বাংলাদেশের সংবিধানঃ আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও অসন্মানের দলিল

অনাস্থা আল্লাহর উপর  

সংবিধান কোন দেশেই কোন মামূলী দলিল নয়। এটিই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। শুধু প্রশাসন, আদালত বা সংসদ নয়, তা থেকে পথনির্দেশনা পায় দেশের সাধারণ জনগণও। কোনটি সিদ্ধ ও কোনটি অসিদ্ধ, কোনটি করণীয় ও কোনটি অপরাধ -সে নির্দেশনাও আসে সংবিধান থেকে। সংবিধান থেকেই পরিচয় মেলে সেদেশের জনগণের চিন্তা-চেতনা, ধর্মীয়-বিশ্বাস ও রাজনৈতিক দর্শনের। রাজতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, পুর্জিবাদী বা নাস্তিক দেশের সংবিধান তাই একটি ইসলামী দেশের সংবিধান থেকে ভিন্নতর। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের সংবিধান কোন পরিচয়টি তুলে ধরে? দেশবাসীকে এটি কোন পথের পথ-নির্দেশনা দেয়? বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ জনগণ মুসলমান, তাই সংবিধানে বাংলাদেশের মুসলিম চরিত্রেরও প্রতিফলন হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেটি কি সংবিধানে ধরা পড়ে? বাংলাদেশের সংবিধান থেকে সরকারি দল গত ৩০ জুন (২০১১) “সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” এ বাক্যটি বাদ দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাসে এ এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কোন অমুসলিম দেশে এমনটি হলে সেটি কোন খবর হত না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি শুধু খবরই নয়, গুরুতর খবর।

সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে মূলতঃ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানের মূল পরিচয়টিকেই গোপনা করা হল। আওয়ামী লীগার ও তাদের বামপন্থি মিত্রগণ যে সেক্যিউলার এবং ইসলামে অঙ্গিকারহীন -সেটি গোপন বিষয় নয়। তারা ইসলামের বিজয় চায় ও মুসলমানের গৌরব চায় -সে কথা তারা কোনদিনও বলেনি। ফলে আল্লাহর উপর বিশ্বাস না থাকাটা তাদের ক্ষেত্রে যেমন অভাবনীয় নয়, তেমনি অস্বাভাবিকও নয়। তবে সেটি তাদের একান্তই ব্যক্তিগত বা দলীয় বিশ্বাসের বিষয়, সমগ্র দেশবাসীর বিশ্বাস নয়। কিন্তু বাংলাদেশ এবং তার সংবিধান কোন ব্যক্তির নয়, কোন দলেরও নয়। এখানে চাই দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের বিশ্বাসের প্রতিফলন। সেটির প্রতিফলন ঘটাতেই দেশে দেশে সাংবিধানিক প্রশ্নে জনমত যাচায়ে রিফারেণ্ডাম হয়। কিছু দিন আগে এমনি এক রিফেরেণ্ডাম মিশরে অনুষ্ঠিত হল। এমন রিফারেণ্ডাম অতীতে ইরানেও হয়েছে। কিছুদিন আগে বিলেতেও হল। কিন্তু আওয়ামী লীগের অপরাধ, তাদের দলীয় বিশ্বাসকে তারা দেশের সংবিধানে ডুকিয়েছে, এবং সেটি দেশবাসীর নামে। এ নিয়ে যেমন  রিফারেণ্ডামের আয়োজন করেনি, তেমনি গত নির্বাচনে নির্বাচনও লড়েনি।  

ঈমানদার হওয়ার শর্ত শুধু মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ বলা নয়, বরং সর্বকাজে ও সর্ব-অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা। মহান আল্লাহর অনুগ্রহ থেকেই যেমন তাঁর জন্ম, তেমনি তাঁর অনুগ্রহের বরকতেই তার জীবনধারণ ও বেঁচে থাকা। বিপদ-আপদ বা মৃত্যূ কোনটাই মানুষের জীবনে নিজ থেকে আসে না, আসে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। মানুষ তার প্রতি কর্মে সামর্থটুকু পায় একমাত্র মহান করুণাময়ের অনুগ্রহ থেকেই। গাছের একটি পাতাও নিজ সামর্থে নীচে পড়ে না, পড়ে মহান আল্লাহর ইচ্ছায়। ইসলামের এটিই বুনিয়াদি আক্বিদা। প্রতিটি কথা ও প্রতিটি আচরণের মধ্য দিয়ে ঈমানদারকে সে বিশ্বাসেরই প্রকাশ ঘটাতে হয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “ওয়া মা তাশাউনা ইল্লা ইয়াশাল্লাহু রাব্বুল আলামীন” অর্থঃ “ এবং তোমরা যা ইচ্ছা কর সেটি হয় না, বরং জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন সেটিই হয়।”-(সুরা তাকবীর, আয়াত ২৯)। মুসলমানের মুখে তাই ধ্বণিত হয়, “ওয়া মা তাওফিক ইল্লা বিল্লাহ” অর্থঃ “আল্লাহর দেয়া সামর্থ ছাড়া আমার কোন সামর্থই নাই।” এটিই ঈমানদারের ঈমান বা মৌল বিশ্বাসের বিষয়। প্রতি পদে এবং প্রতি মুহুর্তে তাই সে মহান আল্লাহর সাহায্য চায়। সেরূপ সাহায্য চাওয়ার মধ্যেই তাঁর ঈমানদারি। এর বিপরীতে যেটি সেটি অহংকার, ইসলামের পরিভাষায় সেটি তাকাব্বুরি। এটি কোন মুসলমানের গুণ নয়, সেটি শয়তানের। মহান আল্লাহর কাছে অতি অপছন্দের হল এই তাকাব্বুরি বা অহংকার। এমন অহংকারে হেদায়াত লাভ অসম্ভব, এবং অসম্ভব হয় জান্নাত প্রাপ্তি। 

 

আস্থা জাহিলিয়াতে

আজকের জাহিলিয়াত নিছক পুতুল পুজা নয়। গোত্রীয় চেতনাও নয়। বরং এক নব্য আধুনিকতা নিয়ে হাজির হয়েছে। সেটি যেমন জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র, তেমনি পরিবার ভিত্তিক দলীয় চেতনা।  আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকাশ করলো তাদের সে জাহেলী চেতনার। তারা নিজেরাই জানিয়ে দিল, নামে মুসলমান হলেও তাদের অন্তরে আল্লাহর উপর বিশ্বাস যেমন নেই, আস্থাও নাই। তবে কোথায় তাদের বিশ্বাস ও আস্থা সেটি তারা গোপন রাখেনি। নিজেদের সে বিশ্বাস ও আস্থার বিষয়টিকেও তারা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেছে। সেটি হল ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম রূপে ইসলামকে অস্বীকার করেনি। অথচ মুসলমান হওয়ার দায়বদ্ধতা নিছক মহান আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর বিশ্বাস করা নয়, বরং কোরআনী বিধানকে পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা। সিরাতুল মোস্তাকিমে চলার অর্থ হল, আল্লাহর প্রদর্শিত বিধান মেনে চলায় লাগাতর লেগে থাকা, সে পথে সবটুকু পথ চলা -সেটি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে ইসলামের প্রতিষ্ঠায়। লাগাতর এ প্রচেষ্ঠা থেকে সামান্য বিচ্যুতির অর্থ সিরাতুল মোস্তাকিম থেকে বিচ্যুতি। যা মূলতঃ পথভ্রষ্টতা তখা জাহান্নামের পথ। অপরদিকে একজন সমাজতন্ত্রির অঙ্গিকার সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায়। তবে সেটি ইসলামি বিশ্বাস ও বিধানকে চালু রেখে সম্ভব নয়। ফলে তাদের উদ্যোগ বাড়ে ইসলামের বিনাশে। একই সাথে দুই নৌকায় পা রাখা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় একসাথে সমাজতন্ত্র ও ইসলামে অঙ্গিকারবন্ধ হওয়া। ইসলামের রয়েছে নিজস্ব অর্থনৈতিক বিধান, রয়েছে সামাজিক কল্যাণের নিজস্ব কর্মসূচী। মুসলমান আজীবনের ব্যস্ততা সে বিধানের বাস্তবায়ন নিয়ে। ফলে আল্লাহর সে বিধানকে পরিত্যাগ করে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার দায়বদ্ধ হওয়ার অবকাশ কোথায়? অপরদিকে রাষ্ট্রে ইসলামের প্রতিষ্ঠা বাড়লে অসম্ভব হয় সমাজতন্ত্র বা সেক্যিউলারিজমের প্রতিষ্ঠা। সমাজতন্ত্রিরা সে কারণেই ইসলামের ভিত্তিকে দুর্বল করতে চায়। এলক্ষ্যেই তারা সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনে হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসাকে ঘোড়ার আস্তাবল বানিয়েছিল, নিষিদ্ধ করছিল কোরআন চর্চা, ইসলামে পালন ও ইসলামের নামে সংগঠিত হওয়া। কার্ল মার্কস ধর্মকে আফিমের নেশা বলেছিলেন, ফলে ইসলামের প্রতি মহব্বত নেই মার্কসবাদীদের। তাদের কাছে বরং ইসলামের প্রতি যে কোন অঙ্গিকারবদ্ধতাই হল সাম্প্রদায়িকতা। এমন এক ইসলামবৈরী চেতনার কারণেই শেখ মুজিব ইসলামি সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং সর্বপ্রকার সহযোগিতা দিয়েছিলেন কম্যুনিষ্ট ও সমাজতন্ত্রিদের। একদিনে তিনি ইসলামীপন্থিদের দফতরে তালা ঝুলিয়েছেন, অপর দিকে দফতর খোলার কাজে ভবন বরাদ্দ দিয়েছিলেন কম্যুনিষ্টদের। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে ইসলাম বা কোরআনের আয়াত দেখেছেন সেখানেই তিনি নিষ্ঠুর কাঁচি চালিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে বিলুপ্ত করেছেন ‘রাব্বি যিদনী ইলামান’ (অর্থঃ হে রব! আমার জ্ঞানকে বৃদ্ধি করে দিন)। ঈমানদার যখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পায় তখনই তাঁর মিশন হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রের বুকে আল্লাহর বিধানের প্রতিষ্ঠা। আল্লাহর উপর বিশ্বাস যেমন তাঁকে অবিরাম মসজিদে টানে, তেমনি রাষ্ট্রের বুকে ইসলামের প্রতিষ্ঠায়ও আন্তরিক করে। ব্যক্তির প্রচ্ছন্ন ঈমান এভাবেই তার কর্ম ও আচরণে দৃশ্যমান হয়। কিন্তু ঈমানহীন ব্যক্তির ক্ষমতায় বসায় উল্টাটি ঘটে। তাদের আচরণে প্রকাশ পায় আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারিরা তো সেটিরই প্রমান রেখে গেছেন। যে রাজনীতির মূল মিশনই হল আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও পথভ্রষ্টতা, সে রাজনীতিতে কি জ্ঞান-বৃদ্ধির মোনাজাত গুরুত্ব পায়? কথা হল, আল্লাহর উপর যার সামান্য ঈমান আছে এমন কোন ব্যক্তি কি তাঁর আয়াত বা ইসলাম শব্দটি মুছে দিতে পারে? সেটি কল্পনাও কি করতে পারে? এমন কাজ তো কুফরি। এমনই এক ইসলামবৈরী চেতনা নিয়ে ঢাকার নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে ইসলাম নামটি মুজিবভক্তরা উঠিয়ে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা যে বিষয়টি আদৌ গোপন রাখেনি তা হল, তাদের রাজনীতির লক্ষ্য আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল ও তাঁর দ্বীনকে সন্মান করা নয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য বাড়ানোও নয়। বরং তাদের সম্মান শেখ মুজিব ও তার পরিববারে প্রতি। মনগ্রাম থেকে কোরআনের আয়াত এবং প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে ইসলাম শব্দটি সরানো হলেও অফিসে অফিসে শেখ মুজিবের ছবি ঝুলানোকে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা সম্প্রতি সংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় পরিনত করেছে। কিন্তু কথা হল, যে ব্যক্তি ইসলাম ও কোরআনের প্রতি সন্মান দেখায়নি তার প্রতি সন্মান দেখালে কি আল্লাহ খুশি হন? সেটি হলে কি মুসলমানের ঈমান থাকে? 

 

বিদ্রোহ আল্লাহর বিরুদ্ধে

বাংলাদেশের সংবিধানে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তাঁর প্রতি অসন্মানের দলীল অনেক। তবে বড় বিদ্রোহটি ঘোষিত হয়েছে সংবিধানের এ ধারায় যে, জনগণই সার্বভৌম। এটি সুস্পষ্ট আগ্রাসন মহান আল্লাহর মালিকানার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের ন্যায় সমগ্র বিশ্বজগতের স্রষ্টা তিনি, মালিকও তিনি। অথচ সংবিধানে মালিক-মোখতার বানানো হয়েছে জনগণকে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তারাই নির্ধারণ করবে কীরূপ হবে তাদের আইন-আদালত। নির্ধারণ করবে কি হবে তাদের শিক্ষানীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি তথা তাবৎ রীতিনীতি । কিন্তু এটি যে সুস্পষ্ট কুফরি তথা আল্লাহর অবাধ্যতা সেটি বুঝতে কি বড় আলেম বা ফকিহ হওয়া লাগে? এটি তো ইসলামের অতি সাধারণ জ্ঞান। নিরক্ষর সাহাবীগণও সেটি বুঝতেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা একবার নয়, বহু বার বলেছেন, “লিল্লাহে মা ফিস্ সামাওয়াতে ওয়া মা ফিল আরদ্” অর্থাৎ আসমানে ও জমিনে যা কিছু আছে সব কিছুই আল্লাহর। যারা জীবনে একবারও কোরআন অধ্যয়ন করেছেন আল্লাহতায়ালার এ ঘোষণাটি তাদের চোখে না পড়ার কথা নয়। লক্ষ্যণীয় হল, এধরণের অতি মৌলিক বিষয় নিয়েও বিশাল অজ্ঞতাই প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানে। কোন দেশের মালিক হওয়ার অর্থ সে ভূমিতে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারি হওয়াও। এ বিশ্বে যিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারি তিনি  একমাত্র মহান আল্লাহ। ইসলামের এটিই মোদ্দা কথা। প্রশ্ন হল, একই দেশের ূ মালিক দুইজন হয় কি করে? যে জমিনের সার্বভৌম মালিক আল্লাহ, সে ভূমির উপর জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় কি করে? আরো বলা হয়েছে, “তিনিই ইলাহ নভোমণ্ডলে, তিনিই ইলাহ ভূতলে এবং তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।” –(সুরা জুখরুফ, আয়াত ৮৪)। এ আয়াতে ইলাহ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ইলাহ শব্দের অর্থ মা’বুদ বা উপাস্য। যিনি মহাপ্রভু ও উপাস্য, একমাত্র তিনিই ইবাদতের হকদার। আর ইবাদতের অর্থ হল তাঁর প্রতিটি হুকুমকে মেনে চলা। সেটি যেমন নামায-রোযার ন্যায় ইবাদতে, তেমনি আইন-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেনসহ জীবনের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে। কাফের হওয়ার অর্থ শুধু মুর্তিপুজা বা জ্বিনা-ব্যভিচারী নয়, বরং মহান আল্লাহর যে কোন একটি হুকুমের অবাধ্যতা। ফলে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত কোন একটি আইন অমান্য হলে কি ঈমান থাকে? মানুষ যে কতটা ঈমানদার বা মুসলমান তা তো নির্ধারিত হয় আল্লাহর হুকুমের আনুগত্যের মধ্য দিয়ে, মুসলিম পরিবারে জন্ম, তার লেবাস বা আরবী নাম থেকে নয়। সেনাবাহিনীর লেবাসধারী সৈনিক যেমন বিদ্রোহী ও দেশের পরম শত্রু হতে পারে, তেমনি ইসলামের নামধারী ও লেবাসধারী ব্যক্তিও ইসলামের মহাশত্রু হতে পারে। বাংলাদেশে যারা আল্লাহর আইনকে অকার্যকর করে রেখেছে তাদের ক’জন অমুসলিম বা স্বঘোষিত কাফের?

ইসলামে মানুষের মূল পরিচয়টি সার্বভৌম শক্তি রূপে নয়, বরং খলিফা বা প্রতিনিধি রূপে। প্রতিটি মানুষ এখানে খলিফা হল মহান আল্লাহর। এবং সার্বভৌম হলেন একমাত্র মহান আল্লাহ। খলিফার আইন রচনার অধিকার থাকে না, থাকে আল্লাহতায়ালার নির্ধারিত আইনের প্রতিপালন ও প্রতিষ্ঠার দায়ভার। সেটি রাষ্ট্র ও সমাজ জুড়ে। মহান আল্লাহর নির্দেশিত সে আইনগুলো এসেছে পবিত্র কোরআনে, ইসলামী পরিভাষায় সেটিই হল শরিয়তি বিধান। এ পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বড় দায়িত্বহীনতা বা অপরাধ হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে আরোপিত খেলাফতের তথা প্রতিনিধিত্বের সে দায়িত্বটি পালন না করা। এবং নিজেই আইনপ্রণেতা রূপে আবির্ভুত হওয়া। ইসলামে এটি কবিরা গুনাহ। কারণ খেলাফতের সে দায়িত্বটি পালিত না হলে রাষ্ট্র ও সমাজ অধিকৃত হয় শয়তানের খলিফা তথা আল্লাহর অবাধ্যদের হাতে। তখন পরাজিত হয় আল্লাহর দ্বীন ও শরিয়তী বিধান। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তাঁর প্রতি অসন্মান তথন দেশবাসীর রাজনীতি ও সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায়। দেশ তখন আল্লাহর অবাধ্যতায় ও দূর্নীতিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ে। বাংলাদেশ তো তেমনি এক দেশ।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্ট ভাবে হুশিয়ার করে দিয়েছেন এই বলে, “…আল্লাহ যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার কার্য পরিচালনা করে না তারাই কাফের। ….(সুরা মায়েদা, আয়াত ৪৪)।“…আল্লাহ যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার কার্য পরিচালনা করে না তারাই যালিম। ….(সুরা মায়েদা, আয়াত ৪৫) “…আল্লাহ যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার কার্য পরিচালনা করে না তারাই ফাসিক। ….(সুরা মায়েদা, আয়াত ৪৭)। প্রশ্ন হল, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ  থেকে এত সুস্পষ্ট হুশিয়ারি আশার পর আইন প্রণয়নে পার্লামেন্ট সার্বভৌম হয় কি করে? আল্লাহর আইনের প্রয়োগে ঈমানদারগণই বা কীরূপে অনাগ্রহী হয়? প্রতিযুগের মুসলিম আলেমগণই সেটি বুঝতেন, ফলে তাদের ব্যস্ততা ছিল, কোরআন ও হাদীস থেকে আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত সে আইনগুলো রাষ্ট্রে সুষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা। কোরআন পাঠের লক্ষ্য তাদের কাছে নিছক সওয়াব লাভ ছিল না, ছিল হেদায়াত লাভ ও আল্লাহর হুকুমগুলি জানা। দেশে স্কুল-কলেজ ও কল-কারখানা কতগুলি নির্মিত হবে, দেশের ট্রাফিক লাইট কীরূপ হবে, সড়ক ও ব্রীজই বা কোথায় কোথায় নির্মিত হবে -এরূপ নানা বিষয় নিয়ে দেশের সংসদে বহু বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু যে বিষয়গুলিতে আল্লাহর সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে সেগুলির প্রয়োগ না করাটি যে কুফরি তা নিয়ে মুসলমানদের মাঝে কোন কালেই কোন সংশয় বা অজ্ঞতা ছিল না। বর্তমানের অজ্ঞতাটি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের সৃষ্টি। উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন শুরুর পূর্বে মুসলিম শাসনাধীন উপমহাদেশ আইনের উৎস্য ছিল কোরআন ও সূন্নাহ। আল্লাহর সে শরিয়তী বিধান অপসারণের কাজটি প্রথম শুরু করে ব্রিটিশেরা। আর বাংলাদেশের সরকারের বড় অপরাধ হল, অমুসলিম ব্রিটিশের সে কুফরি নীতিকেই তারা চালু রেখেছে। এবং অসম্ভব করে রেখেছে শরিয়তী বিধানের প্রয়োগকে। আল্লাহ বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় বিদ্রোহ ও অসন্মান আর কি হতে পারে? তাঁর প্রদর্শিত সিরাতুল মোস্তাকিম থেকে এর চেয়ে বড় বিচ্যুতিই বা কি হতে পারে?

 

মাছি চরিত্র ও সংবিধানে আবর্জনা

পবিত্র কোরআন হল মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। একমাত্র এ কোরআনী বিধান অনুসরণের ফলেই স্বল্প সময়ে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মিত হয়েছিল। মানুষ পেয়েছিল তার মানবিক পরিচয়। নারী পেয়েছিল তার অধিকার ও মর্যাদা, এতিমরা পেয়েছিল সামাজিক নিরাপত্ত। দূর হয়েছিল অনাচার, অবিচার ও শোষণ। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৫০ গুন বৃহৎ রাষ্ট্রের খলিফা রাতের আঁধারে আটার বস্তা নিজ কাঁধে উঠিয়ে দরিদ্রের কুঠিরে পৌঁছে দিয়েছেন। খলিফা চাকরকে উঠের পিঠে চড়িয়ে নিজে লাগাম টেনেছেন। মানবতার মাপকাঠিতে এ ছিল সে সভ্যতার উচ্চতা। অথচ সে কোরআনী বিধানের প্রতি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ নেই। বরং আল্লাহর বিরুদ্ধে তাদের অশ্রদ্ধা ও অসম্মান যে কতটা গভীর সেটিই তারা প্রকাশ করেছে সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে। মশা-মাছির স্বভাব, তারা ফুলের উপর বসে না, বরং তালাশ করে গলিত আবর্জনা। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ, স্বৈরাচারি এরশাদ ও তাদের বামপন্থি মিত্রদের বড় সাফল্য যে তারা দেশে এরূপ মাছি চরিত্রের মানুষদের সংখ্যাই বিপুল ভাবে বাড়িয়েছে। সমাজতন্ত্র আজ ইতিহাসের আস্তাকুঁরে। খোদ রাশিয়ানরাই সেটিকে আবর্জনার স্তুপে ফেলেছে। আস্তাকুঁরে ফেলেছে পূর্ব ইউরোপের সবগুলো সমাজতান্ত্রিক দেশ। আস্তাকুঁরে ফেলেছে চীনারাও। এমন কি প্রতিবেশী পশ্চিমবাংলার বাঙালীরাও ২০১১ মে’ এর নির্বাচনে সমাজতন্ত্রীদের আবর্জনার স্তুপে ফেলেছে। কিন্তু আবর্জনা যত গলিত বা দুর্গন্ধযুক্তই হোক মশামাছির কাছে তার কদর কমে না। বরং বাড়ে। কারণ, এর উপরই তারা বেঁচে থাকে। ফলে বেঁচে থাকার স্বার্থে ড্রেন থেকেও সেটিকে তারা তুলে আনে। তাই সমাজতন্ত্রের কদর কমেনি বাংলাদেশের মাছি চরিত্রের আওয়ামী-বাকশালীদের কাছে। বরং রাজনৈতিক ভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে সমগ্র দেশজুড়ে সে আবর্জনার আবাদ বাড়াতেই তারা বদ্ধ পরিকর। এবং সে সাথে তারা বদ্ধপরিকর ইসলামের প্রসার রোধে। বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধনী এনে সমাজতন্ত্রকে আবার চার মূলনীতির একটি বানানোর প্রেক্ষাপট তো সেটাই।

 

মুজিবী জাহিলিয়াত ও আওয়ামী লীগের অহংকার

নেশাগ্রস্ততার একটা প্রচণ্ড মাদকতা আছে। সে মাদকতা যে নিছক মদ, গাঁজা বা হিরোইনের প্রতি -তা নয়। অজ্ঞতার প্রতিও। অজ্ঞতার প্রতি এমন নেশাগ্রস্ততা নিয়ে এমন কি বিজ্ঞানের যুগেও হাতে গড়া মুর্তি, শাপ-শকুন, গরু-বাছুর, বানর-হনুমান, পাহাড়-পবর্ত, নদ-নদীকেও কোটি কোটি মানুষ ভগবান মনে করে। তবে এর কারণ যতটা না ধর্মীয়, তার চেয়ে বড় হল অতীত ঐতিহ্যপ্রীতি। পূর্ব-পুরুষের অজ্ঞতা বা জাহিলিয়াত তো বেঁচে থাকে এ ঐতিহ্যের নাম নিয়েই। এটিই হল তাদের জীবন-সংস্কৃতি। পূর্ব পুরুষদের নিরেট মিথ্যাচার, অনাচার ও অজ্ঞতাকে নিরেট মিথ্যা ও পথভ্রষ্টতা বলার জন্য যে নৈতিক বল দরকার সেটি সবার থাকে না। অথচ মুসলমান হওয়ার জন্য সে নৈতিক বলটুকুই মূল। আর সেটি না থাকার কারণেই আবু লাহাব ও আবু জেহেলের মত আরবের পৌত্তলিক কাফেরগণ নবীজীর আমলে ইসলামের দাওয়াতকে কবুল করতে পারিনি। অথচ নবীজী (সাঃ)কে তারাই আল-আমীন উপাধী দিয়েছিল। কিন্তু বাপদাদার ঐতিহ্যের মোহের কারণে নবীজী (সাঃ)র পুতঃপবিত্র জীবনও তাদের কাছে অনুকরণীয় মনে হয়নি। তাই শেখ মুজিব যে অজ্ঞতা বা জাহিলিয়াত নিয়ে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করেছিলেন এবং সেটিকে বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে ঢুকিয়েছিলেন, আওয়ামী-বাকশালীরা সেটিকে শেখ মুজিবের জাহিলিয়াত বা অজ্ঞতা বলতে রাজী নয়। কারণ শেখ মুজিবকে জাহেল বা অজ্ঞ বললে তাদের রাজনীতিই বাঁচে না। পৌত্তলিকরা যেমন মুর্তি, শাক-শকুন, গরু-বাছুর, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী পুজার ন্যায় সনাতম অজ্ঞতাকেও সনাতন ধর্ম বলার অহংকার দেখায়, তেমনি অহংকার চেপে বসেছে আওয়ামী বাকশালীদের মগজেও। ফলে শেখ মুজিবের সমাজতন্ত্র, তাঁর স্বৈরাচারি বাকশালী দুঃশাসন, ৪০ হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর হত্যা, ভারতের প্রতি তাঁর নতজানু নীতি, ২৫ সালা দাসচুক্তি, দিল্লির পদতলে বেরুবাড়ী উপহার, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ –এসবকে তারা তাঁর ব্যর্থতা, অজ্ঞতা, ভ্রষ্টতা বা ব্যর্থতা বলতে রাজি নয়। বরং সেগুলি নিয়েই তাদের প্রচণ্ড অহংকার। উলঙ্গ-জটাধর শ্মসানবাসী কাপালিক যেমন তার ভক্তদের কাছে দেবতূল্য মনে হয় তেমনি অবস্থা এ আওয়ামী বাকশালীদের। এটিই তাঁদের রাজনীতির মূল কথা। বাংলাদেশের রাজনীতির বড় ফেতনাও হল এটি। তাই আওয়ামী বাকশালীদের হাতে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী যেমন অস্বাভাবিক নয়, তেমনি অভাবিতও নয়। মশা-মাছি যে আবর্জনায় বসবে সেটি কি অস্বাভাবিক? বরং প্রচণ্ড অস্বাভাবিক তো হল, বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান এসব মশা-মাছিদের কি ভাবে নিজেদের মাথার উপর বসতে দিয়েছে সেটি? এবং স্বজ্ঞানে ভোটের মাধ্যমে? হুশ এবং হাত-পায়ে বল থাকলে দেহের উপর মশা-মাছি বসা মাত্রই মানুষ তাড়া করে। দেহে যে প্রাণ আছে সেটি তো এভাবেই প্রমাণিত হয়। কিন্তু মৃত মানুষের সে সামর্থ থাকে না। তেমনি ঈমানদারের ঈমানদারি হল, রাষ্ট্রে যখনই আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়, সে বিদ্রোহীদের তাড়াতে সে উদ্যোগী হয়। জোটবদ্ধও হয়। তখন শুরু হয় জিহাদ। কিন্তু জনগণের ঈমানশূন্যতা বা পথভ্রষ্টতায় সে সামর্থ লোপ পায়। দেশ তখন অধিকৃত হয় ইসলামের বিপক্ষ শক্তির হাতে। রাষ্ট্রের মুসলিম পরিচয়টি শুধু সে রাষ্ট্রের লাখ লাখ মসজিদ-মাদ্রাসার কারণে বাড়ে না, বরং সেটি প্রকাশ পায় রাষ্ট্র থেকে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের নির্মূল ও আল্লাহর বিধানের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সাহাবায়ে কেরামের সবচেয়ে বেশী অর্থ, শ্রম, মেধা, সময় ও রক্তের খরচ হয়েছে তো বিদ্রোহীদের নির্মূল ও শরিয়তী বিধানের প্রতিষ্ঠায়। নবীজীর মৃত্যুর পরও তাই আবু লাহাব ও আবু জেহলের অনুসারিরা মুসলিম রাষ্ট্রের ক্ষমতার ধারে কাছে ভিড়তে পারিনি। শরিয়তী বিধানের গায়ে কোন আঁচড়ও লাগতে পারিনি। বাংলাদেশে মুসলমানদের বিজয় এসেছিল সেন রাজাদের হটিয়ে। অথচ বাংলাদেশ আজ অধিকৃত সেনদেরই উত্তরসুরী ও তাদের মিত্রদের হাতে। তারা যে আজ কতটা দলেভারি ও বিজয়ী সেটিই নতুন করে প্রমাণিত করল সাম্প্রতিক সংবিধান থেকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার বাক্যটি বিলুপ্ত করার মাধ্যমে।

মানুষের গলার রশি মহান আল্লাহতায়ালা ঢিল করে দিয়েছেন। কবরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে রশিতে তিনি টান দিবেন না। এভাবে মানুষকে তিনি পূর্ণ অবকাশ দিয়েছেন যেমন সাহাবায়ে কেরামের ন্যায় মহামানব হওয়ার, তেমনি সুযোগ দিয়েছেন ঈমান-শূন্য, মানবতা-শূন্য মহা-জানোয়ার হওয়ার। সর্ব কালে ও সর্ব স্থানে মানুষের মাঝে এ দুটিই হল মূল ধারা। একটি ইসলামের, অপরটি জাহিলিয়াতের। একটি আল্লাহর প্রতি প্রবল বিশ্বাস ও আস্থার ধারা, অপরটি অবিশ্বাস ও অনাস্থার ধারা। একটি পূর্ণ আনুগত্যের, অপরটি বিদ্রোহের। তেমন দুটি ধারা যেমন হাবিল-কাবিল, হযরত মূসা (আঃ) ও ফিরাউনের সময় ছিল, তেমনি আজকের বাংলাদেশেও আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকাশ পেল কারা আজ দেশে সেই অবিশ্বাসী ও অনাস্থার ধারার অনুসারি। এটিও প্রমাণিত হল, এ জাহেলী ধারার অনুসারিরাই আজ প্রবল ভাবে বিজয়ী। আর এখানেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অসামর্থতা, অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা। তাদের অযোগ্যতার কারণেই পরাজয় বাড়ছে মহান আল্লাহর মহান দ্বীনের। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি এ কলংকের ইতিহাসও হল এটি। মহান আল্লাহর দরবারে এ অযোগ্যতা ও পরাজয়ের জন্য অবশ্যই হাশর দিনে জবাব দিতে হবে। নিছক নামায-রোযা বা হজ-যাকাতের সংখ্যা বাড়িয়ে সেদিন মূক্তি মিলবে না। ইসলামের বিজয় আনতে নামায-রোযার বাইরেও সাহাবাদের অর্থ-শ্রম-মেধা ও রক্তের বিণিয়োগটি ছিল বিশাল। বিজয় আনতে ও বিজয় ধরে রাখতে তারা লাগাতর জিহাদ করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানদের বিণিয়োগটি কোথায়? কোথায় তাদের অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিণিয়োগ? সে হিসাব কি দিতে হবে না?

 

ধর্মনিরপেক্ষতার ধোকাবাজি

সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি পুণরায় ঢুকানো হয়েছে। অথচ মুসলমান হওয়ার অর্থই হল আল্লাহর পক্ষ নেয়া। তাঁকে শুধু কালেমায়ে শাহাদত পাঠে বা নামায-রোযা আদায়ে চলে না, আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে জিহাদেও যেতে হয়। এটিই কোরআনের দাবী। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষনা করা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারি হয়ে যাও।” সুরা সাফ, আয়াত ১৪।” প্রশ্ন হল কিসের জন্য সে সাহায্য? সেটি কি নামায-রোযা আদায়ে? হজ বা যাকাত পালনে? নামায-রোযা, হজ-যাকাত পালনে আল্লাহর সাহায্যকারি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে কি? বরং সেটি হল তাঁর দ্বীনের তথা তাঁর শরিয়তের প্রতিষ্ঠা সাহায্যকারি হওয়া। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল প্রেরণ ও কোরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য তো সে বিধানের প্রতিষ্ঠা, -যা বিজয়ী হবে সমগ্র বিশ্বজাহানের উপর। পবিত্র কোরআনে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে, “তিনিই সেই মহান সত্ত্বা যিনি হিদায়েত ও সত্য-দ্বীন সহ রাসূল পাঠিয়েছেন যেন সেটি সমগ্র জাহানের সকল ধর্ম ও মতের উপর বিজয়ী হয় যদিও সেটি মুশরিকদের কাছে অপছন্দের।” -(সুরা সাফ, আয়াত ৯)। মুসলমানের মিশন, আল্লাহর সে মহান উদ্দেশ্যের সাথে একাত্ব হওয়া। শুধু চেতনা বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নয়, প্রয়াস-প্রচেষ্ঠা এবং জানমালের বিণিয়োগের ক্ষেত্রেও। ঈমানদারের সে ভূমিকা ও অবস্থানের কথা মহান আল্লাহতায়াল ঘোষনা দিয়েছেন এভাবে, “নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা ঈমানদারের জানমাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিণিময়ে। তাঁরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে, অতঃপর তারা নিজেরা যেমন (শত্রুদের) হত্যা করে তেমনি নিজেরাও নিহত হয়।” –সুরা  তাওবাহ, আয়াত ১১১)। মুসলমান হওয়ার অর্থ তাই শুধু ঘর থেকে মসজিদ আর মসজিদ থেকে ঘরে যাওয়া নয়। জায়নামাযে বসে শুধু তাসবিহ তাহলিলও নয়। এমন কি হজ পালন এবং গরু-ভেড়ার কোরবানীও নয়। বরং সেটি হল, ইসলামের বিজয় ও আল্লাহর কোরআনী আইন প্রতিষ্ঠার জিহাদে জান-মালের কোরবানী পেশ করা। এমন কি মহান নবী (সাঃ)কেও সে কোরবানী পেশ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়নি। তাঁকেও যুদ্ধে নামতে হয়েছে, আঘাতে আঘাতে আহতও হতে হয়েছে। এমন কোরবানী পেশে পদে পদে তাঁকে অনুসরণ করেছেন সাহাবাগণ। তাই কোরআনের উপরুক্ত ঘোষণাটির বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় সাহাবায়ে কেরামের চরিত্রে। নবীজী (সাঃ) নেতৃত্বে তাঁরা বদরের রণাঙ্গণে গিয়ে হাজির হয়েছেন, রক্তাক্ষয়ী লড়াই লড়েছেন এবং সে লড়ায়ে ৭০ জন কাফেরকে হত্যাও করেছেন। আবার নিজেরা রক্ত দিয়েছেন ওহুদের ময়দানে। সে যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন ৭০ জন সাহাবী। এভাবে সাহাবাগণ যেমন নিহত হয়েছেন তেমনি হত্যাও করেছেন।

ইসলাম শান্তির ধর্ম, তবে সে শান্তি শত্রুদের কাছে আত্মসমর্পণের শান্তি নয়। তাছাড়া দুর্বৃত্ত শয়তানি শক্তির কাছে আত্মসমর্পনে কি কখনও শান্তি আসে? আল্লাহর কাছে নিজেদের জান-মাল বিক্রি করার ক্ষেত্রে সাহাবাগণ যে কতটা সাচ্চা ছিলেন এ হল তার নমুনা। মহান আল্লাহতায়ালা তো মোমেনদের এমন বিণিয়োগকেই পছন্দ করেন। পবিত্র কোরআন পাকে তাই তিনি বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তাঁদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর রাস্তায় সীসাঢালা দেয়ালের ন্যায় কাতার বেঁধে জিহাদ করে।” (সুরা সাফ, আয়াত ৪)। তাই যেদেশে ঈমানদারদের সংখ্যা বাড়ে সেদেশে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও বলবান হয়। বাড়ে আল্লাহর রাস্তায় জানমালের বিণিয়োগ। বাড়ে শহিদের সংখ্যা। আর সে বিণিয়োগের সাথে বাড়ে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়। তাই প্রশ্ন হল, ইসলামের বিজয়ে মুসলমানের যেখানে এতটা প্রবল অঙ্গিকার, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার ফুরসত কোথায়? তাছাড়া ইসলাম ও মুসলমানদের উপর শত্রু-শক্তির হামলা চলছে তো লাগাতর। অধিকাংশ মুসলিম ভূমি তো সেক্যিউলার শক্তির হাতে অধিকৃত, এবং তাদের হাতে পরাজিত মহান আল্লাহর বিধান। আইন-আদালত, রাজনীতি-প্রশাসন সব কিছুই অধিকৃত জাহিলী শক্তির হাতে। যারা আল্লাহর দ্বীনের সৈনিক তাঁরা কি শত্রুপক্ষের হামলার মুখে কি কখনও নিরপেক্ষ থাকতে পারে? ঈমানদারের এ লড়াই যেমন আক্রমণাত্মক নয়, প্রতিরক্ষামূলকও নয়। অধিকৃতদের আবার প্রতিরক্ষার কি থাকে? আক্রমণ চালানোরও বা কি থাকে? বরং এ লড়াই আগ্রাসনমু্ক্তির। নিজ দেশে সমাজতন্ত্রি, সেক্যিউলার তথা ইসলামের শত্রু পক্ষের বিজয় দেখে কি তাঁরা আনন্দ পেতে পারে? এখানে নিরপেক্ষতার অর্থ তো নীরব আত্মসমর্পণ।

সংবিধানের মূলনীতি রূপে ধর্মনিরপেক্ষতা লিপিবদ্ধ করার মতলব এ নয় যে, আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্রগণ ইসলাম ও অনৈসলামের চিরন্তন লড়াইয়ে নিরপেক্ষ। বরং এটি হল ইসলামের পক্ষ নেয়াকে আইনতঃ অপরাধ রূপে চিহ্নিত করার এক সাংবিধানিক উদ্যোগ। ইসলামের বিধানকে বাংলাদেশে পরাজিত রাখার লক্ষ্যে এ সাংবিধানিক বিধিবদ্ধতাকে তারা জরুরী মনে করে। তখন ইসলামের পক্ষে কথা বলার অপরাধে যে কোন রাজনীতিকে যেমন জেলে নেয়া যাবে, তেমনি যে কোন সামরিক বা বেসামরিক অফিসারকে চাকুরিচ্যুৎও করা যাবে। তখন মসজিদের ইমামদেরকেও জেলের ভয় দেখানো যাবে। এভাবে ইসলামের বিজয়ে অংশ নেয়া থেকে সর্বশ্রেনীর মানুষকে বিরত রাখা যাবে। এবং সেটি সংবিধানের দোহাই দিয়ে এবং আদালতের ভয় দেখিয়ে। তখন আওয়ামী বাকশালী গোষ্ঠী ও তার মিত্রদের রাজপথে বা ভোট যুদ্ধে মোকাবেলায় নামার প্রয়োজন পড়বে না। তাদের পক্ষে পুলিশ এবং আদালতই সেটি করে দিবে। এবং সেটি হবে জনগণের রাজস্বের অর্থে। একই রূপ কৌশল নিয়েছিল তুরস্কের সেক্যিউলারিষ্টগণ। সে পরিকল্পনার অংশ রূপেই নব্বইয়ের দশকে সে দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জনাব নাযিম উদ্দীন আরবানকে নিছক ইসলামপন্থি হওয়ার অপরাধে তারা কারাগারে পাঠিয়েছিল। নিষিদ্ধ করেছিল তাঁর দল রিফাহ পার্টিকে। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে কোন অপরাধ বা দূর্নীতি তারা খুঁজে বের করতে পারিনি। ইসলামী চেতনা সমৃদ্ধ একটি কবিতার কয়েকটি লাইন এক জনসভায় পাঠ করার অপরাধে (?) জেলে পাঠিয়েছিল তুরস্কের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জনাব রজব তাইয়েব আরদাগানকে। তখন তিনি ইস্তাম্বুল শহরের নির্বাচিত মেয়র। সেক্যিউলারিজমের দোহাই দিয়ে ছাত্রীদের মাথায় রুমাল বাঁধাকে পর্যন্ত তারা নিষিদ্ধ করেছে। প্রতিদেশে ইসলাম-বিরোধীদের একই কৌশল। বাংলাদেশের সেক্যিউলারগণ মূলতঃ সে কৌশল নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে।

 

জাতীয়তাবাদের নাশকতা

সংবিধানে স্থান পেয়েছে আরেক মূলনীতি ভাষা-ভিত্তিক ‘জাতীয়তাবাদ’। এটি কি কোরআন-সম্মত? আর কোরআন সম্মত না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে তা গৃহীত হয় কি করে? প্রতিটি মুসলমানের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ঔষধের নামে বিষপান হলে যেটি অনিবার্য হয় সেটি মৃত্যু। তেমনি সংবিধানের নামে কোরআন বিরোধী ধ্যান-ধারণা স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা পেলে তাতে বিপন্ন হয় মুসলমানের ঈমান, আমল ও পরকাল। তাই জাতীয়তাবাদ কতটা ইসলাম সম্মত সে বিচার অবশ্যই হতে হবে। এবং সেটি কোরআন হাদীসের আলোকে। পবিত্র কোরআন মুসলমানের যে পরিচয়টি অপরিহার্য করে সেটি আল্লাহ ও তার রসূলের উপর অটল বিশ্বাস এবং পবিত্র কোরআনী বিধানের পূর্ণ-অনুসরণ। এখানে ভাষা, বর্ণ বা ভূগোলের বন্ধনের কোন স্থান নেই। এগুলোর গৌরব বাড়াতে জান, মাল, মেধা বা রক্তের বিণিয়োগেরও কোন তাগিদ নেই। রাসূলে করীম (সাঃ)-এর সময় সিরিয়া ও মিশরে ছিল রোমানদের শাসন, ইয়েমেন ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। নবীজী (সাঃ) জন্ম নিয়েছিলেন আরবের অভিজাত হাশিম গোত্রে, পবিত্র ক্বাবার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল এ গোত্রটির উপর। আরবদের কাছে সেটি ছিল এক বিরল সন্মান। সমগ্র আরব ভূখণ্ডের মানুষ এজন্য হাশিম গোত্রকে সমীহ করত। আর নবীজী (সাঃ) ছিলেন সে হাশিম গোত্রেরই অতি সন্মানিত ব্যক্তি। নবুয়ত প্রাপ্তীর আগেই মক্কার লোকেরা তাঁকে আল-আমিন বা বিশ্বাসী বলে অভিহিত করত। পবিত্র ক্বাবার হাজরে আসওয়াদ সরানোর নিয়ে আরবদের মাঝে যে প্রচণ্ড বিবাদ বেঁধেছিল, সেটির মীমাংসায় তিনিই নির্বাচিত হয়েছিলেন মধ্যস্থতাকারি রূপে। ফলে জাতীয়তাবাদে সামান্য আগ্রহ থাকলে তিনি জাতীয়তাবাদী স্লোগান দিয়ে রোমান ও পারসিক – এ উভয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আরবদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারতেন। গড়ে তুলতে পারতেন এক আরব সাম্রাজ্য। কিন্তু নবীজী(সাঃ) সে পথে এগুননি। কারণ নবীর মিশন তো কোন জাতি, বর্ণ, গোত্র বা দেশের গৌরব বাড়ানোর মিশন নয়। তাঁর মিশন তো মহান আল্লাহর। তাই তিনি ঝাণ্ডা উঠিয়েছেন একমাত্র ইসলামের। আরব, ইরানী, কুর্দি, তুর্কি, হাবসী, রোমানসহ নানা দেশ, নানা গোত্র ও নানা ভাষার মানুষদের তিনি একই ময়দানে হাজির করেছেন। ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা ভূগোলের নামে প্রাচীর না গড়ে তিনি সে গুলোর উর্ধ্বে উঠে এক উম্মতে ওয়াহেদা গড়েছেন। আজ বিশ্বের মুসলমানদের সামনে সেটিই তাঁর রেখে যাওয়া অনুকরণীয় সূন্নত।

মহান আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের একে অপরের ‘ভাই’ বলে অভিহিত করেছেন। এটি আল্লাহর দেয়া খেতাব। মুসলমানের দায়িত্ব হল সে খেতাবের সন্মান রক্ষা করা। সামাজিক বন্ধনের ক্ষেত্রে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। মানুষে মানুষে বন্ধন গড়ার ক্ষেত্রে এর চেয়ে মজবুত ও মর্যাদাপূর্ণ পরিচয় আর কি হতে পারে? ‘ভাই’ রূপে পরিচিত হওয়ার এ বিরল সন্মানটি মানুষ পায় কোন বিশেষ দেশে বা ভাষায় কথা বলার কারণে নয়, বরং একই পিতার ঔরসে এবং একই মায়ের পেটে জন্ম নেয়ার কারণে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা সে সন্মানটি দিয়েছেন মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি ঈমানদারকে। তাই মুসলিম সমাজে কোন মুসলমানই ভাতৃহীন,বন্ধুহীন বা আপনজনহীন নয়। এমন একটি ভাতৃসুলভ চেতনা ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহর নির্মানে সিমেন্টের কাজ করে। সে চেতনার কারণেই আফগানিস্তান, কাশ্মির, ফিলিস্তিন বা যে কোন মুসলিম দেশে কোন মুসলিম নারী, পুরুষ বা শিশু যখন বুলেট-বিদ্ধ হয় তখন বিশ্বের প্রতিটি ঈমানদার সে বুলেটের ব্যথা হৃদয়ে অনুভব করে। নবীজী (সাঃ)-এর যুগে মক্কার সাহাবাগণ খালি হাতে মদীনায় হিযরত করেছিলেন, সেখানে গিয়ে তারা আনসারদের কাছে ভাইরূপে সমাদার পেয়েছিলেন। সেটি শুধু মুখের কথায় নয়, বাস্তবেও। আনসারগণ তাদের নিজ উঠান, বাড়িঘর, উঠ, বাগান পর্যন্ত ভাগ করে মোহাজিরদের দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহর উপর যার সামান্যতম বিশ্বাস আছে, সে কি তাঁর দেয়া ভাতৃত্বের সে মহান বন্ধনকে ছিন্ন বা অসম্মান করতে পারে? এমন একটি বিশ্বভাতৃত্বের চেতনার কারণেই মুসলমানদের ভূগোল সে আমলে বিপুল ভাবে বাড়লেও ভাষা, গোত্র বা বর্ণের নামে দেয়াল খাড়া হয়নি। ভৌগলিক সীমারেখা বা বিভক্তিও গড়ে উঠেনি। বিশ্বজনীন সিভিলাইজেশনাল ফোর্স হিসাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বিশ্বভাতৃত্বের এমন চেতনা হল একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের জিহাদে যে হাজার হাজার আরব, পাকিস্তানী, আফ্রিকান, ইউরোপীয় ও চেচেন মুসলমান শামিল হয়েছিলেন সেটি তো তেমন এক চেতনার কারণেই। একই রূপ চেতনার বলে পাকিস্তানের মুসলমানরা ১৯৪৭ য়ে নিজ ভূমিতে স্থান করে দিয়েছিল ভারত থেকে আগত লক্ষ লক্ষ মোহাজিরদের। কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা মুসলিম উম্মাহর দেহ থেকে সে বন্ধন তথা সিমেন্টই খসাতে চায়। সে লক্ষ্যেই তার মুসলমানদের চেতনা থেকে মহান আল্লাহর দেয়া মুসলিম ভাতৃত্বের সে পরিচয়টিই ভূলিয়ে দিতে চায়। তাদের সে প্রচেষ্ঠায় সর্বপ্রকার ইন্ধন জোগাচ্ছে মার্কিন-ভারত-ইহুদী কোয়ালিশন। তারা চায়, ভাষা, বর্ণ ও ভূগোলের গর্ব নিয়ে মুসলমানগণ একে অপরের হত্যাযোগ্য শত্রুরূপে খাড়া হোক। সেরূপ একটি পরিকল্পনা নিয়েই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশেরা আরবদের অস্ত্র দিয়েছিল তুর্কীদের হত্যা করতে। সেটি ছিল উসমানিয়া খেলাফতের বিনাশ, ২০টির বেশী টুকরায় আরবদের বিভক্তি এবং সে বিভক্ত ও দুর্বল আরবদের মাঝে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা। ভারত একই লক্ষ্যে বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের হাতে অস্ত্র দিয়েছিল অবাঙালী মুসলিম হত্যায়। তাদের মূল লক্ষ্যটি ছিল পাকিস্তানের বিনাশ, শক্তিশালী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা নয়। সে অস্ত্র নিয়েই তারা একাত্তরে হাজার হাজার অবাঙ্গালীকে উৎসব ভরে হত্যার ব্যবস্থা করেছিল এবং তাদের ঘরবাড়ী ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে উচ্ছেদ করে বস্তিতে পাঠিয়েছিল। প্যান-ইসলামিক চেতনার যে তারা আজও পরম শত্রু, সেটি আওয়ামী বাকশালী রাজনীতির গোপন বিষয় নয়। বরং সে রাজনীতির চর্চা তারা ঘোষণা দিয়েই করে। মুসলিম উম্মাহর দেহে বিভক্তি গড়ার সে বিষাক্ত বিষকে লাগাতর সঞ্চালিত করার স্বার্থেই তারা জাতীয়তাবাদকে বাঁচিযে রাখার ব্যবস্থা করেছে, এবং সেটি সংবিধানে লিপিবদ্ধ করে। বিশ্বজনীন সিভিলাইজেশনাল ফোর্স রূপে মুসলমানদের উত্থানে তাদের সামান্যতম আগ্রহ নেই, বরং ভাষা ও ক্ষুদ্র ভূগোলের নামে মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত রাখার মধ্যেই তাদের আনন্দ।

 

হুশ ফিরবে কবে?

সংবিধান কোন ব্যক্তি, দল বা জোটের নয়; এটি একটি দেশের সংখ্যাগিরষ্ঠ জনগণের ঈমান-আক্বিদা, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও চেতনা প্রতীক। দেশের জনগণ কীরূপ ধর্ম, চেতনা বা বিশ্বাস নিয়ে বসবাস করে সেটি প্রতিজনের মাঝে তালাশ বা গবেষণা করার বিষয় নয়। সেটির পরিচয় মেলে সেদেশের সংবিধান থেকে। মুসলমান ও অমুসলমানের বাঁচা-মরা, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির এজেণ্ডা যেমন এক নয়, তেমনি এক হয় না শাসনতন্ত্রও। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ কাফের অধ্যুষিত-ভারত ও মুসলিম-অধ্যুষিত পাকিস্তান বা ইরানের শাসনতন্ত্র এক নয়। মুসলমানের মহান আল্লাহ যে শরিয়তি বিধান দেয়, কাফেরদের ভগবান সেটি দেয় না। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরই ভারত ও পাকিস্তান দুটি ভিন্ন ধারারা শাসনতন্ত্র নির্মাণে অগ্রসর হয়। তখন পাকিস্তানের আলেম সম্প্রদায়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, দেশের শাসনতন্ত্র কীরূপ হবে। তখনও আলেমদের মাঝে নানা বিষয়ে নানা মত। কিন্তু শাসনতন্ত্রের মূলনীতি কীরূপ হবে সে বুনিয়াদী বিষয়ে দ্বিমত হয়নি। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল বা রাষ্ট-প্রধান তখন খাজা নাজিমুদ্দীন, প্রধানমন্ত্রী নবাব লিয়াকত আলী খান এবং সংসদের স্পীকার ফরিদপুরের মৌলভী তমিজুদ্দীন খান। সে সময় শীয়া-সূন্নী, দেওবন্দী-বেরেলভী, আহলে হাদীস সব ফেরকার আলেমগণ মিলে ২২ দফা মূল নীতি প্রণয়ন করেন। লক্ষণীয় হল, পাকিস্তানে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে দেরী হলেও আলেমদের প্রণীত সে ২২ দফা মূল নীতি অনুমোদনে সংসদে বিলম্ব হয়নি। পাকিস্তানের ব্যর্থতা অনেক। তবে এক্ষেত্রে তাদের সফলতা কি কম? বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে কম নয়, কিন্তু আলেমদের সে সফলতা কোথায়? আলেমদের প্রণীত ২২ দফা মূলনীতি আজও পাকিস্তানের সংবিধানের বুনিয়াদ। সে মূলনীতির আলোকে পাকিস্তানের সংসদ দায়বদ্ধ পুরাপুরি শরিয়ত ভিত্তিক আইন তৈরীর। সেখানে আইনের উৎস্য রূপে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কোরআন ও সূন্নাহকে। রয়েছে কঠোর ব্লাসফেমী আইন। আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে অসম্মান সে দেশে হত্যাযোগ্য অপরাধ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে সেটি হয়নি। বরং সংবিধান পরিণত হয়েছে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতার দলিল। বাংলাদেশের ১৫ কোটি মুসলমানের কাছে এরচেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে? আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও অসন্মানের অপরাধ যেমন বিশাল, তেমনি গুরুতর হল তার শাস্তিও। সে শাস্তি ভয়ানক আযাব রূপে আসে। কিন্তু আল্লাহর বিরুদ্ধে সংঘঠিত সে বিদ্রোহ ও অসন্মান নীরবে সয়ে যাওয়া এবং সে বিদ্রোহের নায়কদের ভোটে নির্বাচিত করার অপরাধটিও কি কম? মুসলমানের কাজ শুধু ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা নয়, অন্যায়ের নির্মূলও। কোরআনের ভাষায় সেটি “নেহী আনিল মুনকার”। আল্লাহর হুকুমের বিরূদ্ধে বিদ্রোহের চেয়ে বড় অন্যায় আর কি হতে পারে? অথচ বাংলাদেশ সে বিদ্রোহীদের হাতেই দেশ অধিকৃত। এবং সেটি শুধু বিদ্রোহীদের নিজ বলে নয়। বরং যেমন জনগণের ভোটে, তেমনি তাদের রাজস্বের অর্থে। ফলে জনগণই বা দায়ভার থেকে মুক্ত হয় কি করে? কিন্তু প্রশ্ন হল, সে হুশই বা ফিরবে কবে? ৫/০৭/১১

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *