ে সীমিত রাখেননি; নির্মাণ করেন শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। তখন রাষ্ট্র ও তার বিশাল প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ইসলামের হাতিয়ারে পরিণত হয়। ইসলামের বিধানগুলি তখন শুধু কিতাবে থাকেনি, রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষেত্রে তা প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছে। ফলে জনগণ পেয়েছে ইসলামী বিধানের পূর্ণ নেয়ামত। মুসলিমগণ যে মানব ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সভ্যতার জন্ম দিল -তার মূলে ছিল ইসলামী বিধান।  মুসলিমদের তখন উদ্ভব ঘটে সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তি রূপে। অথচ কোন ধর্মকে দূষিত করা, বিলুপ্ত করা এবং জনগণকে ধর্ম থেকে দূরে সরানোর সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারটি কোন মন্দির-মন্ডপ বা গীর্জা নয়; কোন ধর্মগুরুও নয়। সেটি  হলো রাষ্ট্র। কারণ রাষ্ট্রের হাতে থাকে জনগণকে প্রভাবিত করার সকল সামর্থ্য। এজন্যই শয়তানের চিরাচরিত স্ট্র্যাটিজি হলো, রাষ্ট্রকে ইসলামের বিরুদ্ধে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করা। পৌত্তলিক গ্রীক ও রোমানদের শাসনামলে রাষ্ট্রের সে ষড়যন্ত্র ও নাশকতা দেখা গেছে ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের বিরুদ্ধে। জালেম শাসকদের হাত থেকে তাওরাত ও ইঞ্জিলের বিশুদ্ধতা বাঁচেনি। এবং কোথাও প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়নি তাওরাতে প্রদত্ত শরিয়তী আইন।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                      

পবিত্র কুর’আনের বিশুদ্ধতা রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে নবীজী (সা:)’ ১০ বছরের শাসন এবং খোলাফায়ের রাশেদার ২৯ বছরের শাসন। এই ৩৯ বছরের শাসনে পবিত্র কুর‌’আন যেমন বিশুদ্ধ ভাবে সংরক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়, তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ারও সুযোগ পায়। ফলে মুসলিমগণ পায় রাষ্ট্র নির্মাণের ও রাষ্ট্র পরিচালনার অনুকরণীয় সূন্নত। রাষ্ট্রের বুকে সেরূপ প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়নি তাওরাত ও ইঞ্জিল। হযরত মূসা (আ:) ও হযরত ঈসা (আ:) ও তাঁর অনুসারীদের বসবাস করতে হয়েছে গ্রীক ও রোমানদের ন্যায় পৌত্তলিক শাসিত ভূমিতে। ফলে ইহুদী ও খৃষ্টানগণ বঞ্চিত হয়েছে রাষ্ট্র নির্মাণের অনুকরণীয় সূন্নত থেকে। এক্ষেত্রে নবীজী (সা:)’র সাফল্যটি বিশাল ও অতুলনীয়। আর কোন নবী বা রাসূল মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আইনকে এতটা ব্যাপক ভাবে ও বিশুদ্ধ ভাবে পৃথিবী পৃষ্ঠে প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি। এটিই নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। নবীজী (সা:)’র অন্য সকল অর্জনকে হিসাবে না এনেও শুধু ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের ন্যায় এই বিশাল সাফল্যের কারণে নবীজী (সা:) অন্য সকল নবী-রাসূলদের থেকে শ্রেষ্ঠতর। শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোকে কাজে লাগানোর ফলে তিনি যেরূপ বিপুল সংখ্যক মানুষকে জাহান্নামে আগুন থেকে রক্ষা করে জান্নাতে নিয়েছেন সেটিও অন্য কোন নবী-রাসূলের হাতে ঘটেনি। এজন্যই তিনি সায়েদুল মুরসালীন অর্থাৎ সকল নবী-রাসূলদের সর্দার।

 

আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা  ও ইসলামী রাষ্ট্র

ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ -সেটি বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হয় মানব জাতিকে নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে। নিজেদের মুসলিম রূপো দাবী করা সত্ত্বেও যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবে না এবং তেমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদে নামে না -বুঝতে হবে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বুঝতে। তারা ব্যর্থ হয়েছে নবীজী (সা:) যে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন সে ইসলামকে বুঝতে। ইসলাম নিয়ে তাদের ধারণাটি নিতান্তই অজ্ঞতা-প্রসূত। এরূপ অজ্ঞতা ও ব্যর্থতার কারণে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলাম মুসলিম বিশ্বের কোথাও বেঁচে নাই। ফলে বেঁচে নাই মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন; এবং বেঁচে নাই অসত্য ও অবিচারের নির্মূলে ও সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠায় জিহাদ। বেঁচে নাই প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্ব। তারা বসবাস করছে কুর’আনী বর্ণিত ইসলাম ছাড়াই। এখানে ব্যর্থতা মুসলিমদের মুসলিম হওয়ায়।

প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা কি? এ বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট ঘোষণা এসেছে সুরা সাফের ৯ নম্বর, সুরা তাওবার ৩৩ নম্বর এবং সুরা আল-ফাতাহ‌’র ২৮ নম্বর আয়াতে। লক্ষণীয় হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে উপরিউক্ত তিনটি সুরা’র ভাষা একই রকমের। সুরা সাফ‌’য়ের ৯ নম্বর আয়াত থেকে উদাহরণ দেয়া যাক:

هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ

অর্থ: “তিনি হলেন সেই মহান আল্লাহ যিনি তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন পর্থনির্দেশনা ও সত্য দ্বীনসহ -যাতে তার দ্বীন বিজয়ী হয় সকল ধর্ম, সকল মিথ্যা ধ্যান-ধারণা ও সকল মতবাদের উপর। যদিও তা মুশরিকদের কাছে অপছন্দনীয়।” –(সুরা সাফ, আয়াত ৯)। তাঁর দ্বীনের বিজয়ের অর্থ হলো, দেশের শাসনতন্ত্রে ও শাসন প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠা পাবে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব। আদালতে প্রতিষ্ঠা পাবে তাঁর শরিয়তী আইন।  রাষ্ট্র থেকে বিলুপ্ত হবে ইসলাম বিরোধী শক্তির শাসন, বিলুপ্ত করা হবে সর্বপ্রকার জুলুম, দুর্বৃত্তি ও অবিচার এবং প্রতিষ্ঠা পাবে ন্যায়, সত্য এবং সুবিচার। ইসলামকে এরূপ বিজয়ী করার এ কাজটি মসজিদের সংখ্যা বাড়ালে হয় না; নামাজী-রোজাদার-হাজীর সংখ্যা বাড়ালেও হয় না। স্রেফ দোয়া-দরুদের মধ্য দিয়েও এ কাজটি হয়না। সেজন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে হয়। ইসলামী রাষ্ট্রই হলো মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার মূল হাতিয়ার। নবীজী (সা:)কে তাই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে হয়েছে। তেমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন পড়ে শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে লাগাতর জিহাদের। সে জিহাদে বিনিয়োগ ঘটাতে হয় অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের। জিহাদের ময়দানে পরীক্ষিত হয় মু’মিনদের ঈমান ও আমলের। সে জিহাদই হলো এমন এক ব্যবসা -যা ঈমানদারকে জান্নাতে নেয়। সুরা সাফা’র ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে মুসলিম জীবনের সে পবিত্র ব্যবসার কথা বলা হয়েছে। অর্পিত দায়িত্বটি এখানে মহান আল্লাহতায়ালার সৈনিক হওয়ার। তাই মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু নামাজী, রোজাদার ও হাজী হওয়া নয়, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার সৈনিক হওয়াও। যে ব্যক্তি সৈনিক হতে ব্যর্থ হয়, সে ব্যর্থ হয় মুসলিম হতে। এবং ব্যর্থ হয় জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে নিজেকে বাঁচাতে। সে কথাগুলিই অতি স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে সুরা সাফ’য়ের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ تِجَـٰرَةٍۢ تُنجِيكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيمٍۢ ١٠

تُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَتُجَـٰهِدُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ بِأَمْوَٰلِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌۭ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ ١١

অর্থ: “হে মু’মিনগণ! আমি কি তোমাদের এমন বাণিজ্যের সন্ধান দিব -যা তোমাদের রক্ষা করবে বেদনাদায়ক আযাব থেকে? সে বাণিজ্যটি হলো, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনবে এবং তোমাদের নিজেদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর -যদি তোমরা জানতে।” –(সুরা সাফ, আয়াত ১০-১১)।      

যারা শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন তেলাওয়াত ও দোয়া-দরুদ পাঠের মধ্য জান্নাতের রাস্তা দেখেন তাদের জন্য উপরিউক্ত আয়াতে রয়েছে ভয়ানক দুঃসংবাদ। যারা জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি চায় ও জান্নাত চায় -তাদের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার প্রেসক্রিপশন হলো তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ এবং সে জিহাদে নিজ অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ। নবীজী (সা:)’র জামানায় এটিই ছিল মুসলিম জীবনের মূল মিশন। সে মিশন নিয়ে বাঁচতে গিয়ে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন।  সে যুগে ইসলামের লাগাতর বিজয় এসেছে এবং মুসলিমগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে তো সে পথেই। এ পথেই সমাজ থেকে নির্মূল হয়েছে দুর্বৃত্তি এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সুবিচার ও সুনীতি। এরূপ দুর্নীতির নির্মূল ও সুনীতির প্রতিষ্ঠা নিয়ে বাঁচার মিশনই মুসলিমদের মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদা দিয়েছে। সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা আল-ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:     

كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِٱلْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ ٱلْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ ۗ

অর্থ: “তোমরাই হলে শেষ্ঠ উম্মত; তোমাদের আবির্ভাব ঘটনা হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং নির্মূল করবে অসৎ কাজকে। এবং ঈমান আনবে আল্লাহর উপর।” –(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১১০)।

সুরা আল-ইমরানের উপরিউক্ত আয়াতে সুস্পষ্ট করা হয়েছে, কেন আবির্ভাব ঘটনা হয়েছে মুসলিম উম্মাহর। সেটি হলো, সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা এবং অসত্য ও দুর্বৃত্তির নির্মূল। মহান আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন এবং নানা রূপ নিয়ামতে সাঁজিয়েছেন এর প্রতিটি অঙ্গণকে। তবে এ পৃথিবীকে মিথ্যা ধর্ম, অসত্য মতবাদ ও জালেমের নাশকতা দেখে বাঁচানো এবং শান্তি, সুবিচার ও নিরাপত্তার নীড় রূপে গড়ে তোলার দায়িত্বটি মুসলিমদের। একাজের জন্য প্রতি মুসলিম হলো মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা। সেটিই হলো মুসলিম জীবনের মূল ব্যবসা বা মিশন -যার বর্ণনা এসেছে সুরা সাফ’য়ের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে। যারা সে খলিফার দায়িত্ব পালনে সফল হয় তারা পায় জান্নাত। যারা ব্যর্থ হয় তারা পায় জাহান্নাম।  আর সে মিশনকে সফল করার জন্য কাজটি শুধু দ্বীনের তাবলিগ ও নামাজ-রোজা পালন করলে চলে না, শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করলেও হয় না; সে কাজের জন্য অনিবার্য হাতিয়ারটি হলো ইসলামী রাষ্ট্র। তাই যারা শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত এবং মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা নিয়ে খুশি, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নাই -বুঝতে হবে তারা ইসলামের মূল মিশন বুঝতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তারা ব্যর্থ হয়েছে নবীজী (সা:)‌’র জীবন থেকে শিক্ষা নিতে। মুসলিম জীবনের সে মিশনের ঘোষণাটি এসেছে সুরা মায়েদার ৮ নম্বর আয়াতেও। বলা হয়েছে:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ كُونُوا۟ قَوَّٰمِينَ لِلَّهِ شُهَدَآءَ بِٱلْقِسْطِ ۖ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَـَٔانُ قَوْمٍ عَلَىٰٓ أَلَّا تَعْدِلُوا۟ ۚ ٱعْدِلُوا۟ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ ۖ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ خبِيرٌۢ بِمَا تَعْمَلُونَ

অর্থ: “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর জন্য খাড়া হয়ে যাও, সাক্ষ্যদাতা হও সুবিচারের পক্ষে। কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত থেকে বিরত না করে; সুবিচার করবে -সেটিই তাকওয়ার নিকটবর্তী। এবং আল্লাহকে ভয় করবে -তোমরা যা কিছু করো সে বিষয়ে আল্লাহ খবর রাখেন।” একই রকম হুকুম এসেছে সুরা সাবার ৪৬ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

  قُلْ إِنَّمَآ أَعِظُكُم بِوَٰحِدَةٍ ۖ أَن تَقُومُوا۟ لِلَّهِ مَثْنَىٰ وَفُرَٰدَىٰ ثُمَّ تَتَفَكَّرُوا۟ ۚ مَا بِصَاحِبِكُم مِّن جِنَّةٍ ۚ إِنْ هُوَ إِلَّا نَذِيرٌۭ لَّكُم بَيْنَ يَدَىْ عَذَابٍۢ شَدِيدٍۢ

অর্থ: “বল হে মহম্মদ!, “তোমাদের প্রতি আমার একটিই ওয়াজ, তা হলো তোমরা আল্লাহর জন্য (তথা আল্লাহর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে) খাড়া হয়ে যাও -দুই জন -দুই জন করে অথবা একাই।  অতঃপর চিন্তা করে দেখ! তোমাদের সঙ্গী (রাসূল) আদৌ কোন উম্মাদ নন। তিনি তো আসন্ন কঠিন আযাবের ব্যাপারে সতর্ক করছেন মাত্র।” তাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম হলো, যারা  জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচতে চায় তাদের উপর ফরজ হলো তারা খাড়া হয়ে যাবে তাঁর খলিফারূপে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জিহাদে। কিন্তু আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ বাদ দিয়ে যারা রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, দলীয় শাসন, ফ্যাসিবাদ, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ বা অন্য কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে -তারা কি জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা পাবে? উপরিউক্ত দুটি আয়াত অনুসারে মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে খাড়া হওয়া। সেটি শুধু জায়নামাজে নয়, বরং সেটি রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধের ময়দানেও। এবং মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে খাড়া হওয়ার অর্থ: তাঁর এজেন্ডার পক্ষে খাড়া হওয়া। অর্থাৎ তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হওয়া। সেটি একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সম্ভব। এবং যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র নাই, বুঝতে হবে সেখানে প্রতিষ্ঠা পায়নি মহান আল্লাহয়ালার এজেন্ডা এবং তাঁর সার্বভৌমত্ব ও আইন। এখানে ব্যর্থতাটি মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে খাড়া হওয়ায়। এরূপ ব্যর্থতা নিয়ে কি জান্নাত আশা করা যায়?    

 

 

যুদ্ধ যেখানে আল্লাহতায়ালা ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে

মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে বাঁচা। এভাবেই তো বেঁচেছিলেন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। ইসলামের সে মৌল কথাটি বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুর’আনের ছত্রে ছত্রে। তাই এমন একজন সাহাবীও পাওয়া যাবে না যার জীবনে জিহাদ ছিল না। অথচ সেরূপ জিহাদ আজ ক’জন মুসলিমের জীবনে? সে জিহাদ না থাকায় মুসলিম দেশগুলিতেও ইসলাম আজ পরাজিত। বিজয় এখানে রাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, সেক্যুলারিজম, পুঁজিবাদ ও দলীয় ফ্যাসিবাদের। নবীজী (সা:)’র জামানায় যাদের জীবনে জিহাদ ছিল না -তাদেরকে মুনাফিক বলা হয়েছে। জিহাদে না থাকলে যে মুসলিম বলা যায় না -তা নিয়ে সুস্পষ্ট বয়ান এসেছে সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। মু’মিনের জীবনে সে জিহাদ তো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ। স্রেফ মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, মারকায নির্মাণ করে কি মহান মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা সম্ভব? সে জন্য অবশ্যই ইসলামী রাষ্ট্র চাই।

রাষ্ট্রের সরকার, প্রশাসন, আদালত, পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে ইসলাম বিরোধীদের হাতে ন্যস্ত রেখে কি মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা দেয়া সম্ভব? রাষ্ট্র তখন অধিকৃত হয় ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে। তখন সে অধিকৃত রাষ্ট্রে চলে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অর্থ: তাঁর এজেন্ডা, তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। শুধু তাই নয়, কোন অনৈসলামিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও সেটিকে বাঁচিয়ে রাখার যে কোন প্রচেষ্টাই হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সে যুদ্ধটি অতি প্রবল এবং লাগাতর। দেশগুলির স্বৈরাচারী শাসক, সেক্যুলার সংবিধান, অপরাধী প্রশাসন, সেক্যুলার আদালত এবং গুম-খুন-দুর্বৃত্তির প্লাবন হলো মহান আল্লাহতায়ার বিরুদ্ধে তেমন একটি চলমান যুদ্ধের দলিল। অতি পরিতাপের বিষয় হলো, এসব মুসলিম দেশের মুসলিম প্রজাগণ বাঁচছে দখলদার শত্রুশক্তির প্রতি আত্মসমর্পণ নিয়ে। অথচ মুসলিম তো বাঁচবে শত্রু শক্তির দখলদারীর বিরুদ্ধে জিহাদ নিয়ে। শত্রুপক্ষের প্রতি এরূপ আত্মসমর্পণের অর্থই হলো ইসলামের সাথে গাদ্দারি।

রাসূলে পাক (সা:)’য়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অর্থ: তাঁর সূন্নত নির্মূলের যুদ্ধ। নবীজী(সা:)’য়ের সবচেয়ে বড় সূন্নতটি হলো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা -যে রাষ্ট্রের তিনি ১০টি বছর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। ফলে আজ যারা সেরূপ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধী তাদের যুদ্ধটি মূলত মহান নবীজী(সা:)’র সূন্নতের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধটি আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধেও। কারণ, যারা নবীজী(সা:)’র অনুসারী তারাই অনুসারী হলো মহান আল্লাহতায়ালার। সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা নিসার ৮০ নম্বর আয়াতে। এর অর্থ দাঁড়ায়, যাদের যুদ্ধ রাসূলের বিরুদ্ধে, তাদের যুদ্ধ মহান আল্লাহতায়ালারও বিরুদ্ধেও। এমন একটি যুদ্ধের সাথে জড়িত বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্যুলার, জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মী। তাদের অপরাধটি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে পরাজিত করার এবং শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করার। এরাই রাষ্ট্রের বুকে এনেছে জুলুম ও নানারূপ দুর্বৃত্তির জোয়ার। চলমান শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশকে এরা দুর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম স্থানে পৌঁছে দিয়েছে।  এটি গুরুতর অপরাধ। এবং সে অপরাধের শাস্তিও গুরুতর। মহান আল্লাহতায়ালা সে শাস্তির কথা ব্যক্ত করেছেন সুরা মায়েদার ৩৩ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

إِنَّمَا جَزَٰٓؤُا۟ ٱلَّذِينَ يُحَارِبُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَسْعَوْنَ فِى ٱلْأَرْضِ فَسَادًا أَن يُقَتَّلُوٓا۟ أَوْ يُصَلَّبُوٓا۟ أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم مِّنْ خِلَـٰفٍ أَوْ يُنفَوْا۟ مِنَ ٱلْأَرْضِ ۚ ذَٰلِكَ لَهُمْ خِزْىٌۭ فِى ٱلدُّنْيَا ۖ وَلَهُمْ فِى ٱلْـَٔاخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ ٣٣

অর্থ: “যারা যুদ্ধ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে এবং প্রচেষ্টা চালায় পৃথিবী পৃষ্ঠে ফ্যাসাদ তথা দুর্বৃত্তির প্রতিষ্ঠায়, তাদের জন্য  শাস্তি হলো: তাদেরকে হত্যা করা হবে, অথবা শূলে চড়ানো হবে, অথবা তাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে; অথবা দেশ থেকে তাদেরকে নির্বাসিত করা হবে। এটিই হলো তাদের জন্য এ দুনিয়ার জীবনের লাঞ্ছনা জনক শাস্তি; এবং আখেরাতে তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মহাশাস্তি।”

পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে বড় নাশকতাটি হলো মানব হত্যা। এবং সবচেয়ে বড় কল্যাণকর্মটি হলো কোন মানব সন্তানের প্রাণ বাঁচানো। একজন  নিরপরাধ মানুষের হত্যাকে সুরার মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াতে গোটা মানবের হত্যা রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। এবং মানুষের প্রাণ বাঁচানোকে গোটা মানবের প্রাণ বাঁচানো বলা হয়েছে। সুরা মায়েদায় সে ঘোষণাটি হলো:

مِنْ أَجْلِ ذَٰلِكَ كَتَبْنَا عَلَىٰ بَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ أَنَّهُۥ مَن قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍۢ فِى ٱلْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ ٱلنَّاسَ جَمِيعًۭا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَآ أَحْيَا ٱلنَّاسَ جَمِيعًۭا ۚ وَلَقَدْ جَآءَتْهُمْ رُسُلُنَا بِٱلْبَيِّنَـٰتِ ثُمَّ إِنَّ كَثِيرًۭا مِّنْهُم بَعْدَ ذَٰلِكَ فِى ٱلْأَرْضِ لَمُسْرِفُونَ

অর্থ: “ঐ ঘটনার কারণে আমি বনি ইসরাইলীদের উপর বিধান জারি করলাম, কোন মানুষকে হত্যা কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করার শাস্তি প্রদানের কারণ ছাড়া কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে জন্য গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করলো; আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন গোটা মানব জাতিকেই বাঁচিয়ে দিল। এদের কাছে আমার রাসূলগণ সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারপরও এদের অনেক লোক জমিনের বুকে সীমালংঘনকারী রূপেই থেকে গেল।” অথচ একজন বা দুইজন নয়, বিশাল বিশাল গণহত্যার কান্ড ঘটে রাষ্ট্র যখন দুর্বৃত্তদের দখলে যায়। হাজার হাজার মানুষকে তখন নানারূপ নির্যাতনের শিকারও হতে হয়। তাই অতি বড় মাপের পাপকর্ম হলো কোন খুনি দুর্বৃত্তকে ক্ষমতায় বসানো এবং রাজস্ব দিয়ে ও ভোট দিয়ে সে জালেমকে সুরক্ষা দেয়া ও তার শাসনের আয়ু বাড়ানো। অপর দিকে সবচেয়ে বড় কল্যাণকর কাজ হলো কোন খুনি শাসকের হাত থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করা। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে তো সে কাজটিই হয়। তাই পৃথিবী পৃষ্ঠে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম।

 

কেন নাই ইসলামী রাষ্ট্র?

পবিত্র কুর’আন যে ইসলাম পেশ করে এবং মহান নবীজী (সা:) যে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছেন, সে ইসলাম আজ কোথাও বেঁচে নাই। এর কারণ, কোথাও বেঁচে নাই ইসলামী রাষ্ট্র। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ছাড়া সে বিশুদ্ধ ইসলামকে কখনোই বাঁচিয়ে রাখা যায় না। নবীজী (সা:)’র সে ইসলামকে পূর্ণ ভাবে পালন করাও যায়না। কারণ, পূর্ণ ইসলাম পালনের জন্য তো চাই মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, চাই শরিয়ত পালন, চাই দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ এবং সর্বোপরি চাই মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বিজয়।  ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছাড়া কি এগুলি অর্জন করা সম্ভব? তাই যারা মনে করে ইসলামী রাষ্ট্রোর প্রতিষ্ঠা ছাড়াও ইসলাম  পূর্ণ ভাবে পালন করা সম্ভব – বুঝতে হবে নবীজী (সা:)’র ইসলাম নিয়ে তারা গভীর ভাবে অজ্ঞ। বুঝতে হবে, তারা পবিত্র কুর’আন বুঝে পড়েনি এবং নবীজী (সা:)’র জীবনী থেকেও শিক্ষা নেয়নি।  এরাই হলো সে সব অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত ব্যক্তি -যারা মনে করে ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত জীবনে পালনের বিষয়। নিজ গৃহে বা মসজিদের জায়নামাজের পালন করলেই চলে। তারা ভাবে, ইসলাম বলতে বুঝায় স্রেফ নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন পাঠ ও তাসবিহ-তাহলিল। পরিতাপের বিষয় হলো, সে ভ্রান্ত ধারণাটি শুধু সেক্যুলারিস্ট শাসকদের নয়, বেঁচে আছে বহু আলেমের মধ্যেও। বিশেষ করে সুফি তারিকা, তাবলিগ জামায়াত ও দেওবন্দী ফেরকার আলেমদের মাঝে। এমন একটি ধারণার কারণেই নিজগৃহের বাইরে রাজনীতি, আদালত, প্রশাসন, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষাব্যবস্থায় ও সেনাবাহিনীতে ইসলামকে তথা পবিত্র কুর’আনের বিধানকে তারা স্থান দিতে রাজী নয়। ইসলামের শত্রুগণ জানে, রাজনীতি, আদালত ও প্রশাসনে ইসলামকে স্থান দেয়ার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর এজেন্ডাকে স্থান দেয়া। সেটি হলে তাদের নিজেদের সার্বভৌমত্ব, স্বৈরাচার ও অধিকৃতি বাঁচে না। এজন্যই তারা ইসলামবিরোধী।  

পরিতাপের বিষয় হলো, অধিকাংশ মুসলিম দেশ আজ স্বৈরাচারী শাসকদের হাতেই অধিকৃত। তাদের যুদ্ধ তাই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের বিরুদ্ধে। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের যে কোন জিহাদকে এরা সন্ত্রাস বলে। সেটিকে জঙ্গিবাদও বলে। অথচ নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সশস্ত্র জিহাদ ছিল; রণাঙ্গণে তারা শত্রুদের হত্যা করেছেন। নিজেরাও শহীদ হয়েছেন। তবে কি তাদের সে সশস্ত্র জিহাদ সন্ত্রাস ছিল? নবীজী (সা:) ও তার সাহাবাগণ কি সন্ত্রাসী ছিলেন? ইসলামের এ চিহ্নিত শত্রুগণ জেনে শুনেই ইসলামের পবিত্র জিহাদকে সন্ত্রাস বলে। অথচ নিজেদের সেক্যুলার যুদ্ধকে এরা সন্ত্রাস বলেনা। অথচ সন্ত্রাসের আভিধানিক অর্থ হলো, যে কোন রাজনৈতিক স্বার্থে অস্ত্রের ব্যবহারই হলো সন্ত্রাস। সে বিচারে প্রতিটি স্বৈরাচারী শাসকই শতকরা শতভাগ সন্ত্রাসী। তাদের প্রতিটি যুদ্ধই হলো গুরুতর যুদ্ধাপরাধ। এবং তাদের প্রতিটি যুদ্ধই হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। শরিয়তের আইন তাদেরকে প্রাণদন্ড দেয় -যা ঘোষিত হয়েছে উপরিউক্ত সুরা মায়েদা ৩৩ নম্বর আয়াতে। এ চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ইসলামের পবিত্র জিহাদকে যে নামেই অভিহিত করুক না কেন, জিহাদ জিহাদই। কোনটি পবিত্র জিহাদ এবং কোনটি যুদ্ধাপরাধ ও সন্ত্রাস -মুসলিমকে সে রায় নিতে হয় পবিত্র কুর’আন থেকে, ইসলামের কোন চিহ্নিত শত্রু থেকে নয়। জিহাদই হলো ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। জিহাদে না থাকার অর্থ বিনা যুদ্ধে শয়তান ও তার অনুসারীদের ঘরে বিজয় তুলে দেয়া। সেটি কি কোন ঈমানদার মেনে নেয়? অথচ বাংলাদেশের ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম দেশে সেটিই রীতিতে পরিণত হয়েছে।

ইসলামের নির্দেশিত সকল ইবাদতের মাঝে একমাত্র জামাতবদ্ধ নামাজ পালনের কাজটি হয় মসজিদের মেঝেতে বা ঘরের জায়নামাজে। মহান আল্লাহতায়ালার অন্য সবগুলি হুকুম যেমন শাসনতন্ত্রে তাঁর সার্বভৌমত্ব, আদালতে শরিয়তী আইনের বিচার,  নানা ভাষা ও নানা অঞ্চলের মুসলিমদের মাঝে প্যান-ইসলামিক ভাতৃত্ব, দুর্বৃত্তি ও অবিচারের নির্মূল, ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কুর’আন শিক্ষা, মুসলিম উম্মাহর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ প্রকল্প – ইসলামের এরূপ সবগুলি প্রকল্প পালিত হয় মসজিদের বাইরে এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গণে। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এ হুকুমগুলি রাষ্ট্রজুড়ে পালিত না হলে কি কখনো পূর্ণ ইসলাম-পালন হয়? বিজয়ী হয় কি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা? তখন তো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কান্ড ঘটে -যা ব্যক্তিকে কাফিরে পরিণত করে। তাই যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র নাই, বুঝতে হবে সেদেশে পূর্ণ ইসলাম পালনের কাজটিও হয়না। অর্থাৎ সেখানে পালিত হয়না নবীজী (সা:)’র ইসলাম। এর অর্থ দাঁড়ায়, যে ভূমিতে ইসলামী রাষ্ট্র নাই, সে ভূমিতে পূর্ণাঙ্গ মুসলিমও নাই। মুসলিম উম্মাহকে সেরূপ একটি বিপদজনক অবস্থা থেকে বাঁচাতে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের বহু অর্থ, বহু শ্রম ও বহু রক্তের বিনিময়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে হয়েছে। অথচ আজ সেটিই উপেক্ষিত। ফলে মুসলিমগণ বাঁচছে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম ছাড়াই। মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার মূল কারণ তো এখানেই।

প্রশ্ন হলো, নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের ধর্মকর্ম কি শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন তেলাওয়াত, দোয়া-দরুদ ও তাসবিহ পাঠ নিয়ে ছিল? সেরূপ হলে সে কালে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, কাফির শক্তির নির্মূলের জিহাদ, আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজগুলি কে করলো? এবং তারা কেন করলো? প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তি দেশের আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নিল না, ভাষা-বর্ণ-গোত্র ও আঞ্চলিকতা-ভিত্তিক পরিচয়ের উর্দ্ধে ঊঠে নিজকে প্যান-ইসলামিক চেতনায় সমৃদ্ধ করলো না, দুর্বৃত্তদের নির্মূলের কাজে অংশ নিল না, সুবিচারকে প্রতিষ্ঠা দিল না, মুসলিম উম্মাহর জান-মালের সুরক্ষায় জিহাদ করলো না, এবং দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের দুর্দশা দূর করায় কোন উদ্যোগই নিল না  -সে ব্যক্তি  মুসলিম হয় কি করে? নবীজী (সা:)’র সূন্নতের অনুসারীই বা হয় কি করে?  ঈমানদারই বা হয় কি করে? প্রকৃত মুসলিম তো একমাত্র সেই যে ইসলামের এ বিধানগুলিকে নিজ জীবনে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠার জিহাদ নিয়ে বাঁচে। যার জীবনে সে জিহাদ নাই -বুঝতে হবে সে ঈমানদার নয়। ঈমানের দাবীতে সে ব্যক্তি সত্যবাদীও নয়। ঈমানের দাবী তো সূদখোর, ঘুষখোর, জালেম স্বৈরাচারী, খুনি, ব্যাভিচারী, সন্ত্রাসীও করতে পারে। কিন্তু ঈমানের দাবীতে কারা সত্যবাদী -সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণাটি এসেছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। সেটি সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا۟ وَجَـٰهَدُوا۟ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّـٰدِقُونَ

অর্থ: “মু’মিন একমাত্র তারাই যারা ঈমান আনলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর, অতঃপর তার উপর আর কোনরূপ সন্দেহ পোষণ করলো না। এবং নিজেদের সম্পদ ও জান দিয়ে জিহাদ করলো আল্লাহর রাস্তায়। ঈমানের দাবীতে এই লোকগুলোই হলো সত্যবাদী।” –(সুরা হুজরাত, আয়াত ১৫)। এটিই হলো, মহান আল্লাহতায়ালার নিজের পক্ষ থেকে দেয়া প্রকৃত ঈমানদারের সংজ্ঞা বা পরিচয়। যারা ঈমানদার হতে চায় তাদের উচিত উপরিউক্ত আয়াতের সাথে নিজের জীবনকে মিলিয়ে দেখা। এবং খতিয়ে দেখা উচিত আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদে তাঁর অর্থ, সময়, মেধা ও রক্তের কুরবানী আছে কিনা। উপরিউক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে এজন্যই নিশ্চিত বলা যায়, যার জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদে নিজে সম্পদ, সময়, মেধা ও রক্তের কুর’বানী নাই সে নামাজী, রোজাদার, হাজী, পীর, মৌলভী, মুফতি, ইমাম, মোয়াজ্জেন ও মোহাদ্দেস হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত ঈমানদার নয়। এজন্যই নবীজী (সা:)’র এমন কোন সাহাবী ছিলেন না যার জীবনে জিহাদ ছিল না। জিহাদ থেকে যারা দূরে থেকেছে তাদেরকে মুনাফিক বলা হয়েছে।

জিহাদ তো তাদের জীবনেই অনিবার্য হয়ে উঠে যাদের জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তী আইন এবং তাঁর কুর’আনী হুকুমগুলিকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার প্রবল তাড়না থাকে। এবং তাড়না থাকে,এসব কাজের মধ্য দিয়ে মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের। এমন তাড়না থেকেই মু’মিন ব্যক্তির জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদ অনিবার্য হয়ে উঠে। তখন জিহাদে শহীদ হওয়াকে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন গণ্য হয়। কিন্তু যার মধ্য সে তাড়না নাই এবং ধর্মকর্ম বলতে বুঝে স্রেফ নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, দোয়া-দরুদ ও কুর’অআন পাঠ নিয়ে বাঁচা -তার জীবনে জিহাদ না থাকারই কথা। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব এরা বুঝে না। ফলে দেশ শত্রু শক্তির হাতে অধিকৃত হলেও তাদের মধ্যে জিহাদও সৃষ্টি হয় না। মুসলিম বিশ্বে এমন কপট মুসলিমের সংখ্যাই বেশী। তাদের কারণে বাংলাদেশের ন্যায় শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশেও নির্মিত হচ্ছে না ইসলামী রাষ্ট্র। এবং গড়ে উঠছে না ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদ। ফলে মুসলিম উম্মাহ ব্যর্থ হয়েছে এমন এক রাষ্ট্র পেতে যা তাদের জান, মাল, ইজ্জত ও স্বাধীনতার সুরক্ষা দিবে এবং সহায়ক পরিবেশ দিবে পরিপূর্ণ ইসলাম পালনের।  ১৩/৩/২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *