বাংলাদেশের শিক্ষা-সংকট: সমাধান কীরূপে?
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on December 25, 2020
- Bangla Articles, শিক্ষা ও সংস্কৃতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
কতটুকু সফল হচ্ছে শিক্ষা?
শিক্ষাব্যবস্থার মূল্যায়নে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি ছাত্র, শিক্ষক বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানর সংখ্যা ও ইমারত নয়। কত বছর বা বছরে কত ঘন্টা ছাত্রকে শিক্ষা দেওয়া হয় -সেটিও নয়। স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, পিএইচডি বা সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কতজন বের হলো -সেটিও মাপকাঠি নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো, কতজন ছাত্র অন্ধকার থেকে আলোর পথ পেলো, কতজন দুর্বৃত্ত চরিত্রবান হলো, জাতির মেরুদন্ড কতটা মজবুত হলো এবং মানবিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক দিক দিয়ে জাতি কতটা সামনে এগোলো সেগুলি। এক্ষেত্রে ব্যর্থতা বাড়লে নিছক ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাওয়াতে দেশের কল্যাণ বাড়ে না। শিক্ষালয়েই নির্মিত হয় জাতির মেরুদন্ড। এখানে থেকেই জাতি পায় বেঁচে থাকা ও বেড়ে উঠার শক্তি। নির্মিত হয় জাতির মন, মনন ও সংস্কৃতি। তাই নিছক ক্ষেতে-খামারে ও কল-কারখানায় উৎপাদন বাড়ালে জাতি বাঁচে না। এজন্য বিদ্যাচর্চাও বাড়াতে হয়। বিবেক বা আত্মার পুষ্টির জন্য এটি অপরিহার্য। নইলে দেহ নিয়ে বেঁচে থাকাটি সম্ভব হলেও অসম্ভব হয় মানবিক গুণ নিয়ে বাঁচাটি।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহু বেড়েছে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু থানা পর্যায়েই নয়, ইউনিয়নেও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বহু জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাই সরকারি ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত। অথচ আজ থেকে শত বছর আগে সমগ্র দেশে একখানি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। অধিকাংশ জেলায় ছিল না কলেজ। আজ বিপুল হারে বেড়েছে ছাত্র-শিক্ষকের সংখ্যাও। কিন্তু বেড়েছে কি সেগুলিও যা শিক্ষা-বিস্তারের সাথে সাথে বেড়ে উঠা উচিত? নির্মিত হয়েছে কি চরিত্র? মজবুত হয়েছে কি জাতির মেরুদন্ড? বেড়েছে কি সততা, স্বনির্ভরতা, নৈতিকতা ও আবিস্কারের সামর্থ্য? বেড়েছে কি আত্মমর্যাদা? দূর্নীতির বিস্তারে বনজঙ্গলে বসবাসকারি বহু আদিবাসি থেকেও যে বাংলাদেশের জনগণ নীচে নেমেছে -সেটি কি গোপন বিষয়? বরং চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে ব্যর্থতাগুলি বেড়েছে ভয়ানক ভাবে। শিক্ষা খাতে ব্যর্থতার দলিল তো এই, দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বিশ্বের সব দেশকে অতিক্রম করে ৫ বার প্রথম হয়েছে। এসব দুর্বৃত্তগণ যে ক্ষেতখামার ও কলকারখানা থেকে আসেনি, বরং তাদের অধিকাংশই যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রিধারি -তা নিয়েও কি সন্দেহ আছে? এদুর্বৃত্তরা চাকুরির নামে সরকারি অফিসে বসে ঘুষ খাওয়া ও নানারূপ দুর্নীতি করাকে নিজেদের অধিকার মনে করে।
মূল সমস্যা কোথায়?
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা অনেক। তবে বড় সমস্যা অর্থাভাব নয়। বিদ্যালয় বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কমতিও নয়। বরং মূল সমস্যাগুলো শিক্ষাদানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, দর্শন ও শিক্ষা-পদ্ধতিতে। যা শেখানো হয় এবং যারা শেখায়, সমস্যা ঠিক সেই জায়গাতে। ১৪ শত বছর আগে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সভ্যতাটি যখন নির্মিত হয়েছিল তখন বাংলাদেশে আজ একটি জেলায় যত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা আছে তার সিকি ভাগও ছিল না। যত বই-পুস্তক ও শিক্ষাসামগ্রী নিয়ে আজ বিদ্যাবিতরণের আয়োজন, সেটিও ছিল না। অথচ সেদিন দারিদ্র্য ও অপ্রতুল অবকাঠামো নিয়ে মানবতা-সমৃদ্ধ অতি বিস্ময়কর সভ্যতার নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশে আজ কেন সেটি হচ্ছে না -সেটি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। চিন্তাশীল মানুষের উচিত তা নিয়ে ভাবা এবং সঠিক উত্তর খুঁজে বের করা। এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর সাথে জড়িত আমাদের বাঁচামরা।
ট্রেনের গতি বা সেবার মান বড় কথা নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো সেটি কোন দিকে যাচ্ছে -সেটি। বাংলাদেশর শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি অসৎ উদ্দেশ্যে চালু করেছিল ঔপনিবেশিক বৃটিশ শক্তি। প্রণীত হয়েছিল, ঔপনিবেশিক শাসনের একনিষ্ঠ সেবাদাস তৈরীর কাজে। এবং সে জন্য জরুরি ছিল, মুসলিমদের যেমন ইসলাম থেকে দূরে সরানো, তেমনি তাদেরকে চরিত্রহীন করা। কারণ তারা জানতো, মুসলিমদের চেতনায় ইসলাম থাকলে এবং তারা চরিত্রবান হলে –তারা কখনোই ঔপনিবেশিক শত্রু শক্তির সেবাদাস হবে না। তারা চেয়েছিল শিক্ষার নামে এমন এক শ্রেণীর মানুষ সৃষ্টি যারা রক্তমাংশে ভারতীয় হলেও বৃটিশের বিশ্বস্ত দাস হওয়াকে সন্মানজনক ভাববে। বৃটিশ শিক্ষামন্ত্রী লর্ড মেকলে বৃটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে সেটিই সগর্বে ঘোষণা করেছিল। এ লক্ষ্যে তারা সফলও হয়েছিল।
গোলাম সৃষ্ঠির কাজে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশগণ যে শুধু সেক্যুলার স্কুল-কলেজ খুলেছিল -তাই নয়। মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৭৮০ সালে কলিকাতায় উপমহাদেশের প্রথম আলিয়া মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল তৎকালীন বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিং। মাদ্রাসাটির মূল কাজ হয়, মুসলিমদের ইসলামের মৌল শিক্ষা থেকে দূরে সরানো। ছাত্রদের সামনে মহান আল্লাহতায়ালকে পরিচিত করানো হয় স্রেফ উপাস্য রূপে। তিনি যে রাষ্ট্রের উপর সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, সে রাষ্ট্রের আইনদাতা যে একমাত্র তিনিই এবং সে আইনের প্রতিষ্ঠায় জিহাদ করা ও সেগুলি মেনে চলা যে ফরজ –ইসলামের সে মৌলিক শিক্ষাগুলি পরিকল্পিত ভাবে পাঠ্যসূচী থেকে দূরে সরানো হয়েছিল। ফলে সে শিক্ষায় লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে অধিক।
শিক্ষিতরা নিজ দ্বীনের প্রতিষ্ঠায় এবং নিজ দেশের স্বাধীনতায় শ্রম দিবে, অর্থ দিবে, এমনকি প্রাণও দিবে – সেটিই তো কাঙ্খিত। এমন আত্মত্যাগে শিক্ষাব্যবস্থা দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করবে এবং সততা ও আত্ম-ত্যাগকে দেশের আচারে পরিণত হবে –সেটিই তো শিক্ষানীতির কাজ। কিন্তু বৃটিশের গড়া শিক্ষাব্যবস্থায় সেটি হয়নি। বরং সে শিক্ষাব্যবস্থায় তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ নিজেদেরকে বৃটিশের ‘মোস্ট-অবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’ রূপে পরিচিতি দিতে লজ্জাবোধ করেনি। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের পক্ষে তারা যে শুধু কলম ধরেছে বা অফিস আদালতে কাজ করেছে -তাই নয়। দেশে-বিদেশে ঔপনিবেশিক শাসন বাঁচাতে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে এবং অস্ত্রও ধরেছে। বহু স্বদেশীকে হত্যাও করেছে। এমনকি নিরপরাধ মানবহত্যায় ইরাক, ফিলিস্তিন, আফ্রিকা, ইন্দোচীনসহ নানা দেশে গেছে। সাম্রাজ্যবাদীদের দেওয়া মজুরি, পদবী ও উপঢৌকনকে এরা জীবনের বড় অর্জন ভেবেছে। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনমূক্ত হলেও পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মানুষ নিজ দেশে ও নিজ ধর্মে অঙ্গিকারহীন এসব বৃটিশ-সেবাদাসদের শাসন থেকে মুক্তি লাভ করেনি। ফলে কিছু রাস্তা-ঘাট, স্বুল-কলেজ ও শিল্প-করখানা নির্মিত হলেও শিক্ষার মূল লক্ষ্যে পরিবর্তন বা সংস্কার আসেনি। বার বার ভূগোল বা সরকার পরিবর্তন হলেও তাই পরিবর্তন আসেনি বাঁচবার লক্ষ্যে ও রূচীবোধে। বিদেশী স্বার্থের সেবক তৈরীর যে লক্ষ্যে এটি প্রণীত হয়েছিল এখনও সে কাজ অব্যাহত ভাবে চলছে। বিদেশী কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি অঙ্গিকারে নিজ-দেশ ও নিজ-ঐতিহ্য ছেড়ে এরা বিশ্বের যে কোন দেশে সেবাদাসের দায়িত্ব পালনে রাজি। বাংলাদেশে এজন্যই দেশপ্রেমিক নাগরিকের প্রচন্ড অভাব। অথচ অভাব হয় না বিদেশী এনজিও বা সংস্থার এজেন্ট পেতে।
কেন শিক্ষা?
কথা হলো, কেন শিক্ষা? কেনই বা মানুষ শিক্ষিত হবে? শিক্ষার উদ্দেশ্যই বা কি? মানব জীবনের এগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অথচ এর কোন সর্বজন-সম্মত উত্তর নেই। এ জগতে সবাই যেমন একই উদ্দেশ্যে বাঁচে না তেমনি একই উদ্দেশ্যে শিক্ষিতও হয় না। অনেকেই শিক্ষাকে বেশী বেশী জানার মাধ্যম মনে করেন। কেউ ভাবেন, শিক্ষার কাজ যুগোপযোগী নাগরিক গড়া। কেউ বলেন, এর লক্ষ্য ব্যক্তিত্বের বিকাশ। কারো মতে, এটি অর্থ-উপার্জনের মাধ্যম। শিক্ষা নিয়ে মানুষের এরূপ ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার কারণগুলো হলো মগজে বাসাবাঁধা ভিন্ন ভিন্ন জীবন-দর্শন। তাই শিক্ষা নিয়ে মুসলিমের ভাবনা অমুসলিমদের ভাবনা থেকে ভিন্নতর। কারণ, অমুসলিম যে উদ্দেশ্যে বাঁচে, মুসলিম সে উদ্দেশ্যে বাঁচে না। লক্ষ্য ও পথ ভিন্ন হলে, বাহন ও পাথেয় ভিন্ন ভিন্ন হয়। ফলে মুসলিমের হালাল-হারামের বাছ-বিচার শুধু পানাহারের ক্ষেত্রে নয়। একই রূপ বাছবিচার হয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও। দেহের প্রয়োজনের ন্যায় মুসলিমের মনের প্রয়োজনও অমুসলিম থেকে ভিন্ন।
মুসলিমের শিক্ষার মূল লক্ষ্যের কাজ বাঁচার মূল লক্ষ্যে সফলতা দেওয়া। বাঁচার লক্ষ্য ও শিক্ষার লক্ষ্যকে পরস্পরে পরিপূরক হতে হয়। প্রশ্ন হলো, বাঁচার লক্ষ্য কি? এ প্রশ্নের উত্তর অমুসলিমের কাছে যাই হোক, মুসলিমের কাছে সেটিই যা পবিত্র কোর’আনে বর্ণীত হয়েছে। এবং সেটি হলো: “আল্লাযী খালাকাল মাউতা ও হায়াতা লি ইয়াবলুয়াকুম আইয়োকুম আহসানা আমালা” অর্থ: তিনি (সেই মহান আল্লাহ) যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন এজন্য যে, তিনি পরীক্ষা করবেন তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে কে উত্তম।”-(সুরা মূলক, আয়াত-১)। অর্থাৎ দুনিয়ার এ জীবন হলো পরীক্ষাকেন্দ্র। এবং বাঁচার লক্ষ্যটি হলো সে পরীক্ষায় পাশ করা। প্রতি মুহুর্তে এ ভয় নিয়ে বাঁচতে হয়, পরীক্ষার শেষ ঘন্টাটি যখন তখন বেজে উঠতে পারে। যেহেতু এ পরীক্ষায় পাশের উপর নির্ভর করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাতপ্রাপ্তী, এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা মানবজীবনে নেই। একই কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ পরীক্ষায় পাশের প্রস্তুতি। এবং এ প্রস্তুতির জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা। ইসলামে জ্ঞানচর্চা এজন্যই ফরয। এবং সেটি ফরয করা হয়েছে নামায ফরয করার ১১ বছর পূর্বে। পানাহার জোগারের সামর্থ্য পশুরও থাকে। মুসলিম জীবনে জ্ঞানার্জনের প্রধান লক্ষ্য, জীবনের মূল পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য বাড়ানো এবং মহান আল্লাহতায়ালার মাগফিরাত লাভের যোগ্য করা। তবে মাথা টানলে কান-নাক এমনিতেই আসে, তেমনি আখেরাতের পাশের সামর্থ্য বাড়লে, সামর্থ্য বাড়ে বিশ্ব মাঝে বিজয়েরও। যে জ্ঞানচর্চায় জান্নাতপ্রাপ্তি ঘটে তাতে প্রতিষ্ঠা বাড়ে দুনিয়াতেও। এমন শিক্ষায় সামর্থ্য বাড়ে নেক আমলের। সাহাবায়ে কেরাম সেটিই প্রমাণ করে গেছেন। নেক আমলের বর্ণনা দিতে গিয়ে নবীপাক (সাঃ) বলেছেন, পথ থেকে একটি কাঁটা ফেলে দেওয়াও নেক আমল। অর্থাৎ ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ববাসীর জন্য যা কিছু কল্যানকর, এমন প্রতিটি কর্মই হলো নেক আমল। তাই শুধু পথের কাঁটাই নয়, সাহাবায়ে কেরাম অর্থ, শ্রম ও রক্তব্যয় করেছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঁটা সরাতে। অন্য সব কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে শুধু নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ও নানারূপ নফল ইবাদতে মগ্ন হওয়া তাই নবীজীর সূন্নত নয়।
জ্ঞানার্জন শুধু পথের কাঁটা ফেলাতে শেখায় না, গলার, নাড়ীর ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে কাঁটা সরানেরা সামর্থ্যও দেয়। জ্ঞানের বদৌলে ব্যক্তি পায় বিস্ময়কর সৃষ্টিশীলতা। ইসলামে জ্ঞানচর্চা তাই নিছক কিতাব নির্ভর নয়, বরং আমল-নির্ভর। কর্মজগতের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটায় জ্ঞানচর্চার। তাছাড়া যথার্থ জ্ঞানলাভ না হলে ধর্মকর্মও সঠিক হয় না। সম্ভব হয় না সিরাতুল মোস্তাকিমে চলাটিও। জ্ঞানের মাধ্যমেই বাড়ে কোটি কোটি মানুষকে অল্প সময়ে আলোকিত করার সামর্থ্য। সামর্থ্য দেয় বিস্ময়কর বিশ্বলোককে দেখার এবং তা নিয়ে ভাবার। ফলে শিক্ষিত মানুষটি দেখতে পায় মহান আল্লাহর কুদরতকে। জ্ঞানের বদৌলতেই সে দেখে মহাশূণ্যে, মহাসাগরের গভীরে, পত্র-পল্লবে সর্বত্র মহান আল্লাহতায়ালার আয়াতকে। ফলে বৃদ্ধি পায় তাঁর ঈমান। তখন মন মগ্ন হয় যিকিরে। এদের সন্মন্ধেই পবিত্র কোর’আনে বলা হয়েছে, “যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়ানো, বসা ও শয়ন অবস্থায় এবং চিন্তাভাবনা করে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে এবং বলে হে আমাদের রব, আপনি এসব অহেতুক সৃষ্টি করেননি। আপনারই সকল পবিত্রতা, আমাদের রক্ষা করুণ জাহান্নামের আগুন থেকে।” –(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১৯১ )।
যে আত্মঘাত শিক্ষাঙ্গণে
শিক্ষিত ব্যক্তির ঈমান বাড়লে বিপুল ভাবে বাড়ে তাঁর মানব-কল্যাণের সামর্থ্যটি। তখন মানব-কল্যাণ তাঁর জীবনের মিশন হয়ে যায়। সে যেমন কৃষি ফলন বাড়িয়ে লাঘব করে ক্ষুদার্ত মানুষের যাতনা, তেমনি যুদ্ধাস্ত্র বানিয়ে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা দেয় ইসলামি রাষ্ট্রের এবং বিনাশ ঘটায় দূর্বৃত্ত শক্তির। জ্ঞানলাভ এভাবেই সমৃদ্ধি আনে নেক আমলে এবং সামর্থ্য দেয় পরীক্ষাপাশে। এ সামর্থ্য বাড়াতেই নবীজী (সাঃ) এমনকি সুদূর চীনে যেতে বলেছেন। নবীজী (সাঃ)’র সে নির্দেশ নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিলেন সেকালের মুসলিমগণ। বিজ্ঞানচর্চাকে তারা কখনোই দুনিয়াদারী ভাবেননি, বরং উঁচু পর্যায়ের নেক-আমল ভেবে তাতে বিপুল অর্থ, শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করেছিলেন। ফলে কয়েক শত বছরের মধ্যে বিশ্বের নানা ভাষা থেকে বিজ্ঞানের অসংখ্য পুস্তক আরবীতে তর্জমা করেছিলেন এবং গড়ে তুলেছিলেন বিশাল জ্ঞান-ভান্ডার। ফলে স্বল্প সময়ে সম্ভব হয়েছিল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মান এবং বিশ্বশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠালাভ।
বিজ্ঞানচর্চাকে দুনিয়াদারি বলা শুধু মুর্খতাই নয়, আত্মঘাতীও। এমন মুর্খতায় যে শুধু নেক আমলের কমতি দেখা দেয় -তা নয়। মুসলিম উম্মাহ তাতে পরাজিত এবং অপমানিত হয়। আর এরূপ আত্মঘাতী কর্ম সমাজে ব্যাপ্তি পেলে বহিঃশক্তির প্রয়োজন পড়ে কি? মুসলিমদের আজকের পরাজয়ের মূল কারণ, শিক্ষার গুরুত্ব ও নেক-আমল নিয়ে বিভ্রান্তি। মানব জীবনে বড় পাপ হলো জাহেল বা অজ্ঞ থাকা। এ পাপ ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠাকে অসম্ভব করে এবং টানে জাহান্নামের পতে। এ পাপ অনিবার্য করে পরাজয় ও অধঃপতন। অথচ এ পাপে রেকর্ড গড়েছে মুসলিমগণ। ফলে পরাজয় ও অধঃপতন তাদের ঘিরে ধরেছে। শিক্ষা নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে বিজ্ঞানচর্চাকে দুনিয়াদারি বলে সেটিকে মাদ্রাসার অভ্যন্তরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ইতিহাস বিজ্ঞান, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান, দর্শনের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও গুরুত্ব পায়নি। গৌরবযুগে আলেমগণ আসমানের তারকারাজী নিয়েও গবেষণা করতেন। অথচ মাদ্রাসা শিক্ষায় গুরুত্ব পায় না নিজ দেশের সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস ও ভূগোল। দেশের হাজার হাজার মাদ্রাসা ও তার শিক্ষকগণ আজও বেঁচে আছে জ্ঞানবৈরী অদ্ভুদ বিশ্বাস নিয়ে। বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার এটি অতিশয় আত্মঘাতী দিক। আধুনিক জ্ঞানের সন্ধানে আলেমগণ সুদূর চীনে যাওয়া দূরে থাক নিজ দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও খোঁজ নেয়নি। তারা উদ্যোগী হয়নি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঁটা সরাতে। আবর্জনা সরানো হয়নি দেশের রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রশাসন থেকে। এমনকি নানারূপ দূর্নীতির আবর্জনা জমেছে খোদ মাদ্রাসাগুলির অভ্যন্তরে। ফলে দেশ যে আজ দূর্নীতির শিকার সে জন্য আলেমগণও কি কম দায়ী?
পরীক্ষাকেন্দ্রে বসে কোন পরীক্ষার্থী আমোদফুর্তিতে মত্ত হয় না। জানালায় দাঁড়িযে প্রৃকৃতির দৃশ্য দেখে না। বরং নেক কাজে যা কিছু অমনযোগী করে -তা থেকে নিজেকে দূরে রাখে। আখেরাতে সঞ্চয় বাড়াতে কাজে লাগায় প্রতিটি মুহুর্তকে। আনন্দ-উল্লাস বা শিল্প-সংস্কৃতির নামে মুসলিম তাই নাচগান, উলঙ্গতা, অশ্লিলতাকে প্রশ্রয় দেয় না। এগুলি জীবনের মূল মিশন থেকে বিচ্যুত ও বিভ্রান্ত করে। মহাবিপদ ডেকে আনে ব্যক্তির জীবনে। এগুলি এজন্যই ইসলামে হারাম। বরং মোমেন সদাসর্বদা ব্যস্ত থাকে নেক আমলে। খলিফা হয়েও ভৃত্তকে উটের পিঠে চড়িয়ে নিজে রশি ধরে টানা বা রাতে না ঘুমিয়ে আটার বস্তা নিজে কাঁধে গরীবের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার মত ইতিহাস নির্মিত হয়েছে এমন এক বলিষ্ঠ চেতনার কারণেই। নিজে সূদখোর, ঘুষখোর বা দুর্বৃত্ত হওয়া দূরে থাক, রাষ্ট্র ও সমাজকে দুর্বৃত্তমূক্ত করার নিয়তে সে শুধু শ্রম ও অর্থই দেয় না, জীবনও দেয়। এমন সৃষ্টিশীল চেতনা শূন্যে নির্মিত হয় না। এজন্য জ্ঞান চাই এবং জ্ঞানচর্চার উপযুক্ত কেন্দ্রও চাই। নবীজী (সাঃ) এবং সাহাবায়ে কেরাম কলেজ-বিশ্ববিদ্ব্যালয় না গড়লেও মসজিদের মেঝেতে জ্ঞানচর্চার এমন কেন্দ্র গড়েছিলেন। মুসলিম সমাজে সৃষ্টিশীল মানুষ ও আত্মত্যাগী মুজাহিদ সৃষ্টি হয় এমন প্রতিষ্ঠানের কল্যাণেই। সাম্রাজ্যবাদের দাস হওয়া দূরে থাক, তাদের আধিপত্য বিলুপ্তির কাজে এমন মুজাহিদগণ প্রাণপণে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। যে সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা অধিক সে দেশের স্বাধীনতা মীরজাফরের বিশ্বাসাতকতায় বিপদগ্রস্ত হয় না। স্বাধীনতার সুরক্ষায় তখন যুদ্ধ হয় প্রতি মহল্লায়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার মত বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করেছে তো এরাই।
আলো যেমন অন্ধকার দূর করে, শিক্ষাও তেমনি সমাজ থেকে অনাচার ও দূর্নীতি সরায়। বিদ্যালয় এভাবে সমাজ বিপ্লবে ইঞ্জিনের কাজ করে। শিক্ষাব্যবস্থার সফলতার বিচার হয় কতজন ছাত্র দেশ গড়ার কাছে নিজের শ্রম, মেধা, অর্থ ও রক্তের বিনিয়োগ করে -তা দিয়ে। অথচ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষানীতির ব্যর্থতাটি বিশাল। এর বড় প্রমাণ, দেশগড়ার ময়দানে আত্মত্যাগী মানুষের স্বল্পতা। বরং ব্যাপক ভাবে বেড়েছে স্বার্থপরতা। উচ্চশিক্ষা নিয়ে যারা বের হচ্ছে তাদের বিপুল ভাগই দু’পায়ে খাড়া বিদেশে বা বিদেশীদের সংস্থায় মেধা বিনিয়োগে। স্বার্থপরতা নিয়ে নামছে সন্ত্রাসে। এবং লুণ্ঠনে হাত দিচ্ছে জাতীয় সম্পদে। ফলে যতই বাড়ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ততই বাড়ছে দূর্বৃত্তদের সংখ্যা; যেমন আবর্জনা বাড়লে বাড়ে মশা-মাছির সংখ্যা। ফলে দেশ পরাজিত হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির উপর আধিপত্য বিস্তারে শত্রুকে তাই সীমান্ত-যুদ্ধ করতে হচ্ছে না। আমরা পরাজিত হচ্ছি ঘরের শত্রুদের হাতে। বাংলাদেশ আজ দূর্নীতিতে যেরূপ রেকর্ড গড়ছে -সেটি কি মহামারি, জলবায়ু বা প্লাবনের কারণে? অশিক্ষা, রোগব্যাধী বা দারিদ্র্যের কারণে হলে, সেটি আজ থেকে ১০০ বছর আগেই হওয়া উচিত। কারণ আজকের তুলনায় এগুলি তখনই অধিক ছিল।
মানুষ বিশ্বাস, কর্ম ও আচারণে ভিন্ন হয় ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষার কারণে। বস্তুর ব্যক্তির শিক্ষা দৃশ্যমান হয় তার কর্ম ও আচরণের মধ্য দিয়ে। কোর’আনে এজন্য বলা হয়েছে, “যে জানে ও জানে না তারা উভয়ে এক নয়।” জ্ঞানার্জন ফরয শুধু মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসার শিক্ষকের উপর নয়, প্রতিটি মুসলিমের উপরও। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিম হয়েছেন অথচ জ্ঞানার্জনে সময় দেননি -এমন কোন সাহাবী খুঁজে পাওয়া যাবে না। এবং শুধু অংক, বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, অর্থনীতি, চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানার্জন হলে চলে না। ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠার জন্য ওহীর জ্ঞান (কোর’আন) এবং হাদীসের জ্ঞানও শিখতে হয়। এ ফরয আদায় না হলে যেমন ঈমান-আমল বিশুদ্ধ হয় না, তেমনি আখেরাতে নাযাত প্রাপ্তির কাজটিও সহজ হয় না। এ ফরযে তাই ক্বাযা নেই। মুসলিম দেশের সরকারের দায়িত্ব, দেশের মুসলিম নাগরিকদের এ ফরয আদায়ের ব্যবস্থা করা। সরকারের এটি মৌলিক ও অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কাফের দেশের সরকার থেকে মুসলিম দেশের মূল পার্থক্য এখানেই। এ দায়িত্ব পালনে অতীতে মুসলিম সরকারগুলি বড় বড় মাদ্রাসা গড়েছে। মাদ্রাসার খরচ নির্বাহের জন্য বিশাল বিশাল ওয়াক্ফ স্টেটের ব্যবস্থা করেছে।
যে ব্যর্থতা সরকারের
সাধারণ নাগরিক নিজ উদ্যোগে খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে পারে, কিন্ত জ্ঞানার্জনের এ ফরয আদায়ে ঘরে ঘরে মাদ্রাসা খুলবে, সিলেবাস প্রণয়ন বা বই রচনা করবে -সেটি কি সম্ভব? আর নাগরিকগণ সে দায়িত্ব নিলে সরকারের কাজটি কি? তাহলে সরকারকে কেনই বা তারা রাজস্ব দিবে? অথচ বাংলাদেশ ১৭ কোটি মুসলিমের দেশ হওয়ার সত্ত্বেও দেশের সরকার শিক্ষানীতিতে মুসলিমের সে ফরয আদায়ে সহায়তা দিতে কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। সেকুলার শিক্ষার পাশাপাশি দ্বীনিয়াতের কিছু পৃষ্ঠা বাড়িয়ে ইসলামি জ্ঞানার্জনের ফরয আদায় হয় না। যেমন বিষের সাথে কয়েক চামচ সরবত পানে স্বাস্থ্য বাঁচে না। এমন দুষিত শিক্ষায় পুষ্টি পায় না ঈমান। অথচ বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটিই চালু রয়েছে। ফলে এ শিক্ষায় পূর্ণ-মুসলমান রূপে বেড়ে উঠাটি নিশ্চিত হচ্ছে না। বরং সেক্যুলার শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামের প্রতি অনীহা ও বহু ক্ষেত্রে ঘৃণাও সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে মুসলিমের রাজস্ব ব্যয় হয়েছে তার নিজ সন্তানকে জাহান্নামের দিকে ধাবিত করার কাজে। সরকারের এ ব্যর্থতার বিরুদ্ধে কোন ঈমানদার ব্যক্তি কি চুপ থাকতে পারে? চিকিৎসার নামে বিষ পান হলে প্রতিবাদ হয়। অথচ বিদ্যাশিক্ষার নামে ব্যাপক হারে ঈমান নাশ হলেও তা নিয়ে প্রতিবাদ নেই। প্রতিরোধও নেই। অথচ শিক্ষাদান যথার্থ হলে সেটি ছাত্রকে অনৈসলামিক চিন্তা ও ধ্যানধারণা থেকে বাঁচতে পারতো, দিতে পারতো দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ ক্ষমতা। দূর্নীতিতে রেকর্ড না গড়ে ঈমান নিয়ে তখন শক্ত ভাবে ছাত্রগণ দাঁড়াতে পারতো। ভ্যাকসিন শিশুকে রোগভোগের বিরুদ্ধে ইম্যুনিটি দেয়, শিক্ষা তেমনি ইম্যুনিটি দেয় নৈতিক রোগের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতাটি ভয়ানক। দুর্বৃত্তির বিরুদ্ধে ইম্যুনিটি দূরে থাক, এ শিক্ষাব্যবস্থা বিপন্ন করছে সন্তানদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাকে। শিক্ষানীতি পরিণত হয়েছে তাগুতের তথা শয়তানী শক্তির মোক্ষম হাতিয়ারে।
যে ব্যর্থতাটি বিশাল
শিক্ষার মূল লক্ষ্য কি নিছক তথ্য ও তত্ত্ব নিয়ে জ্ঞানদান? শুধু কি বিজ্ঞান বা কারগরি কৌশলে দক্ষ করা? বরং সেটি হলো, ব্যক্তির ঘুমন্ত বিবেক ও সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করা। এবং মানবকে তার মানবিক গুণে বেড়ে উঠতে সাহায্য করা। সুপ্ত শক্তির আবিস্কারে এ বিশ্বাসটি জরুরি, প্রতিটি ব্যক্তির গভীরে যে সম্পদ লুকিয়ে আছে তা সোনার খনির বা তেলের খনির চেয়েও মূল্যবান। সমাজে শান্তি আসে এবং উন্নততর সভ্যতা নির্মিত হয় বস্তুত সে মানবিক সম্পদের বিস্ফোরণের ফলে। উচ্চতর মানব সভ্যতার নির্মান কাজে প্রাকৃতিক সম্পদ সহায়ক শক্তি বটে, কিন্তু মূল শক্তি নয়। তাই উন্নত জাতিসমূহ শুধু মাটি বা সাগরের তলাতেই অনুসন্ধান করে না, বরং আবিস্কারে হাত দেয় মানুষের মনের গভীরে। মানুষের নিজ শক্তি আবিস্কৃত না হলে প্রাকৃতিক শক্তিতে তেমন কল্যাণ আসে না। তাই আফ্রিকার সোনার খনি বা আরবদের তেলের খনি সে এলাকার মানুষের জন্য ডেকে এনেছে বিশ্বের নানা কোণ থেকে সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের। প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস স্বৈরাচারকে। জন্ম দিয়েছে রক্তাত্ব যুদ্ধের। অথচ মানুষকে সভ্যতর কাজে ও সভ্যতার নির্মানে নবীজী (সাঃ) হাত দিয়েছিলেন, ব্যক্তির সুপ্ত শক্তির আবিস্কারে। ফলে সমগ্র মানব-ইতিহাসে সাহাবায়ে কেরাম পরিণত হয়েছিলেন সবচেয়ে সৃষ্টিশীল ও চরিত্রবান মানুষে। ফেরেশতাদের চেয়েও তারা উঁচুতে উঠতে পেরেছিলেন। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষানীতির ব্যর্থতাগুলো এ ক্ষেত্রে বিশাল।
বিবেকের বধ্যশালা
বীজ থেকে অঙ্কুরোদগমের জন্য চাই উপযুক্ত মাটি, পানি ও জলবায়ু। নইলে তা থেকে চারা গজায় না, এবং গজালেও বেড়ে উঠে না। তেমনি ব্যক্তির সুপ্ত শক্তি ও সামর্থ্যের বেড়ে উঠার জন্যও চাই উপযুক্ত পরিবেশ। সেরূপ একটি পরিবেশ দিয়ে সাহায্য করাই বিদ্যালয়ের মূল কাজ। তখন জেগে উঠে ব্যক্তির ঘুমন্ত বিবেক। বেড়ে উঠে সৃষ্টিশীলতা। উৎকর্ষ পায় তার ব্যক্তিত্ব। বিদ্যালয়ে এ কাজ না হলে তখন দেহ হত্যা না হলেও নিহত হয় শিশুর সুপ্ত সৃষ্টিশীল সামর্থ্য। তখন বিদ্যালয় পরিণত হয় বিবেকের বধ্যশালায়। তখন মানুষ পরিণত হয় নিজেই নিজের বিবেক ও প্রতিভার কবরস্থানে। বাংলাদেশের বিদ্যালয়ে এভাবেই খুণ হচেছ বহু খালেদ, তারেক, ইবনে সিনা, ফারাবী, তারাবীর ন্যায় প্রতিভা। তবে ভয়ানক বিপদটি শুধু প্রতিভার হত্যাকান্ডতেই সীমিত নয়। জমিতে ফসল না ফলালে যেমন বাড়ে আগাছার তান্ডব, তেমনি সৃষ্টিশীল মানুষের আবাদ না হলে বেড়ে উঠে দুর্বৃত্তরা। বাংলাদেশে সেটিই হয়েছে অতি ব্যাপক ভাবে। ফলে লাশ পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে গড়ে উঠা ছাত্রদের হাতে। বাংলাদেশে বিপদের মূল হেতু এখানেই। দুর্বৃত্তগণ যে শুধু পতিতাপল্লী, জোয়ার আসর ও ড্রাগের বাবসা দখলে নিয়েছে -তাই নয়। রাজনীতি, অফিস আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিও তারা দখলে নিয়েছ। বাংলাদেশ দূর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়েছে। সেটি নিছক ছিঁচকে চোর বা রাস্তার সন্ত্রাসীদের কারণে নয়, বরং দুর্বৃত্তদের দখলদারি দেশের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে।
পশু থেকে মানুষ যে কারণ পৃথক সেটি হলো তার চেতনা। এ চেতনা দেয় চিন্তা-ভাবনার সামর্থ্য। এবং এ চিন্তা-ভাবনা থেকেই ব্যক্তি পায় সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় এবং ধর্ম-অধর্ম বেছে চলার যোগ্যতা। ধর্ম নিয়ে বা মানবিক ভাবে বেড়ে উঠার জন্য এটি এতই গুরুত্বপুর্ণ যে পবিত্র কোরআনে বার বার বলা হয়েছে, ‘আফালাতা’কীলুন’, ‘আফালাতাদাব্বারূন’ ‘আফালাতাফাক্কারুন’ বলে। অর্থঃ ‘তোমরা কেন চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাও না?’ ‘তোমরা কেন ধ্যানমগ্ন হও না?’, ‘তোমরা কেন ভাবনা?’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবিক গুণ তাই দৈহিক বল নয়, বরং সেটি চিন্তাভাবনার সামর্থ্য। চিন্তার সামর্থ্য অর্জিত হলে নিজেকে শিক্ষিত করার কাজে সে শুধু সুশীল ছাত্র রূপেই বেড়ে উঠে না, নিজেই নিজের শিক্ষকে পরিণত হয়। এমন ব্যক্তির জীবনে শেখা এবং শেখানো -এ দুটোই তখন সমানে এগোয়। ঈমানদার তাই সর্বাবস্থায় ছাত্র, তেমনি সর্বাবস্থায় শিক্ষকও। ফুলে ফুলে ঘুরে মধুসংগ্রহ যেমন মৌমাছির ফিতরাত, তেমনি সর্বমুহুর্তে ও সর্বস্থলে জ্ঞানার্জন ফিতরাত হলো প্রকৃত জ্ঞানীর। তখন জ্ঞানের সন্ধানে সাগর, মরুভুমি, পাহাড়-পর্বত অতিক্রমেও সে পিছপা হয়না। বিদ্যালয়ের কাজ তো সে ফিতরাতকে জাগ্রত করা। শিক্ষকের দায়িত্ব, বিবেকের সে জাগরণকে বিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি কোনে পৌঁছে দেয়া। তখন সমগ্র দেশ পরিণত হয় পাঠশালায়। নবীজী (সাঃ)’র আমলে সেটিই হয়েছিল। ফলে সে সময় কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলেও যে হারে ও যে মাপে জ্ঞানী ব্যক্তি সৃষ্টি হয়েছিলেন -মুসলিম বিশ্বের শত শত বিশ্ববিদ্যালয় আজ তা পারছে না।
আজকের সমস্যা হলো, সে আমলে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব একজন গৃহবধু যতটুকু বুঝতেন এ আমলের প্রফেসরও তা বুঝেন না। এবং সে প্রমাণ ইতিহাসে প্রচুর। শিশু আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)এর মা তাঁর জীবনের সকল সঞ্চয় শিশুপুত্রের জামার আস্তিনে বেঁধে ইরানের গিলান প্রদেশ ছেড়ে হাজার মাইল দূরের বাগদাদে পাঠিছিলেন। অথচ সে সময় আধুনিক যানবাহন ছিল না। পথে ছিল ডাকাতের ভয়, যার কবলে তিনি পড়েছিলেনও। মুসলমানগণ তাদের গৌরব কালে জ্ঞানার্জনকে কতটা গুরুত্ব দিতেন -এটি হলো তারই নমুনা। অথচ আজ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জ্ঞানদানের কাজে ফাঁকি দিয়ে বিদেশী সংস্থায় কাজ করেন। মেডিকেল কলেজের প্রফেসর ভবিষ্যৎ ডাক্তার তৈরীর কাজে ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে বসে অর্থ কামাই করেন। তারা নিজ সন্তানের ধর্মজ্ঞান দানে এতই উদাসীন যে, সে লক্ষ্যে হাজার মাইল দূরে পাঠানো দূরে থাক, পাশের মাদ্রাসাতে পাঠাতে রাজি নয়। লক্ষ্য এখানে সন্তানকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করা নয়, বরং অর্থ কামাইয়ের হাতিয়ারে পরিণত করা।
পাল্টায়নি চেতনার মডেল
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আরেক ব্যর্থতা: শিক্ষককে যেমন প্রকৃত শিক্ষক রূপে গড়ে তুলতে পারেনি, তেমনি ছাত্রকে গড়ে তুলতে পারিনি প্রকৃত ছাত্র রূপে। নিছক পড়ন, লিখন বা হিসাব-নিকাশ শিখিয়ে সে আগ্রহ সৃষ্টি করা যায় না। এজন্য ব্যক্তির বিশ্বাস ও দর্শনে হাত দিতে হয়। বিপ্লব আনতে হয় ব্যক্তির চিন্তার মডেল। পবিত্র কোর’আনে সে বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সুরা বনি ইসরাইলে। বলা হয়েছে, “ক্বোল, কুল্লুই ইয়ামালু শাকেলাতিহি” অর্থ: “বল হে মহম্মদ, প্রতিটি ব্যক্তিই কাজ করে তার (চিন্তাভারনা বা দর্শন)’র মডেল অনুযায়ী। এ আয়াতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে চিন্তাভারনা বা দর্শনের মডেল পরিবর্তনে। নবীজীর (সাঃ) আগমনে আরবের আবহাওয়ায় পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন আসেনি তাদের দৈহিক বল বা খনিজ সম্পদে। বরং ইনকিলাব এসেছিল তাদের জীবন-দর্শনের মডেলে। সে দর্শন পাল্টে দিয়েছিল বাঁচবার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও রূচীবোধ। আরবগণ ভাবতো, মৃত্যুর পর তারা মাটিতে হারিয়ে যাবে। রোজ-হাশর নাই, জবাবদেহীতাও নাই। অপর দিকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা দেয়, এ জীবনে কোন মৃত্যু নাই। আছে শুধু পরকালে স্থানান্তর। আছে পরকালে জবাবদেহীতা। দিয়েছিল, জান্নাত ও জাহান্নামের ধারণা। ফলে জান্নাতে পৌঁছাটি বাঁচা-মরার টার্গেটে পরিণত হয়। এবং সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ করে জান্নাত পেতে। উন্নত চরিত্র ও নেক আমল নিয়ে বেড়ে উঠাটি তখন জীবনের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। উচ্চতর সভ্যতা তো এভাবেই নির্মিত হয়। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় লিখন, পড়ন বা হিসাব-নিকাশ গুরুত্ব পেলেও গুরুত্ব পায়নি দর্শনের মডেল পাল্টানোর বিষয়টি। ফলে জীবন পাচেছ না সঠিক দিক-নির্দেশনা ও প্রেরণা। পুষ্টি পাচ্ছে না শিক্ষার্থীর বিবেক ও চেতনা। গড়ে উঠছে না সুষ্ঠ চিন্তার ও নেক আমলের সামর্থ্য। জাতি আদর্শ নেতা, সৎ বুদ্ধিজীবী ও সংস্কারকের সরবরাহ পায় দর্শনসমৃদ্ধ সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের থেকে; পেশাজীবী, কর্মজীবী বা টেকনোক্রাটদের থেকে নয়।
দর্শনের প্রতি অবহেলায় মানুষ নিছক নকল-নবীশে পরণিত হয়। বাংলাদেশে উন্নত বিবেকবোধ, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি বেড়ে না উঠার অন্যতম কারণ হলো এটি। তাছাড়া জ্ঞান শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, তা ছড়িয়ে আছে আসমান-জমিনের সর্বক্ষেত্র জুড়ে। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রই শুধু নয়, গাছপালা, জীবজন্তু, নদীনালা, অনুপরমানু তথা দৃশ্য-অদৃশ্য প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে লুকিয়ে আছে জ্ঞানের উপকরণ। কোর’আনের ভাষায় এগুলি হলো মহান আল্লাহতায়ালার আয়াত -যা পড়তে হয় শুধু চোখের আলাতে নয়, মনের আলোতেও। ইসলাম তাই আলোকিত মনের মানুষ গড়তে চায়। তখন সমগ্র বিশ্বটাই পাঠশালা মনে হয়। এ পাঠশালারই শিক্ষক ছিলেন নবীপাক (সাঃ)। জ্ঞান বিতরণে ও মানুষকে চিন্তাশীল করার কাজে মহান আল্লাহতায়ালার এ আয়াতগুলিকে তিনি কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছেন। সেখান থেকেই গড়ে উঠেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানসাধকগণ। জীবনের মূল পরীক্ষায় তথা মহান আল্লাহকে খুশী করার কাজে তাঁরাই মানব-ইতিহাসে সর্বাধিক সফল হয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে তাঁদের নিয়ে তিনি গর্বও করেছেন।
জ্ঞানবিতরণে জ্ঞানকেন্দ্রের চেয়ে শিক্ষকই যে মূল সেটিই নবীজী (সা:) প্রমাণ করে গেছেন। অথচ আমরা বিদ্যালয় গড়ে চলেছি যোগ্য শিক্ষক না গড়েই। সেটি ডাক্তার না গড়ে হাসপাতাল চালানোর মত। সে ব্যর্থতা ঢাকতে বাংলাদেশে সকল ব্যর্থতার কারণ খোঁজা হচ্ছে অন্যত্র। শিক্ষার বিস্তারে শিক্ষককে প্রথমে শিক্ষিত করতে হয়। শুধু জ্ঞানদাতা হলেই চলে না, প্রতিটি শিক্ষককে ছাত্রদের সামনে অনুকরণীয় মডেলও হতে হয়। এটি কোন বাড়তি দায়িত্ব নয়, বরং এটিই শিক্ষকের মৌলিক দায়িত্ব। ফলে যে চরিত্র নিয়ে প্রশাসনের কর্মচারি, বিচারক বা ব্যবসায়ী হওয়া যায়, শিক্ষককে তার চেয়েও উত্তম চরিত্রের অধিকারি হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটি যথার্থ ভাবে হয়নি। দেশে নিদারুন কমতি হলো উপযুক্ত শিক্ষকের। শিক্ষকের যে স্থানটিতে বসেছিলেন নবীপাক (সাঃ) স্বয়ং নিজে, সেখানে প্রবেশ করেছে বহু নাস্তিক, পাপাচারি ও চরিত্রহীনেরা। ফলে ছাত্ররা শুধু জ্ঞানের স্বল্পতা নিয়েই বেরুচ্ছে না, বেরুচ্ছে দুর্বল চরিত্র নিয়েও।
ব্যর্থতা পূর্ণ মানব রূপে গড়ে তোলায়
স্পেশালাইজেশনের নামে ব্যক্তিকে কেঁচোর ন্যায় গর্তের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়াতে কল্যাণ নেই। এতে অসম্ভব হয়ে পড়ে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়াটা। ইসলাম চায় মানুষকে পূর্ণতা দিতে, যেন সে সমস্ত প্রতিভা ও সামর্থ্যকে কাজে লাগাতে পারে। মানুষ ভূমি নয় যে তার সুপ্ত সম্পদ অনাবিস্কৃত থাকলে পরবর্তী বংশধরেরা উত্তোলন করবে। বরং মৃত্যুর সাথে সাথে কবরস্থ্য হয় সকল সামর্থ্য। ফলে বুদ্ধিমত্ততা এটাই, মৃত্যুর আগেই নিজের সমুদয় প্রতিভা ও শক্তি আবিস্কার করা এবং আখেরাতের সঞ্চয় বাড়াতে সেগুলি কাজে লাগানো। তখন প্লাবন সৃষ্টি হয় কল্যাণকর্মে। রাষ্ট্রপ্রধানও তখন রাতদুপুরে আটার বস্তা পিঠে নিয়ে দরিদ্র মানুষ খোঁজেন। বিদ্যালয়ের কাজ শুধু এ চেতনাকে ছাত্রের মনে বদ্ধমূল করাই নয়, এ কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়াও। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কারিগরি জীবের আদলে না গড়ে, ছাত্রকে গড়ে তুলবে পূর্ণ মানব রূপে। গড়ে তুলবে ভারসাম্যপূণ্য ব্যক্তি রূপে। ফলে বিজ্ঞানী হয়ে মুসলিম তখন নাস্তিক হয় না, ধর্মের নামে গবাদি পশু বা শাপশকুনকেও পুজা করে না। বিজ্ঞানের ধ্বংসাত্মক অপপ্রয়োগও করে না। নবী করীমের (সাঃ) সাহাবাগণ শুধু ইবাদতে আধ্যাত্মীক ছিলেন না, বরং আধ্যাত্মীকতা নিয়ে এসেছিলেন রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসাবাণিজ্য ও যুদ্ধবিগ্রহেও। আদর্শ মানুষ রূপে তাদের বিচরণ ছিল জীবনের প্রতিক্ষেত্রে। ইসলামে মানুষকে এভাবে জীবন ও জগতকে নিয়ে বৃহৎ ভাবে ভাবতে অভ্যস্থ করে।
প্রতিটি পদার্থ, অণু-পরমাণু ও পত্র-পল্লবে মহান আল্লাহতায়ালার যে প্রকাশমান কুদরত সেটিই ধ্বণিত হয় ঈমানদারদের হৃদয়ের গভীরে। মুসলমানের শিক্ষা এ ভাবেই ব্যক্তিকে তাঁর স্রষ্টার সাথে সম্পৃক্ত করে। আল্লামা ইকবাল সেটি তুলে ধরেছেন এভাবেঃ “কাফের কি ইয়ে পেহচান কেহ আফাক মে গুম হ্যায়, মোমেন কি ইয়ে পেহচান কেহ গুম উস মে হ্যায় আফাক। অর্থঃ কাফেরের পরিচিতি হলো সে বিশ্বমাঝে হারিয়ে যায়, আর মোমেনের পরিচিতি হলো তার মধ্যে হারিয়ে যায় বিশ্বপ্রকিৃতি।” এভাবে মহান আল্লাহতায়ালার একাত্ববাদ ও কুদরতের প্রকাশ ঘটে মোমেনের সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে।
কোর’আনের জ্ঞান ব্যক্তিকে দেয় মহান আল্লাহতায়ালার আনুগত্যে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রেরণা। ব্যক্তি নিজেই তখন মহান আল্লাহতায়ালার কুদরত ও মহিমার দৃশ্যমান অভিব্যক্তি হয়ে দাঁড়ায়। আল্লামা ইকবাল সেটির প্রকাশ করেছেন তার এক দর্শনসমৃদ্ধ বিখ্যাত কবিতায়: “খুদী কা সার নেহা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, খুদি হ্যায় তেগ ফেশা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ইয়ে নাগমা ফসলে গুল ও লালেহ কা নেহি পাবন্দ, বাহার হো কেহ খেজাহ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” অর্থ: ব্যক্তির (খুদীর) আত্মপ্রকাশ হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। খুদী তো তলোয়ার, সেটি শানিত করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এ গান কোন মৌসূম বা ফুলের কারণে নয়; বসন্ত হোক অথবা হোক হেমন্ত, একই আওয়াজ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” এটিই হলো মোমেনের আত্ম-উপলদ্ধি ও আত্মপ্রকাশ।
ব্যক্তির আত্ম-উপলদ্ধি ও আত্মপ্রকাশের সামর্থ্য আসে তাঁর শিক্ষা থেকে। শিক্ষা আত্মার ময়লা ধোয়ার কাজ করে। আর পরিশুদ্ধ আত্মা তখন রূপ দেয় স্বচ্ছ আয়নাতে -যার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয় মহান আল্লাহতায়ালার কুদরাত ও নিদর্শন। মোমেনের বিশ্বাস এভাবেই প্রকাশ পায় তার রাজনীতি, অর্থনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, যুদ্ধবিগ্রহ ও আচার-আচারণে। ঈমানদার এভাবেই পরিণত হয় ইনসানে কামেলে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতাটি আকাশচুম্বি। এবং এ ব্যর্থতাই বাংলাদেশের সকল ব্যর্থতার জনক। প্রশ্ন হলো, এ ব্যর্থতা কি পরকালে সফলতা দিবে? শিক্ষার ব্যর্থতা বস্তুত ইহকাল ও পরকালের ব্যর্থতাকে একাকার করে ফেলে। ১ম সংস্করণ ১০/১২/০৪; ২য় সংস্করণ ২৪/১২/২০২০
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018