খেলাফত প্রতিষ্ঠার জিহাদ ও সাম্রাজ্যবাদি শক্তির কোয়ালিশন

নতুন সম্ভাবনার পথে

ইসলামের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শুধু পবিত্র কোরআনের প্রচারই করেননি বরং কোরআনী বিধানগুলির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং সে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মজবুত অবকাঠামোও প্রতিষ্ঠা করে যান। সে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোটিই পরবর্তীতে তাঁর মহান সাহাবীদের হাতে খেলাফত নামে পৃথিবীর বিশাল ভূখন্ড জুড়ে প্রতিষ্ঠা পায়।খোলাফায়ে রাশেদার শাসকগণ ছিলেন মূলত নবীজী (সাঃ)র প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পরিচালনায় নবীজী (সাঃ)র রাজনৈতীক ও আধ্যাত্মীক প্রতিনিধি তথা খলিফা।খেলাফতী রাষ্ট্রীয় পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে তাই নবীজীর প্রতিনিধিত্বের দায়বদ্ধতা থেকে। মুসলমান যেমন নামাযের সময় হলে নবীজী (সাঃ)র অনুকরণে নামায পড়ে, মাহে রামাদ্বান এলে নবীজী (সাঃ)র ন্যায় রোযা রাখে, তেমনি কোন দেশ বা রাষ্ট্রের উপর দখল জমাতে পারলে সেখানে খেলাফতের আদর্শে রাষ্ট্রও গড়ে। নবীজী (সাঃ)র এ সুন্নত পালন মুসলমানদের জীবনে এক ধর্মীয় দায়ব্ধতা।নবীজী (সাঃ) নিজে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করলে মুসলমানদের সামনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুন্নতই থাকতো না। শরিয়ত, জিহাদ, জিজিয়া, আ’মিরু বিল মারূফ ওয়া নেহীয়ানুল মুনকার তথা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলের ন্যায় মহান আল্লাহতায়ালার বহু কোরআনী হুকুমই সমাজে পালিত হতো না। ফলে প্রতিষ্ঠা পেত না মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন। তাছাড়া নবীজী (সাঃ)র এ সুন্নতের আনুগত্য ছাড়া কি আল্লাহর হুকুম পালিত হয়? তাতে কি মুসলমান হওয়া যায়? সাহাবাগণ নিজেদের অর্থ,শ্রম,মেধা ও প্রাণ দিয়েছেন তো সে খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও সেটিকে প্রতিরক্ষা দেয়ার কাজে। খিলাফত প্রতিষ্ঠা না পেলে খৃষ্টানদের ন্যায় মুসলমানদের সংখ্যা বাড়লেও ইসলাম পরিচিতি পেত এক অপূর্ণাঙ্গ দ্বীন রূপে।ফলে মহান আল্লাহর নির্দেশিত পথে কোথাও শান্তি প্রতিষ্ঠা পেত না। ইসলামি ন্যায়নীতির উপর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতাও নির্মিত হতো না।

ইসলামের ইতিহাস অনন্য। পৃথিবীপৃষ্ঠে বহু হাজার নবী-রাসূল এসেছেন, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে একাধীক আসমানি কিতাবও নাযিল হয়েছে। কিন্তু সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি হলো মহান নবীজী (সাঃ)র নেতৃত্বে এই ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের ফলে সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে এই প্রথমবার মহান আল্লাহতায়ালার মু’মিন বান্দারা সবচেয়ে শক্তিমান বিশ্বশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ পান। একমাত্র তখনই মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর মহান দ্বীনের প্রতিষ্ঠায় ও সে দ্বীনের প্রতিরক্ষায় সর্বশ্রেষ্ঠ একটি বিশ্বশক্তি তার সর্বসামর্থ নিয়ে পাশে দাঁড়ায়। মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি বিধান তখন আর পবিত্র কোরআনের পাতায় বন্দি থাকেনি। বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা লাভের গৌরব অর্জন করে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কর্ম রূপে গুরুত্ব পায় খেলাফত ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ও সে খেলাফতের সুরক্ষায় জানমালের কোরবানি পেশ। একমাত্র তখনই একটি বিশাল রাষ্ট্র তার সমগ্র সামরিক, প্রশাসনিক, বিচারবিভাগীয় ও শিক্ষা বিষয়ক অবকাঠামো নিয়ে ইসলামের প্রতিষ্ঠায় অংশ নেয়। আজও এটিই সর্বকালের ও  সর্বদেশের মুসলমানদের জন্য অনুকরণীয় নবী আদর্শ।

তাই যারা নবীজী (সাঃ)র উম্মত রূপে পরিচয় দিতে চায় তাদের সামনে খেলাফতের প্রতিষ্ঠা ও তার প্রতিরক্ষা ছাড়া ভিন্ন পথ নেই। মহান আল্লাহতায়ালার নাযিলকৃত দ্বীনকে মসজিদ মাদ্রাসায় সীমিত করা কোন কোলেই নবীজী (সাঃ)র সূন্নত নয়। সেটি তারা সাহাবাগণও করেননি। নামায-রোযা, হজ-যাকাত ও পবিত্র কোরআনে পাঠের মধ্যে নিজেদের ধর্মকর্মকে তারা সীমিত রাখেননি। বরং কোরআনী বিধানের প্রতিষ্ঠায় তারা যেমন শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি সে রাষ্ট্রের উপর ইসলামের পক্ষের শক্তির পূর্ণ দখলদারিও প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুসলমানগণ দেরীতে হলেও ইরাক ও সিরিয়ায় সে প্রচেষ্ঠা আজ শুরু করেছে। সে খিলাফতের হাতে আজ গ্রেটব্রিটেনের চেয়েও বৃহত্তর ভূমি। মুসলমানদের সামনে তাই নতুন সম্ভাবনা।

আজকের ন্যায় নবীজী (সাঃ)র যুগেও ইসলামের শত্রুর অভাব ছিল না। শত্রুপক্ষে যেমন আরবের স্থানীয় কাফের ও ইহুদী গোত্রগুলো ছিল, তেমনি ছিল দুই বিশ্বশক্তি -বিশাল পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য। তারা ইসলামের প্রচার যেমন চায়নি, তেমনি চায়নি খেলাফত ও আল্লাহতায়ালার শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠাও। ইসলাম ও মুসলমানদের নির্মূলে তারা শুরু থেকেই যুদ্ধ শুরু করে। তাদের লাগাতর হামলার মুখে ইসলামের অনুসারিদের প্রতিপদে যুদ্ধ এবং সে যুদ্ধে জানমালের বিপুল কোরবানি দিয়ে সামনে এগুতে হয়েছে। শত্রুর হাত থেকে খেলাফত এবং ইসলামের প্রতিষ্ঠা বাঁচাতে নবীজী (সাঃ)র প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ সাহাবীকে শহীদ হতে হয়েছে। সে আমলের দুর্বৃত্ত শয়তানগণ ইসলামের সে মহান সৈনিকদের হাতে নির্মূল হয়েছিল, কিন্তু নির্মূল হয়নি তাদের সে শয়তানি মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র। আজও তা ইসলামের বিরুদ্ধে একই রূপ হিংস্রতা নিয়ে প্রবল ভাবে বেঁচে আছে। ইসলামের এ শত্রুপক্ষগুলি প্রবল বল পায় যখন মুসলিম দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদি কাফের শক্তির উপনিবেশে পরিণত হয়। রাষ্ট্রের সমগ্র শক্তি ও অবকাঠামো তখন ইসলামের শিকড় কাটার কাজে ব্যবহৃত হয়।

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদি শক্তিবর্গ মুসলিম দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও তার ষড়যন্ত্র বিলুপ্ত হয়নি। বিলুপ্ত হয়নি তাদের প্রতিপত্তিও। সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্থ খলিফাদের হাতে মুসলিম দেশগুলি আজও অধিকৃত। এরা হলো তাদের হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও তাদেরই আদর্শে দীক্ষাপ্রাপ্ত সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, ট্রাইবালিস্ট, সোসালিস্ট, সেক্যুলার সামরিক বাহিনী ও স্বৈরাচারি রাজাবাদশাহগণ। এরাই ইসলামের দেশী শত্রুপক্ষ। মুসলিম নামধারি হলেও ইসলামের প্রতিষ্ঠা রোধে তাদের শত্রুতা কোন কাফের শক্তির চেয়ে কম নয়। তাদের একাত্মতা বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেটব্রিটেন, ফ্রান্স, হিন্দুস্থানসহ সকল কাফের শক্তির সাথে। ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে যারা নিরপরাধ মুসল্লি করলো বা ইসলামবাদের লালমসজিদ ধ্বংস করলো এবং মসজিদ সংলগ্ন হাফসা মাদ্রাসার শতাধিক ছাত্রীদের হত্যা করলো তারা তো এরাই। মুসলিম দেশগুলি আজ তাদের হাতেই অধিকৃত। শয়তানি শক্তির এ নতুন প্রজন্ম আজ থেলাফত, শরিয়ত, জিহাদ, জিজিয়া ও প্যানইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্বের ন্যায় ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সর্বসামর্থ নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

 

 

অপরিহার্য কেন খিলাফত?

মৌলিক মানবিক অধিকার, উচ্চতর মূল্যবোধ, নীতি ও নৈতীকতা, সুবিচার ও সাম্য –এসব নিয়ে বড় বড় কথা বলা খুবই সহজ। লক্ষ লক্ষ পন্ডিতজন শত শত বছর ধরে এমন কথা বলে আসছেন। ভবিষ্যতেও বলবেন। তাদের সেসব কথা হাজার হাজার বছর ধরে বইয়ের পাতায় বেঁচেও থাকবে। কিন্তু তাদের কথায় বিশ্বের কোথাও নির্যাতীতা নারীদের মুক্তি মিলেনি। দাসপ্রথাও বিলুপ্ত হয়নি। বর্ণবাদী, গোত্রবাদী ও জাতিয়তাবাদী বৈষম্য ও শোষণও বিলুপ্ত হয়নি। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলে অতিশয় অপরিহার্য হলো সহায়ক রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। আর তেমন রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর প্রতিষ্ঠা এজন্যই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। সে ইবাদতের ছওয়াব কখনোই স্রেফ নামায-রোযা বা হজ-যাকাত পালনে অর্জিত হয় না। এমন রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় একমুহুর্ত ব্যয়কে নবীজী (সাঃ) সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলেছেন। তাছাড়া মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য নিয়ে হাজার হাজার ফেরেশতার বাহিনী কখনোই কোন বান্দাহর ঘরে হাজির হন না। কোন কামেল ব্যক্তির ঘর, সুফি খানকা বা মসজিদ-মাদ্রাসাও নয়। কারণ, সেগুলি তাদের অবতরণের ক্ষেত্র নয়। সে ক্ষেত্রটি সেটি হলো জিহাদের অঙ্গণ। তাদের উপস্থিতি তাই বদর, ওহুদ, হুনায়ুনের ন্যায় জিহাদের অঙ্গণে বার বার দেখা গেছে। মুসলমানের কাজ হলো তাই লাগাতর অবতরণের ক্ষেত্র নির্মাণ। সেজন্য চাই খেলাফা। চাই লাগাতর জিহাদ। চাই মু’মিনদের নিজেদের জানমালের কোরবানি। চাই শরিয়তের প্রতিষ্ঠার লাগাতর প্রচেষ্টা। এমন জিহাদ ও এমন কোরবানীর মাধ্যমে ঈমানদারগণ তখন খোদ মহান আল্লাহতায়ালার বাহিনীতে পরিণত হয়। আর মহান আল্লাহতায়ালার ফেরেশতা বাহিনী তো ভূপৃষ্ঠে নেমে আসেন স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালার বাহিনীকে বিজয়ী করতে। যেদেশে মহান আল্লাহতায়ালার বাহিনী হওয়ার ব্যর্থতা সেদেশে রহমতের ফিরেশতাগণ নয়, নেমে আসেন আযাবের ফিরেশতাগণ। তাঁরা নামেন বন্যা, খড়া, অতিবৃষ্টি, ঘুর্ণিঝড়, ভূমিকম্প ও সুনামী নিয়ে। বাড়ে ফিতনা-ফ্যাসাদ। তেমন আযাব যে অতীতে বহু জনপদে বহুবার এসেছে সে সাক্ষ্যটি তো মহান আল্লাহতায়ালার -যা তিনি পবিত্র কোরঅনে বহুবার উল্লেখ করেছেন। তা নিয়ে কি কোন ঈমানদারের সামান্যতম সন্দেহ থাকতে পারে? সন্দেহ হলে কি সে আর মুসলমান থাকে? তাই খেলাফত আমলে সমাজে বিপর্যয় বা ফিতনা দেখা দিলে খলিফার দায়িত্ব ছিল ইসলামের শত্রুদেশের বিরুদ্ধে দ্রুত জিহাদ সংগঠিত করা। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে গুনাহমাফ ও রহমত লাভের জন্য এটিই হতো সে আমলে বিজ্ঞ আলেমদের ফতওয়া।

বান্দার উপর মহান আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে বড় নিয়ামত সন্তান-সন্ততি বা ধনসম্পদ নয়, সেটি হলো হিদায়েত ও শরিয়ত। হিদায়েত ও শরিয়তের সে মহান গ্রন্থটি হলো পবিত্র কোরআন। আর বান্দাহর উপর ফরজ হলোঃ প্রতিটি কথা, প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি চিন্তা ও প্রতিটি আচরনে হিদায়েতের পথে চলা। নির্দেশ হলোঃ বিচার-আচারে শরিয়তের পরিপূর্ণ অনুসরণ। এখানে অবাধ্যতা বা বিদ্রোহ হলে আসে বিপর্যয়, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আসে আযাবও। সেটি যেমন দুনিয়ায়, তেমনি আখেরাতে। মহান আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের বড় খেয়ানত ও সে সাথে কবিরা গুনাহ হলো তাঁর নাযিলকৃত হিদায়েতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তেমন বিদ্রোহে অতীতে ইতিহাস গড়েছিল ইহুদীদগণ, আর আজ সে পথ ধরেছে মুসলমানগণ। হযরত মূসা (আঃ) এর উপর মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র গ্রন্থ তাওরাত নাযিল করেছিলেন। তাওরাতে শরিয়তের বিধান ছিল। সে শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে হযরত ইয়াকুব (আঃ) জন্মভূমি কানানে গিয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছিলেন। সেখানে তখন শাসন চলছিল এক দুর্বৃত্ত জালেম গোষ্ঠির। খিলাফতের প্রতিষ্ঠায় তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল জান ও মালের কোরবানীর। কিন্তু ইহুদীদের তাতে আগ্রহ ছিল না। তাদের আগ্রহ ছিল স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালা থেকে শুধু পাওয়ায়, তার পথে দেয়ায় নয়। তাই প্রচন্ড অবাধ্যতার সুরে তারা হযরত মূসা (আঃ)কে বলেছিল, “হে মুসা! তুমি ও তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ করো, আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।” তাদের সে অবাধ্যতার কথা মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করেছেন। এমন অবাধ্যতা কি কোন জনগোষ্ঠির উপর আল্লাহ রহমত আনে? বরং যা আনে তা হলো কঠিন আযাব। সে আযাবেরই আলামত হলো, ইসরাইলীদের ভাগ্যে কোথায়ও কোন ইজ্জত মিলেনি। ভবঘুরের ন্যায় নানা দেশের পথেপ্রান্তরে হাজার হাজার বছর ধরে ঘুরে বেড়ানোই তাদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। অবশেষে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশেরা অধিকৃত মুসলিম ভূমিতে অবৈধ ভাবে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা দেয়। কিন্তু তাতেও তাদের ইজ্জত বাড়েনি। নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়নি। বরং বিশ্বব্যাপী ধিক্কার কুড়াচ্ছে এক অতি বর্বর ও নৃশংস জাতি রূপে। তাওরাতের শরিয়তি বিধানকে প্রতিষ্ঠার মিশন দিয়ে হযরত ইসা (আঃ)কে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সে শরিয়ত প্রতিষ্ঠায় কোন আগ্রহই দেখায়নি, বরং খৃষ্টানগণ হযরত ঈসা (আঃ)কে খোদা বানিয়ে পুজা শুরু করে। খৃষ্টান ধর্মে তারা হারাম-হালালে কোন পার্থক্যই রাখেনি। তারা বেঁচে আছে মদ্যপান, জুয়া, অশ্লিলতা ও ব্যাভিচারের ন্যায় আদিম পাপাচার নিয়ে। সমকামিতার ন্যায় পাপাচারকে তারা আইনগত বৈধতা দিয়েছে, তেমনি আইনসিদ্ধ করেছে পুরুষের সাথে পুরুষের এবং নারীর সাথে নারীর বিবাহের ন্যায় অপরাধকেও।একই ভাবে মুসলমানগণ আজ শরিয়তকে বিদায় দিয়েছে দেশের বিচারকার্য থেকে।

 

 

অনিবার্য কেন জিহাদ?

রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হলে ধর্ম তখন বিশুদ্ধতা নিয়ে বাঁচে না। নানা রূপ দূষন শুরু হয় ধর্মীয় আক্বিদা-বিশ্বাস ও ধর্মপালনের ক্ষেত্রে। সরকারি সহযোগিতায় তথন রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গণে দুর্বৃত্তির প্লাবন সৃষ্টি করা হয়। পতিতাপল্লি, সূদী ব্যাংক, মদের দোকান, নাচগানের আসর বাড়াতে তখন সরকারও তার প্রশাসন নিয়ে এগিয়ে আসে। সে নমুনা স্রেফ খৃষ্টান বা ইহুদী দেশে নয়, মুসলিম দেশগুলোতেও। বাংলাদেশের মুসলমানগণ দূর্নীতিতে ৫ বার বিশ্বরেকর্ডও স্থাপন করেছে সে প্লাবনের কারণেই। এজন্যই ইসলামে পবিত্র জিহাদ শুধু মুসলিম রাষ্ট্রের উপর কাফের শক্তির হামলা প্রতিরোধ করা নয়, অতি পবিত্র জিহাদ হলো রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের বুক থেকে পাপাচারের প্লাবন থামানো। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূল। এবং সে লক্ষ্যসাধনে জরুরী হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উপর থেকে ইসলাম বিরোধী শক্তির দখলদারি নির্মূল। খিলাফত বা ইসলামি রাষ্ট্র তো এ পথেই প্রতিষ্ঠিত হয়। মু’মিনের জীবনে এটিই জিহাদ। এপথে প্রাণ গেলে জান্নাতপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত। সে প্রতিশ্রুতি মহান আল্লাহতায়ালার। সে জিহাদ যার মধ্যে নাই মহান নবীজী (সাঃ) তাকে মুনাফিক বলেছেন। নবীজী (সাঃ)র প্রখ্যাত হাদীসঃ “যে ব্যক্তি জিহাদ করলো না এবং জিহাদের নিয়েতও করলো না সে ব্যক্তি মুনাফিক।”

মুসলমানদের তাই শুধু নামায-রোযা ও হজ-যাকাতের বিধান শিখলে চলে না। যুদ্ধও শিখতে হয়। নামাযী ও রোযাদার হওয়ার পাশাপাশি আজীবন মুজাহিদের দায়িত্বও পালন করতে হয়। সাহাবায়ে কেরামের মাঝে এমন কোন সাহাবীকে কি পাওয়া যাবে যিনি নামায-রোযা শিখেছেন অথচ যুদ্ধাবিদ্যা জানতেন না বা জিহাদে যোগ দেননি? হযরত আম্মার (রাঃ)র ন্যায় বহু সাহাবী ৮০ বছর বয়সে জিহাদের ময়দানে গেছেন এবং শহীদও হয়েছেন। তাই ইসলামি রাষ্টের প্রতিটি নাগরিক যেমন সৈনিক,তেমনি পুরা রাষ্ট্র হলো ক্যান্টনমেন্ট।এবং লাগাতর শিক্ষালাভ ও সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ হলো মুসলিম সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্দ্য অঙ্গ। ইসলামি সরকারের দায়িত্ব হলো সে সংস্কৃতির লালন। কিন্তু মুসলিম দেশ যখনই শয়তানি শক্তির হাতে আধিকৃত হয় তখন নির্মূল করা হয় সে সংস্কৃতি। প্রতিষ্ঠা দেয়া হয় নাচগান, খেলাধুলা, মদজুয়া, অশ্লিলতা ও ব্যাভিচারের সংস্কৃতি। এ হলো পরকালের ভাবনা ও আল্লাহর কাছে জবাবদেহীতা ভূলানোর সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতিতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয় ইসলামে অঙ্গিকার শূণ্য সেক্যুলারিস্টদের হাতে।এবং অস্ত্রহীন করা হয় আল্লাহর দ্বীনের মোজাহিদদের।ভারতের বুকে ব্রিটিশগণ সে রীতি ও সংস্কৃতি সরকারি ভাবে প্রতিষ্ঠা করে গেছে।আর আজ বাংলাদেশ,পাকিস্তান,তুরস্ক,মিশরের মত দেশগুলোতে সে সংস্কৃতির পরিচর্যা দিচ্ছে স্বদেশী সেক্যুলারিস্টগণ।

মুসলিম সমাজে যুদ্ধ কিছু বেতনভোগী সৈনিকদের পেশাদারিত্ব নয়।বরং নামায-রোযার ন্যায় প্রতিটি মুসলমানের জীবনে সেটি ফরজ ইবাদত। তাই ইসলামি রাষ্ট্রে বিশাল বেতন, বাড়ি-গাড়ি ও হাজার হাজার সরকারি প্লট দিয়ে বিশাল সেনাবাহিনী প্রতিপালনের প্রয়োজন পড়ে না। মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিটি ঘরই সৈনিকের ঘর। এ সৈনিকেরা ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় শুধু শ্রম, মেধা ও মালের কোরবানিই দেয় না, জানের কোরবানিও দেয়। খালিদ বিন ওলিদ, সাদ বিন আবি ওক্কাস, আমর ইবনুল আস, আবু ওবাইদা, তারিক বিন যিয়াদের ন্যায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে খ্যাতিনামা জেনারেলগণ কি কোন সামরিক কলেজ বা ক্যান্টনমেন্টের সৃষ্টি? তারা তো গড়ে উঠেছে মাটির ঘর থেকে। পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বড় বড় যুদ্ধ জয় তো তারাই করেছে। তাদের রণকৌশলগুলো এখন বিভিন্ন দেশের সামরিক কলেজে পড়ানো হয়।

তাছাড়া বিজয় তো আসে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। কোন যুদ্ধই মুসলমানগণ নিজ শক্তিবলে অর্জন করেনি। প্রতিটি বিজয় এসেছে মহান আল্লাহতায়ালার রহমতের বরকতে| তাদের বিজয়ী করতে হাজার হাজার ফিরেশতা মুসলিম বাহিনীতে যোগ দিত। তাই পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণাঃ “কোন বিজয় নেই একমাত্র আল্লাহর সাহায্য ছাড়া; নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিমান ও প্রজ্ঞাময়।” সুরা আনফাল আয়াত ১০। তাই আল্লাহর সাহায্য নামিয়ে আনার মূল সামর্থটাই সৈনিকের মূল সামর্থ। আর সে সামর্থ কি শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সামরিক কলেজ বা সেনানীবাসে তৈরী হয়? সে জন্য তো প্রয়োজন আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার সামর্থ। সে সামর্থ তো আসে মহান আল্লাহতায়ালার উপর ঈমান, কোরআনী জ্ঞান ও গভীর তাকওয়া থেকে। সে সামর্থ সৃষ্টিতে কি সেনানীবাস লাগে? তা তো গ্রাম-গঞ্জে এবং মাটির ঘরেও নির্মিত হতে পারে। সে সামর্থ সৃষ্টির মূল উপকরণ তো কোরআনী জ্ঞান ও সে জ্ঞানলদ্ধ আল্লাহর উপর গভীর বিশ্বাস। সে সামর্থের বদৌলতে বিশ্বের যে কোন দেশে ও যে কোন সময় আসতে পারে। সে সাহায্য তো আজও আসছে। তাই আজও আসছে বিস্ময়কর বিজয়। সেটিই সম্প্রতি দেখা গেল ইরাকের রণাঙ্গনে। ইরাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মোসল করে নিল মাত্র আট শত মোজাহিদ। অথচ সেখানে তাদের যুদ্ধটি ছিল আধুনিক সেনানীবাস ও সামরিক কলেজে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তিরিশ হাজর ইরাকী সৈন্যদের বিরুদ্ধে। তারা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল বিশ্বের সেরা মার্কিনী যুদ্ধবিশেষজ্ঞদের হাতে। অথচ সে বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় লাভে মোজাহিদদের একদিনও লাগেনি।

আবার তাই প্রমাণিত হলো, মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য পাওয়ার জন্য নবীজী (সাঃ) সাহাবা হওয়া ও তাঁর পিছনে নামায পড়ার প্রয়োজন পড়েনা। বরং অপরিহার্য হলো গভীর ঈমান, তাকওয়া ও নবীজী (সাঃ)র প্রদর্শিত পথে জানমাল কোরবানীর পূর্ণ প্রস্তুতি। সে প্রস্তুতির বরকতে নবীজীর ইন্তেকালের বহুহাজার বছর পরও পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য যেমন আসে, তেমনি বিজয়ও আসে। মহান নবীজী (সাঃ)র সাহাবাগণ যেরূপ লাগাতর বিজয় আনতে পেরেছিলেন তা তো এমন মর্দেমুমিন মোজাহিদদের কারণেই। তখন খলিফার অধীনে কোন পেশাদার সেনাবাহিনীই ছিল না। অথচ তাঁরা নবীজী (সাঃ) ইন্তেকালের মাত্র ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তির জন্ম দেন। নির্মাণ করেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। সে সভ্যতায় বুকে বড় বড় প্রাসাদ, দুর্গ, দেয়াল বা পিরামিড নির্মিত হয়নি। বরং নির্মিত হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও মূল্যবোধ, সর্বশ্রেষ্ঠ আইন ও বিচার ব্যবস্থা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সামাজিক ও রাষ্ঠ্রীয় নীতি। সে মূল্যবোধে খলিফা তথা বিশ্বশক্তির রাষ্ট্রপ্রধান চাকরকে উঠের পিঠে চড়িয়ে নিজে রশি ধরে টেনেছেন। অথচ মুসলমানগণ আজ আল্লাহতায়ালার  সাহায্যপ্রাপ্তির সে বহু পরিক্ষিত পথটি ছেড়ে বনি ইসরাইলীদের অনুসৃত ও পরিক্ষিত অভিশপ্তের পথটি ধরেছে। তাদের অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ খোদ আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। হিদায়েত ও শরিয়তকে তারা নিজেদের জীবন থেকে বিসর্জন দিয়েছে। খেলাফতের দায়ভার বহনের বদলে তারা নিজেরাই সার্বভৌম রাজা-বাদশাহ ও শাসকে পরিণত হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালার আনুগত্যের বদলে আনুগত্য শুরু করেছে নিজের স্বৈরাচারি নফসের।

 

 

দায়িত্ব রাজনৈতীক প্রতিনিধিত্বের

মুসলমান হওয়ার অর্থ শুধু মহান আল্লাহর উপর অটল বিশ্বাস নয়, স্রেফ নামায-রোযা পালনও নয়। বরং সেটি ধর্মীয়, রাজনৈতীক, প্রশাসনিক ও সামরিক অঙ্গণে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিনিধিত্বের। নিজ জীবনের প্রতিকর্ম, প্রতিসিদ্ধান্ত ও প্রতিটি আচরণেই সে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা। প্রতিনিধিত্ব এখানে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তি আইন প্রতিষ্ঠার। ঈমানদারের জানমালের বিনিয়োগ তো হয় এ দায়িত্বপালনে। অথচ আজ মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে শুধু যে খেলাফত বিলুপ্ত হয়েছে তা নয়, শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত হয়েছে মুসলিম রাষ্ট্রসমুহ ও তার প্রতিষ্ঠানগুলি। কার্যতঃ মুসলমানগণ পরিণত হয়েছে শয়তানের খলিফায়। ইসলামি দল, ইসলামি জামাত বা ইসলামি আন্দোলনের নামে এমন কিছু ব্যক্তিবর্গের উদ্ভব ঘটেছে যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের বদলে মন্ত্রি, এমপি ও নেতা হওয়াকে গুরুত্ব দেয়। দেশের শাসনতন্ত্র ও আইন-আদালতে মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনের অনুপস্থিতি নিয়ে তাদের হৃদয়ে কোন মাতম উঠে না। মাতম উঠে তখন যখন তাদের নেতাকর্মীদের জেলে ঢুকানো নয় বা তাদের অফিসে তালা ঝুলানো হয়। তাদের রাজনীতির এজেন্ডা দেশে শরিয়তের প্রতিষ্ঠাও নয়। দেশে শাসনতন্ত্র ও আইন-আদালতে মহান আল্লাহতায়ালার আইন স্থান পায়নি। স্থান পেয়েছে ব্রিটিশ কাফেরদের প্রনীত আইন। মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্বের বদলে স্থান পেয়েছে মানুষের সার্বভৌমত্ব। মহান আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় বিদ্রোহ আর কি হতে পারে? অথচ সে শাসনতন্ত্র ও আইন বাঁচানো নিয়েই তথাকথিত ইসলামি দলগুলির রাজনীতি। তাদের বক্তৃতা, লেখনি ও ওকালতি স্রেফ নিজের দল, নিজের নেতা ও নিজেদের ধর্মীয় ফিরকাকে বড় রূপে দেখানো নিয়ে। তাদের আন্দোলন স্রেফ নিজ দল, দলীয় স্বার্থ ও দলীয় নেতাদের বাঁচানো নিয়ে।সে লক্ষ্যে তারা দেশের বা বিদেশের কোন দল বা ব্যক্তিদের সাথে আঁতাত করতেও রাজী। শরিয়ত, খেলাফত ও জিহাদের পক্ষে তাদের মুখে কোন কথা নেই। আন্দোলনও নাই।

অথচ প্রকৃত ঈমানদারের প্রতিমুহুর্তের বাঁচাতো আল্লাহর দ্বীনের প্রতিটি বিধান ও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ওকালতি ও জিহাদ নিয়ে বাঁচা। সে সত্যের পক্ষে আমৃত্যু সাক্ষ্যদাতা ও উকিল। শরিয়ত, খেলাফত ও জিহাদের পক্ষে সে হবে নির্ভীক। মু’মীনের জীবনে মূল সামর্থ তো সত্যকে চেনা, সত্যের পক্ষ নেয়া ও সত্যের পক্ষে জানমাল কোরবানীর সামর্থ। ব্যক্তির ঈমানদারি তো সে সামর্থের মধ্যে ধরা পড়ে। নবীজীর (সাঃ) শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবা সে কাজে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশের মুলমানদের মাঝে শতকরা একজনও সে কাজে হাজির? মহান আল্লাহ যাদের দিয়ে জাহান্নাম ভরবেন তারা যে সবাই চোর-ডাকাত, খুনি বা ব্যাভিচারি -তা নয়। অধিকাংশ মুশরিক এবং কাফের খুনি নয়। তারা চোর-ডাকাত বা ব্যাভিচারিও নয়। কিন্তু তারা জাহান্নামে যাবে সত্যকে চিনতে না পারা ও সত্যের পক্ষ না নেয়ার কারণে। বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের চেয়ে সত্যকে চেনার গুরুত্ব অপরিসীম। সে সামর্থের গুণেই ব্যক্তি জান্নাত পাবে। বৈজ্ঞানিক আবিস্কারে নয়।

রাসূলে পাক (সাঃ)এর সময়ও এমন ইহুদী ও খৃষ্টানদের সংখ্যা কি কম ছিল যারা উপোস, উপাসনা ও তাওরাত বা বাইবেল পাঠে শরীর পতন ঘটাতো? অথচ মহান আল্লাহপাক তাদেরকে কাফের বলেছেন। এবং মুসলমানদেরকে অতি সুস্পষ্ট ভাবে হুশিয়ার করে দিয়েছেন যেন তাদের অনুসরণ না করা হয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার সে হুশিয়ারিটি এসেছে এভাবেঃ “হে ঈমানদারগণ! যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের মাঝের কোন দলকে যদি তোমরা অনুসরণ করো তবে তারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পরও আবার কাফেরে পরিণত করবে।” –(সুরা আল ইমরান আয়াত ১০০)। ইহুদী ও খৃষ্টান আহলে কিতাবীদের কাফের বলার কারণ তারা মহান আল্লাহতায়ালার শেষ রাসূল ও শেষ আসমানি কিতাবকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা ব্যর্থ হয়েছিল নবীজী (সাঃ)র মিশনের সাথে একাত্ম হতে। ধার্মিকের লেবাসে তাদের কাজ ছিল মানুষকে কাফেরে পরিণত করা। প্রশ্ন হলো, আজকের মুসলিম আলেম, আল্লামা ও মুফতিদের কি সে ব্যর্থতা কম? তারাদেরই বা ক’জন নবীজী (সাঃ)র মিশনকে চিনতে পেরেছে। নবীজী (সাঃ)এর রেখে যাওয়া খিলাফত, শরিয়ত ও জিহাদের সাথে তাদের ক’জন আজ সংশ্লিষ্ট? নবীজী (সাঃ)র অধীকাংশ সাহাবাগণ যে পথে শহীদ হয়েছেন এসব আলেমদের ক’জন সে পথে? যে যুবকগণ হাজার হাজার মাইল দূর থেকে স্রেফ খেলাফত, শরিয়ত ও জিহাদের লক্ষ্যে আরাম-আয়াশের ঘরবাড়ি ছেড়ে শহীদ হচ্ছে তাদেরকে এরা খারেজী ও কাফের বলছে! মোশাদ, সিআইয়ের এজেন্ট বলছে। নারী লোভীও বলছে! এবং খেলাফত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে তারা হটকারিতা বলছে। তারা কি মনে করে এসব যুবকদের বদলে আসমান থেকে ফেরেশতারা এসে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন? অথচ উমাইয়া, আব্বাসী ও ওসমানিয়া খেলাফতের প্রতিষ্ঠারা কি ফেরেশতারা ছিলেন? তাদের ক’জন জিহাদের ময়দানে সশরীরে প্রাণ কোরবানীতে হাজির হয়েছেন? তারা ছিলেন দোষেগুণের মানুষ। তাদেরই শাসনামলে হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ)ও তাঁর ৭২ জন নিরপরাধ সঙ্গিকে কারবালায় নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে। অথচ তারপরও তাদেরকে খলিফা রূপে স্বীকৃতি ও তাদের নামে জুম্মার খোতবা দেয়া হয়েছে। বিগত ৯০ বছর মুসলিম বিশ্বে কোন খলিফা নাই। ফেরেশতাতূল্য মহামানবদের অপেক্ষায় কি আরো অপেক্ষা করতে হবে?

 

 

বিষাক্ত প্রচারণা

আল্লাহর দ্বীনের প্রতি মুসলিম দেশের অধিকাংশ ইসলামি দলের নেতাকর্মী ও আলেমদের অঙ্গিকার যে কতটা ফাঁকা সেটি খেলাফত, শরিয়ত এবং জিহাদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানই সুস্পষ্ট করে দেয়। বনি ইসরাইলের আলেমগণ আজও মাথা-ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে তাওরাতে নাযিলকৃত শরিয়তের বিধানগুলো মুখস্থ করে। কিন্তু তার প্রয়োগ নিয়ে তারা ময়দানে নেই। তাদের থেকে মুসলিম আলেমদের অবস্থা কতটুকু ভিন্নতর? তাদের বিভ্রান্তিকর ভূমিকার কারণেই মুসলিম দেশে জনবল বেড়েছে জাতিয়তাবাদী, রাজতন্ত্রি, স্বৈরাচারি ও সাম্রাজ্যবাদি শিবিবে। তাদের কারণেই পরাজয় বেড়েছে ইসলামের। এবং মুসলিম দেশগুলি অধিকৃত হয়ে গেছে ইসলামি শত্রুশক্তির হাতে। এবং বিলুপ্ত রয়ে গেছে খিলাফত। এসব ইসলামি দলের বর্তমান প্রচারনার সুর কোন কাফের শক্তির বিরুদ্ধে নয় বরং সেটি খেলাফত, শরিয়ত ও জিহাদের বিরুদ্ধে। সৌদি আরবের গ্রাণ্ড মুফতি ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করার নিন্দা করেছেন। অথচ যুদ্ধ করতে বলছেন ইরাকের জিহাদীদের বিরুদ্ধে। সৌদি আরবের গ্রাণ্ড মুফতি সৌদি আরবে মার্কিন কাফের সৈনিকদের অবস্থানের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। অথচ হযরত ওমর (রাঃ) সমগ্র জাজিরাতুল আরব থেকে সকল অমুসলিমদের বিতাড়িত করেছিলেন। একই ভূমিকায় নেমেছেন শেখ ইউসুফ কারযাভী। তাঁর অবস্থান কাতারে। অথচ কাতার হলো সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। তিনি সে মার্কিন অবস্থানের বিরুদ্ধেও মুখ খুলেন না। আল্লাহকে খুশি করার বদলে এরা গুরুত্ব দেন ইসলাম, মুসলমান ও আল্লাহর শত্রুদের সাথে সুসম্পর্ক রাখাকে। গুজরাতের মুসলিম নারী-শিশুর রক্তে রঞ্জিত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদীর হাত। অথচ বাংলাদেশের প্রধান ইসলামি দলের নেতা তার নির্বাচনি বিজয়কে অভিনন্দন করেছেন। সেটি স্রেফ দলীয় স্বার্থে। এটিই সেক্যুলারিজম। ইসলামি চেতনায় এটি অসম্ভব।এ বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালার হুশিয়ারি হলোঃ “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করোনা। তোমরা তাদের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ আচরণও করবে না, তারা তো অস্বীকার করেছে সে সত্যকে যা তোমাদের কাছে এসেছে?..) –সুরা মুমতেহানা আয়াত ১)। আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে শত্রুতাই নবীজী (সাঃ)র সূন্নত। তাদের বিজয়ে অভিনন্দন জানানো নয়। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ সে সতর্কবানী একবার নয়, বহুবার এসেছে পবিত্র কোরআনে। অথচ সে হুশিয়ারির বিরুদ্ধে এসব নেতাদের ভ্রক্ষেপ নাই।

ব্যক্তির ঈমান শুধু নামায-রোযায় ধরা পড়ে না, নির্ভূল ভাবে ধরা পড়ে রাজনীতিতে। নামায-রোযা মুনাফিকও পড়তে পারে। কিন্তু শরিয়ত ও খেলাফতের প্রতিষ্ঠার জিহাদে অংশ নেয়া ও সে জিহাদে প্রাণ দেয়ার সামর্থ মুনাফিকের থাকে না। ঈমানের আরেক পরিচয় হলো প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনা। সে চেতনা দেয় ভাষা, ভূগোল ও বর্ণের পরিচয় অতিক্রম করার সামর্থ। সে চেতনায় মুসলিম বিশ্বে জাতীয় রাষ্ট্রের নামে গড়া বিভক্তির মানচিত্র ও দেয়ালগুলি বৈধতা পায় না। ভাষা, ভূগোল ও বর্ণের পরিচয়ে বিভক্তি গড়া এবং বিভক্তিকে বৈধতা দেয়া ইসলামে হারাম। এটি মহান আল্লাহর ফরমান “লা তাফাররাকু” অর্থাৎ “বিভক্ত হয়োনা”র বিরূদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ। অথচ ইসলামের নামে যারা দল বা জামায়াত গড়ে তারাও এ বিভক্তিকে বৈধতা দেয় এবং ভক্তি করে মুসলিম বিশ্বের বিভক্ত মানচিত্রকে। এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্ম দিবস নিয়ে জাতিয়তাবাদীদের ন্যায় বিজয়-উৎসব করে। যেমনটি বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোর দ্বারা হচ্ছে। বিভক্ত এ মানচিত্র ভেঙ্গে বিশাল এক খেলাফতি রাষ্ট্র গড়ার জিহাদ শুরু হলে সে পবিত্র কর্মকে তারা যে শুধু ঘৃনা করে তা নয়, কাফেরদের সাথে নিয়ে তা প্রতিরোধেরও চেষ্টা করে। এমন জিহাদকে তারা আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী বলে অভিহিত করে। খিলাফত প্রতিষ্ঠার জিহাদে যারা আজ কাফেরশক্তির বিমান হামলায় ইরাক ও সিরিয়ার বুকে শহীদ হচ্ছেন তাদেরকে বলে সিআইএ ও মোশাদের এজেন্ট। কি বিস্ময়! জিহাদীদের চরিত্র ধ্বংসে এরা প্রচার করে, মোসলের রাস্তায় তারা নাকি মহল্লাবাসীদের কাছে নারী সাপ্লাইয়ের দাবী জানিয়ে পোষ্টার লাগায়!সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার কত জঘন্য অপপ্রচার! এতো ব্যাভিচারের অপরাধ। অথচ কাউকে ব্যাভিচারির অপবাদ দেয়ার শরিয়তের শাস্তি হলো, তার পিঠে ৮০ চাবুকের ঘা। ব্যাভিচারিদের হাতে অস্ত্র থাকলে তারা কি পোষ্টার লাগিয়ে নারী খোঁজে? তারা বলে, এ জিহাদীরা নাকি খারেজী। অথচ ভূলে যায়, খারেজীদের যুদ্ধ ছিল খেলাফতের বিরুদ্ধে। তাদের যুদ্ধ খেলাফতের প্রতিষ্ঠা বা সুরক্ষা নিয়ে ছিল না। খারেজীরা যুদ্ধ করেছে ইসলামের মহান খলিফা হযরত আলী (রাঃ)র বিরুদ্ধে। অথচ আজ যাদেরকে খারেজী বলা হচ্ছে তাদের জিহাদ তো খেলাফতের প্রতিষ্ঠায়। তারা প্রাণ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। তাদের যুদ্ধ তো ইসলাম বিরোধী কুর্দি ও আরব জাতিয়তাবাদী, রাজতন্ত্রি, স্বৈরাচারি ও সেক্যুলারিস্টদের বিরুদ্ধে।

 

 

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের অপরাধ

ঔপনিবেশিক শত্রুদের অপরাধ শুধু দেশদখল এবং অধিকৃত দেশে গণহত্যা, অর্থনৈতীক শোষণ ও নির্যাতন নয়। তাদের দ্বারা সবচেয়ে বড় অপরাধটি ঘটেছে মুসলিম দেশের শিক্ষাঙ্গণে। শিক্ষাঙ্গণকে তারা ব্যবহার করেছে মগজ ধোলাইয়ের কারখানা রূপে। ফলে বাংলার ন্যায় মুসলিম ভূমিতে মুসলমানদের খৃষ্টান বানাতে না পারলেও ইসলাম থেকে দূরে সরাতে পেরেছে। এতে মড়ক লেগেছে মুসলমানদের ঈমানে। ঈমানের সে মড়কটি সবচেয়ে বেশী ঘটেছে তাদের জীবনে যারা শিক্ষা অর্জনের নামে মগজ ধোলাইয়ের সে কারখানায় প্রবেশ করেছে। ফলে বাংলার নিরক্ষর মুসলমানগণ যতটা ঈমান নিয়ে বেঁচেছে তথাকথিত বাঙালী শিক্ষিতরা তা পারেনি। বরং বহুদূর ছিটকে পড়েছে পবিত্র কোরআনে বর্নিত সিরাতুল মোস্তাকীম থেকে। আর যারা মূল রাস্তা থেকে ছিটকে গভীর খাদে গিয়ে জ্ঞান হারায় তাদের পক্ষে কি সেখান থেকে উঠে আসা সহজ? হিন্দু, খৃষ্টান বা ইহুদী থেকে ইসলাম থেকে দূরে সরা এসব মুসলিম নামধারিদের পার্থক্যই বা কতটুকু? বরং মিলতো বিশাল। হিন্দু, খৃষ্টান বা ইহুদীদের ন্যায় তাদের অবস্থানও সিরাতুল মোস্তাকীমে নয়। তারাও কাফেরদের ন্যায় শরিয়ত, খেলাফত ও জিহাদের বিরোধীতায় একই রূপ যুদ্ধাংদেহী। রাজনীতি, সংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহের অঙ্গণে মুসলমান নামধারি এসব ব্যক্তিগণও তাই অমুসলমানের সাথে একত্রে নামে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বাহিনী যখন ইরাক ও ফিলিস্তিন দখলে হামলা চালায় তখন হানাদার সে সামরিক বাহিনীতে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ন্যায় হাজার হাজার মুসলিম নামধারি যুবকও মুসলিম হত্যায় শামিল হয়েছিল। অন্তরে ঈমান থাকলে কেউ কি এভাবে কাফের বাহিনীতে যোগ দিতে পারে? এমন কাজ তো হারাম। কিন্তু সে হারামকেও বহু মুসলিম নামধারি সেদিন হালাল রূপে গ্রহণ করেছিল। লক্ষ লক্ষ আধুনিক শিক্ষিতরা আজও সে ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। মুখে মুসলমান হওয়ার গগনবিদারি দাবী, অথচ তাদের সশস্ত্র অবস্থান শত্রু শিবিরে।একাত্তরে তাদেরকেই ভারতীয় কাফেরদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে মুসলিম নিধনে দেখা গেছে। শিক্ষাদানের নামে ইংরেজগণ এভাবেই সেদিন বহু মুসলিম সন্তানকে ইসলাম থেকে দূরে সরাতে পেরছিল। এদের কারণেই ভারতের বুকে ১৯০ বছরে ঔপনিবেশিক শাসনে ব্রিটিশদের কলাবোরেটর পেতে কোনরূপ অসুবিধা হয়নি। ইসলাম থেকে দূরে সরা এ্মন মানুষদের কারণে খেলাফতের বিরুদ্ধে যোদ্ধা পেতে সাম্রাজ্যবাদি কাফেরশক্তির আজও কোন অসুবিধা হচেছ না।

মুসলিম দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটেছে। কিন্ত তাদের প্রতিষ্ঠিত ঈমানহীন করার কারখানাগুলো এখনো বন্ধ হয়নি। বরং অভিন্ন প্রকল্প নিয়ে বিপুল ভাবে বেড়েছে সেগুলির সংখ্যা ও সামর্থ। ফলে বিপুল ভাবে বেড়েছে ইসলামের শত্রু উৎপাদনও। তাতে দ্রুত বাড়ছে দিন দিন ইসলাম থেকে দূরে সরার কাজ। ফলে বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে শরিয়ত, খেলাফত ও জিহাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিরোধীতাটি কাফেরদের পক্ষ থেকে আসছে না, আসছে তথাকথিত মুসলমানদের পক্ষ থেকে। এমন কি আসছে তথাকথিত আলেমদের পক্ষ থেকেও। আজ থেকে শত বছর আগেও বাংলার বা ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা এতটা শোচনীয় ছিল না। খেলাফতের পক্ষে সেদিন গড়ে উঠেছিল তুমুল গণআন্দোলন। ভারতীয় ইতিহাসে সেটি খিলাফত আন্দোলন নামে পরিচিত। ভারতের ইতিহাসে সেটিই ছিল সর্বপ্রথম গণআন্দোলন। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে সেদিন খলিফার সাহায্যে মুষ্টির চালের হাড়ি বসানো হয়েছিল। বহু ভারতীয় মোজাহিদ সেদিন ছুটে গিয়েছিলেন খলিফার বাহিনীতে যোগ দিতে। অথচ তেমন আত্মত্যাগকে আজ বলা হচ্ছে সন্ত্রাস। জাতিয়তাবাদের ভূগোল ডিঙানো প্যান-ইসলামীক মুসিলিম ভাতৃত্বকে বলা হচ্ছে মৌলবাদ।

 

 

খিলাফত কেন অপরিহার্য?

ঈমানদারের জন্য ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাটি শুধু রাজনৈতীক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন নয়। বরং এমন একটি রাষ্ট্র অতি অপরিহার্য হলো মু’মিন রূপে বাঁচা ও ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠার স্বার্থে। আলোবাতাস ও পানাহারে দেহ নিয়ে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু তাতে ঈমান নিয়ে বাঁচাটি সম্ভব হয় না। ঈমান বাঁচাতে যা অপরিহার্য তা হলো ইসলামি শিক্ষা। ঈমানে পুষ্টি জোগানোর স্বার্থে পানাহারের ন্যায় ইসলামি শিক্ষার প্রয়োজনটিও প্রতিদিনের। সে প্রয়োজনটি কয়েক বছরের ছাত্রাবস্থায় মেটে না। ঈমানদারের সে ছাত্রাবস্থাটি আজীবনের।ফলে মুসলিম দেশের সব নাগরিকই কার্যত ছাত্র। তেমন একটি প্রয়োজন মেটাতে সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্র তখন পরিণত হয় মাদ্রাসায়। শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়াই মহান নবীজী (সাঃ)র সূন্নত। শত্রুর বিরুদ্ধে কোরআনই ইসলামের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ইসলামের যাত্রা তাই নামায-রোযা ও হজ-যাকাত দিয়ে হয়নি; হয়েছে ইকরা বা পড়া দিয়ে। সেটি নবুয়তের প্রথম দিন থেকেই। সেটির শুরু লাগাতর কোরআনী জ্ঞান-বিতরনের মধ্য দিয়ে।

নারী-পুরুষ ও সকল বয়সের ছাত্রদের ইসলামি জ্ঞানদান সুনিশ্চিত করার মূল দায়ভারটি রাষ্ট্রের। মূলতঃ রাষ্ট্রের ঘাড়ে এটিই হলো সবচেয়ে বড় দায়ভার। কোরআন-হাদীসের জ্ঞান হলো সে পুষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ ভান্ডার। অথচ রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা কি ধরণের জ্ঞান জোগাবে সেটির পূর্ণ-নিয়ন্ত্রন থাকে সরকারের হাতে। তাই রাষ্ট্র্র ইসলামের শত্রুপক্ষের দখলে গেলে অসম্ভব হয় ইসলামি জ্ঞান লাভ। তাতে অসম্ভব হয় মুসলমানদের মুসলমান রূপে বাঁচা ও বেড়ে উঠা। কাফেরশক্তির হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ার এখানেই মূল বিপদ।সে বিপদ যেমন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের শাসনামলে বেড়েছে। তেমনি বেড়েছে জাতিয়তাবাদি সেক্যলারিস্টদের দখলদারিতেও। ফলে মুসলিম চেতনায় প্রবল ভাবে বেড়েছে কোরআনী জ্ঞানের অপুষ্টি। তাতে মুসলিম সন্তানের মনে ঈমান যে মারা যাবে সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে সেটিই ঘটছে। ফলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ হয়, ধর্ষণে সেঞ্চুরির উৎসবও হয়।এবং দেশ দুর্বৃত্তিতে বিশ্বরেকর্ডও গড়ে।

জীবননাশী জীবাণুর চেয়ে ধ্যান-ধারণাও কম বিষাক্ত বা কম বিনাশী নয়। বিষাক্ত জীবাণু প্রাণনাশ ঘটায়। আর ঈমাননাশ ঘটায় দূষিত ধ্যান-ধারণা। বিষাক্ত ধ্যান-ধারণার সে নাশকতায় এমন কি দেশের ভূগোলেরও বিনাশ ঘটে। সে দৃষ্টান্ত হলো পাকিস্তান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে। নানা ভাষার ভারতীয় মুসলমানদের বিশাল রক্তের কোরবানীতে দেশটি সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু অধিকৃত হয়ে যায় সামরিক ও বেসামরিক সেক্যুলারিষ্টদের হাতে। ইসলামের এ শত্রুরা নিজেদের নানামুখি নাশকতার পাশাপাশি বিশ্বের নানা কাফের দেশ থেকে ঈমাননাশী জীবাণূ আমদানি শুরু করে। সে জীবাণু মার্কসবাদের নামে আনে সোভিয়েত রাশিয়া এবং চীন থেকে।সস্তায় মার্কসবাদের সে বিষাক্ত বই ও পত্রিকা পৌছিয়ে দেয়া হতো কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে। ফল দাঁড়ায়, মার্কসবাদের বিষপান করা ও মার্কসবাদী হওয়া তখন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ফ্যাশনে পরিণত হয়। সে সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিষাক্ত বিষ আমদানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সে বিষ আসে হলিউডের উলঙ্গ ছায়াছবির মাধ্যমে। সে বিষ দিবারাত্র পান করানো হতো সিনেমা হল গুলোতে। ফলে আমদানিকৃত সে বিষে মারা যায় প্যান-ইসলামিক চেতনা -যা ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির মূল ভিত্তি। এবং প্রতিষ্ঠা পায় জাতিয়তাবাদ, সমাজবাদ ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় ইসলাম-বিনাশী বিষাক্ত মতবাদ। ফলে ধ্বসে যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ।এখন সে বিষাক্ত বিষ পচিয়ে দিচ্ছে বাঙালী মুসলমানের চরিত্রও। দেশে ভাত-মাছের আয়োজন বাড়িয়েও তাই শান্তি বাড়ছে না। বরং বাড়ছে আযাব। আযাব আসছে ভয়ানক এক দুর্বৃত্ত শাসনের বেশ ধরে|

মুসলিম রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু ভয়ানক রোগভোগ, পোকা-মাকড় ও পানাহার রোধই নয়, বিষাক্ত ধ্যান-ধারণার প্রতিরোধও। আর সে কাজটি কোন ব্যক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।সে দায়িত্বটিও রাষ্ট্রের।ইসলামি রাষ্ট্র ঈমাননাশী ধারণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ভ্যাকসিন দেয় কোরআনী-হাদীসের গভীর জ্ঞান দিয়ে। এতে ইম্যুনিটি বাড়ে কুফরি ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রে জন্ম নেয়া শিশুর পক্ষে ঈমান নিয়ে বাঁচা ও বেড়ে উঠাটি সহজ হয়। অপরদিকে অনৈসলামি রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা ছাত্রের চেতনায় ভ্যাকসিন দেয় ইসলামের বিরুদ্ধে। ফলে সে দেশে দুরূহ হয় ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠা। কাফের অধ্যুষিত দেশে বা কাফেরদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থায় বেড়ে উঠা মানুষের মাঝে আল্লাহর আইন, খিলাফত, জিহাদ ও জিজিয়ার বিরুদ্ধে ঘৃণাবোধ এজন্যই অতি প্রচন্ড। কাফের অধ্যুষিত দেশে বসবাস ও কাফেরদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভের এটিই হলো সবচেয়ে বড় বিপদ। কাফেরদের কাছ থেকে আলুপটল বা হাসমুরগী কেনা চলে, তাদের থেকে প্রযুক্তি বা চিকিৎসা জ্ঞানও নেয়া যায়। কিন্তু তাদের থেকে রাজনীতি, সমাজনীতি, দর্শন, ধর্মজ্ঞান, নীতিজ্ঞান, ইতিহাস ও জীবন জিজ্ঞাসার অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা লাভের বিপদ ভয়ানক। এজন্যই নবীজী (সাঃ)র যুগে মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর কাফের দেশে বসবাস করা হারাম ঘোষিত হয় এবং ফরজ ঘোষিত হয় হিজরত।

 

খেলাফত বিলুপ্তির আযাব

খেলাফতের প্রতিষ্ঠা কোন কালেই ফেরেশতাদের হাতে ঘটেনি। দোষত্রুটি নিয়ে যে মানুষ তারাই খেলাফত প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। কিন্তু সে ত্রুটির দোহাই দিয়ে খেলাফত বিলুপ্তিকে কোন কালে কি জায়েজ বলা হয়েছে? অথচ আজ খেলাফতের বিলুপ্তির লক্ষ্যে জিহাদীদের মাথার উপর বোমা ফেলার জন্য কাফের মার্কিন বাহিনীকে ডাকা হচ্ছে। দোষত্রুটি সম্পন্ন মানুষদের মধ্য থেকেই কাউকে খেলাফত প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে হবে। খলিফা হওয়ার শর্ত ফেরশতা হওয়া নয়। বরং সে শর্তটি হলো গোত্র, বর্ণ, ভাষাগত পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা, মুসলমানদের একতা ও লাগাতর জিহাদ সংগঠিত করায় আন্তরিক হওয়া। শর্ত হলো, বিশ্বের তাবত ভাষাভাষি মুসলমানদের জন্য ইসলামি রাষ্ট্রের দরওয়াজা সবসময়ের জন্য খুলে দেয়া। শর্ত হলো মুসলিম জাহান জুড়ে পৃথক পৃথক জাতীয় রাষ্ট্রের নামে যে বিভক্তির দেয়াল গড়া হয়েছে সেগুলো বিলুপ্ত করায় সচেষ্ট হওয়া।

মাত্র শত বছর আগেও যে কোন মুসলিম খলিফা শাসনভূক্ত যে কোন প্রদেশে, শহরে ও গ্রামে বসতি স্থাপন করতে পারতো। দোকান-পাঠ বসিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করতে পারতো। তাতে কোন বাধা ছিল না। কে আরব, কে তুর্কি, কে কুর্দি, হিন্দি, আফগানি বা বাঙালী -সে পরিচয় নেয়া হতো না। এমন কি আজ ই্সরাইলেও নেয়া হয়। ইসরাইলের নাগরিক হওয়ার জন্য ইহুদী হওয়াটিই যথেষ্ট। আমরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর নাগরিক হওয়ার জন্য সে সব দেশে ৫ বছরের বেশী বৈধ বসবাসই যথেষ্ট। অথচ সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলি মুসলিম দেশে ২০ বা ৩০ বছর বৈধভাবে বসবাস ও খেদমতের পরও অনারব মুসলমানের নাগরিকত্ব জুটে না। এটি কি মানবতা? এটি কি ইসলাম? এতো আদিম জাহিলিয়াত যুগের বর্বরতা। অথচ এরূপ বর্বরদের হাতে মুসলিম ভূমিগুলি আজ অধিকৃত। এ হলো খেলাফত বিলুপ্তির আযাব।

আরব দেশগুলির উন্নয়নে যারা নিজেদের রক্ত পানি করছে সে দেশে তাদের নাগরিকত্ব লাভের অধিকার কি সেদেশের আদি জনগণের চেয়ে কম? কোন সভ্য দেশ কি সে অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করতে পারে? খেলাফত প্রতিষ্ঠিত খাকলে কি এরূপ বর্বরতা স্থান পেত? খলিফা তো বিশ্বের সমগ্র মুসলমানদের অভিভাবক। তার কাছে আরব-অনারব, সাদা-কালো সবাই সমান। তাই এমন বিভাজন উমাইয়া, আব্বাসীয় ও ওসমানীয়া খেলাফত আমলেও ছিল না। মহান আল্লাহতায়ালা প্রতিটি মু’মিনকে অপর মু’মিনের ভাই বলেছেন। প্রকৃত ঈমানদারের দায়িত্ব হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে দেয়া ভাতৃত্বের পরিচয়ের প্রতি সম্মান দেখানো। নিজ ভাইয়ের প্রবেশ রুখতে কি দেয়াল গড়া যায়? অথচ আরব দেশগুলো সেটাই করেছে এবং এরপরও তারা নিজেদের মুসলমান রূপে দাবী করে! খেলাফত প্রতিষ্ঠা পেলে বিভক্তির দেয়াল লোপ পাবে। তখন বিলুপ্ত হবে আরব-অনারব, শ্বেতাঙ্গ-কষ্ণাঙ্গ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মুসলমানের পার্থক্য।এবং প্রতিষ্ঠা পাবে প্যান-ইসলামিক ভাতৃত্ব। খলিফা বাগদাদীর পক্ষে থেকে তো সেটিরই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইরাক এবং সিরিয়ার মাঝের সীমান্ত রেখাকে তাই ইতিমধ্যেই গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আরব-অনারব, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান-ইউরোপীয়ানগ সেখানে একই রণাঙ্গণে। বিশ্বের নানা ভাষা-ভাষী মুসলমানগণ আজ মিলেমিশে এক বিশাল বিশ্বশক্তি রূপে মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সেটি যেমন বিদেশী কাফেরগণ চায় না, তেমনি বর্ণবাদী, গোত্রবাদী, রাজতন্ত্রি ও স্বৈরাচারি জাতিয়তাবাদিগণও চায় না। আরব শাসকগণ ফিরে গিছে ইসলামপূর্ব আরব জাহিলিয়াতের দিকে। নবীজী (সাঃ) বিরুদ্ধে সে আমলের আবর গোত্রগুলি যেরূপ কোয়ালিশন গড়েছিল, আজকের স্বৈরাচারি আরব শাসকগণও সে পথ ধরেছে। খেলাফতের বিরুদ্ধে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে গভীর একতা। গাজায় ইসরাইলী গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তারা একটি দিন বা একটি ঘন্টার জন্য একত্রে বৈঠক করতে পারিনি। এখন খিলাফতের বিরুদ্ধে তাদের বৈঠকের শেষ নাই। এসব আরব শাসকবর্গ অনারব মুসলমানদের চেয়ে পাশ্চাত্যের কাফেরদেরকেই বেশী আপন ভাবছে। নিজেদের অবৈধ শাসনের প্রতিরক্ষায় তারা ইসলামের পবিত্র ভূমিতে কাফেরবাহিনীকে ডাকছে। খেলাফতের নির্মূলে গড়ে তুলেছে বৃহত্তর কোয়ালিশন। স্বৈরাচারি এসব আরব শাসকগণ ও তাদের গৃহপালিত আলেমগণ ইসলাম থেকে যে কতটা দূরে সরেছে সেটি বুঝতে কি এরপরও কিছু বাঁকি থাকে?  ২২/০৯/১৪

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *