ইসলামী রাষ্ট্র এবং মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার বিষয়
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 19, 2024
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, মুসলিম জাহান
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
বিকল্প নাই ইসলামী রাষ্ট্রের
মুসলিম উম্মাহর জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের কোন বিকল্প নাই -যেমন বিকল্প নাই আলো-বাতাসের। ইসলামী রাষ্ট্র এবং সে রাষ্ট্রের মজবুত স্থিতি ও সামরিক শক্তি না থাকলে নিরাপত্তা পায় না মুসলিমদের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরু। তখন তাদের স্বাধীনতাও বাঁচে না; অধিকৃত হতে হয় শত্রুশক্তির হাতে। তখন সে মুসলিম ভূমিতে অসম্ভব হয় পূর্ণ ইসলাম পালন এবং পূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর যে এজেন্ডার কথা ঘোষণা দিয়েছেন এবং যে শরিয়তী আইন নাযিল করেছেন -সেগুলি তখন শুধু কুর’আনেই থেকে যায়। তাই মুসলিমদের শুধু ঘর গড়লে চলে না, রাষ্ট্রও গড়তে হয়। সেরূপ একটি রাষ্ট্র নির্মাণে ব্যর্থ হলে লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে এবং সম্পদে ও জনবলে বহুগুণ বৃদ্ধি ঘটিয়েও কোন লাভ হয়না। তখন শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃতি, গণহত্যা, গণধর্ষণ, ধ্বংস এবং গোলামী নিয়ে বাঁচতে হয়। সে করুণ চিত্রটি আজ প্রকট ভাবে দেখা যায় গাজা, জর্দান নদীর পশ্চিম তীর, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, কাশ্মীর, আরাকান, উইঘুরের ন্যায় মুসলিম ভূমিতে। নারী-পুরুষসহ হাজার হাজার শিশুকে সেখানে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। পঙ্গু হচ্ছে বহু হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। বিধ্বস্ত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ী ও দোকানপাট। বহু লক্ষ মানুষ হচ্ছে গৃহহীন উদ্বাস্তু। পিতা-মাতা হারিয়ে হাজার হাজার শিশু আজ অসহায় এতিম। এসবই হলো শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ না করার খেসারত।
শক্তিশালী গৃহ নির্মাণ না করে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, শীত-তাপ, হিংস্র পশু ও চোর-ডাকাত থেকে নিরাপত্তা মেলে না। তাই যাদের প্রাণে বাঁচার তাড়না থাকে তারা মজবুত গৃহ নির্মাণ করে। তাই কে কতটা সভ্য, ভদ্র ও আত্মমর্যাদার অধিকারী -সেটি বুঝা যায় তাঁর গৃহের দেয়ালের দিকে তাকালে। তেমনি একটি জাতি কতটা স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে চায় -সেটি বুঝা যায়ে জনগণের জিহাদের প্রস্তুতি দেখে। অন্য ধর্মে রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি রাজা-বাদশাহ ও শাসক শক্তির রাজনীতি; কিন্তু ইসলামে এটি পবিত্র জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। অর্ধেকের বেশী সাহাবা এ ইবাদতে শহীদ হয়ে গেছেন। তাদের এ বিশাল কুর’বানীর ফলে তারা শুধু নিরাপত্তাই পাননি, ইজ্জতও পেয়েছেন। অথচ এ ইবাদতটি না হলে শুধু ঈমান বাঁচানো নয়, প্রাণে বাঁচাও কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্যই ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ও সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জিহাদে অংশ নেয়া প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ। যে মুসলিম দেশে এ ফরজ পালিত হয়না সে দেশের মুসলিমদের বাঁচতে হয় বিদেশ শক্তির পদানত গোলাম হয়ে। তারই প্রমাণ, বাঙালি মুসলিমগণ ১৯০ বছর গোলামী করেছে ব্রিটিশদের। এবং এখন গোলামী করছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের।
মুসলিমদের সংখ্যা আজ প্রায় ১৫০ কোটি। মসজিদের সংখ্যা বহু লক্ষ। রাষ্ট্রের সংখ্যা ৫০্রটির অধিক। দ্বীনি মাদ্রাসা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বহু লক্ষ, কিন্তু তাতে নিরাপত্তা পাচ্ছে কি মুসলিমদের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরু? সুরক্ষিত হচ্ছে কি স্বাধীনতা? অতীতে সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিম উম্মাহর যেরূপ উত্থান ঘটে -সেটি স্রেফ নামাজ-রোজা ও হ্জ্জ-যাকাতের কারণে ঘটেনি। সে বিজয় ও গৌরব শত শত মসজিদ নির্মাণের কারণেও অর্জিত হয়নি। বরং সেটি সম্ভব হয়েছে নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণে। এটিই ছিল মুসলিমদের সবচেয়ে ব্যয়বহুল খাত। অথচ এ খাতে মুসলিমদের আজকের বিনিয়োগ অতি সামান্যই। ফলে ১৫০ কোটি মুসলিম ব্যর্থ হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে।
ইসলামী রাষ্ট্রের গুরুত্ব বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হয় রাষ্ট্রের শক্তি ও গুরুত্বকে। পৃথিবীপৃষ্ঠে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হলো রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রটি ইসলামের শত্রু শক্তির দখলে গেলে ভয়াবহ বিপদ বাড়ে মুসলিমদের। তখন শুধু মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা ও তাঁর শরিয়তী বিধানই বিলুপ্ত হয়না, নিরাপত্তা হারায় মুসলিমদের জান, মাল ও ইজ্জত-আবরু। অথচ রাষ্ট্রটি ইসলামী হলে এবং সে রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে বৃদ্ধি ঘটলে মুসলিম উম্মাহর শক্তি, নিরাপত্তা ও ইজ্জত সুরক্ষা পায়। তাই নবীজীী (সা:) তাঁর নবুয়তী জীবনের প্রথম ১৩ বছরে কোন মসজিদ বা মাদ্রাসা গড়েননি, কিন্তু মদিনায় হিজরতের সাথে সাথে একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেন। এবং সে রাষ্ট্রের ভূগোল বাড়াতে জিহাদের পর জিহাদ শুরু করেন। তাই নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূন্নত হলো ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ করা এবং সে রাষ্ট্রের ভূগোলে লাগাতর বৃদ্ধি আনা। এতে বাড়ে মুসলিমদের ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি। তখন বিশ্বের দরবারে মুসলিমদের ইজ্জত, গুরুত্ব এবং গ্রহনযোগ্যতাও বাড়ে। সেরূপ একটি শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র না থাকায় সাড়ে ৬ কোটি ব্রিটিশের বিশ্বের মঞ্চে ও জাতিসংঘে যে গুরুত্ব আছে -তা ১৫০ কোটি মুসলিমের নাই। মহান নবীজী (সা:) এ বিষয়টি ষোল আনা বুঝতেন, তাই তিনি পবিত্র কুর’আনের বাণী ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্র নির্মাণেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। এটি ছিল নবীজী (সা:)’র প্রজ্ঞাময় রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। ১০টি বছর যাবত তিনি সে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এবং ইন্তেকালের পূর্বে সাহাবাদের রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটান্টিনোপল দখলে নেয়ার জন্য নসিহত করে যান। সাহাবাগণ নবীজী (সা:)’র সে সূন্নতকে অব্যাহত রাখেন এবং তাঁর সে গুরুত্বপূর্ণ নসিহতকে বাস্তবে রূপ দেন তুর্কী মুজাহিদ সুলতান মুহম্মদ ফাতেহ। কন্সটান্টিনোপল দখলে নেয়ার পর শহরটির নাম রাখা হয় ইস্তাম্বুল। পরে সেটি বহুশত বছরের জন্য উসমানিয়া খেলাফতের রাজধানীতে পরিণত হয়।
অপর দিকে কোন মুসলিম দেশকে ভাঙ্গা বা ক্ষুদ্রতর করার পরিণতিটি ভয়াবহ। সে খণ্ডিত মুসলিম ভূমি সহজেই শত্রু শক্তির হাতে অধিকৃত হয়। তখন অসম্ভব হয় সে অধিকৃত দেশে পূর্ণ ইসলাম-পালন। তখন বিলুপ্ত হয় সে অধিকৃত ভূমিতে স্বাধীনতা, মানবাধিকার, নিরাপত্তা ও শান্তি । তখন অসম্ভব হয় সে অধিকৃত ভূমিতে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা। তাই মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গার কাজটি কোন কালেই ঈমানদারদের কাজ ছিল না। সে হারাম কাজটি সংঘটিত হয়েছে ভিতরের ও বাইরের কাফির ও মুনাফিক শত্রুদের পক্ষ থেকে। তারা রাজনীতির ময়দানে নামে ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিকতার নামে। এরাই মুসলিম বিশ্বে ৫০টির বেশী রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। ১৯১৭ সালে আরব জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টগণ ইংরেজদের সহযোগিতা নিয়ে উসমানিয়া খেলাফা ভেঙ্গেছে এবং জন্ম দিয়েছে ২২টি আরব রাষ্ট্রসহ ইসরাইলের। এরই পরিণতি হলো, আরব ভূমিতে ইসরাইল হলো সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রুরাষ্ট্র এবং মুসলিমদের প্রথম কিবলা জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি এখন ইসরাইলীদের হাতে অধিকৃত।
অপর দিকে ইসলাম থেকে দূরে সরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টগণ ১৯৭১ সালে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গে। সে ভূগোল ভাঙ্গার পরিণতি হলো, দক্ষিণ এশিয়ার বুকে দাপট বেড়েছে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের। ফলে বাঙালি মুসলিমদের বাঁচতে হচ্ছে ভারতীয় রাডারের নিচে। এবং ভারতীয়দের স্বার্থ বাঁচাতে বাংলাদেশীদের মৌলিক মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানো হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে ভারতসেবী শেখ হাসিনার নৃশংস ফ্যাসিবাদের। সে ক্ষমতায় থাকছে ভোটডাকাতির মাধ্যমে। এদেশে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের এজেন্ডা পূরণ করতে গিয়ে ইসলামীপন্থী নেতাদের ফাঁসিতে চড়ানো হয় এবং মুসল্লীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানো হয় -যেমন ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হিফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ জমায়েতের উপর হয়েছে।
মুসলিম উম্মাহর পতনের শুরু তখন থেকেই যখন মুসলিমগণ নিজে দেশের ভূগোলে বৃদ্ধি না ঘটিয়ে সেটিকে খণ্ডিত করা শুরু করে। অথচ দেশের ভূগোলে যখন বৃদ্ধি আসে তখন শক্তিও বৃদ্ধি পায়। এজন্যই কোন মুসলিম দেশের ভৌগলিক সীমানাকে সুরক্ষিত করার ন্যায় ভূগোল বৃদ্ধির কাজটিও পবিত্র জিহাদ। সে পবিত্র জিহাদ মু’মিনদের জন্য শাহাদতের রাস্তা খুলে দেয়। অপর দিকে হারাম হলো মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গা। এটি কবিরা গুনাহ। এ গুনাহ বিজয় বাড়ায় শয়তানী শক্তির। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান বিপর্যয়ের কারণ, তারা ফরজ জিহাদকে বাদ দিয়ে কবিরা গুনাহর হারাম পথটি বেছে নিয়েছে।
ইসলামী রাষ্ট্রের নামকরণ ও শর্তাবলী
নবীজী (সা:) যে ইসলামের প্রচার করেছিলেন এবং যেরূপ রাষ্ট্রের তিনি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছিলেন -সে ইসলাম ও সেরূপ রাষ্ট আজ কোথাও বেঁচে নাই। কিন্তু সেরূপ একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কথা উঠলেই বিতর্ক শুরু হয় সে রাষ্ট্রের নাম নিয়ে। খেলাফত হবে, না ইসলামী রাষ্ট্র হবে, না ইসলামী ইমারাত হবে -তা নিয়ে নানা বিতর্ক। মানবকে বিচিত্র গুণাগুণ ও সামর্থ্য দিয়ে সৃষ্টি করেন মহান আল্লাহতায়ালা। কি হবে তাদের ধর্ম, কি হবে তাদের জীবনের এজেন্ডা ও মিশন, কিরূপ হবে তাদের পথচলার রোডম্যাপ -সেগুলি তিনি তাঁর নাযিলকৃত কিতাবে বিষদ ভাবে বলে দিয়েছেন। কিন্তু কি হবে তাদের নাম -সেটি তিনি বলে দেন নাই। সন্তানের নাম ঠিক করে সন্তানের পিতা-মাতা। ব্যতিত্রুম হলো হযরত ইয়াহিয়া (আ:) ও হযরত মরিয়ম; তাঁদের নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন মহান আল্লাহতায়ালা খোদ নিজে। মানবের মূল্যায়ন হয় তার কর্মের ভিত্তিতে, নামের ভিত্তিতে নয়। নামে আব্দুল্লাহ তথা আল্লাহর দাস হয়েও কাফির ও শয়তানের দাস হতে পারে। এমন আব্দুল্লাহগণ পরকালে জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। কখনোই সুন্দর নামের কারণে তারা মুক্তি পাবে না। অপর দিকে আবু বকর (অর্থ গরুর পিতা) নাম ধারণ করেও সমগ্র মানব ইতিহাসের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানব হতে পারেন। তেমনি খেলাফত নামধারী রাষ্ট্রও স্বৈরাচারী জালেম ফ্যাসিস্টের অধিকৃত এক অসভ্য একটি রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। এমন রাষ্ট্র হতে পারে জাহান্নামের বাহন।
ইসলামের বিধানকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার এজেন্ডা নিয়ে মুসলিমগণ যখন কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেয় -সে রাষ্ট্রের নাম কি হবে পবিত্র কুর’আনের কোথাও সেটির উল্লেখ নেই। খেলাফতে রাসূলুল্লাহ, খেলাফতে রাশেদা, রিয়াসতে মদিনা, রিয়াসতে ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র, ইমারাতে ইসলামী, ইসলামী প্রজাতন্ত্র, সুলতানাতে ইসলামী -এসব নামের উল্লেখ মুসলিম ইতিহাসে থাকলেও পবিত্র কুর’আনে নাই। এমনকি নবীজী (সা:) যে রাষ্ট্রের ১০টি বছর প্রধান ছিলেন সে রাষ্ট্রেরও কোন নাম তিনি নিজে রাখেননি। অথচ সে রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট ভূমি ছিল, সে ভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ছিল, কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক প্রশাসন ছিল, গভর্নর ছিল, বিচারব্যবস্থা ছিল, সমাজ কল্যাণমূলক নীতি ছিল, অর্থনীতি ছিল, শিক্ষানীতি ছিল, পররাষ্ট্র নীতি ছিল, শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহ ছিল এবং সেসব যুদ্ধে সেনাবাহিনী ও সেনাপতি ছিল। তৎকালীন বিশ্বের যে কোন রাষ্ট্রের চেয়ে নবীজী (সা:)’র সে রাষ্ট্র অধিক সুশাসন, সুবিচার ও সুসংহতি ছিল। বস্তুত কিরূপ হবে রাষ্ট্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এবং কিরূপ হবে সে রাষ্ট্রের আইন-কানূন -মহান আল্লাহতায়ালা সেগুলিই পবিত্র কুর’আনে বিষদ ভাবে বর্ণনা করেছেন। এবং মহান নবীজী (সা:) সেগুলির প্রয়োগ করে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। মুসলিমদের দায়িত্ব হলো সেগুলি পুরোপুরি অনুসরণ করা। নইলে কাফির, জালেম ও ফাসেক হতে হয়। রাষ্ট্রের জন্য পছন্দমত কোনটি নাম নির্ধারণ করা হারাম নয়; কিন্তু হারাম হলো মহান আল্লাহ ইসলামী রাষ্ট্রের যে লক্ষ্য, এজেন্ডা ও রোডম্যাপ বেঁধে দিয়েছেন এবং নবীজী সে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে সূন্নত রেখে যান -তা থেকে বিচ্যুৎ হওয়া। তাই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের নাম যখন ইসলামিক রিপাবলিক তথা ইসলামী প্রজাতন্ত্র রাখা হয় -তখন কোন আলেম সেটিকে হারাম বলেননি। বরং দেশের প্রখ্যাত আলেমগণ পাকিস্তানকে একটি ইসলামী রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২২ দফা মূলনীতি প্রণয়ন করেন। ইসলামী রাষ্ট্র হওয়ার শর্তগুলি নিম্মরূপ:
শর্ত ১: সার্বভৌমত্ব একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার
একটি রাষ্ট্রে সার্বভৌম তো সেই -যার থাকে আইন প্রণয়নের একমাত্র অধিকার। রাজতন্ত্রে সে সার্বভৌমত্ব একমাত্র রাজার বা রাণীর। রাজা বা রাণীর হুকুমই দেশের আইনে পরিণত হয়। পাশ্চাত্য মডেলের গণতান্ত্রিক দেশে সে সার্বভৌমত্ব থাকে জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্টের। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে সে ক্ষমতা না কোন শাসকের থাকে, না থাকে পার্লামেন্ট বা সংসদের। সে সার্বভৌমত্ব একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার। পবিত্র কুর’আনে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে:
إِنِ ٱلْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۖ يَقُصُّ ٱلْحَقَّ ۖ وَهَُ خَيْرُ ٱلْفَـٰصِلِينَ
অর্থ: “হুকুম দেয়ার অধিকার তথা কর্তৃত্বের হক তো একমাত্র আল্লাহর। তিনি সত্য বিবৃত করেন। এবং ফয়সালাকারীদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ।” –(সুরা আনয়াম, আয়াত ৫৭)। একই ঘোষণা এসেছে সুরা ইউসুফে। বলা হয়েছে:
إِنِ ٱلْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوٓا۟ إِلَّآ إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلْقَيِّمُ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থ: “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বিধান দেয়ার তথা হুকুম দেয়ার অধিকার নাই;; তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদত না করার। এটিই হলো শ্বাশত দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।” –(সুরা ইউসুফ, আয়াত ৪০)। অনুরূপ ঘোষণা এসেছে নিম্নের আয়াতে:
إِنِ ٱلْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۖ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ ۖ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ ٱلْمُتَوَكِّلُونَ
অর্থ: “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বিধান দেয়ার তথা হুকুম দেয়ার অধিকার নাই; আমি তার উপরই নির্ভর করি। এবং অবশ্যই তাঁর উপর নির্ভর করুক এমন সবাই যারা নির্ভর করতে চায়।” –(সুরা ইউসুফ, আয়াত ৬৭)।
শর্ত ২: আদালতে থাকতে হয় শরিয়তী আইনের বিচার
জাহিলিয়াতের সাথে ইসলামের মূল পার্থক্যটি হলো, ইসলামে থাকে আদালতের বিচারে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষিত শরিয়তী আইন অনুসরণের বাধ্যকতা। অথচ জাহিলিয়াতে শরিয়তী আইনের কোন স্থান থাকে না। জাহিলিয়াতের এটিই হলো বড় আলামত। জাহিলিয়াত অজ্ঞতার পথ; এটি ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথ। তাই জাহিলিয়াত জাহান্নামে নেয় এবং ইসলাম জান্নাতে নেয়। যে সব মুসলিম দেশের আদালতে শরিয়তের আইনের পালন নাই, বুঝতে হবে তারা বাঁচছে জাহিলিয়াত নিয়ে। তাই যারা শরিয়ত-বিরোধী তাদের সামনে প্রশ্ন রাখা হয়েছে:
أَفَحُكْمَ ٱلْجَـٰهِلِيَّةِ يَبْغُونَ ۚ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ ٱللَّهِ حُكْمًۭا لِّقَوْمٍۢ يُوقِنُونَ
অর্থ: “তবে কি তারা জাহিলী যুগের বিধি-বিধানকে কামনা করে? যারা নিশ্চিত বিশ্বাসী তাদের কাছে বিধান দানে আল্লাহর চেয়ে আর কে উত্তম? –(সুরা মায়েদা, আয়াত ৫০)।
যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধী তাদের যুক্তি হলো, তারা চায় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। এবং চায়, আইন প্রণীত হবে পার্লামেন্টের অধিকাংশের ভোটে। কিন্তু ইসলাম আইন প্রণয়নের অধিকার কখনোই সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে দেয় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণেই কেউ সে অধিকারটি পায়না। একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কাফির হতে পারে, সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়ার কারণে তাদের সিদ্ধান্ত ও প্রণীত আইন সঠিক হয়না, সেটি ভয়ানক ভূল, অতিশয় নৃশংস ও ক্ষতিকর হতে পারে। মানব ইতিহাসের বড় বড় গণহত্যা, বর্ণবাদী নির্মূল, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ও নির্মূলের নৃশংস কান্ডগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা কোনটি ন্যায় (জায়েজ) ও কোনটি অন্যায় (হারাম) -সেটি যেমন নিজে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তেমনি আইন প্রণয়নের অধিকারটি নিজ হাতে রেখেছেন। সে আইনকে অস্বীকার করলে বা সে আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হলে সে ব্যক্তি আর মুসলিম থাকে না, সে সরাসরি কাফির, জালিম ও ফাসিকে পরিণত হয় -যার ঘোষণা এসেছে সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে। এমন অবাধ্য ব্যক্তি যতই নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্জ পালন করুক না কেন -তাতে সে মুসলিম হয়না। মহান আল্লাহতায়ালার প্রণীত সে আইন হলো শরিয়তী আইন।
দেশের পার্লামেন্ট বড় জোর রাস্তাঘাট, ব্রিজ, রেল, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, শিল্প উন্নয়ন, কৃষি উন্নয়ন ও বিজ্ঞানের উন্নয়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেসব কাজে বাজেটও নির্ধারণ করতে পারে। প্রতিদেশেই এগুলির প্রয়োজন ও চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন। যুগের তালে প্রয়োজন ও চাহিদাও পাল্টে যায়। তাই সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব মহান আল্লাহতায়ালা বান্দার হাতে দিয়েছেন। কিন্তু প্রতি দেশে এবং প্রতি যুগে চুরি -ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ,অশ্লিলতা, মিথ্যা অপবাদ, প্রতারণা, সম্পদের লুণ্ঠন, সন্ত্রাসের ন্যায় অপরাধগুলির নাশকতা একই রূপ। ফলে শাস্তিও একই রূপ। হাজার হাজার বছর পরেও সে শাস্তিতে কোন পরিবর্তন আসে না। সে আইন সেকেলে হয়না। পবিত্র কুর’আনে নাযিলকৃত সে শাশ্বত আইন হলো শরিয়তী আইন। সে শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। যুদ্ধ এখানে রাব্বুল আলামীনের আইন ও তাঁর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। নবীজী ও সাহাবাদের আমলে এমন বিদ্রোহের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। হযরত আবু বকর (রা:)’য়ের শাসনামলে যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করে তাদের নির্মূলে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ইসলামের অর্থ শুধু মহান আল্লাহতায়ালা, তাঁর রাসূল, তাঁর কিতাব ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস নয়, বরং তাঁর আইনের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এমন বিদ্রোহ ব্যক্তি মাত্রই কাফির, জালেম ও ফাসেক – যা তিনি স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন পবিত্র কুর’আনে।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিরপেক্ষ, ন্যায়পরায়ন ও সত্যবাদী হয় -ইতিহাসে সে প্রমাণ নেই। অধিকাংশ মানুষ ব্যর্থ হতে পারে সত্যকে চিনতে; তারা হতে পারে মুর্তিপূজারী, গরুপূজারী ও মিথ্যা ধর্ম ও মতবাদের অনুসারী। দেশের অধিকাংশ মানুষ বর্ণবাদী, ফ্যাসিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীও হতে পারে। ভারত, চীন ও পাশ্চত্যের দেশগুলি তো তারই উদাহরণ। মুসলিম হতে হলে তাই সত্যের অনুসারি হতে হয়; এবং অনুসরণ করতে হয় মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত রোডম্যাপ। অধিকাংশ মানুষ কোন একটি ধর্ম বা বিশ্বাসের অনুসারী হলেই সেটি সত্য হয়না। এ বিষয়ে নবীজী (সা:)’র প্রতি মহান আল্লাহতায়ালার হুশিয়ারী হলো:
وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِى ٱلْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا ٱلظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ
অর্থ: “যদি তুমি ভূ-পৃষ্ঠের অধিকাংশ লোকের কথামত চল, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুৎ করবে। তারা যা অনুসরণ করে সেটি কেবল অনুমান; এবং যা বলে সেটির ভিত্তিও অনুমান।” –(সুরা আনয়াম, আয়াত ১১৬)। মানুষের স্বভাব হলো অধিকাংশ মানুষ যেদিকে যায়, সেদিকে যাওয়া। সে স্বভাব গরু-ছাগল-ভেড়ারও। উপরিউক্ত আয়াতে অধিকাংশের অনুসরণ থেকে সাবধান করা হয়েছে। হুশিয়ার করা হয়েছে, কোনটি সত্য এবং সঠিক -সেটির বিচারে যেন অধিকাংশ মানুষের রায়কে মানদন্ড রূপে গ্রহণ করা না হয়। সঠিক সেটিই যা এসেছে সর্বজ্ঞানী মহান রাব্বুল আলামীন ও তাঁর মহান রাসূল (সা:) থেকে।
শর্ত ৩: রাষ্ট্র পরিচালিত হবে শুরা তথা পরামর্শের ভিত্তিতে।
কোন একক ব্যক্তির মত কখনোই কোটি কোটি মানুষের মতামত থেকে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। ইসলামে কোন ব্যক্তির স্বৈরশাসনের স্থান নাই। সেটি মেনে নেয়া হারাম। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম হলো, রাষ্ট্র পরিচালিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। সেটিই হবে ঈমানদারের মৌলিক গুণ। মু’মিনের সে বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুর’আনে । বলা হয়েছে:
وَٱلَّذِينَ ٱسْتَجَابُوا۟ لِرَبِّهِمْ وَأَقَامُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَمْرُهُمْ شُورَٰ بَيْنَهُمْ وَمِمَّا رَزَقْنَـٰهُمْ يُنفِقُونَ
অর্থ: “ (সত্যিকার মু’মনি তারাই) যারা তাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দেয়, প্রতিষ্ঠা দেয় নামাজের, নিজেদের কার্য সম্পাদন করে পরামর্শের ভিত্তিতে এবং যে রিযিক আমি তাদের দিয়েছি তা থকে তারা ব্যয় করে।” –(সুরা শুরা, আয়াত ৩৮)। উপরুক্ত আয়াতে এ বিষয় সুস্পষ্ট করা হয়েছে, মুসলিমগণ তাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি পরিচালিত করবে পরামর্শের ভিত্তিতে। পরামর্শ না করাই মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্যতা। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি যেহেতু মানব সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ -সেটিকে কখনোই কোন রাজা বা শাসকের একক মতামতের উপর ছেড়ে দেয়া যায়না। রাজনীতির বিজ্ঞানে এটি স্বৈরাচার। ইসলামে সেটি হারাম। তাই মুসলিমকে শুধু হারাম পানাহার বর্জন করলে চলে না, বর্জন করতে হয় এরূপ হারাম স্বৈরশাসনকেও। তাই পবিত্র জিহাদ হলো স্বৈরশাসনের নির্মূলের লড়াই।
তবে প্রশ্ন হলো, উপরিউক্ত আয়াতে যে পরামর্শের কথা বলা হয়েছে, সে পরামর্শ কাদের সাথে? এমন কি চোর-ডাকাতগণও চুরি-ডাকাতি সফল করতে পরস্পরে পরামর্শ করে। মুসলিমদের পরামর্শের ধরণ ও চরিত্রই ভিন্ন। সেটির নমুনা রেখেছেন খোলাফায়ে রাশেদাগণ। এ পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে কঠিন ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ হলো রাষ্ট্র পরিচালনা। একাজে থাকে প্রশাসন, অর্থনীতি, আইন শৃঙ্খলা, শিক্ষা, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা, বিদেশী হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা, শিল্প, কৃষি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন একক ব্যক্তির পক্ষে এরূপ বিবিধ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকে না। সেটি সম্ভবও নয়। একজনের মেধা কখনোই দশ জনের সম্মিলিত মেধার সমকক্ষ হতে পারে না। এজন্যই সুশাসন নিশ্চিত করার প্রয়োজনে আয়োজন করতে দেশের সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান ও সবচেয়ে ঈমানদার লোকদের থেকে পরামর্শ নেয়ার বিধান। পবিত্র কুর’আনে সেটিকে মুসলিম চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে। এমন শুরা-ভিত্তিক রাষ্ট্রে যেরূপ দ্রুত উন্নয়ন ঘটে -সেটি স্বৈরশাসনের অধীনে ভাবা যায় না। সে রকম একটি শুরার পদ্ধতি খোলাফায়ে রাশেদার সময় দেখা গেছে। প্রত্যেক খলিফাই অন্যদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতেন। সে পরামর্শ সভায় তারাই সংযুক্ত ছিলেন যাদের ছিল কুর’আন-হাদীসের গভীর জ্ঞান, ছিল রাজনীতি ও সমাজনীতির জ্ঞান, ছিল ইতিহাস জ্ঞান, ছিল গভীর প্রজ্ঞা, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টি। এ কথা নিশ্চিত বলা যায় সে শুরা পদ্ধতির সাথে জড়িত ছিলেন নবীজী (সা:)’র নিজ হাতে গড়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একদল মানব। তাদের মাঝে ১০ জন ছিলেন জীবিত অবস্থাতেই জান্নাতের পুরস্কারপ্রাপ্ত -যাদেরকে বলা হতো আশরায়ে মোবাশ্শেরা। মানব ইতিহাসের আর কোন কালেই এতো উচ্চস্তরের মানুষের দ্বারা কোন পরামর্শ সভা গঠিত হয়নি। এরই ফলে সে আমলের ইসলামী রাষ্ট্র দ্রুত জন্ম দেয় মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার ও বিশ্বশক্তির। বিশ্বের আর কোন রাষ্ট্রই এতো বিপুল সংখ্যক মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে পারেনি -যা বাঁচিয়েছে সে আমলের ইসলামী রাষ্ট্র।
শর্ত ৪). অবিরাম জিহাদ থাকতে হবে অসত্য ও দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠায়
সমগ্র পৃথিবীটি মহান আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট এক বিশাল রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের তিনিই একমাত্র সার্বভৌম শাসক। এ রাষ্ট্রের তিনিই একমাত্র আইনদাতা। তিনি তাঁর এ রাষ্ট্রের বুক থেকে শয়তান ও তার অনুসারীদের শাসনের নির্মূল চান। নির্মূল চান মিথ্যা, দুর্নীতি ও অবিচারের। প্রতিষ্ঠা দিতে চান সত্য, সুবিচার ও সুশাসনের। সে পবিত্র কাজে তাঁর নিয়োগপ্রাপ্ত খলিফা তথা নির্বাহী অফিসার হলো মুসলিমগণ। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে পুরোপুরি একাত্ম হওয়ার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় ব্যক্তির ঈমানদারী। সেরূপ একাত্মতা না থাকলে ঈমানের দাবীটি নিছক মুনাফিকি। বুঝতে হবে, মহান আল্লাহতায়ালার সাথে একাত্ম হওয়ার কাজটি শুধু দোয়া-দরুদ, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে সম্ভব নয়। কারণ, মহান আল্লাহতায়ালার এ ভূমি কোথাও খালী নয়, তাতে অবৈধ দখলদারী প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তাঁর শত্রু- শয়তানের অনুসারীগণ।
মহান আল্লাহতায়ালার এ বিশ্বময় রাষ্ট্রের বুকে তারাই সবচেয়ে বড় অপরাধী যারা তাঁর এ রাষ্ট্রের উপর নিজেদের অবৈধ দখলদারী প্রতিষ্ঠা করেছে এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নিজেদের সার্বভৌমত্বের ও আইনের। তাই সর্বশ্রেষ্ঠ সওয়াবের কাজ হলো মহান আল্লাহতায়ালার ভূমিকে অবৈধ দখলদারদের শাসন থেকে মুক্ত করা এবং তাঁর শরিয়তী আইনে প্রতিষ্ঠা দেয়া। নবীজী (সা:)’র সাহাবাগণ ছিলেন এ বিচারে সমগ্র মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। কারণ তারা এ পৃথিবীব বিশাল ভূ-ভাগ থেকে শয়তানের অনুসারীদের অবৈধ দখলদারী নির্মূল করে সেখানে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আইনের প্রতিষ্ঠ দিয়েছিলেন। এতবড় কাজ তাদের পূর্বে আর কেউই করেনি।
এজন্যই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো, শত্রুশক্তির দখলদারী নির্মূলের জিহাদ। একমাত্র এ জিহাদের মধ্য দিয়েই মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করা সম্ভব। যেখানে সে জিহাদ নেই সেখানে বিজয়টি শয়তানী শক্তির। ব্যর্থতা সেখানে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফাদের। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার কাজটি শুধু কুর’আন পাঠ, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে সফল হয়না। তাছাড় কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র কোথাও প্রতিষ্ঠা পেলেও এ জিহাদ শেষ হয় না। তাই মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও নবীজী (সা:)’র জিহাদ শেষ হয়নি। যখন তিনি মৃত্যু শয্যায়, তখনও তাঁর প্রেরীত মুজাহিদ বাহিনী রোমান সম্রাটের বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদের ময়দানে।
জিহাদের ভূমি কখনো এক থাকে না, সেটি সময়ের তালে পাল্টে যায়। কিন্তু প্রতিটি ভূমিতে জিহাদের লক্ষ্য ও এজেন্ডা অভিন্ন। সেটি শয়তানী শক্তির দখলদারী নির্মূল এবং মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও আইনের বিজয়। তাই যে লক্ষ্যে বদর, ওহুদ ও হুনায়ুনে জিহাদ সংঘটিত হয়েছে, সে অভিন্ন লক্ষ্যে জিহাদ হয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্য রণাঙ্গণে। কারণ, যেখানে মানবের বসবাস, সেখানেই থাকে শয়তানী শক্তির দখলদারী প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ। শয়তানের ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধে কোন বিরতি নেই; তাই ইসলামের বিরুদ্ধে শয়তানের অনুসারীদের যুদ্ধটি সার্বক্ষণিক। তাদের সে সার্বক্ষণিক যুদ্ধের কথাটি সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার কাছে অজানা নয়। সেটি তুলে ধরেছেন সুরা বাকারার ২১৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:
وَلَا يَزَالُونَ يُقَـٰتِلُونَكُمْ حَتَّىٰ يَرُدُّوكُمْ عَن دِينِكُمْ إِنِ ٱسْتَطَـٰعُوا۟ ۚ
অর্থ: “এবং তারা (শয়তানের অনুসারী পক্ষ) তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে কখনোই বিরতি দিবে না -যতক্ষন না তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে না নেয়, যদি তারা তাতে সক্ষম হতো।” তাই শয়তানের অনুসারীদের তথা ইসলামের শত্রুদের যুদ্ধ যেখানে বিরামহীন -সেখানে মুসলিম তার জিহাদ থেকে বিরত হয় কি করে? জিহাদ পরিত্যাগ করার অর্থ তো শয়তানের অনুসারীদের ঘরে বিজয় তুলে দেয়া। মুসলিমদের পরাজয় ও বিপর্যের শুরু তো তখন থেকেই যখন তারা জিহাদ বাদ দিয়ে স্রেফ নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও তাসবিহ পাঠকে ইসলাম ভেবেছে। ফলে মুসলিম ভূমি সহজে দখলে গেছে ইসলামে শত্রুপক্ষের। ফলে অসম্ভব হয়েছে পূর্ণ ইসলাম পালন। এবং মুসলিম ব্যর্থ হচ্ছে পূর্ণ মুসলিম হতে। ফলে সম্ভব হচ্ছে না ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। তাই জিহাদে আবার ফিরে আসতে হবে। তাছাড়া নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও কুর’আন শিক্ষার মূল লক্ষ্য তো মুসলিমদের মাঝে জিহাদের আযানে লাব্বায়েক বলার সামর্থ্য সৃস্টি করা। সে সামর্থ্য সৃষ্টি না হলে বুঝতে হবে ইবাদতে দারুন ত্রুটি রয়ে গেছে।
শর্ত ৫). বিলুপ্তি ঘটাতে হবে বর্ণ, ভাষা, গোত্র, জাতীয় রাষ্ট্র ও অঞ্চল ভিত্তিক বিভক্তির, এবং প্রতিষ্ঠা দিতে হবে ইসলামী ভাতৃত্ববোধ ভিত্তিক মুসলিম উম্মাহর
মহান আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট এ পৃথিবীর উপর বর্ণ, ভাষা, গোত্র, জাতীয় রাষ্ট্র ও অঞ্চল ভিত্তিক বিভক্তির দেয়াল গড়াটি হরাম। সেরূপ বিভক্তি নিয়ে বাঁচতো জাহিয়াত যুগের আরবগণ। মহান আল্লাহতায়ালা একতাকে ফরজ করেছেন। নবীজী (সা:) তাই সে বিভক্তির দেয়াল ভেঙ্গে প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্বের বন্ধনে ইসলামী উম্মাহর জন্ম দেন। সেটিই হলো ইসলামের বিধান এবং নবীজী (সা:)’র গুরুত্বপূর্ণ সূন্নত। পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমগণ সে সূন্নত নিয়ে আজ বাঁচে না। তারা ফিরে গেছে জাহিলী যুগের আরব ঐতিহ্যে। ফলে তাদের মাঝে ফিরে এসেছে বর্ণ, ভাষা, গোত্র ও অঞ্চল ভিত্তিক বিভক্তির হারাম ঐতিহ্য। এ বিভক্তির ফলে মুসলিম ভূমিতে বিজয়ী হয়েছে শয়তানের এজেন্ডা। বিভক্তি জন্ম দেয় শক্তিহীনতার ও পরাধীনতার। এরূপ বিভক্তি নিয়ে শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র গড়া অসম্ভব। এবং অসম্ভব হয় স্বাধীনতা ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচা।
শর্ত ৬). শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাধান্য দিতে হবে কুর’আন-হাদীসের জ্ঞানদান
শিক্ষাই নির্ধারণ করে কিরূপ ধর্মীয় বিশ্বাস, চেতনা ও চরিত্র নিয়ে একজন ছাত্র বেড়ে উঠবে; নির্ধারণ করে কিরূপ রাষ্ট্র বা সমাজ নির্মিত হবে। তাই কোন ব্যক্তি ও জাতির নির্মাণে শুরুটি শিক্ষাদান থেকে শুরু করতে হয়। সেটিই মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। তাই তিনি ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও মাসব্যাপী রোজা ফরজ করার পূর্বে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানার্জন ফরজ করেছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের শুরুটি তাই শিক্ষাঙ্গণ থেকে শুরু করতে হয়। তাই কোন দেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত না হলে বুঝতে হবে, সে দেশে শিক্ষাদানের কাজটি আদৌ সঠিক ভাবে হয়নি। কুর’আন-হাদীসের জ্ঞানার্জন না হলে জ্ঞানার্জনের ফরজ পালিত হয়না। অধিকাংশ মুসলিম দেশে শিক্ষাদানের নাম বিপুল সংখ্যায় সার্টিফিকেট দানের কাজটি হলেও জ্ঞানার্জনের সে ফরজ পালিত হচ্ছেনা। ফলে মুসলিম সমাজ থেকে দূর হচ্ছে না জাহিলিয়াত এবং গড়ে উঠছে না ইসলামী চেতনা সমৃদ্ধ সুশিক্ষিত মুসলিম। জ্ঞানদানে এ ব্যর্থতার কারণেই নির্মিত হচ্ছে না ইসলামী রাষ্ট্র।
বিদ্রোহ যখন ফরজ বিধানের বিরুদ্ধে
জমিতে আগাছার প্রবল বৃদ্ধি দেখে এ কথা বলা ঠিক নয়, আগাছার বেড়ে উঠার সামর্থ্যটি বিশাল। বরং বুঝতে হবে, সে ভূমির কৃষক কতই না অযোগ্য ও ব্যর্থ। বুঝতে হবে, সে ভূমিতে কৃষক ঠিকমত চাষবাদই করেনি। দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য সে কৃষকের শাস্তি হওয়া উচিত। তেমনি কোন মুসলিম দেশে দুর্বৃত্ত শক্তির বিশাল বিজয় দেখে বুঝা ঠিক নয়, তারা পরাক্রমশালী। বরং বুঝতে হবে, সে দেশে ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ও গাফলতিটি তাদের -যারা নিজেদের পরিচয় দেয় ঈমানদার রূপে। তারা চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে অর্পিত খেলাফতের দায়িত্বপালনে। ঈমানের দাবী করেও তারা নিষ্ক্রিয়; অনেকে পরিণত হয়েছে শয়তানের খলিফায়।
মুসলিম উম্মাহর বর্তমান ব্যর্থতা দেখে সুস্পষ্ট বুঝা যায়, অধিকাংশ মুসলিমই ইসলামের অতি মৌলিক বিষয়টিও বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। সে মৌলিক বিষয়টি হলো, মহান আল্লাহতায়ালা শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ফরজ করেননি, ফরজ করেছেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও সে রাষ্ট্রের সুরক্ষাকে। এটি শুধু মুসলিমদের ঈমান বাঁচানোর বিষয় নয়, বরং তাদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু ও স্বাধীনতা বাঁচানোর বিষয়ও। ঈমান বাঁচানোর জন্যও তো সহায়ক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবেশ চাই। ঈমানে পুষ্টি জোগানোর জন্য চাই, কুর’আনী জ্ঞান-সমৃদ্ধ শিক্ষা ও ইসলামী সংস্কৃতি। যথার্থ শিক্ষাই ঈমানকে বাঁচায় মিথ্যা ধর্ম ও দূষিত দর্শনের নাশকতা থেকে। শিক্ষার উপকরণ, সিলেবাস রচনার দায়ভার, শিক্ষাঙ্গণ ও শিক্ষাদান প্রকল্প তো রাষ্ট্রের হাতে। তাই রাষ্ট্রকে ইসলামের শত্রু শক্তির হাতে রেখে ঈমানদার নাগরিক ও ইসলামী সমাজ নির্মাণের কাজটি হয়না। সে লক্ষ্য অর্জনে অপরিহার্য হলো ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। সেরূপ একটি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার দায়ভারটিও কখনোই মুষ্টিমেয় সংখ্যক সেনা সদস্যদের নয়, বরং সেটি প্রতিটি মুসলিমের। সেটি বুঝা যায় সুরা আনফালের ৬০ নম্বর আয়াতের দিকে নজর দিলে। এ আয়াতে সশস্ত্র জিহাদের জন্য সদাপ্রস্তুত থাকার যে হুকুমটি এসেছে -সেটি তো প্রতিটি ঈমানদারের উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহতায়ালার সে নির্দেশটি হলো:
وَأَعِدُّوا۟ لَهُم مَّا ٱسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍۢ وَمِن رِّبَاطِ ٱلْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِۦ عَدُوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ
অর্থ: “এবং শত্রুদের মোকাবেলায় তোমরা সর্বশক্তি দিয়ে নিজেদের প্রস্তুত রাখো এবং প্রস্তুত রাখো তোমাদের যুদ্ধের ঘোড়াগুলিকে; এরূপ প্রস্তুতির মাধ্যমে সন্ত্রস্ত করো আল্লাহর শত্রুদের এবং তোমাদের নিজেদের শত্রুদের।” তাই প্রতি ঈমানদারকে যেমন নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়, তেমনি সর্বাত্মক প্রস্তুত থাকতে হয় শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের। তবে পার্থক্য হলো, নামাজের ওয়াক্ত দিনে মাত্র ৫ বার এবং রোজার ওয়াক্ত ১২ মাসের মাঝে মাত্র এক মাস। কিন্তু জিহাদের ওয়াক্ত প্রতি দিন ও প্রতিটি মুহুর্ত। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম হলো সে জিহাদের জন্য প্রতিক্ষণ প্রস্তুত থাকা। এজন্যই নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের গৃহে শুধু জায়নামাজ ছিল না, উন্নত মানের ঢাল-তলোয়ার, বর্ম, তীর-ধনুকও ছিল। কোন কোন বর্ণনায় আছে, নবীজী (সা:)’র গৃহে ৯ খানি তলোয়ার ছিল। যাদের আর্থিক সামর্থ্য ছিল তারা প্রশিক্ষিত ঘোড়াও পালতেন। কিন্তু সেরূপ জিহাদের প্রস্তুতি আজ ক’জন মুসলিমের? জিহাদ শুরু হলে ক’জনই বা জিহাদে যোগ দেন? অথচ দেশ শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত হলে প্রথম দিন থেকেই জিহাদ ফরজ হয়ে যায়। তাই বাঙালি মুসলিমদের উপর সেদিনও জিহাদ ফরজ হয়েছিল যখন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজুদ্দৌলার বাহিনীর পরাজয় ঘটেছিল। কিন্তু ক’জন বাঙালি মুসলিম সেদিন জিহাদের ফরজ আদায় করেছিল? দেশরক্ষার দায়িত্ব কি শুধু সিরাজুদ্দৌলার ছিল?
মুসলিমদের আজকের বিপর্যের অন্যতম কারণ, প্রতিরক্ষার দায়িত্বটি মুষ্টিমেয় সংখ্যক সৈনিকের হাতে তুলে দিয়ে অধিকাংশ মুসলিম নিজেরা নিষ্ক্রিয় থাকছে। নবীজী (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামদের যুগে এমনটি কখনো দেখা যায়নি। যাদের দৈহিক সামর্থ্য ছিল, তাদের সবাই সেদিন জিহাদে যোগ দিয়েছেন। অথচ আজ বিদ্রোহ বা অবাধ্যতাটি ঘটছে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে। এবং সেটি শত শত বছর ধরে। সে বিদ্রোহের শাস্তিও কি তারা কম পেয়েছে? সে শাস্ত্রির নমুনা হলো, প্রতিটি মুসলিম দেশ অধিকৃত হয়েছে ইসলামের দেশী-বিদেশী শত্রুদের হাতে। এবং অধিকৃত এ দেশগুলির কোনটিতে সর্বশক্তিমান মহান প্রভুর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আইন বাঁচেনি। এবং বাঁচেনি তাদের নিজেদের ইজ্জত, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম মোতাবেক শত্রুর প্রতিরোধে ঘরে ঘরে সশস্ত্র প্রস্তুতি দেখা যায় একমাত্র আফগানিস্তানে। ফলে বিশ্বমাঝে মাথাপিছু অস্ত্রের হার সবচেয়ে বেশী হলো আফগানিস্তানে। এরূপ প্রস্তুতির সুফলও তারা পেয়েছে। বেঁচে গেছে তাদের ইসলামী আক্বীদা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতি। সমগ্র ইতিহাসে একমাত্র তারাই পরাজিত করতে পেরেছে ব্রিটিশ, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় তিনটি বিশ্বশক্তিকে।
রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কারখানা, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল গড়া নয়। বরং সেটি হলো, জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো। সে বাঁচাকে মহান আল্লাহতায়ালা সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় বলেছেন। সে লক্ষ্য হাছিলে দায়িত্ব হলো, ঈমান-আক্বীদা, স্বাধীনতা, জান-মাল ও ইজ্জতের সুরক্ষা দেয়া। মহান আল্লাহতায়ালার এ কাজকে ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছেন। রাষ্ট্রের উপর সে ফরজ দায়িত্বটি হলো, মুসলিম জনগণকে জিহাদের জন্য সদাপ্রস্তুত রাখা এবং তাদের সাথে নিয়ে জিহাদ সংগঠিত করা। নাগরিকদের দায়িত্ব হলো, সে জিহাদে নিজেদের জান, মাল, মেধা, শ্রম ও রক্তের বিনিয়োগ ঘটানো। ইসলামের গৌরব কালে রাষ্ট্রের খলিফাগণ তো সেটিই করেছেন। এবং যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জিহাদ সংগঠিত হয়, সে রাষ্ট্রের উপর মহান আল্লাহতায়ালা নানারূপ রহমত ও নিয়ামত পাঠান। সে প্রতিশ্রুতিটি দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালার। এজন্যই ইসলামের গৌরবকালে শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে প্রতি বছরে জিহাদ সংগঠিত করাকে খলিফাগণ নিজেদের ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করতেন। এ জিহাদের মূল উদ্দেশ্যটি রাজ্য বিস্তার ছিল না, বরং সেটি ছিল মহান আল্লাহতায়ালার ভূমিকে শয়তানী শক্তির দখলদারী থেকে যেমন মুক্ত করা, তেমনি অগণিত মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো। তাই তাদের কাছে সেটি গণ্য হতো সর্বশ্রেষ্ঠ সওয়াবের কাজ রূপে।
অথচ আজ মুসলিম জীবনে সে জিহাদ নাই; ফলে তারা সে সওয়াবের কাজেও নাই। এরই ফলে নির্মিত হয়নি কোন ইসলামী রাষ্ট্র। এরই পরিণাম হলো, মুসলিমদের সংখ্যা বিপুল ভাবে বাড়লেও তাদের শক্তি ও ইজ্জত একটুও বাড়েনি; বরং দারুন ভাবে কমেছে। জিহাদই হলো ইসলামকে বিজয়ী করা ও নিজেদের জান-মালের সুরক্ষা দেয়ার কাজে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত একমাত্র হাতিয়ার। অথচ সে হাতিয়ার আজ মুসলিমদের হাতে নাই। বরং বিস্ময়ের বিষয় হলো, বহু মুসলিম এবং বহু ইসলামী দল জিহাদ ছাড়াই ইসলামকে বিজয়ী করার স্বপ্ন দেখেন। এরই ফল হলো, নবীজী (সা:) জিহাদের যে সূন্নত রেখে গেলেন, সে সূন্নত মুসলিম জীবনে বেঁচে নাই। বরং বিস্ময়ের বিষয় হলো, মুষ্টিমেয় যে ঈমানদারদের জীবনে এখনো সে সূন্নত বেঁচে আছে তাদেরকে সন্ত্রাসী, উগ্রবাদী ও জঙ্গি বলা হয়। এসবই হলো মুসলিম দেশে সেক্যুলারাইজেশন ও ডিইসলামাইজেশনের ফল। মুসলিম দেশের দখলদার শাসকদের কাজ হয়েছে সেক্যুলারাইজেশন ও ডিইসলামাইজেশনকে তীব্রতর করা। ফলে এ শাসকগণ মুসলিমদের জন্য কল্যাণের বদলে মহা-অকল্যাণই বাড়িয়ে চলেছে। সেটি যেমন এ পার্থিব জীবনে, তেমনি আখেরাতে। এটিই হলো অনৈসলামিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নাশকতা। এ নাশকতা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। এ কাজে ব্যর্থ হলে শয়তান সফল হবে শত শত কোটি মানুষকে জাহান্নামের আগুনে নিতে। তখন সমগ্র রাষ্ট্র পরিণত হবে জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার বাহনে। ১৭/০৩/২০২৪
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018