পতনমুখী উম্মাহর উত্থান কীরূপে?
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on January 1, 2021
- Bangla Articles, মুসলিম জাহান
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
লেখক পরিচিতি: বিলেতে মেডিসিনের কনসালটেন্ট; গবেষণা নিবন্ধ, পত্রিকার কলাম এবং বইয়ের লেখক; ইন্টার ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সায়েন্টিফিক স্টাডিস অব পপুলিশেন (আই.ইউ.এস.এস.পি)’র ১৯৯৭ সালের চীনের বেইজিংয়ে ও ১৯৯৮ সালে ব্রাজিলে এবং ২০২০ সালের ফেব্রেয়ারীতে ফ্রান্সে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় ও নরম্যান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান ও গবেষণা পেপার পেশ।
শুরু কোত্থেকে?
মুসলিমদের পতন-যাত্রা বহু শত বছর পূর্বে শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। বরং দিন দিন শত্রুদের হাতে পরাজয়ই বাড়ছে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার বহু মুসলিম নগরী মাটির সাথে মিশে গেছে। তেমনি দেশে দেশে মুসলিমগণ নিহত, নির্যাতিত, ধর্ষিতা ও উদ্বাস্তু হচ্ছে। নির্যাতিত ফিলিস্তিনী মুসলিমদের সাথে যোগ হয়েছে ভারতের মুসলিম, চীনের উইঘুর মুসলিম, মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম, কাশ্মিরের মুসলিমের নিদারুণ দুর্দশা। পতনমুখী এ জাতির উত্থান নিয়ে যারা চিন্তিত তাদের প্রশ্ন, এ পতন যাত্রা থামানো যায় কীরূপে? উত্থানের কাজই বা শুরু করতে হবে কোত্থেকে? এ নিয়ে নানা জন নানা মতে বিভক্ত। তবে আশার কথা হলো, অন্য নানা বিষযের ন্যায় এ বিষয়েও নির্ভূল নির্দেশনাটি পাওয়া যায় মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষনা ও নবীজী (সাঃ)’র সূন্নত থেকে। ব্যক্তি ও জাতি গঠনের কাজে নির্ভূল রোড ম্যাপ হলো পবিত্র কোর’আন। একই রূপ পতিত দশায় ছিল আরবের জনগণ। সে কোর’আনী রোড ম্যাপ নিয়ে নবীজী (সাঃ) যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন আমাদেরও জাতি গঠনের কাজ সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। আর সে নির্দেশনাটি হলো ’ইকরা’ তথা ’পড়’ অর্থাৎ জ্ঞানার্জন করো।
“ইকরা” একটি প্রতিকী শব্দ। এর অর্থ: পাঠ করো। পবিত্র কোর’আনের প্রথম শব্দটি ঈমান, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত বা কোন নেক আমল নয়, সেটি “ইকরা”। পড়া বা অধ্যয়ন যেহেতু জ্ঞানার্জনের চাবি, পবিত্র কোরআনের প্রথম শব্দ রূপে এ শব্দটি নির্বাচন করে মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা বুঝি দিয়েছেন মানব জীবনে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব কত অপরিসীম। জ্ঞান দেয় মনের আলো। দেয় নানা পথের ভীড়ে সত্য পথটি চেনার সামর্থ্য। তখন পথহারা মানুষটি পায় হিদায়াত। পায় আলোর পথ। অন্ধকার যেমন আচ্ছন্ন করে রাখে রাতের পৃথিবীকে, অজ্ঞতাও তেমনি আচ্ছন্ন করে মনের ভুবনকে। অজ্ঞতা এভাবেই ব্যক্তির জীবনে আনে সত্যপথ থেকে বিচ্যুতি। এবং অসম্ভব করে জান্নাতের পথে পথচলা। সত্যের তথা ইসলামের বড় শত্রু তাই অজ্ঞতা। অজ্ঞতা না সরিয়ে ইসলামের পথে চলা অসম্ভব। পবিত্র কোর’আনের শুরুটি তাই “ইকরা” তথা পাঠ করো অর্থাৎ জ্ঞানার্জন করো -এ নির্দেশ দিয়ে।
অতি পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমদের ব্যর্থতা যেমন জ্ঞানের গুরুত্ব বুঝায়, তেমনি ব্যর্থতা অজ্ঞতার নাশকতা বুঝায়। সেটি বুঝলে শতভাগ মুসলিম জ্ঞানী তথা আলেম হতো। জ্ঞান ছাড়া যে মুসলিম হওয়া যায় না –সেটিও তখন বুঝতো। অজ্ঞতার আরবী পরিভাষা হলো জাহিলিয়াত। যে কোন মানব সন্তানের জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামতটি যেমন তার জ্ঞান, তেমনি তার জীবনে সবচেয়ে ভয়ানক নাশকতাটি ঘটে অজ্ঞতার কারণে। জ্ঞানের বরকতে মানুষ ফিরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হতে পারে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই হযরত আদম (আ:) ফিরেশতাদের সেজদা পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়েছিলেন। পানাহারারের অভাবে জীবন ব্যর্থ হয় না, সে জন্য কেউ জাহান্নামের আগুনে যাবে না। কিন্তু জাহান্নামে নেয় অজ্ঞতা। মানব জীবনের সব চেয় বড় পাপ তাই অজ্ঞ থাকা। এ পাপ আরো অনেক পাপের জন্ম দেয় এবং অসম্ভব করে ঈমানদার হওয়া এবং পরকালে জান্নাত পাওয়া। রাতের অন্ধকার যেমন শিকার ধরতে সুযোগ করে দেয়, মনের অন্ধকার তেমনি সুযোগ সৃষ্টি করে শয়তানের শিকার ধরায়। শয়তানের মূল হাতিয়ার হলো অজ্ঞতার অন্ধকার, তাই সে মানবকে আলো থেকে অন্ধকারে নেয়। শয়তান জাহিলিয়াতের ফেরী করে ও ফাঁদ পাতে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বুদ্ধিবৃত্তির ন্যায় জীবনের প্রতিটির ক্ষেত্র জুড়ে। সেখান থেকে যাত্রী তুলে জাহান্নামে পথে। তাই মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাটি শুধু বিষাক্ত সাপ বা হিংস্র পশু থেকে বাঁচা নয়, বরং অজ্ঞতা দূর করা এবং শয়তানের ফাঁদগুলো থেকে বাঁচা। সে জন্য চাই জ্ঞান। এবং সে জ্ঞানটি হতে হয় পবিত্র কোর’আনের জ্ঞান। একমাত্র সে জ্ঞানই দেয় ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, শিষ্ঠ-অশিষ্ঠ এবং শ্লিল-অশ্লিল চেনার সামর্থ্য। এবং নেয় অন্ধকার থেকে আলোতে।
শ্রেষ্ঠদান ও সবচেয়ে বড় নাশকতা
পবিত্র কোর’আনে পাকে বলা হয়েছে,‘‘আল্লাহু ওয়ালী উল্লাযীনা আমানু ইয়ুখরিজুহুম মিনাযযুলুমাতি ইলান্নূর।’’- (সুরা বাকারা)। অর্থ: ‘‘যারা ঈমান আনলো, তাদের বন্ধু হলো আল্লাহ; তিনি তাঁদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে আসেন।’’ পবিত্র কোর’আনের এ আয়াতটি মহান আল্লাহতায়ালা গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘোষণা দিয়েছেন। এবং এ বিশেষ ঘোষণাটি একমাত্র ঈমানদারদের জন্য। এ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন নিজেকে পরিচয় করিয়েছেন ঈমানদারদের বন্ধু রূপে। প্রশ্ন হলো, ঈমানদারের জন্য এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আর কি হতে পারে? মহান আল্লাহতায়ালাকে নিজের বন্ধু রূপে পাওয়ার চেয়ে বড় পাওয়াই বা কি হতে পারে? এবং প্রতিশ্রুতি পালনে মহান আল্লাহতায়ালার চেয়ে আর কে শ্রেষ্ঠতর হতে পারেন? তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকার জন্য এ বিশাল মেহেরবানীই কি যথেষ্ট নয়? উক্ত আয়াতে দ্বিতীয় ঘোষণাটি হলো, বন্ধু রূপে মহান আল্লাহতায়ালার বড় দানটি এই যে তিনি ঈমানদারদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসেন। অর্থ দাঁড়ায়, অন্ধকার থেকে আলোতে নেয়ার চেয়ে অধিক উপকার অন্য কিছুতে হতে পারে না। যে আলোর পথ পায়, সেই পায় জান্নাত। উক্ত আয়াতে যে আলোর কথা বলা হয়েছে, সেটি সূর্যের আলো নয়। সেটি মনের আলো তথা জ্ঞান। এবং সেটি কোর’আনের জ্ঞান। সূর্যের আলো তিনি গাছপালা, পশুপাখীসহ সবাইকে দেন। কাফেরদেরও দেন। কিন্তু মনের আলো তথা কোর’আনের জ্ঞান পায় একমাত্র ঈমানদারগণ। এবং এ জ্ঞানই দেয় জীবনের পথ চলায় হিদায়াত। যার জীবনে সে জ্ঞান নাই, তার জীবনে হিদায়েতও নাই। বস্তুত মহান আল্লাাহতয়ালার উপর ঈমান আনার এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিদান। মহান আল্লাহতায়ালার সর্বোত্তম পুরস্কারটি তাই ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি বা উত্তম চেহারা-সুরত নয়, সেটি হলো এই কোর’আনী জ্ঞান।
উপরুক্ত আয়াতে আরেকটি সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। সেটি হলো, বেঈমানদের বন্ধু হলো শয়তান। শয়তান তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। মানব জাতির বিরুদ্ধে এটিই হলো শয়তানের সবচেয়ে বড় নাশকতা। এজন্যই দেখা যায়, যেখানেই বাড়ে শয়তানদের আধিপত্য, সেখানেই বাড়ে অজ্ঞতার গভীরতা। এই অজ্ঞতার কারণেই মুসলিম বিশ্ব জুড়ে প্রবলতর হয়েছে শত্রুশক্তির বিজয় এবং এসেছে শরিয়তের পরাজয়। তাই মহান আল্লাহতায়ালার নিয়ামত প্রাপ্তির বড় আলামতটি হলো জ্ঞানবান হওয়া। অপর দিকে কোর’আনী জ্ঞানে অজ্ঞতা প্রমাণ করে শয়তানের বিজয়। তাই নামে মুসলিম হলেও এমন ব্যক্তির অন্ধকারময় ও দূর্বৃত্তময় জীবন দেখে নিশ্চিত বলা যায়, জ্ঞান, ঈমান ও মহান আল্লাহর বন্ধুত্ব –এরূপ নেয়ামতের কোনটিই তার জীবনে জুটেনি। অথচ এটিই হলো আজকের মুসলিমদের প্রকৃত চিত্র। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া কোর’আনী আলো পেয়ে আরবের নিরক্ষর মুসলিমগণ আজ থেকে ১৪ শত বছর পূর্বে অন্যায়, অসত্য ও অসুন্দরকে সঠিক ভাবে যেমন সনাক্ত করেছিলেন, তেমনি নির্মূলও করেছিলেন। ফলে নিজেদের বাঁচাতে পেরেছিলেন শয়তানের বিছানো ফাঁদ থেকে। সেটিই ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। তাতে তাদের মর্যাদা জুটেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রূপে। অথচ সে সাফল্য মুসলিম নামধারি পন্ডিতদের যেমন জুটছে না, তেমনি জুটছে না পাশ্চাত্যের নবেল প্রাইজ বিজয়ী জ্ঞানীদেরও। ফলে মুসলিমধারি শিক্ষিত বাংলাদেশীরা যেমন দেশকে দূর্নীতিতে বিশ্বের শীর্ষে নিয়ে গেছে, তেমনি পাশ্চাত্যের শিক্ষিতরাও ব্যভিচার, ফ্রি-সেক্স, হোমোসেক্সুয়ালিটি, মদপানের ন্যায় আদিম পাপাচারকে সভ্য আচার রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
অজ্ঞতায় অসম্ভব হয় ইবাদত
জ্ঞানার্জন ছাড়া অন্য ফরজগুলোও যথাযত পালিত হয় না। ইসলাম খৃষ্টান ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের ন্যায় নয় যে গীর্জার যাযক বা মন্দিরের ঠাকুরকে দিয়ে বন্দেগী করিয়ে নেয়া যায়। ইবাদতের দায়িত্ব একান্তই ব্যক্তির নিজের, কাউকে দিয়ে এ দায়িত্ব পালন হওয়ার নয়। তাই ইসলামের খলিফাকেও প্রজার ন্যায় একই ভাবে নামাজ, রোযা, হজ্ব ও অন্য ইবাদত করতে হয়েছে। অজ্ঞতা নিয়ে ইবাদত হয় না, ইবাদতের সামর্থ্য অর্জনে জ্ঞানার্জন অপরিহার্য। অন্য ধর্মে বিদ্যাশিক্ষা ফরজ নয়। অন্য ধর্মগুলি যে কতটা ভ্রান্ত -সেটি বুঝা যায় জ্ঞানার্জনের বিষয়টি গুরুত্ব না দেয়া থেকে। কারণ জ্ঞান না বাড়িয়ে কি মানুষ গড়া যায়? এক্ষেত্রে ইসলাম য সর্বশ্রেষ্ঠ ও অনন্য -সেটি বুঝা যায় জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা থেকে। ইসলাম জ্ঞানার্জনক বাধ্যতামূলক করেছে নামায-রোযার ফরজ হওয়ার প্রায় ১১ বছর আগে। তবে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য শুধু পড়া, লেখা বা হিসাব নিকাশের সামর্থ্য বৃদ্ধি নয়, বরং মনের অন্ধকার দূর করা। ব্যক্তির দেখবার ও ভাববার সামর্থ্যে সমৃদ্ধি আনা।
মনের অন্ধকার নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার কুদরতকে দেখা যায় না। দেখা যায় না তাঁর মহান সৃষ্টিরহস্যকেও। জাহেল ব্যক্তির আচরন তাই অজ্ঞের ন্যায়। আল্লাহর অসীম সৃষ্টি জগতের মাঝে বসেও তাঁর অস্তিত্বকে সে অস্বীকার করে। জাহলে ব্যক্তির ইবাদতে তাই মনের সংযোগ থাকে না। ইসলাম মানব মনের এ অন্ধকার দূর করতে চায়, সদা জাগ্রত রাখতে চায় আল্লাহ-সচেতনতা তথা তাকওয়া। মানব কল্যাণে এটিই হলো শ্রেষ্ঠ নেক কর্ম। মানব রূপে বেড়ে উঠার জন্য এর বিকল্প নেই। জ্ঞানার্জন ইসলামে নিজেই কোন লক্ষ্য নয়, বরং এটি লক্ষ্যে পৌঁছবার মাধ্যম মাত্র। আর লক্ষ্যটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা পালনে নিজেকে লাগাতর যোগ্যতর করা। লক্ষ্য, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। এটিই তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। চালক যেমন গাড়ী চালনায় সর্বপ্রথম গন্তব্যস্থলকে জেনে নেয় এবং রোডম্যাপ মেনে গাড়ি চালায়, একজন মুসলিমকেও তেমনি সঠিক রোডম্যাপকে জানতে চায় এবং সে রোডম্যাপ অনুসরণ করতে হয়। নইলে অসম্ভব হয় জান্নাতে বা মহান আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্যে পৌঁছা। গাড়ি চালনায় গাড়ির মান ও গতিই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার চেয়েও অধিক গুরুত্পূর্ণ হলো পথটি সঠিক কিনা –সেটি। বিজ্ঞানের বৈপ্লবিক অগ্রগতির পরও অসংখ্য মানব যে আজ সীমাহীন বিভ্রান্তির শিকার তার মূল কারণ, সে রোডম্যাপ নিয়ে অজ্ঞতা। জীবন চালনায় বিশুদ্ধ রোড-ম্যাপটি বিদ্যমান একমাত্র পবিত্র কোর’আনে। মানব জাতির জন্য এটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। এ দিক দিয়ে মুসলিমরাই সবচেয়ে ভাগ্যবান। এবং মানব জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো এ রোডম্যাপের জ্ঞানার্জন। বিষয়টি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে এখানে ভূল হলে বা অবহেলা হলে অনিবার্য হয় পরকালে জাহান্নামে পৌঁছা। দুনিয়ার জীবনও তখন ব্যর্থতায় ভরে উঠে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন তো তখনই রোগমুক্তি ঘটায় যখন সেটি মেনে ঔষধ খাওয়া হয়। ফলে না বুঝে তেলাওয়াতে বা মুখস্থ্য করায় কোর’আন থেকে জ্ঞান লাভের কাজটি যেমন হয় না, তেমনি হয়না কোর’আন মেনে জীবন চালানোর কাজটিও। তখন প্রচণ্ড বেঈমানী ঘটে মহান আল্লাহতায়ালার এই শ্রেষ্ঠ নেয়ামতটির সাথে। এবং সে বেঈমানী তখন ভয়ানক আযাব নামিয়ে আনে। মুসলিম বিশ্বকে তো সে আযাবই ঘিরে ধরেছে।
ইসলামে জ্ঞানের অর্থ এ নয়, তাতে শুধু উপার্জনের সামর্থ্য বাড়বে বা কলাকৌশলে দক্ষতা বাড়বে। জ্ঞানের মোদ্দা কথাটি হলো, তাতে সৃষ্টি হতে হবে মহান আল্লাহতায়ালার ভয়। যে জ্ঞান ব্যক্তির মনে মহান আল্লাহতায়ালার ভয় সৃষ্টিতে ব্যর্থ -সে জ্ঞান জ্ঞানই নয়। সেটি জ্ঞানের লেবাসে আরেক অজ্ঞতা তথা জাহিলিয়াত। মহান আল্লাহতায়ালা কোরআন মজিদে বলেছেন একমাত্র জ্ঞানীরাই আমাকে ভয় করে। এ থেকে বুঝা যায়, মহান আল্লাহপাক জ্ঞান বলতে কি বুঝাতে চান। যার মধ্যে আল্লাহর ভয় নেই, তার মধ্যে ইলমও নেই। কোরআন মজীদের অন্যত্র বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টি ও রাত-দিনের ঘুর্ণায়নের মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” অর্থাৎ বিশ্ব চরাচর হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিশাল গ্রন্থ। এ গ্রন্থ্যের প্রতিটি ছত্রে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আয়াত বা নিদর্শন। জ্ঞানী তো তারাই যারা সে গ্রন্থ থেকে শিক্ষা লাভের সামর্থ্য রাখে। এ সামর্থ্য না থাকাটিই মানব মনের সবচেয়ে বড় পঙ্গুত্ব -যা অসম্ভব করে মানবিক গুণে বেড়ে উঠাটি। এ সামর্থ্য না থাকলে সিরাতুল মোস্তাকীমে চলতে আল্লাহতায়ালার আয়াতগুলো নানা প্রান্তর থেকে যে সিগনাল দেয় -তা বুঝতে সে ব্যর্থ হয়। তখন বিজ্ঞানী হয়েও মামূলী বিষয়ে বিশাল ভূল করে।
বিশ্বের কোন জ্ঞানই কোরআনী জ্ঞানের সমকক্ষ হওয়া দুরে থাক, তুলনীয়ও হতে পারে না। কারণ, বিশুদ্ধ জ্ঞানের উৎপাদনে মানুষের সামর্থ্য অতি সামান্য। যত বড় জ্ঞানী বা বিজ্ঞানীই হোক, সে ব্যক্তি নিজেই জানে না আগামী কাল সে বাঁচবে কি বাঁচবে না। দেয়ালের ওপারে কি আছে সেটি জানার সামর্থ্য তার নাই। সে সীমিত জ্ঞান নিয়ে তখন ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার সংজ্ঞা খুঁজতেই হিমসিম খেতে হয়। ফলে ব্যর্থ হয় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা দিতে। সম্পদে নারীদের বঞ্চিত করা, কৃষ্ণাঙ্গদের পশুর ন্যায় হাটে তোলা, রেড-ইন্ডিয়ানদের নির্মূল করা, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার ন্যায় অসভ্যতাগুলি তো হয়েছে তো সে আদিম অজ্ঞতার কারণেই। অথচ ইসলাম ১৪ শত পূর্বেই সে অসভ্যতার দাফন করেছে। ধর্মবিবর্জিত যে শিক্ষার কারণে পাশ্চাত্য-সমাজ আজ বিপর্যয়ের মুখে। অথচ সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় মুসলিমগণও আজ সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ফলে বিপর্যয় তাদেরও ধাওয়া করছে। ফলে উত্থানের বদলে দিন দিন বাড়ছে তাদের পতন-যাত্রায় গতি।
বিজয় যে পথে আসে
বিজয়ের পথ খুঁজে পেতে হলে অবশ্যই দেখতে হবে, মুসলিমদের বিস্ময়কর অতীত সফলতার মূলে কি ছিল –সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। ইতিহাসের মূল্য অপরিসীম। বস্তুত জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো ইতিহাস বিজ্ঞান। বিজয়ের ইতিহাস নির্মাণে রক্ত, অর্থ, শ্রম, মেধা ও সময়ের ব্যয়গুলি বিশাল। যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় তারা বাঁচে সে বিশাল খরচ থেকে। বাঁচে একই ভূল বার বার করা থেকে। তাই মুসলিমদের বিজয়ের অতীত ইতিহাসই দিতে পারে বিজয়ের পথ চলার সঠিক নির্দেশনা। কিন্তু সমস্যা হলো, নিজেদের সে ইতিহাস পাঠে মুসলিমদের আগ্রহ সামান্যই। তারা বহু কিছুই শিখছে; মুসলিম দেশগুলো ভরে উঠছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু তারা শিখছে না সে গৌরবোজ্জল ইতিহাস থেকে। ফলে তাদের জানাই হয়নি চলমান পতন-যাত্রা থেকে উদ্ধারের পরিক্ষিত পথটি।
অথচ ইতিহাসের পাঠ কোন জটিল রকেট সায়েন্স নয়। বরং ইতিহাসের পাঠ অতি সহজ। মোটা দাগে ও চোখ আঙ্গুল দিয়ে ইতিহাস তার শিক্ষনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরে। সেগুলো বুঝবার জন্য বিশাল ডিগ্রীধারী, বড় মাপের জ্ঞানী বা আল্লামা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শুধু চাই সুস্থ্য বিবেক, চিন্তার সামর্থ্য ও শিক্ষা লাভে গভীর আগ্রহ। তখন সাধারণ মানুষও তা বুঝতে পারে এবং তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। মুসলিমদের অতীত বিজয় ও গর্বের মূলে ছিল মাত্র তিনটি বিষয়। এক). পবিত্র কোর’আনের পূর্ণ অনুসরণ। রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিচার-আচারে রোডম্যাপ রূপে গ্রহণ করেছিলেন তারা কোর’আনী বিধানকে। বাস্তবতা হলো, কোর’আন ছাড়া তাদের সামনে সে সময় আর কোন কিতাবই ছিল না। দুই). একতা। ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল ও গোত্র-ভিত্তিক চেতনার উর্দ্ধে উঠে তারা গড়েছিলেন প্যান-ইসলামিক একতার সংস্কৃতি। ফলে আরব, ইরানী, কুর্দ, তুর্ক, মুর ইত্যাদি নানা পরিচয়ের মানুষ সেদিন এক কাতারে এবং একই লক্ষ্যে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তারা বিভ্ক্ত হননি। জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, সেক্যুলারিজমের ন্যায় ভ্রষ্ট মতবাদ তাদের মগজে তখন স্থান পায়নি। তিন). জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ তথা মহান আল্লাহতায়ালার রাস্তায় জিহাদ। সে সময় জিহাদ ভিন্ন তাদের জীবনে আর কোন যুদ্ধই ছিল না। তারা নিজেদের সমুদয় সামর্থ্যের বিনিয়োগ করেছিলেন মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার লক্ষ্যে। সে পথে শহীদ হওয়াকে তারা জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন মনে করতেন। জনগণের মাঝে সে জিহাদী চেতনার কারণে মুসলিম রাষ্ট্র পেয়েছিল অপ্রতিরোধ্য প্রতিরক্ষা ক্ষমতা। সে পবিত্র চেতনায় প্রতিটি নাগরিক পরিণত হয়েছিল সৈন্যে এবং সমগ্র দেশ পরিণত হয়েছিল সেনানীবাসে।
আজও চলমান পতন-যাত্রা থেকে মুক্তি ও বিজয়ের পথে এগোনের এ ছাড়া ভিন্ন পথ আছে কি? সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে তাদের সে পথই তো একমাত্র পরিক্ষিত পথ। আরো লক্ষনীয় হলো, কোর’আনের জ্ঞানার্জন, সীসা-ঢালা একতা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ – এ তিনটি বিষয়ই প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ। পবিত্র কোর’আনের সাথে গাদ্দারী করে কেউ যেমন মুসলিম থাকে না। তেমন মুসলিম থাকে একতা ও জিহাদের সাথে গাদ্দারী করেও। একমাত্র অনৈক্যের কারণেই যে মুসলিমদের উপর ভয়ানক আযাব নেমে আসে -সে সুস্পষ্ট হুশিয়ারিটি এসেছে সুরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। মুসলিমদের আজকের পরাজয়ের মূল কারণ, উপরুক্ত তিনটি ফরজ পালন থেকে তারা দূরে সরেছে। বরং চলছে উল্টো পথে। তারা যেমন দূরে সরেছে পবিত্র কোর’আনের জ্ঞান থেকে, তেমনি ধাবিত হয়েছে অনৈক্যের পথে। এবং জিহাদ বিলুপ্ত হয়েছে তাদে জীবন থেকে। ঐক্যের বদলে তারা গড়েছে ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিত্তিক অনৈক্য। মুসলিম বিশ্ব আজ ৫৭ টুকরায় বিভক্ত। অথচ গৌরবকালে তাদের ছিল এক অখন্ড ভূগোল। তারা আজ রক্ত দেয়, অর্থ দেয় ও মেধা দেয় নিজেদের ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা অঞ্চলের নাম বড় করতে, আল্লাহতায়ালার নাম বড় করতে বা তাঁর দ্বীনের বিজয় আনতে নয়। ফলে তারা যে পথ ধরেছে -তা তো বহু পরিক্ষিত পরাজয়ের পথ। এ পথ জাহান্নামের পথও। ইসলামের বিজয় নিয়ে যাদের সামান্যতম ভাবনা আছে এবং যারা বাঁচে মহান আল্লাহকে খুশি করার ভাবনা নিয়ে এবং চায় জান্নাত -তারা কি কখনো এ পথ বেছে নিতে পারে? ১ম সংস্করন ২৭/০৫/২০০৭; ২য় সংস্করন ০১/০১/২০২১
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018