বাংলাদেশে ভারতীয় নাশকতা ও একাত্তরের ইতিহাসে মিথ্যাচার প্রসঙ্গ
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 9, 2019
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
কেন এ লেখা?
ইতিহাস কখনোই মারা যায় না; বেঁচে থাকে স্মৃতিতে এবং প্রভাবিত করে চিন্তা-ভাবনা, রাজনীতি, সমাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহকে। একাত্তরের যুদ্ধ ঘটে গেছে আজ থেকে ৪৮ বছর আগে, কিছু আজও তা প্রবল ভাবে বেঁচে আছে দেশের রাজনীতিতে। বরং বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতি গুরুতপূর্ণ প্রভাব ফেলছে একাত্তরের ঘটনাবলী। রাজনীতির অঙ্গণে অনেককে বীরের মর্যাদা দেয়া হয়, এবং অনেকের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় একাত্তরের ভূমিকার কারণে। আগামী বহুকাল যাবত একাত্তরের ইতিহাসই যে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারন করবে -তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? তবে বাংলাদেশীদের জন্য বিপদের ভয়ানক কারণটি হলো, একাত্তরের ইতিহাসটি আদৌ সঠিক ভাবে বেঁচে নাই। ইতিহাসের নামে প্রচুর মিথ্যাচার হয়েছে। ধর্মের নামে মিথ্যাচার হলে সেটি আর ধর্ম থাকে না বরং সেটি ভয়ানক অধর্মের কারণ হয়। তেমনি ইতিহাসের নামে মিথ্যাচার হলে সেটি আর ইতিহাস থাকে না। তখন দেশের ইতিহাস পরিণত হয় জাতিকে বিভক্ত ও ধ্বংস করার মারাত্মক হাতিয়ারে। বাংলাদেশে বস্তুতঃ সেটিই হচ্ছে। ফলে প্রবলতর হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসা ও প্রতিপক্ষা নির্মূলের রাজনীতি। দেশের ধ্বংসপ্রক্রিয়া তো এভাবেই বেগবান হয়।
দেশের চলমান প্রেক্ষাপটে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একাত্তরের ঘটনাবলি নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা। একাত্তরে কার কি ভুমিকা ছিল এবং কার কি মটিভ ছিল –সেটিকে সামনে নিয়ে আসা। আলোচ্য নিবন্ধটি লেখা হয়েছে তেমনি এক দায়িত্ববোধ থেকে। একাত্তরের সংঘাতকে ভূলে যাওয়াতে কোন সমাধান নাই। বরং ভয়ানক বিপদ বাড়বে একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে লাগাতর মিথ্যাচার হলে। ইতিহাস নিজে কথা বলে না, ফলে ইতিহাসের নামে বিকট মিথ্যাচার হলেও প্রতিবাদ করে না। ফলে ইতিহাসের নামে মিথ্যা রটিয়ে যে কোন ব্যক্তিকে যেমন অপরাধী ঘোষণা দেয়া যায়, তেমনি তাকে বিচারের নামে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যাও করা যায়। ফিরাউন বনি ইসরাইলী শিশুদেরও গণহারে হত্যা করতো। সে গণহত্যাকে দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য করা হয়েছিল ইতিহাস বিকৃত করে। মিশরীদের কাছে নিরপরাধ শিশুদেরও শত্রুরূপে চিত্রিত করা হয়েছিল। হিটলারও তেমনি ইতিহাস বিকৃতি করে ইহুদীদের জার্মান জাতির শত্রু রূপে চিত্রিত করে। এভাবে দেশবাসীর সামনে জায়েজ রূপে পেশ করে লাখ লাখ ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে গণহারে হত্যার অপরাধকেও। তাই যে কোন সভ্য দেশে মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হওয়া উচিত। এ প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে তেমন একটি দায়বদ্ধতা থেকেও।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি কোন গোপন বিষয় নয় যে, বাকশালী স্বৈরাচারিগণ তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের বাহানা চায়। সেটি সুযোগটি তারা নিতে চায় একাত্তর থেকে। সেটিরই প্রমাণ মেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল কাদের মোল্লাকে মীরপুরের কশাই ও খুনি বানিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে। যে দেশে নির্বাচনের নামে ভোট-ডাকাতি হয় এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গুম-খুনের মাধ্যমে নির্মূল করা হয়, সেদেশে ইতিহাসের নামে ভয়নাক মিথ্যাচার হবে এবং সে মিথ্যার উপর ভিত্তি করে গণহত্যার কাজ হবে –সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? এমন দেশে আদালতে ন্যায়-বিচার ও আইনের শাসন নিছক তামাশা মাত্র। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশে সে অপরাধটি লাগাতর হচ্ছে। একাত্তরে বাংলাদেশ দু’টি মূল পক্ষ ছিল এবং তাদের নিজ নিজ মটিভও ছিল। এক পক্ষে ছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলি। এ পক্ষের নেতৃত্বে ছিল শেখ মুজিব। এবং তাঁর সাথে ছিল মস্কোপন্থি ও চীনপন্থি রাজনৈতিক দলগুলির সেক্যুলার নেতাকর্মীগণ। দ্বিতীয় পক্ষে ছিল অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচিয়ে রাখার পক্ষের দলগুলি। সেগুলি হলো মুসলিম লীগ, জাম’য়াতে ইসলামী, নিজামে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, কৃষক শ্রমিক পার্টি, ইত্যাদি। তবে এ দুটি দেশীয় পক্ষের বাইরে আরেকটি বিদেশী পক্ষ ছিল, সেটি হলো ভারত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা পর থেকে ভারতের সুস্পষ্ট মটিভ ছিল। সেটি হলো, পাকিস্তান ভাঙ্গা। ভারত সে সুযোগটি পায় ১৯৭১ সালে।
ভারতীয় হস্তক্ষেপে নতুন মাত্রা
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের এজেন্ডা ও বিনিয়োগ শেষ হয়নি। বরং বিনিয়োগ বাড়ছে নতুন এজেন্ডা নিয়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের বিনিয়োগ ও মুসলিম বিরোধী নাশকতা এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতিতে বহু পূর্ব থেকেই দু’টি প্রধান ধারা। একটি ইসলামের বিজয় এবং মুসলিমদের বিলুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনার প্রতি বলিষ্ঠ অঙ্গিকারের। সে অঙ্গিকার নিয়েই ১৯৪৭ সালে নানা ভাষা ও নানা প্রদেশের মুসলিমগণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত করেছিল। অপর ধারাটি ছিল ইসলামের বিজয় বা প্রতিষ্ঠার প্রতি অঙ্গিকার বিলুপ্ত করে ভারতীয় হিন্দু আধিপত্যের প্রতি আনুগত্যের। মুসলিমদের মাঝে এ শেষাক্ত ধারার অনুসারি ছিল ভারতীয় কংগ্রেসের সহযোগী দেওবন্দি আলেমগণ এবং জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টগণ। ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা তাদের ভাল লাগেনি। ফলে তারা শুধু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠারই বিরোধীতা করেনি; হিন্দু ও মুসলিম যে দুটি পৃথক জাতি –সেটিও তারা মানেনি। তারা গড়ে তোলে হিন্দু-মুসলিম সম্মিলিত একক ভারতীয় জাতিসত্ত্বার ধারণা। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তাদের মাঝের আঁতাতটি চোখের পড়ার মত। ভারতীয় উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমগণ তাদের সে ধারণাকে বর্জন করেছিল বলেই পাকিস্তান আজ পারমানবিক শক্তিধারি ভারতের সমকক্ষীয় শক্তি এবং ৫৭টি মুসলিম দেশের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। অপর দিকে ১৬ কোটি মুসলিমের বাংলাদেশ আজও হারিয়ে যায়নি ভারতের পেটে।
শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির মূল চরিত্রটি হলো লাগাতর ভারত নির্ভরতা। একাত্তরে ভারত তার বিশাল সেনা বাহিনী নিয়ে দাঁড়ায় মুজিবের পাশে। লক্ষ্য ছিল, ভারতের এবং সে সাথে মুজিবের অভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়ন। একাত্তর নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রচুর মিথ্যাচার হয়েছে। প্রবল দু’টি মিথ্যার একটি হলো, মুক্তি বাহিনীর হাতে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়। অপরটি হলো, যুদ্ধে তিরিশ লাখের মৃত্যু। প্রথম মিথ্যাটি বলা হয়, বাংলাদেশের সৃষ্টিতে ভারতের অবদানকে খাটো করার জন্য এবং দ্বিতীয়টি বলা হয় নিজেদের অবদানকে বিশাল করে দেখানোর জন্য। অথচ একাত্তরের ৯ মাসে যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী কোন একটি জেলাকে স্বাধীন করেছে -সে প্রমান নেই। এবং ৩০ লাখ লোকের মৃত্যু হতে হলে প্রতি ২৫ জনের মাঝে একজনের নিহত হতে হয়। হিসাবটি অতি সহজ। একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি; যার অর্থ দাড়ায় ৭৫ মিলিয়ন। এবং তিরিশ লাখের অর্থ ৩ মিলিয়ন। অনুপাতের নিয়মে হিসাবটি এরূপ: ৭৫ মিলিয়ন : ৩ মিলিয়ন = ২৫:১। তাছাড়া ৯ মাসে ৩০ লাখের মৃত্যু হতে হলে গড়ে প্রতিদিন ১১ হাজারের বেশী মানুষকে মারা যেতে হয়। সেটিও ঘটেনি। অতএব তথ্যটি ভূয়া। একমাত্র মিথ্যাবাদীরাই সেটি বলতে পারে এবং মতলববাজ মিথ্যুকেরাই সেটি বিশ্বাস করতে পারে। তবে যারা মিথ্যাচারি, তারা যেমন সত্যের ধার ধারে না, তেমনি হিসাব-নিকাশেরও ধার ধারে না। বরং নিজেদের রাজনীতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য অসংখ্য মিথ্যা তারা লাগাতর আবিস্কার করে। নইলে ৩০ লাখের সংখ্যাটি যে কতবড় মিথ্যা -সেটি তো স্কুলের ছাত্রেরও সহজে বুঝে উঠার কথা। ফলে বাংলাদেশে সেটি বাজার পায় কি করে? অথচ সে হিসাবটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং পার্লামেন্টের সদস্যগনও বুঝতে রাজী নয়। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল অবদানটি ছিল ভারতের –সেটিই একাত্তরের সবচেয়ে বড় সত্য। শেখ মুজিব পাকিস্তান ভাঙ্গার স্বপ্ন দেখেছিল বটে, তবে ভারত সে স্বপ্নটি দেখেছিল মুজিবের অনেক আগেই। বরং মুজিবকে সে স্বপ্ন দেখায় ভারতীয় গুপ্তচরেরা প্ররোচিত করেছিল। নইলে শেখ মুজিব তো নিজেই ১৯৪৬ সালে কলকাতার রাস্তায় মুসলিম লীগের সভা-মিছিলে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” ধ্বনিতে গগন কাঁপিয়েছিল। ফলে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বপ্ন দ্রষ্টা বা স্রষ্টা –এর কোনটিই নয়। সেটি ভারতীয় শাসকগোষ্ঠি। প্রকৃত সত্যটি হলো, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পরাজয় ঘটেছিল, মুক্তিবাহিনীর কাছে নয়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান দূরে থাক, কোন একটি জেলাতেও মুক্তি বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পরাজয় হয়নি। অথচ একাত্তরের ইতিহাসে সে কথাটি ইচ্ছা করেই লুকানো হয়।
ইতিহাসের আরেক সত্য হলো, ১৯৪৭ সালে যেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ ভারতকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করতে পারিনি, একাত্তরেও তাদেরই অধিকাংশ ভারতকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করতে পারেনি। এবং আজও পারছে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এদের সংখ্যা কম নয়; বরং তারাই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেটি বুঝা যায় আওয়ামী লীগ সরকারের দলন প্রক্রিয়া দেখে। তাছাড়া অআওয়ামী কোন কালেই পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের দল ছিল না। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও ছিল না। তখন বিজয়ীদের মধ্যে প্রধান দল ছিল শেরে বাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক-প্রজা পার্টি দল। আরেকটি স্মরণীয় বিষয় হলো, ষাটের দশকের প্রথমার্ধে আউয়ুব খানের স্বৈরাচারি নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতারা একটি বিবৃতি দেন। ইতিহাসে সেটি ৯ নেতার বিবৃতি নামে পরিচিত। সে নেতাদের মাঝে ৯ম নেতা রূপে মুজিবকে শামিল করা যায় কিনা -তা নিয়েও বিতর্ক উঠেছিল। আরো ঘটনা হলো, ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব যখন ৬ দফা পেশ করেন তখন সেটির বিরোধীতা করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৭টি জেলার দলীয় নেতাদের মধ্য থেকে ১৪ জেলার সভাপতিও দল থেকে বেরিয়ে যায়। কারণ, তাদের ধারণা ছিল ৬ দফায় পাকিস্তান দুর্বল হবে।
১৯৭০’য়ের নির্বাচনে ভারত-বিরোধীরা হেরেছিল নিজেদের মধ্যে বিভক্তির কারণে। তবে সে পরাজয়ে সেসব দলের নেতাকর্মীগণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। দেশের আনাচে-কাঁনাচে ছড়িয়ে থাকা তাদের সংখ্যা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চেয়ে কম ছিল না। পাকিস্তান ভাঙ্গা হবে কি হবে না -এ নিয়ে গণভোট হলে সেদিন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আসল অভিমতটি জানা যেত। কিন্তু সেটি হয়নি। মুজিবও সেরূপ কোন দাবী তোলেননি। শেখ মুজিব নির্বাচন জিতেছিলেন স্বায়ত্বশাসনের দাবী নিয়ে, দেশ ভাঙ্গার ওয়াদা দিয়ে নয়। তাছাড়া শেখ মুজিবের বিজয়ের কারণ, তাঁর সোনার বাংলা গড়ার ধোকায় ধোকাগ্রস্ত হয়েছিল বিপুল সংখ্যক মানুষ। তবে বেশীর ভাগ মানুষই যে তাঁর দেয়া ধোকার আছড় থেকে দ্রুত মুক্তি পেয়েছিল –সে প্রমাণও তো প্রচুর। ১৯৭৫’য়ে মুজিবের বাকশালী ফ্যাসিবাদ থেকে যারা দেশকে মুক্তি দিয়েছিল -তারা তো ধোকাগ্রস্ততা থেকে মুক্তি-প্রাপ্তরাই। এবং যতই বাড়ছে ভারতের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ভূ-প্রাকৃতিক আগ্রাসন -ততই এরা দলে ভারী হচ্ছে। ফলে দেশটি দ্রুত বিভক্ত হচ্ছে ভারতসেবী ও ভারত-বিরোধী দ্বি-জাতিতে। কোন দেশের রাজনীতিতে যখন এমন বিভক্তি আসে তখন সংঘাতও অনিবার্য হয়। বস্তুতঃ বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে তেমনি এক অনিবার্য সংঘাতের দিকে। বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের গুরুতর অপরাধ হলো, দলটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পালাবদলের প্রক্রিয়াকে অসম্ভব করে তুলেছে। তবে দেখবার বিষয়টি হলো, সে আসন্ন সংঘাতে ভারতের ভূমিকা কি হয়? তবে সে সংঘাতে ভারত যে নিশ্চুপ বসে থাকবে না -সেটিও নিশ্চিত। যে দেশকে ভারত নিজ অর্থ, নিজ শ্রম ও নিজ সেনা-সদস্যদের রক্ত দিয়ে সৃষ্টি করলো, সে দেশের রাজনীতিতে ভারত ভূমিকা রাখবে না -সেটি একমাত্র অতি আহম্মকগণই বিশ্বাস করতে পারে। তাছাড়া আরেকটি বিষয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় অনেকেই যে ভারতের তেমন একটি হস্তক্ষেপে সম্মতি দিবে তাতেও কি সন্দেহ আছে? ভারতপন্থিদের ভোট-ডাকাতি বিশ্বে যেরূপ গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে -তার পিছনেও তো ভারতীয় লবি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা থেকেই ভারতের লক্ষ্য শুধু দেশটিকে খণ্ডিত ও দূর্বল করা ছিল না। তারা বিনাশ করতে চেয়েছ উপমহাদেশের মুসলিম জাগরণকেও। ফলে মুসলিমদের উপর হামলা হচ্ছে ভারতের ভিতরে ও বাইরে। ফলে বাবরী মসজিদের ন্যায় মসজিদগুলো জমিনে মিশিয়ে দেওয়াই তাদের একমাত্র লক্ষ্য নয়, গুড়িয়ে দিতে চায় ভারতের ভিতরে ও বাইরে মুসলিমদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক ও সামরিক শক্তিকেও। পাকিস্তানকে খণ্ডিত করার পর ভারতের তেমন একটি নাশকতাপূর্ণ স্ট্রাটেজী ধরা পড়ে বাংলাদেশকে তলাহীন ও পঙ্গু করার মধ্যে। সেটির প্রমাণ মেলে একাত্তরের পর বাংলাদেশে ভারতীয় সেনা বাহিনীর ব্যাপক লুটপাট ও অব্যবহৃত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ভারতে নিয়ে যাওয়াতে।
পাকিস্তান ভাঙ্গা ও বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের রাজনীতি শেষ হয়নি। দলটির পরবর্তী স্ট্রাটেজী হলো, বাংলাদেশের জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো। কারণ, তারা জানে ইসলামের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়লে মারা পড়বে তাদের সেক্যুলার ও ভারতমুখি রাজনীতি। বাংলাদেশে মাটিতে ভারত ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লক্ষ্য এজন্যই অভিন্ন। ফলে ভারতের কাছে আওয়ামী লীগের এবং আওয়ামী লীগের কাছে ভারতের প্রয়োজনীয়তা তাই ফুরিয়ে যায়নি। ফলে আওয়ামী লীগ একাত্তরে যেমন ভারতের পার্টনার ছিল, এখনও পার্টনার। ফলে ভোট-চুরি, ভোট-ডাকাতির মাধ্যমে শেখ হাসিনার নির্বাচনী বিজয় এবং তার গুম, খুন ও বিচারের নামে বিরোধী দলীয় নেতাদের জেল-ফাঁসী দেয়ার রাজনীতিকেও তারা অকুণ্ঠ সমর্থণ দেয়। লক্ষ্য এখানে বাংলাদেশের মাটিতে যে কোন মূল্য ভারতসেবীদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। এমন কি গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে হলেও।
ইতিহাস রচনায় চরিত্রহননের প্রজেক্ট
বাংলাদেশে ইতিহাস-বিকৃতি হয়েছে বিচিত্র ভাবে। বিকৃত সে ইতিহাসের ভাষ্য হলো, মুষ্টিমেয় কিছু রাজাকার ছাড়া সবাই একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে ছিল। কিন্তু প্রকৃত সত্য কি তাই? শেখ মুজিব সেদিন বাঙ্গালী জাতীয়তার জোয়ার সৃ্ষ্টি করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সবাই সে জোয়ারে ভেসে যায়নি –সে প্রমাণও তো প্রচুর। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে তার উল্লেখ নাই। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে শুধু রাজাকারগণই ছিল না, ছিল এক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিপক্ষও। পাকিস্তান খন্ডিত হওয়াতে বাংলার মুসলমানদেরই শুধু নয়, বিশ্বের মুসলমানদেরও যে অপুরণীয় শক্তিহানী হবে সেটি যে শুধু ইসলামী দলের নেতাকর্মী, উলামা ও রাজাকারগণ অনুধাবন করেছিলেন -তা নয়। তাদের পাশাপাশি সে সময়ের বহু প্রথম সারির বুদ্ধিজীবীরাও বুঝতে পেরেছিলেন। তাদের যু্ক্তি ছিলঃ পাকিস্তানে বিস্তর সমস্যা আছে, সমাধানের রাস্তাও আছে। ঘর থাকলে সেখানে বিষাক্ত গোখরাও বাসা বাঁধতে পারে। ঘর থেকে শাপ তাড়ানোর মধ্যেই বুদ্ধিমত্তা, শাপ মারতে ঘরে আগুন দেয়া বা সেটিকে ভেঙ্গে ফেলা নয়। বিশ্বের প্রতিদেশেই সেটি হয়ে। প্রকৃত বুদ্ধিমানদের কাজ দেশ থেকে দুর্বৃত্ত তাড়ানো, দেশ ভাঙ্গা নয়। বাহাদুরী তো গড়াতে, ভাঙ্গাতে নয়। দেশের সীমান্ত এক মাইল বাড়াতে হলেও প্রকাণ্ড যুদ্ধ লড়তে হয়। ফলে দেশ ভেঙ্গে উৎসব করা তো আহাম্মকদের কাজ। তাছাড়া মুসলিম রাষ্ট্র ভাঙ্গার কাজে কি একটি তীর ছুড়ারও প্রয়োজন আছে? একাজ করার জন্য অতীতের ন্যায় আজও কি শত্রুর অভাব আছে? মুসলিম দেশ ভাঙ্গার দাবী উঠালে বহু কাফের রাষ্ট্র সেটি নিজ খরচে করে দিতে দুই পায়ে খাড়া। কুয়েত, কাতার, আবুধাবি, দুবাই, বাহরাইনের মত তথাকথিত স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করতে কি আরবদের অর্থব্যয়, শ্রমব্যয় বা রক্তব্যয় করতে হয়েছে? কারও একটি তীরও কি ছুঁড়তে হয়েছে? মুসলমানদের শক্তিহীন করা, ইসরাইলের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করা এবং আরবদের তেল সম্পদকে লুন্ঠন করার স্বার্থে পাশ্চাত্য দেশগুলো নিজ খরচে এ দেশগুলোকে সৃষ্টি করেছে। ভারত তেমন একটি লক্ষ্যে পাকিস্তান ভাঙ্গায় ১৯৪৭ সালে দু’পায়ে খাড়া ছিল।
শুধু ভাঙ্গা কেন, পাকিস্তানের জন্ম বন্ধ করার জন্য ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের চেষ্টা কি কম ছিল? একারণেই পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে আওয়ামী লীগকে একটি টাকাও ব্যয় করতে হয়নি। নিজ খরচে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও খুলতে হয়নি। কোন অস্ত্রও কিনতে হয়নি। ভারতই সে কাজ নিজ খরচে ও নিজ উদ্যোগে করে দিয়েছে। এমন সহজ সত্যটি ভারতসেবীরা না বুঝলেও অনেকেই বুঝতেন। ফলে একাত্তরে তারা পাকিস্তানের বিরাজমান সমস্যার সমাধানে ভারতের মত একটি চিহ্নিত শত্রুদেশের হস্তক্ষেপ চাননি। চাননি ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ। তারা চাইতেন শান্তিপূর্ণ ভাবে একটি নিস্পতির, এবং কখনই সেটি পাকিস্তানেকে বিভক্ত করে নয়। পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে আলেমদের মাঝে সে সময় যারা প্রথম সারিতে ছিলেন তারা হলেন কিশোরগঞ্জের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা আতাহার আলী, চট্টগ্রামের প্রখ্যাত আলেম ও হাটহাজারী মাদ্রাসাব তৎকালীন প্রধান মাওলানা সিদ্দিক আহম্মদ, ঢাকার প্রখ্যাত মাওলানা মোস্তাফা আল মাদানী, লালবাগ মাদ্রাসার মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজজী হুজুর, পীর মোহসীন উদ্দিন দুদু মিয়া, শর্শিনার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ, সিলেটের ফুলতলীর পীর এবং তাদের অনুসারিরা। তাদের সাথে ছিলেন বাংলাদেশের প্রায় সকল গণ্যমান্য আলেম। প্রকৃত সত্য হলো, সে সময় কোন প্রসিদ্ধ আলেম পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নিয়েছে এমন প্রমাণ নেই। তাদের যু্ক্তিটি ছিল, একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গলে মুসলিম উম্মাহর শক্তিহানী হয়। আর মুসলিম উম্মাহর শক্তিহানী তো কবিরা গুনাহ। একাজ তো কাফেরদের। অথচ বাংলাদেশের সেকুলারিষ্টদের কাছে মহান আল্লাহতায়ালা বা তাঁর রাসূল (সাঃ) কি বললেন -সেটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কোনটি কুফরি ও কোনটি জায়েজ -সেটিও তাদের কাছে বিচার্য বিষয় ছিল না। এসব গুরুতর বিষয়গুলি গুরুত্ব পায়নি সেসব স্বৈরাচারি আরবদের কাছেও যারা অখন্ড আরব ভূখন্ড বিশেরও বেশী টুকরায় বিভক্ত করতে সাম্রাজ্যবাদী কাফের শক্তিকে সাহায্য করেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ আজও এসব শাসকদের সবচেয়ে বড় রক্ষক। একইভাবে মুজিব ও তাঁর অনুসারিদের রক্ষকের ভূমিকা নিয়েছে ভারত।
শুধু আলেম, ইসলামী দলগুলীর নেতাকর্মী ও রাজাকারগণই নয়, তাদের সাথে অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীও। অথচ সে প্রকট সত্যটিকে আজ ভূলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। যে মিথ্যাটি আজ জোরে শোরে বলা হচ্ছে তা হলো, পাকিস্তানের বিভক্তির বিরোধী করেছিল মুষ্টিমেয় রাজাকার। সেটি যে কতটা মিথ্যা তার কিছু প্রমাণ দেয়া যাক। সে সময় ৫৫ জন কবি, শিল্পি ও বুদ্ধিজীবী একটি বিবৃতি দেন। তাতে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপের বিরোধীতা ও নিন্দা করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ডক্টর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, প্রখ্যাত লেখক প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিভাগের প্রধান এম, কবীর, মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. মীর ফখরুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রিডার ড. কাজী দীন মোহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ও নাট্যকার নুরুল মোমেন, কবি আহসান হাবীব, চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমান, গায়িকা শাহনাজ বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচেরার ও নাট্যকার আশকার ইবনে শাইখ, গায়িকা ফরিদা ইয়াসমিন, পল্লী গীতির গায়ক আব্দুল হালিম, চিত্র পরিচালক এ. এইচ. চৌধুরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. মোহর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান মুনীর চৌধুরী, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের ড. আশরাফ সিদ্দিকী, গায়ক খোন্দকার ফারুক আহমদ, গায়ক এস, এ, হাদী গায়িকা নীনা হামিদ, গায়িকা লায়লা আর্জুমান্দ বানু, শামশুল হুদা চৌধুরী (জিয়া ক্যাবিনেটের মন্ত্রী এবং এরশাদ সরকারের পার্লামেন্ট স্পীকার), গায়ীকা সাবিনা ইয়াসমীন, গায়িকা ফেরদৌসী রহমান, গায়ক মোস্তাফা জামান আব্বাসী, ছোটগল্পকার সরদার জয়েদ উদ্দীন, লেখক সৈয়দ মুর্তুজা আলী, কবি তালিম হোসেন, ছোটগল্পকার শাহেদ আলী, মাসিক মাহে নও সম্পাদক কবি আব্দুস সাত্তার, নাট্যকার ফররুখ শীয়র, কবি ফররুখ আহম্মদ, পাকিস্তান অবজারভার (আজকের বাংলাদেশে অবজারভার) পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল সালাম, অধুনা বিলুপ্ত ঢাকার মর্নিং নিউজ পত্রিকার সম্পাদক এস, জি, এম বদরুদ্দীন, দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তী কালের দৈনিক বাংলা)সম্পাদক আবুল কালাম সামসুদ্দীন, অভিনেতা ও চিত্র পরিচালক ফতেহ লোহানী, কবি হেমায়েত হোসেন, লেখক আকবর উদ্দীন, লেখক আকবর হোসেন, লেখক কাজী আফসার উদ্দীন আহমেদ, লেখক ও সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী, লেখক ও কবি শাসসুল হক, লেখক সরদার ফজলুল করিম, গায়িকা ফওজিয়া খান প্রমুখ।– (সুত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান (অধুনালিপ্ত দৈনিক বাংলার পাকিস্তান আমলের নাম), ১৭ই মে, ১৯৭১ সাল)।
বিবৃতিতে উল্লিখিত স্বাক্ষরকারীগণ বলেন, “পাকিস্তানী শাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের নিজস্ব অভাব-অভিযোগ রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের যেটা প্রাপ্য সেটা না পেয়ে আমরা অসুখী। আমাদের এই অসন্তোষ আমরা প্রকাশ করেছি একই রাষ্ট্র কাঠামোর আওতায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে ভোট দিয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের চরমপন্থিরা এই সহজ সরল আইনসঙ্গত দাবীকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবীতে রুপান্তরিত করায় আমরা হতাশ ও দুঃখিত হয়েছি। আমরা কখনও এটা চাইনি, ফলে যা ঘটেছে আমরা তাতে হতাশ ও দুঃখিত হয়েছি। বাঙালী হিন্দু বিশেষ করে কোলকাতার মারোয়াড়ীদের আধিপত্য ও শোষণ এড়ানোর জন্যেই আমরা বাংলার মুসলমানেরা প্রথমে ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজত্বকালে পৃথক পূর্ব বাংলা প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেই। এবং আবার ১৯৪৭ সালে ভোটের মাধ্যমেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রদেশের মুসলিম ভাইদের সাথে যুক্ত হওয়ার সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। উক্ত সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত হওয়ার আমাদের কোন কারণ নেই। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু প্রদেশ হিসেবে সারা পাকিস্তানকে শাসন করার অধিকার আমাদের আছে। আর সেটা আয়ত্তের মধ্যেই এসে গিয়েছিল। ঠিক তখনই চরমপন্থিদের দুরাশায় পেয়ে বসল এবং তারা জাতীয় অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশে সাধারণ নির্বাচন দিলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আলোচনাকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে সংখ্যাগুরু দল হিসাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু উল্টোটাই ঘটে গেল এবং নেমে এল জাতীয় দুর্যোগ। .. কিন্তু আমরা আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন বড় রকমের হস্তক্ষেপের বিরোধীতা ও নিন্দা করছি।”
সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকেও পত্রিকায় আরেকটি বিবৃতি ছাপা হয়। তারা বলেন, “আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনায় গভীর বেদনা বোধ করছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, ভারতীয় যুদ্ধবাজ যারা মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টিকে কখনো গ্রহণ করেনি প্রধানত তাদের চক্রান্তের ফলেই এটা হয়েছে। …আমরা আমাদের প্রিয় স্বদেশ ভূমির সংহতি এবং অখন্ডতা রক্ষার জন্য আমাদের সেনাবাহিনীর সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশংসা করছি।.. আমরা দেশের সংহতি ও অখন্ডতা বিপন্ন করার জন্য চরমপন্থিদের অপপ্রয়াসের নিন্দা করছি। বহির্বিশ্বের চোখে পাকিস্তানের মর্যদা হ্রাস ও পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার অপচেষ্টা এবং সীমান্তে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের আমরা নিন্দা করছি। আমরা ভারতের ভিত্তিহীন ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রচারণার নিন্দা করছি। ভারতীয় বেতারে প্রচারিত একটি খবরের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। উক্ত খবরে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি, এটা নির্লজ্জ মিথ্যা প্রচারণা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের সকল ভবন অক্ষত অবস্থায় রয়েছে এবং কোন ভবনের কোনরূপ ক্ষতিসাধন হয়নি। আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি, বর্তমান মুহুর্তে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন আমাদের সকলের মধ্যে ঐক্য ও শৃঙ্খলা। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে আমরা বর্তমান সংকট হতে মুক্ত হতে পারব।” বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভিসি এবং আইন ফ্যাকাল্টির ডিন ইউ, এন, সিদ্দিকী, ইতিহাস বিভাগের প্রধান ও সাবেক ভিসি ড. আব্দুল করিম, সমাজ বিজ্ঞানের ডিন ড. এম, বদরুজ্জা, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের লেকচেরার মোহাম্মদ ইনামুল হক, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রধান ড. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রিডার মোঃ আনিসুজ্জামান, ইংরাজী বিভাগের সিনিয়র লেকচেরার খোন্দকার রেজাউর রহমান, রাষ্টবিজ্ঞানের লেকচেরার সৈয়দ কামাল মোস্তফা, রাষ্টবিজ্ঞানের লেকচেরার এম, এ, জিন্নাহ, ইতিহাসের সিনিয়র লেকচেরার রফিউদ্দীন, রসায়ন বিভাগের প্রধান এ, কে, এম, আহমদ, সমাজ বিজ্ঞানের সিনিয়র লেকচেরার রুহুল আমীন, বাণিজ্য বিভাগের প্রধান মোঃ আলী ইমদাদ খান, ইতিহাসের সিনিয়র লেকচেরার হোসেন মোঃ ফজলে দাইয়ান, বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচেরার মোঃ দিলওয়ার হোসেন, সংখ্যাতত্ত্বের সিনিয়র লেকচেরার আব্দুর রশিদ, ইতিহাস বিভাগের রিডার মুকাদ্দাসুর রহমান, ইতিহাসের লেকচেরার আহসানুল কবীর, অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার শাহ মোঃ হুজ্জাতুল ইসলাম, ইংরাজী বিভাগের প্রধান মোহম্মদ আলী, পদার্থ বিভাগের রিডার এজাজ আহমেদ, গণিতের লেকচারার জনাব এস, এম, হোসেন, গণিত বিভাগের রিডার জেড, এইচ চৌধুরী, সংখ্যাতত্ত্বের জনাব হাতেম আলী হাওলাদার, বাংলা বিভাগের রিডার ড. মোঃ আব্দুল আওয়াল, বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মোঃ মনিরুজ্জামান, বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মোঃ মনিরুজ্জামান হায়াত (লেখক হায়াত মাহমুদ), ইতিহাস বিভাগের গবেষণা সহকারী আব্দুস সায়ীদ, অর্থনীতির লেকচারার মোহাম্মদ মোস্তাফা, ইতিহাসের লেকচারার সুলতানা নিজাম, ইতিহাসের রিডার ড. জাকিউদ্দীন আহমদ এবং ফাইন আর্টের লেকচেরার আব্দুর রশীদ হায়দার। -(সুত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান, ২৭শে জুন, ১৯৭১)
সেকুলার চেতনার বুদ্ধিজীবীগণও তখন বসে থাকেনি। আওয়ামী ক্যাডারদের সশস্ত্র যুদ্ধের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থণ নিয়ে তারা এগিয়ে আসেন। তাদের মিশন হয়, যেভাবেই হোক পাকিস্তানের আশু ধ্বংস। ভারত, রাশিয়াসহ যে কোন দেশের সাহায্য লাভও তাদের কাছে অতি কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। তাদেরই ক’জন হলেনঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আবু সায়ীদ চৌধুরী, বাংলার অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক ড. মাযহারুল ইসলাম, ড. এ, আর, মল্লিক, কবি আল মাহমুদ, রণেশ দাস গুপ্ত, অধ্যাপক ড. এবনে গোলাম সামাদ, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, শওকত ওসমান, আসাদ চৌধুরী, সরোয়ার মুর্শেদ। এদের অনেকে ভারতেও পাড়ি জমান।
কারা দেশপ্রেমিক এবং কারা দালাল?
কারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক এবং কারা দালাল -তা নিয়ে কি আদৌ কোন সুবিচার হয়েছে? প্রশ্ন হলো, যেসব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ১৯৭১’য়ে অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন তাদের দর্শন ও উদ্দেশ্যটি কি ছিল? আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-বুদ্ধিজীবীগণ তাদেরকে চিত্রিত করেছে পাকিস্তানের দালাল রূপে। তারা কি সত্যই দালাল ছিলেন? দালালের সংজ্ঞা কি? দালাল তাদেরকে বলা হয়, যারা কাজ করে অন্যদেশের স্বার্থে। এবং সেটি করে অর্থলাভ বা সুবিধা লাভের আশায়। কিন্তু যারা সেদিন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন -তারা তো বিদেশের স্বার্থে কাজ করেননি। পাকিস্তান তাদের কাছে বিদেশ ছিল না, ছিল একান্ত নিজেদের দেশ। তারা কাজ করেছেন সে দেশটির স্বার্থে যে দেশটিকে তারা বা তাদের পিতামাতারা ১৯৪৬ সালে ভোট দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ দেশটির একতা ও সংহতি রক্ষার শপথ নিয়ে এমনকি শেখ মুজিবও অতীতে মন্ত্রী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সহরোওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। এমনকি দেশটিকে শক্তিশালী করার অঙ্গিকার ব্যক্ত করে শেখ মুজিব ১৯৭০ সনের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনী ভাষণে বার বার পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনিও দিয়েছেন। তাদের অপরাধ (?) শুধু এ হতে পারে, মুজিবের ন্যায় তারা সে অঙ্গিকারের সাথে গাদ্দারী করেননি। বরং অখন্ড পাকিস্তানের মধ্যে তারা নিজেদের কল্যাণ ও সে সাথে বিশ্ব-মুসলিমের কল্যাণ দেখেছেন। সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি রূপে মুসলিম উম্মাহর ভাগ্য নির্ধারণে তারা দেখতে পেয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ। দেশটির তিন বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানী। আর অর্থ লাভের বিষয়? তারা তো বরং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় এবং ভারতের মোকাবেলায় নিজেদের মেধা, শ্রম এমনকি প্রাণদানে হাজির হয়েছিলেন। সে চেতনা নিয়ে হাজার হাজার রাজাকার শহীদও হয়েছেন। কোন দালাল কি কারো খাতিরে প্রাণ দেয়? পাকিস্তান নয়, ভারত ছিল বিদেশ। নিজ দেশ পাকিস্তানের জন্য কাজ করা যদি দালালী হয় তবে যারা ভারতে গেল, ভারতীয় অর্থ নিল, তাদের ঘরে পানাহার করলো এবং ভারতীয় সেনাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করলো তাদের কি বলা যাবে?
দেখা যাক, যারা সে সময়ে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের নিজেদের অভিমত কি ছিল। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ অবজারভার ও দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার মালিক জনাব হামিদুল হক চৌধুরী তাদের নিজের অবস্থান নিয়ে ১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিলে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ভারতীয় প্রচরণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা এবং তার দ্বারা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে এদেশের অস্তিত্ব বিলোপ করে নিজস্ব সম্প্রসারণবাদী মনোভাব চরিতার্থ করা। এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এবং বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য তারা তাদের সকল প্রচার মাধ্যমের দ্বারা বিশ্ববাসীর নিকট হাজার হাজার নরহত্যা ও বোমাবর্ষণের ফলে শহর ধ্বংসের ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রচার করছে।”-(সুত্রঃ একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়?)। ১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিলে দেওয়া এক বিবৃতিতে জনাব শাহ আজিজুর রহমান (বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী) বলেন, “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রবল উৎকন্ঠার সঙ্গে রাজনৈতিক দলসমূহের অধিকতর স্বাধীনতা প্রদান পূর্বক দেশে পূর্ণ ও বাধাহীন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। .. আওয়ামী লীগ এই সুযোগের ভূল অর্থ করে বল প্রয়োগের … মাধ্যমে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে জয়লাভ করে নিজেদের খেয়ালখুশীতে দেশ শাসনের দাবী করে এবং এভাবেই অহমিকা, অধৈর্য এবং ঔদ্ধত্যের ফলে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়। ..আমি সাম্রাজ্যবাদী ভারতের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।”-(সুত্রঃ একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়?)। পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আব্দুল মান্নান ১৯৭১ য়ের ২৭ শে এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন, “সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমূলে উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনগণ আজ জেহাদের জোশে আগাইয় আসিয়াছে।” -(সুত্রঃ একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়?)। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর জনাব গোলাম আযম এক বিবৃতিতে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানীরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ভারতকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। .. পূর্ব পাকিস্তানীরা কখনই হিন্দু ভারতের দ্বারা প্রভাবিত হবে না। ভারতীয়রা কি মনে করেছে যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এতদূর অধঃপতন হয়েছে যে তারা ভারতকে তাদের বন্ধু ভাববে।” –(দৈনিক সংগ্রাম, ৮ই এপ্রিল, ১৯৭১)। পাকিস্তান ডেমোক্রাটিক পার্টির সভাপতি এবং পুর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জনাব নুরুল আমীন বলেন, “পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি এবং সে সংগ্রামে জয়ী হয়েছি। আজও পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে শক্তির মোকাবেলা করতে হবে। -(দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ই আগষ্ট, ১৯৭১)। পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টির সহসভাপতি ও প্রখ্যাত পার্লামেন্টারীয়ান জনাব মৌলবী ফরিদ আহমদ বলেন, “পাকিস্তানকে খন্তিত করা এবং মুসলমানদের হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য ফ্যাসীবাদীদের ক্রীতদাসে পরিণত করার ভারতীয় চক্রান্ত বর্তমানে নিরপেক্ষ বিশ্ববাসীর কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।… একমাত্র ইসলামের নামে এদেশের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ভারতীয় এজেন্টরা তথাকথিত সাংস্কৃতিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে এমন জঘন্য কাজ সম্পাদনে সক্ষম হয়েছে যা করতে হিটলারের ঘাতকদের বর্বরতাও লজ্জা পাবে। (সম্ভবতঃ এখানে তিনি ১লা মার্চ থেকে ২০ শে এপ্রিল পর্যন্ত দেশ আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের দখলে থাকার সময় অবাঙ্গালীদের উপর যে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ নেমে আসে সেটি বুঝিয়েছেন)-(দৈনিক পাকিস্তান ১৬ই আগষ্ট, ১৯৭১)। মুসলিম লীগ নেতা এবং পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পীকার জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, “জাতি আজ তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। ..পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৬ জন লোক পাকিস্তানের জন্য ভোট দিয়েছিল …ভারতীয় এজেন্টদের দ্বারা পরিচালিত তথাকথিত বাংলাদেশ বেতার থেকে দিনরাত তাঁর ও অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতার মৃত্যুদন্ডের কথা তারস্বরে ঘোষণা করা হচ্ছে। …পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করে যাব। কারণ পাকিস্তানই যদি না থাকে তাহলে অধিকারের জন্য সংগ্রামের অবকাশ কোথায়?”-(দৈনিক পাকিস্তান, ১৮ই জুলাই, ১৯৭১)।
কথা হলো, যারা এমন এক প্রবল চেতনা নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন তাদেরকে কি বিদেশীদের দালাল বলা যায়? তারা যদি দালালী করেই থাকেন তবে সেটি করেছেন তাদের নিজস্ব চেতনা-বিশ্বাস ও স্বার্থের সাথে। তারা লড়াই করেছিলেন এবং প্রাণ দিয়েছিলেন নিজদেশের প্রতিরক্ষায়। আজও একই চেতনা নিয়ে তারা কাজ করছেন বাংলাদেশে। দু’টি ভিন্ন চেতনা আবার সেদিনের মত মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশে। তাই বাংলাদেশে বিভক্তির রাজনীতি একাত্তরে শেষ হয়নি। শেষ হয়নি ভারতীয় আগ্রাসনও। বাংলাদেশের আজকের সমস্যা মূলতঃ ভারতপন্থিদের সৃষ্টি। তবে খেলা এখন বাংলাদেশের ঘরে নেই। বাংলাদেশ চাইলেও সেটি থামানোর সামর্থ্য তার নেই। নিয়ন্ত্রন নেই এমনকি আওয়ামী লীগেরও। বরং এ দলটি নিজেই খেলছে ভারতের ক্রীড়নক হিসাবে। একাত্তরেও একই অবস্থা ছিল। মুজিবের হাত থেকে খেলা আগেই ভারত নিয়ে নিয়েছিল। ফলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ভূট্টোর সাথে আলোপ আলোচনার সময় মুজিব শুধু তাই বলেছে যখন যা ভারত তাঁকে বলতে বলেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই ইতিমধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ঢাকার রাজপথে। অবশেষে বাকি খেলার পুরা দায়িত্ব ভারতকে দিয়ে জেনে বুঝে মুজিব পাকিস্তানের জেলে গিয়ে উঠেন। মুজিবনগর সরকার নামে যে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সামান্যই সামর্থ্য ছিল ভারতকে প্রভাবিত করার। বরং সে সরকার নিজের অস্তিত্ব নির্ভর করছিল ভারত সরকারের করুণার উপর।
ভারত চায় পঙ্গু ও অধীনত বাংলাদেশ
ভারতের স্ট্রাটেজী হলো, বাংলাদেশকে একটি দূর্বল রাষ্ট্র রূপে কোন মত বাঁচিয়ে রাখা। যে উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশগণ ৫ শতের বেশী রাজ্যকে নামে মাত্র স্বাধীনতা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল –ভারত সেটিই চায় বাংলাদেশকে। কারণ, ভারতের জন্য এটি এক রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। একাত্তরের যুদ্ধে ভারত বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছিল এবং তার হাজার হাজার সৈন্য প্রাণ দিয়েছিল সেটিও ছিল এ লক্ষেই। একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলাদেশ নির্মাণে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল -সেটি কিছু বাংলাদেশী বেওকুফ বিশ্বাস করলেও কোন ভারতীয় বিশ্বাস করেনি। ভারত ঠিকই বুঝে, বাংলাদেশ সবল হওয়ার মধ্যেই ভারতের বিপদ। তখন বল পাবে ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যের বিদ্রোহীরা। বল পাবে ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিম। ভারতের কাছে সেটি অসহনীয়। তাই আরেক পাকিস্তানকে কখনই তারা ভারতের পূর্ব সীমান্তে বেড়ে উঠতে দিবে না। এ নিয়ে তাদের আপোষ নেই। এজন্যই তাদের কাছে অতি অপরিহার্য হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিবাদ ও সংঘাত টিকিয়ে রাখা। কারণ এরূপ গৃহবিবাদই একটি দেশের মেরুদন্ড ভাঙ্গার মোক্ষম হাতিয়ার। তাই বিভক্তির সূত্রগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে ভারত ও ভারতপন্থিগণ সেগুলিকে লাগাতর পরিচর্যা দিচ্ছে। তাই জনজীবনে একাত্তরের বিবাদ ও বিভক্তি বিলুপ্ত না হয়ে দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। আরো লক্ষ্য হলো, ভারত-বিরোধীদের নির্মূলের প্রক্রিয়াকে বাঁচিয়ে রাখা। তাই মুজিব যা নিয়ে এগুনোর সাহস পায়নি, তার কন্যা তা নিয়ে বহু দূর এগিয়েছে। ফলে শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধের নামে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের হত্যা। শুরু হয়েছে হাজার হাজার বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর পুলিশী হয়রানী, নির্যাতন ও জেলজুলুম। ফ্রিডম পার্টি বা জামায়াতের নেতাদের নির্মূলই ভারতের একমাত্র লক্ষ্য নয়। বিএনপিকেও তারা নির্মূল করে ছাড়বে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ ও বিশাল পুঁজি বিণিয়োগের মূল লক্ষ্য তো এটিই।
তবে ভারত অতীতের ন্যায় এবার সব ডিম এক থলিতে রাখেনি। বিস্তর পুঁজি বিণিয়োগ হয়েছে আওয়ামী লীগের বাইরেও। সেটি বোঝা যায় মিডিয়া ও এনজিও জগতের দিকে তাকালে। মুজিব আমলেও এত পত্রিকা ও এত বুদ্ধিজীবী ভারতের পক্ষ নেয়নি -যা আজ নিচ্ছে। এরাই আজ আরেকটি যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরী করছে। সেটি পত্র-পত্রিকা ও টিভির মাধ্যমে ঘৃণার বীজ ছড়িয়ে। তাদের পক্ষ থেকেই বার বার দাবী উঠছে, “শুরু হোক আরেক একাত্তর” এবং “আবার গর্জে উঠুক একাত্তরের হাতিয়ার”। একাত্তরের এক যুদ্ধই বাংলাদেশকে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত করেছিল। আরেক যুদ্ধের ব্যয়ভারবহনের সামর্থ্য কি বাংলাদেশের আছে? তাছাড়া আরেক যুদ্ধ শুরু হলে সেটি কি নয় মাসে শেষ হবে? সেটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হবে না, সেটি হবে গৃহযুদ্ধ। আর গৃহযুদ্ধে কোন পক্ষ জিতে না, হারে সমগ্র দেশ। সেটি হবে বাংলাদেশের জন্য বড় আত্মঘাত। ভারত তো সেটিই চায়। ভারতের লক্ষ্যই হলো মুসলমানদের বিভক্ত করা, পঙ্গু করা এবং অবিরাম শাসন করা। অধিকৃত দেশের অভ্যন্তরে যে কোন শত্রুদেশের এটিই হলো অভিন্ন স্ট্রাটেজী। নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করার লক্ষ্য হলো বাঙালী মুসলিমদের মাঝের বিভক্তিকে আরো দীর্ঘজীবী ও প্রবলতর করা।
ভারতীয় কামানের মুখ এবার বাংলাদেশের দিকে
বাংলাদেশীদের মাঝে বিভক্তি গড়ার বড় কাজটি করছে মিডিয়া। ভারতের পক্ষে আজকের বুদ্ধিবৃত্তিক মূল যুদ্ধটি করছে বস্তুতঃ তারাই। আর আওয়ামী লীগের ন্যায় ভারতপন্থি দলগুলীর মূল কাজটি হয়েছে সে বিভক্তিকে একটি রাজনৈতিক সংঘাতে রূপ দেওয়া। কারণ, এ পথেই বাড়ে ভারতের অর্থলাভ ও সাহায্যলাভ। তাই বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া ও ভারতপন্থি দলগুলো এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করছে। ইসলামপন্থি এবং একাত্তরের পাকিস্তানপন্থিদের বিরুদ্ধে ভারতপন্থিদের আজকের আক্রমণ এজন্যই আজ নতুন মাত্রা পাচ্ছে। ফলে যে রাজনৈতিক বিভক্তি ও সংঘাতের আগুন জ্বলে উঠেছিল একাত্তরে, ৪০ বছর পরও সেটি নিভছে না। একাত্তরে তাদের কামানের মুখ ছিল পাকিস্তানের দিকে। কিন্ত এবারের রণাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান নেই। কামানের নল এবার খোদ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। একাত্তরের চেতনার নামে এটিই ভারত ও ভারতসেবীদের মরণছোবল। একাত্তরে কারা রাজাকার ছিল তাদের কাছে সেটিই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারা আজ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধী – তাদের রাডার তাদের বিরুদ্ধেও। নির্মূলের টার্গেট তারাও। বাঙালী মুসলিমদের দুর্বল করার এমন একটি মাস্টার প্লান নিয়ে ভারত ১৯৪৭ থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে লাগাতর বিনিয়োগ বাড়িয়েছিল। একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে সেটি অর্ধেক সফল হয়েছিল। সেটি বুঝা যায়, বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার পাকিস্তানী অস্ত্রের ভারতে পাচার এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির তলা ধ্বসিয় দেয়ার মধ্য দিয়ে। এবার তারা সফল করতে চায় বাঁকিটুকু। তারা ব্যর্থ করতে চায় বাঙালী মুসলিমদের স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলাদেশ নির্মাণের প্রকল্প। বিলুপ্ত করতে চায় ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠার স্বপ্ন। প্রশ্ন হলো, কোন ঈমানদার কি এরূপ ভারতীয় প্রকল্পকে সমর্থন করতে পারে? সমর্থন করলে কি সে মুসলিম থাকে? একাত্তরে যাদের জিহাদ ছিল অখণ্ড ও শক্তিশালী পাকিস্তান বাঁচানোর লক্ষ্যে, এখন তাদের জিহাদ হতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশ বাঁচাতে। একাজে তাদের কোয়ালিশন গড়তে হবে তাদের সাথেও যাদের ইতিমধ্যেই মোহমুক্তি ঘটেছে একাত্তরের মুজিবসৃষ্ট ভারত-প্রেম থেকে। নইলে ভারতীয় প্রজেক্টকে মোকাবেলা করা এবং ঈমান বাঁচানোই যে কঠিন হবে -তা নিয়ে কি সামান্যত সন্দেহ আছে? দ্বিতীয় সংস্করণ ১১/০৩/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018