উপেক্ষিত জিহাদ ও পরাজিত ইসলাম
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 26, 2018
- ইসলাম
- No Comments.
মুসলমান হওয়ার জন্য কারো উপরই কোন বাধ্যবাধকতা নেই। “লা ইকরাহা ফিদ্দীন” কোরআনের এই বহুল প্রচারিত আয়াতের অর্থ হলঃ দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নবীজী (সাঃ)র আমলেও আরবের হাজার হাজার মানুষ অমুসলমান থেকেছে। মিশর, লেবানন, ইরাকসহ আরব দেশগুলির লক্ষ লক্ষ মানুষ আজও যে অমুসললিম, –তারা তো তাদেরই বংশধর। কোন মুসলিম সেনাবাহিনী কোন কালেই তাদেরকে মুসলিম হতে বাধ্য করেনি। কিন্তু যারা জেনে বুঝে মুসলিম হয় তাদের মাথার উপর অলংঘনীয় দায়িত্বও এসে যায়। অনেকটা সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার মত। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে কাউকে বাধ্য করা হয় না। কিন্তু যোগ দিলে সেনাবাহিনীর বাইরের লোকদের থেকে তার দায়িত্বটা ভিন্নতর হয়। তখন প্রাণ হাতে রণাঙ্গণে যাওয়াটি তার মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে এসে যায়। যুদ্ধে না গেলে বা নির্দেশ পালনে অবাধ্যতা দেখালে তার কোর্টমার্শাল হয়। বিচারে কঠোর শাস্তি হয়, এমনকি প্রাণদন্ডও হয়। প্রশ্ন হলো, মুসলমান হওয়ার পর সে বাধ্যবাধকতাটি কি? আর সেটি হলো, মহাশক্তিমান আল্লাহতায়ালার সাথে এক অলংঘনীয় চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া। এবং চুক্তিটি হলো, একমাত্র আল্লাহতায়ালাকে সে মাবুদ বা উপাস্য রূপে মেনে নিবে এবং নিজে তাঁর একান্ত দাসরূপ প্রতিটি হুকুমকে প্রতিনিয়ত মান্য করে চলবে। সেটি শুধু নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাতের ন্যায় ইবাদতে নয়, বরং যেখানেই আল্লাহর হুকুম তাকে তৎক্ষনাৎ সঁপে দিতে হবে সে হুকুমের প্রতিপালনে।
আল্লাহর হুকুম প্রতিপালনের দায়িত্ববোধ মোমেনকে সর্বক্ষণ নিবিষ্ট করবে তাঁর হুকুমের অনুসন্ধানে। অনুসন্ধানের সে কাজটি প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরয। কারণ, আল্লাহর হুকুমটি যে জানে না, সে ব্যক্তি হুকুমের অনুসরণ করবে কি করে? কোরআনের জ্ঞানার্জন এ জন্যই ফরয। অজ্ঞতা একারণেই সবচেয়ে ভয়ানক কবীরা গুনাহ। অজ্ঞতা নিয়ে তাই মুসলমান হওয়া যায় না, মুসলমান থাকাও যায় না। পথের অজ্ঞতা নিয়ে সঠিক রাস্তায় পথচলা অসম্ভব। এখানে যেটি অনিবার্য সেটি পথভ্রষ্টতা। ধর্মীয় জ্ঞানের অজ্ঞতা নিয়ে তেমনি অসম্ভব হলো আল্লাহর প্রদর্শিত সিরাতুল মোস্তাকিমে চলা। তাছাড়া মুসলমানের দায়িত্ব শুধু এ নয় যে, সে শুধু নিজে বা পরিবারকে নিয়ে সিরাতুল মোস্তাকিমে চলবে। সেটি নবীজী (সাঃ)র সূন্নত নয়, সাহাবায়ে কেরামেরও রীতি নয়। তাকে পথ দেখাতে হয় অন্যদেরও। পথ দেখা ও দেখানো, জাগা ও জাগানোই তার জীবনের মিশন। সে সাথে সরাতে হয় রাষ্ট্রের বুক থেকে সত্যের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি বাধা এবং শয়তানী শক্তির প্রতিটি প্রতিষ্ঠান। নবীজী শুধু কাবার মধ্য থেকে মুর্তি সরাননি, সরিয়েছেন কাবার বাইরে থেকেও। মদ্যপান, সূদ-ঘুষ, বেশ্যাবৃত্তিসহ পাপের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নির্মূল করেছেন। কারণ পাপের রাজ্যে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় অসম্ভব। সে বিজয় আনতে হয় পাপ ও পাপের প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটিয়ে। আর একাজে নামলে লড়াই বাধবেই, তখন অনিবার্য হয় জিহাদ। একার পক্ষে এমন জিহাদ গড়ে তোলা অসম্ভব। তখন তাকে লোক গড়তে হয় এবং একাত্ম হতে হয় অন্য ঈমানদারদের সাথে। দ্বীনের প্রচার ও প্রসার এবং একতা গড়া এজন্যই নামায-রোযার ন্যায় ফরয। জিহাদর শুরুর আগে নবীজী (সাঃ)কে একাজ মক্কায় ১৩টি বছর অবিরাম করতে হয়েছে। আজও এটিই দ্বীন প্রতিষ্ঠার অনুকরণীয় মডেল।
জিহাদ যে ইসলামে কতটা অনিবার্য সেটির প্রকাশ ঘটেছে কোরআনের অসংখ্য আয়াতে এবং কোরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্যটির মধ্যে। আল্লাহতায়ালা সত্য দ্বীনসহ রাসূল পাঠানোর মূল লক্ষ্যটি কখনই অস্পষ্ট রাখেননি। আজকের বহু আলেম সেটি বুঝতে না পারলেও নবীজী (সাঃ)র যুগের নিরক্ষর বেদুঈনরাও সেটি বুঝতেন। তাই সেদিন তারা জিহাদ লড়েছেন, এবং জান-মালের কোরবানীও পেশ করেছেন। পবিত্র কোরআনের সূরা সাফ’এ ঘোষণা দিয়েছেনঃ “তিনিই (সেই আল্লাহ যিনি) তাঁর রসুলকে পথনির্দেশ ও সত্যধর্ম দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে তা সকল ধর্মের উপর প্রবল ভাবে বিজয়ী হয়। যদিও কাফেরদের কাছে তা অপছন্দ করে।” – (আয়াত ৬)। অবিকল একই রূপ ঘোষনা এসেছে সুরা তাওবা’র ৩২ ও ৩৩ নম্বর আয়াতে। অন্যান্য ধর্ম থেকে ইসলামের এখানেই ভিন্নতা। হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ)এর উপর এমন নির্দেশ একবারও নাযিল হয়নি। অথচ হযরত মহম্মদ (সাঃ)এর উপর সেটি নাযিল হয়েছে তিনবার। নবীজী (সাঃ)-র পূর্বে যে সব নবী-রাসূল এসেছিলেন তারা ছিলেন নিজ-নিজ গোত্রের জন্য। যেমন হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর ভাই হযরত হারুন (আঃ) নবুয়তি জীবনের সবটুকু ব্যয় করেছেন বনী ইসরাইলের মানুষদের মূক্তি দিতে ও তাদেরকে সত্য দ্বীনের পথে আনতে। হযরত ঈসা (আঃ)ও এসেছিলেন মূলতঃ বনি ইসরাইলের উদ্দেশ্যে। অপর দিকে নবীজী (সাঃ) এসেছেন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য। পবিত্র কোরআনে তাকে বলা হয়েছে “রাহমাতুল্লিল আলামীন” তথা সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত। অন্যকোন নবীকে সে বিশেষ উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি। নবীজী (সাঃ)র উম্মত রূপে আল্লাহর দ্বীনের বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় একই রূপ উদ্যোগ নিতে হয় পরবর্তী আমলের মুসলমানদের।
তাছাড়া দ্বীন নাযিলের অর্থ এ নয় যে, সেটি কোরআনের পাতায়, মসজিদের জায়নামাযে বা মাদ্রাসার শ্রেনীকক্ষে সীমাবদ্ধ থাকবে। বরং সেটি প্রতিষ্ঠা ঘটাতে হবে দেশের রাজনীতি, আইন-আদালত, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গনে। দ্বীন তো পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠার জন্য, নিছক পাঠের জন্য নয়। নিছক ব্যক্তিজীবনে পালনের জন্যও নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালার ঘোষণাঃ “তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশে দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মুসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। -(সুরা আশ-শুরা, আয়াত ১৩)। কোরআনে যেমন নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাতের আহকাম রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাষ্ট্রপরিচালনা ও জিহাদের আহকামও। রয়েছে ফৌজদারি আইন, রয়েছে সম্পদের বন্টন নিয়ে আইন। রয়েছে পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য-পানীয় নিয়ে হারাম-হালালের বিধান। প্রতিবেশীর সাথে আচরণ কীরূপ হবে, কীরূপ আচরণ হবে শিশুদের সাথে, কীরূপ ব্যবহার করতে হবে পিতা-মাতা ও মুরব্বীদের সাথে –আল্লাহতায়ালার নির্দেশ এসেছে এসব বিষয়েও। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ বিধান। এটি আল্লাহর দেওয়া এক পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ। জীবনের প্রতিক্ষেত্রে এটি পথ দেখায়। মুসলমানের কাজ হলো সেটি পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ। কোরআনে একথাও বলা হয়েছে, “ইন্নাদ্দীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম”। অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহনযোগ্য দ্বীন হল ইসলাম। অর্থাৎ ইসলামের বাইরে ধর্মের নামে অন্য যত ধর্ম-কর্ম করা হোক না কেন সেগুলি মহান আল্লাহর কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
কিন্তু রাষ্ট্র কোন শূণ্য স্থান নয়। একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সেখানে পূর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত থাকে। ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত থাকে সে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কর্ণধারেরা। সেটি যেমন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)ও হযরত মূসা (আঃ)এর সময় ছিল, তেমনি ছিল হযরত মুহম্মদ (সাঃ)এর সময়ও। নমরুদ, ফিরাউন, আবু জেহল ও আবু লাহাবগণ ছিল আল্লাহ-বিরোধী পক্ষের সমকালীন কর্ণধার। আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে তারা ছিল প্রবল প্রতিপক্ষ। ফলে সংঘাতকে তারা অনিবার্য করে তুলেছিল। অথচ বিশ্বটি মহান আল্লাহর। তাঁর গড়া এ বিশ্বে সে দখল জমানোর অধিকার তাদের ছিল না। ঈমানদারের দায়িত্ব হলো, এ অধিকৃত ভূমিকে শয়তানি শয়তানী শক্তির হাত থেকে অধিকার মূক্ত করা। এবং সে সাথে আত্মনিয়োগ করা আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠায়। এ দায়িত্ব আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের। একাজের জন্যই প্রতিটি ঈমানদার হলো আল্লাহর খলিফা। আর মুসলিম উম্মাহকে বলা হয়েছে হিজবুল্লাহ বা আল্লাহর দল। আর এগুলি কোন রাজনীতিকের বা সমাজ বিজ্ঞানীর আবিস্কৃত প্রতিশব্দ নয়, বরং কোরআনী পরিভাষা। খলিফা, উম্মাহ, হিজবুল্লাহ –এরূপ প্রতিটি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে ইসলামের কোরআনী দর্শন, এবং সে সাথে প্রতিটি ঈমানদারের উপর অর্পিত এক বিশাল দায়িত্ববোধ। এ দায়িত্ব পালনের মধ্যেই পরিচয় মেলে একজন মুসলমানের প্রকৃত ঈমানদারি। সে দায়িত্বপালনের তাগিদেই প্রতিটি মুসলমান পরিণত হয় মহান আল্লাহর সার্বক্ষণিক সৈনিকে। দায়িত্ব পালনের সে মিশনে মহান আল্লাহর সাথে ঈমানদারের চুক্তিটি পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হযেছে এভাবেঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মোমেনদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল, এই মূল্যে যে তাদের জন্য নির্ধারিত থাকবে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়, অতঃপর (আল্লাহর শত্রুদেরকে) হত্যা করে ও নিজেরাও নিহত হয়। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেন-দেনের উপর যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ মহান সাফল্য।” –(সুরা তাওবাহ, আয়াত ১১১)। মুসলমান হওয়ার অর্থ হলো, আল্লাহতায়ালার সাথে কেনা বেচার এ দলীলটি পূর্ণাঙ্গ ভাবে মেনে নেওয়া। আর এটিই হলো মোমেনের ঈমানদারী। কেনা-বেচার এ দলীলের শর্ত মোতাবেক তার জান-মালের কোন ভাগই আর তার নিজের নয়, সেটি মহান আল্লাহর। আল্লাহ জান্নাতের দরে সেটি ক্রয় করে তার কাছেই সেটি জিম্মা রেখেছেন। তার দায়িত্ব হলো, আল্লাহর ক্রয়কৃত এ মহামূল্য আমানতকে খেয়ানত থেকে বাঁচানো। এটি ব্যয় করতে হবে একমাত্র আল্লাহর নির্দেশিত পথে। এখানেই তার জীবনের মূল পরীক্ষা। নামায-রোযার কাজ হলো সে পরীক্ষায় পাশের সামর্থ সৃষ্টি করা। পাঁচবার মসজিদে ডেকে নামায মূলতঃ সে চুক্তির কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। ইসলামে এমন স্মরণই হলো প্রকৃত যিকর। নামাযকেও তাই পবিত্র কোরআনে যিকর বলা হয়েছে। কথা হলো, আল্লাহতায়ালার সাথে কেনাবেচার উপরুক্ত এ দলীলটি শোনার পর কোন মুসলমান কি আল্লাহর রাস্তায় লড়াইয়ের কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে? দূরে থাকলে কি সে আর মুসলমান থাকে? মুসলমান হওয়ার অর্থ তো আল্লাহর সাথে সাধিত এ পবিত্র চুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করা। যারা সে চুক্তির কথা গলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল, কেবল তারাই এ চুক্তি অনুযায়ী অর্পিত দায়িত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে পারে। এমন অবাধ্য ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে নিজেদেরকে মুসলমান রূপে পরিচয় দেয়া নিছক ধোকাবাজী। তবে আল্লাহপাক এমন ধোকাবাজী গোপন রাখার কোন পথ খোলা রাখেননি। তিনি তাদের মুখোশ উম্মোচন করেন তাদের জীবদ্দশাতেই। নিজেদের দাড়ি, টুপি, পো্ষাক ও মুসলিম নাম দিয়ে তারা হয়তো অন্যকে ধোকা দিতে পারে, কিন্তু আল্লাহকে নয়। আল্লাহতায়ালা সেটি প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন জিহাদে ডাক দিয়ে। যারা সে জিহাদ থেকে দূরে থাকলো নবীজী (সাঃ) তাদেরকে মুনাফিক বলেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি গুরুত্বপূর্ণ। হাদীসটি হলোঃ আল্লাহর রাসূল (সাঃ)বলেছেন, “যে ব্যক্তি মারা গেল অথচ আল্লাহর রাস্তায় কোন যুদ্ধই লড়লো না, এবং এটিও ভাবলো না যে যুদ্ধ লড়াটি তার দায়িত্ব ছিল, এমন ব্যক্তির মৃত্যু হয় মুনাফেকীর মধ্যে।” – আল মুসলিম।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে জিহাদকে বলেছেন এমন এক ব্যবসা যা ব্যক্তিকে মুক্তি দেয় জাহান্নামের আগুণ থেকে। মানব সম্পাদিত সকল কাজের মাঝে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। একাজ তাজমহল নির্মানের কাজ নয়, নিছক কৃষি, কারিগরি বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজও নয়। বরং দুনিয়ার বুকে জান্নাত নামিয়ে আনার কাজে। কোটি কোটি মানব সন্তানকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচানোর কাজ। এ কাজের ফলেই মর্তের বুক থেকে সিরাতুল মোস্তাকিম গড়ে উঠে জান্নাতে পৌঁছার। ইসলামে এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। নিছক নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত ব্যক্তিকে বীনা হিসাবে জান্নাতে নেয় না। কবরের মাঝে রেযেকও দেয় না। বিচার দিনে শাফায়াতের অধিকারও দেয় না। কিন্তু জিহাদ দেয়। কারণ একমাত্র জিহাদই আল্লাহর ধরিত্রিকে শয়তানী শক্তির দখলমূক্ত করে এবং প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর আইনের সার্বভৌমত্ব। এর ফলেই শয়তানী শক্তির অধিকার মূক্ত হয় আল্লাহর ভূমি। আল্লাহার কাছে এ কাজ যে কত প্রিয় এবং এর পুরস্কার যে কত বিশাল সে ঘোষণাটি এসেছে পবিত্র কোরআনে। আখেরাতে মুক্তি ও পুরস্কারের সে সুখবরটি আল্লাহতায়ালা বাতলিয়েছেন এভাবেঃ “হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্যের সন্ধান দিব যা তোমাদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দিবে? আর তা হলো, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ও জীবনপণ করে জেহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বোঝ। -(সুরা সাফ, আয়াত ১০-১১)।
তাই মোমেন ব্যক্তি শুধু বাঁচার জন্যই বাচেঁ না। তাঁর বাঁচার মধ্যেও একটি লক্ষ্য থাকে। তাঁর বাঁচার লক্ষ্য ও জীবনের মূল কাজ নিছক রুটি-রুজির তালাশ নয়। সম্পদের আহরণও নয়। বরং সেটি হলো আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা। এবং সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামের বিপক্ষ শক্তির দখলদারি থেকে মূক্ত করা। এটিই তার জীবনের মূল লড়াই। আর ইসলামে এমন লড়াই হলো জিহাদ। এমন জিহাদই নিশ্চিত করে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সীমাহীন পুরস্কার। সে প্রতিশ্রুতি এসেছে এভাবেঃ “তিনি তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দিবেন এবং এমন জান্নাতে দাখিল করবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত এবং বসবাসের জন্য জান্নাতের উত্তম বাসগৃহে। এটিই মহাসাফল্য।” (সুরা সাফ, আয়াত ১২)। তবে মহাজ্ঞানী আল্লাহতায়ালার কাছে এটিও অজানা নয় যে, তাঁর মোমেন বান্দাহ শুধু ওপারে জান্নাতই চায় না, এপারে নিজেদের বিজয়ও দেখতে চায়। আল্লাহতায়ালা তাঁর ঈমানদার বান্দাহদের সে সুসংবাদও দিয়েছে। সেটি এসেছে একই সুরার পরবর্তী আয়াতে। বলা হয়েছে, “এবং আরও একটি অনুগ্রহ যা তোমরা পছন্দ কর, (এবং সেটি হল) আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং আসন্ন বিজয়। (হে রাসূল!) মুমিনদেরকে এর সুসংবাদ দান করুন। -(সুরা সাফ, আয়াত ১৩)। আরো লক্ষণীয় হলো, মহান আল্লাহতায়ালা যে শুধু জিহাদের পথ বাতলিয়ে দিয়েছেন তা নয়। বরং নির্দেশ দিয়েছেন সে জিহাদে সামিল হওয়ার। সে নির্দেশটি হলোঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারি হয়ে যাও। যেমন ঈসা ইবনে মরিয়ম তার শিষ্যদেরকে বলেছিল, আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারি হবে? শিষ্যবর্গ বলেছিল, আমরা আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। অতঃপর বনী ইসরাইলীদের একদল বিশ্বাস স্থাপন করল এবং একদল কাফের হয়ে গেল। যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, আমি তাদেরকে শত্রুর মোকাবেলায় শক্তি যোগালাম, ফলে তার বিজয়ী হল। -(সুরা সাফ, আয়াত ১৪)। আল্লাহতায়ালার এর নির্দেশের পর জিহাদের গুরুত্ব এবং সে জিহাদে অংশগ্রহণের অপরিহার্যতা নিয়ে কি আর কোন অস্পষ্টতা থাকে? এখানে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট তা হল, মুসলমান হওয়ার অর্থ শুধু নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত আদায় নয়, বরং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে আল্লাহর সাহায্যকারি হয়ে যাওয়া। ফলে শুধু আযানের ডাকে মসজিদে ছুটলেই পূর্ণ ঈমানদার বলা যায় না, তাকে বিপক্ষ শক্তির সাথে লড়াইয়েও নামতে হয়। লড়াইয়ের মাধ্যমেই তাকে নিশ্চিত করতে হয় ইসলামের প্রতিষ্ঠা। আল্লাহর সাহায্যকারি রূপে তার আসল রূপটি প্রকাশ পায় তো এমন লড়াইয়ের মাধ্যমেই। নামায, রোযা, ও হজ্জ-পালন ও ইসলামি জ্ঞানার্জনের মূল লক্ষ্য তো ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহর সাহায্যকারি রূপে গড়ে উঠার প্রয়োজনীয় সামর্থ সৃষ্টি করা। কিন্তু মোমেনের জীবনে যদি সে সামর্থই গড়ে না উঠে তবে সেগুলি কি আদৌ ইবাদত? নিছক নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাতের মধ্যে প্রকৃত ঈমানদার নিজের ধর্ম-কর্ম সমাপ্ত করে না, বরং আরো বহুদূর যায়। আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের লক্ষ্যে যেখানে যা কিছু অপরিহার্য সেটিই সে করে।। এ লক্ষ্যে দ্বীনের প্রচারে যেমন আত্মনিয়োগ করবে এবং পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর অতিক্রম করে নানা দেশে যাবে, তেমনি মানুষকে সুসংগঠিত করবে এবং প্রশিক্ষণও দিবে। রাজনীতিতে যেমন অংশ নিবে, তেমনি শিক্ষা-সংস্কৃতির ময়দানেও অবিরাম লড়বে। এরূপ কাজে আমৃত্যু অংশ নেওয়াটিই তো ঈমানদারি। এবং তা থেকে দূরে থাকাটিই হলো মুনাফিকী।
ঈমানদারের প্রকৃত ঈমানদারি ধরা পড়ে তার দোয়ার মধ্যে। আল্লাহর কাছে চাওয়া-পাওয়ার এ আকুতিতে প্রকাশ পায় তার জীবনের মূল প্রায়োরিটি। যেমন মুসলমানদের আদিপিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কোরবানী, আমার বেঁচেথাকা ও মৃত্যু একমাত্র রাব্বুল আলামিনের জন্য।” ইব্রাহীম (আঃ)এ দোয়া আল্লাহতায়ালার এতই ভাল লেগেছে যে তিনি সে দোয়াটি কোরআনে সন্নিবেশিত করে অনাগত কালের ঈমানদার বান্দাহর জন্য স্মরণীয় ও অনুকরণীয় করে গেছেন। নামায-রোযা-হ্জ্জ-যাকাতের ন্যায় ইবাদতের ক্ষেত্রগুলতোতেই শুধু নয়, মোমেনের বাঁচা-মরাটিও একমাত্র তারই উদ্দেশ্যে। আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানুষ। প্রতিটি মানব-দেহে রয়েছে বহু হাজার কোটি জীবকোষ। এর একটিতে যে জটিল কম্পিপিউটর লুকিয়ে আছে সেটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় কম্পিউটারেও নেই। জীবকোষের ক্ষুদ্র জিনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে বহু মিলিয়ন ডাটা। বিশ্বের তাবত বিজ্ঞানীদের সামর্থ নেই এমন একটি জীব কোষের নির্মান। আর আল্লাহতায়ালা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ এ সৃষ্টিকে আমানত রূপে গচ্ছিত রেখেছেন ব্যক্তির কাছে। তার উপর অর্পিত দায়িত্ব হলো, আল্লাহপ্রদত্ত বিশাল এ সামর্থ ও প্রতিভা নিয়ে একমাত্র মহান আল্লাহর ইবাদত করা। যেমন পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ “ওয়া মা খালাকুতুল জিন্নাহ ওয়াল ইনসানা ইল্লা লি ইয়াবুদুন।” অর্থঃ আমি মানুষ ও জিনকে এ ভিন্ন আর কোন কারণে সৃষ্টি করেনি যে তারা একমাত্র আমার ইবাদত করবে। কিন্তু সে আমানত যদি নিয়োজিত হয় মুর্তি পুজায় বা ইসলামের বিপক্ষ শক্তির বিজয় বা গৌরব বাড়াতে, তবে তার চেয়ে জঘন্য গাদ্দারী ও অপরাধ আর কি হতে পারে? যে কোন আদালতে হাজার বা লক্ষ টাকার খেয়ানতেও শাস্তি হয়। কিন্তু এখানে যে খেয়ানতটি হচ্ছে তা তো বহু লক্ষ বা বহু কোটি টাকার নয়। মানব দেহের একটি ক্ষুদ্র অঙ্গকেও দুনিয়ার তাবত সম্পদ দিয়ে কি কেনা যায়? সমগ্র হিমালয় যদি সোনা হয়ে যায়, তা দিযে কি একটি হৃৎপিন্ড কেনা যাবে? কিন্তু সে আমানত যদি ব্যয় হয় শয়তানী শক্তির গৌরব বাড়াতে, তবে সেটি কি ক্রোধ বাড়াবে না মহান আল্লাহর? এটি হলো আল্লাহর বিরুদ্ধে বড় বিদ্রোহ। এমন খেয়ানতের পর সে কি মাফ পেতে পারে মহান আল্লাহর আদালতে। এমন অবাধ্য বান্দাহ কি কখনও জাহান্নামের আগুণ থেকে মুক্তি পেতে পারে? যার অন্তরে সামান্যতম ঈমান আছে সে কখনও কি এমন অবাধ্যতায় লিপ্ত হতে পারে? ঈমানদার ব্যক্তি কখনও তাই রাজা-বাদশাহ-দল-নেতা-ভাষা-ভূগোল বা জাতীয় স্বার্থের বিজয়ে এ মহামূল্যমান আমানত ব্যয় করেনা। বরং সেটিকে সে সদাসর্বদা নিয়োজিত রাখে একমাত্র আল্লাহর হুকুমের আনুগত্যে ও ইসলামের বিজয়ে।
দুনিয়াদার বা সেকুলার ব্যক্তির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো চাকুরি-বাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘরবাড়ী ও সন্তান-সন্ততির কল্যাণ, ইসলামের বিজয় নয়। ইসলামের বিজয় তার কাছে চিহ্নিত হয় সাম্প্রদায়িক কুপমন্ডকতা রূপে। পার্থিব কল্যাণের আশায় এমন ব্যক্তি এমনকি নিজ ঘর বা প্রতিষ্ঠানে মৌলভী ডেকে দোওয়ার মজলিস বসায়, পীরের মজলিসেও ধর্ণা দেয়। কিন্তু সে দোওয়ার জলসায় গুরুত্ব পায় না জিহাদের সামর্থ অর্জন বা সে পথে শহীদ হওয়ার আকাঙ্খা। অথচ সাহাবায়ে কেরাম শুধু নিজে নয়, অন্যকে দিয়ে দোয়া করাতেন যেন শাহাদত নসীব হয়। কারণ এটিকে তারা গণ্য করতেন জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন রূপে। পবিত্র কোরয়ানে বলা হয়েছেঃ “তোমরা ততক্ষন কোন কল্যানই অর্জন করবে না যতক্ষণ না তোমাদের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কোরবানী না কর।” –সুরা আল ইমরান আয়াত ৯২ )। আর ব্যক্তির কাছে সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি হলো তার জীবন। সেটি কোরবানী করার সামর্থ-অর্জন এতটা সহজ নয়। এর জন্য চাই ঈমানী বল, আর সে বল আসে কোরআনের জ্ঞান থেকে। তাই যার মধ্যে সে কোরআনের চর্চা নেই, তার মধ্যে সে ঈমানী বলও নেই। তাই একটি দেশে কোরআন-চর্চার কীরূপ বেহাল অবস্থা সেটি বুঝার জন্য মসজিদ-মাদ্রাসার গণনা করার প্রয়োজন নেই, জিহাদের অনুপস্থিতিই সেটি বলে দেয়। সাহাবায়ে কেরামের আমলে কি এত মসজিদ-মাদ্রাসা ছিল? কিন্তু সে আমলে কোরআন-চর্চা যে কতটা গভীর ছিল সেটি তাদের মাঝে শাহাদতের প্রেরণাই বলে দেয়। শতকরা ৬০ ভাগ সাহাবা সেদিন শহীদ হয়েছিলেন। ইসলামের বিজয় তো এসেছিল তাদের কোরবানীর বরকতে। তাদের নিজেদের বিপুল বিণিয়োগ সেদিন সম্ভব হযেছিল আল্লাহর সাহায্য-লাভ, -যেটির ওয়াদা মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বার বার দিয়েছেন। বস্তুতঃ প্রকৃত মুসলমানের জীবনে বড় চিন্তা হলো, কি করে সে সামর্থ অর্জন করা যায় সেটি। নবীজী (সাঃ)র আমলে সাহাবাগণ তাই বহু মাইল দূর থেকে মরুর কঠোর আবহাওয়া সহ্য করে নবীজী (সাঃ)র কাছে কোরআন শিক্ষার জন্য ছুটে আসতেন। বহু নিরক্ষর সাহাবী এ প্রেরণায় সেদিন কোরআনের হাফিয হয়েছিলেন।
মোমেনের ঈমানদারি ও তার জীবনের মূল সফলতা তো যাচাই হয় সে কোরবানীর মাপকাটিতেই, ‘আমিও মুসলমান’ -সে কথার ভিত্তিতে নয়।। নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাতসহ সকল ইবাদতের মূল লক্ষ্য তো সে সামর্থ অর্জনে সহায়তা দেওয়া। যে ব্যক্তি সারা জীবন ইবাদত করলো অথচ সে সামর্থ অর্জিত হলো না, তবে সে ইবাদতের সফলতা কোথায়? মুসলিম বিশ্ব কি আজ এমন বিফল ইবাদতকারীদের দিয়েই পূর্ণ হচ্ছে না? ফলে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় না বেড়ে বাড়ছে পরাজয়। অথচ আল্লাহপাক তাঁর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার প্রস্তুত রেখেছেন তাঁর ঈমানদার বান্দাহর জন্য। সে পুরস্কারের মাধ্যমে তিনি তাঁরই সৃষ্ট মাটির মানুষকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে। তখন স্বল্প আয়ুর মানুষ লাভ করবে এক আনন্দময় অনন্ত জীবন। ব্যক্তির জীবনে এরচেয়ে বড় প্রমোশন আর আছে কি? আর এর বিপরীতে সবচেয়ে বড় পদচ্যুতি বা ডিমোশন হল জাহান্নাম-প্রাপ্তি। কথা হলো কোন পরীক্ষা ছাড়া কি প্রমোশন হয়? প্রমোশনের পূর্বে পরীক্ষা তো অনিবার্য। এবং সেটি ঈমানদার ব্যক্তির জীবনেও। বস্তুতঃ দুনিয়ার জীবনটাই হলো সে পরীক্ষাকেন্দ্র। আল্লাহতায়ালা সেটিরই ঘোষণা দিয়েছেন এভাবেঃ “তিনি মৃত্যু ও জীবন এজন্য সৃষ্টি করেছেন যে, তিনি পরীক্ষা করবেন তোমাদের মধ্যে কে আমলের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠতর।” কোরআনের ভাষায় পৃথিবীটা তাই পরীক্ষা কেন্দ্র। তাই এ পার্থিব জীবনের মূল লক্ষ্য হল, আমলে শ্রেষ্ঠতর হওয়ার পরীক্ষা। এবং সেটি, আল্লাহর রাস্তায় জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি পেশ করার মধ্য দিয়ে। নিরাপদ ঘরে নফল ইবাদত, অবসরে ওয়াজের মহফিলে যোগদান, কিছু কোরআন তেলাওয়াত, কিছু দানখয়রাত, কিছু ঘরোয়া আলোচনা, আপোষের রাজনীতি – এসবে কি সবচেয়ে প্রিয় বস্তুর কোরবানী হয়? সাহাবাগণ তাদের প্রিয় জান হাতে নিয়ে প্রবল কাফের বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছেন। তারা আহত হয়েছেন, শহীদ হয়েছেন বা বেঁচেছেন জিন্দা শহীদ রূপে। মুসলমানের জীবনে তাই দুই অবস্থা। হয় সে আল্লাহ-প্রদত্ত এ জীবনটি কোরবানী করবে মহান আল্লাহর দ্বীনের বিজয় আনতে। আর সে নসীব যদি না হয়, সে বেঁচে থাকে আল্লাহর দ্বীনের সাক্ষীদাতা রূপে। এ দু’টি অবস্থা ছাড়া মুসলমানের জন্য তৃতীয় অবস্থা নেই। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে যেমন আল্লাহর পক্ষে সাক্ষী দেয়, তেমনি প্রতিক্ষণ সাক্ষী দেয় জীবিত অবস্থাতেও। আর এটিই তো ঈমানদার হওয়ার দায়বদ্ধতা। এমন ব্যক্তি বিছানায় মারা গেলেও তার মর্যাদা শহীদের সমান বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এবং সেটির উল্লেখ এসেছে নিম্মূক্ত হাদীসে। হযরত সাহল বিন হুনাইফ (রাঃ)থেকে বর্ণিতঃ আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি শাহাদতের জন্য আল্লাহর কাছে আন্তরিক ভাবে দোওয়া করে আল্লাহ তার মর্যাদাকে বাড়িয়ে শহীদের মর্যাদার সমান করে দেন -এমনকি সে যদি বিছানায়ও মারা যায়।” -আল মুসলিম। একই রূপ বর্ণনা এসেছে হযরত আনাস (রাঃ) থেকে। তিনি বর্ণনা করেছেনঃ আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আন্তরিক ভাবে আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার জন্য প্রার্থণা করে আল্লাহতায়ালা তাঁকে সে মর্যাদা দিবেন -এমনকি সে যদি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা না যায় তবুও।” -মুসলিম। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো আল্লাহর রাস্তায় জানমালের কোরবানীর সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি এবং সুযোগ এলেই স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহণ। নিজেকে মুসলিম রূপে নিজেকে পরিচয় দিল অথচ আগ্রহ নেই আল্লাহর রাস্তায় কোরবানীতে –সেটি কি ঈমানের পরিচয়? নবীজী (সাঃ)র আমলে এমন কোন সাহাবা ছিলেন কি যার মধ্যে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানী পেশের আগ্রহ ছিল না? তারা অর্থ, সময় ও শ্রমদানেই শুধু নয়, দু’পায়ে খাড়া ছিলেন এমনকি প্রাণদানেও। আদর্শ মুসলিম সমাজ তাই জিন্দা শহিদদের সমাজ। এজন্যই প্রকৃত মুসলিম সমাজে অতি দ্রুত উন্নত মানুষ ও সে সাথে উন্নত সভ্যতা নির্মিত হয়। কারণ, শহীদ হওয়ার প্রেরণায় বিলুপ্ত হয় ব্যক্তির দুনিয়াবী লোভ-লালসা। কথা হলো, যে ব্যক্তি নিজের সম্পদই শুধু নয়, প্রাণটিও আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে চায় সে অন্যের সম্পদে কেন হানা দিবে? এমন মানুষ সে সমাজে বৃদ্ধি পায় সে সমাজকে দূর্নীতিমূক্ত করতে পুলিশের প্রয়োজন হয় না। এখানে প্রতিটি ঈমানদার পরিণত হয় দূর্নীতির বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরীতে।
মহান আল্লাহতায়ালা মানুষের নিয়ত দেখেন। দেখেন আমল। হিসাব হয়, সে তার নিয়তে কতটা সাচ্চা ও সচেষ্ট। বান্দাহ তো পুরস্কার পায় তার নিয়ত ও নিয়ত অনুযায়ী প্রচেষ্ঠার প্রতিদান স্বরূপ। সফলতার জন্য নয়। কারণ সফলতা তো আল্লাহর দান। এখানে বান্দাহর করণীয় কিছু নেই, বাহবা পাওয়ারও কিছু নেই। ফলে সে সফলতার প্রতিদান স্বরূপ পাওয়ারও কিছু নেই। তাই প্রকৃত ঈমানদার সফলতা নিয়ে ভাবে না, ভাবে সাচ্চা নিয়েত ও আল্লাহর পথে নিজের বিণিয়োগটি নিয়ে। এখানে ব্যর্থ হলে তার বাঁচাটাই ব্যর্থ। খালিদ বিন ওদিলের ন্যায় বহু সাহাবী মনেপ্রাণে শহীদ হতে চেয়েছেন, বহু যুদ্ধও লড়েছেন। কিন্তু শাহাদত তাদের নসীবে হয়নি। সে নসীব হযরত আবুবকর (রাঃ)র ন্যায় আরো অনেক প্রথম সারীর সাহাবীরও হয়নি। অপরদিকে অনেক সাহাবী তাদের জীবনের প্রথম জিহাদেই শহীদ হয়ে গেছেন। এজন্যই শাহাদতের প্রেরণা নিয়ে যারা আমৃর্ত্যু লড়াই করে তাদের সে নিয়ত ও মেহনতকেও আল্লাহতায়ালা বিফল হতে দেন না। তাদেরও শহীদের সমপরিমাণ মর্যাদা দেন। সেটিরই ঘোষণা এসেছে উপরুক্ত হাদীসে।
কিন্তু আজ বাংলাদেশের মত দেশে যারা নিজেদের মুসলমান রূপে পরিচয় দিচেছ তাদের ক’জন সাক্ষী দিচ্ছে আল্লাহ ও তার দ্বীনের পক্ষে? কারো পক্ষে ভোট দেওয়া বা রাজপথে নামার অর্থ কি এ নয়, যার পক্ষে বা যে বিধান বা যে মেনিফেস্টোর পক্ষে সে ভোট দিচেছ তার বিবেচনায় সে ব্যক্তিটি বা সে বিধানটিই শ্রেষ্ঠ? কোন মুসলমান কি ইসলামে অঙ্গিকারহীন কোন সেকুলার দল,নেতা বা প্রার্থীর পক্ষে এমন রায় দিতে পারে? তাতে কি তার ঈমান থাকে? অথচ বাংলাদেশের ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম দেশে বহু নামায-রোযা-হজ্জ পালনকারিদের দ্বারা সেটিই হচ্ছে। এটি তো ইসলামের বিরুদ্ধে গাদ্দারী। এবং এমন ভোটদানের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটছে আল্লাহর বিরুদ্ধে। অধিকাংশ মুসলিম দেশে আজ আল্লাহর বিধান পরাজিত। এবং সেটি কোন কাফের বাহিনীর দখলদারির কারণে নয়। বরং মুসলিম নামধারি সেকুলার শক্তির হাতে মুসলিম ভূমি অধিকৃত হওয়ায়। এবং সেটি সম্ভব হয়েছে মুসলিম নামধারি জনগণের ভোটে ও রাজস্বদানে। এবং সে সাথে প্রশাসন, অফিস-আদালত, রাজপথসহ রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রতিটি ময়দানে তাদের সক্রিয় সমর্থণদানে। ইসলামের যে বিপক্ষ শক্তিগুলির বিরুদ্ধে জিহাদ প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরয ছিল তারাই পাচ্ছে তাদের বিপুল সমর্থণ। এটি কি কম অপরাধ? নিছক কালেমা পাঠ ও নামায-রোযা-হজ্জ্-যাকাতে কি অপরাধ থেকে মার্জনা মিলবে? এভাবে কি কখনও প্রতিষ্ঠা পাবে মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব? কথা হলো, আল্লাহর দ্বীনের এ পরাজিত অবস্থায় কি মহান রাব্বুল আলামীন মুসলমানদের উপর প্রসন্ন হবেন? এজন্য কি হাশরের দিনে মহান আল্লাহর দরবারে জবাব দিতে হবে না? কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে ভয়ই বা ক’জনের?
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018