ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on November 20, 2020
- Bangla Articles, ইসলাম
- No Comments.
বিদ্রোহ আল্লাহর বিরুদ্ধে
জাতির পরাজয় এবং বিপর্যয়ের কারণগুলি বহুবিধ। তবে শুরুটি হয় জনগণের চিন্তা-চেতনা থেকে। হাত-পায়ে যত শক্তিই থাক, মগজ হুশ হারালে দেহও শক্তিহীন হয়। তেমনি অবস্থা একটি জাতির। অতীতে মুসলিমগণ যখন বিজয়ের পর বিজয় এনেছিল এবং দ্রুত প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বিশ্বশক্তি রূপে -তখন তাদের হাতে তেল-গ্যাস ও বিশাল জনশক্তি ছিল না। হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসাও ছিল না। কিন্তু মুসলিম নারী-পুরুষের চেতনায় সুস্থ্যতা ছিল। জীবনের মিশন নিয়ে পূর্ণ সচেতনতা ছিল। সে সুস্থ্যতা ও সচেনতার মূল ভিত্তিটি ছিল ঈমান এবং কোরআনী জ্ঞান। কিন্তু আজ সে সচেতনতা প্রায়ই বিলুপ্ত। চেতনার সে বেহাল অবস্থাটি প্রকাশ পাচ্ছে মুসলিমদের ধর্ম-কর্ম, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আচার-আচরণে। ফলে ব্যর্থ হচ্ছে ফরজ দায়িত্ব পালেন। এরই প্রমাণ, তারা ব্যর্থ হয়েছে ঐক্যবদ্ধ হতে। ব্যর্থ হয়েছে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে। পূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার বদলে প্রায়োরিটি পাচ্ছে ভাষা, অঞ্চল, দেশ, মজহাব ও ফেরকার পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠা। এভাবে গড়ছে আত্মঘাতী বিভক্তি। পৃথিবীতে আজ ৫৭টি মুসলিম দেশ; উড়ছে ৫৭টি জাতীয় রাষ্ট্রের পতাকা। কিন্তু কোথাও কি উড়ছে ইসলামের পতাকা? বরং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নৃশংস স্বৈরাচার ও রাজতন্ত্র; পদদলিত হচ্ছে মৌলিক মানবিক অধিকার। এবং জোয়ার এসেছে কুফরি আইন-কানূন, সূদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, পতিতাবৃত্তির ন্যায় পাপাচারের।
হুশ হারালে ভাবনার ও মাতমের সামর্থ্য থাকে না। ফলে ইসলামের পরাজয়ের পরও মুসলিমদের মাঝে মাতম নেই। চিন্তা-ভাবনাও নাই। নেতৃবর্গ ব্যস্ত নিজেদের স্বার্থ হাসিল, দলের বিজয় ও গদি দখল নিয়ে। অপরদিকে জনগণও বসে নাই; তারা ব্যস্ত নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে। নিজেদের কাজকর্ম, ধর্মপালন, রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রশাসন এবং আইন-কানূনের মধ্যেও যে মহান আল্লাহতায়লার এজেন্ডা থাকে এবং সে এজেন্ডার বাস্তবায়নে প্রতিটি ঈমানদারের যে ঈমানী দায়বদ্ধতা থাকে -সে হুশই বা ক’জনের। বরং বিচ্যুতি এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, বিস্মৃতির পাশাপাশি প্রশ্ন তোলা হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে। বিতণ্ডা উঠছে খোদ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে। অনেকেরই দাবী, কোর’আন নাযিলের লক্ষ্য ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়, বরং সেটি ব্যক্তির ইসলাহ ও আত্মীক পরিশুদ্ধি। অথচ তারা ভূলে যায়, পবিত্র কোরআনে বহু আয়াত নাযিল হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার আইন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়ে। শরিয়তের আইন না মানলে পবিত্র কোর’আনে তাকে কাফের, জালেম ও ফাসেক বলা হয়েছে। এবং ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা না দিলে শরিয়তের প্রতিষ্ঠাই বা কীরূপে সম্ভব? সাহাবী কেরামদের জানমালের বিশাল ভাগ ব্যয় হয়েছে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এবং সে রাষ্ট্রে আল্লাহর এজেন্ডা বাস্তবায়নে। শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবী সে কাজে শহীদ হয়েছেন। নবীজী (সাঃ)কে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং তিনি নিজেও আহতও হয়েছেন। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ। যে কোন বিদ্রোহ ও অবাধ্যতাই হলো কুফরি। সে অবাধ্যতাটি যেমন নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত পালনে হতে পারে তেমনি হতে পারে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অঙ্গণও। এর চেয়ে বড় অবাধ্যতা আর কি হতে পারে, মুসলিমগণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো এবং সে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা দিল কাফেরদের প্রণীত আইন? এবং মহান আল্লাহতায়ালার বদলে নিজেরাই আইনপ্রণেতা হয়ে বসলো। এটি তো তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতার উপর হামলা। এ কাজ তো কাফের, জালেম ও ফাসেকের।
ব্যক্তির জীবনে বড় রকমের পরিশুদ্ধি কখনোই ভাবনাশূণ্য অলস জীবনে আসে না। পরিশুদ্ধিটি তখন আসে যখন জীবন কাটে অর্থ, শ্রম, মেধা এবং জানের কোরবানীর মধ্য দিয়ে। এবং সেটি ঘটে মহান আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদে। এ জন্যই যে জনগণের মাঝে জিহাদ নাই, সে জনপদে নামায-রোযা, হজ-যাকাত যতই থাক, চরিত্র ও কর্মে তাদের মাঝে পরিশুদ্ধি আসে না। ইসলামী রাষ্ট্রও গড়ে উঠে না। বরং মুসলিম দেশ তখন ইতিহাস গড়ে দুর্নীতিতে। “সামেয়’না ওয়া তায়া’না” অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম শুনলাম এবং মেনে নিলাম –আত্মার এমন ধ্বনিটি মূলত পরিশুদ্ধ আত্মার। পরিতাপের বিষয়, মুসলিম সমাজে তেমন একটি স্বতঃস্ফুর্ততা বিলুপ্ত হয়েছে। বরং “শুনলাম এবং বিদ্রোহ করলাম” –সেটিই আজ রীতিতে পরিণত হয়েছে। মূলত সে বিদ্রোহের উপরই প্রতিষ্ঠিত আজকের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সংবিধান, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি। ফলে মুসলিম দেশে মহা-পরাক্রমশালী আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বদলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে জনগণের সার্বভৌমত্ব। এবং নর্দমায় গিয়ে পড়েছে শরিয়তী আইন, খেলাফতী শাসন ও বিশ্বমুসলিম ভাতৃত্ব। উদ্ধতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে খোদ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। এর চেয়ে বড় শিরক আর কি হতে পারে? শিরকের গুনাহ কি কখনো মাফ হয়?
বিতর্ক ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিয়ে
ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এখন আর শুধু মুসলিম নামধারী সেক্যুলারিস্টদের মাঝে সীমিত নয়; অনাগ্রহ ও বিতণ্ডা শুরু হয়েছে আলেম সমাজ ও ইসলামী দলগুলোর মধ্যেও। দেশের রাজনীতি এবং শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাবলিগ জামায়াত, নানা তরিকার সুফীদল ও অধিকাংশ পীরদের কোন মাথাব্যাথা নেই। অনেকে সেটিকে দুনিয়াদারিও বলে। তাদের এ অনাগ্রহে প্রচণ্ড খুশি সেক্যুলারিস্টগণ। মুসলিম দেশগুলির রাজনীতিতে এরাই বিজয়ী শক্তি। তারা চায়না ধর্মপ্রাণ মানুষ রাজনীতিতে তাদের প্রতিদ্বন্দি রূপে খাড়া হোক। পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের স্ট্রাটেজী,এদেরকে সাথে নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিটি উদ্যোগকে প্রতিহত করা। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে সূন্নত নবীজী(সাঃ) রেখে গেছেন, সে পথে এগুনোর চেষ্ঠা যেমন অতীতে হয়েছে তেমনি আজও হচ্ছে। যে সব আলেম ইসলামি রাষ্ট্রের নির্মানে বিশ্বাসী তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হলেন, নজদের শেখ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব, বাংলার হাজী শরিয়াতুল্লাহ ও শহীদ হাজী নেছার আলী তিতুমীর, মিশরের শহীদ হাসানূল বান্না, শহীদ কুতুব, শেখ ইউসুফ কারযাভী, পাকিস্তানের মাওলানা মওদূদী ও ডাক্তার ইসরার আহমেদ, ফিলিস্তিনের শেখ আযযাম,সূদানের ডক্টর হাসান তুরাবী এবং তিউনিসিয়ার রশীদ আল ঘানুশী প্রমুখ। শিয়াদের মধ্য এ মতের প্রধান ধারক হলেন, ইরানের আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমিনী, আয়াতুল্লাহ মুর্তজা মোতাহারী, লেবাননের আয়াতুল্লাহ শেখ ফজলুল্লাহ প্রমুখ। ইরানের বিপ্লব,আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান ও মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রদায়িক বিপ্লবের ফলে এ মতের অনুসারিরা দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে তাদের ঘোরতর প্রতিপক্ষ রূপে দাঁড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইসরাইল ও ভারতসহ বিশ্বের তাবত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ। নবীজী (সাঃ)র নির্দেশিত ইসলামের মূল ধারায় ফিরে যাওয়ার যে কোন উদ্যোগকে তারা বলছে মৌলবাদ। চিত্রিত হচ্ছে পাশ্চাত্যের সেক্যুলার মূল্যবোধের ঘোরতর প্রতিপক্ষ রূপে। এবং মুসলিমদের আজকের বিভক্ত মানচিত্র ও পরাজিত অবস্থাকে বলছে স্থিতিশীলতা। এরূপ বিভক্তির মাঝে নিজেদের নিরাপত্তা দেখে। তাদের দাবী, মুসলিম বিশ্বের এ স্থিতিশীলতাকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। “গ্লোবাল ওয়ার অন টেরর” নামে নানা দেশে তারা যে রক্তাত্ব যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তার মূল লক্ষ্য হলো, নবীজী (সাঃ)র ইসলামের দিকে ফিরে যাওয়ার এ বিপ্লবী ধারাকে প্রতিহত করা।
ইসলামী রাষ্ট্র নির্মান নিয়ে মুসলিম দেশের সেক্যুলারিষ্টদের চেতনার বিভ্রাট যে কতটা প্রকট তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক। আওয়ামী লীগের নেতা এবং এক সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জনাব হোসেন শহীদ সহরাওয়ার্দী। পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার দাবীর জবাবে তিনি বলতেন, ইসলামী রাষ্ট্র আবার কেন? যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম, সেটিই তো ইসলামী রাষ্ট্র। অবাক করার মত কথা। অথচ জনাব সহরাওয়ার্দী মুর্খ ছিলেন না। ছিলেন ব্যারিষ্টার। জন্মেছিলেন এমন এক মুসলিম পরিবারে যে পরিবারে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতিসহ বহু জ্ঞানী ব্যক্তি জন্ম নিয়েছেন। কিন্তু এই হলো তাঁর জ্ঞানের গভীরতা! একই রূপ চেতনা বিভ্রাট নিয়ে বসবাস করছে প্রতিটি মুসলিম দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ। অথচ অতি সাধারণ কথা হলো,পরিবারের সদস্যের সবাই নামে মুসলিম হলেই সেটি ইসলামি পরিবার হয় না। কত পরিবারই তো আছে যেখানে নামায-রোযা-হজ-যাকাত নাই, পর্দা-পুশিদাও নাই। হারাম-হালাল, সূদ-ঘুষের বাছবিচারও নাই। আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে চলছে অহরহ। এমন পরিবারে মদজুয়া, নাচ-গান, ব্যাভিচারি ও বেপর্দাগী যেমন চলতে পারে,তেমনি সেগুলি সেক্যুলারিজম,সমাজাবাদ ও জাতীয়তাবাদের ঘাঁটিও হতে পারে। সেসব পরিবারের লোকেরা এমনকি কোরআনী বিধানের প্রয়োগের বিরুদ্ধে যুদ্ধাংদেহীও হতে পারে। এমন পরিবারের সদস্যরা নামে মুসলিম হলেও তাদেরকে কি ইসলামী বলা যায়? তেমনি দেশের নাগরিকদের অধিকাংশ মুসলিম হলেই কোন রাষ্ট্র ইসলামী হয় না। ইসলামী হওয়ার জন্য শর্ত হলো, সেখানে সার্বভৌমত্ব থাকবে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার। এবং আইন-আদালতে থাকবে শরিয়তের বিধান।
বিভ্রান্তি ইসলামকে জানায়
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিতর্কটি শুরু হয়েছে মূলত ইসলাম-পালন নিয়ে মতের ভিন্নতা থেকে। সবাই যেমন ইসলামকে একই ভাবে দেখে না, তেমনি ধর্মকর্মও সবাই একই ভাবে করে না। ইসলাম বলতে অনেকেই বুঝে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, আখেরাত, বিচারদিন, ফিরেশতা ও আসমানী কিতাবের উপর ঈমান এবং নামায-রোযা-হজ-যাকাত পালন। তাদের চিন্তার গণ্ডিতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনা যেমন নেই, তেমনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদ এবং কোরবানীও নেই। আল্লাহর শরিয়তী বিধান রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হলো কি হলো না -তা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যাথা বা আগ্রহও নেই। তাদের ধর্ম-পালন স্রেফ নামায-রোযা-হজ-যাকাত পালনে সীমিত। বহুশত বছর ধরে মুসলিম দেশগুলিতে এরাই ধর্মপ্রাণ মুসলিম বলে প্রশংসিত হয়ে আসছে। তাদের ইসলামকে বলা হয় মডারেট ইসলাম। অপরদিকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা বিশ্বাসী তাদেরকে চিত্রিত করা হয় মৌলবাদী বা চরমপন্থি মুসলিম রূপে। তাদের ইসলামকে বলা হচ্ছে পলিটিকাল ইসলাম। বাংলাদেশের সেক্যুলারিষ্টরা তাদেরকে জঙ্গিবাদী রূপে অভিহিত করছে এবং তাদের ইসলামকে বলছে জঙ্গি ইসলাম। স্বৈরাচার অধিকৃত প্রতিটি মুসলিম দেশে তাদেরকে রাজনৈতিক শত্রু রূপে দেখা হয়। তাদের উপর যে শুধু রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা জেল-জুলুম আছে তা নয়, তাদের হত্যায় কোন রূপ বিচার অনুষ্ঠানের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করা হয় না।
ইসলামের আংশিক অনুসরণকারিগণ আজ ঘরে ঘরে। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ হজ্বে যায়। বাংলাদেশে তাবলিগের জামায়াতের ইজতেমাতেও বিশ লাখের বেশী মানুষ তল্পি-তল্পা নিয়ে হাজির হয়। দেশে দেশে এরূপ বহু এজতেমা হচ্ছে¸ নির্মিত হচ্ছে হাজার হাজার মসজিদ ও মাদ্রাসা। লিখিত হচেছ শত শত বই। কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লোক নেই। বরং বিরোধীতা শুরু হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিয়ে। বলা হচ্ছে, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ ও কোরবানী পেশের বিষয়টি ঈমানদার হওয়ার জন্য শর্ত নয়। অনেকে বলছেন,আল্লাহতায়ালা দেখেন মুমিনের ঈমান, দেখেন তাঁর প্রতি ব্যক্তির ভালবাসা, তাঁর আক্বিদা এবং নামায-রোযা-হজ-যাকাতের ন্যায় ইবাদত। এ মতের প্রচারে শুধু যে সেক্যুলার রাজনীতিবিদ ও বু্দ্ধিজীবীগণ ময়দানে নেমেছে তা নয়, ময়দানে নেমেছে বহু হাজার আলেম, অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, এমন কি তথাকথিত ইসলামি আন্দোলনের বহু নেতা-কর্মীও।
বিভ্রান্তি ধর্মের নামে
ভেজাল ঔষধও ঔষধের রূপ ধরে বাজারে আসে। তেমনি মেকী ধর্মও ধর্মের নামে রূপ ধরে আসে। বনি ইসরাইলীদের কোন পৌত্তলিক কাফের বা নাস্তিক পথভ্রষ্ট করেনি। পথভ্রষ্ট করেছে তাদের আলেমরা। তারা মূসা (আঃ)’র শেখানো প্রকৃত ইসলামকে জনগণ থেকে আড়াল করেছে। হযরত মূসা (আঃ)এর শিক্ষাকে আবার জীবন্তু করার চেষ্টা করলেন যখন ঈসা (আঃ), তখন ইহুদী আলেমগণ মিথ্যা অপবাদে তাঁকে জেরুজালেমের রোমান শাসকের হাতে তুলে দিল। তাঁকে হত্যা করারও দাবী জানালো। মহান আল্লাহতায়ালা তাদের সে অপরাধের বিবরণ অতি বিষদ ভাবে তুলে ধরেছেন পবিত্র কোর’আনে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে নবীজী (সাঃ)’র ও তাঁর সাহাবাযে কেরামের জিহাদ ও কোরবানীকে আজ যারা সাধারণ মুসলিমদের থেকে আড়াল করে রেখেছে তারাও কোন পৌত্তলিক কাফের নয়। ইহুদী-নাছারা বা নাস্তিকরাও নয়। সে কাজ তো তাদের, যাদের হাতে অধিকৃত দেশের মসজিদ-মাদ্রসা।
ইসলামের লেবাসধারি অনেকে ইদানিং বলা শুরু করেছেন, আধ্যাত্মীক পরিশুদ্ধির উপর সমাজ বা কম্যুনিটি গড়ে তোলাই যথেষ্ট। এবং বলছেন, এটিই মুসলিমদের প্রধান কাজ, রাষ্ট নির্মাণ নয়। আধ্যাত্মীকতাকেই তারা পূর্ণাঙ্গ ইসলাম রূপে চিত্রিত করছেন। রাষ্ট্র, রাজনীতি, শরিয়ত, জিহাদ –এসবকে তারা নিজেদের ধর্মীয় কাজ-কর্মের তালিকা থেকেই বিদায় দিয়েছেন। অনেকে বলছেন, সেক্যুলারিজমের সাথে ইসলামের কোন সংঘাত নেই। এভাবে জায়েজ বলছেন সেক্যুলারিজমকেও। এভাবে বিভ্রাট ঘটছে যেমন ইসলাম বুঝায়, তেমনি ধর্মপালনে। শ্রী চৈতন্য দেব ভক্তিমূলক গান গেয়েই বাংলায় ইসলামের দ্রুত প্রসার রুখে দিয়েছিলেন, এবং তিনি দেখিয়েছিলেন ধর্ম-পালন ও ধার্মিক সাজার সহজ পথ। হিন্দুরা তখন গানের মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজেছে। গানের মধ্যে আধ্যাত্মীকতা ও মনের তৃপ্তি খোঁজে সুফি তরিকার অনুসারি বহু মুসলিমও। ফলে কদর বেড়েছে লালন ফকির ও হাসন রাজার মত গায়কদের। ভক্তি ভরে গান গাইলে এবং ভক্তির অতিশায্যে পাগল হলে, এবং পাগলের বেশে এমনকি উলঙ্গ হলেও মহান আল্লাহতায়ালা অধিক খুশি হবেন -এমন ধারণাও অনেকের। এরূপ পাগল মারা গেলে তার কবর ঘিরে বসে গান এবং মদ-গাঁজা-হিরোইন সেবনের আসর।। ভাবটা এমন, মনে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি থাকলে গান গেয়ে মদ-গাঁজা-হিরোইন সেবনে দোষ নেই। প্রয়োজন নেই আল্লাহর হুকুম পালনের। ধর্ম নিয়ে এমন বিভ্রান্তিতে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয়েছে খৃষ্টান ধর্মের অনুসারিগণ। যীশু খৃষ্টের প্রতি ভালবাসার গানই এ ধর্মের মূল কথা। রবিবারে গীর্জায় দল বেঁধে সে গান গাওয়াটাই তাদের প্রধান ধর্মকর্ম। এ ধর্মে হারাম-হালালের কোন বালাই নেই। পাপ যত বিশাল ও জঘন্যই হোক -তাতে শাস্তির ভয়ও নেই। তাদের বিশ্বাস, তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ঈসা (আঃ) বহু আগেই করে গেছেন। খৃষ্টানদের কাজ হলো শুধু গীর্জায় গিয়ে তাঁর প্রতি ভক্তিতে গান গাওয়া। চিকিৎসার নামে ঝাড়-ফুঁকের মধ্যেও যেমন অজ্ঞ মানুষের তৃপ্তিবোধ ও মনতুষ্টি থাকে, তেমনি তৃপ্তিবোধ ও মনতুষ্টি রয়েছে এমন ধর্মপালনেও। সেটি আদৌ সত্য-নির্ভর কিনা -তা নিয়ে চিন্তাভাবনা নেই।
ধর্মপালনের নামে বাংলাদেশের মুসলিমদের বিভ্রান্তু ও পথভ্রষ্ট করার সে সনাতন কৌশলটি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণ। তারা লালন শাহ ও হাসন রাজার গানের খোঁজ করছে। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মানের আন্দোলন যতই তীব্রতা পাচ্ছে, সেক্যুলারিস্টদের পক্ষ থেকে ততই বাড়ছে এসব গানের গুরুত্ব। নিছক মুসলিম সেক্যুলারিস্টই নয়, এদের পিছনে অমুসলিমদেরও বিপুল অর্থ, শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ হচ্ছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় পশ্চিমা দেশগুলির বিনিয়োগের সাথে বিনিয়োগ করছে ভারতও। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করার মধ্যেই তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। তারা জানে, সভ্যতা কখনোই খানকায় গড়ে উঠে না। লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসায় নির্মাণেও বিশ্বশক্তি গড়ে উঠে না। সেটি সম্ভব হলে বাংলাদেশে উচ্চতর সভ্যতা গড়ে উঠতো। এবং দেশটি বিশ্বশক্তিতে পরিনত হতো। এজন্য চাই ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। এজন্যই ইসলামী বিরোধী শক্তির টার্গেট মসজিদ-মাদ্রাসা বা খানকা নয়। বরং সেগুলির নির্মাণে তারা অর্থ দেয়, মসজিদ নির্মাণে জমিও দেয়। কিন্তু তারা বদ্ধপরিকর ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ প্রতিহত করায়। সে লক্ষে তারা লাগাতর প্রচারনা, সামরিক হামলা ও ড্রন হামলার স্ট্রাটেজী গ্রহণ করেছে।
বিজয় শয়তানের এজেন্ডার
শয়তান জানে, মানব নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার পরিকল্পনাটি। শয়তান আরো জানে, ইসলামী রাষ্ট্রই এ জমিনে মহান আল্লাহতায়ালার ফিরেশতা নামিয়ে আনে, তখন বিশ্বশক্তিতে পরিনত হয় মুসলিম রাষ্ট্র। ফলে সভ্যতার দ্বন্দে এমন রাষ্ট্রই হলো শয়তানী শক্তির প্রকৃত প্রতিপক্ষ। এমন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করা গেলে শয়তানের সামনে আর কোন প্রতিদ্বন্দীই থাকে না। মিশর, সৌদি আরব, সিরিয়া, আমিরাত, বাহরাইনসহ বহু মুসলিম দেশে রয়েছে অতি বর্বর ও নৃশংস স্বৈরাচারি শাসক। কিন্তু তাদের নিয়ে পাশ্চাত্য শক্তিসমূহের কোন ভাবনা নাই। তাদের ভাবনা স্রেফ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠারোধ নিয়ে। এবং সেকাজে মুসলিম দেশের স্বৈরাচারি শাসকদেরকে তারা পার্টনার রূপে গ্রহণ করছে এবং গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন।
মানুষের মাঝে নিজের স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্বার্থের ন্যায় নানা স্বার্থ কাজ করে। সে স্বার্থপরতায় মানুষ আপোষ করে এবং বিভ্রান্তও হয়। কিন্তু ঈমানদারকে কাজ করতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাপূরণে। ফলে ঈমানদারের সম্পর্ক মহান আল্লাহ ও তার নাযিলকৃত কোরআনের সাথে। ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থ তাই নিছক মুসলিম অধ্যূষিত রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্রকে ইসলামী হতে হলে তাকে পরিচালিত হতে হয় আল্লাহর নির্দেশনায়। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সাথে তখন গুরুত্ব পায় তাঁর এজেন্ডার সাথে পরিপূর্ণ একাত্মতাও। সেখানে প্রতিষ্ঠা পায় ইসলামের শরিয়তী বিধান। খাবারে টেবিলে শুকরের গোশত ও মদ শোভা পেলে কি সে পরিবারে সদস্যদের ঈমান বাঁচে? বাঁচে কি ইসলাম? মুসলিম পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব শুধু নামায-রোযা পালন নয়, বরং হারাম-হালালের বাছবিচারও। সেটি খাদ্য-পানীয়, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালতসহ সর্ব ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে দায়িত্বশূণ্য হলে ঈমানশূন্যতার জন্ম দেয়। এজন্যই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের দায়ভার প্রতিটি ঈমানদার নাগরিকের কাঁধে এসে যায়।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “উদখুলু ফি সিলমে কা’ফ্ফা”, অর্থঃ ইসলামে প্রবেশ করো পরিপূর্ণ রূপে। অর্থাৎ যেখানেই আল্লাহর হুকুম, সেখানেই সে হুকুম প্রতিপালনে অবনত হও। রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও আইন-আদলতের অঙ্গণকেও ইসলামের অধীনে আনতে হয়। আল্লাহর বিধানকে তাই নিছক নামায-রোযা-হজ-যাকাতে সীমিত রাখার সুযোগ নাই। আত্মীক পরিসুদ্ধি শূন্যে ঘটে না, সে লক্ষ্য পূরণে পরিসুদ্ধি আনতে হয় সমাজ ও রাষ্ট্রে। তখন রাষ্ট্রে আসে নৈতিক স্বাস্থ্যসম্পন্নতা। সে জন্য রাষ্ট্রকে কোরআনী বিধানের আঁওতায় আনা এতো জরুরি। কিন্তু সে উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হয় যদি আদালতে কুফরি আইন প্রতিষ্ঠা পায় এবং সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর উপর আস্থা বিলুপ্ত হয়। বাংলাদেশে তো সেটিই হয়েছে। দেশটির সংবিধান থেকে যেমন আল্লাহর উপর আস্থা ও তাঁর সার্বভৌমত্ব বিলুপ্ত হয়েছে, তেমনি আদালতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ব্রিটিশ কাফেরদের প্রণীত পেনাল কোড। ফলে দেশটিতে নিষিদ্ধ নয় সূদ, মদ, জুয়া, পতিতাবৃত্তির ন্যায় নানাবিথ পাপাচার। কারারুদ্ধ করা হয় ঘরে জিহাদ বিষয়ক বই রাখার কারণে। প্রশ্ন হলো, শয়তানের এজেন্ডাকে এভাবে বিজয়ী করে কি আল্লাহতায়ালার করুণা মিলবে? মিলবে কি পরকালে মুক্তি? ২০/১১/২০২০
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
- সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018