নবীজী (সা:)‌’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি

ফিরোজ মাহবুব কামাল

অনেক আলেম রাজনীতিকে দুনিয়াদারী মনে করেন এবং সযত্নে রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। এসব আলেমগণ নিজেদেরকে আলেম রূপে জাহির করলেও আসলে তারা জাহেল। তাদের অজ্ঞতা নবীজী (সা:) জীবন-ইতিহাস নিয়ে। তারা ভূলে যান, নবীজী (সা:) নিজে ১০টি বছর যাবত নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তার সে রাষ্ট্রটি ছিল আজকের বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বড়। সে রাষ্ট্র নিয়ে আজ সৌদি আরব, কাতার, আমিরাত, ওমান ও ইয়েমেন -এই ৫টি রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্রপ্রধানের কাজটি কৃষিবিদ্যা, কুঠিরশিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, মসজিদের ইমামতি বা মাদ্রাসার শিক্ষকতার বিষয় নয়, বরং সেটি হলো নিরেট রাজনীতির বিষয়।

প্রশ্ন হলো, রাজনীতি বলতে আমরা কি বুঝি? রাজনীতির অর্থ যেমন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা, প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নের নীতি, তেমনি সেটি হলো সুবিচারের প্রতিষ্ঠা এবং দুর্বৃত্তি নির্মূলের নীতি।  সে সাথে রাজনীতি হলো দেশবাসীর জান-মালের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সুশিক্ষাকে সুনিশ্চিত করার নীতি। ইসলামে রাজনীতি হলো সর্বোচ্চ জিহাদ। রাজনৈতিক সে জিহাদের লক্ষ্যটি হলো, রাষ্ট্র ও তার প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোকে জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো ও তাদেরকে জান্নাতে নেয়ার হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করা। এ বিশাল কাজটি লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেও হয় না।

নবীজী (সা)’র হাতে নির্মিত মাদ্রাসা-মসজিদের সংখ্যা অতি সামান্য, কিন্তু তিনি ইসলামের এবং সে সাথে মানব জাতির ইতিহাস পাল্টে দিয়েছেন ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করে। এতে মুসলিমদের উত্থান হয়েছে বিশ্বশক্তি রূপে। এবং সে রাষ্ট্রের ভূমিতে নির্মিত হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতি। রাজনীতির এ জিহাদটি ঈমানদারদের দিয়ে না হলে রাষ্ট্র ফিরাউন-নমরুদের ন্যায় শয়তানী শক্তির দখলে যায়। এখানেই আজকের মুসলিমদের মূল ব্যর্থতা। ফলে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশ অধিকৃত হয়েছিল মুজিব-হাসিনার ন্যায় দুর্বৃত্ত ফিরাউনদের হাতে। এমন ফিরাউন-অধিকৃত রাষ্ট্রগুলিই জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার হাতিয়ারে পরিণত হয়। তখন শয়তানী শক্তির অধিকৃত রাষ্ট্রে পূর্ণ ইসলাম পালন ও সিরাতাল মুস্তাকীমে চলাই অসম্ভব হয়। কারণ পূর্ণ ইসলাম পালনের জন্য তথা সিরাতাল মুস্তাকীমে চলতে হলে তো অবশ্যই শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা দিতে হয়। এমন দুর্বৃত্ত-অধিকৃত দেশের রাজনীতি, পুলিশ বিভাগ, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি জনগণকে গুনাহগার বানানোর হাতিয়ারে পরিণত হয়।

রাজনীতিই হলো ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-উমরাহ ঘুষখোর, সূদখোর ও প্রতারকগণও পালন করতে পারে। কিন্তু সে কখনোই ইসলামকে বিজয়ী করার রাজনীতিতে যোগ দেয় না। তাকে দেখা যায় সেক্যুলার ঘরানার ফ্যাসিবাদী, জাতীয়তাবাদী ও নানারূপ মতবাদী রাজনীতিতে। বাংলাদেশ তো ইসলাম থেকে দূরে-সরা এমন দুর্বৃত্ত লোকদের দ্বারাই শাসিত হচ্ছে। রাজনীতির জিহাদে ব্যয় হয় মু’মিন ব্যক্তির অর্থ, মেধা, শ্রম ও রক্তসহ তাঁর শ্রেষ্ঠ সামর্থ্যের। নামাজ-রোযা, হজ্জ-যাকাতের কাজ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ এ ইবাদতের জন্য ব্যক্তিকে প্রস্তুত করা।  সাহাবাদের জান ও মালের সিংহভাগ খরচ হয়েছে রাজনীতির এই জিহাদে।

নবুয়ত লাভের পর নবীজী (সা:) তাঁর ১৩ বছর মক্কায় কাটান। কিন্তু সেখানে তিনি একখানি মসজিদও নির্মাণ করেননি, কোন মাদ্রাসাও গড়েননি। বরং পূর্ণ মনযোগ দিয়েছেন এমন মানুষ গড়ায় যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় ও প্রতিরক্ষায় যোগ্য মোজাহিদ হবে এবং প্রয়োজনে শহীদ হবে। সমগ্র মানব ইতিহাসের এরাই হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। এরাই পরবর্তীতে ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা হয়েছেন। তারা মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ জেনারেল হয়েছেন এবং বিশাল বিশাল প্রদেশের সুযোগ্য গভর্নর, প্রশাসক ও বিচারপতি হয়েছেন। তাদের কারণেই মুসলিমগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আজ মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা গুরুত্ব পেলেও সেরূপ মানব গড়া ও রাষ্ট্র গড়া গুরুত্ব পায়নি। ফলে মুসলিম উম্মাহর কপালে বিজয়ের কোন লক্ষণ নাই।  

বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্র গড়াই হলো নবীজী (সা:)’র জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ার কাজটি এর সমকক্ষ হতে পারে না। হযরত মূসা (সা:)’য়ের জীবনে বড় আফসোস, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি একাজটি করে যেতে পারেননি। কারণ, তার সাহাবাদের ছিল জিহাদে অনাগ্রহ। তাদেরকে শরিয়ত দেয়া হয়েছিল। শরিয়ত পালনের জন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও হুকুম এসেছিল। হযরত মূসা (সা:) যখন তাদেরকে জিহাদে ডাক দিলেন তখন তারা বলেছিল, “হে মূসা, তুমি ও তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ করো। আমরা অপেক্ষায় রইলাম।” ফলে হযরত মূসা (সা:)’র হাতে শরিয়তি বিধান থাকলেও তিনি সে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে খেলাফায়ে রাশেদা গড়ে যেতে পারেননি। ফলে বনি ইসরাইল ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ব শক্তি রূপে খাড়া হতে। বরং তাদের ঘাড়ে আযাব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। উদ্বাস্তুর ন্যায় তাদের ঘুরতে হয়েছে নানা দেশের পথে-প্রান্তরে।

ইসলামী রাষ্ট্রের বিকল্প একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্রই। লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়েও শরিয়ত পালনের কাজটি হয় না। অথচ শরিয়তের পালন ফরজ। যাদের মাঝে শরিয়তী আইনের বিচার নাই তাদেরকে সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ আয়াতে কাফির, জালিম ও ফাসিক বলা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র না থাকায় শরিয়ত পালনসহ পূর্ণ ইসলাম পালনের ফরজটি আদায় হয়না। তাতে ইসলামের প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিমদের ইজ্জতও বাড়ে না। তখন বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠার সুযোগও সৃষ্টি হয় না। তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্র না থাকলে এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নিয়েত না থাকলে জিহাদ সংগঠিত করার প্রেক্ষাপটও সৃষ্টি হয় না। তখন উপেক্ষিত হয় জিহাদের ন্যায় ইসলামের সর্বোচ্চ ইবাদত। মুসলিমদের আজকের পরাজয়ের কারণ বহু। তবে মূল কারণটি মুসলিমদের সংখ্যার কমতি নয়; মসজিদ-মাদ্রাসার কমতিও নয়। বরং সেটি হলো, তারা ব্যর্থ হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রগড়ায়। এবং ব্যর্থ হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রগড়ার জিহাদে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *