প্রসঙ্গ ঈমানশূণ্যতা ও জিহাদশূণ্যতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on December 4, 2020
- Bangla Articles, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
যে পরীক্ষা থেকে পলায়নের পথ নেই
এ বিশ্বজগতে কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র। এ পৃথিবী পৃষ্ঠ জুড়ে শত শত পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, নদ-নদী, মাঠঘাট, বৃক্ষরাজী¸ জীবজন্তু ও মানবসৃষ্টি। কিন্তু এগুলিই মহান আল্লাহতায়ালার একমাত্র কুদরত নয়। এর চেয়েও বিস্ময়কর কুদরত অপেক্ষা করছে আখেরাতে। আজকের নশ্বর মানুষ সেদিন অবিনশ্বরে পরিণত হবে। মৃত্যু আর কোন কালই তাদের জীবনে আসবে না। সেখানে রয়েছে জান্নাত –যা মাঠঘাট, ফলমূল, খাদ্য-পানীয়, নদ-নদী ও নানাবিধ সামগ্রী দিয়ে সাজানো। সেখানে অভাবেরই অভাব। পার্থিব জীবনের কোন সুখের মুহুর্তের জান্নাতের সুখের সাথে তূলনীয় নয়। মহাসমুদ্রের বিশাল জলরাশীর সাথে এ বিন্দু পানির তূলনা চলে, কিন্তু জান্নাতের যে বিশাল প্রাপ্তির তার সাথে দুনিয়ার কোন বিশাল অর্জনেরও কি তূলনা চলে? মানব জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনটি তাই জান্নাতপ্রাপ্তি। এবং সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হলো জাহান্নামের বাসিন্দা হওয়া। জাহান্নাম রয়েছে শুধু আযাব আর আযাব। জাহান্নামের সে আযাবের সাথে দুনিয়ার দুঃখ-যাতনা -তা যত তীব্রই হোক, তার তূলনা চলে না।
পুরস্কার যেখানে বিশাল, পরীক্ষা সেখানে অনিবার্য। সেটি শুধু দুনিয়ার নিয়মই নয়, রোয-হাশরের বিচার দিনেরও। মহান আল্লাহতায়ালা চান সাচ্চা ঈমানদারদের জান্নাত পূর্ণ করতে। ফলে কারা সাচ্চা ঈমানদার এবং কারা বেঈমান -এ দুই শ্রেণীর মানুষকে পৃথক করার জন্য চাই পরীক্ষা। চাই নির্ভূল ছাঁকুনি। ছাঁকুনির সে কাজটি নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতে হয় না। কারণ দুর্বৃত্ত মুনাফিকও নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতে শামিল হতে পারে। এ কাজে মোক্ষম ছাঁকুনির কাজটি করে জিহাদ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণাটি হলো, “তোমাদের কি ধারণা, তোমরা (এমনিতেই) জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্যশীল?”–(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১৪২)। কারা জান্নাতের যোগ্য এবং কারা অযোগ্য -সেটির বিচারে মহান আল্লাহতায়ালা জিহাদকে ছাঁকুনি রূপে গ্রহণ করেছেন। অন্য এক আয়াতে বলছেন, “তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে (কোন পরীক্ষা ছাড়াই) তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে? অথচ আল্লাহ জেনে নিবেন তোমাদের মধ্য থেকে কারা যুদ্ধ করেছে (আল্লাহর রাস্তায়) এবং কারা বিরত থেকেছে আল্লাহ ও মুসলিমদের ব্যতীত অন্যদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গহণ করা থেকে। তোমরা যা কিছূ কর সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ১৬)। মানব জীবনে পরীক্ষা যে অনিবার্য এবং তা থেকে পালানোর যে কোন পথ নাই -সেটিই বলা হয়েছে আরেক আয়াতেঃ “তোমরা কি ধারণা করে নিয়েছো যে, তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের পূর্ববর্তীদের জীবনে যা এসেছিল তা এখনো আসেনি। তাদের উপর এসেছিল বিপদ ও ক্ষয়- ক্ষতি, এবং তারা প্রকম্পিত হয়েছিল এমন ভাবে যে এমন কি নবী এবং তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তারা আওয়াজ তুলেছিল, “কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য?” হাঁ, আল্লাহর সাহায্য নিশ্চয়ই অতি নিকটবর্তী।”–(সুরা বাকারা, আয়াত ২১৪)।
মৃত্যু অনিবার্য, তেমনি অনিবার্য হলো মৃত্যুর পূর্বে প্রতিটি মানব জীবনে পরীক্ষা। তবে সে চুড়ান্ত পরীক্ষাটি যেমন নামায-রোযা’তে হয় না, তেমনি হজ্জ-যাকাতেও হয় না। সেটি হয় জিহাদের ময়দানে। জান্নাতে প্রবেশের এটি এন্ট্রি তথা প্রবেশাধিকার পরীক্ষা। ঈমানদার ও বেঈমানদের মাঝে এ রক্তাক্ষয়ী জিহাদে কেনারে দাঁড়িয়ে দর্শক হওয়ার সুযোগ নেই। জিহাদ চলাকালে তাই ইবাদতের নামে জায়নামাযে দাঁড়িয়ে নিজেকে লুকানোর কোন পথ নাই। ঈমানদার হওয়ার অর্থই হলো, লড়াইয়ের মধ্যমাঠে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও কোরবানী পেশ করতে হয়। অনন্ত- অসীম কালের জন্য নেয়ামত-ভরা জান্নাতে প্রবেশের আগে আল্লাহতায়ালা সে পরীক্ষাটিই করতে চান। নবীজী (সাঃ)’র সাহাবাদের মাঝে মহান আল্লাহতায়ালা এ পরিকল্পনা নিয়ে সামান্যতম সন্দেহ ছিল না। ফলে তারা পলায়নের রাস্তা খুঁজেননি। কিছু অন্ধ, বধির ও পঙ্গু ছাড়া এমন কোন সাহাবা ছিল না যারা জিহাদে অংশ নেননি। যারা জিহাদ থেকে পালিয়েছে তারা চিহ্নিত হয়েছে মুনাফিক রূপে।
জিহাদে শুধু বিজয়ই আসেনা, ভয়ানক পরাজয়ও আসে। এবং তা আসে মহা প্রজ্ঞাময় মহান রাব্বুল আলামিনের পরিকল্পনার অংশ রূপে। তাই সাহাবাদের জীবনে যেমন বদরের বিজয় এসেছে, তেমনি জীবননাশী ওহুদও এসেছে। বদরের যুদ্ধে ৭০ জন কাফের মুসলিমদের হাতে নিহত হয়েছিল এবং গ্রেফতার হয়েছিল আরো ৭০ জন। অপরদিকে ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন ৭০ জন সাহাবা। শহীদ হয়েছিলেন সে যুদ্ধে মুসলিম সেনা বাহিনীর সেনাপতি এবং নবীজী (সাঃ)’র নিজের চাচা হযরত হামযা (রাঃ)। হযরত হামযা (রাঃ)কে সাইয়েদুশ শোহাদা অর্থাৎ শহিদদের নেতা। যারা ভাবতেন, মুসলিম হওয়ার কারণে তাদের জন্য পরাজয় নয়, উপর্যপরি বিজয় এবং গণিমতের মালই শুধু প্রতিশ্রুত, সে ধারণা সেদিন দুর করা হয়েছিল। সে ধারণা দূর করতে রাসূলে করীম (সাঃ)’র উপস্থিতিতে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের মুখে ফেলা হয়েছে। লক্ষ্য, শুধু বিজয়ের জন্য নয়, পরাজয়ের জন্যও মুসলিমদের প্রস্তুত করা। এবং পরাজয় কেন আসে সেটিও জানিয়ে দেয়া। সর্বকালের মুসলিমদের জন্য সে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি সুস্পষ্ট করা হয়েছে এভাবে, “আর যেদিন দু’দুল সৈন্যের মোকাবিলা হয়েছে, সেদিন তোমাদের উপর যা আপতিত হযেছে তা আল্লাহর হুকুমই হয়েছে। এবং তা এজন্য যে, তাতে প্রকৃত ঈমানদারদের যেন জানা যায়। এবং যারা মুনাফিক তাদেরকেও যাতে সনাক্ত করা যায়। আর তাদেরকে বলা হলো এসো, আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করো এবং শত্রুদেরকে প্রতিহত করো। তারা বলেছিল, “আমরা যদি জানতাম যে লড়াই হবে তাহলে অবশ্যই তোমাদের সাথে থাকতাম।” সেদিন তারা ঈমানের তুলনায় কুফরীর কাছাকাছি ছিল। যা তাদের অন্তরে নেই তারা নিজের মুখে সে কথাই বলে। বস্তুতঃ আল্লাহ ভালভাবে জানেন, তারা যা কিছু গোপন করে। ওরা হলো সে সব লোক যারা বসে থেকে নিজেদের ভাইদের সম্মদ্ধে বলে, যদি তারা আমাদের কথা শুনতো তবে নিহত হতো না। তাদেরকে বলে দিন, “এবার তোমরা নিজেদের উপর থেকে মৃত্যুকে সরিয়ে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।” –(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১৬৬-১৬৮)।
মুসলিম জীবনের মূল এজেন্ডাঃ নিজেকে জান্নাতের উপযোগী রূপে তৈরী করা। জান্নাতই হলো জীবনের শেষ ঠিকানা। জান্নাতে প্রবেশের জন্য অপরিহার্য হলো, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত পরীক্ষা-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা। কোন একটি পরীক্ষাকে সামনে রেখে প্রস্তুতি শুরু না হলে জীবনে কোন পরিবর্তন আসে না। মু’মিনের কর্ম ও আচরণে যে বিশাল বিপ্লব আসে –তা তো পাশের অদম্য আকাঙ্খাতেই। পরীক্ষায় পাশের প্রক্রিয়ায় সে নিজেকে শুধু জান্নাতেরই যোগ্য করে না, বরং নিজেকে পরিণত করে এক মহা মানবে –যেমনটি দেখা গেছে সাহাবী কেরামদের জীবনে। আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনার মধ্য দিয়ে সে পরীক্ষাটি শুরু হয় মাত্র। নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতের মধ্য দিয়ে সে পরীক্ষা শেষ হয় না। ঈমানদারকে আরো বহুদূর যেতে হয়। সে ঘোষণাটি বার বার এসেছে পবিত্র কোর’আনে। মহান আল্লাহতায়ালার তেমন একটি ঘোষণা হলো, “মানুষ কি ধরে নিয়েছে যে, ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে। এবং এ ব্যাপারে কোন পরীক্ষা করা হবে না। অথচ তাদের পূর্বে যারাই ঈমানের দাবী করেছে তাদেরকে আমরা পরীক্ষা করেছি, যেন আল্লাহ জানতে পারেন যে, ঈমানের দাবী করার ব্যাপারে কে সাচচা এবং কে মিথ্যাবাদী।” –(সুরা আনকাবুত, আয়াত ২-৩)।
রাব্বুল আলামিন থেকে মুনাফিকি লুকানোর রাস্তা নেই। ব্যক্তির মনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সবই তিনি জানেন। তাই ব্যক্তির ঈমানের অবস্থা জানার জন্য তার ইবাদত দেখার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মহান আল্লাহ চান, প্রতিটি ব্যক্তি মৃত্যুর আগে নিজেই জেনে যাক, তার প্রকৃত অবস্থা কীরূপ। জিহাদে ব্যক্তি অংশগ্রহণ করলো কি করলো না -সে বিষয়টি তার ঈমানের প্রকৃত অবস্থাটি প্রকট ভাবে তুলে ধরে। সেটি যেমন তার নিজের সামনে, তেমনি অন্যদের সামনেও। জিহাদের ময়দানে ঈমানদারদের কাছে সুস্ষ্ট হয়, কে তাদের নিজেদের লোক, আর কে নয়। সেটি মসজিদের জায়নামাযে ধরা পড়ে না, রোযা বা হজ্বের জমায়েতেও নয়। কর্মক্ষেত্রে প্রমোশনের জন্য পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। যতই বাড়ে পুরস্কারের মান, ততই কঠোর হয় পরীক্ষা। জান্নাতের এক ইঞ্চি জায়গাও পাহাড় সমান সোনা দিয়ে কেনা যায় না। সেটি কিনতে হয় ঈমান, আমল, ইবাদত এবং জান ও মালের কোরবানী দিয়ে। জিহাদ তো ব্যক্তির জীবনে তেমন এক কোরবানীর ক্ষেত্র পেশ করে। পরীক্ষায় অংশ নেয়ার ফায়দা হলো, এটি ব্যক্তির ঈমানের মান শুধু মহান আল্লাহতায়ালার কাছেই প্রকাশ করে না, প্রকাশ করে তার নিজের কাছেও। এভাবে রোজ হাশরের বিচার দিনের আগে নিজের হিসাব নিজে নেয়ার সুযোগ করে দেয়।
ঈমানদারের জিহাদ ও শয়তানের যুদ্ধ
প্রতিটি রাষ্ট্রেই জনগণের মাঝে বিভাজন থাকে। বিভাজনটি বাঁচবার ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে। সবাই একই উদ্দেশ্যে যেমন বাঁচে না, তেমনি লড়াইও করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে সে বিভাজনটি মোটা দুই ভাগেঃ একটি ঈমানদারের, অপরটি বেঈমানের। উভয় পক্ষের জীবনে লড়াইও থাকে। ঈমানদার বাঁচে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করতে। বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে। অপর দিকে বেঈমানগণ বাঁচে শয়তানের এজেন্ডা নিয়ে। তাদের লক্ষ্য, ইসলামকে পরাজিত রাখা। ইসলামের পরাজয়ের অর্থই শয়তানের বিজয়। কোন ঈমানদারই সে পরাজয়কে মেনে নিতে পারে না। ফলে ঈমানদারের জীবনে লাগাতর যুদ্ধও আছে। এবং ঈমানদারের প্রতিটি যুদ্ধই হলো জিহাদ। এ জিহাদে ঈমানদারকে আপোষহীন হতে হয়। এবং সে আপোষহীনতার মধ্যেই প্রকৃত ঈমানদারী। মিথ্যার সাথে আপোষে ইসলামের বিশুদ্ধতা বাঁচে না। ইসলামের বিজয়ে বিপন্ন হয় শয়তানী শক্তির অস্তিত্ব -সেটি তারা বুঝে। ফলে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কোন রূপ উদ্যোগকে তারা মেনে নেয় না। ইসলামের প্রতিষ্ঠা রুখতে তাদের যুদ্ধটি তাই লাগাতর। সে লক্ষ্যে তাদের কোয়ালিশনটিও বিশাল; সেটি যেমন দেশীয় পর্যায়ে তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
মুসলিম দেশগুলিতে মুসলিম নামধারি অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাদের রাজনীতি বেঁচে আছে কাফের রাষ্ট্রগুলির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যে। ফলে মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার চেয়ে অধিক গুরুত্ব পায় কাফেরদের খুশি করাটি। ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে তারা এতটাই পথভ্রষ্ট যে, এমনকি আল্লাহর দ্বীনের অস্বীকারকারী পরম শত্রুদেরও তারা কাফের বলতে রাজী নয়। অথচ কাফের তো তারাই যারা ইসলামকে মেনে নিতে রাজী নয়। মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোর’আনে তাদেরকে সে নামেই উল্লেখ করেছেন। ফলে কাফেরকে কাফের বলাটাই মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। তারা ভাবে ইসলামের প্রতিষ্ঠার কথা বলাতে তাদের প্রভু বৃহৎ শক্তিবর্গ নারাজ হবে, নারাজ হবে দেশী সংখ্যালঘুরাও। তাদের ভয়, এতে তাদের ভোট-ব্যাংকে টান পড়বে। এমন রাজনৈতিক স্বার্থ চিন্তায় মহান আল্লাহতায়ালা কি চান -সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তাদের কাছে আদৌ গুরুত্ব পায় না। বরং গুরুত্ব পায়, দেশের অমুসলিম সংখ্যলঘু ইসলাম ও অমুসলিম বৃহৎ শক্তিবর্গ কি চায় -সেটি।
প্রশ্ন হলো, কি এমন আপোষপন্থি মুসলিমদের জন্য? ইসলাম কি বেঈমানদদের সাথে আপোষের অনুমোদন দেয়? তাতে কি ঈমান বাঁচে? মুসলিমের রাজনীতিই শুধু নয়, তার বাঁচা-মরা তো নির্ধারিত হয়, মহান আল্লাহতায়ালা কি চান -তা থেকে। দেশের সংখ্যালঘু ভোটার বা বিদেশী বৃহৎ শক্তি কি বলবে -সেটি দূরে থাক, তার নিজ পিতা-মাতার ন্যায় আপনজনদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাটিও তার কাছে গুরুত্বহীন -যদি তারা ইসলামের বিপক্ষ শক্তি হয়। ঈমানদারের জীবনে মূল বিষয়টি হলো একমাত্র আল্লাহকে খুশি করা। এব্যাপারে মহান আল্লাহর হুশিয়ারিটি ঘোষিত হয়েছে এভাবেঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের পিতা ও ভাইদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করোনা যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালবাসে। আর তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে তারা সীমালংঘনকারি। -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ২৩)। আরো বলা হয়েছেঃ “(হে মুহম্মদ!) বলে দাও! তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যার ক্ষতি হওয়ার ভয় করো এবং তোমাদের বাসস্থান –যাকে তোমরা পছন্দ করো আল্লাহ, তাঁর রসুল ও তাঁর রাস্তায় জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয় তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আল্লাহ ফাসেক লোকদের হেদায়েত দেন না। -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ২৪)।
আল্লাহর দ্বীনের বিজয় ও সে লক্ষ্যে লড়াই এতই গুরুত্বপূর্ণ যে পিতা-মাতা ও ভাই-বোনের বিরোধীতা, গোত্রীয় স্বার্থচিন্তা, ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষয়-ক্ষতি কোনটাই যেন সে কাজ থেকে ঈমানদারকে বিচ্যুৎ করতে না পারে। যারা নানা বাহানায় সে লড়াই থেকে দূরে থাকবে আল্লাহপাকের কাছে তারাই হলো ফাসেক তথা পাপী। উপরুক্ত আয়াতে তাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর একটি ঘোষণা রয়েছে। সেটি হলো, জিহাদ থেকে দূরে থাকা মুসলিম নামধারী ব্যক্তিগণ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে চিহ্নিত হয় হেদায়াতের অযোগ্য রূপে। ফলে যতই তাদের দিন যায়, ততই বাড়ে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে তাদের বিচ্যুতি। কল্যাণ দেয় না তাদের নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত। এবং মুক্তি আসে না পাপ-পংকিলতা থেকেও। তাই যে মুসলিম সমাজ জিহাদ থেকে দূরে থাকে, সে সমাজে নামাযী, হাজী ও রোযাদারের সংখ্যা বাড়লেও বাড়ে না জনগণের চারিত্রিক পরিশুদ্ধি। মসজিদ-মাদ্রাসার দেশ বাংলাদেশ এজন্যই বিশ্বের দরবারে শিরোপা পায় দূর্বৃত্তিতে।
ভিন্নতাটি কেবল লড়াইয়ের লক্ষ্যে
মানব ইতিহাসের অতি সত্য বিষয় হলো, সবার জীবনেই লাগাতর যুদ্ধ আছে। দুঃখ-যাতনা এবং মৃত্যুও আছে। ভিন্নতা শুধু যুদ্ধ ও প্রাণদানের লক্ষ্যে। প্রতিদেশই যুদ্ধকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার ও প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার রূপে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশী যুদ্ধ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের নানা কোনে সংঘটিত এসব যুদ্ধ খরচ করছে হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার। শত শত মার্কিনী সৈন্য প্রাণও দিচেছ। উদ্দেশ্য কি গণতন্ত্র বিস্তার? লক্ষ্য গণতন্ত্র বিস্তার হলে স্বৈরাচারি শাসকদের সাথে এতো বন্ধুত্ব কেন? আসল লক্ষ্য, নিজেদের প্রভাব বলয়কে বিশ্বময় করা। ব্রিটিশ, ফরাসী, স্পেনিশদের ন্যায় নানা ঔপনিবেশিক শক্তিবর্গ অতীতে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিতে যুদ্ধ করেছে এবং বনে-বাদাড়ে প্রাণ দিয়েছে। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। এ হলো নিজেদের প্রবৃত্তিকে খুশি করতে যুদ্ধ ও রক্তদানের নমুনা।
কিন্তু আল্লাহতায়ালা তো চান, মানুষ তার সামর্থ্যের বিনিয়োগে করুক এক মহত্তর লক্ষ্যে। আর সেটি হলো ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ে প্রতিরোধ। এভাবেই সে পরিশোধ করুক জান্নাতের মূল্য। রাষ্ট্রই যে সকল মঙ্গল ও অমঙ্গলের মূল -সেটি ইসলাম যতটা বিশুদ্ধ ভাবে তুলে ধরেছে তার নজির অন্য ধর্মে নেই। রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ যা চায়, জনগণকেও ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় সেদিকেই যেতে হয়। যে রাষ্ট্রীয় ব্যংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানগুলি দেশের সবচেয়ে বড় সূদখোর -সে দেশে সূদের বিরুদ্ধে হাজারো ওয়াজ হলেও কি জনগণকে সূদ থেকে বাঁচানো যায়। বরং সূদ দিতে ও সূদ খেতে জনগণও তখন বাধ্য হয়। বাঁচার তাগিদে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নামধারি ব্যক্তিও তখন সূদী ব্যাংকে চাকুরি ন্যায়। অথচ সূদ খাওয়া, সূদ দেওয়া এবং সূদের হিসাব লেখাও হারাম। সূদ খাওয়াকে আল্লাহর রাসূল নিজের মায়ের সাথে জ্বিনার ন্যায় অপরাধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশের সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সে জ্বিনার অপরাধটি অবিরাম ঘটে যাচ্ছে। সূদের ন্যায় মদের আমদানী ও বিক্রয় করা হারাম। বাংলাদেশের ন্যায় দেশের প্রধান বিমান বন্দরে ঢুকলে সরকারের যে ব্যবসাটি প্রথমে নজরে পড়ে সেটি মদ-বিক্রয়ের ব্যবসা। এমন দেশে দীবারাত্র হাজার হাজার ওয়াজ নসিহত করলেও কি মদ্যপান বন্ধ হবে। তেমনি ব্যাভিচারীর বিষয়। বাংলাদেশের ন্যায় দেশে জ্বিনা বা ব্যাভিচারের সবচেয়ে বড় পাহারাদার হলো সরকার। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে পতিতাপল্লিগুলি পাহারা দিচ্ছে সরকারি পুলিশ। আল্লাহর কাছে দোয়া বা বড় বড় ওয়াজ মহফিল করে কি সমাজ পবিত্র করা যায়? নর্দমায় গলিত আবর্জনা জমতে দিয়ে শুধু দোয়ার বরকতে কি মশা নির্মূল হয়। বিষয়টি অভিন্ন সমাজ থেকে নৈতিকতা-ধ্বংসী দুর্বৃত্তি নির্মূলের বিষয়ও।
যে লড়াই বিরামহীন
ইসলাম শেখায় পবিত্র দায়িত্ব নিয়ে বাঁচতে। ঈমানদারের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব তো সে দায়িত্ব পালনের মধ্যে। পবিত্র কোরআনে সে দায়িত্বটির কথা হয়েছে এভাবেঃ “তোমাদের মধ্যে এমন এক উম্মতকে অবশ্যই থাকতে হবে যারা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে, ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায়কে রুখবে। এবং তারাই হলো সফলকাম।”-(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৪)। এটিই তো ইসলামের মিশন। মুসলিম রূপে বাঁচার অর্থ তো ইসলামের মিশন নিয়ে বাঁচা। প্রশ্ন হলো, অন্যায়ের নির্মূলে নামলে অন্যায়কারীগণ কি সেটি মেনে নেয়? সংঘাত তো তখন অনিবার্য হয়ে উঠে। ঈমানদারের জীবনে এভাবেই অনিবার্য হয়ে উঠে জিহাদ। বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করে বুঝানো হয়েছে সুরা হুজরাতে। ঈমানের দাবী মুনাফিকগণও করে। কিন্তু বলা হয়েছে, ঈমানের দাবীতে একমাত্র তারাই সাচ্চা, যাদের জীবনে জিহাদ আছে। এভাবে জিহাদশূণ্যতাকে ঈমানশূণ্যতা রূপে তুলে ধরা হয়েছে। সুরা হুজরাতের সে আয়াতটি হলো, “তারাই মু’মিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে নিজের প্রাণ ও ধন-সম্পদ দিয়ে জেহাদ করে। ঈমানদারীর ব্যাপারে সত্যবাদী একমাত্র তারাই। -(আয়াত ১৫)।
যে রাষ্ট্রে ইসলাম পরাজিত, সে রাষ্ট্রের দখলদারিটা চলে যায় শয়তানী শক্তির হাতে। তখন রাষ্ট্রের প্রতিস্তরে দখল জমায় দুর্বৃত্তির নায়কেরা। এদের কারণেই বাংলাদেশের ন্য্যয় মুসলিম দেশগুলি দুর্নীতিতে শিরোপা পায়। এরা অনুসরণ করে ফিরাউনের নীতি। ফিরাউনের ন্যায় এদের কাজ, অন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়ের প্রতিরোধ। তখন অসম্ভব হয় পূর্ণ ভাবে দ্বীনপালন। জনকল্যাণ, জনগণের জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা ও পূর্ণ ভাবে দ্বীনপালনের স্বার্থে শয়তানী শক্তির নির্মূল এজন্যই জরুরি। ঈমানদারের জীবনে জিহাদ এজন্যই অনিবার্য প্রয়োজন রূপে দেখা দেয়। এজন্যই ফরয করা হয়েছে জিহাদ। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সেটির ঘোষণাটি এসেছে এভাবেঃ “আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ করো সমবেত ভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে সমবেত ভাবে। মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তকীনদের সাথে রয়েছেন। আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহাপাপ। বস্তুতঃ তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদেরকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যদি তা সম্ভব হয়। তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। এবং তারাই হলো দোযখবাসী। তাতে তারা চিরকাল বাস করবে। আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, যারা ঈমান এনেছে, যারা হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে যারা লড়াই করেছে -তারাই আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী। আর আল্লাহ হচ্ছেন ক্ষমাশীল করুণাময়। -(সুরা আল-বাক্বারা, আয়াত ২১৭-২১৮)।
উপরুক্ত আয়াতে ঈমানদারদের জন্য রয়েছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা। সেটি হলো, ইসলামের বিরুদ্ধে দুশমনদের যুদ্ধে যেমন বিরতি নাই, তেমনি বিরতি নাই মুসলিমদের জিহাদেও। হক্ব ও বাতিলের এ যুদ্ধটি বিরামহীন। জিহাদ মুসলিম জীবনে একটি স্থায়ী ইন্সটিটিউশন। পবিত্র কোর’আনে ঘোষিত এ হুকুমের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহী, তাদের প্রতি রয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার চরম হুশিয়ারি। শোনানো হয়েছে কঠিন আযাবের প্রতিশ্রুতি। বলা হযেছে, “যদি জিহাদে বের না হও, তবে আল্লাহ তোমাদের মর্মন্তদ আযাব দেবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। তোমরা তাঁর (আল্লাহর) কোন ক্ষতিই করতে পারবে না, আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ৩৯। সুতরাং মাথার উপর মহান আল্লাহতায়ালার আযাব নামিয়ে আনার জন্য মুর্তিপূজারী বা নাস্তিক হওয়ার প্রয়োজন নাই, জিহাদ থেকে দূরে থাকাটাই সে জন্য যথেষ্ট। সে বার্তাটিই অতি স্পষ্ট ভাবে ধ্বনিত হয়েছে উপরুক্ত আয়াতে। তবে জিহাদের জন্য শর্ত এ নয় যে, বিশাল সেনা বাহিনী গড়তে হবে। হাজার হাজার ট্যাংক, শত শত যুদ্ধ বিমান ও বিশাল নৌ-বহর থাকতে হবে। বরং সামর্থ্য অনুযায়ী জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে সর্ব-অবস্থায়। ঈমানদারের কাজ হলো খালেছ নিয়তে আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে পড়া। এবং বিশ্বাস রাখতে হবে বিজয় আসে একমাত্র আল্লাহতায়ালা থেকে। সে ঘোষাণাটিও দেয়া হয়েছে এভাবে, “ওয়া মা নাছরু ইল্লা মিন ইন্দিল্লাহি, ইন্নাল্লাহা আযুযুন হাকীম।” অর্থঃ সাহায্য একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো থেকে আসে না। এবং আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাবান। -(সুরা অআনফাল, আয়াত ১০)।
বিজয় যে পথে অনিবার্য
বিজয়ের অর্থ শুধু যুদ্ধজয় নয়। ঈমানদারের প্রকৃত বিজয় আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার মধ্যে; সে পথে ঘটে জান্নাত প্রাপ্তি। পবিত্র কোর’আনে তাই বলা হয়েছে,“যারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়, তারা যদি নিহত হয় বা বিজয়ী হয় -উভয় অবস্থাতেই তাদের জন্য বিশাল পুরস্কার।” –(সুরা নিসা, আয়াত ৭৪)। জিহাদের ময়দানে ঈমানদারদের সাহায্য করার জন্য মহান আল্লাহতায়ালার ফিরেশতাগণ সদাপ্রস্তত। ইসলামের বিজয়ে বান্দার নিজস্ব বিনিয়োগ শুরু হলে, মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্যও শুরু হয়ে যায়। মুসলিমদের আজকের পরাজয়ের কারণ, তাদের নিজস্ব বিনিয়োগটি প্রায় শূণ্যের কোঠায়। নিজেদের যা কিছু মেধা, সময়, অর্থ ও দৈহিক বল তা বিনিয়োগ হচ্ছে ভাষা, ভূগোল, নেতা, ফেরকাহ ও দলীয় স্বার্থের বিজয় আনতে। ফলে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সাহায্যও আসছে না। অপর দিকে যে মুসলিম জনগোষ্ঠি বিনিয়োগের ময়দানে এগিয়ে আসছে তারা বিজয়ও পাচ্ছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার ন্যায় একটি বিশ্বশক্তির বিরুদ্ধে যে বিজয় আসলো সে তো তাঁর সাহায্যের বদৌলতেই।
আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মু’মিনের উপর জিহাদের সে তাগিদটি এসেছে এভাবেঃ “তোমরা বের হয়ে পড় স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে, এটিই তোমাদের জন্য অতি উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পার।” –(সুরা তাওবাহ, আয়াত ৪১)। এখানে বিশাল প্রস্তুতির কথা বলা হয়নি। যা আছে তা দিয়েই ময়দানে নামতে বলেছেন। নবীজী (সাঃ) যদি কাফের শক্তির সমকক্ষ লোকবল ও অস্ত্রবল সংগ্রহের অপেক্ষায় থাকতেন তবে কি কোনদিনও জিহাদে নামার যুক্তি খুঁঝে পেতেন? কারণ, একমাত্র হুনায়ুনের যুদ্ধ ছাড়া কাফেরদের সংখ্যাবল ও অস্ত্রবল সব সময়ই মুসলিমদের চেয়ে অধিক ছিল। মুসলিমদের প্রতিরক্ষা, ইজ্জত এবং কল্যাণ কখনই ঘরে বসে থাকাতে বাড়ে না, বাড়ে এভাবে বেরিয়ে পড়াতে। আল্লাহতায়ালা সেটিও জানিয়ে দিয়েছেন এভাবেঃ “যারা জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে, আল্লাহ তাদের পদমর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন -যারা ঘরে অবস্থান নেয় তাদের তুলনায়; এবং প্রত্যেকের সাথেই আল্লাহ কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ মুজাহিদদেরকে ঘরে অবস্থানকারিদের তুলনায় মহান প্রতিদানে শ্রেষ্ঠ করেছেন।”। সুরা নিসা, আয়াত ৯৫। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হোন। তাদের ঠিকানা জাহান্নাম। সেটি কতই না নিকৃষ্ট স্থান। -( সুরা তাহরীম, আয়াত ৯)।
মুসলিমদের মাঝে এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক যারা মুখে ইসলামের অনুসারি হওয়ার দাবী করলেও, তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো পার্থিব স্বার্থ-উদ্ধার। এমন পার্থিব চেতনারই আধুনিক পরিভাষা হলো সেক্যুলারিজম। এদের কাছে পরাকালীন চেতনা হলো সাম্প্রদায়িকতা। নামায-রোযা পালন করলেও জিহাদের আহবান তাদের প্রাণে কোন সাড়া জাগায় না। পবিত্র কোরআনে এদের সম্মন্ধে বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কি হলো, যখন আল্লাহর পথে বের হবার জন্যে তোমাদের বলা হয় তখন মাটি জড়িয়ে ধরো, তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অতি অল্প। -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ৩৮)। যুদ্ধ তাদের কাছে বড়ই অপছন্দীয়। অথচ আল্লাহপাক যুদ্ধকে ফরয করেছেন এবং বলছেন, “তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়তো কোন বিষয় অপছন্দনীয়, অথচ তা তোমাদের জন্য তা কল্যাণকর। হয়তো বা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে তা অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহ যা জানেন তোমরা তা জান না।” –(সুরা বাকারাহ, আয়াত ২১৬)।
ঈমানের বিস্ফোরণ ও শহিদদের মর্যাদা
মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে সবচেয়ে বড় নেককর্ম যেমন জিহাদ, তেমনি সবচেয়ে বড় মর্যাদার অধিকারি হলো শহীদ। শহীদ তো তারাই যারা জিহাদে নিহত হয়। অন্যরা মারা গেলে তাদেরকে মৃত বলা হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম শহীদগণ; তাদের মৃত বলা হারাম। পবিত্র কোর’আনে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবেঃ “আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। বরং তার জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝো না।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ১৫৪)। অতএব শহীদগণ নিহত হলেও তারা জীবিত। তারা পানাহার পেয়ে থাকেন। সে বিষয়টিও জানানো হয়েছে পবিত্র কোর’আনের অন্য এক আয়াতে। জান্নাত পাওয়ার চেয়ে বড় পাওয়া নাই। তবে সে জান্নাতেরও একটি বিশেষ মূল্য আছে। মহান আল্লাহতায়ালা চান, ঈমানদারগণ সে মূল্যটি মৃত্যুর পূর্বে পরিশোধ করুক। সে বার্তাটি জানায় নিম্মের আয়াত, “কস্মিনকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় না করো।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ৯২)। মানুষের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি হলো তার নিজের জান। তাই জান্নাত পেতে হলো ঈমানদারকে শুধু ঈমান আনলে চলে না, মহান আল্লাহতায়ালার পথে সে জানেরও বিনিয়োগ ঘটাতে হয়। আর বিনিয়োগের সে পবিত্র ক্ষেত্রটি হলো জিহাদ। সে জিহাদে যে ব্যক্তি তার প্রাণের কোরবানী দেয় তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কে হতে পারে? শহীদ পুরস্কৃত হয় বিনা বিচারে জান্নাত পেয়ে।
হযরত আল-বারা (রাঃ) থেকে বর্নীত একটি হাদীসঃ এক ব্যক্তি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-র কাছে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি সর্বপ্রথম যুদ্ধে যাবো, না ইসলাম কবুল করবো?” তিনি জবাব দিলেন, “ইসলামের মধ্যে প্রথমে প্রবেশ করো এবং তারপর জিহাদ করো।” সে ব্যক্তিটি ইসলাম কবুল করলো, তারপর লড়াইয়ে গেল এবং শহীদ হয়ে গেল। আল্লাহর রাসূল তার সম্মদ্ধে বলেছেন, “সে অতি অল্প সময়ের জন্য দ্বীন অনুসরণের সুযোগ পেয়েছে কিন্তু প্রতিদান পেয়েছে বিশাল।” –(আল-বোখারী, আল-মুসলিম)। হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্নীত অপর একটি হাদীসঃ আল্লাহর রাসূল(সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি একবার জান্নাতে প্রবেশ করেছে সে আর কখনও দুনিয়াতে ফিরতে চাইবে না -যদিও তাকে বলা হয় দুনিয়াতে যা কিছু আছে তা তাকে দিয়ে দেওয়া হবে। একমাত্র ব্যতিক্রম হবে সে ব্যক্তি -যে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছে। দুনিয়াতে সে আবার ফিরে যেতে চাইবে। শাহাদতের ফলে সে মর্যাদার অধিকারি হয়েছে সেটি দেখে সে আরো দশ বার নিহত হতে চাইবে। -(আল বুখারী, আল মুসলিম)।
প্রতিটি ব্যক্তিই তার নিজ নিজ বিশ্বাস ও দর্শনের প্রকাশ ঘটায় তার কর্ম ও আচরণে। বেঈমানদের আধিক্যে এজন্যই দেশে দুর্বৃত্তির রেকর্ড সৃষ্টি হয়। তেমনি ঈমানের প্রকাশ ঘটবে নেক আমলে। তাই যে সমাজে ঈমানদারের সংখ্যাটি বিশাল, সে সমাজে জোয়ার আসে নেক কর্মে এবং বিলুপ্ত হয় দু্র্বৃত্তদের দৌরাত্ম। ঈমানের যেরূপ বলিষ্ঠ প্রকাশ শহীদদের শাহাদতে ঘটে, সেটি অন্য কোন কর্মে হয় না। বস্তুত শাহাদতে ঘটে ঈমানের বিস্ময়কর বিস্ফোরণ। শহীদদের খুন কাঁপিয়ে দেয় সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রকে। এবং ধ্বসিয়ে দেয় শয়তানী শক্তির দুর্গগুলিকে। ইসলামী সমাজ বিপ্লবে অতীতে সবচেয়ে বড় অবদানটি রেখেছিল শতকরা ৭০ ভাগ সাহাবীর শাহাদত। ফেরেশতাগণ এবং ঈমানদারগণ তখন একই রণাঙ্গনে অপরাজেয় কোয়ালিশনে পরিণত হয়েছিলেন। ঈমানের সে বিশাল বিস্ফোরণের কারণেই মুসলিমগণ এক কালে সেরা বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। এবং তাদের হাতে নির্মিত হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।
ঈমানশূণ্য ও জিহাদশূণ্য করার শয়তানী স্ট্রাটেজী
ইসলামের শত্রুশক্তি নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতের বিলুপ্তি চায় না, বরং বিলুপ্তি চায় মুসলিম জীবন থেকে জিহাদের। শত্রুশক্তি বিশ্বজুড়ে লড়াইয়ে নিজেদের মনোপলি চায়; কারণ সে মনোপলি বাঁচাতে পারে বিশ্বজুড়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য। এবং সে মনোপলি বহাল রাখার স্বার্থেই মুসলিমদের জিহাদশূণ্য করতে চায়। সে কাজে অনিবার্য মনে করে মুসলিমদের ঈমানশূণ্য করা। কারণ, ঈমানশূণ্যতা ছাড়া যে জিহাদশূণ্যতা অসম্ভব –তা নিয়ে তাদের মনে সামান্যতম সন্দেহ নাই। ইসলামের শক্তির উৎস নিয়ে মুসলিম নামধারী অনেকের অজ্ঞতা থাকলেও সে অজ্ঞতা ইবলিস ও তার অনুসারিদের নাই। ঈমানশূণ্যতা সৃষ্টিতে শয়তানের শক্তির মূল প্রকল্প হলো কোর’আন বুঝা থেকে মুসলিমদের দূরে রাখা। কারণ, ঈমান পুষ্টি পায় কোর’আনের জ্ঞান থেকে। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে শয়তানের এ প্রকল্প যে কতটা সফল সেটি বুঝা যায়, জনগণের মাঝে কোর’আনী জ্ঞানার্জনে অনাগ্রহ থেকে। কোর’আন বুঝার চেয়ে তাদের কাছে গুরুত্ব পায় না বুঝে কোর’আন তেলাওয়াত। অথচ প্রতিটি নর-নারীর উপর নামায-রোযার ন্যায় ফরজ হলো কোর’আন বুঝা এবং তা থেকে হিদায়েত নেয়া; না বুঝে তেলাওয়াত নয়।
হাদীস মতে ঈমানের রয়েছে ৭০টি শাখা। ঈমানের অর্থ শুধু আল্লাহতায়ালা, তাঁর নবী-রাসূল, আসমানী কিতাব, আখেরাত ও ফিরেশতাদের উপর ঈমান নয়। বরং ঈমান আনতে হয় তাঁর শরিয়তে উপর এবং সে শরিয়তকে বিজয়ী করার জিহাদের উপর। শরিয়ত পালন ছাড়া কি ইসলাম পালন হয়? অথচ ৫৭ টি মুসলিম দেশের কোথায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শরিয়তী আইন? অথচ সাহাবায়ে কেরামের জীবনে একটি দিনও কি শরিয়ত ছাড়া কেটেছে? হাদীসে এ কথাও বলা হয়েছে ঈমানের সবচেয়ে দুর্বল শাখাটি হলো রাস্তা থেকে কাঁটা তুলে নেয়া। আর সর্বোচ্চ শাখাটি হলো জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদ। প্রশ্ন হলো যে দেশে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নাই, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার জিহাদ নাই এবং কোর’আন বুঝার আয়োজন নাই, সে দেশের জনগণের মাঝে ঈমানশূন্য যে কতটা প্রকট -তা কি বুঝতে বাঁকি থাকে? মুসলিম উম্মাহর সমস্যা তাই শুধু ইসলামী রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি নয়। বরং সেটি যেমন জিহাদশূণ্যতা, তেমনি ঈমানশূণ্যতা। ০৪/১২/২০২০
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018