বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজাকার ও মু্ক্তিযোদ্ধা

কারা রাজাকার ও কারা মুক্তিযোদ্ধা?

একাত্তরে ভারত এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে। এক). পাকিস্তানকে ভেঙ্গেছে। দুই). বাংলাদেশকে গোলাম বানিয়েছে। এ পথেই ভারত বিপুল শক্তি অধিকারি হয়েছে। ফলে মনযোগ দিতে পারছে কাশ্মীর দখলে এবং ভারতের ২০ কোটি মুসলিমের কোমর ভাঙ্গাতে। ভাঙ্গার কাজের শেষ আছে। কিন্তু গোলাম বানানোর কাজের শেষ নাই; এটি লাগাতর অব্যাহত রাখার যুদ্ধ। গোলাম বানানোর পাশাপাশি এখানে রয়েছে শোষণের নেশাও। ফলে বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের যুদ্ধের শেষ নাই। বস্তুতঃ ভারতের যুদ্ধটি বাংলাদেশকে অধীনত রাখার এক অবিরাম যুদ্ধ। একাত্তরে বাংলাদেশকে গোলাম বানানোর কাজ ভারত একা করেনি। সে গোলামী অব্যাহত রাখার যুদ্ধেও ভারত আজ একাকী নয়। আজ  যারা বাংলাদেশের নদীর পানি, সমুদ্রবন্দর, গ্যাস, করিডোর ভারতকে দিচ্ছে তারাই একাত্তরে ভারতীয় প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে ভারতের পক্ষে যুদ্ধে নেমেছিল। এরাই হলো একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা। ভারতের চলমান এ যুদ্ধে তাদের প্রয়োজনও তাই শেষ হয়নি। ভারতীয়দের একাত্তরের সে ষড়যন্ত্র অধিকাংশ বাঙালী টের না পেলেও কিছু বাঙালী শত ভাগ টের পেয়েছিল। তারাই সেদিন ভারতীয়দের মোকাবেলায় যুদ্ধে নেমেছিল। এরাই হলো একাত্তরের রাজাকার। প্যান-ইসলামিজম ও ভারতীয় আধিপত্য থেকে মুক্তির প্রতি আপোষহীনতার কারণে রাজাকারদের চিনতে ভারতীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনী যেমন একাত্তরে ভূল করেনি, এখনো করছে না। ফলে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলাটি আজও তাদের কাছে হত্যাযোগ্য অপরাধ রূপে গণ্য হচ্ছে। বুয়েটের আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে লাশ বানালো তো সে অপরাধেই।   

মিথ্যাচার, দূর্নীতি ও স্বৈরাচারের নাশকতাগুলি বিশাল। এগুলি কখনোই একাকী আসে না। আনে চেতনা, দর্শন ও নৈতিক রোগের মহামারি। তাতে মৃত্যু বরণ করে জনগণের বিবেক। বিনষ্ট হয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি। মিথ্যা বলা বা মিথ্যা লেখাও তখন অভ্যাসে পরিণত হয়। দেশের ইতিহাসও তখন মিথ্যাচারে পূর্ণ হয়। এতে মৃত্যু ঘটে বিবেকের; প্রতিষ্ঠা পায় ব্যক্তিপূজা। ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তগণও তখন ভগবানে পরিণত হয়। তাছাড়া শুধু শাসক রূপেই শুধু নয়, ইতিহাসের পাতায়ও স্বৈরচারী দুর্বৃত্তদের বাঁচার খায়েশটি বিশাল। এ কারণে বিস্তর মিথ্যাচার ঢুকে ইতিহাসে। একাত্তরের ইতিহাসের বিশাল অংশ জুড়ে তাই মুক্তিযুদ্ধের গুণকীর্তন। কিন্তু রাজাকারদের নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা নেই; উল্লেখ আছে স্রেফ ভিলেন রূপে। চিত্রিত হয়েছে পাকিস্তানের দালাল রূপে। কিন্তু দালালের কর্মে থাকে অর্থপ্রাপ্তির লোভ, এবং তাতে মনের সম্পর্ক থাকে না। প্রাণদানের স্পৃহাও তাতে  জাগে না। বাংলাভাষী হলেও প্রতিটি রাজাকার ছিল জন্মসূত্রে পাকিস্তানী; তারা মুক্তিবাহিনীর প্রতিপক্ষ রূপে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানের গর্বিত ও নিষ্ঠাবান নাগরিক রূপে। কথা হলো, নিজ জন্মভূমির পক্ষে নামলে তাদেরকে কি দালাল বলা যায়? কিন্তু একাত্তরের ইতিহাসে রাজাকারের সে পরিচয়টি আলোচিত হয়নি। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য প্রশ্ন থেকে যায়, কারা এ রাজাকার? কি ছিল তাদের মিশন? কেনই বা বাঙালী হয়েও তারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় প্রাণপনে বিরোধীতা করলো এবং রক্ত দিল? কি ছিল তাদের রাজনৈতিক দর্শন? কিসে তারা অনুপ্রাণিত হলো? শুধু আজ নয়,বহুশত বছর পরও এ প্রশ্নগুলি বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠকের মনকে আন্দোলিত করবে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের উত্তর নাই। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝতে হলে কারা রাজাকার এবং কারা মুক্তিযোদ্ধা এবং একাত্তরে কি ছিল তাদের চিন্তাচেতনা -তা নিয়ে  বস্তুনিষ্ট আলোচনা অতি গুরুত্বপূর্ণ। মিথ্যা প্রপাগান্ডা দিয়ে এ বিষয়টিকে আড়াল করলে দেশেরই ক্ষতি বাড়বে এবং লাভবান হবে শত্রুরা।   

রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা –উভয়েই একাত্তরের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পক্ষ। যে কোন যুদ্ধে দুটি পক্ষ থাকে, সেটি একাত্তরেও ছিল। ইতিহাসের অর্থ স্রেফ একটি পক্ষের ধারাবিবরণী নয়। একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল রাজনীতির দুটি বিপরীত ধারা ও দুটি বিপরীত দর্শনের সংঘাত। প্রতিদেশেই রাজনীতি নিয়ে এরূপ নানা মত থাকে, নানা প্রতিপক্ষও থাকে। সেসব মত ও পথ নিয়ে লড়াইও থাকে। কারণ, দেশের কল্যাণ নিয়ে সবাই একই ভাবে ভাবে না। বিপরীতমুখি নানা ভাবনা যেমন ১৯৭১ সালে ছিল, তেমনি ১৯৪৭ সালেও ছিল। আজ যেমন আছে, তেমনি আজ থেকে শত বছর বা হাজার বছর পরও থাকবে। এর মধ্যে কেউ হারবে এবং কেউ জিতবে। ইতিহাসে কারো বিজয়ই চিরস্থায়ী হয় না। দিন বদলের সাথে সরকারেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু কোন একটি পক্ষের পরাজয় বা বিদায় হলে সে পক্ষের ইতিহাসকে বিলুপ্ত করা যায় না। তাদের জন্যও ইতিহাসে স্থান ছেড়ে দিতে হয়। ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ জিতেছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালে তারা হেরেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস পড়লে মনে হয় দেশটির ইতিহাসের শুরুটি ১৯৭১ থেকে; বড় জোর ১৯৫২ সাল থেকে। এ ইতিহাসে ১৯৪৭ সালের নায়কদের জন্য স্থান রাখা হয়নি। কারণ তা হলে কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, নবাব সলিমুল্লাহ, খাজা নাযিমুদ্দীন, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আকরাম খাঁ, নূরুল আমীন, মহম্মদ আলী বোগরা, মৌলভী তমিজউদ্দীন খান, আব্দুর সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী  ন্যায় শত শত ব্যক্তিকে ইতিহাসে স্থান দিতে হয়। আর সেটি হলে ইতিহাসের বইয়ে শেখ মুজিবের ন্যায় ১৯৭১’য়ের নায়কদের জন্য স্থান বহুলাংশে কমে যায়। মুজিবের অনুসারিগণ সে ছাড় দিতে রাজী নয়। মুজিবের অনুসারিদের লড়াই তাই স্রেফ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল নিয়ে নয়, ইতিহাসের দখলদারি নিয়েও। বাংলাদেশের ইতিহাস  তাদের হাতেই অধিকৃত। স্বৈরাচারী রাজনীতির এ হলো আরেক কুফল।

বাংলাদেশে পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু করেছে ভারতের সাহায্যপুষ্ট একাত্তরের বিজয়ী পক্ষ। ইতিহাস রচনার নামে তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থী নেতাদের গায়ে লাগাতর কালিমা লেপন। ফলে রাজাকারকে চিত্রিত করেছে যুদ্ধাপরাধি রূপে; এবং নিজেদেরকে চিত্রিত করেছে দেশের সর্বকালের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান রূপে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কোন মানুষ খুন, ধর্ষণ, গৃহ-লুট বা অন্য কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে -ইতিহাসে তার বিন্দুমাত্র বিবরণও নেই। লক্ষাধিক বিহারী, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থীদের মৃত্যু হয়েছে যেন আসমান থেকে বাজ পড়ায়। তাদের ঘরবাড়ি, ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ লুট হয়েছে যেন কোন অজানা কারণে! বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের উত্তর নাই। দেশের ইতিহাস তো এভাবেই পক্ষপাতদুষ্ট হয়, পরিত্যক্ত হয় এবং আঁস্তাকুড়ে গিয়ে পড়ে। প্রতিটি ব্যক্তির রাজনীতি, কর্ম ও আচরণ পরিচালিত হয় তার চিন্তা-চেতনা ও দর্শন থেকে। এমনকি অতিশয় দুর্বৃত্তও দুর্বৃত্তিতে অনুপ্রেরণা পায় জীবন-জগত নিয়ে তার বিশেষ ধ্যান-ধারণা থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার সে উৎসটি কি? রাজাকারগণই বা কোত্থেকে পেল সে চরম দুর্দিনে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা? বাংলাদেশের ইতিহাসে সে সবেরও উত্তর নেই। কিন্তু সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া কি এতোই কঠিন? ভিলেন রূপে নয়, রাজাকারদেরকে রাজাকার রূপে দেখলে সে উত্তরটি অতি সহজেই পাওয়া যেত।

 

লড়াইটি দর্শনের

১৯৭১’য়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দু’টি দর্শন প্রবল ভাবে কাজ করেছিল। একটি হলো প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন-এ থেকেই জন্ম নিয়েছিল অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচানোর চেতনা। এটিই হলো রাজাকারের চেতনা। অপরটি ছিল ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার দর্শন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনার উৎস হলো এটি। একাত্তরের ঘটনাবলীর যথার্থ বিশ্লেষণে এ দু’টি চেতনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে এবং ঘটনার মূল্যায়নে সে দু’টিকে সামনে রাখতে হবে। নইলে বিচারে প্রচণ্ড অবিচার হবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কর্ম, আচরণ, রুচীবোধ ও রাজনীতিতে যে ব্যাপক পার্থক্য -তা তো এই চেতনার পার্থক্যের কারণেই; খাদ্য-পানীয়, শারীরিক বৈশিষ্ট বা জলবায়ুর কারণে নয়। তাই একই রূপ পানাহার ও জলবায়ুতে বেড়ে উঠে কেউ রাজাকার হয়েছে এবং কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। ব্যক্তি ক্ষণজন্মা, কিন্তু চেতনা বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর। তাই আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন বেঁচে আছে, তেমনি বেঁচে আছে রাজাকারের চেতনাও। এ দু’টি চেতনা ১৯৭১য়ে যেমন ছিল, তেমনি একাত্তরের পূর্বে ১৯৪৭য়েও ছিল। তেমনি বহু শত বা হাজার বছর পরও থাকবে।

ব্যক্তির চরিত্র, চেতনা ও রাজনৈতিক নীতিমালার নির্মাণে যেটি কাজ করে সেটি হলো একটি জীবন-দর্শন। মানব জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো এ দর্শন। দর্শন বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে। সেটি যদি হয় ইসলামী দর্শন, তবে তা তো অমর। তাই সমাজতন্ত্র ও কম্যুনিজমের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলেও ইসলাম টিকে আছে এবং দিন দিন প্রবলতর হচ্ছে। ব্যক্তি তার দর্শন থেকেই কর্মে, ত্যাগে ও প্রাণদানে প্রেরণা পায়। রাজাকারের চেতনায় সে দর্শনটি ছিল ইসলামের। সে দর্শন থেকেই তারা পেয়েছিল প্যান-ইসলামী চেতনা; পেয়েছিল মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার। ফলে রাজাকারদের রাজনীতিতে ভাষা, বর্ণ বা আঞ্চলিকতা কোনরূপ গুরুত্ব পায়নি। ফলে একাত্তরে বাংলা ভাষার নামে যখন পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ হচ্ছিল, তখন রাজাকারগণ সে লড়ায়ে যোগ দেয়নি। বরং সে সময় বহু হাজার বাঙালী রাজাকার পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় প্রাণ দিয়েছে। তারা মুজিব সরকারের জেল খেটেছে এবং মুক্তিবাহিনীর হাতে নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছে। তাদের সে ত্যাগের পিছনে যে দর্শনটি কাজ করেছিল সেটি ছিল মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন। সে দর্শনে ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা ভূগোলভিত্তিক বিভেদের প্রাচীর গড়ার বৈধতা নেই।বরং বিভেদের দেয়াল ভাঙ্গাটি তাদের কাছে ইবাদতে পরিণত হয়েছে। এমন দর্শনের প্রতিষ্ঠায় তারা অর্থ, শ্রম ও রক্তও দিয়েছে।

রাজাকারের দর্শনের জন্মটি একাত্তরে নয়, সাতচল্লিশেও নয়। এ দর্শনের জন্ম তো তখন, যখন ইসলাম সমগ্র মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে একমাত্র ধর্ম রূপে নির্ধারিত হয়েছিল। এ ধর্ম বিভেদের দেয়াল ভাঙ্গতে শেখায়। বিভক্তির সে দেয়াল ভেঙ্গেই আরব, ইরানী, তুর্ক, কুর্দ, মুর ও অন্যান্য ভাষাভাষী মুসলিম ইসলামের পতাকা তলে একতাবদ্ধ হয়েছিল এবং উম্মতে ওয়াহেদার জন্ম দিয়েছিল। এটিই তো ইসলামের রীতি। রাজাকারগণ ছিল সে রীতির অনুসারি। শুধু একাত্তরে নয়, সর্বকালে ও সর্বস্থানে সে রীতি নিয়ে বাঁচাই হলো প্রকৃত ঈমানদারী। ইসলামের এ দর্শন বাঙালী মুসলিমদের মাঝে লক্ষ লক্ষ নিষ্ঠাবান অনুসারি পাবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? একাত্তরে তো সেটিই ঘটেছিল। একাত্তেরর এ সত্যটি আবিস্কারে বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ ব্যর্থ হয়েছে।

ব্যক্তির মন যা জানে না,তার চোখও সেটি দেখতে পায় না। চোখ তো তখনই দেখে যখন তার পিছনে আলোকিত মন কাজ করে।মনের অন্ধকারে তাই চোখও অন্ধ হয়। মহান আল্লাহতায়ালার কুদরত দেখতে হলে তাই জ্ঞানবান মন চাই।তাঁর সৃষ্ট বিশাল জগতে বসবাস করেও বেঈমানেরা তাই তাঁর কুদরত দেখতে ব্যর্থ হয়।অজ্ঞের পক্ষে তাই ঈমানদার হওয়া অসম্ভব।ইসলামে তাই জ্ঞানার্জন প্রথমে ফরজ করা হয়েছে, নামায-রোযা বা হজ-যাকাত নয়।একই কারণে ইসলামী চেতনাশূণ্য সেক্যুলারিস্টগণ তাই রাজাকারদের দর্শনের বলটি দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ এবং সে সাথে নিজের দেশ বাঁচাতে যে ধর্মপ্রেমিক ও দেশপ্রেমিক মানুষগুলো অকাতরে প্রাণ দিল -তাদের কাছে তারা অর্থলোভী দালাল ও যুদ্ধাপরাধী মনে হয়েছে!  

 

ভারতের লক্ষ্যপূরণ

বাঙালী জাতীয়বাদীদের দর্শনটি ছিল ভাষা ও আঞ্চলিকতার নামে মুসলিমদের মাঝে বিভক্তির দেয়াল গড়ার দর্শন। এটি ছিল পাপের পথ। ইসলামে এমন বিভক্তি যেমন হারাম, তেমনি শরিয়তের আইনে দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ। মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণ ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদীর অনুসারি; তাদের কাছে প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনাটি পরিত্যক্ত হয়। এমন নীতি কাফেরদের থেকে সমর্থণ পাবে –সেটি স্বাভাবিক; কিন্তু কোরঅআন-হাদীস বা নবীজীর সূন্নাহ থেকে নয়। তাই একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর আশ্রয়দাতা, সাহায্যদাতা, প্রশিক্ষণদাতা ও একান্ত বন্ধু গণ্য হয় ভারতীয় কাফেরগণ, কোন মুসলিম দেশ নয়। ভারতীয় এজেন্ডা রাজাকরগণ বুঝতে পারলো, মুক্তিবাহিনীর নেতাকর্মীগণ তা ইচ্ছে করেই বুঝতে চাইনি। ভারতের লক্ষ্য ছিল, প্রধান শত্রু পাকিস্তানকে খন্ডিত ও দুর্বল করা। সে সাথে বিচ্ছিন্ন পূর্ব পাকিস্তানের সহায়-সম্পদ লুন্ঠন। ভারতীয়দের সে লুন্ঠনে বাংলাদেশ পরিণত হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি। দুর্ভিক্ষে মরতে হয় বহু লক্ষ বাংলাদেশীকে। পরিতাপের বিষয় হলো, ভারতের সে লক্ষ্য পূরণে মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণ তাদের থেকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নেয়; এবং মুসলিম হত্যায় যুদ্ধে নামে। লক্ষাধিক অবাঙালী মুসলিমকেই শুধু নয়, হত্যা করা হয় হাজার হাজার বাঙালী মুসলিমকেও।

লক্ষণীয় হলো, বাংলাদেশের ইতিহাসে একাত্তরের ভারতীয় লুন্ঠন নিয়ে কোন কথা নেই। সেটি নিছক প্রভু ভারতকে খুশি করতে। ইতিহাসের বইয়ের বিশাল অংশ ব্যয় হয়েছে রাজাকারদের হত্যাযোগ্য প্রতিপক্ষ রূপে খাড়া করতে। ভারত চায়, বাঙালী মুসলিমগণ বিচ্ছিন্ন হোক উপমহাদেশের অবাঙালী মুসলিমদের থেকে। সেটি বুঝা যায় ভারত ও ভারতপন্থিদের প্রচারনার ধরণ দেখে। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার কোর’আনী হুকুম হলো, এক মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই -তা যে ভাষা বা যে এলাকারই হোক। অন্য মুসলিমকে নিজের ভাই রূপে মান্যতা দেয়ার মধ্যেই ঈমানদারি। সেটি না হলে বিদ্রোহ হয় মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে। তাই নামায-রোযা পালন করেও এমন বিদ্রোহী ব্যক্তি ব্যর্থ হয় প্রকৃত মুসলিম হতে। অথচ সে ইসলামী চেতনা মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ছিল না। ফলে অবাঙালী মাত্রই তাদের কাছে “ছাতুখোর” শত্রু –এমনকি হত্যাযোগ্য গণ্য হয়েছে। অথচ রাজাকারদের কাছে সেটি মনে হয়নি। যেমন সাতচল্লিশে মনে হয়নি, তেমনি একাত্তরেও নয়। এবং আজ নয়। বরং পাঞ্জাবী, বিহারী, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচ তথা সকল ভাষার মুসলিমগণ গণ্য হয়েছে তার প্রাণপ্রিয় মুসলিম ভাই রূপে। কারণ, সেরূপ গণ্য করাটাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম।-(সুরা হুজরাত, আয়াত ১০)। তাই ঈমানদার কি পারে তার পাঞ্জাবী, পাঠান বা বিহারীকে হত্যা করতে পারে?

অথচ একাত্তরে বহুলক্ষ অবাঙালীকে নিজেদের ঘর থেকে বের করে যেভাবে বস্তিতে বসানো হয়েছে এবং তাদের ঘরবাড়ী, ব্যবসাবাণিজ্য ও সহায়-সম্পদকে যেভাবে ছিনতাই করা হয়েছে -সেটি কোন মুসলিম সংস্কৃতি নয়। মানবতার সংস্কৃতিও নয়। এটি নিতান্তই মুক্তিযুদ্ধের বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি। এমন অপরাধ কর্মের গভীর স্বাদৃশ্য মেলে হিটলারের ফ্যাসিবাদের সাথে। ইসলামে এমন কর্ম শুধু হারামই নয়, শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। সেটি গুরুতর যুদ্ধাপরাধ আন্তর্জাতিক আইনেও। এরূপ বর্বর জাতীয়তাবাদী চেতনার কারণেই জার্মানগণ লক্ষ লক্ষ ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে জ্যান্ত হত্যা করেছে। মুজিব ও তার অনুসারিগণ সে বর্বর ফ্যাসিবাদের আবাদ বাড়িয়েছে বাংলাদেশে। বঙ্গিয় ভূমিতে ইসলাম আগমনের পর এরূপ বর্বর অসভ্যতা আর কোন কালেই প্রতিষ্ঠা পায়নি। একই অসভ্যতা নিয়ে আজ ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি সমর্থন থাকার কারণে রাজপথে পিটিয়ে তাদের লাশের উপর নাচা হচ্ছে।  মুজিব ও তার অনুসারিগণ আর কোন কারণে না হোক, অন্ততঃ এ অসভ্যতার কারণে বাঙালীর ইতিহাসে শত শত বছর বেঁচে থাকবে। অথচ বাঙলার মুসলিম সংস্কৃতিতে এমন অসভ্যতার কি স্থান আছে? বরং এ মুসলিম সংস্কৃতি তো তুর্কি বীর ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী, ইয়েমেনি সুফিসাধক শাহ জালাল, আফগান বীর ঈসা খাঁ’দের ন্যায় নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মুসলিমদের বাংলার বুকে আপন করে নেয়ার সংস্কৃতি।

মহান আল্লাহতায়ালা ব্যক্তিকে ভাষা,বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠতে নির্দেশ দেন। পবিত্র কোরআনে বহু বার ঘোষিত হয়েছে সে নির্দেশ। বলা হয়েছে, “আক্বীমু দ্বীন ওয়ালা তাতাফাররাকূ” –(সুরা শুরা,আয়াত ১৩)। অর্থঃ  দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করো এবং বিভক্ত হয়োনা। বলা হয়েছে, “ওয়া তাছিমু বি হাবলিল্লাহি জামিয়াঁও ওলা তাফাররাকু” -(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৩)। অর্থঃ এবং শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরো আল্লাহর রশি তথা কোর’আনকে এবং বিভক্ত হয়োনা। তাই যে কোন মুসলিম দেশে ভাঙ্গা ও মুসলিমদের মাঝে বিভক্তির দেয়াল গড়ার যুদ্ধটি মূলতঃ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এমন যুদ্ধে পৌত্তলিক কাফেরগণ অর্থ দিবে, অস্ত্র দিবে, প্রশিক্ষণ দিবে এবং নিজ খরচে প্রকাণ্ড যুদ্ধও লড়ে দিবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? একাত্তরে তো ভারত তো সেটিই ঘটেছে। তাই মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষণাও দিতে হয়নি। মুক্তি বাহিনীকে একটি জেলা বা মহকুমাকে স্বাধীন করতে হয়নি। ভারত প্রকান্ড একটি যুদ্ধ নিজে লড়ে বাংলাদেশ বানিয়ে দিয়েছে। তাই বাংলাদেশের জন্মদাতা যে  ভারত তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ থাকে? ভারতীয় কর্তাগণ তো সে কথাটিই বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এবং জন্মদাতা রূপে একটি পর একটি ছিনিয়ে নেয়ার অধিকার দাবী করছে।

মু’মিনের জীবনের এজেন্ডা তাই আল্লাহর প্রদর্শিত শরিয়ত প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠাবান হওয়া এবং বিভক্তি থেকে বাঁচা। ফলে ঈমানদার হওয়ার দায়বদ্ধতা শুধু নামায-রোযা, হজ-যাকাত পালন নয়, মুসলিমদের মাঝে ঐক্য গড়াও। কিন্তু বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের এজেন্ডাটি ঐক্য নয়, বরং ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার পরিচয়ে বিভক্তির দেয়াল গড়া। ফলে বিভক্তির এ রাজনীতি কি আদৌ কোন মুসলিমের রাজনীতি হতে পারে? এটি তো মহাপাপ। এ পাপ ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুণে নেয়। ভাষা,বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠার কারণেই বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বহু হাজার মাইল দূরের ভূমিতে জন্ম নেয়া মুহাম্মদ (সাঃ)কে তারা প্রাণপ্রিয় রাসূল ও তার প্রচারিত ধর্মকে নিজ ধর্ম রূপে গ্রহণ করতে পেরেছিল। নামে মুসলিম হলেও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মাঝে সে ইসলামী চেতনা ও সে ঈমানী দায়বদ্ধতা গুরুত্ব পায়নি। বাঙালী হওয়াটিই তাদের কাছে সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অপরদিকে রাজাকারের জীবনে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের ইসলামী চেতনাটি ধারাবাহিকতা পেয়েছিল। এ চেতনাটি ১৯৪৭’য়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলিমের জীবনে এতোটাই প্রবল ছিল যে, ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা অবাঙালী মুসলিমদের জন্য ঢাকাসহ পূর্ব-পাকিস্তানের বহু নগরে পরিকল্পিত বাসস্থানের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। কারণ তারা ছিল বাংলার মুসলিম ভূমিতে মেহমান।ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা অসহায় অবাঙালীদেরকে সাহায্য করাকে তারা পবিত্র ইবাদত মনে করতো। ভারত থেকে আসা প্রায় ৭০ লাখ মুহাজিরদের প্রতি অভিন্ন ভালবাসা দেখানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানেও। অথচ তেমন একটি মানবিক আচরণ মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মাঝে একাত্তরে দেখা যায়নি। বরং তারা নেমেছে অবাঙালীদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে। বাঙালী মুসলিমের ইতিহাসে একাত্তর তাই ইসলামী চেতনা ও চরিত্রের এক গভীর অধঃপতনের দিন। অবাঙালী মুসলিমের বিরুদ্ধে এরূপ নৃশংস আচরণ সমগ্র মুসলিম ইতিহাসের অতি বর্বর অধ্যায় রূপে বহুহাজার বছর বেঁচে থাকবে -তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? 

 

বিদ্রোহ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে

ঈমানদারকে শুধু ইবাদত নিয়ে বাঁচলে চলে না, তাকে বাঁচতে হয় পারস্পারিক মুসলিম ভাতৃত্বের অটুট বন্ধন নিয়েও। কারণ, সে ভাবে বাঁচতেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনে। ফলে ভাতৃত্বের সে বন্ধন নিয়ে বাঁচার মধ্যেই প্রকৃত ঈমানদারী। অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমও তার কাছে তখন প্রাণপ্রিয় ভাই গণ্য হয়। এমন চেতনার কারণেই অতীতে ইসলামী খেলাফত বাংলাদেশের চেয়ে শতগুণ বৃহৎ ভূমির উপর বিস্তার লাভ করেছিল; এবং সে বিশাল ভূমিতে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে দেয়াল গড়ে উঠেনি। সে ভূগোল বাঁচাতে দেশের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়নি –যেমনটি পাকিস্তান বাঁচাতে একাত্তরে হয়েছে। ঈমানের প্রকাশ তাই শুধু নামায-রোযা, হজ-যাকাতে নয়,বরং সেটির প্রবল প্রকাশ ঘটে প্যান-ইসলামীক ভাতৃত্ব, রাজনীতি ও ভূগোলের মাঝে। যে মুসলিম দেশে সেরূপ ভাতৃত্ব নাই, বুঝতে হবে সে দেশের নাগরিকদের অপূর্ণতা আছে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায়। মুসলিম ভাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন করা বা সে বন্ধনকে অস্বীকার করার অর্থ মুসলিম উম্মাহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া। মুক্তিবাহিনীর বিদ্রোহ তাই শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষিত নির্দেশমালার বিরুদ্ধেও। সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের বিজয় শুধু এ নয় যে, পাকিস্তান ভেঙ্গে তারা বাংলাদেশে গড়তে পেরেছে। বরং তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি হলো, প্যান-ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বিরুদ্ধে নিজেদের বিদ্রোহটি সফল করতে পেরেছে। ইখতিয়ার মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের পর বাংলার মাটিতে এটিই ছিল মহান আল্লাহতায়ালার কোরআনে ঘোষিত প্যান-ইসলামী নীতির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সফল বিদ্রোহ।

প্যান-ইসলামী চেতনার কারণেই বাঙালী মুসলিমের কাছে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের মত অবাঙালী নেতারা ১৯৪৭ সালে আপনজন মনে হত। পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নামে অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু  সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদে তেমন মুসলিম ভাতৃত্ব গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল। বরং সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে তারা একটি ভাষা ভিত্তিক সীমারেখা টেনে দেয়, যারা সে সীমারেখা অতিক্রম করে তাদেরকে শত্রু গণ্য করা হয়। সাতচল্লিশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও একাত্তরের রাজাকারেরা যে অভিন্ন চেতনার ছিল -সেটি বুঝতে ইসলামের শত্রুপক্ষ আদৌ ভুল করেনা। একারণেই মুক্তিযোদ্ধরা শুধু নিরস্ত্র রাজাকার হত্যাতেই আনন্দ পায়নি, আনন্দ পেয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে ১৯৪৭-য়ের পাকিস্তান আন্দোলনের মুসলিম নেতাদের নাম মুছে ফেলতেও। তাদের কাছে বরং অতি আপনজন মনে হয়েছে গান্ধি, নেহেরু, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, চিত্তরঞ্জন সুতোর, জেনারেল ম্যানেক শ’ ও জেনারেল অরোরা ন্যায় ভারতীয় ব্যক্তিত্ব। এমন এক অসুস্থ চেতনার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হল হয়ে গেছে সূর্য সেন হল এবং ইকবাল হল থেকে বিলুপ্ত হয়েছে মহান কবি আল্লামা ইকবালের নাম। অথচ বাংলার মানুষ যদি সাতচল্লিশে কায়েদে আজম, ইকবাল, লিয়াকত আলী খানদের বাদ দিয়ে গান্ধি, নেহেরু, সূর্যসেন, ক্ষুদিরামের পথ ধরতো তবে আজকের বাংলাদেশই প্রতিষ্ঠা পেত না। কাশ্মীরী মুসলিমদের ন্যায় তাদেরও তখন ভারতীয় সৈন্যদের হাতে প্রতিদিন হত্যার শিকার হতে হত এবং মুসলিম রমনীদের ধর্ষিতা হতে হত। হত্যাযোগ্য অপরাধ গণ্য হত গরু কোরবানী ও গরুর গোশতো ভক্ষণ। শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে একটি চেতনা যে মানব মনে কতটা গভীর প্রভাব ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা হলো তার নজির। এ চেতনার ফলে আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে রাজপথে নামা দাড়ী-টুপিধারী বাঙালী যুবকটিও মুক্তিবাহিনীর কাছে হত্যাযোগ্য মনে হয়। এজন্য তাকে পাঞ্জাবী বা বিহারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

ভারত কোন প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর স্বাধীন বাড়াতে অতীতে যুদ্ধ করেনি। সাহায্যও দেয়নি। একাত্তরেও সে লক্ষ্যে যুদ্ধ করেনি।  পাকিস্তান বিভক্ত করতে যুদ্ধ করলেও কাশ্মীরের স্বাধীনতা দিতে তারা রাজী নয়। ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটির বেশী। বাংলার মত প্রায় বিশটির চেয়ে অধীক ভাষা রয়েছে ভারতে। ভাষাগত সে ভিন্নতা নিয়ে সেদেশে বাংলাদেশের মত ২০টি স্বাধীন দেশ নির্মিত হতে পারতো। অথচ তেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারণা ভারতীয় হিন্দুদের মাথায় স্থান পায়নি। ১৯৪৭’য়ে যেমন নয়, আজও  নয়। নানা ভাষার হিন্দুরা ভাষার উর্দ্ধে উঠে ভারতব্যাপী একটি মাত্র রাষ্ট্র গড়ার কারণেই তারা আজ বিশ্বের বুকে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। বাঙালী মুসলিমগণ সেটি পারেনি। ক্ষুদ্রতর ও দুর্বলতর হওয়ার নেশায় কি সেটি সম্ভব? মুসলিম হওয়ার অর্থ তাই শুধু কোরআন পাঠ, নামাজ-রোযা ও হজ-যাকাত পালনও নয়। সেটি ভাষা, বর্ণ ও ভৌগলিকতার উর্দ্ধে উঠে অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমদের সাথে একাত্ব হওয়ার সামর্থ্য। এরূপ একতা  গড়া ইসলামে ফরজ তথা বাধ্যতামূলক। বিজয় ও ইজ্জত আসে তো এরূপ একতার পথেই। নইলে শক্তি লোপ পায়; বিলুপ্ত হয় ইজ্জতও। মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত এবং শক্তিহীন ও ই্জ্জতহীন করার এজেন্ডা তো ইসলামের শত্রুপক্ষের। একাত্তরে সে এজেন্ডা নিয়েই যুদ্ধে নেমেছিল আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনী। মুজিবের এজেন্ডার সাথে ভারতের এজেন্ডাও তখন একাকার হয়ে যায়।

মুক্তিবাহিনীর পিছনে ভারতের অর্থদান, অস্ত্রদান ও প্রশিক্ষণদানের মতলবটি বুঝতে হলে ভারতের এজেন্ডাকে অবশ্যই বুঝতে হবে। ভারত তো চায় তার সীমান্ত্র ঘিরে দুর্বল ভূটান,নেপাল, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাক, শক্তিশালী পাকিস্তান নয়। অথচ একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে বাংলাদেশে বহু বই লেখা হয়েছে। কিন্তু সেসব বইয়ে ভারতীয় সে এজেন্ডাকে আদৌ তুলে ধরা হয়নি। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের বর্তমান ষড়যন্ত্র ও দখলদারি বুঝতে হলে সে বিষয়টি জানা অতি গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস-বিজ্ঞানের গুরুত্ব এজন্যই এতো অধীক। সে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও চেতনার সে পুষ্টি ছাত্ররা কখনোই অংক, বিজ্ঞান বা চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে পায়না। অথচ বাংলাদেশে জ্ঞানার্জনের সে ক্ষেত্রটিও দেশের দেশী ও বিদেশী শত্রুদের হাতে অধিকৃত। ফলে মারা পড়ছে বিবেক। এবং বিবেকের সে মহামারি  শুধু  ছাত্রদের মাঝে সীমিত নয়; ছড়িয়ে পড়েছে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, বিচারপতি ও রাজনীতিবিদদের মাঝেও। এ মৃত বিবেকের মানুষের মাঝে রম রমা হচ্ছে গুম, খুন, লুটপাট ও সন্ত্রাস-নির্ভর রাজনীতি। ফলে দেশে ভোট-ডাকাতি করে ক্ষমতায় বসলেও যেমন বিচার হয় না, তেমন বিচার হয় না কারা দেশের প্রকৃত  বন্ধু এবং কারা শত্রু তা নিয়েও।   

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *