একাত্তরের গণহত্যা (৮)

 

যে কাহিনী শুনতে নেই (১৩)
================
মোহনগঞ্জ হত্যাকান্ড

সংগ্রহে: কাউ কাউস
——————-
০১.
“… আমার নানাজান দীর্ঘদিনের মুসলিম লীগ কর্মী। তখন শান্তি কমিটির সভাপতি হয়েছেন। নানাজানের শান্তি কমিটিতে যোগ দেবার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি। আমি আমার নানাজানের জন্যে সাফাই গাইছি না। আমার সাফাইয়ের তার প্রয়োজন নেই। তবু সুযোগ যখন পাওয়া গেল বলি। চারদিকে তখন ভয়ঙ্কর দু:সময়। আমার বাবাকে পাকিস্তানী মিলিটারী গুলি করে হত্যা করেছে। নানাজান আমাদের সুদূর বরিশালের গ্রাম থেকে উদ্ধার করে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন। তাও এক দফায় পারেননি। কাজটি করতে হয়েছে দু’বারে। তার অনুপস্থিতিতেই তাকে শান্তি কমিটির সভাপতি করা হল। তিনি না বলতে পারলেন না। না বলা মানেই আমাদের দু’ ভাইয়ের জীবন সংশয়। আমাদের আশ্রয় সুরক্ষিত করার জন্যেই মিলিটারীদের সঙ্গে ভাব রাখা তিনি প্রয়োজন মনে করেছিলেন। তার পরেও আমার মা এবং আমার মামারা নানাজানের এই ব্যাপারটি সমর্থন করতে পারেননি। যদিও নানাজানকে পরামর্শ দিতে কেউ এগিয়ে আসেননি। সেই সাহস তাদের ছিল না। তারা নিজেদের সমর্পন করেছিলেন নিয়তির হাতে।

শান্তি কমিটিতে থাকার কারণে মিলিটারীদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কত মানুষের জীবন তিনি রক্ষা করেছেন সেই ইতিহাস আমি জানি এবং যারা আজ বেঁচে আছেন তারা জানেন। গুলির মুখ থেকে নানাজানের কারণে ফিরে আসা কিছু মানুষই পরবর্তী সময়ে তার মৃত্যুর কারণ হযে দাঁড়ায়। তাকে মরতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। তার মত অসাধারণ একজন মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা গেলেন, এই দু:খ আমার রাখার জায়গা নেই॥”
— হুমায়ুন আহমেদ / আমার আপন আধাঁর ॥ [ প্রতীক প্রকাশন – ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩ । পৃ: ৮১ ]
০২.
“… বাবার বাড়ি মোহনগঞ্জ পৌছেই আমরা একটা অত্যন্ত খারাপ খবর পেলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই মোহনগঞ্জ থানা, সেখানে পাকিস্তান মিলিটারি এসে ঘাঁটি তৈরি করেছে। থানার চারিদিকে গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে, থানা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, বালুর বস্তা দিয়ে বাংকার তৈরি হয়েছে। খারাপ খবর সেটি নয়, খারাপ খবরটি হচ্ছে বাবা যখন আমাদের আনতে গিয়েছেন তখন মিলিটারিরা তাকে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তৈরি করে দিয়েছে। বাবা ছিলেন না বলে প্রথমে আরেকজনকে তৈরি করেছিল। সে এলাকা ছেড়ে সপরিবারে পালিয়ে গেছে। এখন বাবা হচ্ছেন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, মিলিটারির হুকুম তিনি এলেই যেন দেখা করতে যান।

বাবা খুব মুষড়ে পড়লেন। মিলিটারি এসেই এই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব শুরু করেছে, একেবারে বাড়ির পাশে এসে গুলি করে মানুষ মেরে পুকুরে ভাসিয়ে দিয়েছে। দিন দুপুরে মেয়েদের ওপর অত্যাচার। মানুষজনের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, গরু বাছুর ধরে খাওয়ার কথা তো ছেড়েই দিলাম। বাবা বারান্দায় জলচৌকিতে বসে দীর্ঘ সময় ভাবলেন। তার এমনিতে এত বড় পরিবার, তার ওপর শহর থেকে পালিয়ে ছেলেরা তাদের বউ-বাচ্চা নিযে এসেছে। এখন আমিও আমার ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছি, সবাইকে নিয়ে পালিয়ে যাবেন কোথায়, সবাই তো পালিয়ে তার কাছেই এল। পালিয়ে যদি না যান তিনি কী করবেন? মিলিটারিকে বলবেন তিনি এই দায়িত্ব চান না? কী কৈফিয়ত দেবেন?
বাবা কোনো কৈফিয়ত দিতে পারেননি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেই ভয়াবহ অশুভ শক্তির সামনে পরাভূত হয়ে তাকে শান্তি কমিটির দায়িত্ব নিতে হলো।
সেই অপরাধে ডিসেম্বর মাসের আট তারিখ মুক্তিযোদ্ধার একটি দলের হাতে আমার বাবা (শেখ আবুল হোসেন) এবং তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী আমার ছোট ভাই নজরুল মারা যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই সময়টি বড় নিষ্করুণ সময়।
আমার দু:খ হয় এই ভেবে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার কথা সত্যিকারভাবে যদি একজন মানুষ জানত সেটি হচ্ছে আমার বাবা।

… অসংখ্য মানুষকে বাবা প্রাণে রক্ষা করেছিলেন, সেনাবাহিনীর কাছে গিয়ে তাদের প্রাণ ভিক্ষা করতে গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রকৃত রূপ তিনি যেভাবে দেখেছিলেন, আর কেউ সেটা দেখেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি তার যে রকম ঘৃণা ছিল আর কারো সম্ভবত সে রকম ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করেছিল তারা গা ঢাকা দিল। বাবা গা ঢাকা দিলেন না, তিনি তাদের সাথে কোনো সহযোগিতা করেননি, তিনি অসংখ্য মানুষকে প্রাণে বাঁচিয়ে এনেছেন, যাদের প্রাণে বাঁচিয়েছেন তাদের কেউ কেউ মুক্তিবাহিনীতেও যোগ দিয়েছে, তিনি কেন গা ঢাকা দেবেন?
কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পৈশাচিক অত্যাচারের প্রতিশোধের আগুন তবুও তাকে স্পর্শ করেছিল।

আমার বাবা স্বেচ্ছায় শানিত্বাহিনীতে যোগ দেননি, আমাদের সবাইকে নিয়ে পালিয়ে যাবার তার কোনো জায়গা ছিল না, তাই সেনাবাহিনীর অশুভ শক্তির সামনে তাকে সেই কলঙ্কের টীকা পরে থাকতে পরে থাকতে হয়েছিল। তিনি সেনাবাহিনীর সাথে কোনো সহযোগিতা করেননি, বরং অসংখ্য মানুষকে তিনি প্রাণে রক্ষা করেছেন। আমি তাকে কাছ থেকে দেখেছি। তাই জানি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্যে তার মনে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু ছিল না। তাই শুধু আমার বাবার জন্যে রয়েছে আমার বুকভরা ভালোবাসা। কিন্তু যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল তাদের আর কারো জন্যে আমার কোনো ভালোবাসা নেই॥”
— আয়েশা ফয়েজ / জীবন যে রকম ॥ [ সময় – ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ । পৃ: ৭৪-৭৬ ]

০৩.
“… মোহনগঞ্জ থানার প্রভাবশালী দালাল ছিল দৌলতপুর গ্রামের আবুল হোসেন শেখ, নুরুল ইসলাম ও রবিউল্লাহ্। বড় কাশিয়া গ্রামের গোলাম রব্বানী খান পাঠান, সুরুজ আলী পাঠান, ছদ্দু মিয়া, হাবিবুর রহমান সম্রাট, মাহতাব উদ্দিন, আবদুল খালেক, অমজাদ মিয়া। খরম শ্রী গ্রামের আবদুস সাত্তার। দেওথান গ্রামের লাল হোসেন ও ইব্রাহিম। মোহনগঞ্জ থানা মসজিদের তৎকালীন ইমাম সোনামনি খাঁ। মাঘান গ্রামের চাঁন মিয়া, কারী মিয়া। আলোকদিয়া গ্রামের আবদুর রেজ্জাক। মামুদপুর গ্রামের ছুয়াব মিয়া।

মোহনগঞ্জে উপর্যুক্ত দালালদের সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনী অনেক হত্যাকান্ড ও অগ্নিকান্ড ঘটিয়েছিল। মোহনগঞ্জ থেকে হানাদার বাহিনী পলায়ন করলে অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ কয়েক জন দালাললে পিটিয়ে হত্যা করে। সেদিনের গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল আবুল হোসেন শেখ, নজরুল শেখ, নুরুশেখ, আবদুল আজিজ, নুরুল ইসলাম, রবিউল্লাহ, গোলাম রাব্বানী খান পাঠান, ছুদ্দু মিয়া, লাল হোসেন, ইব্রাহিম, সোনামদ্দি খাঁ, আবদুস সাত্তার, আশরাফ আলী চৌধুরী। সাধারণ মানুষ নিহত দালালদের লাশ নদীর ঘাটে ফেলে রেখেছিল॥” — আলী আহাম্মদ খান আইয়োব / নেত্রকোণা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ॥[ গতিধারা – এপ্রিল, ২০০৯।পৃ: ১০

     
 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *