বাংলাদেশের ভূমিতে ভারতের অসমাপ্ত যুদ্ধ

শেষ হয়নি যে যুদ্ধ

বাংলাদেশের ভূমিতে ভারতের যুদ্ধটি একাত্তরে যেমন শুরু হয়নি,শেষও হয়নি। শুরু হয়েছিল উনিশ শ’ সাতচল্লিশে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে। এর পরের মাসে অর্থাৎ সেপ্টম্বরে বসেছিল নিখিল ভারত কংগ্রেসের সেন্ট্রাল কমিটির বৈঠক। সভাপতিত্ব করেন পার্টির তৎকালীন সভাপতি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহার লাল নেহেরু। উক্ত সভায় প্রশ্ন উঠেছিল, “কংগ্রেসের নেতাকর্মীরা ভারতবাসীকে সব সময় অখণ্ড ভারত-মাতার কথা বলে এসেছে,কিন্তু ভারত-মাতার দেহ তো খণ্ডিত হয়ে গেল। আমরা জনগণের কাছে কি জবাব দিব?” জবাবে জওহার লাল নেহেরু বলেছিলেন, “অলইন্ডিয়া কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জানিয়ে দিতে চাই, ভারত বিভাগকে আমরা সাময়ীক ভাবে মেনে নিচ্ছি”। এর অর্থ দাঁড়ায়, পাকিস্তানের সৃষ্টি মেনে নেয়াটি কংগ্রেসের কাছে ছিল সাময়িক ব্যাপার, স্থায়ী নীতি নয়। নেহেরু সেদিন সুস্পষ্ট করেছিলেন,ভারত সরকারের আপাতকালীন নীতি আর স্থায়ী নীতি এক নয়।পাকিস্তানের সৃষ্টিকে সাতচল্লিশে মেনে নিলেও সে নীতির একাত্তরে কোন মূল্য ছিল না। কংগ্রেস এবং ভারত সরকারের স্থায়ী নীতিটি হলো অখণ্ড ভারতমাতার নির্মাণ। কংগ্রেসের সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলের বহু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, কিন্তু নেহেরুর সে ঘোষণার সাথে কেউই সেদিন দ্বিমত পোষণ করেননি।

দিল্লিতে বহু সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু  নেহেরুর ঘোষিত সে নীতিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি। সে নীতিকে সামনে রেখেই ভারত গড়ে তুলেছে তার গ্রাণ্ড স্ট্রাটেজী। প্রতিবছরে খণ্ড খণ্ড স্ট্রাটেজী নিয়েছে সে গ্রাণ্ড স্ট্রাটেজীকে ধাপে ধাপে সফল করার লক্ষ্যে। ১৯৪৭ সাল থেকে এ অবধি অন্যদেশের ভূখন্ডে ভারতীয় বাহিনী যত যুদ্ধবিগ্রহ করেছে এবং ষড়যন্ত্র করেছে –সেগুলি মূলতঃ অখণ্ড ভারত নির্মাণের মূল লক্ষ্যটিকে সামনে রেখেই। সে লক্ষ্যপুরণে শুরুতেই দখল করে নিয়েছে মুসলিম শাসিত রাজ্য জুনাগড় ও মানভাদড়, ১৯৪৮ সালে দখল করেছে কাশ্মীর ও হায়দারাবাদ, ১৯৭১য়ে খণ্ডিত করেছে পাকিস্তান এবং ১৯৭৪ সালে গ্রাস করেছে সিকিমকে। তবে ১৯৭১য়ের যুদ্ধে পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজটি সমাধা হলেও তাতে বাংলাদেশ ভারতে মিশে যায়নি, ফলে অখণ্ড ভারত নির্মাণের লক্ষ্যটি পূরণ হয়নি। তাই অসমাপ্ত রয়ে গেছে সে যুদ্ধ। ফলে বঙ্গীয় এ ভূ-খণ্ডে ভারতের জন্য আরো যুদ্ধ বাঁকি। সম্প্রতি সে কথাটাই স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার শ্রী সন্দীপ চক্রবর্তি। ঢাকায় সহরোয়ার্দী উদ্দ্যানে আওয়ামী লীগের আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি হুশিয়ারি দিয়ে ঘোষণা করেছেন,“এখনও অনেক যুদ্ধ বাঁকি”।সে যুদ্ধে কাদের সাথে তাদের সহযোগিতা হবে এবং কাদের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ পরিচালিত হবে সেটিও তিনি উল্লেখ করেছেন। সে হুশিয়ারিটি বিশ্বাসযোগ্য করতে তিনি বলেছেন, এটা তাঁর নিজের কথা নয়,ভারতের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কথাও।

প্রতিবেশীর প্রতি ভারতীয় নীতির এ নিরেট সত্য বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার প্রকাশ না করলেও ভারতের রাজনীতির সাথে যারা পরিচিত তাদের কাছে সেটি আদৌ অজানা ছিল না। ভারতীয় সে নীতিটি তারা ১৯৪৭ সাল থেকেই অবিরাম দেখে আসছে। তবে ভারত-প্রেমে এখনও যারা অন্ধ বা একাত্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতায় যারা কাতর -এ ঘোষণায় তাদের বোধোদয় হওয়া উচিত। তাদের বোঝা উচিত, অখণ্ড ভারত নির্মাণের স্ট্রাটেজী পূরণে শুধু পাকিস্তানের অস্তিত্বই সংকটের মুখে নয়,সে অভিন্ন সংকটটি বাংলাদেশেরও। হাতির পাল থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বিশাল হাতিও নেকড়ের হামলা থেকে বাঁচে না। হাতিও তাই নেকড়ে উপদ্রুত এলাকায় দল বেঁধে চলে। মুসলিম ভূমি থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণেই স্পেনে দীর্ঘ ৮ শত বছরের মুসলিম স্রামাজ্যও বাঁচেনি। সে বিচ্ছিন্নতার কারণেই ১৭৫৭ সালেও বাংলার স্বাধীনতা বাঁচেনি। পাকিস্তানের চেয়ে মুসলিম ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশের বিপদটি তাই অধীক। তাছাড়া ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অপরাধ, দেশটি আজও পাকিস্তানের ন্যায় বেঁচে আছে অখণ্ড ভারত নীতির বিরুদ্ধে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। অখণ্ড ভারতমাতার পুজারীগণ ১৯৪৭য়েও যেমন এ বিচ্ছিন্নতা মেনে নেয়নি,আজও কি তা মেনে নিবে? বাংলাদেশের মাটিতে আরো যুদ্ধ রয়ে গেছে –ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের ঘোষাণীটি কি দেশটি থেকে কোন পাক-বাহিনীকে পরাস্ত করার লক্ষে? ১৯৪৭য়ে পাকিস্তানকে টুকরো করার কাজ সমাধা হলেও গলাধঃকরণের কাজ সমাধা হয়নি। এ দুটো কাজ তো সব সময় একসাথে হয় না। আরেক যুদ্ধের প্রয়োজন তো সে বাঁকি কাজটি সমাধা করার লক্ষ্যে।

 

ভারতের শত্রুমিত্র

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত তার গোলামদের চিনতে যেমন ভূল করেনি, তেমনি শত্রুদের চিনতেও ভূল করছে না।সে ভূল যেমন সাতচল্লিশে করেনি, একাত্তরেও করেনি। এবং আজও করছে না। শত্রু রূপে সনাক্ত করছে তাদের,যাদের মধ্যে রয়েছে বিশ্বমুসলিম ভাতৃত্বের চেতনা। ভারত চায়, ভারতীয় হিন্দুগণ ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে একত্রিত হোক। এভাবে চায়, বিশ্বশক্তি রূপে ভারত বেড়ে উঠুক। তাই বাঙালী প্রণব মুখার্জীর বাধা নেই পাঞ্জাবী মনমোহন সিংয়ের সাথে একত্রে রাজনীতি করায়। আর প্রতিবেশী মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের নীতি হলো ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিক পরিচয়ের সূত্র ধরে “বিভক্ত করা এবং শাসন করা”। সে নীতির ধারাবাহিকাতায় বাঙালী, পাঞ্জাবী, বিহারী, গুজরাতি, মারাঠি, মাদ্রাজী মারোয়ারী, উড়িয়া, অসমিয়া ও অন্যান্য ভাষাভাষী হিন্দুরা একত্রিত হলেও পাকিস্তানে বিভিন্ন ভাষাভাষি এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের মাঝে তারা গড়েছে ভাতৃঘাতি ও রক্তক্ষয়ী সংঘাত। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালে যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধ করেছে ১৯৬৫ সালেও। কিন্তু কোন যুদ্ধেই পাকিস্তানকে পরাজিত করতে পারিনি। কিন্তু এরূপ পরাজয়ের পর ভারত পরিবর্তন আনে স্ট্রাটেজীতে। পাকিস্তানের সীমান্তে হামলার বদলে তারা দেশটির অভ্যন্তরে সৈন্য সমাবেশে মনযোগী হয়। গড়ে তোলে বেতনভোগী হাজার হাজার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতীক দাস-যোদ্ধা। সে দাস উৎপাদনে অতি উর্বর ভূমি রূপে প্রমানিত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। ভারতের প্রতি নিবেদিত-প্রাণ সে দাস-যোদ্ধার হলো, বাঙালী জাতিয়তাবাদী,সমাজবাদী ও সেক্যুলার দলগুলির নেতাকর্মীগণ। শেখ মুজিব, তাজুদ্দীন ও তাদের অনুসারিগণ তো সে বিনিয়োগেরই ফসল।

দাসত্ব বা গোলামীর সবচেয়ে বড় বিপদটি হলো,তাতে দেহ বাঁচলেও আত্মসম্মান ও বিবেক বাঁচে না। দাসপ্রথা তাই মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অপরাধ। এমনকি বনের পশুও সেটি মেনে নেয় না। সেও চায় স্বাধীন থাকতে।  তাই  ইসলামে এটি হারাম। রাজনৈতীক দাসত্বে মৃত্যু ঘটে মানবিক মূল্যবোধের। ভারতের প্রতি বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের দাসসুলভ চেতনাটি এতই প্রকট ছিল যে ১৯৭১য়ে ইন্দিরাগান্ধির সাথে তাদের প্রতিনিধি তাজুদ্দীনের ৭ দফা দাসচুক্তি সাক্ষর করতে বিবেকে বাধেনি। একই চেতনা নিয়ে মুজিব স্বাক্ষর করেছিলেন ২৫ দফা দাসচুক্তি।কোন সভ্য দেশের সভ্য নাগরিক কি এমন দাসচুক্তি স্বাক্ষর করে?ারভ এ চুক্তির মাধ্যমে কেড়ে নেয়া হয় বাংলাদেশের স্বাধীনভাবে অস্ত্রক্রয় ও সেনাবাহিনী গড়ে তোলার অধিকার। কেড়ে নেয়া হয় অন্যদেশের সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি ও পরারাষ্ট্রনীতির স্বাধীনতা। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দেয়া হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যখন ইচ্ছা তখন প্রবেশের অধিকার। এমন একটি দেশকে কি স্বাধীন বলা যায়? অথচ এটিই মুজিবের অর্জন।

 

রাজাকারভীতি ও ইসলামভীতি

ভারত ভেবেছিল, বাঙালী মাত্রই তাদের দাসত্ব কবুল করে নিবে, এবং ভারতের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে চলবে। একাত্তরে অর্জিত তাদের সামরিক বিজয়কে নিয়ে ভারতীয়দের ন্যায়ই তারাও উৎসব করবে। অথচ একাত্তরে স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশকে ভারত যা উপহার দিয়েছে সেটি সীমান্ত ঘেঁষে কাঁটাতারের বেড়া এবং সে কাঁটাতারে ফ্যালানীর ন্যায় নারীদের লাশ হওয়ার স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতার অর্থ ফারাক্কাবাঁধ,বাকশালী ফ্যাসীবাদ, জালপড়া বাসন্তি, সীমান্তবাণিজ্যের নামে সম্পদলুট এবং বিএসএফের গুলিতে প্রতি বছর শত শত মানুষের লাশ হওয়ার স্বাধীনতা। ভারতের এ দাসত্বের বিরুদ্ধে যারাই বিদ্রোহ করেছে,ভারত তাদেরকেই চিত্রিত করছে নিজেদের শত্রুরূপে। সে বিদ্রোহের চেতনাধারিদের বলছে রাজাকার। তবে ভারত এক্ষেত্রে শত্রু চিনতে ভূল করেনি। যেমন ভূল করেনি তার প্রতি অনুগত সেবাদাসদের চিনতেও।এটি ঠিক, ভারতীয় প্রচারমাধ্যম এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তার নিয়োগকৃত হাজার হাজার এজেন্টদের কারণে একাত্তরে বাঙালীর মাঝে প্রবল স্রোত সৃষ্টিতে ভারত সফল হয়েছিল। এ স্রোতে ভাসা মানুষগুলো ভারতকে মুক্তিদাতা ভেবেছিল। ভারতীয় সে প্রচারের ফলে বাঙালী মুসলমানগণ ভূলেই গিয়েছিল, শুধু বাংলার রাজনীতিতেই নয়, সর্বভারতীয় মুসলিম রাজনীতিতেও বাঙালী মুসলমানগণ ছিল মধ্যমঞ্চের মূল নায়ক। মুসলিম লীগের জন্ম, পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপন, পাকিস্তানের সৃষ্টির লড়াইয়ে প্রথম সারিতে ছিল ইসলামে অঙ্গিকারবদ্ধ বাঙালী মুসলমান। মুসলমানদের সে বৃহত্তর রাজনৈতীক অঙ্গণে ভারতসেবী সেক্যুলার মুজিব ও তাজুদ্দীনগণ আবির্ভূত হয়েছিলেন ভারতসেবী ভিলেন রূপে।

কিছু মানুষকে সারাজীবন বিভ্রান্ত রাখা যায়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বেশী দিন ভূলিয়ে রাখা যায় না। সেটি অসম্ভব বলেই বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ আজ  ভারতবিরোধী। ভারতের বিষাক্ত ছোবল খেয়ে খেয়ে তারা আজ ভারতকে চিনেছে। এমনকি যারা ভারতে গিয়ে ভারতীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতের পক্ষে যুদ্ধ করেছে তাদেরও অনেকে এখন ভারতের আসল রূপকে চিনেছে। অথচ রাজাকারগণ ভারতকে চিনেছিল আজ থেকে ৪১ ব্ছর আগেই। ভারতের মুখোশপড়া ভয়ংকর চেহারাটি তারা সেদিন পরিস্কার ভাবে দেখতে পেয়েছিল। ফলে স্রোতে না ভেসে ভারতের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র ধরেছিল। এখানেই রাজাকারের প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেম। তাদের কাছে অখণ্ড পাকিস্তান স্রেফ পাঞ্জাবী,পাঠান, সিন্ধি বা বেলুচদের দেশ ছিল না, দেশটির উপর শতকরা ৫৬ ভাগ মালিকানা ছিল দেশটির ৫৬% বাঙালী নাগরিকের। রাজাকারগণ তাই কোন বিদেশী শক্তির কলাবোরেটর ছিল না, তারা কোন বিদেশ ভূমিতে গিয়ে যেমন নুন খায়নি, তেমনি প্রশিক্ষণও নেয়নি। বরং নিজ দেশে থেকে শত্রু শক্তি ও তাদের এজেন্টদের বিরুদ্ধে লড়েছে।

রাজাকারদের সে একাত্তরের স্মৃতি ভারত সরকার ও তাদের সেবাদাস মন থেকে আজও  বিলুপ্ত হয়নি। ফলে তাদের মনে ধরেছে প্রচণ্ড রাজকারভীতি। তবে রাজাকারগণ ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সে চেতনাটি বাংলার আলোবাতাস, ভাতমাছ বা জলবায়ু থেকে পায়নি, পেয়েছিল ইসলাম থেকে। ফলে তাদের মধ্যে ঢুকেছে প্রচন্ড ইসলাম ভীতিও। তারা যেখানেই দেখে পুরুষের দাড়ি-টুপি,মেয়েদের হিজাব ও কোরআনের তাফসির মাহফিল,সেখানেই নিজেদের মৃত্যু দেখতে পায়। ভারত জানে, বাঙালী মুসলমানদের যতদিন ইসলাম থেকে দূরে রাখা যাবে,একমাত্র ততদিনই ভারতের দাসত্বকে তারা কবুল করে নিবে। কোরআনের জ্ঞান ও ইসলামে অঙ্গিকার বাড়লে তাদের মধ্যে বাড়বে ভারত বিরোধী চেতনাও। তাই মুজিব আমলে ভারত সরকারের মূল স্ট্রাটেজী ছিল,বাংলার মুসলমানদের ইসলাম থেকে দূরে রাখা। সে লক্ষ্য পূরণে তাঁবেদার মুজিব সরকারকে দিয়ে ভারত প্রাথমিক বিদ্যালয়,কলেজ­-বিশ্ববিদ্যালয়,রেডিও-টিভি ও মসজিদ-মাদ্রাসায় কোরআন শিক্ষাকে সংকুচিত করেছিল।নিষিদ্ধ করেছিল সকল ইসলামি সংগঠন। মাদ্রাসায় ছাত্রদের মাঝে ইসলামে অঙ্গিকার বাড়ানো হয়, এবং সেখানে তারা রাজাকার তৈরী হয় -সে যুক্তি দেখিয়ে মুজিবকে দিয়ে ভারত মাদ্রাসা শিক্ষায় বরাদ্দ কমিয়েছিল। একই লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে মুজিব-কণ্যা হাসিনা। শেখ হাসিনা সরকারি প্রশাসনকে ব্যবহার করছে কোরআন শিক্ষার প্রসার রুখতে। পুলিশ ও র‌্যাবের সেপাইদের মাঠে নামিয়েছে ইসলামি বই বাজেয়াপ্ত করার কাজে। তাঁর হুকুমে থানা, পুলিশ ফাড়ি, র‌্যাবের ফাঁড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্ত্রাস ও নির্যাতনের ভয়ংকর আখড়ায়।মাদ্রাসার ছাত্র, ইসলামী সংগঠনের নেতাকর্মী, এমনি হিজাবধারি মহিলাদের এসব নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে অত্যাচার করা হচ্ছে।

ভারত সরকার ও তার সেবাদাসদের ইসলামভীতি বোমা, রাইফেল ও অন্যান্য আগ্নেয়অস্ত্রের চেয়েও অধীক। ফলে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে,ইসলামের উপর বই বাজেয়াপ্ত করা। তাই একদিকে যেমন রাজাকার নির্মূলের পরিকল্পনা নিয়ে যেমন নির্মূল কমিটি বানিয়েছে, তেমনি ইসলামি বই রাখার অপরাধে পর্দানশিন মহিলাদের জেলহাজতে তুলছে। এভাবে ইসলাম ও ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে লাগাতর এক যুদ্ধ শুরু করেছে। এ যুদ্ধে ভারত সরকার যে পুরাপুরি আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের সাথে আছে এবং থাকবে সে ঘোষণাটিও ঐ অনুষ্ঠানে দিয়েছেন ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার শ্রী সন্দীপ চক্রবর্তী। অথচ এ হলো বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নগ্ন হস্তক্ষেপ। কিন্তু ভারত মনে করে,সেরূপ অধিকার রয়েছে ভারত সরকারেরও। রাজা যেমন তার চাকর-বাকর ও প্রজার গৃহে যখন ইচ্ছা তখন ঢুকে গালিগালাজ ও মারধর করে, ভারতীয় কর্তাব্যক্তিগণও ভাবেন,বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সে অধিকার তাদেরও শতভাগ রয়েছে।

 

ভারতীয় আগ্রাসন ও প্রতিবেশীর স্বাধীনতা

অখণ্ড ভারত নির্মাণের আগ্রাসী ধারণাটি নিছক নেহেরুর একার ভাষ্যে নয়, শুধু ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের কথাতেও নয়, সেটি ধরা পড়ে ভারতের বিভ্ন্নি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের ভাষনেও। সে অভিন্ন চেতনা ধরে পড়ে অসংখ্য ভারতীয় নেতা,লেখক ও রাজনৈতীক বিশ্লেষকদের লেখনি ও বক্তব্যেও। তার কিছু উদাহরণও দেয়া যাক। ২০০১ সালে বাংলাদেশের সীমান্তে হামলা করেছিল ভারতীয় সৈন্যরা। সে হামলা রুখে দিয়েছিল অধুনালুপ্ত বিডিআর’য়ের জোয়ানেরা। বিডিআর জোয়ানদের হাতে সেদিন ২৫ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের বিজিপি নেতা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এল কে আদভানি হুমকি দিয়েছিলেন বোমা হামলা করে ঢাকাস্থ বিডিআর হেডকোয়ার্টার গুড়িয়ে দেয়ার। ভারতীয় নেতৃবর্গ সীমান্তের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে কতটা উদ্ধত এ হলো তার উদাহরণ। ভারতীয় রাজনৈতীক বিশ্লেষক এমভি কামাথ ভারতের “দি মেল” পত্রিকায় ২০০৩ সালে লিখেছিলেন, “Let it be said in simple and plain language: Bangladesh has no business to exist. Its creation in 1947 was a historic mistake as Lord Curzon’s partition of Bengal was in 1905. Curzon’s plan to divide Bengal was annulled because in the end Bengal’s sense of unity prevailed. Bangladesh, if it wants to survive, must return to India and India in return must help it to do so.’’

ভারতের “দি এশিয়ান এজ” পত্রিকার ২০০৯ এর ২৪ মার্চ  সংখ্যায় প্রকাশিত এ নিবন্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ অব আর্মি স্টাফ  জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) শংকর রায় চৌধুরি লিখেছেন, “এটি বড় দুঃখের কথা যে বাংলাদেশ এত সহজে এবং এতটা বার বার নয়াদিল্লীর রাডারের বাইরে চলে যায়। সেটি এখন আর ঘটতে দেয়া যায় না।” সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার কারণে জন্ম থেকেই ছিল পাকিস্তানের বহু শত্রু। একই কারণে ভারতের চক্ষুশূল আজকের বাংলাদেশও। শত্রুতার কারণ, বাংলাদেশের ষোলকোটি মুসলিম জনগণ এবং ভারতের পেটের মধ্যে তার অবস্থান।এতবড় বিশাল জনগোষ্ঠিকে খাঁচার বাইরে রাখার মধ্যে ভারত বিপদ দেখে। বাংলাদেশকে রাডারের তথা তাদের তদারকির বাইরে যেতে দিতে ভারত এজন্যই রাজী নয়। বিশ্বের বৃহ্ত্তম মুসলিম রাষ্ট্র রূপে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা শুধু হিন্দুগণই নয়, ইহুদী-খৃষ্টানও মেনে নিতে পারিনি। তেমনি তারা মেনে নিতে পারছে না জনসংখ্যায় বিশাল বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বও। বাংলাদেশের সিকি ভাগের কম জনসংখ্যা নিয়ে আফগান জনগণ যদি সোভিয়েত রাশিয়ার ন্যায় এক বিশ্বশক্তিকে শুধু পরাজিত নয়, বিশ্ব-রাজনীতির ময়দান থেকে বিদায় দিতে পারে তবে সে সামর্থ কি বাংলাদেশের কম? সে বিপদ তো বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলমানও ভারতের জন্য সৃষ্টি করতে পারে। ফলে প্রচণ্ড ভীতি ঢুকেছে ভারতীয় স্ট্রটেজিস্টদের মনে। সে জন্যই তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে লাগাতর চালিয়ে যেতে চায়। সে যুদ্ধ দিয়ে মেরুদণ্ড ভাঙ্গতে চায় বাংলাদেশের।

খোয়ারে ভরা গরুছাগলকে চলাফেরার স্বাধীনতা দেয়া হয়, তবে সে স্বাধীনতাটি খোয়ারের বাইরে যাওয়ার নয়।ভারতের কাছে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত স্বাধীনতাটুকু হলো,ভারতের পেটের মধ্যে গোলামীর দাসখত নিয়ে বসবাসের স্বাধীনতা। বাংলাদেশকে থাকতে হবে ভারতীয় রাডারের ছত্রছায়ায়। বাইরে যাওয়ার চেষ্টা হলে ভারত সেটি রুখবে,সে হুশিয়ারিটি অতি স্পষ্ট ভাষায় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে জানাতে চেয়েছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই সাবেক চিফ অব আর্মি স্টাফ। মুজিব আমলে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় ওআইসির রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ সম্মেলন। সে সম্মেলনে শেখ মুজিবকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। মুজিব প্রথমত ভারতীয় রক্তচক্ষুর ভয়ে যেতে ইতস্তত করেছিলেন। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারও তাঁকে লাহোর যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু না গেলে মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশ পুরাপুরি একঘরে হয়ে পড়বে এবং বাংলাদেশের জনগণও সে একঘরে অবস্থা মেনে নিবে না –এতে বিপদ বাড়বে মুজিবের। বাংলাদেশ তখনও মুসলিম দেশগুলির থেকে স্বীকৃতি পায়নি। চীন তখনও বাংলাদেশেকে স্বাধীন দেশ গ্রহণ করতে নারাজ। মুজিবের পররাষ্ট্রনীতির এ ছিল প্রচণ্ড ব্যর্থতা। অপরদিকে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানীদের জন্য চাকুরির সকল দরজা খুলে দিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলি। পাকিস্তানীরা তখন পঙ্গপালের মত সে সব দেশে হাজির হচ্ছিল,এবং দেশের অর্থভাণ্ডার ভরছিল বিদেশী মুদ্রায়।

পররাষ্ট্র নীতির সে ব্যর্থতা এড়াতেই শেখ মুজিব সেদিন লাহোরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে সম্মেলনে যোগ দেয়ার ফল দাঁড়িয়েছিল, মুজিবকে তাঁর দিল্লি সফরকালে তৎকালীন ভারতীয় পরারাষ্ট্র মন্ত্রী চরন সিং কড়া ভাষায় শোকোজ করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধির সামনে শ্রী চরন সিং তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন,ভারত সরকারের সাথে চু্ক্তি রয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি হতে হবে ভারতের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে। কিন্তু ভারতকে না জানিয়ে তিনি লাহোরে গেলেন কোন যুক্তিতে? (সূত্রঃ বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব আসাফ উদ্দৌলার ইউটিউবে ধারণকৃত ভাষণ, যিনি দিল্লির সে মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সে কথাটি তিনি নিজ কানে শুনেছিলেন)। এরশাদের আমলে বাংলাদেশ এক স্কোয়ার্ডন মিগ-২১ কিনেছিল চীন থেকে। তা নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া ও শাসক মহলে প্রবল প্রতিবাদ উঠেছিল। ভারতীয় পত্রিকা ডেইলী নিউজ এ্যান্ড এন্যালিসিস এর ২০১১ সালের ১৬ই জুলাই সংখ্যায় প্রকাশ, বিজিপি নেতা এবং সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুব্রামানিয়াম স্বামী বাংলাদেশের কিছু অংশ দখল করে নেয়ার হুমকি দেন। উক্ত নিবন্ধে তিনি সিলেট থেকে খুলনা অবধিক বাংলাদেশের উত্তরাংশের এক-তৃতীয়াংশ দখল করে ভারতের সাথে একীভূত করে সেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য বসবাসের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন।

কাশ্মীরকে দখল করে নেয়ার পিছনে ভারতের বাহানা হলো, হিন্দু রাজা ভারতে যোগ দিতে চেয়েছিল। রাজার আগ্রহটি সেদিন শতকরা ৭০% ভাগ মুসলিম জনগণের আগ্রহের উপর প্রাধান্য পেয়েছিল। আবার হায়াদারাবাদ দখল করার সময় ভারতের বাহানাটি উল্টে যায়। হায়াদরাদের রাজা ছিলেন মুসলমান, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজা ছিল হিন্দু। তখন দেশটিকে ভারতভূক্ত করার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু হওয়ার যুক্তিকে তারা পেশ করে।  কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দু রাজা নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণও নাই। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের পুরোন স্ট্রাটেজিও অচল। এক্ষেত্রে তারা নতুন কৌশল নিয়েছে। যুক্তি দেখাচ্ছে,কোটি কোটি বাংলাদেশী যেহেতু হিন্দুস্থানে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের জন্য বসবাসের ভূমি চাই। ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ দখল করে তাদের জন্য বসতি স্থাপনের সুযোগ করে দেয়া। সে দাবীর পিছিনে বিজেপি নেতা সুব্রামিয়াম একা নন, পশ্চিম বাংলার মাটিতে স্বাধীন বঙ্গভূমির আন্দোলন গড়ে উঠেছে তো সে দাবী নিয়েই। বাংলাদেশের অখন্ডতা ও স্বাধীনতার প্রতি ভারতীয় সরকার, বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া ও রাজনৈতীক দলের নেতাদের সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে এমন দাবী নিয়ে কি ভারতের মাটিতে কোন আন্দোলন গড়ে উঠতে দিত?

 

গণরায়ের হাইজ্যাকারঃ লেন্দুপ দর্জি ও মুজিব

বাংলাদেশে কাশ্মীরের ন্যায় হিন্দুরাজা এবং  হায়দারাবাদের ন্যায় হিন্দু জনগণ না থাকলেও আছে ভারত-অনুগত সেবাদাস চরিত্রের অসংখ্য রাজনৈতীক নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবী। এখানেই ভারতের বল। ভারত বাংলাদেশে যুদ্ধ করছে এ সেবাদাসদের কাঁধে বন্দুক রেখে। ১৯৭৪য়ের আগে সিকিম একটি স্বাধীন দেশ ছিল। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধি সরকারের খায়েশ হয়,নিজ দেশের মানচিত্র আরেকটু বাড়ানোর। ফলে দেশটির গুপ্তচর সংস্থা RAW -র উপর হুকুম হয় সিকিমকে ভারতভূক্ত করার। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা RAW -র তখন প্রচণ্ড গর্বিত অবস্থা এবং আকাশচুম্বি আত্মবিশ্বাস। সবেমাত্র RAW বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানীকে বন্দীও করেছে। সিকিমের ভারতভূক্তির সে কাজটি বিশাল RAW ’বাহিনীর কাছে আদৌ কঠিন ছিল না। সিকিমের হাতে শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল না, হাজার হাজার রাজাকারও ছিল না। ফলে বহু অর্থ ব্যয়ে ও বহু অস্ত্র দিয়ে বাঙালী যুবকদের নিয়ে ভারতকে যেমন মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে হয়েছিল, সিকিমের ক্ষেত্রে সেটির প্রয়োজন পড়েনি। বরং RAW কৌশল নেয় সিকিমের রাজনৈতীক নেতা-কর্মী ক্রয়ে। সিকিম দেশ হিসাবে খুবই ক্ষুদ্র। জনসংখ্যা বাংলাদেশের একটি জেলার চেয়েও কম;জনগণের ন্যায় নেতারাও অতি দরিদ্র। ফলে এসব গরীব নেতাদের বাজার দর খুব একটা বেশী ছিল না। এক হাজার ভারতীয় সৈন্য পালতে যে পরিমান অর্থ ব্যয় তার চেয়ে অনেক কম খরচেই RAW   সিকিমের রাজনৈতীক নেতাকর্মীদের ক্রয় এবং তাদের প্রতিপালনের উদ্যোগ নেয়। এতে ভারতীয় গুপ্তচরগণ আশাতীত সফলতা লাভ করে। নেতাদের মাঝে বাজার দর নিয়ে কমবেশী কিছু পার্থক্য থাকলেও তাদের অধিকাংশের ক্রয়মূল্য ভারতের সামর্থের বাইরে ছিল না। নেতাদের সারা জীবনে যা সঞ্চয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশী দিয়ে ভারত তাদের কিনে ফেলে। লেন্দুপ দর্জি ছিল তাদের একজন এবং নেতা।

সিকিমে তখন রাজতন্ত্র। স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে সিকিমের রাজনীতির ময়দানে নামে ভারতীয় অর্থে প্রতিপালিত এসব শত শত এজেন্ট। তারা যে ভারতীয় এজেন্ট -সিকিমের রাজা সেটি জানলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সামর্থ তাঁর ছিল না। রাজা নিজেও ছিলেন ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কাছে জিম্মি। লেন্দুপ দর্জি ও তাঁর কংগ্রেস পার্টি দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবী করেছিল। তবে সেটি ছিল নিছক প্রতারণাপূর্ণ রাজনীতির মুখোশ।ভারত এসব দাসদের গণতন্ত্র ও সিকিমকে স্বাধীন দেশরূপে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে প্রতিপালন করেনি। বরং তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বটি ছিল সিকিমের ত্বরিৎ ভারতভূক্তি। তাই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর সংসদে বসার প্রথম দিনই লেন্দুপ দর্জি এবং তাঁর  সাথীরা সিকিমের ভারতভূক্তির ঘোষণা দেয়। দেশ ও জনগণের সাথে গাদ্দারী করতে তারা একদিনও দেরি করেনি। ফলে দেশটিকে ভারতভূক্ত করতে ভারতকে কোন সৈন্য সমাবেশ করতে হয়নি, একটি তীরও ছুড়তে হয়নি।

সিকিমবাসীর সাথে লেন্দুপ দর্জির প্রতারণাটি হলো,১৯৭৪ সালের নির্বাচনি সভাগুলোর একটিতেও সিকিমের ভারতভূক্তি নিয়ে তিনি কথা বলেনি। জনগণ থেকে কোন ম্যান্ডেটও নেননি। এক্ষেত্রে তিনি অবিকল অনুসরণ করেন মুজিবের স্ট্রাটেজী। মুজিবও ১৯৭০ সালের কোন নির্বাচনি জনসভায় বা সাংবাদিকদের সাথে কোন সাক্ষাৎকারে একটি বারের জন্যও পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির অভিলাষটি প্রকাশ করেননি। বরং জনসভাগুলোতে তিনি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছেন। ১৯৭০য়ের সহরোয়ার্দী উদ্যানে তিনি যে বিশাল নির্বাচনি জনসভাটি করেন সেখানে তিনি বলেন, “আমাকে বলা হয় আমি নাকি পাকিস্তান ভাঙ্গতে চাই। আপনারা আজকের এ জনসভা থেকে এত জোরে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলুন যাতে তার আওয়াজ পিন্ডিতে পৌঁছে যায়।” (এ নিবন্ধের লেখক নিজে সে জনসভায় উপস্থিত ছিলেন এবং শেখ মুজিবের মুখ থেকে উচ্চরিত সে কথাগুলো নিজ কানে শুনেছেন।)

 

মুজিবের প্রতারণা

মুজিব ভোট নিয়েছেন আট আনা সের চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণোয়নের,প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। জনগণকে পূর্ববাংলা শ্মশান কেন -সে মিথ্যা কিসসা শুনিয়ে ওয়াদা করেছিলেন সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার। অথচ নির্বাচনি বিজয়ের পরই তাঁর নীতি পাল্টে যায়।  ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের সামনে মুজিবকে পাকিস্তানের আগামী প্রধানমন্ত্রী রূপে পরিচয় করে দেন। তবে সে জন্য শর্ত ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণোয়ন। পাকিস্তান সরকারের দেয়া নির্বাচন-পূর্ব “লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক” স্বাক্ষর করে তিনি দেশবাসীর সামনে সে ওয়াদাও করেছিলেন। কিন্তু তিনি গাদ্দারী করেন নিজের সে ওয়াদার সাথে। সত্তরের নির্বাচনের মূল ইস্যু ছিল শাসনতন্ত্র প্রণোয়ন, শাসতন্ত্র রচিত হওয়ার পরই কথা ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের।

নির্বাচনের আগে মুজিবের গোলপোষ্ট ছিল,যে কোন ভাবে নির্বাচনি বিজয়। এমনকি ইয়াহিয়া খানের সামনে টোপ ফেলেছিলেন নির্বাচনে বিজয়ী হলে তাঁকে পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট করবেন। -(সূত্র: জিডব্লিও চৌধুরী, অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলি)। নির্বাচনী বিজয়ের সাথে সাথেই মুজিব তাঁর গোলপোষ্টই পাল্টে ফেলে। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণোয়ন নিয়ে শেখ মুজিবের কোন মনযোগ ছিল না। রাজনীতিকে তিনি পরিকল্পিত ভাবে ধাবিত করেন অচল অবস্থার দিকে। দেশকে রাজনৈতীক ভাবে প্রস্তুত করেন ভারতীয় বাহিনীর অনুপ্রবেশের। ভারতও সেটিই চাচ্ছিল। ইয়াহিয়া খানের সাথে আলাপ আলাচনার শেষ দিনগুলিতে শেষ মুজিব দাবী করেন,শুধু পূর্ব পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা তাঁর হাতে হস্তান্তর করতে হবে। দাবী তুলেন,পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন তুলে নেয়ার। অথচ দেশে তখন শাসনতন্ত্র ছিল না।এ অবস্থায় সামরিক আইন তুলে নিলে দেশ চলবে কোন আইনে? শেখ মুজিবের সে দাবীর অন্তর্নিহিত লক্ষ্যটি ছিল,সামরিক আইন তুলে নিলে সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় থাকার আর কোন বৈধতা থাকবে না। ফলে থাকবে না অখণ্ড পাকিস্তানের কোন প্রশাসক বা রক্ষক। পূর্ব পাকিস্তান তখন এমনিতেই আলাদা হয়ে যাবে। ইয়াহিয়ার কথা ছিল, সামরিক আইন তো তখনই তোলে নেয়া হবে যখন একটি শাসনতন্ত্র নির্মিত হবে। অথচ সেদিকে মুজিবের কোন গরজই ছিল না। অপরদিকে আলোচনা কালে তার দলীয় হাজার হাজার কর্মী মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল একটি যুদ্ধ শুরু করার। ঢাকায় জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ঢাকায় উত্থিত হচ্ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। অথচ ১৯৭০ নির্বাচনের কোন জনসভাতেই পাকিস্তান ভাঙ্গার কথাটি মুজিব বলেননি। প্রতারণা ও মিথ্যাচার আর কাকে বলে? এভাবেই তিনি অনুকূল ক্ষেত্র তৈরী করেন বাংলাদেশের মাটিতে একটি রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধের। এবং পথ করে দেন ভারতীয় সৈন্য অনুপ্রবেশের। তাছাড়া ভারতের সাথে মুজিবের তেমন একটি চুক্তি পূর্বে থেকেই ছিল।-(সূত্রঃ সাপ্তাহিক মেঘনার সাথে আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাতকার,৪ঠা ফেব্রেয়ারি, ১৯৮৭)।

শেখ মুজিব তাঁর মনের গোপন পরিকল্লনাটি প্রকাশ করেন ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পর। এবং সেটি  ১৯৭২ সালের  ১০ই জানুয়ারির সহরোয়ার্দী ময়দানের জনসভায়। সে বিশাল জনসভায় তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির কাজের শুরু ১৯৭১ থেকে নয়, ১৯৪৭ সাল থেকেই। (শেখ মুজিবের সে বাক্যটিও লেখক নিজ কানে শুনেছেন।) প্রশ্ন হলো, এটি কি কোন নেতার রাজনৈতীক সততা? নেতার সততার নীতি হলো, তিনি যা চান তা নিয়ে জনসম্মুখে বলবেন এবং তার পক্ষে জনগণ থেকে ম্যান্ডেট নিবেন। কোন গাড়ীর চালককে গাড়ী চালনার শুরুতেই তার গাড়ীটি কোন দিকে যাবে তা নিয়ে বার বার ঘোষণা দিতে হয়। যে ঘোষণা দিয়ে বাসে যাত্রী তোলা হয় ড্রাইভার যদি সে লক্ষ্যে চালনা না করে নিজের গোপন লক্ষ্যে যাত্রীদের চলতে বাধ্য করে তবে সেটি তো হাইজ্যাকারদের কাজ। মুসলিম লীগকে তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৭ বছর আগেই ১৯৪০ সালে পেশ করতে হয়েছিল। অথচ মুজিব এবং লেন্দুপ দর্জি উভয়ই হাইজ্যাকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। মুজিব তাঁর ১৯৭০ সালের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে একটি বারের জন্যও পাকিস্তান ভাঙ্গার কথাটি উল্লেখ করেননি। তেমনে লেন্দুপ দর্জিও বলেননি। এমন স্ট্রাটেজী তো বিদেশী গুপ্তচরদের কাজ। এমন গুপ্তচরগণ নিজেদের মনের কথাটি অন্যদের বলা দূরে থাক, নিজের স্ত্রীকেও বলে না। সেটি লেন্দুপ দর্জি যেমন বলেনি, মুজিবও বলেননি।

বাংলাদেশের জনগণ আজও মুজিব-লেন্দুপদর্জির ন্যায় রাজনৈতীক হাইজ্যাকারদের হাতে জিম্মি।  শেখ হাসিনা গত নির্বাচনের মুহুর্তে কখনই বলেননি, ক্ষমতায় গেলে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার ন্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিলুপ্ত করবেন। বলেননি,ভারতকে তিনি করিডোর দিবেন। বলেননি, টিপাইমুখ বাধের অনুমতি দিবেন। ভারতকে সীমান্ত বাণিজ্যের অধিকার দেয়ার কথাও তিনি বলেননি। বলেননি, নির্বাচন জিতলেই সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থার বাক্যটি বিলুপ্ত করব্নে এবং ইসলামপন্থিদের নির্মূলে যুদ্ধ শুরু করবেন। কিন্তু সেগুলিই আজ  তিনি জোরে শোরে শুরু করেছেন। ভারত তার নিজ স্বার্থের সেবাদাস মুজিব ও লেন্দুপ দর্জি সৃষ্টির যে স্ট্রাটেজী নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ও সিকিমের রাজনীতির ময়দানে নেমেছিল,সে অভিন্ন স্ট্রাটেজীটি নিয়ে আজ  ময়দানে নেমেছে বাংলাদেশে।লক্ষ্য, বাংলাদেশের মাটিতে তারা বিপুল সংখ্যক মুজিব ও লেন্দুপ দর্জি সৃষ্টি করতে চায়। আর এতে খরচ কমে তাদের নিজেদের রক্তের। অন্য দেশের অভ্যন্তরে প্রতিটি শত্রুদেশের এটিই হলো অভিন্ন স্ট্রাটেজী। সে স্ট্রাটেজীর অংশ রূপেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুর দিন থেকেই শত শত বাঙালী রাজনৈতীক নেতা, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও মিডিয়াকর্মীকে ভারতীয় অর্থে প্রতিপালিত হয়ে আসছে। এমন দালালগণ উল্লেখযোগ্য কোন পৈতীক সম্পত্তি, চাকুরিবাকুরি ও ব্যবসাবাণিজ্য না থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বিশাল বিশাল বাড়ী নির্মাণ করে রাজার হালে থেকেছে। তাজুদ্দীন ও শেখ মুজিবের ন্যায় আওয়ামী লীগ নেতাদের ধানমন্ডির বিশাল বিশাল বাড়িও কি তাঁদের পৈতীক সম্পত্তি,চাকুরিবাকুরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের অর্থে গড়ে উঠেছিল?

 

লড়াই দু‘টি দর্শনের

ভারতের যুদ্ধ একাত্তরে শেষ না হওয়ার কারণ বাংলার মাটিতে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীকে তারা পরাজিত করতে পারলেও ইসলামী দর্শনকে এদেশের ভূমি থেকে নির্মূল করতে পারেনি। এখানেই ভারতে ব্যর্থতা। দর্শন ও সে দর্শনসৃষ্ট চেতনা যুগ যুগ বেঁচে থাকে ব্যক্তির রাজনীতির মাঝে। ভারতের জন্য বিপদের কারণ, বাংলাদেশে যেমন বিপুল সংখ্যক মীরজাফর আছে, তেমনি সিরাজুদ্দৌলা ও তিতুমিরদের অসংখ্য উত্তরসুরীরাও আছে। তাই একাত্তরে যেমন ভারতীয় অর্থ,অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠে,তেমনি তাদের বিরুদ্ধে লড়াকু রাজাকার বাহিনীও গড়ে উঠেছে। আগ্রাসী ভারতীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মোকাবেলায় আজও বেঁচে আছে মুসলমানের সাতচল্লিশের চেতনা। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে আজও আধিপত্যবাদি ভারতের বিরুদ্ধে যে প্রবল লড়াকু জজবা সেটি তো সে অভিন্ন প্রতিরোধের চেতনা থেকেই। ভারতের আগ্রাসন যতই প্রবলতর হচ্ছে ততই বেড়ে চলেছে সে জিহাদী চেতনা। ইসলামি চেতনাধারিরা তাদের জানমাল বিক্রি করে একমাত্র আল্লাহর কাছে,কোন বিদেশী শক্তির কাছে নয়। ভারতের স্ট্রাটেজী পুরণে এমন মোজাহিদরাই হলো বড় বাধা। ফলে যে যুদ্ধটি ভারতকে সিকিমে লড়তে হয়নি,সে সুযোগটি তাদের বাংলাদেশে মিলছে না। বাংলাদেশের সীমান্তে এক পা সামনে বাড়ালেই তাদের রক্ত ঝরবে। একাত্তরের সে সুযোগ তাদের আর মিলছে না। এখানেই ভারতের ক্ষোভ। তাদের জন্য এখানেই বড় বিপদ। ভারত এবং তাদের সেবাদাস তাঁবেদারগণ সেটি জানে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকৃত লড়াই মূলত দু’টি চেতনার। এটি বহু বাংলাদেশী না বুঝলেও ভারত ষোলআনা বুঝে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেবাদাস চরিত্রটি বাঁচাতে ভারত সরকার ও ভারতভক্ত সেক্যুলার বাংলাদেশীদের চলছে লাগাতর বিনিয়োগ। বাংলাদেশের শিল্প, রাস্তাঘাট, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে ভারতের কোন বিনিয়োগ না থাকলে কি হবে, বহু হাজার কোটি টাকা তারা বিনিয়োগ করেছে ভারতসেবী এ সেক্যুলার চেতনা বাঁচাতে। এ বিশাল বিনিয়োগটিও ভারতের যুদ্ধখাতের বিনিয়োগ,সেটি স্বাধীন বাংলাদেশ বিরোধী একটি আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধের। এ লক্ষ্যে অসংখ্য রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দল এবং এনজিওকে তারা বাংলাদেশে রাজনীতি ও সংস্কৃতির ময়দানে নামিয়েছে। লক্ষ্য বাংলাদেশের রাজনৈতীক সীমান্ত বিলোপ। সে রাজনৈতীক সীমান্ত বিলোপের লক্ষ্যে প্রয়োজন হলো, সাংস্কৃতিক সীমান্তের বিলোপ। সে লক্ষ্যে শত শত পত্র-পত্রিকা, বহু শত নাট্য ও সাংস্কৃতিক দল, বহু টিভি প্রতিষ্ঠান এক যোগে কাজ করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সাথে পশ্চিম বাংলার চলচিত্র কতৃপক্ষের চুক্তি হয়েছে। সে চুক্তির শর্ত হলো, বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়া হবে পশ্চিম বাংলার ফিল্মের জন্য।তিস্তার ন্যায্য পানি দিতে পশ্চিম বাংলা সরকারের প্রচণ্ড আপত্তি, কিন্তু ফিল্ম রপ্তানিতে তারা উদার! কলকাতার ছায়াছবি মুক্তি পাবার সাথে সাথে এখন বাংলাদেশে সেটি দেখানো হবে। এ চুক্তির ঘোষিত লক্ষ্যটি হলো,সাংস্কৃতিক সীমান্তের বিলোপ।

 

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সৈন্য

সে অভিন্ন লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমান্তে মোতায়েনকৃত ভারতীয় সেনাদের চেয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়োজিত তাদের রাজনৈতীক ও সাংস্কৃতিক সেনাদের সংখ্যা অধিক। বরং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের পক্ষে মূল যুদ্ধটি লড়ছে তারাই। এজন্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টিপাই মুখ বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে করিডোরের পক্ষে কথা বলতে কোন ভারতীয় নাগরিক লাগে না। বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী রাখার কি প্রয়োজন -তা নিয়েই প্রশ্ন তোলে এসব সেবাদাসরা। তারা নির্মূল করতে চায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জেগে উঠা প্রতিরোধের যে কোন চেতনা ও প্রয়াস।নির্মূল করতে চায় বাংলাদেশীদের স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার যে উদ্যোগ। তেমনি একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মুজিব ও তাঁর সাথীরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিল্প বা বানিজ্যকে সুপরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করেছিল। ডেকে এনেছিল দুর্ভিক্ষ। এবং বিশ্বব্যাপী দেশকে পরিচিত করেছিল তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি রূপে। মুজিবের উপর এটিই ছিল ভারতের পক্ষ থেকে অর্পিত দায়ভার।

আজও  ভারতীয় সেবাদাসদের উপর দায়ভারটি ভিন্নতর নয়। বিশ্বজুড়ে আজ  ইসলামের জোয়ার এসেছে। সে জোয়ারে বাঁচেনি এমন কি ইরানের শক্তিধর রাজা মহম্মদ রেজা শাহ পাহলভি, মিশরের স্বৈরাচারি মোবারক এবং আরো  অনেকে। পরাজিত হয়েছে সোভিয়েত রাশিয়া। হারতে বসেছে খোদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার ন্যাটো মিত্রগণ। ইসলামের সে ঢেউ বাংলাদেশেও এসে আঘাত হানছে। আর এতে বাড়ছে ভারতের ভয়। বাংলাদেশে ইসলামি শক্তির এরূপ বেড়ে উঠায় ভারত খুশি নয়, খুশি নয় তাদের সেবাদাসগণও। ইসলামের প্রভাব বৃদ্ধির অর্থ তো রাজাকারবৃদ্ধি। ফলে তারা চায় ইসলামী শক্তির নির্মূল। সে লক্ষ্যে ভারতসেবী মুক্তিযোদ্ধারাও চায় আরেকটি একাত্তর। বিষয়টি গুরুতর বুঝেই ভারতীয় ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারও একাত্তরের অসমাপ্ত যুদ্ধের হুমকি শুনিয়েছেন। এখন প্রশ্ন,এমন একটি ভারতীয় যুদ্ধের মুখে বাংলাদেশীদের প্রস্তুতি কতটুকু? ১৩/০১/২০১৩

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *