পতন ও পচনের শুরুটি শিক্ষাঙ্গণ থেকে

ফিরোজ মাহবুব কামাল

চলছে অবিরাম আত্মঘাত

বাংলাদেশের ব্যর্থতা নিয়ে বিতর্ক নেই। শয্যাশায়ী রোগীর গায়ে যখন পচন ধরে এবং সে পচন যখন দুর্গন্ধ ছড়ায় -সে রোগ তখন শুধু ঘরের লোকই নয়, প্রতিবেশীও টের পায়। বাংলাদেশের বেলায় সেটিই ঘটেছে। দেশটির পচন মূলত নৈতিক। সে নৈতিক পচনের বড় আলামত হলো চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, ব্যাংক ডাকাতি, গুম, ঘুষ, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের প্লাবনে ভাসা বাংলাদেশ। এ শতাব্দীর শুরুতে দেশটি বিশ্বরেকর্ড গড়েছে দুর্নীতিতে ৫ বার প্রথম হয়ে। কিন্তু এ ব্যর্থতা ক’জন বাংলাদেশীকে ভাবায়? নানা দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নের মডেল রূপে যেখানে আলোচিত হয় জাপান, কোরিয়া বা সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশ সেখানে দূর্নীতিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ার মডেল। দূর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশের পরিচিতি আজ বিশ্বময়। কিছুকাল আগে (ফেব্রেয়ারী, ২০২১) টি.ভি চ্যানেল আল-জাজিরা প্রামাণ্য দলিল পেশ করে, দুর্বৃত্ত প্রতিপালনে কীরূপ সচেষ্ট দেশটির প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী প্রধান। প্রতিবেদনে দেখানো হয়, খুনের অপরাধে দন্ডপ্রাপ্ত আসামীকেও কীরূপে দেশের কারাগার থেকে প্রেসিডেন্টের সুপারিশে বের করা হয়। দেখায়, দেশটিতে খুনির ভাই এবং একটি অপরাধী পরিবারের সদস্য কীরূপে সেনাবাহিনীর প্রধান  হয়। এবং সে সেনাপ্রধান কীরূপে খুনের আসামীকে দেশ থেকে পালাতে সাহায্য করে। এবং আরো দেখানো হয়, খুনের আসামীকে দেশের পুলিশ খুঁজে না পেলে কি হবে, দেশটির রাজধানীর অভিজাত মহলে প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনীর প্রধানের সাথে সেই পলাতক অপরাধী বিয়ের আসরে ফুর্তি করে। অতিশয় বিশাল দেহ হয়েও ডায়নোসর যেমন বিশ্ব থেকে হারিয়ে গিয়ে ইতিহাস গড়েছে, তেমনি বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের বিশাল জনগোষ্ঠি ইতিহাস গড়েছে সভ্য নীতি-নৈতিকতার অঙ্গণ থেকে হারিয়ে গিয়ে। দেশটি সবচেয়ে তলায় নেমেছে এ শতাব্দীর শুরুতে দূর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়ে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন এতো ব্যর্থতা? কোথা থেকে উঠে এসেছে জঘন্য দুর্বৃত্ত চরিত্রের এ অপরাধীগণ। এরা গহীন জঙ্গল, ডাকাতপাড়া বা পতিতাপল্লীর ফসল নয়, এরা ফসল বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের। অনেকেই ভাবেন এ ব্যর্থতার মূল কারণ বিশাল জনসংখ্যা। অনেকে মনে করে, এসবের কারণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক। বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও বুদ্ধিবৃত্তি যাদের দখলে তারাই এরূপ বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলে। তারা এসব মিথ্যা বলে নিছক শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা আড়াল করতে। চায়, মূল সমস্যা থেকে জনগণের মনযোগ সরাতে। এভাবেই শিক্ষাঙ্গণের ব্যর্থতাকে তারা আরো গভীরতর করে। প্রশ্ন হলো, জনসংখ্যাবৃদ্ধিকে সমস্যা মনে করা কি ইসলামে জায়েজ? এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ মুসলিমের ঈমান শুধু হালাল পানাহারে বাঁচে না, ধ্যান-ধারণা ও দর্শনকেও এজন্য হালাল হতে হয়। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রশ্নটি নিছক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজনীতির বিষয় নয়, এটি অতি আক্বিদাগত বিষয়ও। এর সাথে জড়িত মুসলিম থাকা না থাকার প্রশ্ন। কারণ হারাম তথা অসিদ্ধ আক্বিদা নিয়ে তো মুসলিম হওয়া যায় না।  

মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তথা আশরাফুল মাখলুকাত হলো মানুষ; হিরক, মনিমুক্তা,সোনা-রূপা, তেল-গ্যাস বা অন্য কোন জীবজন্তু নয়। মানুষ শুধু শ্রেষ্ঠ-সৃষ্টিই নয়, বরং সে হলো এ পৃথিবী পৃষ্ঠে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত খলিফা। সে মর্যাদা ফেরেশতাদের দেয়া হয়নি। শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করলে খলিফার কাজটি হয় না। মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে মূল দায়ভারটি হলো সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে একমাত্র তাঁরই সার্বভৌমত্ব ও তাঁর দেয়া আইনের প্রতিষ্ঠা দেয়া। ইসলামী পরিভাষায় সে আইন হলো শরিয়তী আইন। মুসলিম হওয়ার অর্থ হলো আমৃত্যু  সে দায়ভার পালনের তাড়না নিয়ে বাঁচা। সে দায়ভার কারো দ্বারা পালিত না হলে বুঝতে হবে সে আর আল্লাহর খলিফা নয়; সে পরিণত হয়েছে শয়তানের খলিফায়। মুসলিম দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাজটি হলো ছাত্র-ছাত্রীদের আল্লাহতায়ালার খলিফায় পরিণত করা। অপরদিকে সেক্যুলার বা অনৈসলামিক শিক্ষাব্যবস্থার কাজ হয় ছাত্র-ছাত্রীদের আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করা  তথা তাদেরকে শয়তানের খলিফায় পরিণত করা। এবং শয়তানের খলিফাগণ যে দেশের রাজনীতিতে বিজয়ী হয় সে দেশে শাসনতন্ত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব যেমন বাঁচে না, তেমনি আদালতে বাঁচে না আল্লাহর আইন। তখন প্রতিষ্ঠা পায় শাসকের বা পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ও বিচার হয় মানুষের তৈরী আইনে। বাংলাদেশে তো সেটিই হয়েছে। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের আমলে কি এটি ভাবা যেত? বাংলাদেশের মুসলিমগণ যে নবীজী (সা:)‌’র ইসলাম নিয়ে বাঁচে না -এটি হলো তারই প্রমাণ। ব্যর্থতা এখানে শিক্ষাব্যবস্থার। দেশটির শিক্ষাব্যবস্থার কাজ হলো, আল্লাহতায়ালার শত্রু উৎপাদন ও তাদের প্রতিপালন দেয়া। এবং সে শত্রুদের কাজ হলো বাংলাদেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ইসলামে পরাজিত রাখা। এজন্যই তাদের বিরামহীন যুদ্ধটি ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে।

শিক্ষাঙ্গণে অতি গুরুতর অপরাধটি হচ্ছে অন্য আরেকটি ক্ষেত্রে। সেটি হচ্ছে ইসলামের মূল শিক্ষা নিয়ে অজ্ঞতাকে বাঁচিয়ে রাখা ও সেটিকে পরিচর্যা দেয়ার মধ্য দিয়ে। কোন শিল্পির শ্রেষ্ঠ শিল্পকে তুচ্ছ বলার অর্থ সে শিল্পির অবমাননা। তেমনি মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবকে আপদ বললে প্রচণ্ড অবমাননা হয় মহান আল্লাহতায়ালার। তাতে হেয় করা হয় তার মহান কুদরত ও হিকমতকে। এ অবমাননার অপরাধটি হচ্ছে তাদের দ্বারা যারা জনসংখ্যাকে বাংলাদেশের সকল সমস্যার মূল কারণ মনে করে। এদের যুদ্ধটি জনসংখ্যা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে। সে যুদ্ধে মায়ের পেটে নিহত হচ্ছে কোটি কোটি মানব শিশু তাদের জন্মের আগেই। তাই অপরাধ হচ্ছে দুটি ক্ষেত্র। এক). আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির প্রতি অবমাননার; দুই). ভ্রুণ হত্যার নামে বিশাল গণহত্যার। ভয়ানক আযার নামিয়ে আনার জন্য কি এ দুটি অপরাধই যথেষ্ট নয়? নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করে কি সে গোনাহ থেকে মুক্তি মেলে? তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির প্রতি এমন অবজ্ঞা ও তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়ে কি কোন মুসলিম আল্লাহতায়ালার রহমত পেতে পারে? এমন নৃশংস পাচাচার ঈমানের মৃত্যু এবং বিবেকের পচনেই সম্ভব, সুস্থ্যতায় নয়। সে পচনে মুসলিমগণ যে বহুদূর এগিয়েছে -সে প্রমাণই কি কম? এ পচনের কারণে সূদ-ঘুষ-দূর্নীতির ন্যায় হারাম কর্ম বাংলাদেশে আচারে পরিণত হয়েছে। পাপকে বৈধতা দিয়ে পতিতাপল্লী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং সে পাপের আইনগণ বৈধতাও দেয়া হয়েছে। এ বিশ্বের বুকে বহু জাতিই মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নানারূপ কদর্য ইতিহাস গড়েছে। সূদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, উলঙ্গতা,পতিতাবৃত্তি, ব্যাভিচার, সমকামিতার ন্যায় বহুবিধ পাপকে তারা বৈধতা দিয়েছে। বাংলাদেশীরা অনুসরণ করছে তাদেরকেই; নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের নয়।   

বাংলাদেশের সেক্য়ুলার সরকার জনগণের জানমাল, ইজ্জত-আবুরু ও স্বাধীনতার সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলে কি হবে, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয় পতিতাবৃত্তির ন্যায় ব্যভিচারের পাহারাদারীতে। ফলে ব্যভিচার, ধর্ষণ, গণধর্ষন উপচে পড়েছে জনপদে। পকেটমার গণপিটুতি মারা পড়লে কি হবে, পাপের ব্যবাসায়ী ব্যভিচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নাই। গবাদি পশুকে আপদ ভাবা হয় না; বরং সবাই চায় গবাদী পশুর বংশ-বিস্তার। কিন্তু সে মর্যাদা মানব সন্তানদের নেই। ফলে লক্ষ লক্ষ মানব শিশুকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা জন্মানোর আগেই। এভাবে গর্ভপাতের নামে দেশজুড়ে চলছে নীরব গণহত্যা। দেশী-বিদেশী অর্থে অসংখ্য এনজিও কর্মী একাজে নৃশংস খুনীর বেশে নেমেছে দেশের গ্রাম-গঞ্জে। ইউরোপ ও আমেরিকার অমুসলিম দেশেগুলিতেও গর্ভপাতের নামে এরূপ মানবহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। আন্দোলনও হয়। গর্ভপাত ঘটালে বহুদেশে মায়ের বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যামামলা করে এবং আদালতে গুরুতর শাস্তি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেসব নাই। বরং বাংলাদেশ গর্ভপাত ঘটানো হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে। এর পিছেন রয়েছে সরকারি পরিকল্পনা ও অর্থবিনিয়োগ। দেশের মুসলিম জনগণ, মসজিদের ইমাম, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এরূপ গণহত্যার কথা জেনেও না জানার ভান করে। বরং এভাবে জনসংখ্যা কমানোতে অনেকেই খুশি। সরকার বিশ্বময় এটিকে তাদের সফলতা বলে প্রচার করছে। ফলে জন্ম নিচ্ছে না মায়ের পেটে জন্ম নেওয়া শিশুদের বাঁচানোর পক্ষে আন্দোলন। এমন মৃত বিবেক ও বিকৃত চেতনার ফলে মানুষ হারিয়েছে তার নিজের মূল্যমান। শিশুহত্যার পাশাপাশি খুনীদের হাত পড়ছে এখন জীবিতদের গলায়ও। ফলে বেড়ে চলেছে হত্যা, ধর্ষণ ও সন্ত্রাস। আগুন  দেওয়া হচ্ছে যাত্রীভর্তি বাসে। ধর্ষণেও উৎসব হচ্ছে। মানুষ বিবস্ত্র, লাঞ্ছিত ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রকাশ্য রাজপথে-যেমন হরতাল কালে  রাজনৈতিক ক্যাডারদের হাতে হয়েছে।

 

মূল কারণটি জাহেলিয়াত                  

দারিদ্র্য তথা সম্পদের অভাবকে যারা মানবের সকল ব্যর্থতার কারণ বলেন, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রান্তিও কি কম? তাদের কথা, অভাব থেকেই স্বভাব নষ্ট হয়। অথচ বাংলাদেশে সবচেয়ে নষ্ট চরিত্র ও সবচেয়ে নষ্ট স্বভাব হলো তাদের যারা ধনী। দেশের অধিকাংশ ঘুষখোর, সূদখোর, দুর্বৃ্ত্ত, সন্ত্রাসী, ব্যভিচারী, দুর্নীতিপরায়ন রাজনীতিক, ঋণখেলাফী, মদখোর, ড্রাগব্যবসায়ী এসেছে ধনীদের মধ্য থেকে। অথচ তাদের আশেপাশে বহু অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি স্বভাব-চরিত্রে অতি উত্তম দৃষ্টান্ত রাখছে। কথা হলো, দর্শন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির অঙ্গণে যারা কর্মহীন বা সৃষ্টিহীন -তারা কি কখনো সম্পদ সৃষ্টি করে? বরং আনে দারিদ্র্য। এরূপ সৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা যে দেশে অধিক সেদেশের মানুষ দারিদ্যে ভোগে। বুঝতে হবে, সম্পদ মানুষের সৃষ্টি এবং সম্পদের সৃষ্টিতে চাই সৃষ্টিশীল সভ্য মানুষ। এমন মানুষ গড়ে উঠে শুধু দেহের গুণে নয়, মনের গুণে। আর এমন মানবিক গুণে বেড়ে উঠার জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও সঠিক দর্শন। অশিক্ষা, অপসংস্কৃতি ও দূর্নীতি একটি জনগোষ্টিকে শুধু সৃষ্টিহীনই করে না, অনাসৃষ্টিপূর্ণ দুর্বৃত্ত রূপে গড়ে তুলে। দারিদ্র্য ও দূর্ভিক্ষ এমন দেশের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বেলায় সেটিই হয়েছে।

বাংলাদেশের দারিদ্র্যের জন্ম জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা থেকে। জনসংখ্যা থেকেও নয়; ক্ষুদ্র ভূগোল থেকেও নয়। বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র দেশ হলো সিঙ্গাপুর। আয়তন মাত্র ২৪০ বর্গ মাইল। জনসংখ্যা ৫৭ লাখ। আয়তনে ও লোকসংখ্যায় ঢাকা শহরের অর্ধেকের চেয়েও কম। প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশের চেয়ে অধিক। অথচ দেশটির বাৎসরিক বৈদেশিক রফতানি ৩৯০.৩ বিলিয়ন ডলার (২০১৯ সালের পরিসংখ্যান মতে)। অথচ ২০১৯ সালে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের মোটি বৈদেশিক রফতানি ছিল মাত্র ৪৬.৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের জনসংখ্যা সিঙ্গাপুরের তূলনায় প্রায় ৩০ গুণ। অথচ সিঙ্গাপুরের রফতানি বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৮ গুণ অধিক। সোনার খনি বা তেলের খনি নিয়ে সিঙ্গাপুর এ অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেনি। বরং এ সাফল্য এনেছে দেশটির সৃষ্টিশীল মানুষ। মানুষকে তারা আপদ ভাবেনি বরং সোনার বা তেলের খনির চেয়েও মহামূল্যবান ভেবে তাদের উন্নয়নে মনযোগী হয়েছে। ফলে সিঙ্গাপুরের একজন নাগরিকের যে উৎপাদন ক্ষমতা তা বাংলাদেশের বহু শত মানুষের মধ্যেও সৃষ্টি হয়নি।

 

অভাব দর্শন বা ফিলোসফির 

বাংলাদেশের অভাব মূলত দর্শন বা ফিলোসফিতে। একটি দেশের অগ্রগতি বা বিজয় শুরু হয় দর্শন থেকেই। খাদ্য যেমন দেহের শক্তি বাড়ায়, দর্শন তেমনি মনের শক্তি বাড়ায়। মানুষ সৃষ্টিশীল হয় তো মনের শক্তির কারণেই, দেহের শক্তির কারণে নয়। তাই যারা দেশ গড়তে চায় তারা মানুষের বিশ্বাসে বা দর্শনে হাত দেয়। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিস্কার হলো পারমানবিক শক্তি। সে  শক্তি বলে আলোকিত হয় কিছূ শহর, চালিত হয় কিছু কলকারখানা, জাহাজ বা সাবমেরিন। অথচ দর্শন আলোকিত করে এবং পাল্টে দেয় কোটি কোটি মানুষের মনের জগত। পাল্টে দিতে পারে বিশ্বের মানচিত্র। এক্ষেত্রে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পেশ করেছে ইসলাম। ইসলামের আগমনে আরবের ভূগোলে বা জলবায়ুতে পরিবর্তন আসেনি। মাটির তলায় সোনার খনি বা তেলের খনিও আবিস্কৃত হয়নি। পরিবর্তন আসেনি মানুষের দৈহিক আকার-আকৃতি বা অবয়বে। বরং বিপ্লব এসেছিল তাদের জীবন দর্শনে। পরিবর্তন এসেছিল চিন্তার মডেলে। সে পরিবর্তনের ফলে জীবন ও জগত নিয়ে মানুষের ধ্যান-ধারণাই পাল্টে যায়। পরিবর্তন আসে তাদের কর্মে ও আচরণে। সে পরিবর্তনের পথ ধরে পাল্টে গিযেছিল মধপ্রাচ্যের ভূগোল, ভাষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি তথা সবকিছূ। দর্শনের বলেই নিঃস্ব আরবেরা বিশ্বের সুপার পাওয়ারে পরিণত হয়েছিল।

ইসলামের পূর্বে আরবের মানুষ ভাবতো জীবনের শুরু ও শেষ ইহলোকেই, পরকাল বা রোজহাশরের বিচার বলে কিছু নেই। ভাবতো, মৃত্যুর পর তাদের হাড্ডি-মাংস মাটিতে মিশে যাবে এবং চিরতরে ধুলায় হারিয়ে যাবে। ফলে তারা তাদের সকল প্রচেষ্টা ও মেধা নিয়োজিত করতো এ দুনিয়ার জীবনকে আনন্দময় করতে। বাংলাদেশে আজ যারা ঘুষ খায়, সূদ খায়, ব্যভিচারি করে বা গর্ভপাত ঘটিয়ে নিজ সন্তান হত্যা করে -তাদের মত তারাও সেদিন সন্ত্রাস করতো, মদ খেতো ও ব্যভিচারি করতো। এমনকি নিজ সন্তানদেরকেও জীবন্ত করব দিত। যে দর্শনটি আরবদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তার মূল উপাদানটি ছিল মানব জীবনের সঠিক পরিচিতির জ্ঞান। কোথায় এ জীবনের শেষ ও অন্তহীন ঠিকানা তা নিয়ে সম্যক ধারণা। তাদের চেতনায় কাজ করেছিল পরকালের ভয়। পরকালের ভয় তাদের চেতনা ও চরিত্রে আনে আমূল বিপ্লব। সে আমলে গ্রহ-নক্ষত্রের পরিচয় না জানলেও তারা নিজ জীবনের পরিচয় ও পরিণতিকে জেনেছিলেন অতি সঠিক ভাবেই। এবং সেটি জেনেছিলেন সেই মহান সত্ত্বা থেকে যিনি স্বয়ং এ জীবন ও জগতের স্রষ্টা। জেনেছিলেন তাঁর প্রেরীত মহান নবী (সা:) থেকে। প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের সাফল্যের মূল কারণ, মহান আল্লাহতায়ালা থেকে প্রাপ্ত কুর’আনী জ্ঞান -যা তাদের মুক্তি দিয়েছিল জাহলিয়াত থেকে এবং দেখিয়েছিল আলোকিত পথ। উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণ কি এছাড়া সম্ভব? মুসলিম দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল দায়িত্ব হলো সে দর্শন ও পথের সাথে ছাত্রদের পরিচিত করিয়ে দেয়া। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টিকেই পরিকল্পিত ভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। তাই বাঙালি মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করছে এই শিক্ষানীতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *