ইসলামী রাষ্ট্র ও অনৈসলামী রাষ্ট্র এবং ঈমানদারী ও বেঈমানীর বিষয়
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on February 10, 2021
- Bangla Articles, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
প্রসঙ্গ: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি
মুসলিম জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ঈমানদার রূপে বাঁচা। এখানে ব্যর্থ হলে অনন্ত কালের জন্য জাহান্নাম অনিবার্য। এ জন্যই ঈমানদার রূপে বাঁচার চেয়ে এ জীবনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু নাই। এ কারণেই ঈমানদারীর অর্থ কী –এর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোন প্রশ্নও নাই। কারণ, ঈমানদারী কি -সেটি সঠিক ভাবে না জানলে ঈমানদার রূপে বাঁচবে কীরূপে? তখন সমগ্র বাঁচাটাই ভূল পথে হয় এবং সে বাঁচাটি জাহান্নামে পৌঁছায়। প্রশ্ন হলো, ঈমানদারীর অর্থ কি? মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ঈমানদারীর সংজ্ঞাই বা কী? এতবড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পবিত্র কোর’আনে কোন বিবরণ থাকবে না –সেটি কি ভাবা যায়? তাই ঈমানদারীর সংজ্ঞা বুঝতে হলে বুঝতে হবে পবিত্র কোর’আন; না বুঝে তেলাওয়াতে সেটি সম্ভব নয়। সে সাথে দেখতে হবে, মহান নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম কীরূপে বেঁচেছেন –সেটিও। কারণ তাদের বাঁচার মধ্যে মেলে প্রকৃত ঈমানদারীর পরিচয়।
প্রশ্ন হলো, ঈমানদারীর অর্থ কি স্রেফ কালেমা পাঠ, তাসিবহ-তাহলিল, নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত? এবং এগুলো পালন করলেই কি জান্নাত জুটবে? নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের ধর্ম-কর্ম কি শুধু এগুলোর মধ্যে সীমিত ছিল? ঈমানদার রূপে বাঁচতে হলে তো নিজের বাঁচাকে তাঁদের বাঁচার প্রক্রিয়ার সাথে বার বার মিলিয়ে দেখতে হবে। সে হিসাব নেয়া হলে ধরা পড়বে আজকের মুসলিমদের বাঁচাটি নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের বাঁচাটি কতটা ভিন্নতর। আর সে ভিন্নতাটিই হলো সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুতি। প্রশ্ন হলো, সে বিচ্যুতি নিয়ে কি জান্নাতে পৌঁছা যাবে? পবিত্র কোর’আনে ঈমানদারের পরিচয় নিয়ে সামান্যতম অস্পষ্টতা নাই। সেটি অতি স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালার; এবং একবার নয়, অসংখ্যবার। ঈমানদার হওয়ার অর্থ স্রেফ কালেম পাঠ, নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত আদায় নয়। বরং সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাথে নিজের জান ও মালের ক্রয়-বিক্রয় চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া। এ চুক্তি মোতাবেক ঈমানদার তার জান ও মাল বিক্রয় করে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে। বিনিময়ে পায় জান্নাত। কোর’আনের ভাষায় এটি হলো বাইয়া অর্থাৎ বিক্রয়নামা। সে চুক্তিনামাটি পবিত্র কোর’আনে ঘোষিত হয়েছে এভাবে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিন থেকে তাঁর জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন, তাদের জন্য এর বিনিময়ে রয়েছে জান্নাত। তাঁরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, (শত্রুদের) নিধন করে এবং (নিজেরা) নিহত হয়।” –(সুরা তাওবাহ, আয়াত ১১১)।
ঈমানদারী তাই শুধু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত নিয়ে বাঁচায় সীমিত নয়। বরং সর্বক্ষণ এ চেতনা নিয়ে বাঁচা যে তাঁর নিজের জান ও মালের উপর তাঁর নিজের কোন মালিকানাই নাই। মালিকানাটি মহান আল্লাহতায়ালার। নিজের জান ও মাল বলতে যা বুঝায় -তা হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অর্পিত আমানত মাত্র। এবং দায়িত্ব হলো, সে আমানতের কোনরূপ খেয়ানত না করে একমাত্র তাঁর নির্দেশিত পথে বিনিয়োগ করা। বিনিয়োগের সে খাতটিও উপরুক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি হলো, তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জিহাদে নেমে শত্রুকে নিধন করা এবং নিজে শহীদ হওয়াও নিয়েত। তাই যার জীবনে জিহাদ নাই, বুঝতে হবে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে তার কোন বিক্রয়নামাও নাই। এবং সে জিহাদশূণ্য প্রমাণ করে, তাঁর মধ্যে সত্যিকারের ঈমানদারীও নাই।
নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতের মাঝে শত্রুর সাথে যুদ্ধ নাই। সেখানে জিহাদ নাই। ফলে সেখানে জানমালের কোরবানী এবং শহীদ হওয়ারও কোন সুযোগ নাই। সেটি ঘটে রাজনীতির অঙ্গণে। রাজনীতিতে কাজ করে দুটি দল: একটি মহান আল্লাহতায়ালার; অপরটি শয়তানের। মহান আল্লাহতায়ালার দলটি তো সেটিই যারা পক্ষ নেয় মহান আল্লাহর ও রাসূলের নিজের নিয়োজিত করে তার এজেন্ডাকে বিজয়ী। আর সে বিজয়ের লক্ষ্যমাত্র হলো শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা। আর শয়তানের দলের এজেন্ডা হলো, ইসলামের বিজয়কে প্রতিহত করা। পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিম দেশগুলোতে শয়তানের দলই বিজয়ী, ফলে বিলুপ্ত হয়েছে শরিয়ত।
নবীজী (সা:)’র জীবদ্দশাতে আল্লাহতায়ালার দলের সৈনিকদের সংগ্রহ করেছেন তিনি স্বয়ং। সৈনিক হয়েছেন একমাত্র তারাই যারা মহান আল্লাহতায়ালার সাথে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সমাধা করেছেন। নবীজী (সা:) তাদের থেকে সে পবিত্র চুক্তির শপথ পাঠ করিয়েছেন। ইসলামী পরিভাষায় এ শপথটি হলো বাইয়াত। বলা হয়ে থাকে, সাহাবাগণ যখন নবীজী (সা:)’র হাত ধরে বাইয়াত করতেন, তখন সেখানে মু’মিনের হাতের সাথে শুধু নবীজী (সা:)’র হাতই থাকতো না। সে দু’টি হাতের উপর আরেকটি হাত থাকতো এবং সেটি মহান আল্লাহতায়ালার। নবীজী (সা:)’র অবর্তমানে বাইয়াতের কাজটি করেন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা খলিফা। লক্ষণীয় হলো, মুসলিম বিশ্বে মহান আল্লাহতায়ালার সে দল বেঁচে নাই্। এবং বেঁচে নাই জিহাদ, ইসলামের বিজয় এবং শরিয়ত। কিন্তু সে বাইয়াত আজও বেঁচে আছে। সে বাইয়াতের রীতি বেঁচে আছে পীর-দরবেশদের মুরিদ রূপে আনুগত্য জাহিরের মাধ্যম রূপে। কিন্তু পীর-দরবেশদের কাছে সে বাইয়েতে বাদ পড়েছে মহান আল্লাহতায়ালার দল গড়া, তাঁর দ্বীনের বিজয়ে জিহাদে নামা এবং সে বিজয়ে জানমালের কোরবানী পেশ। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের আমলে মুসলিম রাষ্ট্রে সৈন্য পালতে গ্রীক, রোমান বা পারসিকদের ন্যায় বড় বড় সেনানিবাস গড়তে হয়নি। বড় বড় কেল্লাও নির্মিত হয়নি। বরং প্রতিটি জনপদ ছিল সেনানিবাস, প্রতিটি ঘর ছিল বাংকার। যুদ্ধের প্রয়োজন হলে রাষ্ট্র-প্রধানের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণাই যথেষ্ট হতো। আযানের ডাকে ঈমানদার যেমন মসজিদে নামাযে যোগ দেয়, জিহাদের ডাকে তাঁরা সেদিন জিহাদেও যোগ দিতেন। চাষাবাদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ন্যায় যুদ্ধবিদ্ধাও তাঁরা নিজ গরজে শিখতেন। নিজ খরচে অস্ত্র কিনে, নিজ অর্থে যুদ্ধের রশদ সংগ্রহ করে এবং নিজের ঘোড়া বা উঠ নিয়ে শত শত মাইল দূরের রণাঙ্গনে গিয়ে হাজির হতেন। এবং সে যুদ্ধে প্রাণও দিতেন। ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থ এবং মুসলিম ভূমি এভাবেই সে সময় সুরক্ষা পেত।
অনৈসলামী রাষ্ট্রের বিপদ
অনৈসলামী রাষ্ট্রের বিপদটি অতি ভয়াবহ। তখন অসম্ভব হয় মহান আল্লাহতায়ালার সাথে কৃত পবিত্র চুক্তির শর্ত পালন। তখন রাষ্ট্রের ভূগোলের উপর শুধু নয়, চেতনার ভূগোলেও প্রতিষ্ঠা পায় শয়তানের অধিকৃতি। শিক্ষা-সংস্কৃতি, প্রশাসন, আদালত, পুলিশ, সেনাবাহিনী –এসবই তখন শয়তানের হাতিয়ারে পরিণত হয়। ফলে অসম্ভব হয় সত্যিকার ঈমানদার রূপে বাঁচা ও বেড়ে উঠা। তখন নিষিদ্ধ হয় জিহাদের ন্যায় ইসলামের সর্বোচ্চ ইবাদত। জিহাদ গণ্য হয় সন্ত্রাস রূপে। এসব রাষ্ট্রের শাসকদের কাছে মুজাহিদগণ গণ্য হয় নিজেদের প্রতিপক্ষ রূপে। ফলে লাগাতর যুদ্ধ শুরু করে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে। তারা আইন করে বন্ধ করে ইসলামের নামে সংগঠিত হওয়া। এবং দণ্ডনীয় অপরাধ গণ্য হয় শরিয়ত প্রতিষ্ঠার যে কোন উদ্যোগ। এভাবেই অনৈসলামী রাষ্ট্রে দুরুহ হয় জান্নাতের পথে পথচলা। তখন সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও বিচার-ব্যবস্থাসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান লিপ্ত হয় শয়তানের এজেন্ডা সফল করায়। আরো বিপদ হলো, জনগণ জিহাদশূণ্য হওয়াতে ইসলাম, মুসলিম ভূমি ও মুসলিম জনগণের জানমাল বিপন্ন হলেও এমন রাষ্ট্রে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু হয়না।
মুসলিমদের আজকের পরাজিত দশা এজন্য নয় যে, মুসলিম দেশগুলোতে কোর’আন-হাদীস বা মসজিদ মাদ্রাসার কমতি রয়েছে। বরং অতীতের তুলনায় এসব শতগুণ বেড়েছে। নবীজী(সাঃ)’র শাসনামলে এমনকি খোলাফায়ে রাশেদার আমলেও কোন সাহাবার ঘরে একখানি পুরা কোর’আন ছিল না। হযরত উসমান (রাঃ) খলিফা থাকা কালে সমগ্র দেশে পূর্ণাঙ্গ কোর’আন পুস্তাকারে ছিল মাত্র ৪ খানি। অথচ আজ ঘরে ঘরে কোর’আন মজিদ ও কোর’আনের তাফসির। আর হাদীস গ্রন্থ? সে সময় কোন হাদীস গ্রন্থই ছিল না। অথচ আজ যে কোন ব্যক্তি বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাজার হাজার হাদীস পাঠ করতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক কালে হাদীসের সে রূপ শিক্ষা লাভে হাজার হাজার মাইলের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে নানা দেশের নানা স্থানে গিয়ে বিক্ষিপ্ত সাহাবা ও তাবে-তাবেয়ীনদের নিকট থেকে হাদীস শিখতে হতো।
মুসলিমদের আজকের পরাজয়ের মূল কারণটি অন্যত্র। সেটি ইসলামী রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি। কোরআন হাদীস আজ ঘরে ঘরে বেঁচে থাকলেও সমগ্র মুসলিম জাহানে ইসলামী রাষ্ট্র বেঁচে নাই। রাষ্ট্র অধিকৃত হয়ে গেছে ইসলামের শত্রু শক্তির হাতে। তাতে নানারূপ সেক্যুলার ধ্যানধারণায় প্লাবিত হয়েছে মুসলিমদের চেতনার ভূমি। ফলে বিলুপ্ত হয়েছে কোর’আনী জ্ঞানের ক্ষুধা। ফলে বাড়ছে ঈমানে ভয়ানক অপুষ্টি নিয়ে। আজকের মুসলিমদের এটিই সবচেয়ে বড় বিপদ। চোর-ডাকাতদের হাতে ঘরবাড়ি অধিকৃত হলে এতো বড় ক্ষতি হয় না। কারণ তখনও ঈমান বেঁচে থাকে। কিন্তু দুর্বৃত্ত জাহেলদের হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত হলে পরিকল্পিত ভাবে ঈমানকে বাঁচতে দেয়া হয় না। নেক আমলের পথও বন্ধ বা সংকুচিত করে দেয়া হয়। ঈমান যে সুস্থ্যতা নিয়ে বেঁচে নাই –সে প্রমাণ কি কম? বেঁচে থাকলে তো মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী বিধানের এমন পরাজয়ে মুসলিম জীবনে জিহাদ কি অনিবার্য হতো না? শয়তানের খলিফাদের দখলদারির বিরুদ্ধে জিহাদ যে শুরু হয়নি -সেটিই প্রমাণ করে ঈমান তার সুস্থ্যতা নিয়ে বেশী মানুষের মাঝে বেঁচে নাই।
শত্রুপক্ষের স্ট্রাটেজী
শয়তান ও তার অনুসারিগণ চায় না, রাষ্ট্র ও তার শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানসমূহ ঈমানদারদের হাতিয়ারে পরিণত হোক। কারণ তারা জানে, তাতে বিপন্ন হবে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব। এজন্যই সেগুলোকে ইসলামের শত্রুপক্ষ নিজ হাতে রাখতে চায়। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে মুসলিম ভূমি দীর্ঘকাল অধিকৃত থাকা কালে তারা সেটিকেই সুনিশ্চিত করেছে। মিশরে ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিনিধি লর্ড ক্রমার বলেছিলেন, “মুসলিম দেশগুলিতে সেক্যুলার একটি শ্রেণী গড়ে না উঠা না পর্যন্ত তাদের অধিনত মুসলিম দেশগুলিকে স্বাধীনতা দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা।” কাউকে সেক্যুলার করার অর্থই হলো তাকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো। আজও সাম্রাজ্যবাদীদের একই স্ট্রাটেজী। সে স্ট্রাটেজী নিয়ে আফিগানিস্তানকে আজও তারা অধিকৃত রেখেছে। সেক্যুলারিজমের মূল কথা ইহজাগতিক স্বার্থচেতনা নিয়ে বাঁচা। পারলৌকিক স্বার্থচেতনা এখানে কুসংস্কার ও পশ্চাদপদতা। লক্ষ্য এখানে চেতনা থেকে মহান আল্লাহর স্মরণকে ভূলিয়ে দেয়া। সেক্যুলার মানুষ গড়তে ইসলামের শত্রুপক্ষ শুধু সিনেমা ঘর, গানের স্কুল, নাট্যশালা ও স্টেডিয়ামই গড়ছে না, সেক্যুলার সেনাবাহিনী, প্রশাসন, আইন-আদালতও গড়ছে। তাই বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে কাফেরদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান ঘটলেও সেক্যুলারিষ্ট এজেন্ট প্রতিপালনের কাজ শেষ হয়নি।
বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামের শত্রু পক্ষের শক্তি বাড়াতে কাফের শক্তির বিনিয়োগটি বিশাল। সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে নাগরিকদের মনযোগ হঠাতেই রাষ্ট্রীয় খরচে বাড়ানো হচেচ্ছ নানা দিবস, নানা উৎসব, নানা রূপ খেলাধুলা ও নাচগানের মহা আয়োজন। অপরদিকে ইসলামচর্চা এবং ইসলামপন্থীদের রাজনীতির উপর লাগানো হচ্ছে নানারূপ নিষেধাজ্ঞা। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে ইসলামী টিভি চ্যানেল। কোর’আনের তাফসিরকারকদের কারাবন্দী করা হচ্ছে। বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে জিহাদ বিষয়ক বইপত্র। এবং ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে ইসলামপন্থী নেতাদের। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হয় ইসলামের শরিয়তী বিধানের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের উত্তেজিত করতে। মুসলিম দেশগুলি ইসলামের শত্রুদের হাতে অধিকৃত হওয়াতে মুসলিম রাষ্ট্র এবং মুসলিম জনসংখ্যা বাড়লেও কোথাও মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি বিধানের বিজয় সম্ভব হয়নি। ফলে সম্ভব হয়নি মহান আল্লাহর ইচ্ছাপূরণ। মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীনের সাথে এর চেয়ে বড় বেঈমানী আর কি হতে পারে? এমন বেঈমানী একমাত্র শয়তান ও তার মিত্রদেরই খুশি করতে পারে। কিন্তু তা নিয়ে সচেতনতা ও আত্মসমালোচনাই বা ক’জনের? আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতা অনেক। তবে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের সাথে বেঈমানী। এমন বেঈমানী কি জান্নাতে নিবে?
স্বাধীনতার নামে পরাধীনতা
অনৈসলামী রাষ্ট্রগুলো জনজীবনে আযাব ডেকে এনেছে নানা ভাবে। আযাব এনেছে মহান আল্লাহর নির্দেশের সাথে বেঈমানির বাড়িয়ে। স্বাধীনতার নামে এনেছে পরাধীনতা। তাদের কারণেই মুসলিম ভূমি আজ যেমন বিভক্ত, তেমনি পরাজিত। এ বিভক্ত ভূমিতে শুধু ইসরাইল সৃষ্টি হয়নি; লাগাতর যুদ্ধ, রক্তপাত এবং দুর্ভিক্ষও এসেছে। এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। এ বিপদ এসেছে জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের হাতে। প্রশ্ন হলো, যে স্বাধীনতার নামে উসমানিয়া খেলাফতকে তারা ভাঙ্গলো সে স্বাধীনতা কি আদৌ এসেছে? বরং সৃষ্টি হয়েছে কাতার, কুয়েত, জর্দান, লেবানন, বাইরাইন, সৌদি আরব, ওমান, আমিরাতের মত এমন সব রাষ্ট্র যার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই, ঐতিহ্যও নাই। দেশগুলো নামে মাত্রই স্বাধীন। আসলে শাসিত হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অতি অনুগত দাসদের হাতে। অথচ দাসদের শাসন মুসলিম ইতিহাসে অতি পরিচিত। কিন্তু অতীতের সে দাসদের যেমন শক্তি ছিল, তেমনি নিজেরা স্বাধীন ছিল। এবং মুসলিম ভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় তাদের প্রবল ইচ্ছা এবং সামর্থ্যও ছিল। আজকের দাসদের ন্যায় তারা সেদিন শক্তিহীন, পরাধীন এবং শত্রুশক্তির দাস ছিলেন না।
শুধু একখন্ড ভূগোল ও একটি পতাকা থাকলেই কি স্বাধীনতা থাকে? স্বাধীনতার সুরক্ষায় লোকবল, অর্থবল ও সামরিক বলও থাকতে হয়। থাকতে হয় স্বাধীনতার সুরক্ষায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য একটি প্রবল দর্শন। ইসলাম তো সে দর্শনের বলটাই জোগায়। ২২টি আরব রাষ্ট্র এবং ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের মাঝে কোনটিরও কি সে আদর্শিক বল আছে? ইসলামী দর্শন বেঁচে না থাকলে স্বাধীনতা বাঁচানোর আগ্রহও বাঁচে না। মুসলিম দেশগুলোর সামন্ত শাসকেরা বেঁচে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পুরাপুরি জিম্মি রূপে। কাতার, কুয়েত, বাইরান ও ওমানে যেভাবে মার্কিনীরা নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়েছে তাতে মনে হয় দেশগুলী যেন তাদেরই। বিজয় ও গৌরব ক্ষুদ্রতর হওয়াতে আসে না। রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও আসেনা। মুসলিম দেশ ভাঙ্গা তো ইসলামের দুষমনদের কাজ। তেমন একটি খণ্ডিত মানচিত্র সৃষ্টির কাজে তো ইসলামের শত্রুরা নিজ অর্থ, নিজ রক্ত ও নিজ অস্ত্র ব্যয়ে প্রকাণ্ড যুদ্ধ লড়ে দিতেও রাজী। যেমন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্যে করেছে এবং ভারত করেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। খণ্ডিত ভূগোল নিয়ে কোন বিশ্ব শক্তি গড়ে উঠেছে -সে নজির মানব-ইতিহাসে নাই। সে জন্য বৃহৎ রাষ্ট্র চাই। সামরিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বলও চাই।
মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, মহান আল্লাহতায়ালার সৈনিক হওয়া। আর আল্লাহতায়ালা কি তাঁর সৈনিকদের মাঝে অনৈক্য চাইতে পারেন? তেমন অনৈক্যে কি তাঁর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা বাড়ে? বরং অনৈক্যে তো মহা বিপর্যয়, সে বিপর্যয় এড়াতেই মহান আল্লাহতায়ালাই তাঁর সৈনিকদের উপর একতাকে ফরজ ঘোষণা করেছেন। তারা বরং কোর’আনে বর্নিত “বুনিয়ানুন মারসুস” তথা সীসাঢালা দেয়ালের মত অটুট হবে -সেটিই মহান আল্লাহতায়ালার কামনা। একতার গুরুত্ব এমনকি কাফেরগণও বুঝে। কারণ তারাও তো বিজয় চায়। তাই বাঙালী-অবাঙালী এবং নানা ভাষা ও নানা বর্ণে বিভক্ত হিন্দু ভারত তাই তার ভৌগলিক অখণ্ডতাকে সযন্তে ধরে রেখেছে। কিন্তু মুসলিমগণ তা পারেনি। মুসলিম দেশে সে বিভক্তি এনেছে জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টগণ। ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে এটাই তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। তারা মুসলিম উম্মাহর জীবনে শুধু বিভক্তিই আনেনি, মুসলিম সভ্যতায় বিপর্যয়ও এনেছে। ফলে অসম্ভব হয়ে পড়েছে বিশ্বশক্তি রূপে পুণরায় মাথা তুলে দাঁড়ানো।
সবচেয়ে বড় বিপর্যয়: উদ্ধার কীরূপে?
অনৈসলামী রাষ্ট্রে বসবাসের সবচেয়ে বড় বিপদটি এ নয়, সেখানে মুসলিমগণ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। বরং সবচেয়ে বড় বিপদটি হলো, অধিকৃত সে ভূমিতে মুসলিমগণ ব্যর্থ হয় মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে দায়িত্বপালনে। অর্থাৎ যে লক্ষ্যে তাদের বাঁচা ও মরা -সেটিই ব্যর্থ হয়। ভূল পথের গাড়ী তা যত বিশাল, যত দামী বা যত উন্নত প্রকৌশলেরই হোক না কেন -তাতে চড়ে বসাতে কি কোন কল্যাণ আসে? সেটি তো বরং ভ্রান্ত পথে নিয়ে যায়। ভারত, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার ন্যায় রাষ্ট্রগুলো বিশ্বশক্তিতে পরিনত হলেও তাতে কি সে রাষ্ট্রে বসবাসকারি মুসলিমদের কল্যাণ বাড়ে? বরং তাদের অর্থ, মেধা, শ্রম তথা সামর্থ্যে বিনিয়োগ হয় অমুসলিম দেশের শক্তি বৃদ্ধিতে। একই ভাবে কোন মুসলিম দেশে কাফের শক্তির হাতে অধিকৃত হলে মুসলিমগণও তখন দখলদার শক্তির সৈনিকরূপে কাজ করে। এরই উদাহরণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ২ লাখের বেশী ভারতীয় মুসলিম ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সদস্য রূপে ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া ইত্যাদি মুসলিম ভূমিতে মুসলিম হত্যাতে নেমেছে।
মুসলিমদের প্রকৃত কল্যাণ নির্ভর করে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাতে -সেটি যেমন এ দুনিয়ায় তেমনি আখেরাতে। কিন্ত্র কোন অমুসলিম দেশে সেটি অতি দুরুহ হয়ে দাঁড়ায়। মুসলিমগণ আজকাল নিছক অর্থনৈতিক কারণে অমুসলিম দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। অথচ মুসলিমদের প্রয়োজনীয়তা নিছক অর্থনৈতিক নয়। সেটি যেমন আধ্যাত্মীক, তেমনি রাজনৈতিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক। সে প্রয়োজনটি অমুসলিমদের থেকে ভিন্নতর। মুসলিমদের সে প্রয়োজন মেটানোটি কোন অমুসলিম দেশের এজেন্ডাও নয়। অথচ ইসলামের আধ্যাত্মীক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠতে ব্যর্থ হলে বিপন্ন হয় মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার ন্যায় জীবনের মূল লক্ষ্যটি। তখন জীবনে বাঁচাটাই ব্যর্থ হয়।
মুসলিমদের খাদ্য-পানীয়তে তেমন হালাল-হারামের বিষয় আছে -তেমনি ভিন্নতা আছে তাদের শিক্ষার বিষয়েও। প্রয়োজনীয়তা রয়েছে শরিয়তের প্রতিষ্ঠারও। কারন শরিয়ত পালন ছাড়া ধর্ম পালনও পুরাপুরি হয় না। একারণেই শুরু থেকে মুসলিমগণ কাফেরদের থেকে শুধু ভিন্নতর ইবাদতগাহই গড়েনি, ভিন্নতর রাষ্ট্রও গড়েছে। ভারত ভেঙ্গে মুসলিমগণ তাই পাকিস্তান গড়াকে অপরিহার্য মনে করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের রাষ্ট্রে পরিণত হলেও সেক্যুলারিস্টদের বাধার মুখে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। ফলে হিন্দুদের জুলুম থেকে বাঁচলেও জনগণ ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ পায়নি। যে ভিশন নিয়ে আল্লামা মহম্মদ ইকবাল পাকিস্তানের প্রস্তাবনা রেখেছিলেন তা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার মত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব পাকিস্তান কোন সময়ই পায়নি। এমনকি আলেমগণও মসজিদ ও মাদ্র্রাসার চার দেয়ালের বাইরে ইসলামের প্রতিষ্ঠা নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। তারাও দেশটিকে ইসলামী করার কাজে ময়দানে নেমে আসেনি। বরং তাদের নিষ্ক্রীয়তার কারণেই অতি সহজেই দেশটি জাতীয়তাবাদী, সমাজবাদী ও সেক্যুলারিস্ট শত্রুদের হাতে অধিকৃত হয়ে যায়।
অমুসলিম দেশে সংখ্যালঘু রূপে বসবাসকারি মুসলিমদের সংখ্যা আজ অনেক। তাদের পক্ষে সে সব দেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, হিসাবরক্ষক, কৃষিবিদ বা বিজ্ঞানী রূপে বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যালাভ জুটলেও মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাটি ভয়ানক বিপদে পড়ছে। এবং সেটি ইসলামী জ্ঞানলাভ না হওয়ার কারণে। অথচ ইসলামী জ্ঞানলাভের দায়ভারটি মুসলিমদেরকে নিজ হাতে নিতে হয়। এবং মুসলিম রাষ্ট্রে সে দায়িত্বটি সরকারের। বিদ্যাদান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার। মানুষের চরিত্রে মূল পরিবর্তনটি আসে তার চেতনার পরিবর্তন থেকে। তাই চেতনার ভূবনের উপর দখলদারীর গুরুত্ব ভূগোলের উপর দখলদারীর চেয়ে কম গুরুত্পূর্ণ নয়। সে দখলদারী বাড়াতে শত্রুপক্ষ এজন্যই মুসলিম ভূমিতে শত শত মিশনারি বিদ্যালয় খুলে। মুসলিম দেশগুলোতে বিপদ তখন থেকেই বাড়তে শুরু করেছে যখন জ্ঞানার্জনের জন্য সেসব দেশ থেকে নাগরিকদের কাফের দেশে যাওয়া শুরু হয়েছে।
হারাম পানাহারের ন্যায় হারাম শিক্ষালাভও যে ভয়ানক তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো তুরস্কের উসমানিয়া খেলাফত। জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, আঞ্চলিকতা, সেক্যুলারিজম –এসব মূলত পাশ্চাত্যের রোগ। এ রোগের প্রকোপে ইউরোপ বহু টুকরোয় বিভক্ত হয়েছে এবং বিভক্ত টুকরোগুলো শত শত বছর ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধও করেছে। অথচ এমন রোগ থেকে মুসলিম ভূমি ১৩ শত বছর মুক্ত থেকেছে। আরব¸ তুর্কী, কু্র্দি, মুর, আলবেনীয়, কোসোভান মুসলিমরা তাই অখণ্ড ভূ-খন্ডে শত শত বছর বসবাস করেছে। এক কাতারে শামিল হয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইও করেছে। কিন্তু তুর্কী ও অতুর্কী নাগরিগদের শিক্ষালাভের জন্য ইউরোপে পাঠানো শুরু হলো তখন তারা শুধু মদ্যপান, সূদ, বেপর্দাগী ও নাচগানের সংস্কৃতি নিয়েই ঘরে ফিরেনি। জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, আঞ্চলিকতা, সেক্যুলারিজমের জীবাণূতেও আক্রান্ত হয়ে ফিরেছে। তখন তারা ইসলামের পতাকা ফেলে দিয়ে তুর্কী, আরব, কুর্দি জাতীয়তার পতাকা নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এমন একটি যুদ্ধে মুসলিমদের রক্তক্ষয় ও শক্তিক্ষয় বাড়াতে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিল শত্রুপক্ষ। মক্কার শরিফ হোসেনদের ন্যায় অনেকেই সে অস্ত্র নিয়ে মুসলিম হত্যায় পাগল হয়ে উঠে। ফলে তুরস্ক উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে বিশটির বেশী রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর এ রাষ্ট্রগুলো দ্রুত ইসলামের শত্রু পক্ষের হাতে অধিকৃত হয়; এবং সেগুলো মিত্রতে পরিণত হলো পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। পাশ্চাত্যের এ মিত্রগণ শরিয়তের প্রতিষ্ঠাই শুধু অসম্ভব করেনি, অসম্ভব করেছে বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিমদের উত্থানেরও। একই রূপ জাতীয়তাবাদী ও সমাজবাদী সেক্যুলারিস্টগণ ব্যর্থ করে দিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের সম্মিলিত পাকিস্তান প্রজেক্ট। তারা কলেজ-বিশ্ববি্দ্যালয়, প্রশাসন, রাজনীতি, সংস্কৃতি, মিডিয়াকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেছে আল্লাহ ও তাঁর শরিয়তি বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বাড়াতে।
মুসলিম দেশগুলিতে আজ যে ভয়ানক চরিত্রহীনতা ও দুর্নীতি –তার মূল কারণ দেশগুলির সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা। এ শিক্ষাব্যবস্থা কাজ করছে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে পথভ্রষ্ট করার কাজে। এ শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রগণ পরিণত হচ্ছে ভয়ানক শিকারি জীবে। তাদের জ্ঞান, মেধা ও শিক্ষালদ্ধ যোগ্যতার সবটুকুই ব্যয় হয় স্রেফ দুনিয়ার জীবনকে ঐশ্বর্যময় ও আনন্দময় করতে। এরাই হলো সবচেয়ে ব্যর্থ মানব। এবং তাদের সে ব্যর্থতার সার্টিফিকেটটি এসেছে মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। পবিত্র কোর’আনে তিনি বলেছেন, “বল (হে মুহাম্মদ), আমরা কি তোমাদেরকে বলে দিব কর্মের বিচারে কে সবচেয়ে ব্যর্থ? এরা হচ্ছে তারা যাদের জীবনের সকল প্রচেষ্ঠা নষ্ট হয়েছে এ দুনিয়ার জীবনের স্বাচ্ছন্দ বাড়াতে এবং ভাবে যে কর্মে তারা ভাল করছে। এরাই হচ্ছে তারা যারা আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকার করে এবং অস্বীকার করে পরকালে তাঁর সাথে সাক্ষাতকেও। তাদের কর্মকান্ড ব্যর্থ। এক আখেরাতের বিচার দিনে তাদের কর্মকে ওজনও করা হবে না। -(সুরা কাহাফ, আয়াত ১০৩-১০৫)। উপরুক্ত আয়াতে যা বুঝানো হয়েছে তা হলো, মানব জীবনের মূল লক্ষ্যকে ব্যর্থ করে দেয় সেক্যুলার ধ্যান-ধারণা। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে সেক্যুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সেরূপ ব্যর্থ মানুষদের সংখ্যাই বিপুল ভাবে বাড়িয়ে চলেছে।
শয়তান শুধু মহান আল্লাহতায়ালার দুষমন নয়, মানুষেরও সবচেয়ে বড় দুষমন। মহান আল্লাহতায়ারা পবিত্র কোরআনে সে সত্যটি বার বার শুনিয়েছেন। শয়তান শুধু হযরত আদম (আঃ) ও তাঁর বিবি হযরত হাওয়াকে জান্নাত থেকে বেরই করেনি, বরং দিবারাত্র কাজ করে যাতে তাঁর বংশধরগণ পুণরায় জান্নাতে ঢুকতে না পারে। সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা মূলত নাগরিকদের মহাক্ষতি সাধনের সে শয়তানি প্রকল্প। লক্ষ্য, পরকাল ব্যর্থ করে দেয়া। একাজে শয়তানের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো রাষ্ট্র এবং সে রাষ্ট্রের সরকার, প্রশাসন ও শিক্ষা-সংস্কৃতি। শয়তান তাই মসজিদ-মাদ্রাসার দখলদারী নিয়ে ততটা ভাবে না, যতটা ভাবে রাষ্ট্রের উপর দখলদারী নিয়ে। শেখ মুজিব রাষ্ট্রের উপর সে দখলদারী নিশ্চিত করতেই রাজনীতির অঙ্গণে ইসলামপন্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। হাসিনাও এগুচ্ছে সে পথ ধরে।
সেক্যুলার তথা অনৈসলামী রাষ্ট্রের বিপদটি তাই ভয়ানক। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার বাহনে। অথচ জাহান্নামমুখী সে জাহাজটির নির্মাণে ব্যয় হয় জনগণের নিজেদের অর্থ, শ্রম ও মেধা। শয়তান এভাবেই কইয়ের তেলে কই ভাজে। প্রতি দেশে বেঈমানদের প্রধান এজেন্ডা হলো, এ শয়তানী প্রকল্পকে সফল করা। অপর দিকে ঈমানদারদের উপর ঈমানী দায়ভারটি হলো, এ শয়তানী প্রকল্পের বিরুদ্ধে সর্বভাবে রুখে দাঁড়ানো। নইলে তাদের ঈমান বাঁচে না, পরকালও বাঁচে না। মুসলিমের জীবনে তো সেটাই জিহাদ। মু’মিনের তাকওয়া তো সে সামর্থ্যই বাড়ায়। পবিত্র কোর’আনে তাই বলা হয়েছে, “যারা ঈমানদার তাঁরা জিহাদ করে আল্লাহর রাস্তায়, আর যারা কাফের তারা লড়াই করে শয়তানের রাস্তায়। সুতরাং তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; শয়তানের কৌশল অতিদুর্বল।” -(সুরা নিসা, আয়াত ৭৬)। মুসলিম রাষ্ট্রে শাসকের বড় দায়িত্বটি হলো জিহাদের দায়ভার পালনে মু’মিনদের সংগঠিত করা ও সর্বভাবে সহায়তা দেয়া। এবং শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে জিহাদকে লাগাতর জারি রাখা। এবং যে রাষ্ট্রে যত জিহাদ সংগঠিত হয়, সে রাষ্ট্রের উপর মহান আল্লাহতায়ালার রহমতও তত বেশী নাযিল হয়। সেটি দেখা যায় অতীতের ইতিহাসে।
কেন জরুরি ইসলামী রাষ্ট্র
মাছের জন্য যেমন পানি, ঈমানদারের জন্য তেমনি হলো ইসলামী রাষ্ট্র। এ কারণেই অতীতে মুসলিমগণ যেখানেই ঘর গড়েছে, সেখানে ইসলামী রাষ্ট্রও গড়েছে। সে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় ও প্রতিরক্ষায় যখনই ডাক পড়েছে তখন সকল মুসলিমগণ ময়দানে নেমে এসেছে। জানমালের বিশাল কোরবানীও দিয়েছে। তাবুক যুদ্ধের সময় মুনাফিকগণ ছাড়া কোন সামর্থ্যবান মুসলিম পুরুষ তাই ঘরে বসে ছিল না। অন্য কোন জাতির জীবনে এমন ইতিহাস একটি বারের জন্যও নির্মিত হয়নি। মুসলিম জীবনে এটিই হলো সবচেয়ে বড় দায়িত্বশীলতা। কিন্তু অনৈসলামী রাষ্ট্রের প্রধান ষড়যন্ত্র হলো ঈমানদারের জীবন থেকে সে দায়িত্বশীলতাকে নির্মূল করা। মুসলিম জীবনে যে এমন একটি গুরুতর দায়ভার আছে -সেটিকেই ভূলিয়ে দেয়া। তাই যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র নাই সেখানে মসজিদ-মাদ্রাসা, নামায-রোযা বাড়লেও সে দায়িত্বশীলতা বাড়ে না। এবং সে দায়িত্বশীলতা না থাকার কারণেই মুসলিম দেশগুলিতে আজ জাতি, গোত্র, ভাষা, ভূগোল, দল ও নেতার নামে যুদ্ধ ও রক্তপাত বাড়লেও বাড়েনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদ। সাহাবায়ে কেরামের ধর্মপালন থেকে আজকের মুসলিমের ধর্মপালনে এখানেই বড় পার্থক্য। ফলে মুসলিমদের রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়লেও একখানি ইসলামী রাষ্ট্রও নির্মিত হয়নি। ফলে কোথাও প্রতিষ্ঠা পায়নি মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী বিধান। বরং মুসলিমদের শ্রম, মেধা, অর্থ ও রক্তের কোরবানিতে বিজয়ী হয়েছে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, সমাজবাদ, পুঁজিবাদ, স্বৈরতন্ত্র, সেক্যুলারিজমের ন্যায় নানা নামের ও নানারূপের জাহিলিয়াত। এবং গৌরব বেড়েছে নানা দল, গোত্র ও নেতার। আল্লাহ ও তাঁর মহান দ্বীনের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় বেঈমানী আর কি হতে পারে? মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সরকারের কাজ হয়েছে সে বেঈমানীকে লাগাতর বাড়ানো। মুসলিম ভূমিতে অনৈসলামী রাষ্ট্রগুলো তো বেঁচে থাকে সে বেঈমানীর উপর। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছাড়া এমন অকল্যাণ থেকে মুক্তি আছে কি? ১ম সংস্করণ ২২/০৬/২০১২; ২য় সংস্করণ ১০/০২/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018