ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ এবং বেঈমান শক্তির রাষ্ট্রীয় অসভ্যতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা ও মর্দে মু’মিনের জিহাদ        

বিশ্বজগতসহ সকল সৃষ্টিকূলের সৃষ্টিই মহান আল্লাহতায়ালার একমাত্র এজেন্ডা নয়, তাঁর এজেন্ডা রয়েছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সমগ্র মানব জাতিকে নিয়েও। প্রতিটি ব্যক্তি পরিণত হবে তাঁর অনুগত দাসে, রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পাবে একমাত্র তাঁর সার্বভৌমত্ব, এবং আদালতে প্রতিষ্ঠা পাবে একমাত্র তাঁর আইন। এবং ঈমানদার মাত্রই পরিণত হবে দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠার আমৃত্যু সৈনিকে এবং যুদ্ধ হবে একমাত্র তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে। এসবই তো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা। ঈমানদার হওয়ার লক্ষ্য তাই শুধু মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রাসূলদের উপর ঈমান আনা নয়। শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালনও নয়। বরং প্রকৃত ঈমানদারী হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচা। একমাত্র তখনই মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা এবং বান্দার এজেন্ডা একাকার হয়ে যায়। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণতো সেভাবেই বেঁচেছেন।

তাই বেঈমানী শুধু মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলকে অবিশ্বাস করা নয়, বরং তাঁর এজেন্ডাকে অবিশ্বাস করা ও সে এজেন্ডার সাথে একাত্ম না হওয়া। বহু অমুসলিমও আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে মহান আল্লাহতায়ালা, তাঁর রাসূল ও তাঁর কুর’আনকে। কিন্তু তাদের অপরাধটি অন্যত্র। বিশ্বাস থাকলেও তারা মহান আল্লাহতায়ার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচে না। বরং তাদের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহে দেখা যায় ইসলামকে পরাজিত রাখার এজেন্ডা। এটিই হলো শয়তানের এজেন্ডা। এবং নিরেট বেঈমানী হলো সেরূপ শয়তানী এজেন্ডা নিয়ে বাঁচা। এরূপ বেঈমানগণ নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করলে বুঝতে হবে তারা মুনাফিক।

নবীজী (সা:)’র যুগেও এমন মুনাফিকদের সংখ্যা নেহায়েত কম ছিল না। হাজারের মাঝে প্রায় তিনশত। তারা নবীজী (সা:)’র পিছনে নামাজ পড়েছে, রোজা রেখেছে, যাকাতও দিয়েছে। কিন্তু তারা মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদে নামেনি। তারা নিজেদের ঈমানদার রূপে দাবী করতো বিধায় তাদেরকে কাফির বলা হয়না। বরং মুনাফিক বলা হয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন উবাই ছিল তাদেরই একজন। মুসলিম দেশগুলিতে সে মুনাফিকদের সংখ্যাটিই বিপুল ভাবে বেড়েছে। মুসলিম দেশগুলি তাদের হাতেই অধিকৃত। তাদের বেঈমানীর কারণেই মুসলিম দেশগুলিতে শরিয়তী আইন আজ বিলুপ্ত; বিলুপ্ত হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব। এবং তাদের ভোট, অর্থ ও শ্রমে বিজয়ী হয়েছে আত্মস্বীকৃত ইসলামের শত্রুশক্তি।

মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচার কাজটি বিরান মরুভূমি বা বন-জঙ্গলে হয়না। এমন কি নিজ গৃহ, মসজিদ-মাদ্রাসা, সুফি খানকাহ, পীরের আখড়াতেও হয়না। কারণ পূর্ণ এজেন্ডা নিয়ে বাঁচাটি শুধু তাসবিহ পাঠ, কুর‌’আন পাঠ, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত নিয়ে বাঁচা নয়। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচতে হলে তাঁর সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তী আইন, তাঁর কুর’আনী জ্ঞান, প্যান-ইসলামিক ঐক্য,  দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ নিয়ে বাঁচতে হয়। সেগুলির প্রতিষ্ঠা ছাড়া পূর্ণ ইসলাম পালন এবং পূর্ণাঙ্গ মুসলিম রূপে বাঁচার কাজটি হয়না। সেগুলি প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য সহযোগী পরিবেশ চাই। সে জন্য চাই ইসলামী রাষ্ট্র। কারণ একমাত্র রাষ্ট্রই সৃষ্টি করে সেরূপ একটি সহায়ক পরিবেশ। এবং সেরূপ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য হলো জিহাদ। কিন্তু আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতার মূল কারণ তাদের কাছে দাড়িটুপি, পাগড়ি, নামাজ-রোজা, হ্জ্জ-যাকাত ও দোয়াদরুদ নিয়ে বাঁচা গুরুত্ব পেলেও গুরুত্ব পায়নি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচা। বরং বহু নামাজী, রোজাদার ও হাজী বাঁচে জাতীয়তাবাদী, স্বৈরাচারী, রাজতন্ত্রী ও সেক্যুলার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে।   

পানি ছাড়া মাছ বাঁচে না। তাই ডাঙ্গায় তুলা মাত্রই পানিতে ফিরার জন্য ছটফটানি শুরু করে। যতক্ষন প্রাণ থাকে, ততক্ষণ ছটফটানিও থাকে। ঈমানদারের জন্য তেমনি হলো ইসলামী রাষ্ট্র। ঈমানদারের  মাঝে সেরূপ ছটফটানি শুরু হয় যখন কোন অনৈসলামী রাষ্ট্রে বসবাসে বাধ্য করা হলে। সে রাষ্ট্র তখন ঈমানদারের কাছে কারাগার মনে হয়। যে এজেন্ডার জন্য মুমিনের বাঁচা-মরা -সে কাজটিই তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। মু’মিনের বাঁচার লক্ষ্য শুধু প্রাণে বাঁচা নয়, বরং মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের পূর্ণ আনুগত্য নিয়ে বাঁচা। একমাত্র পূর্ণ আনুগত্যই ঈমানদারকে গড়ে তোলে জান্নাতের যোগ্য রূপে। নইলে অনিবার্য হয় জাহান্নামে যাওয়া।

সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা হলো, যারা তাঁর নাযিলকৃত শরিয়তী আইন অনুযায়ী বিচার করে না তারা কাফির, তারা জালিম ও তারা ফাসিক। অনৈসলামিক রাষ্ট্রে বসবাসের বিপদ এজন্যই ভয়াবহ। কারণ সেরূপ রাষ্ট্রে অসম্ভব হয় শরিয়তের বিচার। বাঁচতে হয় কাফিরদের প্রণীত আইনের বিচার মেনে নিয়ে -যেমনটি বাংলাদেশে হচ্ছে। তাছাড়া মু’মিনের উপর আরো ফরজ হলো, তাকে বাঁচতে হয় মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জিহাদ নিয়ে। কিন্তু অনৈসলামিক রাষ্ট্রে সেটিও সম্ভব নয়। কারণ সে রাষ্ট্রে জিহাদের অনুমতি থাকে না। অনৈসলামিক রাষ্ট্রে বসবাসের বিপদ এজন্যই ভয়াবহ। তখন শাস্তি পেতে হয় মহান আল্লাহতায়ালা নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের। মু’মিনের মাঝে এজন্যই ছটফটানি শুরু হয় ইসলামী রাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার। সেরূপ একটি রাষ্ট্র না থাকলে জিহাদে শুরু হয় সেরূপ একটি রাষ্ট্র নির্মাণের। অনৈসলামিক রাষ্ট্রে বসবাসের পাপমোচন তো একমাত্র সে পথেই সম্ভব। সেরূপ রাষ্ট্র নির্মাণের তাড়না না থাকাটিই চরম বেঈমানী।   

 

জিহাদের অর্থ

প্রতিটি ধর্ম ও মতবাদের নিজস্ব পরিভাষা থাকে। “জিহাদ” হলো ইসলামের নিজস্ব পরিভাষা। এটি এমন এক অনন্য শব্দ -যা সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কুর’আন বার বার উল্লেখ করেছেন। অন্য কোন ধর্মে জিহাদের সমার্থক কোন শব্দ নাই। এটি এমন এক কুর’আনী jargon -যার অর্থ বুঝতে হলে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান থাকা জরুরি। তাছাড়া সেটি যথার্থ ভাবে বুঝতে ব্যক্তিকে অবশ্যই ঈমানদার হতে হয়। যেমন চিকিৎসার শাস্ত্রের jargon বুঝতে ডাক্তার হতে হয়; বিশেষ এ শব্দগুলির অর্থ সাধারণ মানুষ বুঝে না।

“জিহাদ” শব্দের তরজমা অসম্ভব। জিহাদ’য়ের অর্থ অনেকে চেষ্টা, প্রচেষ্টা ও লড়াই রূপে বুঝেন। জিহাদ’য়ের সেটি পূর্ণাঙ্গ অর্থ নয়। জিহাদের সঠিক অর্থ বুঝতে হলে জিহাদের ব্যাখ্যাটি সরাসরি পবিত্র কুর’আন থেকে গ্রহণ করতে হয়। এজন্যই জিহাদ শব্দটি বাংলা, উর্দু, ফার্সি, তুর্কি, ইংরেজীসহ বিশ্বের তাবত ভাষার শব্দমালাতে “জিহাদ” রূপেই শামিল হয়েছে; শাব্দিক তরজমা রূপে নয়। বাংলা, উর্দু, ফার্সি ও তুর্কি ভাষাতে আরবী শব্দ ছালাত’য়ের তরজমা নামায এবং সিয়াম’য়ের তরজমা রোযা অধিক প্রচলিত। সাধারণ মানুষের মাঝে কুর’আনী পরিভাষা ছালাত ও সিয়ামের তেমন ব্যবহার নাই। কিন্তু তাতে ছালাত ও সিয়ামের গুরুত্ব কমেনি। কিন্তু এ ভাষাগুলিতে জিহাদ শব্দটি জিহাদ রূপেই রয়ে গেছে। মুসলিম বিজ্ঞজনেরা এর তরজমা করার প্রয়োজন বোধ করেননি।

জিহাদ শব্দটির তরজমা অসম্ভব হওয়ার কারণ, জিহাদের মধ্যে দিয়ে একটি পবিত্র দর্শন, একটি পবিত্র এজেন্ডা এবং একটি পবিত্র তাড়না কথা বলে। সে দর্শন, সে এজেন্ডা ও সে তাড়নাটি না বুঝলে জিহাদের অর্থ বুঝা অসম্ভব। জিহাদের শাব্দিক তরজমা করলে সে শব্দের মাঝে সে দর্শন, এজেন্ডা ও তাড়নার প্রকাশ ঘটানো যায়না। জিহাদের দর্শনটি হলো পবিত্র কুর‌’আনের, জিহাদের এজেন্ডাটি মহান আল্লাহতায়ালার এবং জিহাদের তাড়নাটি ঈমানদারের। জিহাদের এজেন্ডাটি মহান আল্লাহতায়ালার হওয়ার অর্থ হলো, জিহাদকে অবশ্যই পরিচালিত হতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা লক্ষ্যে। এজন্যই পবিত্র কুর’আনের অধিকাংশ স্থানে জিহাদ শব্দটি একক শব্দ রূপে ব্যবহৃত হয়নি, ব্যবহৃত হয়েছে ‍“জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহি” তথা আল্লাহর পথে জিহাদ রূপে। জিহাদ হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার সর্বাত্মক লড়াই। সেটি যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক হতে পারে, তেমন অস্ত্রেরও হতে পারে।  তবে শুরুটি বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে।  বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের মূল হাতিয়ারটি হলো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান।

 

জিহাদের দর্শন

জিহাদের মাঝে কাজ করে যে প্রবল দর্শন -সে দর্শনের উৎস হলো পবিত্র কুর’আন। সে দর্শনের পিছনে কাজ করে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি দায়বদ্ধতার চেতনা। সেটি হলো তাঁর পবিত্র এজেন্ডা পূরণে অর্থ, শ্রম, মেধা ও প্রাণের বিনিয়োগ। সে বিনিয়োগের পিছনে কাজ করে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে সম্পাদিত মু’মিনের এমন এক ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি -যার উল্লেখ এসেছে সুরা তাওবার ১১১ নম্বর আয়াতে। মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু কালেমা পাঠ এবং নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন নয়, বরং সে পবিত্র চুক্তিনামাতে স্বাক্ষর করা এবং সে চুক্তির শর্তগুলিকে চেতনায় সদাসর্বদা ধারণ করে বাঁচা। সে চুক্তিনামা অনুযায়ী মুমিন তাঁর জান ও মাল বিক্রয় করবে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এবং বিনিময়ে ক্রয় করবে জান্নাত। তবে লক্ষণীয় হলো, ক্রয়ের পর মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর সে ক্রয়কৃত জান ও মাল নিজের কাছে তুলে নেন না, বরং মুমিনের কাছেই আমানত রূপে রেখে দেন। সেটি এ শর্তে যে, তাঁর ক্রয়কৃত জান ও মালের বিনিয়োগ হবে একমাত্র তারই এজেন্ডাকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে।

মানব জীবনে সবচেয়ে বড় গাদ্দারী এবং সে সাথে বড় অপরাধটি সংঘটিত হয় তখন, যখন মহান আল্লাহতায়ালার ক্রয়কৃত সে জান ও মালকে বিনিয়োগ করা হয় শয়তানের এজেন্ডা পূরণে তথা ইসলামকে পরাজিত করার রাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহে। সে গাদ্দারীর অপরাধ ব্যক্তিকে জাহান্নামে হাজির করে। তখন তার নামাজ-রোজা ও  হজ্জ-যাকাত কাজ দেয়না -যেমন কাজে লাগেনি নবীজী (সা:)’ পিছনে আদায় করা আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের নামাজ। সাহাবাগণ এবং গৌরব যুগের মুসলিমগণ সে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির শর্ত পালনে ইতিহাস গড়েছিলেন। ইসলামের বিজয় এবং ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। তাদের সে কুরবানীর ফলে পৃথিবীর বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন। অথচ আজকের মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে সে চুক্তির সাথে গাদ্দারীতে। সে গাদ্দারীর নমুনা হলো, মুসলিমগণ আজ আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদে নাই। ফলে বিশ্বের কোথাও প্রতিষ্ঠা পায়নি মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন।     

আগুন থেকে তার উত্তাপকে কখনোই পৃথক করা যায় না। আগুন থাকলে উত্তাপ থাকবেই। তেমনি মু’মিন ব্যক্তি থেকে তাঁর জিহাদকে কখনোই পৃথক করা যায় না। ঈমান থাকলে জিহাদও থাকে। জিহাদের মধ্যেই ঈমানের প্রকাশ। কারণ, তাঁর চেতনায় কাজ করে মহান আল্লাহতয়ালার সাথে কৃত তাঁর জান-মালের বিক্রয়ের চুক্তিনামা। সেটি পরিণত হয় তাঁর ঈমানের অবিচ্ছেদ্দ অংশে। একমাত্র ঈমানের বিলুপ্তিতেই বিলুপ্ত হয় তার চেতনা থেকে সে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির স্মৃতি। সে স্মৃতি-বিলুপ্তির ফলে বিলুপ্তি ঘটে জিহাদের প্রতি দায়বদ্ধতারও। ঈমানের দাবী সূদখোর, ঘুষখোর, মিথ্যাবাদী, সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী, স্বৈরাচারীগণও করতে পারে। কিন্তু তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়, ঈমানের অর্থ শুধু আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস নয়। ঈমানের দাবীতে একমাত্র তারাই সত্যবাদী -যাদের মাঝে রয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার পথে তথা তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ।  মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। অর্থাৎ জিহাদ না থাকার অর্থ ঈমান না থাকা।    

 

জিহাদ কেন সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত?

জিহাদ ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জিহাদ কেন সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত? সেটি ভাববার বিষয় এবং তা থেকে শিক্ষা নেয়ার বিষয়ও। যে কোন ইবাদতের শ্রেষ্ঠত্ব যাচাই হয় তার কল্যাণের সামর্থ্য থেকে। পথ থেকে একটি কাঁটা সরানোও ইবাদত। কারণ তাতে জনগণের কল্যাণ থাকে। কিন্তু সে কল্যাণটি রাষ্ট্রের বুক থেকে জালেম শাসক সরানোর কল্যাণের সমান নয়। কোটি কোটি মানুষের কালেমা পাঠ, কুর’আন তেলাওয়াত এবং তাদের নামাজ -রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালনে সমাজ থেকে দুর্বত্তির নির্মূল ঘটে না। এবং তাতে ইসলামের বিজয়ও আসে না। এমন কি যে ব্যক্তিটি নিজেকে নামাজী, রোজাদার বা হাজী রূপে জাহির করে, সে ব্যক্তিটি ঘুষখোর, সূদখোর, মিথ্যাবাদী এবং শেখ হাসিনার ন্যায় নৃশংস স্বৈরাচারীও হতে পারে। ঈমানের দাবীদার সে ব্যক্তিটি চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত, জালেম এবং খুনিও হতে পারে।

কিন্তু জিহাদের কল্যাণটি বিশাল। এটি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রকে দুর্বৃত্তিমক্তু ও পবিত্রতম করার একমাত্র হাতিয়ার। মুজাহিদদের জিহাদে ও তাদের কুরবানীতে পৃথিবী পৃষ্ঠে বিজয়ী হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা। নির্মিত হয় ইসলামী রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠা পায় শরিয়তী আইনের বিচার। একমাত্র জিহাদের মধ্য দিয়েই দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ঘটে। জিহাদের মধ্য দিয়ে এভাবেই সভ্য রাষ্ট্র ও উচ্চতর সভ্যতা নির্মিত হয়। এবং নিরাপত্তা পায় জনগণের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরু। তখন সে রাষ্ট্রে উপযোগী পরিবেশ গড়ে উঠে পূর্ণ ইসলাম পালনের।

নামাজ-রোজা এবং হজ্জ-যাকাতও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রে এ ইবাদতগুলি কখনোই জিহাদের সমকক্ষ নয়। জিহাদ নিয়ে বাঁচার কারণেই গৌরব যুগের মুসলিমগণ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছিলেন এবং অর্জন করেছিলেন বিশ্বশক্তির মর্যাদা। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রই হলো সে লক্ষ্য অর্জনে একমাত্র হাতিয়ার। আজ মুসলিমদের মাঝে লাখ লাখ মসজিদ-মাদ্রাসা আছে, বহু কোটি নামাজী-রোজাদারও আছে। বহু লক্ষ আলেম, ইমাম ও মোহাদ্দাসও আছে। কিন্তু তাদের চেতনায় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে নিজ জান-মাল বিক্রয়ের সে পবিত্র স্মৃতি কাজ করেনা। একারণে তাদের জীবনে জিহাদ থাকেনা। এবং জিহাদ না থাকাতে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা এবং তাঁর শরিয়তী আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার লক্ষ্যে নির্মিত হয়নি কোন ইসলামী রাষ্ট্র।  সেরূপ একটি রাষ্ট্র নির্মিত না হওয়ার ফল হলো, মুসলিমগণ আজ স্বাধীনতাহীন, নিরাপত্তাহীন ও ইজ্জতহীন। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ভারত, আরকান ও উইঘুরের মুসলিমগণ এজন্যই আজ এতোটা অসহায়। তাদের পাশে দাঁড়ানোর মত কোন শক্তিশালী রাষ্ট্র নাই।     

 শয়তানের এজেন্ডা এবং বেঈমানের এজেন্ডা

ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে শয়তানের সুস্পষ্ট এজেন্ডা রয়েছে। শয়তানের সে এজেন্ডাটি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে ব্যর্থ করার। সেটি যেমন তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের বিলুপ্তি, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে ব্যর্থ করার। সে সাথে এজেন্ডা হলো মুসলিম জীবন থেকে জিহাদ বিলুপ্তির। বেঈমান বাঁচে শয়তানের সে এজেন্ডার সাথে পুরোপুরি একাত্ম হয়ে। সে এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বেঈমানের জীবনে লাগাতর যুদ্ধও থাকে। বেঈমানের সে যুদ্ধটি হলো নিরেট সন্ত্রাস। সন্ত্রাসের আভিধানিক অর্থ হলো, রাজনৈতিক স্বার্থে অস্ত্রের ব্যবহার। লক্ষ্য এখানে ত্রাস সৃষ্টি।

রাজনীতি সবার জীবনেই থাকে। কিন্তু সে রাজনীতির লক্ষ্য যদি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা হয় -তখন সেটি আর নিছক যুদ্ধ থাকে না, সেটি পরিণত হয় মহান আল্লাহতায়ালার পথে পবিত্র জিহাদে তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতে। এবং জিহাদের এ অঙ্গণ থেকেই মহান আল্লাহতায়ালা শহীদদের বেছে নেন -যার উল্লেখ এসেছে সুরা আল ইমরানের ১৪০ নম্বর আয়াতে। আর জিহাদ ভিন্ন প্রতিটি যুদ্ধই হলো শয়তানের প্রকল্প। এবং সে যুদ্ধগুলির প্রতিটিই হলো নির্ভেজাল সন্ত্রাস। এবং সে সন্ত্রাসের প্রতিটি পথই হলো জাহান্নামে পথ। এ পথে যারা নিজেদের জান, মাল, শ্রম ও মেধার বিনিয়োগ করে -তারা নিশ্চিত জাহান্নামে যায়। অথচ অতি পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম দেশে অধিকাংশ মানুষ চলছে এবং সবচেয়ে বেশী বিনিয়োগ হচ্ছে জাহান্নামে এ পথে। সেটি সুষ্পষ্ট বুঝা যায় এজন্যই স্বৈরাচারী দেশগুলির রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের দিকে নজর দিলে।   

বাংলাদেশের ইতিহাসে যারা সবচেয়ে নৃশংস সন্ত্রাসীগণ মহল্লার চোর-ডাকাত, পেশাদার খুনি, সন্ত্রাসী দলের গুন্ডারা নয়। বরং সে ভয়ংকর সন্ত্রাসী শক্তি হলো জনগণের রাজস্বের অর্থে প্রতিপালিত রাষ্ট্রীয় অস্ত্রধারীরা। বাংলাদেশে এরা হলো পুলিশ, ডিবি, RAB, বিজিবি এবং সেনা বাহিনীর লোকেরা। সভ্য দেশে জনগণ রাজস্ব দিয়ে অস্ত্রধারীদের প্রতিপালন দেয় এ জন্য যে, সেগুলি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার নিরাপত্তা দিবে এবং সে সাথে জনগণের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর প্রতিরক্ষা দিবে। কিন্তু রাষ্ট্র যখন সন্ত্রাসী শক্তির হাতে অধিকৃত হয়, তখন রাষ্ট্রীয় এজেন্ডাই পাল্টে যায়। জনগণের অর্থে প্রতিপালিত এ সশস্ত্র ব্যক্তিগণ তখন ব্যবহৃত হয় জনগণের বিরুদ্ধে গুম, খুন, নির্যাতন ও অপহরণের কাজে। তাদের এজেন্ডা হয়, স্বৈরাচারী সরকারের গদীর সুরক্ষা দেয়া। এরূপ স্বৈরাচারী সরকার মাত্রই অসভ্য সন্ত্রাসী।  

 

রাষ্ট্র যখন অসভ্যতার হাতিয়ার

সভ্য রাষ্ট্রের সরকার মাত্রই জনগণের সেবক, অথচ স্বৈরশাসক মাত্রই গণশত্রু। তাদের হাতে রাষ্ট্র পরিণত হয় অসভ্যতার হাতিয়ারে। জনগণের বিরুদ্ধে তাদের শত্রুতার নজির হলো, তারা জনগণের রায়ের তথা ভোটের ইজ্জত দেয় না। কেড়ে নেয় তাদের কথা বলা ও মিটিং-মিছিলের স্বাধীনতা। বাংলাদেশে তেমন একটি অসভ্য সরকারের প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে জনগণের ভোটের উপর ডাকাতি করে। এটি ছিল রাষ্ট্রের উপর অসভ্য ডাকাতি। মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে কোন ডাকাত দল কি এতো বড় ডাকাতি কোথাও করতে পেরেছে? অথচ সে ডাকাতি বাংলাদেশে হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন ডাকাতগণ তা নিয়ে উৎসবও করে। তাই যে অসভ্য অপরাধের মধ্য দিয়ে একটি সন্ত্রাসী সরকারের জন্ম, সেরূপ অপরাধ করাই এ সরকারের নীতি। সে সন্ত্রাসের শিকার হলো বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণ। যে কোন দেশ এরূপ অসভ্য  শাসকগণই হলো ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণের ন্যায় মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্য কর্মে এসব ডাকাতদের রুচি থাকে না। তারা জানে, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণের অর্থই হলো, স্বৈর-শাসনের বিলুপ্তি। তখন স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তদের আদালতে তোলা হবে অপরাধী রূপে। তাই তাদের নিরন্তর যুদ্ধটি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সৈনিকদের বিরুদ্ধে।      

২০১৩ সালের ৫ই মে’র রাতে শাপলা চত্বরে নিরপরাধ মানুষ হত্যার যে নৃশংস তাণ্ডবটি সংঘটিত হলো -সেরূপ গণহত্যার সামর্থ্য কি দেশের পেশাজীবী চোর-ডাকাত, খুনি ও সন্ত্রাসীদের আছে? বাংলাদেশে সেরূপ সন্ত্রাসের সামর্থ্য তো একমাত্র অসভ্য শাসক শক্তির। ঐ রাতে সে সামর্থ্যের নৃশংস প্রয়োগ হয়েছে হিফাজতে ইসলামীর মুসল্লীদের বিরুদ্ধে -যারা সেখানে শান্তিপূর্ণ ভাবে ধর্ণা দিচ্ছিল। কথা হলো, একটি দেশে সন্ত্রাসী শক্তির শাসন থাকবে অথচ সন্ত্রাসী গণহত্যা থাকবে না -সেটি কি কখনো ভাবা যায়? হিংস্র পশু থেকে শুধু হিংস্রতাই আশা করা যায়, তেমনি স্বৈরাচারী সরকার থেকে শুধু সন্ত্রাসই আশা করা যায়। তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যেমন হালাকু, চেঙ্গিজ, হিটলার ও শেখ মুজিবের আমলে হয়েছে -তেমনি আজ হচ্ছে শেখ হাসিনার আমলে। কারণ, পুরনো স্বৈরশাসকগণ কবরেও গেলেও সে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নব্য নৃশংসতা পেয়েছে নতুন স্বৈর শাসকদের হাতে। তাই যে নৃশংস গণহত্যা ২০১৩ সালের ১৪ই আগষ্ট কায়রোর রাবা আল আদাবিয়ার ময়দানে ঘটেছে -সেটি হিটলারের আমলে কোন জার্মান নগরীর গণ-জমায়েতে ঘটেনি। মিশরের স্বৈরশাসক জেনারেল আবুল ফাতাহ সিসির নির্দেশে সেখানে প্রায় ১২০০ নিরস্ত্র মানুষকে সেনাবাহিনী কামান দেগে হত্যা করেছিল এবং আহত করেছিল বহু হাজারকে। নিহত ও আহতের মাঝে নারী, শিশুও ছিল। তাদের অপরাধ, সেখানে বসে তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। সে প্রতিবাদটি ছিল মিশরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে। একই রূপ নৃশংস রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জনগণের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালীন যুদ্ধে পরিণত হয়েছে সিরিয়াতে। সেখানে প্রায় ৬ লাখের বেশী মানুষকে হত্যা এবং ৬০ লাখের বেশী মানুষকে ঘরছাড়া করা হয়েছে।  

 

অসভ্যতা ও অপরাধ কর্ম যখন সংস্কৃতি

স্বৈরশাসকের হাতে কোন দেশ অধিকৃত হলে অসভ্যতা ও অপরাধকর্ম তখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। সে দেশের পুলিশ, সীমান্ত রক্ষী ও সেনা বাহিনীর ন্যায় সকল সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা পরিণত হয় স্বৈরশাসকের চাকর-বাকরে। তারা ব্যবহৃত জনগণের বিরুদ্ধে বিরামহীন যুদ্ধে তথা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। রাষ্ট্র তখন জুলুম, নির্যাতন, গুম, খুন, অপহরণের ন্যায় নানারূপ অপরাধ কর্মের হাতিয়ারে পরিণত হয়। বাংলাদেশে সেরূপ অপরাধ কর্মের এক রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শেখ হাসিনার সন্ত্রাসী শাসনে। কয়েক বছরে আগে তারই একটি সচিত্র প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরেছিল আল-জাজিরা টিভির ইংরাজী বিভাগ “All the Prime Minister’s Men‍” এ শিরোনামায়। সেটি আজও যে কেউ “ইউ টিউব”য়ে দেখতে পারে। মানব সভ্যতার যত ক্ষয়-ক্ষতি বন্য জন্তু-জানোয়ারের হাতে হয়েছে, দেশে দেশে তার চেয়ে বহু গুণ বেশী হয়েছে স্বৈরশাসকের হাতে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তখন স্রেফ ভোট ডাকাতি, মানবাধিকার হনন ও গণতন্ত্র হত্যায় সীমিত থাকে না। বরং তার বীভৎস রূপটি প্রকাশ পায় খুন, গুম, গণ-গ্রেফতারি, ধর্ষণ, অত্যাচার, ব্যাংক লুট, শেয়ার মার্কেট লুট, সরকারি ট্রেজারির সঞ্চয় লুট, সরকারি প্রজেক্টের অর্থলুট এবং নানাবিধ অপরাধ কর্মের মধ্য দিয়ে।

সম্প্রতি (ডিসেম্বর, ২০২৩ সাল) Centre for Policy Dialogue (CPD)’র এক গবেষণা নিবন্ধে তথ্য পেশ করা হয়েছে, বিগত ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল অবধি এ‌ই ১৫ বছর ৯২ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশের ব্যাংকগুলি থেকে ভূয়া নামে ভূয়া প্রজেক্ট দেখিয়ে ডাকাতি করে  নেয়া হয়েছে। একমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকে লুট হয়ে গেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাংলার মানুষ এরূপ জঘণ্য কু-শাসন কি আর কোন কালে দেখেছে? লক্ষণীয় হলো, ডাকাতির পূর্বে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারী ব্যাংক ছিল ইসলামী ব্যাংক। এ ব্যাংকের উপর ডাকাতিকে বাধাহীন করার লক্ষ্যে সরকার ব্যাংকটির পরিচালকদের সরিয়ে পূর্ণ দখলদারী প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে।  প্রধানমন্ত্রীর আসনে একজন ডাকাত বসে থাকলে সর্ব প্রকারের অপরাধ কর্মে অপরাধীগণ পায় তাদের অপরাধ কর্মকে নির্ভয়ে চালিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স। বাংলাদেশে তো সেটিই নির্ভয়ে হচ্ছে।

সন্ত্রাসী স্বৈর-সরকারের এজেন্ডা একটিই। সেটি হলো স্রেফ নিজেদের কুশাসনকে টিকিয়ে রাখা। নিরস্ত্র জনগণের উপর দখলদারী জমাতে স্বৈরাচারী সরকারের মূল অস্ত্র হলো মিথ্যার জোয়ার ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। নিজেদের অপরাধ লুকাতে চোর-ডাকাতেরা সভ্য মানুষের বেশ ধরে রাস্তায় নামে এবং গোপন রাখে আপন পরিচয়কে। তেমনি সন্ত্রাসী এবং স্বৈরাচারী সরকারও নিজেদের সন্ত্রাসী ও স্বৈরাচারী বলে না। জনগণের ভোটের অধিকার, মিছিল-মিটিং ও মত-প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার পরও নিজেদেরকে গণতন্ত্রী বলে বড়াই করে। এবং সন্ত্রাসী ও জঙ্গী বলে স্বৈরাচার-বিরোধী নিরস্ত্র নাগরিকদের। এটি ডাকাতদের পক্ষ থেকে গৃহস্থ্যকে ডাকাত বলার মত। এভাবে তারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তও করছে। তাই প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, সন্ত্রাস কাকে বলে এবং স্বৈরাচারই কাকে বলে -সে বিষয়গুলি মোটা দাগে পরিস্কার করা।  

যেখানেই ত্রাসের সাথে রাজনীতির মিশ্রণ -সেটিই হলো সন্ত্রাস। ত্রাস সৃষ্টির কাজে ব্যবহৃত হয় অস্ত্র। শক্তির তথা অস্ত্রের প্রয়োগ স্রেফ অর্থ লাভের লক্ষ্যে হলে এবং তাতে রাজনীতি না থাকলে -সেটি হলো নিছক ডাকাতি। ডাকাতি ও সন্ত্রাস -উভয়ই তাই পরস্পরের সহোদর। পার্থক্যটি হলো: ডাকাত অর্থ ছিনতাই করে; আর সন্ত্রাসী ছিনতাই করে জনগণের স্বাধীনতা, মানবিক অধিকার এবং ভোট। ভোট ছিনতাইয়ের অপরাধে তাদেরকে ভোট-ডাকাতও বলা হয়। সন্ত্রাস কখনোই খালি হাতে হয় না। এজন্য অপরিহার্য হলো অস্ত্র। কারণ, অস্ত্রের প্রদর্শণী ও প্রয়োগ ছাড়া মানুষকে ভয় দেখানো যায় না; ফলে ত্রাসও সৃষ্টি করা যায় না। তাই রাজনৈতিক দলের নিরস্ত্র কর্মী বা নাগরিককে সন্ত্রাসী বলাটি গৃহস্থ্যকে ডাকাত বলার মত।

দেশের অস্ত্রের বড় বড় ভাণ্ডারগুলি কোন ব্যক্তির ঘরে, মসজিদ-মাদ্রাসায় বা রাজনৈতিক দলের অফিসে থাকে না। সে গুলি থাকে তো সেনানীবাসে ও পুলিশ ফাঁড়িতে। ফলে সে অস্ত্রের মালিক সরকার। সরকার স্বৈরাচারী হলে, সে অস্ত্রের প্রয়োগ অবাধে হয় জনগণের বিরুদ্ধে। সেটি করা হয় অবৈধ সরকারের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। অথচ গণতান্ত্রিক সরকারের সে প্রয়োজন থাকে না; নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার বেঁচে থেকে জনগণের সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে। কিন্তু যে সরকার সংসদের ১৫৩ সিট থেকে কোন ভোটই নিল না এবং যে সব সিটে নির্বাচন হলো সেখানে শতকরা ৫ জন ভোটারও ভোট দিল না –এমন একটি সরকার তো জন্ম থেকেই অবৈধ।  ২০১৪ সালের নির্বাচনে তো সেটিই হয়েছে। ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে ডাকাতী হয়ে যায়। ২০২৪ সালেও নির্বাচনের নামে প্রহসন হলো। এ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর জন্য নির্বাচনের রাজনীতিতে অংশ নেয়ার কোন সুযোগই রাখা হয়নি।

এরূপ অবৈধ সরকারের জন্ম কখনোই ভোটে হয় না, হয় অস্ত্রের ঔরসে। এজন্যই শেখ হাসিনার সরকার একটি নিরেট অবৈধ সরকার। এটি ডাকাত সরকার। এমন সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বনটি হলো অস্ত্রের প্রয়োগ। এমন প্রতিটি অবৈধ সরকার যেমন স্বৈরাচারী হয়, তেমনি অসভ্য ও সন্ত্রাসীও হয়। অপর দিকে নিরস্ত্র হওয়ার কারণে স্বৈরাচার-অধিকৃত রাষ্ট্রের কোটি কোটি নাগরিক পরিণত হয় অসহায় জিম্মিতে। সন্ত্রাসের সে অপ্রতিরোধ্য সামর্থ্যের কারণেই নগণ্য সংখ্যক ইংরেজের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল বিশাল ভারতের উপর ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন। বাংলাদেশের স্বৈরশাসকেরা দেশকে দখলে রাখার ক্ষেত্রে ইংরেজ স্বৈরশাসকদের সে ঔপনিবেশিক রীতিরই প্রয়োগ করে চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *