নবীজী (সা)’র ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 29, 2024
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
অপরিহার্য কেন ইসলামী রাষ্ট্র?
মুসলিম কখনোই শুধু বাঁচার জন্য বাঁচে না; সে বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয়তর হওয়ার তাড়না নিয়ে। একমাত্র সে পথেই জুটে মাগফিরাত -যা হলো জান্নাতের চাবী। সে জন্য তাকে বাঁচতে হয় নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামের পূর্ণ অনুসরণ করে এবং মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে পূর্ণ একাত্মতা নিয়ে। তখনই মু’মিনের জীবনে শুরু হয় ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ছাড়া নবীজী (সা:)’র ইসলাম পূর্ণ ভাবে পালন করা যেমন অসম্ভব; তেমনি অসম্ভব হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়া। বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদই হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়া ও তাঁর কাছে প্রিয়তর হওয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম। একমাত্র এ পথেই মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন বিজয়ী হয়। তাই নবীজী (সা:)’র সাহাবীদের কোন সুফী খানকায়, পীরের দরবারে, মৃত দরবেশের দরগায় বা তাবলিগী ইজতেমায় দেখা যায়নি, তাদের দেখা গেছে জিহাদের ময়দানে।
কাফির, মুনাফিক, মুশরিক ও স্বৈরাচারী জালেম অধিকৃত দেশে বসবাসের বিপদটি ভয়ানক। কারণ, সেখানে অসম্ভব হলো পূর্ণ ইসলাম পালন। নবীজী (সা:)’র যুগে সেটি অসম্ভব ছিল কাফির-অধিকৃত মক্কায়। নবীজী (সা:)সেরূপ কাফির অধিকৃত দেশে বসবাস হলে কি করতে হবে -সেটির সূন্নতও তিনি রেখে গেছেন। ইসলাম পালনের অর্থ শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন নয়, সেটি মহান আল্লাহতায়ালার সর্বময় সার্বভৌমত্বের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং তাঁর শরিয়তী আইনের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে বাঁচা। সে সাথে বাঁচতে হয় অসত্য ও দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ নিয়ে। কোন অনৈসলামিক রাষ্ট্রই সেভাবে বাঁচতে দেয়না। কারণ, সেটি হলে নির্মূল হতে হয় তাদের নিজেদেরই। পূর্ণ ইসলাম পালনের স্বার্থেই মুসলিমদের উপর ফরজ হলো কোন নিরাপদ দেশে হিজরত এবং সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করা। সেদিন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাথীগণ মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত না করলে অসম্ভব হতো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এবং ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত না হলে মুসলিমদের বাঁচতে হতো অপূর্ণাঙ্গ মুসলিম রূপে। তখন বাঁচতে হতো কোন এক অনৈসলামিক দেশে কাফির, মুনাফিক ও জালিম শক্তির গোলামী মেনে নিয়ে। তাতে অসম্ভব হতো বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামকে তুলে ধরার কাজ। তখন মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা এবং কুর’আনী বিধান স্রেফ কুর’আনেই থেকে যেত। তাতে ব্যর্থ হয়ে যেত মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা। তাই মুসলিম জীবনে পূর্ণ ইসলাম পালন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি পূর্ণ ইসলাম পালনের লক্ষ্য পূরণে গুরুত্বপূর্ণ হলো হিজরত, জিহাদ ও ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। সুরা তাওবার ২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালার বয়ান:
ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَهَاجَرُوا۟ وَجَـٰهَدُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ ٱللَّهِ ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَآئِزُونَ
অর্থ: “যারা ঈমান আনলো, হিজরত করলো, এবং নিজেদের সম্পদ ও জান দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করলো, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে শ্রেষ্ঠ মর্যাদা। এবং তারাই বিজয়ী।”
বার্তাটি সুস্পষ্ট। যারা এ জীবনে ও আখেরাতে সফলতা চায় এবং মহান আল্লাহতায়ালার কাছে শ্রেষ্টতম মর্যাদা চায়, তাদের শুধু ঈমান আনলে চলে না। শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করলেও চলে না। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সম্ভাবনাময় স্থানে হিজরত করতে হয় এবং অর্থ ও জান দিয়ে অবশ্যই জিহাদ করতে হয়। পবিত্র কুর’আনের উপরিউক্ত আয়াতে এটিকেই সফলতার পথ বলা হয়েছে। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ এ তিনটি পর্যায়ই অতিক্রম করেছিলেন। ফলে তারা যেমন সফল হয়েছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায়, তেমনি পেয়েছিলেন পূর্ণ ইসলাম পালনের সুযোগ। এভাবেই তারা বিজয়ী করেছিলেন মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে। ফলে তাঁরা অতি প্রিয় হতে পেরেছিলেন রাব্বুল আলামিনের কাছে। পবিত্র কুর’আনের সুরা বায়েনাহ’র ৮ নম্বর আয়াতে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে:
رَّضِىَ ٱللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا۟ عَنْهُ ۚ ذَٰلِكَ لِمَنْ خَشِىَ رَبَّهُۥ
অর্থ: “আল্লাহ তাদের (ঈমানদারদের) উপর প্রসন্ন, এবং তারাও (ঈমানদারগণ) তার উপর সন্তুষ্ট। এসব তাদের জন্য যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে।”
কিন্তু আজকের মুসলিমগণ ব্যর্থ এ তিনটি খাতেই। তাদের জীবনে না আছে মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের উপর পূর্ণ ঈমান, না আছে হিজরত, এবং না আছে ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণের জিহাদ। বরং তারা বাঁচছে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে গাদ্দারী নিয়ে। সে গাদ্দারীর প্রমাণ, তারা তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী না করে বিজয়ী করেছে শয়তান ও তার অনুসারীদের এজেন্ডা। সে গাদ্দারীর কারণেই মুসলিম ভূমিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, রাজতন্ত্র, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের ন্যায় হারাম মতবাদ।
মহান নবীজী (সা:) ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁকে বেছে নেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজে। এ ক্ষেত্রে নবীজী (সা:)’র সাফল্য ছিল অভূতপূর্ব। সেটি ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং সে রাষ্ট্রে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব এবং শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাওয়াতে গড়ে উঠে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতি। সেটিই হলো মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল। এ অনন্য কর্মের মধ্য দিয়েই মুসলিমগণ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয় হওয়ার সুযোগ পায়। যারা নবীজী (সা:)’র অনুসারী রূপে বাঁচতে চায় তাদের দায়িত্ব হলো, নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সে নেক আমলের সূন্নত নিয়ে বাঁচা। সে সূন্নত নিয়ে বাঁচার তাড়নাতেই সাহাবাগণ জন্ম দিয়েছিলেন খোলাফায়ে রাশেদার। লক্ষণীয় হলো, অক্ষত পবিত্র কুর’আন বেঁচে আছে বলেই সে পবিত্র ঈমানী তাড়নাটি মারা যায়নি। কারণ, পবিত্র কুর’আন সে তাড়না নিয়েই বাঁচতে শেখায়। ফলে যুগে যুগে মুসলিম বিশ্বের নানা কোণে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ দেখা যায়। শত্রুশক্তির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মুসলিমদের মাঝে এখনো তাই জিহাদ বেঁচে আছে।
মুসলিম জীবনে গুরুত্বপূর্ণ যেমন হিজরত, তেমনি মুসলিম ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের বছর। হিজরতের ঘটনাটি সাহাবাদের কাছে এতোই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রূপে স্বীকৃতি পায় যে হিজরী সাল গণনার শুরু হয় হিজরতের বছর থেকে। কারণ হলো, এটি শুধু বছর গণনার শুরু ছিল না, এটি ছিল এ পৃথিবী পৃষ্ঠে এক নতুন ইতিহাস ও এক নতুন সভ্যতার শুরু। লক্ষণীয় হলো, মদিনায় হিজরতের পর পরই নবীজী (সা:) প্রতিষ্ঠা দেন ইসলামী রাষ্ট্রের এবং ১০টি বছর তিনি সে রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন। সে রাষ্ট্রের কারণেই মুসলিম উম্মাহর উদ্ভব ঘটে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তি রূপে। এবং নির্মিত হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তাই ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ হলো নবীজী (সা:)’র জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান বা সূন্নত।
ইসলামের পূর্ণ পরিচয়টি শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, মসজিদ-মাদ্রাসা, তাবলিগ, ওরশ, ইজতেমা নিয়ে নয়, বরং তাতে অবশ্যই থাকতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার একক সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা, দুর্বৃত্তি ও অবিচারের নির্মূল, সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম উম্মাহর প্যান-ইসলামিক ঐক্য। ইসলামের সে পূর্ণ পরিচয় নিয়ে বাঁচার কাজটি শুধু মসজিদ-মকতব, মাদ্রাসা, দরগা, খানকা প্রতিষ্ঠা দিলে হয় না, সে জন্য অপরিহার্য হলো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। তেমন একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্যতা শুধু নবীজী (সা:) বুঝেননি, বুঝেছিলেন সাহাবাগণও। তাই তাদের জান ও মালের সর্বাধিক কুর’আনী ছিল তেমন একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় ও সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায়। তেমন একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার জিহাদকে তারা সর্বোচ্চ ইবাদত মনে করতেন। সে পথে শাহাদতকে সর্বোচ্চ অর্জন মনে করতেন।
কিন্তু আজকের মুসলিমগণ তেমন একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে যেমন রাজী নয়, তেমনি রাজী নয় সেরূপ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় কুর’বানী পেশ করতে। তারা জিহাদ নিয়ে ভাবে না। তারা জান্নাতের চাবি মনে করে নামাজকে; ফলে সে চাবী হাত পেলেই খুশি। তারা ভাবে হজ্জে গিয়ে আরাফাতে মোনাজাত করলে সব পাপ মার্জনা হয়ে যায়। এভাবে নামাজ-রোজা-হজ্জের মাঝেই তারা জান্নাত দেখে; ফলে জিহাদে জান-মালের বিনিয়োগের ন্যায় ব্যয়বহু বিনিয়োগ নিয়ে তাদের কোন আগ্রহ নাই। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তাদের কাছে অতি সেকেলে এবং একালে অসম্ভব মনে হয়। মোল্লা-মৌলভীগণ মসজিদ-মাদ্রাসায় চাকুরি পেলেই খুশি, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় জিহাদ দূরে থাক, তা নিয়ে তারা ভাবতেও রাজী নয়। সেরূপ ভাবনাকে তারা উগ্রবাদ বলে। যেন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিয়ে বড়ই উগ্রবাদী কর্ম করেছিলেন নবীজী (সা:)।
কেন ব্যর্থতা ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে?
রাষ্ট্রের গুণাগুণের মাঝেই সে রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণের ঈমান, চেতনা ও চরিত্র ধরা পড়ে। তাই যে ভূমিতে ইসলামী রাষ্ট্র নাই, বরং প্লাবনটি অসত্য, জুলুম, নির্যাতন, স্বৈরাচার ও দুর্বৃত্তির -বুঝতে হবে সে ভূমিতে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলাম বেঁচে নাই। ইসলামের নামে এমন দেশে যা বেঁচে থাকে তা নিতান্তই বিকৃত ও অপূর্ণাঙ্গ ইসলাম। পূর্ণাঙ্গ ইসলাম নিয়ে না বাঁচার কারণেই আজ বেঁচে নাই মুসলিমদের সে পুরণো মান-মর্যাদা, গৌরব ও শক্তি। প্রশ্ন হলো, কারা বাঁচছে পূর্ণ ইসলাম নিয়ে, এবং কারা বাঁচছে অপূর্ণাঙ্গ ইসলাম নিয়ে -সে বিচার কিরূপে সম্ভব? বিচারটি অতি সহজ। সেটি বুঝা যায়, বাঁচার আয়োজনে জিহাদ আছে কিনা -সেটি দেখে। প্রাইমারী পাশ করে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়না, ফলে সবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকেনা। কিন্তু যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী তারা যে সবাই প্রাইমারী পাশ -তা নিয়ে কখনোই কোন প্রশ্ন উঠে না। তেমনি সব নামাজীই জিহাদী হয় না। কিন্তু যারা জিহাদী হয় তাদের সবাই যে নামাজী হয় -তা নিয়ে সন্দেহ থাকে না। জিহাদ হলো ইবাদতের সর্বোচ্চ চূড়া। তাই জিহাদ দেয় পূর্ণ ইসলাম পালনের পরিমাপ। তাই যাদের জীবনে পূর্ণ ইসলাম নিয়ে বাঁচার তাড়না থাকে, তাদের সবার জীবনে শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত থাকেনা, থাকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদও। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ছাড়া পূর্ণ ইসলাম পালন অসম্ভব।
প্রশ্ন হলো, যারা শুধু নামাজ-রোজা ও হ্জ্জ-যাকাত পালন, পীর-মুরিদী ও তাবলিগ করাকে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম মনে করে -তারা কেন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদে নামবে? কেনই বা তারা সে জিহাদে নিজেদের জান, মাল, সময় ও মেধার বিনিয়োগ করবে? এগুলি যে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম নয়, সে হুশই বা ক’জনের? অধিকাংশ মুসলিম সে অপূর্ণাঙ্গ ইসলাম নিয়ে বাঁচে বলেই মুসলিম উম্মাহ আজ জিহাদশূণ্য। এর ফলে শত্রুর হামলার মুখে ইসলাম ও মুসলিম ভূমিকে প্রতিরক্ষা দেয়ার তেমন কেউ নাই। ফলে অধিকাংশ মুসলিম ভূমি অধিকৃত হয়ে গেছে স্বার্থান্বেষী রাজ-বাদশাহ, সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী ও গোত্রবাদীদের হাতে। নবীজী (সা:)’র যুগে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় বাধা আসতো কাফিরদের থেকে। কিন্তু আজ সে বাধা আসছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলির দখলদার স্বৈরাচারী শাসকদের থেকে এবং তাদের সমর্থক মুসলিমনামধারী স্তাবকদের থেকে। ইসলামী রাষ্ট্র না থাকায় কুর’আনের দর্শন, শরিয়তী আইন, ইসলামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি, শিক্ষা নীতি, বিচার ব্যবস্থা, অন্যায়ের নির্মূল ও ন্যায় প্রতিষ্ঠারর জিহাদের ন্যায় ইসলামের মূল এজেন্ডাগুলি শুধু কিতাবেই রয়ে গেছে। ফলে অতীতে ইসলামী রাষ্ট্রের কারণে মুসলিমগণ যে শক্তি, বিশ্বজোড়া মর্যাদা ও নিরাপত্তা পেয়েছিল, আজকের মুসলিমগণ তা থেকে বঞ্চিত। বরং তারা আজ বিভক্ত ও অধিকৃত; এবং বাঁচছে গুম, খুন, ধর্ষণ ও অপমানের শিকার হয়ে।
অসভ্য, বর্বর ও অপরাধী মানুষেরাও ঘর বাঁধে। তারাও শিকার ধরে, মাছ ধরে, ও পশু পালন করে। তাদের অনেকে চাষবাদও করে এবং বস্ত্র বুনে। এরূপ বহুবিধ কর্মে দক্ষতা দেখালেও তাদের অনেকেই রাষ্ট্র নির্মাণে অক্ষম। এটিই তাদের সবচেয়ে বড় অক্ষমতা। ফলে তারা ব্যর্থ হয় সভ্যতা গড়তে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ হাজার হাজার বছর যাবত রাষ্ট্র ছাড়াই বসবাস করেছে। তারা বসবাস করেছে গোত্রীয় পরিচয় নিয়ে বা পরিচয় ছাড়াই। তাদের দ্বারা রাষ্ট্র নির্মাণের ন্যায় সভ্য কাজটি কোন কালেই হয়নি। কারণ, রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য শুধু পানাহারে বাঁচার সামর্থ্য থাকলে চলে না। সে কাজে লাগে সমৃদ্ধ চেতনা, উন্নত জীবন দর্শন ও বিবেকবোধ। বিপুল বিনিয়োগ লাগে জান, মাল, মেধা, শ্রম ও সময়সহ উচ্চতর মানবিক সামর্থ্যের। কিন্তু অসভ্য, অজ্ঞ ও দর্শনহীন মানুষের সে সামর্থ্য থাকে না।
পর্বত গুহায় বা জঙ্গলেও আমৃত্যু বসবাস করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্র ছাড়া জান-মাল ও ইজ্জতের সুরক্ষা, সুশিক্ষা, আইনের শাসন, মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূল, সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নিয়ে বসবাসের কাজটি হয় না। তাই সভ্য রাষ্ট্র -বিশেষ করে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণই হলো মানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম। সভ্য ও ভদ্র মানুষের পরিচয়ের মেলে কি ধরনের বাড়ীতে সে বসবাস করে তা দেখে। যে গৃহে দেয়াল নাই, দরজা-জানালা নাই, মেঝেতে দুর্গন্ধময় আবর্জনার স্তুপ -এমন গৃহের বাসিন্দাকে কখনোই কেউ সভ্য, ভদ্র, রুচিবান ও বিবেকমান বলবে না। এমন গৃহের বাসিন্দকে অসভ্য, বর্বর ও মানসিক দিক দিয়ে অসুস্থ ভাবাই স্বাভাবিক। তেমনি যে দেশে গুম, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, সন্ত্রাসের প্লাবন এবং শাসন ক্ষমতায় ভোটডাকাত দুর্বৃত্ত অধিষ্ঠিত -সে দেশ কখনোই সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় না। সেটি তো অসভ্য ও বর্বর রাষ্ট্র। সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রের পরিচয় একমাত্র তখনই মেলে যখন সে রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণী ও জনগণ উন্নত দর্শন, বিবেকবোধ, চরিত্র ও শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী হয়। সেটি আরো স্পষ্টতর হয় রাষ্ট্রের বুক থেকে অবিচার ও দুর্বৃত্তির নির্মূল দেখে।
জনগণ যত বেশী ঈমানদার, জ্ঞানবান, বিবেকবান ও সভ্যতর হয়, ততই বাড়ে উন্নত রাষ্ট্র-নির্মাণের তাড়না। তখন বাড়ে সে রাষ্ট্রের সৃষ্টিশীল সামর্থ্যও। ইসলামের আগে আরবদের কোন রাষ্ট্র ছিল না। তাদের কোন শক্তি, প্রতিপত্তি ও ইজ্জতও ছিল না। বহু হাজার বছর তারা কাটিয়েছে মরুর বুকে গোত্রীয় জীবনের কোন্দল, সংহিংসতা, অসভ্যতা ও বর্বরতা নিয়ে। মুর্তিপূজার সনাতন অজ্ঞতা ছিল তাদের ধর্ম । সেখানেো কোন সভ্য আইন ছিল না; আইনের শাসনও ছিল না। সেখানে দুর্বলের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা ছিল না। মানুষ হাটে বাজারে গরু-ছাগলের ন্যায় বিক্রি হতো। নারীদের কোন মর্যাদা ছিল না, জীবিত কবর দেয়া হতো কন্যা সন্তানদের। “জোর যার মুল্লুক তার” -জঙ্গলের এ নীতিই ছিল আরবদের নীতি। কিন্তু ইসলাম কবুলের পর এই আরব মুসলিমগণই স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্মাণ করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তারা প্রতিষ্ঠা পায় বিশ্বশক্তি রূপে। তাদের হাতে পরাজিত হয় পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের ন্যায় তৎকালীন বিশ্বের দুটি বিশ্বশক্তির। তাদের সে হঠাৎ শক্তিসঞ্চয় ও জেগে উঠার কারণ, কোন কৃষি বা শিল্প বিপ্লব ছিল না। বরং এ কারণে যে, তারা সফল হয়েছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে। এরূপ অতি উচ্চাঙ্গের মানবিক কাজটি অন্য কোন জাতির দ্বারা আর কোন কালেই হয়নি। এরূপ কাজ কোটি কোটি মসজিদ, মাদ্রাসা বা পীরের খানকা গড়ে সম্ভব নয়। সেটি সম্ভব হয়েছিল একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার মধ্য দিয়ে। বস্তুত সেরূপ একটি রাষ্ট্রের নির্মাণই হলো মহান নবীজী (সা)’র সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম ও সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত। সে রাষ্ট্রটি ছিল পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্র নির্মাণের ফলে পৃথিবীর বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বিজয় ঘটে। পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত সে এজেন্ডাটি হলো: لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِ অর্থাৎ সকল ধর্ম, সকল মতবাদ ও সকল জীবন-দর্শনের উপর ইসলামের বিজয়।
ঈমানদার হওয়ার দায় হলো, সে কাজ করবে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে -কোন ব্যক্তি, নেতা বা দলের এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে নয়। এটিই হলো ঈমানদারের এ জীবনে বাঁচার নিয়েত। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা বিজয়ী হওয়াতে ইসলামী রাষ্ট্রের কোটি কোটি মানুষ উদ্ধার পায় জাহান্নামের আগুনে পড়া থেকে; তারা জান্নাতের পথ পায়। নবীজী (সা:)’য়ের নির্মিত সে রাষ্ট্রের কারণে কোন দুর্বৃত্ব স্বৈরশাসক ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে কলুষিত করতে পারিনি। অথচ সেরূপ একটি রাষ্ট্র না থাকায় হযরত মূসা (আ:)’য়ের উপর তাওরাতে নাযিলকৃত শরিয়তী আইন আইন স্রেফ কিতাবেই রয়ে গেছে, কোথাও কার্যকর হওযার স্থান পায়নি। মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া বিধানের প্রতি এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কি হতে। বনি ইসরাইলীগণ তাদের কৃত সে অপরাধের শাস্তিও পেয়েছে। তারা কোথাও নিরাপত্তা পায়নি, নানা দেশের পথে প্রান্তরে গৃহহীন উদ্বাস্তুর ন্যায় তাদের ঘুরতে হয়েছে। বনি ইসরাইলীদের সে পথ ধরেছে আজকের মুসলিমগণও। তারাও বাঁচছে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে গাদ্দারী নিয়ে। ফলে তারাও আজ আযাবের গ্রাসে। নিজ দেশেই তারা আজ পরাধীন। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না দেয়াতে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে হযরত ঈসা (আ:)’য়ের দেয়া তাওহিদের শিক্ষাও। ধর্মের মাঝে পৌত্তলিকতা ঢুকিয়েছে খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষা নেয়া স্বৈরাচারী রোমান রাজা কনস্টান্টিন। উল্লেখ্য যে, খৃষ্টান হওয়ার আগে রাজা কনস্টান্টিন ছিলেন পৌত্তলিক প্যাগান। হযরত ঈসা (আ:)’র পেশকৃত তাওহিদী ধ্যান-ধারণার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ না করে তিনি বরং খৃষ্টানদের বাধ্য করেন তাঁর পৌত্তলিক বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণে। তাই হযরত ঈসা (আ:)কে বসানো হয় ঈশ্বরের আসনে। মুর্তি গড়া হয় হযরত ঈসা (আ:)’র এবং সে মুর্তিগুলিকে স্থাপন করা হয় গীর্জায়। ফলে গীর্জা পরিণত হয় পূজার মন্দিরে। এমন কি তারা অসংখ্য মুর্তি বসিয়েছে মুসলিম ইতিহাসের বিখ্যাত স্থাপনা স্পেনের কর্ডোভা মসজিদে। এ গ্রন্থের লেখক সেটি স্বচোখে দেখেছে। অথচ শুরুর ১০টি বছর নবীজী (সা:) নিজে রাষ্ট্র প্রধান থাকায় কোন স্বৈরশাসক ইসলামের মৌল বিশ্বাসকে দূষিত করার সুযোগ পায়নি। নবীজী (সা:)’র সে ধারাকে অব্যাহত রাখেন খোলাফায়ে রাশেদাও। ফলে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র শুধু মুসলিমদের জান-মাল ও স্বাধীনতারই সুরক্ষা দেয়নি, সুরক্ষা দিয়েছে ইসলামের বিশুদ্ধ ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাসকেও। কিন্তু রাষ্ট্র গড়তে ব্যর্থ হওয়ায় সেরূপ সুরক্ষা পায়নি হযরত মূসা (আ:)ও হযরত ঈসা (আ:)’র শিক্ষা।
বড় জিহাদ ও ছোট জিহাদ
মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণের কাজটি সহজ। সূদখোর, ঘুষখোর, মিথ্যাবাদী এবং নৃশংস স্বৈরাচারী শাসকগণও সেগুলি অনায়াসে গড়তে পারে। এমন কি বাংলাদেশের ন্যায় যে দেশটি দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্বরেকর্ড গড়েছ, সে দেশেও লক্ষ লক্ষ মসজিদ এবং হাজার হাজার মাদ্রাসা রয়েছে। এমন কি নামাজ-রোজা পালনও কঠিন নয়। গুম, খুন, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতির প্লাবনে ডুবা এ দেশটিতে বহু কোটি নামাজী ও রোজাদার দেখা যায়। এমন দেশে তাবলিগের ইজতেমায় ২০ লাখ মানুষ জমায়েত হয়। কিন্তু তাদের মানবিক, চারিত্রিক ও ঈমানী দুর্বলতাটি প্রকট ভাবে ধরা পড়ে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে বিশাল ব্যর্থতা দেখে। ঘুষখোর, সূদখোর, মিথ্যাবাদী, প্রতারক ও সেক্যুলার রাজনীতির দুর্বৃত্ত নেতা-কর্মীগণও নামাজী, রোজাদার ও হাজী হতে পারে। কিন্তু তারা কখনোই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে মুজাহিদ হতে পারে না। কারণ এ পবিত্র জিহাদ শুধু অর্থ ও সময়ের কুরবানী চায় না, রক্ত ও প্রাণের কুরবানীও চায়। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে তো সেই নামতে পারে, যে প্রকৃত ঈমানদার এবং নিজ নফসের বিরুদ্ধে জিহাদে বিজয়ী। নামাজী, রোজাদার ও হাজী তো ঘুষখোর, সূদখোর মিথ্যাচারী ও স্বৈরাচারী খুনী শাসকগণও হতে পারে। কিন্তু ঈমানদার হতে হলে হৃদয়ে কুর’আনী জ্ঞানের নূর থাকতে হয়। আলো যেমন অন্ধকার দূর করে, কুর’আনী জ্ঞানের নূর তেমনি মনের অন্ধকার তথা জাহিলিয়াত দূর করে। মনের ভূবনে অন্ধকার তথা অজ্ঞতা নিয়ে আর যাই হোক কখনোই ঈমানদার হওয়া যায় না। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা যা প্রথম ফরজ করেন সেটি নামাজ-রোজা বা হজ্জ-যাকাত নয়, সেটি হলো পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জন। বুদ্ধিবৃত্তিক সে জিহাদটি বস্তুত অজ্ঞতার নির্মূলে। নামাজ দিনে মাত্র ৫ বার, কিন্তু এ বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ সর্বক্ষণ। নফসের বিরুদ্ধে বিরামহীন এ জিহাদে একমাত্র সেই বিজয়ী হয় যার হৃদয়ে রয়েছে কুর’আনী জ্ঞানের তথা নূরের অস্ত্র। পবিত্র কুর’আনে সে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের নির্দেশ এসেছে এভাবে:
فَلَا تُطِعِ ٱلْكَـٰفِرِينَ وَجَـٰهِدْهُم بِهِۦ جِهَادًۭا كَبِيرًۭا
অর্থ: “অতএব কাফিরদের অনুসরণ করো না, এবং এই (কুর’আন) দিয়ে বড় জিহাদটি লড়ো”। -(সুরা ফুরকান, আয়াত ৫২)। মুমিনের এ বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদকে বলা হয়েছে বড় জিহাদ। বড় জিহাদ বলার কারণ, এ জিহাদের ময়দানেই নির্ধারিত হয় ব্যক্তির জীবনের সবচেয়ে বড় তথা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। অর্থাৎ কে মুসলিম হবে এবং কে কাফির হবে, জান্নাতের পথ যাবে, না জাহান্নামের পথে যাবে -সে বড় বিষয়টি। কোন ব্যক্তির জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় আছে কি? মুমিনের জীবনে শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্রের যুদ্ধটি শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক এই জিহাদে বিজয়ের পর। সে লাগাতর জিহাদটি হয় চেতনার ভূমিতে। যুদ্ধ এখানে মিথ্যার নির্মূলে। বুদ্ধিবৃত্তিক এ জিহাদে ব্যক্তির চেতনার ভূমিকে বাঁচাতে হয় কাফিরদের প্রচারিত মিথ্যা ধর্ম, মিথ্যা মতবাদ ও মিথ্যা দর্শনের আগ্রাসন থেকে। এ লড়াইয়ে হেরে গেল চেতনার ভূমি অধিকৃত হয় কুফরি ধ্যান-ধারণায়; তখন অসম্ভব হয় মুসলিম রূপে বাঁচা। এমন ব্যক্তিরাই মুসলিম ঘরে জন্ম নিয়ে ইসলামের শত্রু পক্ষের সৈনিক হয়। মুসলিম দেশগুলিতে এরাই ইসলামী বিধানকে পরাজিত এবং অনৈসলামীক ধ্যান-ধারণাকে বিজয়ী করে রেখেছে। যে দেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে লোকবল নাই, বুঝতে হবে সে দেশে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম -যারা জিহাদে আকবরে তথা জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে বিজয়ী হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে পরাজিতরা তাবলিগের ইজতেমায় নিয়মিত হাজির হতে পারে, পীরের ওরশ মহফিলেও যোগ দিতে পারে, মসজিদ-মাদ্রাসার নির্মাণেও অর্থ দিতে পারে, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ থেকে তারা দূরে থাকে।
বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের মূল অস্ত্রটি হলো পবিত্র কুর’আন। ইসলামের পথে ব্যক্তির যাত্রা শুরু হয় এ জিহাদের মধ্য দিয়ে। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা প্রথমে নামাজ-রোজা ফরজ না করে কুর’আনের জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন। নামাজ-রোজা সঠিক ভাবে করার জন্য কুর’আনী জ্ঞানের নূরে আলোকিত মন চাই। তাই মুসলিম হওয়ার কাজটি শুধু মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস করলেই হয় না, হৃদয়কে আলোকিত করতে হয় পবিত্র কুরআনের জ্ঞানে। তাই যার মধ্যে কুর’আনী জ্ঞান নাই, তাকে বাঁচতে হয় মনের ভূবনে জাহিলিয়াতের গভীর অন্ধকার নিয়ে। এজন্যই সে কুর’আনী নূরের উপর বিশ্বাস যেমন ফরজ, তেমনি ফরজ হলো তা দিয়ে মনকে আলোকিত করা। তাই নির্দেশ দেয়া হয়েছে:
فَـَٔامِنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَٱلنُّورِ ٱلَّذِىٓ أَنزَلْنَا ۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌۭ
অর্থ,: “অতঃপর ঈমান আনো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর এবং সেই নূরের উপর (কুর’আনের উপর) যা আমি নাযিল করেছি; এবং তোমরা যা কিছু করো -সে বিষয়ে আল্লাহ খবর রাখেন।” –(সুরা তাগাবুন, আয়াত ৮)। কুর’আনের নূর কখনোই না বুঝে তেলাওয়াতে জুটে না, সে জন্য কুর’আনের বাণীগুলিকে বুঝতে হয়। সেগুলিকে মনের গভীরে নিতে হয়। তাই প্রতিটি নর-নারীর উপর কুর’আন বুঝা ফরজ করা হয়েছে, তেলাওয়াত নয়। সে কুর’আনী নূরের সাথে নিজেদের বন্ধনকে মজবুত করার তাগিদেই মিশর, সিরিয়া, ইরাক, মরক্কো, সুদান, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, আলজিরিয়ার ন্যায় বহু দেশের জনগণ মাতৃভাষাকে কবরে পাঠিয়ে কুর’আনের ভাষাকে নিজেদের ভাষা বানিয়েছে।
বদরের ময়দানে যে ৩১৩ জন সাহাবী জিহাদে খাড়া হয়েছিলেন তাদের মধ্যে বেশীর ভাগ ছিলেন মক্কা থেকে আগত মোহাজির সাহাবী। সশস্ত্র জিহাদে নামার পূর্বে মক্কায় অবস্থান কালে তারা বড় জিহাদটি লড়েছেন নিজের নফসের বিরুদ্ধে। সেটি কুর’আনী জ্ঞানের অস্ত্র দিয়ে। নফসের বিরুদ্ধে সে জিহাদে যারা বিজয়ী হয়েছিলেন -তাদেরকেই সেদিন প্রথম সারিতে দেখা গেছে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সশস্ত্র জিহাদে। তারাই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন খোলাফায়ে রাশেদাকে। তারাই ইসলামের বাণীকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আজকের মুসলিমদের মাঝে ক’জনের হৃদয়ে রয়েছে কুর’আনী জ্ঞানের সে নূর? ক’জন তাদের চেতনা ভূমিকে পরিশুদ্ধ করতে পেরেছে নানারূপ জাহিলী বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা থেকে? যার নাই পবিত্র কুর’আন বুঝার সামর্থ্য, তার মনে কুর’আনী নূর আসবে কোত্থেকে? ফলে জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে সে “জিহাদে কবিরা” তথা বড় জিহাদ করবে কিরূপে? সে তো বরং নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করেও ভেসে যায় জাতীয়তাবাদ, সুবিধাবাদ, পুঁজিবাদ, সেক্যলারিজম, সমাজতন্ত্রের ন্যায় নানা রূপ জাহিলিয়াতের স্রোতে।
বাংলাদেশে কুর’আন তেলাওয়াতের কাজটি কিছুটা হলেও কুর’আন বুঝার কাজটি তেমন হয়নি। ফলে কুর’আনী জ্ঞানের অভাবে অধিকাংশ মানুষ ভাসছে জাহিলীয়াতের স্রোতে। দেশটির রাজনীতির অঙ্গণে তারাই বিজয়ী। ফলে এদেশে প্রচণ্ড অভাব হলো পরিশুদ্ধ মনের মুজাহিদের। ফলে এদেশে ভোটডাকাত ফ্যাসিস্ট নিজ দলে লক্ষ লক্ষ সৈনিক পেলেও সৈনিক জুটে না ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে। কারণ, দেশটিতে কোটি কোটি নামাজী ও রোজাদার থাকলেও নিজের নফসের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে এমন ঈমানদার নাই। ঘুষখোর, সূদখোর ও মিথ্যাচারী নামাজীদের দিয়ে আর যাই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের পবিত্র জিহাদটি হয়না। এসব সেক্যুলারিস্ট দুর্বৃত্তগণ বরং ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের পবিত্র জিহাদকে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে জিহাদীদের উপর নির্যাতন করবে এবং তাদেরকে হত্যা করবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। মিশর ও বাংলাদেশের মত দেশে তো সেটিই তো অহরহ হচ্ছে। এরা এতোটাই বিবেকশূণ্য যে হাসিনার ন্যায় এক ভোটডাকাত দুর্বৃত্তকে ক্ষমতায় বসিয়ে মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী বলে। যে কোন প্রকারের দুর্বৃত্তিই গুরুতর অপরাধ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দুর্বৃত্তিকে সমর্থন করাও কি কম অপরাধ? অথচ বাংলাদেশে চলছে সে অপরাধের মহামারি। এদের কারণেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এদেশটিতে চলছে দুর্বৃত্তদের বর্বর শাসন এবং অসম্ভব করে রেখেছে ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। এমন দেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ ব্যর্থ হবে -সেটিই স্বাভাবিক।
ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে নবীজী (সা:)’র সূন্নত
ইসলামী রাষ্ট্রনির্মাণের কৌশলটি কোন আবিস্কারের বিষয় নয়। সেটি অনুসরণের বিষয়। অনুসরণের সে কাজটি সহজ করতেই নবীজী (সা:) দিয়ে গেছেন রাষ্ট্র নির্মাণের নির্ভূল রোডম্যাপ। সে রোডম্যাপ যে কতটা নির্ভূল ও সফল সেটির প্রমাণ আজও ইতিহসে বেঁচে আছে। এক্ষেত্রে অতি জরুরি ছিল, পদে পদে নবীজী (সা:) পরীক্ষিত সে রোডম্যাপকে পদে পদে অনুসরণ করা। কিন্তু মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে সে রোডম্যাপের সঠিক অনুসরণে। সে ব্যর্থতাই মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার মূল কারণ। তারা এ মৌল বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে, পৃথিবী পৃষ্ঠে সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণকর্মটি মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল বা কল-কারখানার নির্মাণ নয়, সেটি হলো ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। বস্তুত এটিই হলো নবী জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। রাষ্ট্র ইসলামী হলে, সেটি পরিণত হয় উন্নত মানব ও সভ্যতা নির্মাণের হাতিয়ারে ও জনগণকে জান্নাতে নেয়ার বাহনে। এবং অনৈসলামিক হলে সেটি পরিনত হয় দুর্বৃত্ত তৈরীর কারখানায় ও জাহান্নামের বাহনে। তখন সে অনৈসলামিক রাষ্ট্রের বুকে লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেও জনগণকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো কাজটি যথার্থ ভাবে হয় না। রাষ্ট্র নায়কগণ যেদিকে নিতে চায় জনগণকে সেদিকেই যেতে হয়।
ইসলামী রাষ্ট্রের অবদানটি সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার কারণ, জাহান্নাম থেকে বাঁচানো ও জান্নাতে নেয়ার ক্ষেত্রে এর চেয়ে শক্তিশালী কোন প্রতিষ্ঠান পৃথিবী পৃষ্ঠে নাই। নবীজী (সা:) যেমন সে মিশন পূরণেই রাষ্ট্র নির্মাণ করেছিলেন; সে লক্ষ্য পূরণে খোলাফায়ে রাশেদাও সে রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে রাখেন। অপর দিকে শয়তান ও অনুসারীগণও তাদের লক্ষ্য পূরণে রাষ্ট্র নির্মাণ করে। সে লক্ষ্যটি হলো জনগণকে জাহান্নামে নেয়া। এ পৃথিবী পৃষ্ঠে তাই অবিরাম যুদ্ধটি রাষ্ট্র নির্মাণ ও রাষ্ট্রের উপর দখলদারী নিয়ে। সংঘাত এখানে শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে আল্লাহতায়ালার দ্বীনের অনুসারীদের। মানব জাতির জান-মাল, শ্রম, সময় ও মেধার সবচেয়ে ব্যয়বহুল খাত হলো রাষ্ট্র দখলের এ যুদ্ধ। তাই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো রাষ্ট্রকে ইসলামের হাতিয়ারে পরিণত করা। এটি গণ্য হয় পবিত্র জিহাদ রূপে। সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণে মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও রাস্তা-ঘাট নির্মাণের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু পবিত্র জিহাদের মর্যাদা পেয়েছে একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ও সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার কাজ। কারণ এ লড়াইয়ের সাথে জড়িত মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বিজয়। এজন্যই নবীজী (সা:)’র প্রসিদ্ধ হাদীস, ইসলামী রাষ্ট্রের পাহারায় এক মুহুর্ত ব্যয়ের সওয়াব সারা রাত নফল নামাজের চেয়ে অধিক। তাই যারা মহান আল্লাহতায়ালার প্রকৃত আশেক এবং চায় তাঁর এজেন্ডার বিজয় -তারা তাদের সমগ্র সামর্থ্য বিনিয়োগ করে ইসরামী রাষ্ট্রের নির্মাণে।
রাষ্ট্র ইসলামী হলে তার সমগ্র অবকাঠামো ও অঙ্গ প্রতিষ্ঠানসমূহ কল্যাণকর্মের কারখানায় পরিণত হয়। নানা ভাবে জনগণের কল্যাণ করা এবং অকল্যাণ থেকে তাদের বাঁচানোই তখন রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়। তখন বিপ্লব আসে যেমন নৈতিক, আধ্যত্মিক ও চারিত্রিক অঙ্গণে, তেমনি দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সুবিচার-সুশাসনের প্রতিষ্ঠায়। সবচেয়ে বড় বিপ্লবটি আসে চরিত্রবান ও দায়িত্ববান মানব গড়ার ক্ষেত্রে। এরূপ কল্যাণকর কাজে রাষ্ট্রের সামর্থ্যটি বিশাল। রাষ্ট্রের হাতে থাকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন, মিডিয়া, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আদালত। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা বাস্তবায়নের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারে। রাষ্ট্রের অবর্তমানে সে কাজটি লাখ লাখ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে হয় না। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত হলে রাষ্ট্র পরিণত হয়ে জনগণকে আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয়তর করে গড়ে তোলার হাতিয়ারে। রাষ্ট্র সে মহা কল্যাণকর কাজটি করে প্রতিটি জনপদে কুর’আন-হাদীস চর্চা, সুশিক্ষা, প্রশিক্ষণ, মিডিয়া ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধির মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গণ তখন পরিণত হয় শিক্ষাঙ্গণে। একারণেই মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাল মানবগণ সর্বাধিক সংখ্যায় গড়ে উঠেছিলেন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের আমলে। মানব ইতিহাসের আর কোন কালেই এরূপ বিস্ময়কর কর্মটি ঘটেনি। এর ফলে মুসলিমগণ দ্রুত প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন বিশ্বশক্তি রূপে এবং তারা গড়তে পেরেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। তাদের সে সাফল্যের মূল কারণ, তারা পেয়েছিলেন উন্নত মানুষ গড়ার বিশাল রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও তার প্রতিষ্ঠানসমূহ। কিন্তু সেরূপ রাষ্ট্র অন্য কোন নবী-রাসূলের হাতে ছিল না। ফলে নবীজী (সা:) সে সাফল্য পেয়েছেন, তাঁরা তা পাননি।
এ নিয়ে সন্দেহ নাই যে, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ও কল-কারখানার গুরুত্ব অতি অপরিসীম। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের আগে সেগুলি গড়লে শত্রুশক্তি সেগুলি সহজেই দখলে নিয়ে নেয়। সেগুলিকে তখন শত্রুর হাত থেকে বাঁচানো যায়না। বাংলাদেশ ও মিশরের ইসলামপন্থীরা সেটি হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। তাদের গড়া বহু প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীদের হাতে ছিনতাই হয়ে গেছে। তাই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয় সর্ব প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণের লক্ষ্যে। ইসলামী রাষ্ট্র গড়লে কল্যাণ কর্মের জোয়ার শুরু হয়ে যায়। এরূপ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা তখন সহজ হয়ে যায়। তাই নবীজী (সা:) তাঁর ১৩ বছরের মক্কী জীবনে একটি মসজিদও গড়েননি। একটি মাদ্রাসাও নির্মাণ করেননি। সব সময় তাঁর নজরে ছিল ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের ন্যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি। সে লক্ষ্য পূরণে সর্বপ্রথম যে কাজটি সমাধা করা জরুরি ছিল, নবীজী (সা:) সর্বপ্রথম সেটিই করেন। প্রাসাদ গড়তে হলে প্রথমে বেছে বেছে উন্নত মানের ইট-পাথর ও রড-সিমেন্ট সংগ্রহ করতে হয়। তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে হলে প্রথমে সে রাষ্ট্রের গভর্নর, প্রশাসক, জেনারেল, সৈনিক, বিচারক, শিক্ষক, বিচারপতি, ফকিহ, ইমাম রূপে যারা কাজ করবে তাদের তৈরী করতে হয়। পাকিস্তান গড়ার আগে সে কাজটি হয়নি, তাই ব্যর্থ হয়ে গেছে ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার পাকিস্তান প্রকল্প । অন্যরাও যারা এ পথে এগুচ্ছে তারা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
নবীজী (সা:) তাঁর ১৩টি বছরের মক্কী জীবনে যে কাজটিই দিবারাত্র করেছেন সেটি হলো মানুষ গড়ার কাজ। সেদিন মানুষ গড়ার সে কাজে মূল উপকরণটি ছিল পবিত্র কুর’আন। পবিত্র কুর’আন শুধু হিদায়েতের গ্রন্থ নয়, এটি বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের অস্ত্রও। মুসলিম জীবনে জিহাদ শুরু হয় ইসলাম কবুলের সাথে সাথে। সে’টি যেমন নিজ মনের জাহিলিয়াত ও খায়েশাতের বিরুদ্ধে, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের বুক থেকে জাহিলিয়াত সরাতে। মুসলিম জীবনে সে জিহাদের শুরুটি কুর’আন নাজিলের প্রথম দিন থেকেই। পবিত্র কুর’আনে জাহিলিয়াতে বিরুদ্ধে এ জিহাদকে “জিহাদে কবিরা” তথা বড় জিহাদ বলা হয়েছে। এবং সে জিহাদ লড়তে বলা হয়েছে কুর’আন দিয়ে অর্থাৎ কুর’আনের জ্ঞান দিয়ে। নবীজী (সা:)’র নবুয়তপ্রাপ্তির শুরু থেকে প্রথম ১২ বছর কোনরূপ নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ছিল না, ছিল শুধু কুর’আন বুঝা এবং কুর’আনের শিক্ষাকে কাজে লাগানো। অথচ আজকের মুসলিম জীবনে নামাজ-রোজা বেড়েছে, কিন্তু সবচেয়ে অবহেলিত হয়েছে কুর’আন বুঝার কাজটি। তাদের কাছে গুরুত্ব পায় স্রেফ কুর’আন তেলাওয়াত, কুর’আন বুঝা নয়। ফলে নবীজী (সা:) তাঁর মিশনটি যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, আজকের মুসলিমগণ তার ধারে কাছেও নাই। ফলে তারা বাঁচছে নিজ মনে জাহিলিয়াতের ঘন অন্ধকার নিয়ে। ফলে ইসলাম-পূর্ব আরব কাফিরদের ন্যায় আজকের মুসলিমগণও বাঁচে গোত্রবাদ, জাতীয়তাবাদ ও ইহজাগতিক স্বার্থচেতনা নিয়ে তথা সেক্যুলারিজমের জাহিলিয়াত নিয়ে। তারা শুধু নামেই মুসলিম রয়ে গেছে। এমন কি যারা মোল্লা, মৌলবী, আলেম রূপে পরিচিত, তাদেরও অনেকে সত্যিকার ঈমান ও উন্নত চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠতে পারিনি। তাদের মধ্য থেকে অনেকে এ যুগের দুর্বৃত্ত ইয়াজিদদের মোজাদ্দেদ ও জান্নাতি বলে ভূষিত করে এবং তাদের রাজনীতির সমর্থক ও প্রচারকে পরিণত হয়।
নবীজী (সা:)’র নিজ হাতে গড়া সে মানুষগুলিই পরিণত হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবে। তাদের চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বের নমুনা হলো, তাঁরা যখন বাংলাদেশের চেয়ে ৫০-৬০ গুণ বৃহৎ রাষ্ট্রের শাসক, তখনও তাদের জন্য কোন প্রাসাদ বানাতে হয়নি। তারা সে বিশাল রাষ্ট্রের শাসকের কাজটি করেছেন মাটির ঘরে বাস করে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কোন প্রটোকল বা পাহারাদারের নিয়োগ করা হয়নি। বহু বড় বড় সাম্রাজ্য তারা দখলে নিয়েছেন, কিন্তু সেসব দেশের রাজপ্রাসাদের বিলাস সামগ্রী কখনোই খলিফার ঘরে তোলা হয়নি, সেগুলি দরিদ্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়েছে। খলিফা হযরত উমর (রা:) মদিনা থেকে জেরুজালেমের প্রায় ৫৭০ মাইল পাড়ি দিয়েছেন একজন মাত্র সহচর এবং একটি মাত্র উঠ নিয়ে। সে উঠের পিঠে পালাক্রমে কখনো খলিফা হযরত উমর (রা:) উঠেছেন, কখনো বা তাঁর সহচর উঠেছেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে এমন নজির কি একটিও আছে? সেদিন খলিফাসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি দায়িত্বশীল যে তাড়নাটি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতেন -তা ছিল মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয়তর হওয়া ও তাঁর মাগফিরাত লাভের তাড়না। অথচ বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারম্যান বা মেম্বরও রাস্তায় একাকী নামে না। মন্ত্রী ও এমপিগণ নামে একপাল সঙ্গি ও গাড়ির বহর নিয়ে।
মক্কার বুকে ১৩ বছর কাটানোর পর মদিনায় হিজরতের সাথে সাথে নবীজী (সা:)’র তাঁর এজেন্ডা পাল্টান। প্রথম দিনেই মসজিদে নববী নির্মাণ শুরু করেন। এবং মসজিদে নববীকে সেক্রেটারিয়েট তথা প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে প্রতিষ্ঠা দেন ইসলামী রাষ্ট্রের। সে রাষ্ট্রই পরবর্তীতে রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করে সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়। এভাবে নবীজী (সা:) তাঁর উম্মতের জন্য রেখে যান ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সফল পদ্ধতি তথা methodology। সে প্রক্রিয়ার বিবরণ ইতিহাসের বইয়ে আজও বেঁচে আছে।
গৃহে নির্ভুল প্রেসক্রিপশন থাকা সত্ত্বেও সে অনুযায়ী মরাণাপন্ন রোগীকে চিকিৎসা না করাটি গুরুতর অপরাধ। সেটি নিরেট হত্যাকান্ড। তেমনি গুরুতর অপরাধ হলো নবীজী (সা:)’র দেখানো নির্ভূল রোডম্যাপ সামনে থাকা সত্ত্বেও সেটি অনুসরণ না করা। পরিতাপের বিষয় হলো, আজকের মুসলিম উম্মাহ জড়িত সে গুরুতর অপরাধের সাথে। সে অপরাধের কারণে অর্জন করছে প্রতিশ্রুত আযাব -সেটি যেমন এ দুনিয়ায়, তেমনি আখেরাতে। ১৭/০২/২০২৪
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018