বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সংকট
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on April 7, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
প্রেক্ষাপট জঙ্গলতূল্য অরাজকতার
আলাদা মানচিত্র বা ভিন্ন পতাকাই কি স্বাধীনতার সবটুকু? এমন মানচিত্র ও পতাকা ভূটানের মত বিশ্বের বহু দেশেরই রয়েছে। একসময় সিকিমেরও ছিল। স্বাধীনতার অর্থ নিজের অধীনতা। অপরদিকে পরাধীনতায় অধীনতা অপরের। এবং সেটি শত্রুপক্ষের। স্বাধীন দেশকে পরাধীন করার অমানবিকতা ইতিহাসে প্রচুর। সভ্যতার দাবীদার ইউরোপীয়রা এমনকি দেড় শত বছর আগেও আফ্রিকার মানুষদের গলায় রশি বেঁধে গরুছাগলের ন্যায় জাহাজে তুলেছে, পরিবার-পরিজন থেকে আলাদা করেছে এবং আটলান্টিকের ওপারে নিয়ে নিলামে তুলেছে। কেউ মনিব এবং কেউ ক্রীতদাস এ বিভাজন শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিশ্বটা অধিকৃত পরাধীন দেশ এবং আধিপত্যবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশ – এ দুই ভাগে বিভক্ত বহু হাজার বছর পূর্ব থেকে। মনিবের কাছে যা অধিকার পরাধীন গোলামের জন্য তা বিদ্রোহ বা ঔদ্ধত্য গন্য হতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিগত শতাব্দিতে নিছক মানবিক অধিকার চাওয়ার অপরাধে হাজার হাজার কৃষ্নাঙ্গ কৃতদাসকে বিচারের নামে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
সমাজ থেকে স্বাধীন ও পরাধীন মানুষের বিভাজন বহুলাংশে দূর হলেও বিশ্ব-রাজনীতি থেকে তা এখনও দূর হয়নি। আধিপত্যবাদী দেশগুলির দাপটে দরিদ্র ও দূর্বলের স্বাধীনতা এখনও নিরাপদ নয়। আমেরিকা তার জাতীয় স্বার্থ খুঁজে ইরাকের অভ্যন্তরে, কুয়েতে, সৌদি আরবে, ইরানে এবং আরো অনেক দেশে। নিজ নিরাপত্তার বাহানায় বিশাল সামরিক উপস্থিতি রেখেছে ইরানের একান্ত উপকূলে, পারস্য উপসাগরে। প্রয়োজনে বিশ্বের যে কোন দেশে বৃষ্টির ন্যায় বোমাবর্ষনেও তার কুছ-পরওয়া নেই। অমানবিকতায় এরা এতটাই আক্রান্ত যে, আনবিক বোমায় দুটি সম্পূর্ণ শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকির নিরস্ত্র মানুষদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারতেও তাদের সামান্য আফসোসও হয়নি। এ ভয়ানক অপরাধের পরও তারা কোন ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। শুধু এটুকু বলেই তারা খালাস, এ বোমা বর্ষিত হয়েছে মার্কিনীদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়া, ইয়েমনে ৩০ লাখের বেশী মানুষ নিহত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরিচালিত যুদ্ধে। বৃহৎ শক্তির পক্ষ থেকে পরিচালিত এ ধরনের আগ্রাসন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তে পরিষদের কিছু করার সামর্থ্য পূর্বেও যেমন ছিল না, এখনও নাই। প্রতিকার দূরে থাক নিন্দা জ্ঞাপনেরও সামর্থ্যও নাই। ভেটো প্রয়োগে যে কোন প্রস্তাবের নাকচের হক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল বৃহৎ শক্তিবর্গের।
পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা বাহানায় বহুবার বোমা বর্ষণ করেছে ইরাকের অভ্যন্তরেও। হত্যা করেছে অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষকে। এমনকি ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলাকালে মিজাইল মেরে হত্যা করেছে যাত্রীবাহী ইরানী এয়ারবাসের তিন শতের বেশী বেসামরিক বিমান যাত্রীকে। এমন জঘন্য অপরাধও জাতিসংঘ ফোরামে নিন্দিত হয়নি। দূরপাল্লার মিজাইল, আনবিক বোমা ও নানা মারনাস্ত্র নিয়ে মার্কিন রণতরী দিবারাত্র ঘুরছে বিশ্বব্যাপী। স্বার্থ খুঁজছে অন্যদেশের জলে-স্থলে, আকাশে এবং জমিনের নীচে। অন্য দেশের একান্তরে অভ্যন্তরে ঢুকতেও তারা কোনরূপ পরওয়া করে না। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উপকুলে দূরে থাক, আটলান্টিকের মধ্যখানেও অন্যদেশের যুদ্ধ জাহাজের উপস্থিতিতেই তাদের প্রচণ্ড আপত্তি। নিজ ভূখন্ড থেকে অনেক দূরে কিউবাতে মিজাইল স্থাপনেও তারা যুদ্ধের হুমকি দেয়।
তবে শক্তিধরদের এরূপ আগ্রাসী নীতি শুধু মার্কিনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটিই বিশ্বব্যাপী শক্তিধরদের রাজনৈতিক কালচার। তাই খেয়ালখুশী মত ইসরাইল বোমা বর্ষণ করে লেবানন ও গাজার অসামরিক মুসলিম পল্লিতে। ৬ লাখেরও বেশী ভারতীয় সেনা অবিরাম হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে চলেছে কাশ্মীরে। যুদ্ধে লিপ্ত উত্তরপূর্ব ভারতেও। সকল আধিপত্যবাদী শক্তির এ হলো অভিন্ন চরিত্র। এমন আধিপত্যবাদী আগ্রাসন আজ বিশ্বের কোণে কোণে। দূর্বল দেশগুলোর স্বাধীন অস্তিত্ব এদের কারণেই আজ প্রচন্ড হুমকির মূখে। তাই স্বাধীনতাকে সমুন্নতা রাখতে হলে ভাবতে হবে বিশ্বের এরূপ জঙ্গলতূল্য অরাজকতাকে সামনে রেখে। তাছাড়া বাংলাদেশের অবস্থান যে এলাকাটিতে সেটিও এমন আধিত্যবাদ থেকে মুক্ত নয়। বিশ্বে যেমন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যে যেমন ইসরাইল, দক্ষিন এশিয়ায়ে তেমনি ভারত। ভারতের ক্ষুধা মেটাতে সিকিম ইতিমধ্যেই তার স্বাধীনতা খুইয়েছে। ১৯৪৮য়ে খুইয়েছিল কাশ্মীর। আজও শৃংখলিত অবস্থা ভূটান ও নেপালের। ফলে প্রতিবেশীর এরূপ অতি আগ্রাসী রসনার মূখমূখী অবস্থান হল বাংলাদেশের। পনের কোটি মানু্ষই শুধু নয়, ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার হল, বাংলাদেশের নদ-নদী, প্রকৃতি, জলবায়ু, পশু-পাখী সবকিছুই। ভারতের বৈরীভাব বা শত্রুতা শুধু বাংলাদেশের সীমান্তকে নিয়ে নয়, বরং এর অস্তিত্ব নিয়ে। ফলে এক খন্ড ভূমি ও এক টুকরা পতাকা নিয়ে আশ্বস্থ্য হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুরক্ষা হবে না।বরং অরক্ষিতই থেকে যাবে। পরাধীনতাই তখন গ্রাস করবে এর সবটুকু। স্বাধীনতার সুরক্ষার কথা ভাবতে হবে ভারতের এ আগ্রাসী অভীপ্রায়কে সামনে রেখেই।
আগ্রাসী ভারত ও অরক্ষিত বাংলাদেশ
প্রশ্ন হল, ভারতের অভিপ্রায় কি? বাংলাদেশের প্রতি তার নীতিই বা কি? একাত্তরে দেশটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে -এটাই কি যথেষ্ট প্রমান যে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে? এবং বাংলাদেশ আশংকা মূক্ত? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ এটাই প্রথম ছিল না। এর পূর্ব ১৯৪৮ এবং ১৯৬৫ সনেও তারা লড়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের চারগুণ বড় হয়েও কোনটিতেই তারা জিততে পারেনি। ১৯৪৮য়ের যুদ্ধে জাতিসংঘে ভারত কাশ্মীরে গণভোটের প্রতিশ্রতি দিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৬২ সনে তারা বেদম মার খেয়েছিল চীনের কাছে। জনসংখ্যায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হয়েও এ ধরনের উপর্যুপরি পরাজয় ও অপমানে ভারতীয় নেতাদের অসামর্থ্যতাই ধরা পড়ে। এতে বিশ্বরাজনীতিতে ভারতের এবং সে সাথে নেহেরুর সম্মান ও গ্রহনযোগ্যতাই বিপন্ন হয়। ফলে তারা প্রতিক্ষায় ছিল একটি সহজ বিজয়ের। অপমানের প্রতিশোধ ভারত সবসমই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সুযোগ খুঁজেছে। একাত্তরের যুদ্ধ তাদের সে সুযোগই এনে দেয়। ১৯৪৮ এবং ১৯৬৫য়ের যুদ্ধে তারা কোন বন্ধু পায়নি। এমনকি বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপালও তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। সে দেশটিও সেদিন পাকিস্তান সাথে সদ্ভাব রেখেছিল। কিন্তু একাত্তরে ভারতের একান্ত পাশে ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনবসতি বাংলাদেশ। ভারতের জন্য কোন মুসলিম দেশের সহযোগিতার এটাই ছিল প্রথম। ফলে ইতিহাসে তারা এই প্রথম বিজয়ের মূখ দেখে। একাত্তরে ভারতের সংশ্লিটাতাকে দেখতে হবে এ নিরিখেই। ভারতের এ অতীতকে বাদ দিয়ে একাত্তরের বিচার করতে গেলে বহু সত্যকে উপেক্ষা করা হবে। এতে ভারতের কুৎসিত অভিসন্ধিও অজানা থেকে যাবে। তখন পাকিস্তান আর্মির পরিত্যক্ত বহু হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ভারতে নিয়ে যাওয়া, বাংলাদেশের সাথে ভারতের ২৫ সালা চুক্তি, জাল নোট ছেপে বাংলাদেশের অর্থনীতির রাহাজানী, তিনবিঘা ফেরতে অনীহা, তালপট্টি দ্বীপের জবর দখল, গঙ্গার একতরফা পানি প্রত্যহার, পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ- এসব জঘন্যতার পিছনে যে দুর্বৃত্তি ও অসুস্থ মানসিকতা কাজ করছে সেটিও অজানা থেকে যাবে। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারের যুগেও ইতিহাসপাঠ যে গুরুত্ব হারায়নি সেটি বস্তুতঃ এসব কারণেই। তাই প্রসঙ্গতা হারায়নি ভারতের অতীত মানসিকতার সাথে পরিচয় লাভও।
