উম্মাহর ব্যর্থতা ও মুসলমানের দায়ভার
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 26, 2018
- সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
কোন জাতির ব্যর্থতা নিছক সরকারের কারণে আসে না। বরং সেটি অনিবার্য হয় সে জাতির সাধারণ মানুষের ব্যর্থতায়। জাতির অর্জিত সফলতার কৃতিত্ব যেমন জনগণের, তেমনি ব্যর্থতার দায়ভারও জনগণের। দেশগড়ার দায়িত্ব নিছক রাজনৈতিক নেতা, প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের নয়। এ কাজ সমগ্র দেশবাসীর। এটি কোন খেলার বিষয় নয় যে, মুষ্টিমেয় খেলোয়াড় খেলবে এবং আমজনতা দর্শকরূপে দেখবে। এ কাজে দায়িত্ব সবার। একটি জাতি যখন নীচে নামতে থাকে তখন সে নীচে নামার কারণ, দেশ গড়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি মুষ্টিমেয়র হাতে সীমাবদ্ধ হয় এবং বাকিরা দর্শকে পরিণত হয়। সকল বিফলতার জন্য তখন সেই মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের দায়বদ্ধ করা হয়। অথচ জাতির বিফলতার জিম্মাদারিত্ব সবার। পলাশির যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা যখন অস্তমিত হলো তখন শুধু সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় হয়নি বরং পরাজিত হয়েছিল বাংলার সমগ্র মানুষ। এ পরাজয়ের জন্য শুধু মীর জাফরকে দায়ী করে অসুস্থ চেতনার মানুষই শুধু নিজের দায়ভার ও দুরূখ কমাতে পারে, বিবেকবান মানুষ তা পারে না। সে পরাজয়ের জন্য দায়ী ছিল বাংলার সমগ্র মানুষ।
নিজ ঘরে আগুন লাগলে সে আগুন থামানোর দায়িত্ব গৃহে বসবাসকারী সবার। ঘর জ্বলতে দেখেও সে পরিবারের কেউ নি‘িয় থাকলে তাকে আদৌ সুস্থ বলা যায় না। খন্দরে যুদ্ধে আরবের কাফেরদের সম্মিলিত হামলায় মদিনা নগরী যখন অবরুদ্ধ তখন প্রতিটি পুরুষই শুধু নয়, প্রতিটি নারীও মোকাবেলায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শত্র“র সে হামলার মুখে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল শতকরা শতভাগ। ফলে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের বিলুপ্তি থেকে তারা রক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু উপনিবেশিক বৃটিশ হামলার মুখে শতকরা ১ জন বাঙালী মুসলমান কি সেদিন ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিল? হয়নি। ফলে এমন জাতির স্বাধীনতা রক্ষা পায় কি করে? জাতির প্রতিরক্ষার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আমাদের পূর্ব পুরুষরা সেদিন মুষ্টিমেয় ষড়যন্ত্রকারীর খেলায় পরিণত করেছিলেন। মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষাকে ইসলামে যেখানে জিহাদ বলা হয়েছে, সেটিকে সংগঠিত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। অথচ একই বৃটিশ বাহিনী যখন আফগানিস্তানে ঢুকেছিল তখন আফগান জনতা হাতে যা ছিল তা নিয়েই ময়দানে নেমেছিল। ফলে বৃটিশ বাহিনীর অনেকেই সেদিন জ্যান্ত ফিরতে পারেনি। সে লোমহর্ষক পরাজয়ের কথা বৃটিশ জাতি আজও ভুলতে পারেনি। স্বৈরাচারী শাসনের সবচেয়ে বড় কুফল হলো, দেশগড়া ও দেশ শাসনের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে মুষ্টিমেয় বেতনভুকের খেলা তামাশার বিষয়ে পরিণত করে। এ নিয়ে রচিত হয় নানা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। এবং দেশের আপামর সর্বসাধারণ পরিণত হয় নীরব দর্শকে। স্বৈরাচারী শাসনকালে তাই যুদ্ধ হয় দুটি শাসকগোষ্ঠির। দেশ গড়ার বিষয়টি গণ্য হয় তাদের নিজস্ব বিষয়রূপে।
আজকের বিশ্বে ১৫০ কোটি মুসলমানের যে পতিত দশা তার কারণে এই স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের নির্মাণে ও প্রতিরক্ষায় অংশ নেয়া ইসলামে কোন পেশাদারিত্ব নয়, চাকুরিও নয়; এটি ইবাদত। শুধু শ্রম ও অর্থ দানই নয়, অনেক সময় প্রাণ দান অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ চেতনা বলেই প্রাথমিক কালের মুষ্টিমেয় দরিদ্র মুসলমানেরা সে আমলের দু দুটি বৃহ্ শক্তিকে পরাজিত করে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এযুগের মুসলিম শাসকেরা নানা বাহানয় সর্বসাধারণের রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে ফৌজদারী অপরাধে পরিণত করেছে। অথচ রাজনীতি হলো রাষ্ট্রের উন্নয়নে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। ফলে প্রতিটি নাগরিকের এটি মৌলিক অধিকার। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে এটি মৃত্যুদন্ডনীয় অপরাধ। শেখ মুজিবও এটি নিষিদ্ধ করেছিলেন ইসলামপন্থীদের জন্য। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ অবধি তিনি দেশের ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক দলগুলোকে বেআইনী ঘোষিত করেছিলেন এবং ১৯৭৪ এ এসে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজকে পরিণত করেছিলেন তার পরিবার ও দলের নিজস্ব বিষয়ে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একদলীয় বাকশালী শাসন। যে কোন স্বৈরাচারীর ন্যায় তিনিও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দর্শকে পরিণত করেছিলেন। কোন টীমের নবধ্বই ভাগ খেলোয়াড়কে দর্শকের গ্যালারীতে বসিয়ে কোন দলই বিজয়ী হতে পারে না। তেমনি পারেনি মুজিব আমলের বাংলাদেশ। তখন রাজনীতি পরিণত হয়েছিল লুণ্ঠনের হাতিয়ারে। ফলে নিরূস্ব হয়েছিল সরকারি তহবিল ও জনগণ। তিনিই বাংলাদেশের জন্য অর্জন করেছিলেন সবচেয়ে লজ্জাজনক তলবিহীন ঝুড়ির খেতাবটি। তার আমলে দরিদ্র মানুষ কাপড়ের অভাবে মাছ ধরা জাল পরে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। দেশ গড়ার কাজকে সফল করতে হলে এ কাজে জনগণের সম্পৃক্ততা অবশ্যই ব্যাপকতর করতে হবে। তবে প্রশ্ন হলো সেটিই বা কেমনে সম্ভব? এ সম্পৃক্ততা বাড়ানো যেতে পারে জনগণের চেতনায় পরিবর্তনের মাধ্যমে।
দেশ গড়ার কাজ থেকে দূরে থাকা যে নিছক দায়িত্বহীনতাই নয়, অমার্জনীয় অপরাধ- সেটি প্রতিটি নারী পুরুষের মগজে বদ্ধমূল করতে হবে। এটি যে নিছক রাজনীতি বা পেশাদারিত্ব নয় বরং পবিত্র ইবাদত সেটিও প্রতিটি নাগরিকের চেতনায় দৃঢ়মূল করতে হবে। এজন্য ইসলামের হুকুম ও শিক্ষনীয় বিষয়গুলো জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে। আল¬াহ তায়ালা একটি সভ্য ও সুন্দর সমাজ নির্মাণের গুরুদায়িত্ব দিয়ে মানুষকে এ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। এ দায়িত্ব খেলাফতের। প্রতিটি মুসলমান তাই আল্লাহতায়ালার খলিফা তথা প্রতিনিধি। প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী বা সচিব হওয়ার চেয়েও এ পদের মর্যাদা আল¬াহর দরবারে অধিক। বিচার দিনে এ কাজের হিসাব দিতে হবে প্রত্যেককে। প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী বা সচিব হওয়ার চেয়েও এ পদের মর্যাদা আল্লাহতায়ালার দরবারে অধিক। বিচার দিনে এ কাজের হিসাব দিতে হবে প্রত্যেককে। প্রতিটি অফিস কর্মীকে তার অফিসে কি দায়িত্ব সেটি প্রথমেই জানতে হয়, নইলে তার দায়িত্ব পালন যথার্থ হয় না। তেমনি প্রতিটি ব্যক্তিকেও জেনে নিতে হয় এ বিশ্বে ও নিজ দেশে তার রোল বা ভূমিকা কি। জীবনের এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। তার জীবনের সকল কর্মকান্ড, দায়িত্ব পালন ও ত্পরতা নির্ধারিত হয় এটুকু জানার পরই। নইলে জীবনযাপনে ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যক্তি স্বেচ্চছাচারী হয়। তাই ইসলামের প্রথম শিক্ষাই হলো এ বিশ্বের ব্যক্তির রোল কি। কিন্তু অতিশয় পরিতাপের বিষয়, সে মৌল পাঠটিই আমাদের জানা হয়নি। আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের বহু ভাষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বহু বিষয় শেখালেও এ মৌলিক পাঠটি শেখায়নি। ফলে দেশ ও সমাজ নির্মাণের ফরজ কাজটি ফরজরূপে গণ্য হয়নি। বরং এটি গদি দখল, আরাম আয়েশ ও নিজস্ব জৌলুস বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। অথচ দেশ গড়ার এ অঙ্গনে সবচেয়ে ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান মানুষের আধিক্য অতি কািিখত ছিল। যেমনটি হয়েছিল খোলাফায়ে রাশেদার সময়। কারণ, অন্যরা না হোক যারা ধার্মিক তাদের অন্তত জানা উচিত ছিল, উচ্চচতর সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ার অর্থ শুধু দায়িত্বহীনতাই নয়,’ িেট আল¬াহর নির্দেশের চরম অবাধ্যতা। বস্তুত বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার সর্বস্তরে যে দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তিদের দৌরাত“ সে দায়ভার এ তথাকথিত ধর্মপরায়নদেরও। সমাজের আবু লাহাব, আবু জেহেলের বিরুদ্ধে সে আমলের মুসলমানগণ যে আমৃত্যু যুদ্ধ করেছিলেন সেটি বাংলাদেশের ধর্ম পরায়ন মানুষদের দ্বারা সংঘটিতই হয়নি। ফলে সমাজের দুর্বৃত্তরা অনেকটা বীনা প্রতিরোধেই সমাজ ও রাজনীতির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গন দখল করে নিয়েছে। তাছাড়া ময়দান কখনও খালি থাকে না। সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষেরা ময়দান খালি করে দিলে দুর্বৃত্তরা তা অবশ্যই দখল করে নেয়। রাষ্ট্রের সম্পদ এভাবেই দুর্নীতিপরায়ন রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের অধীনস্ত হয়েছে। ফলে জনগণ নিরূস্ব হলেও ঐশ্বর্য বেড়েছে তাদের।
দেশ গড়ার ক্ষেত্র শুধু রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন নয়। এ কাজটি হয় দেশের সর্বাঙ্গ জুড়ে। শুধু রাজনীতি দিয়ে একটি সভ্যতার সমাজ নির্মিত হয় না। এ লক্ষ্যে রাজনীতিতে যেমন স্ ও যোগ্য মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হয় তেমনি বাড়াতে হয় দেশের শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজসেবা ও ব্যবসা বাণিজ্যে তাদের উপস্থিতি। স্ মানুষকে শুধু স্ হলে চলে না, সাহসী ও সংগ্রামীও হতে হয়। নবীজীর (সারূ) সাহাবাগণ শুধু স্ই ছিলেন না, নির্ভীক ও অতিশয় লড়াকুও ছিলেন। এ যোগ্যতা বলেই দুর্বৃত্তদের দেশের রাজনীতি ও প্রশাসন থেকে হটিয়ে নিজেরা কান্ডারী হাতে নিয়েছিলেন। সে সুন্নত আজকের ধর্মপরায়ন মানুষদেরও কার্যে পরিণত করতে হবে। নিছক বক্তৃতা বা উপদেশ খয়রাতে দেশ সমৃদ্ধতর হবে না। তাদেরকে দেশের এক্সিকিউটিভ ফোর্স বা পলিসি বাস্তবায়নকারী শক্তিতে পরিণত হতে হবে। এজন্য ময়দানে নামা প্রতিটি স্ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের জন্য অপরিহার্য। এটিই ইসলামের মৌল শিক্ষা। ফলে নবীজী (সারূ) যেমন নেমেছিলেন তেমনি নেমেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। সেদিন ন্যায় কর্ম ও ধর্মপরায়নতা শুধু মসজিদে নয় সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। তবে জাতি গঠনের পূর্বে ব্যক্তি গঠন জরুরী। ইমারাত নির্মাণের পূর্বে ইট তৈরির ন্যায় এটি অপরিহার্য। আর ব্যক্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিছক জ্ঞান ও শারীরিক সুস্থ্যতা নয়, বরং সবচেয়ে অপরিহার্য হলো তার ব্যক্তিত্ব। ঐ ব্যক্তিত্বই একজন মানুষকে মহত্তর পরিচয় দেয়। এ গুণটির জন্যই সে প্রকৃত মানুষ। আর ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সৃষ্টির মূল উপাদান হলো সত্যবাদিতা। হযরত আলী (রারূ) এক্ষেত্রে একটি অতিশয় মূল্যবান কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ব্যক্তির ব্যতিত্ব তার জিহধ্বায়। তথা সত্যবাদিতায়। যার জিহধ্বা বা কথা বক্র তার চরিত্রও বক্র। সুদর্শন ও সুস্থ্য শরীরের অধিকারী হয়েও সে ব্যক্তিত্ব পঙ্গু। ভাল মানুষ হিসেবে সে সমাজে পরিচিতি পেতে পারে না। বক্র ইট যেমন একটি ভাল প্রাসাদে বিন্যস্ত বা ফিট হতে পারে না তেমনি মিথ্যাচারী মানুষ দিয়ে একটি সভ্য ও উন্নততর সমাজ নির্মিত হয় না। এমন অস্ ও মিথ্যাচারী মানুষের ভীড়ে একটি জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়। গরু মহিষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বরং একটি জাতি বিস্তর লাভবানই হয়, কিন্তু মিথ্যাচারী মানুষের বৃদ্ধিতে দেশের ধধ্বংস নেমে আসে। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ বা নৈসর্গিক পরিবেশও সে জাতির কোন কল্যাণই করতে পারে না। বাংলাদেশের বিপন্নতা বস্তুত মিথ্যাচারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে, সম্পদের অপ্রতুলতায় নয়। ভুগোল, জলবায়ু বা জনসংখ্যার কারণেও নয়। জাতিকে সদাচারী ও সত্যবাদী বানানোর দায়িত্ব দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের। তারাই জাতির সংস্কৃতির নির্মাতা। তারা সংস্কার আনে ব্যক্তির আচরণ ও রুচীবোধে। অতি প্রতিকুল অবস্থাতেও সত্য কথা বলার জন্য যে মনোবল দরকার সেটির জোগান দেয় তারাই। তারাই সমাজের মিথ্যুক ও দুশ্চরিত্রদের বাঁচাটা নিরানন্দ করে দেয়। সম্পদের অধিকারী হয়েও দুর্বৃত্তরা সমাজে নন্দিত না হয়ে প্রচন্ড নিন্দিত হয় বস্তুত এদের কারণেই। নমরুদ,ি ফরাউন, হালাকু বা হিটলারগণ ইতিহাসে যে আজও ঘৃণিত তা এসব ন্যায়পরায়ন বুদ্ধিজীবীদের কারণেই। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটিই হয়নি।
সমাজে আজ যে মূল্যবোধের প্রচন্ড অবক্ষয় সেটিই প্রমাণ দেয় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা মানবিক মূল্যবোধের নির্মাণে কতটা ব্যর্থ। শিক্ষা ও সাহিত্যের ময়দান থেকে মানুষ একটি সমৃদ্ধ চেতনা পাবে, উন্নত মূল্যবোধ নির্মিত হবে এবং তা থেকে সমাজ একটি সভ্যতর স্তরে পৌঁছবার সামর্থ পাবে সেটি কািিখত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বরং তারাই জন্ম দিয়েছেন বর্তমান অবক্ষয়ের। বস্তুত তাদের কারণেই বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ। তাদের সাথে যাদেরই সাহচর্য বেড়েছে তারাই রোগগ্রস্ত হয়েছে চৈতন্য, চরিত্রে ও মূল্যবোধে। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের এ ব্যর্থতার বড় কারণ, তাদের অধিকাংশই কোন না কোন মিথ্যাচারী নেতার আশ্রিয় রাজনৈতিক শ্রমিক। সমাজে মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠার চেয়ে এসব নেতাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাই তাদের মূল লক্ষ্য। নেতাদের মিথ্যাচার ও চারিত্রিক কদর্যতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে অন্যদের দেখিয়ে দেয়ার পরিবর্তে সে মিথ্যাচারের প্রচারে তারা স্বেচ্চছা শ্রমিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। আমাদের রাজনৈতিকগণ কতটা মিথ্যাচারী এবং আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সে মিথ্যা প্রচারে কতটা বিবেকবর্জিত তার সবচেয়ে চোখা ধাঁধানো নজির শেখ মুজিবের ৩০ লাখের তথ্য। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের দুষ্কর্ম তুলে ধরার জন্য এ বিষয়টি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যে কোন ধর্ম যে কোন মূল্যবোধই মানুষকে সত্যবাদী হতে শেখায়। এমনকি চরম শত্র“র বিরুদ্ধেও। খুনের আসামীর বিরুদ্ধেও আদালতে মিথ্যা বলার অধিকার কোন আইনই কাউকে দেয়নি। একজন ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, শত্র“র সামনে সে মিথ্যা বলে। বন্ধুর সামনে ফেরেশতা সাজাতে সে চারিত্রিক ভ্রষ্টতা দূর হবার নয়। মিথ্যার প্রতি আসক্তিই ব্যক্তির চেতনার ও চরিত্রের সঠিক পরিমাপ দেয়। এ পরিমাপে শেখ মুজিবই শুধু নয়, তার অনুগত বুদ্ধিজীবীরাও সদাচারী প্রমাণিত হননি। শেখ মুজিব কোনরূপ জরিপ না করেই বললেন, একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। সে সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। অর্থাৎ ৭৫ মিলিয়ন। ৭৫ মিলিয়নের মধ্যে ৩০ লাখ বা তিন মিলয়ন নিহত হলে প্রতি ২৫ জনে একজন নিহত হতে হয়। স্কুলের ছাত্ররা এ হিসাব বুঝে। যে গ্রামের প্রতি বাড়িতে গড়ে ৫ জনের বাস সে গ্রামে প্রতি ৫ বাড়িতে একজনকে নিহত হতে হয়। অতএব যে গ্রামে ১০০ ঘর আবাদী সেখানে কমপক্ষে ২০ জনকে প্রাণ দিতে হয়। সে গ্রামে যদি কেউই মারা না যান তবে পাশের সম বসতিপূর্ণ গ্রামে ১০০ ঘরে ৪০ জনকে নিহত হতে হবে। নইলে ৩০ লাখের হিসাব মিলবে না। বাংলাদেশে যাদের বাস তারা শেঝ মুজিবের এ মিথ্যা তথ্য বুঝলেও বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই সেটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, আদালতের উকিল বা পত্রিকার কলামিস্ট হয়েও এখনও সে কথা নির্দ্বিধায় বলেন। মিথ্যাচারী হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, কোন কথা শুনা মাত্র তার সত্যাসত্য বিচার না করেই সে বলে বেড়াবে। যত তিক্তই হোক আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচারীতা প্রমাণের জন্য এ বিষয়টি একটি মজবুত দলিল।
আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র বিধধ্বংসী এ মিথ্যা প্রবণতা দূর করতে হলে বুদ্ধি চর্চায় সততা ও স্বচ্চছতা আনতেই হবে। মিথ্যাচারিতা মহাপাপ। বস্তুত সব পাপের জন্ম এ পাপ থেকেই। নবীজী (সারূ) ব্যাভিচার, চৌর্যকর্ম ও মিথ্যাচারে লিপ্ত এক ব্যক্তিকে চারিত্রিক পরিশুদ্ধির জন্য প্রথমে যে পাপ কর্মটি পরিত্যাগ করতে উপদেশ দিয়েছিলেন সেটি হলো মিথ্যাচার। নানা পাপের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরও মিথ্যা চর্চা বর্জন করতে হবে। ফলে আমাদের জাতীয় পুনর্গঠনে প্রথমে যে কাজটি শুরু করতে হবে সেটি মিথ্যাচারী রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি পরিত্যাগের মধ্য দিয়ে। মিথ্যা ও মিথ্যাচারীদের দূরে হঠাতে পারলে অন্য সব পাপাচার এমনিতেই দূর হবে। নইলে সমাজের দুর্বৃত্ত মিথ্যাচারিরা শুধু দেশের নেতা, মন্ত্রী বা বুদ্ধিজীবী নয়, জাতির পিতা হওয়ারও স্বপ্ন দেখবে। কারণ মিথ্যাচারিতা জাতীয় জীবনে প্রাধান্য পেলে ফেরাউনরা শুধু রাজ নয়, খোদা হওয়ারও স্বপ্ন দেখে। এটিই ইতিহাসের শিক্ষা। তাই সব যুগের ফেরাউনেরাই মিথ্যাকে গণমুখিতা দিয়েছে। আর সে কাজে আশ্রিত শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করেছে সে সমাজের বুদ্ধিজীবীদের। কারণ, মিথ্যাচার প্রসারে তাদের ন্যায় কার্যকর শক্তি আর নেই। এজন্যই মধ্যযুগের স্বৈরাচারী রাজাদের দরবারে বহু গৃহপালিত সভাকবি থাকতো। বাংলাদেশেও এমন সত্য বিবর্জিত গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা অনেক। তাছাড়া তাদের উপর দেশটির চি?িত শত্র“দের পুঁজি নিয়োগ হয়েছে বিস্তর। তাই বাংলাদেশকে গড়তে হলে বুদ্ধিবৃত্তির মিথ্যাচারিতা বন্ধ করতে হবে।
ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মৃত্যু ঘটে দেহের জীবকোষের, কিন্তু মিথ্যাচরিতায় মৃত্যু ঘটে বিবেকের। ফলে যক্ষা, কলেরা, টাইফয়েডের মহামারীতে বাংলাদেশের ততটা ক্ষতি হয়নি যতটা হয়েছে মিথ্যাচারিতার ব্যাপ্তিতে। দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হওয়ার মূল কারণ এটিই। মিথ্যাচারিতার যে বীজ আমাদের রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রোথিত হয়েছিল তা এখন পরিণত হয়েছে প্রকান্ড মহিরুহে। মিথ্যার ফসল যে পাপাচার ও দুর্নীতি, বাংলাদেশ আজ তা নিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে জাতিকে সেটি তলাশূন্য করেছে। এ রোগ আমাদের ইজ্জত নিয়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকেই বিপন্ন করছে। মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো সে সত্যের পক্ষে সাক্ষী দিবে এবং মিথ্যার মুখ উন্মোচিত করবে। এটি আমাদের ধর্মীয় দায়বদ্ধতা। কিন্তু সে কাজটিই যথাযথভাবে হয়নি। মিথ্যার সামনে নীরবতা ও সদাচারিতা থেকে এ বিচ্যুতি একটি জাতিকে কখনই সাফল্য দিতে পারে না। শুধু দেশ গড়াই নয়, মুসলমান হওয়ার জন্যও বস্তুত সত্য চর্চার বিকল্প নেই। সত্য প্রতিষ্ঠা পেলে মিথ্যা দুরীভূত হবেই। যেমন অন্ধকার অপসারিত হয় আলোর আগমনে। আর সে আলো জ্বালানোর দায়িত্ব নিতে হবে সত্যাচারী বুদ্ধিজীবীদের। মুসলিম সমাজে এ কাজের জন্যই তারা আল্লাহর খলিফা ও রাসুলের (সাঃ) প্রতিনিধি। দেশ গড়ার কাজ শুরু করতে হবে এখান থেকেই। প্রতিটি মুসলমানের উপর এটাই বড় দায়ভার।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018