একাত্তরের গণহত্যা ও ভারতসেবীদের অপরাধনামা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on February 23, 2025
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
গণহত্যার সংজ্ঞা এবং অপরাধের রাজনীতি
গণহত্যা হলো একটি বিশেষ দল, বর্ণ, ধর্ম বা ভাষাভাষী মানুষের নির্বিচারে হত্যা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণহত্যার নৃশংস ঘটনা বার বার ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে। সম্প্রতি অতি নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হলো ফিলিস্তিনের গাজায়। গাজায় যা ঘটেছে তা হলো গণহত্যার টেক্সট বুক কেস। বাংলাদেশেও গণহত্যার নৃশংসতা কয়েকবার ঘটেছে। সেটি যেমন ১৯৭১’য়ের মার্চে এবং ১৯৭১’য়ের ডিসেম্বরে। গণহত্যার সে দুটি পর্ব ছিল বিহারীদের নির্মূলের লক্ষ্যে। মুজিব আমলে পরিকল্পিত গণহত্যা হয়েছে বামপন্থী ও জাসসের নির্মূলে। নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে হাসিনার আমলে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময়। শাপলা চত্বরের গণহত্যাটি ছিল ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে।। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। সে হত্যাকান্ডে প্রায় ২ হাজার ব্যক্তি প্রাণ হারায় এবং ২০ হাজারের বেশী আহত হয়। সে গণহত্যা থেকে এমন কি শিশুরাও রক্ষা পায়নি।
গণহত্যার অন্যতম দেশ হলো ভারত। এদেশে বার বার গণহত্যা হয়েছে মুসলিম, শিখ, আদিবাসী ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে। এ অবধি প্রায় এক লক্ষ নর-নারীকে হত্যা করা হয়েছে কাশ্মীরে। ১৯৪৮ সালে লক্ষাধিক মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে হায়দ্রাবাদে। হায়দ্রাবাদে সে গণহত্যা চালানো হয়েছিল মুসলিম শাসনাধীন স্বাধীন হায়দারাবাদকে ভারতভুক্ত করার ভারতীয় আগ্রাসন কালে। তাছাড়া ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামে মুসলিম নির্মূল করতে নিয়মিত গণহত্যা চালানো হয়। ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, সেখানে ৫ হাজার মুসলিমকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৮৩ সালে রাজিব গান্ধি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তখন আসামের নেলীতে প্রায় ১০ হাজার মুসলিম গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। সে হত্যাকাণ্ডে নারী ও শিশুরাও বাদ পড়েনি। এতো বড় হত্যাকান্ডের পরও কাউকে সে হত্যাকান্ডের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি, কারো কোন শাস্তিও হয়নি। সেটিই ভারতীয় নীতি। কারণ, গণহত্যা কালে শুধু মানব হত্যার কাণ্ডই ঘটে না, বৈচারিক ব্যবস্থাকেও হত্যা করা হয়। সম্প্রতি একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটিত হলো ভারতের মনিপুর রাজ্যে।
কতজন মারা যায় ২৫ মার্চের রাতে?
লক্ষণীয় হলো, ভারতে গণহত্যা বার বার সংঘটিত হলেও সেখানে গণহত্যাকে কেন্দ্র করে দেশভাঙ্গার আন্দোলন হয়নি। অথচ সে কাজটি হয়েছে পাকিস্তানে; এবং সেটি ১৯৭১’য়ে। পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজকে জায়েজ করা হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান আর্মির পরিচালিাত গণহত্যার সূত্র ধরে। কিন্তু সে রাতে কতজন মারা যায় -সে সংখ্যাটি আজও জানা যায়নি। যারা মারা গেছে তাদের নামের তালিকাও প্রকাশ করা হয়নি। তবে ২৫ মার্চের মৃতদের সংখ্যা নিয়ে যে প্রচুর মিথ্যাচার করা হয়েছে -সে প্রমাণ প্রচুর। সে মিথ্যাচারটি করা হয়েছে রাজনৈতিক প্রয়োজনে। গণহত্যা নিয়ে রাজনীতি করার স্বার্থে নিহতদের প্রকৃত সংখ্যাটি জানার জন্য কখনোই কোন চেষ্টা হয়নি। অথচ তা নিয়ে রাজনীতি হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের ধ্বংসকে জায়েজ করার লক্ষ্যে। গণহত্যা নিয়ে মিথ্যাচারের নমুনা দেয়া যাক। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের সিদ্দিকী তাই বই “স্বাধীনতা ’৭১” ‘য়ের ১৮ পৃষ্ঠায় লিখেছে “পঁচিশে মার্চের অভিশপ্ত কাল রাতেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলায় তিন থেকে পাঁচলক্ষ মানুষ হানাদারদের বর্বর আক্রমণে শহীদ হন।”
এক রাতেই ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষের হত্যা? কত বড় মিথ্যাচার? এবং এই প্রকাণ্ড মিথ্যা নিয়েই তারা পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে একটি দলিল তৈরী করে এবং ভারতের অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে নামে। যে কোন নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষের মৃত্যু অবশ্যই অতি নিন্দনীয়। সভ্য দেশে সে নিন্দনীয় হত্যাকান্ডের বিচার হয় এবং অপরাধীদের শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু সেটিকে কেন্দ্র করে কোন দেশকে ধ্বংস যায় করা যায়না।
তবে যারা এরূপ মিথ্যা রটিয়েছিল তাদের কাণ্ডহীনতাটি সুস্পষ্ট। রাজনৈতিক কুমতলব মানুষকে যে কতটা জ্ঞানশূণ্য করে এ হলো তার নমুনা। মাত্র এক রাতের মধ্যে ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষ হত্যা করা ও তাদের লাশ দাফন করা বা গায়েব করা কি আদৌ সম্ভব? সে জনশক্তি কি পাক বাহিনীর ছিল?একাত্তরের মার্চ অবধি পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র এক ডিভিশন পাক সৈন্য ছিল; তাতে সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪ হাজার। পরে অবশ্য আরো দুই ডিভিশন এনে সৈন্য সংখ্যা ৪৫ হাজার করা হয়। সহজেই বুঝা যায়, ২৫ মার্চের রাতে ৩ থেকে ৫ লাখ হত্যার কাহিনীটি ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ হত্যার মতই ভূয়া ও বানোয়াট। ৯ মাসে ৩০ লাখ হত্যা করতে হলে প্রতি দিন ১১ হাজার ১১ শত মানুষকে এবং প্রতি ২৫ জন পূর্ব পাকিস্তানীর মাঝে ১ জনকে হত্যা করতে হয়। এটি কি বিশ্বাসযোগ্য? গণহত্যা যেমন নিন্দনীয়, তেমনি নিন্দনীয় হলো এরূপ মিথ্যাচার। অথচ বাংলাদেশে সে মিথ্যাচারটি বাঙালি ফ্যাসিস্টদের পক্ষ থেকে অতি বিশাল আকারে হয়েছে।
১৯৭১’য়ে ২৫ মার্চের রাতে কতজন নিহত হয়েছিল তার উপর একমাত্র গবেষণা কর্মটি করেছেন ভারতীয় গবেষক শর্মিলা বোস। তিনি তাঁর গবেষণার বিবরণ ছেপেছেন নিজের লেখা Dead Reckoning বইতে। তথ্য সংগ্রহে তিনি যেমন ঢাকার হিন্দু মহল্লা শাখারি পাড়ায় গেছেন, তেমনি কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সেসব শিক্ষকদের সাথে যারা সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ গৃহে অবস্থান করছিলেন। সে রাতে যারা ট্যাংক নিয়ে ঢাকার রাস্তায় নেমেছিল তাদের সাথে কথা বলতে শর্মিলা বোস পাকিস্তানে গেছেন। তিন যা বিবরণ পেয়েছেন তাত এক রাতে ৩ থেক ৫ লাখ মানুষের নিহত হওয়ার তথ্য মেলে না। সেটিকে গাঁজাখোরী মিথ্যা মনে হয়। বলা হয়েছে, শাখারি পাড়ায় ২৫ মার্চের এক রাতে ৮ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়। শর্মিলা বোস স্থানীয় হিন্দুদের সাথে কথা বলে জানতে পারেন ঐ রাতে ১৪/১৫ জন নিহত হয়। তার মধ্যে একজন শিশুও ছিল। শর্মিলা বোস সেনা অফিসারদের সাথে আলাপ করে জানতে পারেন ঐ রাতে ৩টি ট্যাংক নামানো হয়েছিল। ঐ ট্যাংকের মূল কামানগুলি একটি বারের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি। আওয়াজ সৃষ্টির জন্য পাশের দুটি ছোট কামান থেকে মাঝে মাঝে গোলা ছোড়া হয়েছিল। এবং জানায়, ট্যাংকগুলি প্রধান রাস্তা দিয়ে চালানো হয়েছিল, কোন আবাসিক এলাকায় ঢুকেনি। এমন কি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং নিউ মার্কেট এলাকাতেও যায়নি। প্রশ্ন হলো এভাবে কি এক রাতে ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষ হত্যা করা যায়? আর হত্যা করে থাকলে তাদের লাশ গায়েবের সময় পেল কোথায়? লাশগুলো রাস্তায় ফেলে রাখলেও ঢাকায় কি এতো কুকুর, শিয়াল ও শকুন ছিল যে লাখ লাখ লাশকে রাতারাতি গায়েব করে দিবে? মিথ্যা উৎপাদনে বাঙালি ফ্যাসিস্ট ও বাম কাপালিকদের মগজ যে কত উর্বর -এ হলো তার নজির। ভাঙ্গার কাজের শুরু কি ২৫শে মার্চের পর থেকে?
আরো প্রশ্ন হলো, যারা পাকিস্তান ভাঙ্গতে নেমেছিল তারা কি সে কাজটি ২৫ শে মার্চের পর শুরু করে? বাংলাদেশের পতাকা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একাত্তরের ৩রা মার্চেই উত্তোলন করা হয়। এ থেকে বুঝা যায়, ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ড না ঘটলেও তারা ভারতকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধ অবশ্যই শুরু করতো। শেখ মুজিব তো পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল ১৯৪৭ থেকেই -যা মুজিব পাকিস্তান থেকে ফিরে ১৯৭২’য়ের ১০ জানুয়ারীর সোহরাওয়ার্দী উদ্দানের জনসভায় গর্বভরে প্রকাশ করে। তাছাড়া ভারতীয় RAW’য়ে সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে মুজিব যে আগরতলা ষড়যন্ত্র করেছিল সেটিও তো ষাটের দশকেই। অপর দিকে সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ, আব্দুর রাজ্জাক পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে ছাত্রলীগের যে নিউক্লিয়াস তৈরী করে -সেটির শুরুও তো ষাটের দশকে। পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধ শুরু করতে তার তাই একাত্তরের ২৫ মার্চের জন্য অপেক্ষা করেনি।
ফিতনা কেন মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর?
কোন মানুষকে হত্যা করলে সে প্রাণ হারায়। কিন্তু কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গলে ও ক্ষুদ্রতর করলে তখন সে দেশ অধিকৃত হয় শত্রু শক্তির হাতে। তখন স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা হারায় সেদেশে বসবাসকারী কোটি কোটি মুসলিম। এটি মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এক গুরুতর নাশকতা। এটি এমন এক ফিতনা -যা মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর। ফিতনা তো তাই যা মুসলিম দেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে এবং অসম্ভব করে দেশবাসীর পূর্ণ ইসলাম পালন। ফিতনা হলো এমন ভাতৃঘাতী সংঘাত যা একটি মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করে এবং দেশবাসীকে গৃহযুদ্ধের মধ্যে ফেলে। কোন দেশে ফেতনা শুরু হলে সে দেশে মুসলিমদের আর ভবিষ্যৎ থাকে না; মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার বদলে ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা অঞ্চল ভিত্তিক এজেন্ডাকে বিজয়ী করার যুদ্ধে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে সেটিই হয়েছিল। আর সে ফিতনা সৃষ্টির নায়ক ছিল মুজিবে অনুসারী বাঙালি ফ্যাসিস্ট ও বাম কাপালিকগণ। তাই ইসলামে জাতীয়বাদ যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো নানারূপ মতবাদী রাজনীতি। এগুলি হলো ফেতনা সৃষ্টির শয়তানী হাতিয়ার।
মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনের সুরা বাকারার ১৭ নম্বর আয়াতে ফিতনাকে মানব হত্যার চেয়েও নাশকতামূলক অপরাধ রূপে ঘোষণা দিয়েছেন। মহা আল্লাহতায়ালার সে রায় তো শত্রুর হাত থেকে মুসলিমদের জান, মাল, ইজ্জত ও স্বাধীনতার বাঁচানোর স্বার্থে। মুসলিমগণ এমন ভাতৃঘাতী অপরাধে লিপ্ত হলে বিজয়ী হয় শয়তানের এজেন্ডা। ১৯৭১’য়ে আওয়ামী ফাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামপন্থীদের হাতে স্বাধীন বাংলা ও বাঙালির নামে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে তাতে লাভবান হয়েছে আগ্রাসী ভারত। তাদের ষড়যন্ত্রের ফলে পাকিস্তান খণ্ডিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন ভারত পরিবেষ্ঠিত এক অরপক্ষিত রাষ্ট্র। আর অরক্ষিত হওয়ার অর্থই তো পরাধীন হওয়া। ফলে নিরাপত্তা নেই বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা, জান-মাল, ইজ্জত-আবরুর। তাই প্রতি বছর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের গুলীতে এক হাজারের বেশী বাংলাদেশীদের নিহত হতে হয়। নিহত ফালানীকে তারকাঁটার বেড়ায় ঝুলতে হয়। ভারতীয় ডাকাতির শিকার হয় পদ্মা, তিস্তাসহ ৫৪টি নদীর পানি। অপর দিকে ১৯৭১’য়ের ২৫ শে মার্চের রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে যত মানুষ নিহত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ নিহত হয়েছে হাসিনা এবং মুজিবের আমলে। অথচ ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ অবধি ২৩ বছরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে একজন পূর্ব পাকিস্তানীও নিহত হয়নি। অথচ তখনও এ প্রদেশের সেনানীবাসগুলিতে পাকবাহিনী ছিল।
একাত্তরের যুদ্ধ কি এড়ানো যেত না?
প্রশ্ন হলো, একাত্তরের যে যুদ্ধটি এতো অর্থক্ষয় ও রক্তক্ষয়কে অনিবার্য করলো, সেটি কি এড়ানো যেত না? কেন এড়ানো গেল না -এ নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। এমন একটি যুদ্ধে পাকিস্তানের যে সামান্যতম আগ্রহ ছিল না -সে প্রমাণ তো প্রচুর। সেটি বুঝা যায় একাত্তরের মার্চে মাত্র এক ডিভিশন তথা ১৪ হাজার সৈন্যের পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান দেখে। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকার তো চাচ্ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। সে জন্যই আয়োজন করে একটি বহু দলীয় নির্বাচনের। কিন্তু শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক নিষ্পত্তির উদ্যোগ নস্যাৎ করে দেয় ভারত এবং ভারতের অনুগত বাঙালি ফ্যাসিস্ট সেবাদাসগণ। তাদের সাথে ছিল পাকিস্তানের আজন্ম শত্রু বাম কাপালিকগণ। তারা চায়নি অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে যাক এবং চায়নি মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোক। সে কথাটি এখন তারা প্রকাশ্যেই বলে।
পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশের মাঝে শেখ মুজিবের দল আওয়ামী লীগ জিতেছিল মাত্র একটি প্রদেশে। ইয়াহিয়া খান চাচ্ছিল, মুজিব অন্য প্রদেশের বিজয়ী নেতাদের সাথে সমাঝোতা করুক এবং কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করুক। সেটি না করলে তার শাসন পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। সে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি নজরে রেখেই ১৯৪৭ থেকে যতবারই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নসরকার গঠিত হয়েছে তাতে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান -এ উভয় প্রদেশের লোকদের নিয়েই সরকার গঠিত হয়েছে। ফলে ২৩ বছরে বাংলা থেকে ৩ জন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে; ২ জন প্রেসিডেন্টও হয়ে|ছে। ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারাও সেটিই চাচ্ছিল। এ নিয়ে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভূ্ট্টোর সাথে ঢাকায় মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আলোচনা শুরু হয়।
ঢাকায় যখন আলাচনা চলছিল তখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাগণ মুজিবের উপর লাগাতর চাপ দিচ্ছিল যাতে মুজিব ভূ্ট্টোর সাথে কোন রপ আপোষ ফর্মূলা মেনে না নেয়া হয়। একই লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের উপর কাজ করছিল ঢাকায় অবস্থানরত RAW য়ের এজেন্টগণ। আওয়ামী লীগের বহু নেতা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাথে কাজ করছিল দলটির জন্মের পূর্ব থেকেই। তারা সম্মিলিত ভাবে ও পরিকল্পিত ভাবেই একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তিকে অসম্ভব করে।
যুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানের অপ্রস্তুতির কথা ভারত জানতো। মুজিব দাবী তুলে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের বদলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন তুলে নিয়ে তার হাতে এই প্রদেশের শাসন ক্ষমতা দেয়া হোক। ইয়াহিয়া খান মনে করে, এটি হলো বিনা যুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ বানানোর পরিকল্পনা। ফলে আলোচনা ব্যর্থ হয়। মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র এক ডিভিশন পাক সৈন্যের অবস্থানের খবর মেজর জিয়াও জানতো। সে সৈন্যের মাঝে বহু হাজার সৈন্য ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্য। ফলে বিদ্রোহ করলে বিজয় অতি সহজ হবে মনে করে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। মেজর জিয়া তার উর্ধতন অবাঙালি অফিসার নিরস্ত্র কর্নেল জানজুয়াকে তার বাসগৃহে হত্যার ব্যবস্থা করে।
৮ মাসের যুদ্ধে দেখা গেল মুক্তিবাহিনী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান দূরে থাক, একটি জেলা বা একটি মহাকুমা বা একটি থানাও দখলে নিতে পারিনি। ভারত তখন পিছনে না থেকে সরাসরি যুদ্ধে নামার পরিকল্পনা নেয়। পাকিস্তানী গোয়েন্দাগণ সেটি বুঝতে পারে। মাসটি ছিল সেপ্টেম্বর মাস। ভারতের সাথে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়াতে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার প্রশ্নে রিফারেন্ডামের প্রস্তাব দিয়ে ইসলামে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার জয় কুমার অটালের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটি প্রস্তাব ইন্দিরা গান্ধির কাছে পাঠায়। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধি সেটিই নাকচ করে দেয় এবং বলে, ১৯৭০’য়ের নির্বাচনই হলো স্বাধীনতার পক্ষে রিফারেন্ডাম। (সূত্র: Sission, Richard and Leo Rose, War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, Berkeley: University of California, 1990). অথচ ইন্দিরা গান্ধির সে দাবীটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল। ১৯৭০’য়ের নির্বাচন কখনোই স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে রিফারেন্ডাম ছিল না।
ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধের পথ বেছে নেয়। কারণ, ভারত এমন একটি যুদ্ধের জন্য ১৯৪৭ থেকেই অপেক্ষায় ছিল। ভারতের পাশে ছিল তার পুরনো মিত্র সোভিয়েত রাশিয়া। অপর দিকে পাকিস্তানের উপর তখনও চলছিল মার্কিনী অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। চীন, ইরান,সৌদি আরব ও তুরস্কের ন্যায় মুসলিম দেশগুলি মৌখিক সমর্থন দিলেও কেই অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা দেয়নি। পাকিস্তানের পরাজয়ের কারণে ভারত সুযোগ পায় অবাধ লুণ্ঠনের এবং সুযোগ পায় বাংলাদেশকে একটি পদানত গোলাম রাষ্ট্র বানানোর। এভাবেই ভারতীয় হিন্দুগণ পায় মুসলিমদের উপর তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজয়। সে বিজয় পেয়ে ইন্দিরা গান্ধি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে গর্বভরে বলে, “হাজার সাল কা বদলা লে লিয়া।” ভারত সে বদলা নেয়ার জন্য এতোই বেপরোয়া ছিল যে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে সে যুদ্ধ পরিহারের উপায় ছিল না। উপায় ছিল না পরাজয় এড়ানোরও। ভারতের ঘরে সে বিজয়টি তুলে দিয়েছে যেমন শেখ মুজিব এবং তেমনি মুজিবের অনুসারী মুক্তি বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর বাঙালি সৈনিকেরা। তবে শেখ মুজিব ভারতের হাতে এমন একটি বিজয় তুলে দেয়ার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্রের প্রথম দিন থেকেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। একাত্তরে বস্তুত সে ষড়যন্ত্রই চুড়ান্ত ভাবে সফল হয়। ২৩/০২/২০২৫
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- একাত্তরের গণহত্যা ও ভারতসেবীদের অপরাধনামা
- বাঙালি মুসলিম জীবনে পূজা ও নাশকতার উৎসব
- স্বাধীনতার সুরক্ষার ভাবনা
- বাম-অধিকৃত বিএনপি এবং বাংলাদেশের জন্য নতুন বিপদ
- পরিশুদ্ধ ব্যক্তি ও রাষ্ট্র নির্মাণের রোডম্যাপ
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- February 2025
- January 2025
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018