ভারত তার সৃষ্টি থেকেই আধিপত্যবাদী। সে আধিপত্যবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে কাশ্মীর বিগত পঞ্চাশটি বছর ধরে। বিশ্বের বৃহৎ গণতন্ত্ররুপে ভারতের গর্ব অনেক। অথচ কাশ্মিরীদের স্বাধীকারের প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘে গনভোটের ওয়াদা দিয়েও আজ অবধি ভারত সেটির বাস্তবায়ন করেনি। সে সময় মার্কিনী এডমিরাল মিষ্টার নিমিটজকে গনভোট অনুষ্ঠানের তদারকীতে নিয়োগও করা হয়। কিন্তু ভারত তাকে কাশ্মিরে প্রবেশের অনুমতিও দেয়নি। ভারতের যুক্তি ছিল কাশ্মিরের হিন্দু রাজা স্বেচ্ছায় ভারতে যোগ দিয়েছে। অথচ একই যুক্তিকে গ্রাহ্য করেনি হায়দারাবাদের বেলায়। সে রাজ্যটির মুসলিম নিজাম পাকিস্তান যোগ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় বাহিনী জোর করে দেশটিকে দখল করে নেয়। বাংলাদেশের সাথেও ভারতের ব্যবহার কম ছলনাময়ী নয়। একদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সহযোগীতার কথা বলে। অথচ পাকিস্তানী বাহিনীর ফেলে যাওয়া বিপুল যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক যানবাহন নিজ দেশে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ কি আজও সে পরিমাণ অস্ত্র কিনতে পেরেছে? মুজিব তো একখানি ট্যাংকও কিনতে পারেনি। সে আর্থিক সামর্থ্য যেমন ছিল না, মনের ইচ্ছাও তেমন ছিল না। ফলে অরক্ষিত থাকে সমগ্র দেশ। আর অরক্ষিত দেশের কি কোন স্বাধীনতা থাকে?
১৯৪৮ ও ১৯৬৫-য়ের ন্যায় একাত্তরের যুদ্ধেও ভারতের কাছে কোন তৃতীয় পক্ষ ছিল না। পক্ষ ছিল মাত্র দুটি। একটি ভারত ও আরেকটি পাকিস্তান। উনিশ শ’ সাতচল্লিশ থেকে যে দ্বন্দের শুরু একাত্তর ছিল তার একটি পর্যায় মাত্র, পরিসমাপ্তি নয়। বলা যায়, ভারতীয় আধিপত্য বিস্তারের পথে এটি ছিল এক অপরিহার্য মাইল ফলক। এ মাইল ফলকের ওপারেও ভারত বহুদুর যেতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম, ট্রানজিট, অবাধ বাজার ও চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবহার বস্তুতঃ সে মাইল ফলকেরই অপর পাড়ের বিষয়। অথচ ভারত ও তার সেবাদাস প্রচার মাধ্যম এ সত্যকে বাংলাদেশের জনগণকে জানতে দেয়নি। একাত্তরে ভারত কৈয়ের তেলে কৈ ভেজেছে। তবে এতে আমাদের আমাদের নিজেদের খরচটা পড়েছে বেশী। সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশদের থেকে স্বাধীনতালাভেও এত রক্তক্ষয় হয়নি। অবশ্য রক্তক্ষয় প্রবলতর করায় ভারতের প্রবল আগ্রহেরও কারণ ছিল। উপমহাদেশের দুই মুসলিম শক্তির শত্রুতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার এটাই ছিল একমাত্র টেকসই উপায়। এক্ষেত্রে ডিভাইড এ্যান্ড রুল – এ সাম্রাজ্যবাদী নীতিটিই হল সবচেয়ে বেশী কার্যকর। ইংরেজদের অভিজ্ঞ আমলা রূপে এ নীতির প্রয়োগে তাদের দক্ষতাও কম ছিল না। বলা যায় সাতচল্লিশে ভারতের ভিন্ন ভাষাভাষি মুসলমানদের সম্মিলিত শক্তির পরিচয়লাভে তারা যথার্থভাবেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মুসলিম ঐক্যের মূখে কংগ্রেস ও ঔপনিবেশিক বৃটিশের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রও বিজয়ী হতে পারেনি। ফলে ডাস্টবীনে গিয়ে পড়েছিল তাদের অখন্ড ভারত নির্মানের পরিকল্পনা। তাই একাত্তর ছিল ভারতের জন্য বড়ই সৌভাগ্যের বছর। সাতচল্লিশে বাংলাদেশের আপামর মানুষ অবাঙ্গালী মুসলমানদের সাথে একাত্ম হয়ে ভারত মাতাকে যেভাবে দ্বি-খন্ডিত করেছিল একাত্তরে ভারত তারই বদলা নেওয়ার সুযোগ পায়। তাই একাত্তরে ভারতই বরং বিপুল সাহায্য পেয়েছে বাংলাদেশ থেকে। বহু বছর ধরে তারা তো সেটির্র প্রতিক্ষায় ছিল।
শৃঙ্খলিত স্বাধীনতা
বাংলাদেশের সৃষ্টিতে ভারতের দুই পার্শ্বে দুই পাকিস্তান গড়ে উঠার আশংকায় ভারতীয় নেতাদের দুশ্চিন্তা কম ছিল না। এ ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্বেগও প্রকাশ করেন বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপায়ী। ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি ছিল এমন একটি সম্ভাবনাকে দূর করার লক্ষ্যে। এ ভাবে মিত্র চুক্তির খোলসে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই শৃঙ্খলিত করে। ১৯৯৭ য়ের ১৮ই মার্চে এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। তবে কি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আবার শৃঙ্খলিত করা যায় সে প্রচেষ্টা ভারতীয়দের কখনোই কম ছিল না। উপআঞ্চলিক জোট, করিডোর চুক্তি, বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরে ভারতের প্রবেশাধীকার মূলতঃ শৃঙ্খলিত করারই চেষ্টা। যে কোন স্বাধীন দেশই প্রভু নয় বন্ধু খোঁজে, কিন্তু এসব চুক্তি বাংলাদেশকে শুধু শৃঙ্খলিতই নয়, বরং বন্ধুহীন করবে! যেমনটি করেছিল ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত।
ভারত এলাকায় প্রভু হতে চায়। পদ্মা ও তিস্তার পানি তুলে নিয়ে ভারত যে গোয়ার্তুমির পরিচয় দিয়েছে -সেটি আজ আর অস্পষ্ট নয়। অস্পষ্ট নয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সসস্ত্র বিদ্রোহীদের প্রতি ভারতীয়দের সাহার্য্য ও প্রশিক্ষণ। কিন্ত মুশকিল হলো, বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সে ইতিহাস জানতে চায় না। সরকার ভারতের ভূমিকা অতীতে যেমন দেখেনি। আজও দেখছে না। যেমনটি দেখেনি ৭২ সালে, যখন এদেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সামরিক সরঞ্জাম ভারতীয় ট্রাক প্রকাশ্য দিবালোকে সীমান্ত দিয়ে নিয়ে যায়! দেখেনি তখনও যখন ভারত সরকার কারেন্সি নোট ছাপানোর দায়িত্ব নিয়ে তিন-চার গুণ বেশী ছেপে কালো বাজারে বিক্রি করে বাংলাদেশের অর্থনীতিরই সর্বনাশ করেছিল। ভারতীয় নেতাদের মন ও মননে কি পরিমান বাংলাদেশ বিরোধী বিদ্বেষ বা ঘৃনা থাকতে পারে -এসব হল তারই প্রমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে ভারত অতীতে এতটা বিবেকহীন হত না। এটা মিথ্যা নয় যে একাত্তরের কারণে ভারতের প্রতি বর্তমান সরকারের দায়বদ্ধতা আছে, কিন্তু সে দায়বদ্ধতার দ্বায়ভার কেন সাধারণ মানুষ বহন করবে?
ভারত -পুঁজি বিনিয়োগ করছে নেপালে, করছে ভিয়েতনামে, করছে আফ্রিকায়। কিন্তু বিনিয়োগ করেনি বাংলাদেশে। বরং বিনা বিনিয়োগেই পশ্চিম বাংলা, আসাম ও বিহারের সম্মিলিত বাজারের চেয়ে এক বৃহৎ বাজার পেয়েছে বাংলাদেশে। অথচ নিজ দেশে নানা খাতে কত খরচই না তাদের করতে হয়। একমাত্র অবাঙ্গালী মুসলমানেরাই এদেশে শিল্পখাতে কিছু বিনিয়োগ করেছিল। অথচ আওয়ামী লীগ তাদেরও দেশ ছাড়া করেছে। অবশ্য আওয়ামী আমলে বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিনিয়োগটা বেড়েছে। এবং সেটি ভারতের। বানিজ্যিক পণ্যের সাথে প্লাবন বইছে সাংস্কৃতিক পণ্যেরও। ফলে ভারতমূখীতা ভর করেছে এদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে। ফলে দিন দিন বিলুপ্ত হতে চলেছে এদেশের সংস্কৃতিক সীমানা। আর সংস্কৃতিক সীমানা লোপ পেলে পৃথক রাজনৈতিক সীমানার পুয়োজন পড়ে কি? স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রয়োজন হয় একটি জাতির নিজের মত বেড়ে উঠার প্রয়োজনে। বাঁচা ও সুস্থ্য ভাবে বেড়ে উঠার সে প্রক্রিয়া সেটিই তো হলো সংস্কৃতি। যদি বেড়ে উঠতে হয় অন্যের মত করে তবে নিজেদের পৃথক মানচিত্রের প্রয়োজনটা কি? এরূপ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় ও প্রতিপালনে বিস্তর অর্থ ও শ্রমব্যয়েরই বা যৌক্তিকতা কি?
স্বাধীনতা লুন্ঠিত হওয়ার আশংকা যে কারণে
সংস্কৃতিক ভিন্নতাই ভিন্ন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। বাংলাদেশ এবং এর পূর্বে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয় মূলতঃ সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে ভিত্তি করেই। নিছক ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ, চাকুরি-বাকুরির জন্য ভিন্ন রাষ্ট্রের প্রয়োজন পড়ে কি? বিশ্বের অন্য প্রান্তে, অন্য যেকোন দেশেও এগুলী করা যায়। যেমন বহু লক্ষ বাংলাদেশী ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে তা করছে। কিন্তু সেখানে তারা বেড়ে উঠেছে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য বা শিকড়কে ছিন্ন করে। শিকড়হীনতায় তারা ভাসছে ভাসমান কচুরিপানার মতই। অনেকেই ভেসে গেছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রবল স্রোতে। ইসলাম শিকড়হীনদের ধর্ম নয়। তাই মুসলমানেরা যেখানেই আবাদী গড়েছে সেখানে শুধু ইসলামের শিকড়ই প্রোথীত করেনি, গড়ে তুলেছে ভিন্ন রাষ্ট্রও। রাষ্ট্র গড়ার এ প্রচেষ্টাই হলো জিহাদ। মদিনায় এমনি এক রাষ্ট্র গড়ায় হাজারো সাহাবী শহীদ হয়েছেন, নবীজী (সঃ) নিজেও আহত হয়েছেন। তাঁদেরই প্রচেষ্টায় মুসলমানেরা এক নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছেন। তাতে ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠার জন্য নিরাপদ ভূমি সৃষ্টি হয়েছে। বাড়ন্ত গাছ যেমন বেড়ে উঠার জন্য নিরাপদ ভূমি চায়, তেমনি নিরাপদ আশ্রয় চায় ঈমান। অন্যের অধীনতায় তথা পরাধীনতায় সেটি সম্ভব নয়। আধিপত্যবাদীরা পরাধীনদের ঈমানও নিয়ন্ত্রনে নিতে চায়। আবু লাহাব, আবু জেহল বা ফেরাউন, নমরুদ এমনটিই করতে চেয়েছিল। ভারতীয় আধিপত্যবাদও বাংলাদেশে তেমনটিই চায়।
তাছাড়া বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় বাড়লে তাতে প্রতিবেশী পশ্চিম বাংলা ও আসামেও মুসলমানেরা আন্দোলিত হতে পারে -সে ভয়ে শত্রুপক্ষ ইসলাম চর্চাকে সীমিত রাখতে চায়। এ লক্ষেই একাত্তরের পর মুজিব নিষিদ্ধ হয়েছিল ইসলামের নামে যে কোন রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। সে সময় ব্যাপক ভাবে শুরু হয়েছিল চেতনার ধোলাইকরণ। ভারতমূখী সরকারের ক্ষমতাদখলে সে একাত্তর-পরবর্তী প্রক্রিয়া আবার তীব্রতা পেয়েছ। শুরু হয়েছে বহুমূখী ও ব্যাপক সংস্কৃতিক আগ্রাসন। এ আগ্রাসন অব্যাহত থাকলে রাজনীতিও পাল্টে যাবে, কারণ সংস্কৃতির সাথে রাজনীতির নাড়ীর সম্পর্ক। সমাজ সংস্কারের রীতিই হল সংস্কৃতি। সংস্কৃতিক আবহাওয়ায় লালিত হয় ব্যক্তির মন ও মনন, তার জীবন যাত্রা ও রূচীবোধ। ভারত যে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি ঘটাচ্ছে তাতে অন্ততঃ ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার বাড়বে না। আর ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী নাহলে ভারতে লীন হওয়াতেই বা আপত্তি কিসের? বরং ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে মেশার মত খোদ ভারতীয় সংস্কৃতির অবগাহনে আগ্রহী হওয়াটাই তখন স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এতে বরং সীমান্ত তুলে দেওয়ারই আহবানই তীব্রতর হবে। যেমনটি হয়েছিল সিকিমে। স্বাধীনতার সুরক্ষায় আন্তরিক অঙ্গিকারও তখন বিনষ্ট হবে। ফলে বিপন্ন হবে স্বাধীনতাও।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকী তাই নিছক সামরিক নয়, বরং সবচেয়ে বড় হামলাটি রচিত হচ্ছে দেশের সাংস্কৃতিক্ ও রাজনৈতিক ময়দানে। ভারতীয় স্ট্রাটেজী শুধু বাংলাদেশকে সামরিক ভাবে দুর্বল করা নয়, বরং স্বাধীনতার পক্ষে লড়াকু মনভাবকেই বিলুপ্ত করা। বাংলাদেশের মুসলমানদের বিপদ এ নয় যে, দেশে বিপুল সংখ্যায় মানুষ অন্য ধর্মে ধর্মান্তর হচ্ছে। বরং যে কাজটি ব্যাপক ভাবে হচ্ছে সেটি হল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কনভার্শন। এ নব্য কনভার্টরা স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষকদের নির্মূলে সুযোগ বুঝে ময়দানে নেমে আসবে। ভারত থেকে বিপুল অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্রও পাবে। পদ্মাপারের এক নির্ভৃত পল্লী থেকে নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে কোন ইংরেজ গ্রেফতার করেনি। তাকে কোন ইংরেজও হত্যা করেনি। গ্রেফতার ও নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল স্বদেশী সন্তানেরা। তেমনি বাংলার বেরুবারীও কোন হিন্দুস্থানী সেনাদল দখলে নেয়নি। বরং সে ভূখন্ডটি ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল এক বঙ্গসন্তানই। একই ভাবে কোন পৌত্তলিক কাফের এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে কোরআনের আয়াত খুলে নেওয়ার ন্যায় হারাম কাজটি করেনি। করেছিল মুসলমান নামধারীরাই। আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বড় বিপদ এখানেই। দেশে এরূপ বঙ্গসন্তানরাই আজ দূষিত জলাশয়ে বেড়ে উঠা মশামাছির ন্যায় ব্যাপক ভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বড় সংকট এখানেই।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018