বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদী তান্ডব এবং বিপন্ন মুসলিম-বিশ্ব
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on December 29, 2020
- Bangla Articles, মুসলিম জাহান
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
সাম্রাজ্যাবাদের কেন বহুজাতিক রূপ?
পুঁজিবাদী অর্থনীতি যেমন তার বিশ্বব্যাপী দাপট ও শোষন প্রক্রিয়া চালু রাখতে বহুজাতিক কোম্পানীর রূপ নিয়েছে, তেমন বহুজাতিক কৌশল নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব রাজনীতিও। আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ এখন পুঁজিবাদী বিশ্বের বহুজাতিক প্রজেক্ট। সে বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদই হাজির হয়েছে ইরাক ও আফগানিস্তানে। ইরাক ও আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা এই প্রথম নয়, অতীতেও হয়েছে। হামলা করেছিল এক সময়ের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেন। আফগানিস্তানে দুই দুই বার হামলা করে ভয়ানক ভাবে পরাস্ত হয়েছিল তারা। হামলা করেছিল সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বশক্তি সোভিয়েত রাশিয়াও। আফগানিস্তানে প্রায় দশ বছর চেষ্টা করেও রাশিয়া ব্যর্থ হয়েছে। যে কোন যুদ্ধই বিপুল অর্থক্ষয় ও রক্তক্ষয় হয়। সে অর্থক্ষয় ও রক্তক্ষয়ের কারণে সোভিয়েত রাশিয়া নিজেই টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। প্রায় এক শত বছর আগে ব্রিটিশ বাহিনী ইরাক দখল করেছিল। কিন্তু ধরে রাখার সামর্থ্য না থাকায় হটে আসতে বাধ্য হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নতুন উপলব্ধি হলো, কোন দেশের একার পক্ষে অন্য দেশ দখল করা ও সেখানে অধিকার জমিয়ে রাখা -এখন অসম্ভব।
বিশ্বশক্তি রূপে টিকে থাকার খরচটি বিশাল। সে খরচ পোষাতে না পেরেই সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে গেছে। একই কারণে অতীতে ব্রিটিশ ও ফরাসী উপনিবেশিক শাসনেরও সমাপ্তি ঘটেছিল। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতসহ এশিয়া-আফ্রিকা থেকে যে ভাবে ভেগে আসতে বাধ্য হয়েছিল -সেটি কোন মানবিক মূল্যবোধের কারণে নয়। তবে বাস্তবতা হলো, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হলেও, ইংরেজদের মন থেকে সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা বিলুপ্ত হয়নি। অন্য দেশের উপর আগ্রাসী হামলা ও গণহত্যা পরিচালনায় ব্রিটিশ সরকারকে তাই জন-সমর্থণ পেতে অসুবিধা হয়না। হামলা ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে অন্যদেশের উপর অর্জিত আধিপত্য নিয়ে ব্রিটিশ মিডিয়াতে প্রচন্ড উল্লাসও হয়। যে বিপুল উল্লাসটি ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলার সময় বিবিসিসহ সকল ব্রিটিশ মিডিয়াতে দেখা গেছে। যুদ্ধের পর সংসদীয় নির্বাচনে টনি ব্লেয়ারের ন্যায় গণহত্যার নায়কগণ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় তো -সে কারণেই। তাই নৈতিক দিক দিয়ে লর্ড ক্লাইভের আমলের ব্রিটেন ও আজকের ব্রিটেনের মাঝে পার্থক্য অতি সামান্যই। সে সময় আধিপত্য বিস্তারে তারা ঘুষ দিত মীর জাফরের ন্যায় দুর্বৃত্ত গাদ্দারদের। এখন ঘুষ দিচ্ছে মধ্য প্রাচ্যের স্বৈরাচারি রাজা-বাদশাহদের। সৌদি আরবের সাথে বাহাত্তর বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তিতে যে বিপুল ঘুষ দেওয়া হয়েছিল সে দেশের রাজপরিবারের সদস্যদের -সে তথ্য ফাঁস করেছে ব্রিটিশ মিডিয়া। যে কোন সভ্য দেশে এটি এক গুরুতর অপরাধ। অথচ সে অপরাধের তদন্তে যে নৈতিক দায়িত্ববোধটুকু থাকার দরকার -ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রি টনি ব্লেয়ার সেটিও দেখাতে পারেননি। এটিই হলো ব্রিটিশ শাসকচক্রের নৈতিকতার প্রকৃত মান।
খরচ বেড়েছে সাম্রাজ্যবাদের
সাম্রাজ্যবাদী দেশের একক সামরিক শক্তির দূর্বলতা নিয়ে সম্প্রতি সত্য কথাটি বলছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন। জার্মানীতে অনুষ্ঠিত এক শীর্ষ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘‘বিশ্বশক্তি রূপে টিকে থাকাটি অতি ব্যয়বহুল। কোন একক দেশের সে সামর্থ্য নাই।’’ সে সত্যটি উপলদ্বি করেছে এমন কি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্রপক্ষও। এজন্যই মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ তার স্ট্রাটেজীই পাল্টে ফেলেছে। একই কারণে ফকল্যান্ড হামলার পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কোন দেশেই একাকী যায়নি। গেছে বহু জাতিক বাহিনীর সদস্য রূপে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বিরুদ্ধে একাকী হামলা চালাতে ভয় পেয়েছে। এজন্যই বহুজাতিক হামলার পথ বেছে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকের উপর হামলায় মার্কিন বাহিনী এজন্যই সাথে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, ইটালি, স্পেন, ক্যানাডা, কোরিয়া, পোলান্ড, বুলগেরিয়া, চেক রিপাবলিকসহ বহুদেশের সেনাবাহিনীকে। সহযোগিতা নিয়েছিল বা ভূমি ব্যবহার করেছিল সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ প্রায় সকল দেশের। অপর দিকে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করছে ন্যাটোর সম্মিলিত বাহিনী। ন্যাটো যে বহুজতিক সাম্রাজ্যবাদের সামরিক ফ্রন্ট এখন আর সেটি গোপন বিষয় নয়। বহুজাতিক কোম্পানী যেমন নিজেদের বাজার ও মুনাফা বাড়াতে বাজারে শেয়ার ছাড়ে, তেমনি শেয়ার ছেড়েছে বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদী জোটও। এবং সেটি মুসলিম দেশগুলিতেও। ১৯৯১ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে হামলায় সে জোটের শেয়ার হোল্ডার রূপে তাই ডাক পড়েছিল বহু মুসলিম দেশের সমারিক বাহিনীর।
হিংস্র পশুর আসল চেহারা টের পাওয়া যায় তখন যখন সে ক্ষুদার্ত হয়। বিষয়টি অভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্ষেত্রেও। গণতন্ত্র, বিশ্বশান্তি ও মানবিক অধিকারের বড় বড় বুলি নিয়ে ইঙ্গো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্ররা বড্ড মুখর। কিন্তু এরূপ অতি মানবিক বিষয় নিয়ে তাদের আগ্রহ যে সামান্যই সেটি পূর্বের ন্যায় আজও প্রমাণিত হচ্ছে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, লেবাননসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কোনে। তাদের আসল চেহারা নিয়ে তাই কোন দিব্যমান ব্যক্তির দ্বিধা-দ্বন্দের থাকার অবকাশ নাই। ইরাকে হামলার সময় তারা বলেছিল, তাদের যুদ্ধ নিছক সাদ্দামের বিরুদ্ধে, ইরাকের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। সাদ্দামকে তারা মারাত্মক যুদ্ধাপরাধি রূপে চিত্রিত করেছিল। এ অভিযোগে তাকে হত্যাও করেছে। কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের শাসনের শেষ হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ শেষ হয়নি। এখন লিপ্ত ইরাকের জনগণ হত্যায়। তাদের যু্দ্ধের কারণে প্রায় এক লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে। দিন দিন সে হত্যাকান্ড আরো তীব্রতর হচ্ছে। কিন্ত তা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী মহলে কোন দুঃখ বা ক্ষোভ নেই। তাদের আসল লক্ষ্য সাদ্দাম বা তার সরকার ছিল না। লক্ষ্য ছিল ইরাকের তেল এবং ইসরাইলের নিরাপত্তা। এ লক্ষ্যে তারা দেশটির উপর পূর্ণ আধিপত্য চায়। সাদ্দাম ছাড়া অন্য কেউ থাকলেও তারা দেশটিকে দখলে নিত। তার ইরাকের উপর হামলা যে নিছক একটি বহু জাতিক সাম্রাজ্যবাদী প্রজেক্ট তা নিয়ে আর কি কোন সন্দেহ থাকে?
বিভক্ত মুসলিমবিশ্ব ও দেশীশত্রুর অধিকৃতি
মুসলিম দেশগুলির সমস্যা শুধু বিদেশী শক্তির অধিকৃতি নয়, বরং সেটি দেশী শত্রুদের অধিকৃতিও। প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে জেঁকে বসে আছে নৃশংস স্বৈরশক্তি। নিজেদের গদি বাঁচাতে তারা ভয়ানক গণহত্যাতেও রাজী। বাংলাদেশে হাসিনার হাতে ঢাকার শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যা, মিশরের জেনারেল সিসির কায়রাতে রাবা আল-আদাবিয়ার গণহত্যা এবং পাকিস্তানের ইসলামাবাদে জেনারেল মোশাররাফের লাল মসজিদের গণহত্যা তো -সে নৃশংস অধিকৃতিরই প্রমাণ। তাদের কারণে বিদেশী হামলার বিরুদ্ধে লন্ডন, ওয়াশিংটন, রোম, প্যারিসের ন্যায় সাম্রাজ্যবাদী দেশের রাজধানিতে বড় বড় মিছিল হলেও অধিকাংশ মুসলিম দেশে তা হয়নি।
মুসলিম বিশ্বের বড় সমস্যা হলো অনৈক্য। অন্য দেশে হামলা, গণহত্যা, দস্যুবৃত্তি ও আধিপত্য বিস্তারে বহু জাতিক সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে যে অটুট ঐক্য -সে রূপ ঐক্য মুসলিমদের মাঝে নেই। অথচ মুসলিমদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কাজটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আরোপিত ফরজ বিধান। অনৈক্য ইসলামে শতভাগ হারাম। হারাম হলো, হামলাকারি কাফের বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করা। অথচ সূদ-ঘুষ ও পতিতাবৃত্তির ন্যায় সে হারাম চর্চা বেড়েছে প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে। তাই ইরাকের উপর হামলা ও সেদেশে মুসলিম হত্যার লক্ষ্যে যখন মার্কিন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে ডাক পড়লো -তখন তাঁবেদার ভৃত্যের ন্যায় সে ডাকে সাড়া দিল বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিশরসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশ।
যে আগ্রাসন অনিবার্য
মুসলিম বিশ্বের, বিশেষ করে আরব বিশ্বের, সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ যেমন তেল, তেমনি সকল সমস্যার মূল কারণও হলো এই তেল। তেল সম্পদ আরব ভূমিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হামলার লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করেছে। আরবদের মর্যাদা না বাড়িয়ে সে সম্পদ দাসত্বের জিঞ্জির পড়িয়েছে। বিশাল তেল সম্পদের কারণেই এ মুসলিম ভূমিতে সাম্যাজ্যবাদীরা পৃথিবীর অপর গোলার্ধ থেকে ছুটে আসছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের পর মুসোল ও কিরকুকের বিশাল তেল খনি দেশটিতে ডেকে এনেছিল বৃটিশের সাম্রাজ্যবাদী শাসন। ইরাক এখনও বিশ্বের দ্বিতীয় তেল উৎপাদনকারি দেশ। ফলে বিপদ থেকেই গেছে। নিরীহ মেষ শাবক দেখে ছুটে আসে যেমন ক্ষুদার্ত নেকডে, ইরাকের তেল সম্পদ দেখে তেমনি ধেয়ে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, দেশটির প্রতিদিন প্রয়োজন পড়ে ২০ মিলিয়ন ( দুই কোটি) ব্যারেল। খাদ্য ছাড়া প্রাণ অচল, তেমনি তেল ছাড়া মার্কিনীদের অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রাও অচল। তেল ভিন্ন তাই বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের সামর্থ্য আসবে কী করে? ফলে এ তেল ক্ষেত্র দখলে রাখার প্রয়োজনটি বিশাল। ইরাকের তেলের উপর একক দখলদারি থাকার কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর উপর ইঙ্গোমার্কিনীদের বিজয় সহজতর হয়। বাস্তবতা হলো, মার্কিনীদের প্রতিদিন দুইকোটি ব্যারেল তেলের জোগানদানের সামর্থ্য সৌদি আরবের নেই। এমন তেল ভান্ডার তাদের নিজ ভূমিতেও নেই। তাছাড়া সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ নিয়ে মার্কিনীরা এমনিতে উদ্বিগ্ন। তারা চিন্তিত, এ দেশ থেকে তাদের তেলের জোগান কতটা বহাল থাকবে -তা নিয়ে।
দস্যুকে বাঁচতে হয় লাগাতর দস্যুবৃত্তি নিয়ে। নইলে তার ঠাটবাট ও সংসার চলে না। ফলে দস্যুর জীবনে ডাকাতি তাই সংস্কৃতি ও নেশায় পরিণত হয়। তেমনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে তার দম্ভ নিয়ে বাঁচতে নানা দেশে আগ্রাসনে নামতে হয়। ম্যালেরিয়ার জীবাণূ শরীরে ঢুকলে জ্বরের কাঁপুনি অনিবার্য; তেমনি চেতনায় সাম্রাাজ্যবাদ বাসা বাঁধলে শুরু করে অন্যের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন। নতুন ক্ষেত্র সে খুঁজবেই। জর্জ বুশ, টনি ব্লেয়ার বা ভ্লাদিমির পুটিনের মধ্যে এ ক্ষেত্রে তাই সামান্যতম পার্থক্যও নেই। বনের সব বাঘই একই চরিত্রের। তেমনি অবস্থা সকল সাম্রাজ্যবাদীরও। তাই মুসলিম ভূমিতে যতদিন সম্পদের ভান্ডার থাকবে, ততদিন থাকবে সাম্রাজ্যবাদী হামলার বিপদও। তাই ইরাক বা আফগানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রথম হামলা যেমন নয়, তেমনি শেষ হামলাও নয়।
ডাকাত পল্লীতে সম্পদশালী থাকাটাই বিপদ। একই রূপ বিপদ, সাম্রাজ্যবাদ কবলিত এ বিশ্বে সম্পদশালী থাকাটিও। মুসলিম উম্ম্হার বড় বিপদ একারণেই। এজন্যই অতি প্রয়োজন হল প্রতিরক্ষার সদাপ্রস্তুতি ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য। সেরূপ একটি সদা-প্রস্তুতির হুকুম এসেছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। পবিত্র কোর’আনে বলা হয়েছে, ‘‘ওয়াদ্দালাহুম মাস্তাতাতুম বিল কুউয়া।’’ অর্থ: ‘‘তাদের বিরুদ্ধে সদা প্রস্তুতি নাও সর্বশক্তি দিয়ে।’’ –(সুরা আনফাল আয়াত ৬০)। শুধু প্রস্তুতিই ফরয নয়, সে সাথে অপরিহার্য হলো একতা। ইসলামে পরস্পরে একতাবদ্ধ হওয়াটি নামায-রোযার ন্যায় ফরজ। ঐক্য বুঝাতে বলা হয়েছে, ‘‘কা আন্নাহুম বুনইয়ানুম মারসুস’’ অর্থাৎ সীসা ঢালা দেওয়ালের ন্যায় অটুট। এবং আরো বলা হয়েছে, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তারা প্রিয় যারা যুদ্ধ করে তার রাস্তায় সীসী ঢালা প্রাচীরের ন্যায়। তাই মহান আল্লাহতায়ালার বড় অবাধ্যতা শুধু নামায-পরিত্যাগ করা নয়, সেটি হলো শত্রুর বিরুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত না রাখা। এবং সে সাথে বিভক্ত থাকাটিও। এরূপ অবাধ্যতা মহাপাপ। এমন পাপ কাফের শত্রুর অধিকৃতির ন্যায় ভয়ানক আযাব ডেকে আনে। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব আজ মূলত সে আযাবেরই শিকার।
লক্ষ্য: জনগণকে শক্তিহীন ও অধিকারহীন রাখা
মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের পররাষ্ট্র ও সামরিক নীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: এক). মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের উপর অব্যাহত আধিপত্য। দুই). সম্পদের উপর তাদের খলিফা স্বৈরাচারি শাসক গোষ্ঠির পাহারাদারি এবং রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা থেকে জনগণকে দূরে রাখা। সে লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে মধ্যপ্রাচ্যে -বিশেষ করে তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোতে অসম্ভব করে রাখা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোটভূক্ত দেশগুলো এ লক্ষ্যে আপোষহীন। আরব জগতে স্বৈরাচার-বিরোধী যে গণ-আন্দোলন হয়েছিল -সেটি একারণেই তাদের ভাল লাগেনি। সে গণ-বিস্ফোরণ থেকে স্বৈরাচার বাঁচাতে পরিকল্পিত ভাবেই সে জোয়ার আর বেশী দূর এগোতে দেয়নি। মিশরবাসীর জন্য যে অভূতপূর্ব অধিকার অর্জিত হয়েছিল সেটি তারা দ্রুত নস্যাৎ করে দেয়। সামরিক ক্যু’র মাধ্যমে সে দেশের ইতিহাসে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট ড. মহম্মদ মুরসীকে অপসারণ করা হয় এবং জেলে নিয়ে তাঁকে হত্যাও করা হয়।
লক্ষ্যণীয় হলো, মিশরীয় সামরিক বাহিনীর গণতন্ত্র-বিরোধী সে সন্ত্রাসকে কোন পাশ্চাত্য শক্তিই নিন্দা করেনি। নিন্দা করেনি প্রেসিডেন্ট ড. মুরসীর হত্যাকেও। অতএব এ হলো তাদের গণতন্ত্রপ্রেম। অপর দিকে তারা রাজি নয় ইরাক থেকে তাদের সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণ রূপে তুলে নেওয়ায়। রাজি নয় জাতিসংঘ নীতিমালাকে মানতেও। বরং নিজেদের সামরিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে লাগাতর ব্যবহার করছে জাতিসংঘকে। সত্য তো এটাই, জাতিসংঘের কাজ দাঁড়িয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সকল কুকর্মকে নিন্দা না করে বরং স্বীকৃতি দেওয়া। তাই ইঙ্গো-মার্কিন বাহিনী যখন ইরাক ও আফগানিস্তান দখল করলো এবং দেশ দুটির লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করলো – সে রক্তাত্ব আগ্রাসনকে নিন্দা না করে জাতিসংঘ সেটিকে বৈধতা দিয়েছে। সে বৈধতার সূত্র ধরেই মার্কিন বাহিনী দাবী করে, ইরাকে তাদের অবস্থান অবৈধ নয়। তারা সেখানে আছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে।
আরো লক্ষণীয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতই সাম্রাজ্যবাদী হানাদার চরিত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে ততই প্রকাশ পাচ্ছে বিশ্বের মেরুদন্ডহীন মুসলিম নেতৃত্ব। এরা শুধু অযোগ্য, শক্তিহীন এবং বিভক্তই নয়, বিবেকহীনও। ইরাকের উপর হামলা যে একটি অতি অন্যায় ও অপরাধমূলক কাজ -সেটি বুঝতেও কি বড় রকমের কান্ডজ্ঞান লাগে? অথচ সে কান্ডজ্ঞানের প্রমাণ এ স্বৈরশাসকগণ রাখতে পারেনি। তাই কোন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের মুখ থেকে এ হামলার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ শোনা যায়নি। ব্যর্থতা শুধু মুসলিম দেশগুলির সরকারেরই নয়, জনগনেরও। কোন মুসলিম রাজধানিতে এমন হামলার বিরুদ্ধে বড় রকমের কোন বিক্ষোভও আয়োজিত হয়নি। যেগুলি হয়েছে তার কোনটিই বিশাল আকারের নয়। বরং যতগুলো বৃহৎ বিক্ষোভ আয়োজিত হয়েছে তার সবগুলোই হয়েছে অমুসলিম দেশে। এবং সেগুলীর আয়োজকও ছিলেন অমুসলিমেরা।
ইরাকে হামলার বিরুদ্ধে ২০ লাখ মানুষের মিছিল হয়েছে লন্ডনে। ৩০ লাখ মানুষের মিছিল হয়েছে ইটালীর রাজধানী রোমে। সে তুলনায় করাচী, ঢাকা, কায়রো, জাকার্তা ও ইস্তাম্বুলের মত নগরীতে দশ ভাগের এক ভাগ সমাবেশও হয়নি। অথচ এ নগরগুলোর লোকসংখ্যা লন্ডন ও রোমের চেয়ে অধিক। প্রতিটি নগরে প্রায় কোটি লোকের বাস। একটি মুসলিম দেশের উপর অন্যায় হামলা হতে যাচ্ছে – সেটি জেনে তার বিরুদ্ধে এসব নগরগুলোর প্রতিটিতে যদি দশ লক্ষ মানুষের সমাবেশ হতো -তবে মুসলিম উম্মাহ এরূপ হামলাকে কতটা ঘৃনা করে সেটির প্রমাণ মিলতো। কিন্তু সে ঘৃণা প্রকাশ পায়নি। বরং উল্টোটি হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্র-প্রধান ও নেতারা মার্কিন প্রশাসনের কাছে বিশ্বাসভাজন হওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অথচ মার্কিন জোটের হামলায় নিহত ও আহত হয়েছে লক্ষাধিক ইরাকী ও আফগান নাগরিক, ভস্মিভূত হয়েছে হাজার হাজার কোটি ডলারের সম্পদ এবং শৃঙ্খলিত হ মুসলিম উম্মাহর একটি বিরাট অংশ। এমন হামলায় সামান্যতম সহযোগিতাও হারাম। অবকাশ নেই নিরপেক্ষ থাকার। কিন্তু এ নিয়ে কি মুসলিম নেতৃবৃন্দের কোন ভাবনা আছে কী? আর থাকলে তার প্রকাশ কই? পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, মুসলিম মাত্রই পরস্পরের ভাই। এক ভাইয়ের ব্যাথা অপর ভাই অনুভব করবে -সেটিই তো কাঙ্খিত। অথচ সে অনুভবই যার নেই -তাকে কি ভাই বলা যায়? ভাতৃত্ববোধ না থাকলে তাকে মুসলিমই বা বলা যায় কি করে? ইরাক ও আফগানিস্তানের মুসলমিদের সে দুঃসহ ব্যাথা অনুভব দূরে থাক, কিভাবে তা বাড়ানো যায় -তা নিয়ে হামলাকারি মার্কিন বাহিনীর সাথে জর্দান, কুয়েত, সৌদিআরব, বাহরাইন, তুরস্ক, পাকিস্তান, ইয়েমেন, ওমান, কাতারের সরকারগুলো বরং সহযোগীতা করতে উদগ্রীব। নিজ ভূমিতে তারা ঘাঁটি নির্মাণের অধিকার দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। প্রতিবশীর ঘরে হামলায় দস্যুকে সহায়তা দানের ন্যায় এরাও সহায়তা দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের। নিজ নাগরিকদের ধরে ধরে কাফেরদের হাতে তুলে দিচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ এভাবে নির্মম নির্যাতনের শিকার হচেছ গোয়ান্তোনামো বে’র ন্যায় কারাগারে।
গোলামী মানসিকতায় আচ্ছন্ন মানুষের কাছে স্বাধীনতার মূল্য সামান্যই। দূর্বৃত্ত সর্দারের পার্শ্বচর হওয়ার ন্যায় এরাও সাম্যাজ্যবাদী শক্তির কাছে বিশ্বস্থ থাকাকে জীবনের বড় অর্জন মনে করে। এক কালে ভারতে কিছু মুসলিম নামধারি ব্যক্তির বৃটিশ স্বার্থের প্রতি বিশ্বস্থ্যতা এতই প্রগাঢ় ছিল যে, বৃটিশেরাও তাতে মোহিত হতো। এমনকি তাদেরকে স্যার বলতো বা নানা উপাধিতে ডাকতো। একই ভাবে মার্কিনীদের কাছে বিশ্বস্থ হওয়ার প্রগাঢ় আগ্রহ বেড়েছে মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝে। এমন বিশ্বস্থ হওয়াকে তারা জাতীয় মান-সম্মান নির্ণয়ের মানদন্ডে পরিণত করেছে। সম্প্রতি এমন গোলামী মানসিকতার উলঙ্গ প্রকাশ ঘটেছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন বিভাগ যে কয়টি দেশের নাগরিকের উপর কড়া নজর রাখার ঘোষণা দিয়েছে তাদের মধ্যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নামও রয়েছে। রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবসহ আরো প্রায় বিশটি দেশের নাম। এসব দেশের নাগরিকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকালে টিপসই দিতে হবে, নিয়মিত পুলিশ দফতরে হাজিরা দিতে হবে এবং ঠিকানা পরিবর্তন করলে তা অতিসত্বর সরকারকে জানাতে হবে। তা নিয়েই পাকিস্তান ও বাংলাদেশে প্রচন্ড আলোড়ন। “ইজ্জত গেল, ইজ্জত গেল” – আওয়াজ উঠেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের সাবেক বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সে সময় খালেদা জিয়া সরকারের পদত্যাগেরও দাবী তুলেছিলেন।
জর্জ বুশের ক্রসেড
মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ যে ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়েছেন -সেটি কোন গোপন বিষয় নয়। তিনি সে কথাটি অতি প্রকাশ্যে বলেছেন। মিডিয়াতেও সেটি এসেছে। ইতিহাসে ক্রুসেডের একটি নিজস্ব পরিচিতি আছে। সেটি হলো, মুসলিম ভূমিতে ভয়ানক যুদ্ধ, মুসলিম বিরোধী গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ এবং শত বছরের আধিপত্য। তিনি একথাও বলেছেন, “এ যুদ্ধে অন্যদের অবস্থান হয় আমাদের পক্ষে, না হয় আমাদের বিপক্ষে।” এ মুসলিম বিরোধী ক্রুসেডে তিনি মুসলিমদেরকে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ দেননি। অতএব যারা তার স্বঘোষিত ক্রুসেডে মার্কিনীদের পক্ষে অস্ত্র ধরবে না -তাদেরকে শত্রু পক্ষ ভাবা এবং তাদের উপর কড়া নজর রাখাই হবে মার্কিন নীতি। এ নিয়ে একজন ঈমানদারের করণীয় কি থাকতে পারে? তাছাড়া সে ক্রুসেডের একটি পর্ব চলছে আফগানিস্তানে, দ্বিতীয় পর্ব ইরাকে ও তৃতীয় পর্ব শুরু হয়েছে সিরিয়ায়। হয়তো এর পর হবে অন্য কোন মুসলিম দেশে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ন্যায় মুসলিম দেশের সেক্যুলারিষ্টগণ না জানলেও মার্কিনীরা ঠিকই জানে, কোন ঈমানদারই তাদের মুসলিম বিরোধী এ ক্রুসেডে সহযোগী হবে না। ইসলামে এটি শতভাগ হারাম। মুসলিমের ঈমান তাঁকে আল্লাহ ও মুসলিম স্বার্থে বিশ্বস্থ ও অঙ্গিকারবদ্ধ করে; মার্কিন স্বার্থের প্রতি নয়। ফলে যার হৃদয়ে ঈমানের স্পন্দন আছে, মার্কিনীরা তাকে অবিশ্বাস করবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? আর সে জাগ্রত চেতনা এখন মুসলিম বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিমের মনে। বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের এ সন্দেহজনক নীতি এটিই প্রমাণ করে, বাংলাদেশ যে একটি মুসলিম অধ্যুাষিত দেশ -সেটি তাদের কাছে স্বীকৃত। দেশটি ইসরাইল নয়, হিন্দুস্থানও নয়। অথচ তেমন এক প্রেক্ষাপটে মুসলিম স্বার্থে অঙ্গিকারহীন সেক্যুলারিষ্টগণ মার্কিন স্বার্থের প্রতি তাদের অঙ্গিকার প্রমাণ করতে উদগ্রিব। ইসলামে অঙ্গিকারহীন অথচ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে নিবেদিত এমন নেতৃত্ব বস্তুত এখন প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে। নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষ পুরণে অমুসলিম কাফের শক্তির নিজ দেশে আগ্রাসনে আহবান করা ও তাদের অস্ত্র নিয়ে মুসলিম হত্যার ইতিহাস গড়ার ঐতিহ্য এদের অনেকেরই। এমন গাদ্দারেরাই মার্কিন বাহিনীকে দাওয়াত দিয়েছিল আফগানিস্তান ও ইরাক দখলে। মুসলিম বিশ্বে হামলা ও আধিপত্যের দিন, ক্ষণ ও প্রেক্ষাপট এজন্যই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের কাছে এতটা উপযোগী। তাই বিপদ শুধু বিদেশী শত্রুর কারণে বাড়ছে না, বাড়ছে ঘরের শত্রুর কারণেই। তাই আগ্রাসনের শিকার শুধু আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মির বা লেবানন নয়, তেমন একটি আগ্রাসনের মুখে সমগ্র মুসলিম উম্মাহও। লন্ডন: ১ম সংস্করণ ০৫/০৫/২০০৭; ২য় সংস্করণ ২৯/১২/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018