বাংলাদেশে অপরাধীদের শাসন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

অপরাধী সরকার ও জনগণের অপরাধ

অপরাধীদের নির্মূল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাই হলো মুসলিম জীবনের মূল মিশন। এ মিশন নিয়ে বাঁচার জন্যই মুসলিম মাত্রই মহান আল্লাহাতায়ালার খলিফা। এবং এ কাজের জন্যই পবিত্র কোর’আনে মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির (খায়রা উম্মাহ) মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহাতায়ালার পক্ষ থেকে সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা আল-ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে। যারা এ মিশন পালনে ব্যর্থ হয় তারা পরিণত হয় শয়তানের খলিফাতে। আর শয়তানের খলিফাদের শাস্তি দেয়াই মহান আল্লাহাতায়ালার রীতি -সেটি যেমন এ দুনিয়ার বুকে, তেমনি আখেরাত। সে আযাবটি আসে দুর্বৃত্ত শাসনের অসভ্যতার মধ্য দিয়ে। এবং পরকালে জুটে জাহান্নামের শাস্তি।

কোন সমাজেই আযাব শুধু অপরাধী সরকারের কারণে আসে না। জনগণের অপরাধের কারণেও আসে। হিংস্র পশু তাড়ানোর কাজটি দোয়াদরুদে হয় না, অস্ত্র হাতে মাঠে নামতে হয়। নইলে মহল্লায় নিরাপত্তা থাকে না। তেমনি সভ্যভাবে বাঁচার জন্যও মূল্য দিতে হয়। সে মূল্য দিতে হয় জিহাদে নেমে। ইসলামে জিহাদ তাই ফরজ; সভ্যতর রাষ্ট্র নির্মাণের এটিই হলো একমাত্র হাতিয়ার। ঈমানদার এখানে বিনিয়োগ করে তার শক্তি, অর্থ, মেধা ও রক্তের। জনগণ সভ্যতর সমাজে নির্মাণে মূল্য পেশ করে জিহাদের মধ্য দিয়ে। তাই যে সমাজে জিহাদ নাই, সে সমাজে আযাব নেমে আসে দুর্বৃত্ত শাসনের। কারণ, আবর্জনা সরানোর সভ্য কাজটি না হলে, বাঁচতে হয় গলিত আবর্জনার বিষাক্ততা নিয়ে। তখন জোয়ার আসে চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের। সভ্য সমাজে গুরুতর অপরাধ হলো মহল্লায় হিংস্র পশুকে বিচরণ করতে দেখেও অস্ত্র হাতে তা মারতে না নামা। তেমনি গুরুতর অপরাধ হলো, দেশে দুর্বৃত্ত শাসন দেখে তার নির্মূলে না নামা। মানব জীবনে এটিই হলো চরম দায়িত্বহীনতা। এবং এরূপ অপরাধ ও দায়িত্বহীনতায় যা অনিবার্য হয় তা হলো আযাব। তখন জোয়ার আসে দুঃসহ দুর্বৃত্তির। অবিকল সেটিই ঘটছে বাঙালী মুসলিমদের জীবনে।

নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতের ন্যায় ইবাদতের মূল ভূমিকা হলো, ঈমানদারকে জীবনের সবচেয়ে এ গুরুত্বপূর্ণ মিশনের জন্য প্রস্তুত করা। সে মিশনটি হলো অপরাধীদের নির্মূল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। পবিত্র এ মিশনটি জান, মাল, অর্থ, মেধা ও সময়ের লাগাতর কোরবানী চায়।এটিই হলো মুমিনের জীবনে সবচেয়ে বড় ইবাদত। অন্যান্য ইবাদতের লক্ষ্য হলো, জিহাদের ন্যায় এ বড় ইবাদতটির জন্য মুসলিমদের গড়ে তোলা। যেমন নামাযের ভূমিকা সন্মন্ধে পবিত্র কোর’আনে বলা হয়েছে, “ইন্নাস সালাতা তানহা আনিল ফাহশায়ে ওয়াল মুনকার”। অর্থ: নামায অশ্লিলতা ও দুর্বৃত্ত কর্ম থেকে দূরে রাখে। ঔষধের রোগ সারানোর ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু মুমিনের নামায যে তাকে অশ্লিলতা ও দুর্বৃত্ত কর্ম থেকে দূরে রাখবে না –সেটি কি ভাবা যায়? কারণ নামাযের সে অব্যর্থ কার্যকারিতা নিয়ে রায়টি তো মহান আল্লাহাতায়ালার। নামাযের সে কার্যকারিতা নিয়ে তাই কি সন্দেহ চলে? কিন্তু নামায পড়েও যে নামাযী সূদ খায়, ঘুষ খায়, মিথ্যা বলে ও অশ্লিল হয় -তখন কি বুঝতে বাঁকি থাকে, তার নামায প্রকৃত অর্থে নামাযই নয়?

বাংলাদেশে আজ যেরূপ চোরডাকাত ও ভোটচোরদের শাসন, এবং দুর্বৃত্তি, গুম, খুন, ফাঁসি, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের যে দুর্বিসহ প্লাবন -তার কারণ কি শুধু অপরাধী সরকার? দায়ী তো জনগণও। জনগণের অপরাধ হলো, দুর্বৃ্ত্তির নির্মূল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে বাঁচায় তাদের ব্যর্থতা। অপরাধীদের বিচরন শুধু দেশের রাজনীতি. পুলিশ বাহিনী, প্রশাসন, আদালত, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বানিজ্য ও বুদ্ধবিত্তিতে নয়, জনগণের মাঝেও। সমগ্র দেশ অধকিৃত হয়ে গেছে অপরাধীদের হাতে। অপরাধীদের সবচেয়ে বড় ভীড়টি দেশের রাজনীতিতে। রাজনীতি এখন আর জনসেবার হাতিয়ার নয়, রাজনীতি ব্যবহৃত হচ্ছে স্বার্থ-শিকারের অস্ত্র রূপ। হিংস্র পশু যেমন শিকিার শেষে বনে গিয়ে নিজ গুহায় আশ্রয় নেয়, তেমনি বহু অপরাধীও নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে বা কৃত অপরাধের শাস্তি এড়াতে যোগ দিচ্ছে রাজনীতিতে। অফিস-আদালত, সেনানিবাস, হাট-বাজার বা লোকালয়ে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে সেটির তবুও বিচারের সম্ভাবনা থাকে। কারণ সেখানে রাজনীতি থাকে না। কিন্তু রাজনীতির অঙ্গণে সে সম্ভাবনা নইে। কারণ, আদালত, সচিবালয়, ডাকাতপাড়া বা পথেঘাটে দুর্ষ্কমে লিপ্ত কোন অপরাধীকে পুলিশ ধরলে তার পক্ষে মিছিল হয় না, লগি বৈঠা নিয়ে সে অপরাধীকে বাঁচাতে কেউ যুদ্ধ শুরু করে না। অথচ কোন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে দূর্নীতি বা কোন বিদেশী শত্রুর গুপ্তচর হওয়ার অভিযোগ উঠলেও তার বিচার করা অসম্ভব। বিচারের আগেই অপরাধী নেতাকে নির্দোষ রূপে ঘোষণা দেওয়া হয় রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে। বিচার চিত্রিত হয় ষড়যন্ত্র রূপে। সে অপরাধী নেতার বিচারকে রাজনৈতিক প্রতহিংসা আখ্যা দিয়ে বিচারকদেরই বরং রাজপথে লাঠি দেখানো হয়।

 

স্বৈরশাসনের অসভ্যতা

সভ্য সমাজের আলামত হলো, সেখানে থাকে আইনের শাসন। কিন্তু সেটি অসম্ভব হয় অসভ্য সমাজে। তখন আদালত জিম্মি হয় দুবৃত্তদের হাতে। তখন দেশে অপরাধের প্লাবন আসে, কিন্তু বিচার হয়না। বাংলাদেশে সেরূপ উদাহরণ অনেক। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল ভারতীয় গুপ্তচরদের সাথে মিলে আগরতলা ষড়যন্ত্রের। লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তান ভাঙ্গা। সে ষড়যন্ত্রের সত্যতা নিয়ে এখন খোদ আওয়ামী লীগ মহলেও কোন বিতর্ক নাই। বরং তা নিয়ে জড়িতদের সাবাশ দেয়া হয়। অথচ সে সময় সে মামলাকে ষড়যন্ত্র মূলক ও মিথ্যা বলা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মুজিবের মুক্তি দাবী করা হয়।

দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে শত্রু দেশের সাথে মিলে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া যে কোন সভ্য দেশেই মৃত্যুদন্ড বা যাবৎজীবন কারদন্ডে দন্ডিত হওয়ার ন্যায় গুরুতর অপরাধ। পাকিস্তান সরকাররে কাছে মুজিবের সে অপরাধটি ছিল দেশোদ্রোহ-মূলক জঘন্য অপরাধ। ভারত বা অন্য যে কোন দেশের বিরুদ্ধে সেরূপ ষড়যন্ত্র হলে –সে সব দেশেও এ অপরাধকে ভিন্ন ভাবে দেখা হতো না। কিন্তু পাকিস্তান সরকার মুজিব ও তার সহচরদের অপরাধের বিচার করতে পারনি। পাকিস্তানের আদালত শেখ মুজিবকে কাঠগড়ায় তুলেছিল ঠিকই -কিন্তু বিচারের কাজ শেষ করতে পারিনি। রাজনীতি ঢুকে পড়ে আদালতের অঙ্গণে। শেখ মুজিবকে শাস্তি দেওয়া দূরে থাক, আগরতলা ষড়যন্ত্রের সাথে তার সংশ্লিষ্টতাই তাকে হিরো বানিয়ে দেয়। বাংলাদেশের রাজনী্তিতে অপরাধ কর্মের নায়কগণও যে কতটা বিশাল ভাবে প্রতিষ্ঠা পায় -এ হলো তার নজির। আর এরূপ প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তরাই দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে অপরাধীদরে অভয় অরণ্যে পরণিত করে। এতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটে সমগ্র দেশ জুড়ে।

অর্থহরণ, নারীহরণ, দস্যুবৃত্তি ও শত্রুদেশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি -যে কোন সমাজেই জঘন্য অপরাধ। সে সাথে জঘন্য অপরাধ হলো, জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকারের ন্যায় মৌলিক মানবিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া। এতে লুন্ঠিত হয় মানবের মানবিক পরচিতি ও মর্যাদা। তখন সমাজের মানবিক পরিচয়টি বিলুপ্ত হয়। সমাজে পশুদের কোন অধিকার থাকে না। মানুষও সে অধিকার হারায় যখন সমাজে পশুত্ব বিজয়ী হয়। মানুষ উপার্জন বাড়ায়, উন্নত সমাজ গড়ে এবং সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণ করে তো সে মানবিক মর্যাদা বা অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। তাই মানবতার মূল শত্রু হলো তারাই যারা মানুষকে স্বাধীন মানুষ রূপে বাঁচার অধিকারকে ছিনিয়ে নেয়। যে কোন সভ্য দেশে সামরকি ক্যু বা ফ্যাসিবাদী নীতিতে জনগণের সে রাজনৈতিক অধকিারহনন এজন্যই অতি গুরুতর অপরাধ। স্বৈরশাসনের এটিই হলো সবচেয়ে বড় নাশকতা।  তখন ব্যহত হয় সভ্য ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ। সমগ্র দেশ তখন কারাগারে পরণিত হয়। জঙ্গলে কেউ খুন হলে সেখানে বিচার হয় না। কারণ সেখানে আদালত থাকে না। সেরূপ বিচারশূণ্য দেখা যায় অসভ্য সমাজেও।

 

শেখ মুজিব: অপরাধের শিকড়

অপরাধ কোথাও হটাৎ করে শুরু হয়না। রোগের যেমন জীবণু থাকে, অপরাধেরও তেমনি শিকড় থাকে। অপরাধী মারা যায়, কিন্তু শিকড় রেখে যায়। বাংলাদেশে আজ যেরূপ অপরাধীদের শাসন -তার শিকড় রোপন করেছিল শেখ মুজিব। আজ সেটিই বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে আজকের ক্ষমতাসীনগণ যে চেতনার ধারক -সেটি মূলত মুজিবের। তাদের হাতে অধিকৃত হওয়ায় অপরাধে ভরে গেছে সমগ্র রাষ্ট্র। ফলে অপরাধ আর অপরাধ গণ্য হচ্ছে না। শেখ মুজিবের অপরাধের তালিকাটি বিশাল। গণতন্ত্র হরণ, সকল বিরোধী দল নিষিদ্ধ করণ, একদলীয় বাকশালী শাসনে প্রতিষ্ঠা, সকল সরকার-বিরোধী পত্রিকার দফতরে তালা ঝুলানো –এসবই হলো তার অপরাধ। ইসলামী দলগুলো নিষিদ্ধ করে নিষিদ্ধ করেছিল ইসলামী চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠাও। এসবই ছিল দেশের শাসনতন্ত্র বিরোধী অপরাধ। এ অপরাধ ছিল জনগণের অধিকারের উপর ছিনতাই। কিন্তু সে অপরাধের বিচার হয়নি। তার আমলে নিহত হয়ছে প্রায় ৩০ হাজারের বেশী বিরেধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মী। কোন কোন হত্যার পর প্রচন্ড দম্ভ দেখিয়েছেন স্বয়ং শেখ মুজিব। বন্দী সিরাজ শিকদারকে পুলিশী হিফাজতে হত্যা করার পর সংসদে উল্লাসিত হয়ে হুংকার দিয়েছেন, “কোথায় আজ সিরাজ শিকদার?” কাউকে বিনা বিচারে হত্যার অধিকার কোন সরকারেরই থাকে না। শেখ মুজিবেরও ছিল না। কিন্তু বনের নেকড়ে যেমন কারো অনুমতি নিয়ে শিকার ধরে না, তেমনি স্বৈরাচারি শাসকগণও কারো অনুমতি নিয়ে কাউকে খুন করে না। তখন হিংস্র পশুর আচরণ জনপদে নেমে আসে। স্বৈরশাসনকে এজন্যই জঙ্গলের অসভ্য শাসন বলা হয়।

অপরাধ কর্ম প্রতি সমাজইে ঘটে। তবে সভ্য সমাজের বৈশিষ্ঠ হলো সে সমাজে অপরাধের বিচার হয়। আইনের শাসন প্রতষ্ঠা পায়। অথচ অসভ্য সমাজে সেটি হয় না। অপরাধীদের বিচারে সর্বপ্রথম যা জরুরি,  তা হলো অপরাধকে ঘৃণা করা সামর্থ্য।  এবং চাই অপরাধীকে নিছক অপরাধী রূপে দেখার রুচি। বিচারের আগে কে কোন দলের, কে কোন ভাষা বা বর্ণের অপরাধীর সে পরচিয়টি গুরুত্ব পেলে সুবিচারই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই সুবিচারের সামর্থ্য সবার থাকে না। সে সামর্থ্য স্বৈরাচারি শাসক, দুর্বৃত্ত বিচারক, আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক লুটেরাদেরও থাকে না। তাদের এজেন্ডা বরং ন্যায় বিচারকেই অসম্ভব করা। কারণ, ন্যায় বিচারকে হত্যা করার মধ্যেই তাদের নিজেদের বাঁচা। তাই এরা শুধু প্রশাসন ও রাজনীতিকেইে দখলে নেয় না, দখলে নেয় দেশের আদালতকেও। তাদের অন্যায় কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রতিটি ব্যক্তিকেই তারা গণ্য করে রাজনৈতিক শত্রু রূপে; এবং লক্ষ্য হয় তাদের হত্যা করাও। তখন বিরোধীদের জন্য বাড়ে ফাঁসির আয়োজন।

ন্যায় বিচারে আওয়ামী লীগের যে সামান্যতম আগ্রহ নাই –সেটি বুঝা যায় দলটির নীতি থেকে। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে দলটি নিজ দলের শত শত নেতা-কর্মীদের উপর থেকে দায়েরকৃত সকল মামলা তুলে নেয়। এর মধ্যে ছিল বহু খুণ ও দুর্নীতির মামলা। যে দেশে আদালত কাজ করে সে দেশে কাউকে নির্দোষ বলে খালাস দেওয়ার সামর্থ্য সরকাররে থাকে না। সে অধিকার একমাত্র আদালতের। অথচ স্বৈরাচারি শাসকগণ আদালতের বিচারকদের দলীয় লাঠিয়ালে পরিণত করে। ফলে নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের উপর থেকে মামলা তূলে নিলেও মামলার বন্যা শুরু হয় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। একই রূপ ঘটনা ঘটেছে সত্তরের দশকে আওয়ামী শাসনামলে। তখন লক্ষাধিক বিহারী, বহু হাজার রাজাকার , শত শত আলেম ও বহু হাজার বামপন্থি নেতাকর্মীকে বিনাবিচারে হত্যা করা হয়ছে। লুন্ঠিত হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি ও সহায়সম্পদ। লুন্ঠিত হয়েছে রিলিফির মালামাল। কিন্তু শেখ মুজিবের স্বৈরাচারি সরকার সে অপরাধের নায়কদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেয়নি।

 

শেখ মুজিবের অপরাধী মানস

বহু হাজার মানুষের সামনে ঢাকা স্টডেয়িামে কাদের সিদ্দিকী ৪ জন হাত-পা বাঁধা রাজাকারকে হত্যা করে। আন্তর্জাতিক আইনে এভাবে বন্দীদের হত্যা যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ সে জঘন্য অপরাধকে অপরাধ রূপে গণ্য করেনি। শেখ মুজিব সে অপরাধ কর্মকে প্রথমে অস্বীকার করেন, তারপর নিহতরা যেহেতু রাজাকার সেহেতু সেটিকে জায়জে ঘোষনা দেন। মুজিবের চরিত্র, যুদ্ধাপরাধ ও মিথ্যাচারের প্রামাণ্য দলিল এসেছে প্রখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাসীর রিপোর্ট থেকে। রিপোর্টটি এসেছে মুজিবের সাথে তাঁর সাক্ষাতকারের বিবরণ রূপে। সে বিবরণটি এরূপ: “এরপর ১৮ই ডিসেম্বর হত্যাযজ্ঞ সর্ম্পকে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি রাগে ফেটে পড়েন। নীচের অংশটি আমার (ওরিয়ানা ফালাসীর) টেপ থেকে নেয়া।

শেখ মুজিব: “ম্যাসাকার? হোয়াট ম্যাসাকার?”

ওরিয়ানা ফালাসী: “ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ঘটনাটি?

শেখ মুজিব: “ঢাকা স্টেডিয়ামে কোন ম্যাসাকার হয়নি। তুমি মিথ্যা বলছো।”

ওরিয়ানা ফালাসী: “মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি মিথ্যাবাদী নই। সেখানে আরো সাংবাদিক এবং প্রায় পনেরো হাজার লোকের সাথে আমি সে হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেছি। আমি চাইলে আমি আপনাকে তার ছবিও দেখাবো। আমার পত্রিকায় সে ছবি প্রকাশিত হয়েছে।”

শেখ মুজিব: “মিথ্যবাদী, ওরা মুক্তি বাহিনী নয়।”

ওরিয়ানা ফালাসী: “মি. প্রাইম মিনিস্টার, দয়া করে মিথ্যাবাদী শব্দটি আর উচ্চারণ করবেন না। তারা মুক্তি বাহিনীর। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল আব্দুল কাদের সিদ্দিকী এবং তারা ইউনিফর্ম পরা ছিল।”

শেখ মুজিব: “তাহলে হয়তো ওরা রাজাকার ছিল যারা প্রতিরোধের বিরোধীতা করেছিল এবং কাদের সিদ্দিকী তাদের নির্মূল করতে বাধ্য হয়েছে।”

ওরিয়ানা ফালাসী: “মি. প্রাইম মিনিস্টার,…কেউই প্রতিরোধের বিরোধীতা করেনি। তারা ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। হাত-পা বাঁধা থাকায় তারা নড়াচড়াও করতে পারছিল না।”

শেখ মুজিব: “মিথ্যাবাদী।”

ওরিয়ানা ফালাসী: “শেষবারের মতো বলছি, আমাকে মিথ্যাবাদী বলার অনুমতি আপনাকে দেবো না।” (ইন্টারভউি উইথ হিস্টরী, ওরিয়ানা ফালাসী। – (অনুবাদে:  আনোয়ার হোসনে মঞ্জু)।

এই হলো শেখ মুজিবের মানসিকতা। এই হলো বাংলাদেশীদের জাতির পিতার প্রকৃত পরিচয়। এই হলো আওয়ামী লীগ ঘোষিত সর্বকালের সেরা বাঙালীর মানবতা, নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায়বোধ ও চরিত্রের মান। বাঙালীদের সেরা ব্যক্তির চরিত্রের মান যদি এই হয় -তবে সাধারণ বাঙালীর চরিত্রের মান কোথায় দাঁড়াবে? এক নেকড়ের কাছে অন্য নেকড়ের হিংস্রতা দোষের মনে হয় না। এরই ফল হলো, মুজিবের যে অপরাধী চরিত্রটি ওরিয়ানা ফালাসী তাঁর প্রথম দিনের প্রথম দৃষ্টিতে সঠিক ভাবে সনাক্ত করতে পেরেছিলেন -তা আওয়ামী লীগের নেতা-র্কমীগণ অর্ধশতাব্দী যাবত তাকে কাছে থেকে দেখেও বুঝতে পারিনি। একই কারণে সমগ্র বিশ্বের বিবেকমান মানুষের দৃষ্টিতে একাত্তরের যে অপরাধগুলো জঘন্য যুদ্ধাপরাধ রূপে গণ্য হলো -তা তাদের কাছে আদৌ অপরাধ গণ্য হয়না। বরং সে নৃশংসতা গণ্য হয়েছে বীরত্বর্পূণ র্কম রূপ। এমন মানসকিতা নিয়ে বিনা বিচারে মানুষ হত্যাকে জায়জে মনে করাটিই স্বাভাবিক।

 

বিচারের নামে রাজনৈতিক শত্রু হত্যা

যে কোন অপরাধের ন্যায় যুদ্ধাপরাধের ন্যায্য বিচারেও কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তেমন একটি বিচারে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের আদৌ কোন আগ্রহ ও যোগ্যতা আছে কি? কারণ, বিচারের কাজ তো খুনিদের দিয়ে হয়না। আওয়ামী লীগ এর আগেও দুইবার ক্ষমতায় এসেছে। আগ্রহ থাকলে সে বিচার সত্তরের দশকই মুজিব আমলে হত। অপরাধরে আলামাত ৪০ বছর পর অক্ষত থাকার কথা নয়। যে কোন যুদ্ধে দুইটি পক্ষ থাক। প্রতি পক্ষেই কিছু অপরাধী থাকে। তারাই অপরাধ ঘটায়। বহু নিরপরাধ লোক তখন মারা যায়। সুবিচারে আগ্রহী হলে উভয় পক্ষের অপরাধীদেরই আদালতের কাঠগড়ায় তুলতে হয়। শুধু একপক্ষের বিচার নিজেই এক বিরাট অবিচার। একাত্তররে সকল অপরাধ শুধু পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বা পাকিস্তানপন্থিরা করেছে -সেটি ঠিক নয়। তা হলে লক্ষাধিক বিহারীদের কারা হত্যা করলো? কারা বিহারীদের ধর্ষণ করলো? কারা তাদের ঘর-বাড়ী, ব্যবসা-বানিজ্য কেড়ে নিয়ে বস্তিতে বসালো? সেটি কি অপরাধ নয়? কারাই বা বহুহাজার বন্দী রাজকার এবং নিরস্ত্র হাজার হাজার পাকস্তানপন্থিকে হত্যা করলো? তারা নিশ্চয়ই বজ্রপাতে বা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা যায়নি। বসনিয়া ও কসভোর যুদ্ধে বহু অপরাধ সংঘটিত হয়ছে। হেগের আন্তর্জাতিক আদালত সার্ব ও মুসলিম উভয় পক্ষের অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি হয়নি। বিচারের এই কি আন্তর্জাতিক মান?

আন্তর্জাতিক আইনে যে কোন বন্দীকে হত্যা করা যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু বিচারের নামে অবিচারের আয়োজন হলে তখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের আগ্রহ থাকে না। আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদরে বিচারের নামে শুধু সরকার-বিরোধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু যেসব যুদ্ধাপরধারীদের অবস্থান আওয়ামী লীগের ভীতরে তাদের বিচারের কোন উদ্যোগ নেই। কারো বিচার করতে হলে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী প্রমাণ আনতে হয়। কথা হলো, যাদেরকে গ্রেফতার করা হলো তাদের বিরুদ্ধে কি ছবিসহ এমন প্রমাণ আছে যে তারা রাইফেলের মাথার বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ি খুঁচিয়ে মানুষ হত্যা করছে? সেটি থাকলে সরকারের সে ছবি প্রকাশ করা উচিতি। কিন্তু কাদের সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে সে ছবি আছে। বিদেশী পত্রিকায় সে ছবি ছাপা হয়ছে। সে ছবি বহু ওয়ব সাইটে আজও প্রামাণ্য দলীল রূপে শোভা পায়। ফলে যুদ্ধাপরাধারীদরে বিচারে আওয়ামী লীগ সরকারের সামান্যতম আগ্রহ থাকলে কাদের সিদ্দিকীকে কাঠগড়ায় খাড়া করা উচিত ছিল।

 

বিচার অপরাধীদের হাতে!

বাংলাদেশে বিচার এখন আর বিচারকদের হাতে নাই। বিচারের আয়োজক এখন অপরাধীগণ। শুধু একাত্তরে নয়, বাংলাদেশের সমগ্র ইতিহাসে সবচেয় বড় অপরাধ কান্ডগুলো ঘটেছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে। আজও বাংলাদেশে যত আপরাধ ঘটছে তারও সিংহ ভাগ ঘটছে তাদের হাতে। দেশ জুড়ে দুর্নীতি, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসীর রাজনীতির যে জোয়ার -তার কারণ তো আওয়ামী শাসন। আন্তর্জাতিক আইনে কাউকে জোরপূর্বক ঘর থেকে রাস্তায় নামিয়ে তার ঘর-বাড়ি ও সহায়-সম্পদ দখলে নেয়া গুরুতর অপরাধ। যুদ্ধকালে ঘটলে সেটি ভয়ানক যুদ্ধাপরাধ। বাংলাদেশে সে অপরাধ যে কতটা বীভৎস ভাবে হয়ছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো, কয়েক লক্ষ বিহারীর হত্যাই শুধু নয়, তাদের সহায়-সম্বলহীন বস্তির জীবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর পরাজয়রে পর সেদেশে হিটলারের নাজী পার্টির বহু লক্ষ নেতা-কর্মি জড়িত ছিল। কিন্তু বিজয়ীরা কি তাদের ঘরবাড়ী দখলে নিয়েছে? কেউ খুন বা ডাকাতি করলে তার শাস্তি দেয়া যায়। সে জন্য কি অপরাধীর ঘরবাড়ী ছিনিয়ি নিয়ে তার তার স্ত্রী ও পুত্র-কণ্যাদেরকে রাস্তায় নামানো যায়? বিশ্বের কোন সভ্য দেশে কি এরূপ অপরাধ ঘটে? কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছে এ গুরুতর অপরাধ কোন অপরাধই গণ্য হয়নি। বরং মুজিব সরকার সেসব জঘন্য অপরাধীদেরকে অন্যায় ভাবে দখলকৃত বিহারীদের ঘরবাড়ীর মালিকানা লিখে দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। কথা হলো এই যাদের ন্যায়বোধ, মূল্যবোধ, বিচারবোধ ও মানবতার মান, তারা যুদ্ধাপরাধ দূরে থাক, কোন বিচারের সামর্থ্য রাখে কী? সে জন্য তো ন্যায়কে ন্যায় এবং অন্যায়কে অন্যায় বলার ন্যূনতম সামর্থ্যটুকু থাকা দরকার।

অপরাধ শুধু যুদ্ধকালে ঘটে না। যুদ্ধ ছাড়াও প্রতি দেশে বহু মানুষ খুন হয়, বহু নারী ধর্ষিত হয়, বহু দোকানপাঠ ও ঘরবাড়ি লুন্ঠিতও হয়। অন্য যে কোন দেশের তুলনায় বাংলাদশে সেটি বরং বেশী বেশী হয়। দেশটি যে অপরাধীদের যে অভয় অরণ্য তার প্রমাণ, অপরাধ কর্মে বাংলাদেশ বিশ্বের ২০০টির বেশী রাষ্ট্রকে পিছনে ফেলে ৫ বার বিশ্বে প্রথম হয়েছে। মুজিব আমলে হাজার হাজার কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী লুন্ঠিত হয়ছে। লুণ্ঠনে লুন্ঠনে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশ্বের দরবারে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির খেতাবও পেয়েছে। যে জমিতে গাছের চেয়ে আগাছার সংখ্যাই বেশী -সে জমি থেকে আগাছা তুলতে বেগ পেতে হয় না। প্রশ্ন হলো, যে দেশে এতো অপরাধী, তাদের মধ্য থেকে ক’জনের বিচার হয়েছে? আওয়ামী লীগ তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর দুর্বৃত্তদের অপরাধ কর্ম প্রতিবারের ন্যায় প্রচন্ড তীব্রতা পেয়েছে। দলীয় অপরাধীদের হাতে বেদখল হয়ে যাচ্ছে সরকারি খাস জমি, নদীর পাড়, রেল সড়কের জমি, বনভূমি ও সমূদ্র সৈকত। ডাকাতির শিকার হচ্ছে দেশের হাটবাজার। লুটপাঠ হয়ে যাচ্ছে রাস্তার পাশের সরকারি গাছ। অপরাধীদের বিচারে সরকারের সামান্যতম ইচ্ছা থাকলে এসব অপরাধ কর্মের নায়কদের গ্রেফতার করা হতো। তাদেরকে আদালতে তোলা হতো। কিন্তু মুজিব যেমন বিচার করেনি, তেমনি হাসিনাও করছে না। তাদের আগ্রহ অন্যত্র। তারা বরং এসব অপরাধীদের নিজ দলে স্থান করে দিচ্ছে। এবং গুম, খুন ও জেলে তুলছে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের।

 

লক্ষ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূল

বিচারেরর নামে স্বৈরাচারি সরকারের মূল এজন্ডা হলো, রাজনৈতিক প্রতপক্ষ-নির্মূল। সে নির্মূল প্রক্রিয়াকে জায়েজ করতে তারা প্রতিপক্ষের গায়ে অপরাধীর লেবেল লাগায় এবং গ্রেফতার করে আদালতে তোলে। প্রকৃত অপরাধীদরে দাপটে দেশবাসীর জীবনে নাভিশ্বাস উঠলে কি হবে, পুলিশের নজর সে দিকে নেই। তারা ব্যস্ত সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা তৈরি করার কাজে। পুলিশের এটিই যেন সবচেয়ে বড় কাজ। ফলে মিথ্যা মামলা হচ্ছে হাজারে হাজার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাদের কাছে কোন প্রসঙ্গই নয়। সেটি হলে একাত্তরে যারা যুদ্ধ করলো -সেই পাক-বাহিনীর অফিসারদের তারা আদালতে তুলতো। অথচ তাদের কথা তারা মুখেও আনে না। কারণ, পাকিস্তানী সেনা অফিসারগণ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়। তারা তো চায়, রাজনীতির ময়দান থেকে শত্রু-নির্মূল।

চোরডাকাত, খুনি ও ধর্ষকগণ জনগণের ও রাষ্ট্রের শত্রু হলেও শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের শত্রু নয়। ফলে তাদের নির্মূল ক্ষমতাসীন দলের এজেন্ডা নয়। সরকার তার নিজের শত্রুদের চেনে। তাই প্রশাসনের হাতে নির্মূল হচ্ছে জামায়াত ও শিবির কর্মী, গুম ও খুন হচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মী এবং ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে গণহত্যার শিকার হয়েছে বহুশত হিফাজতে ইসলাম কর্মী। অথচ যে দুর্বৃত্তগণ দেশে অপরাধের জোয়ার এনেছে তাদেরকে ধরে শাস্তি দিয়েছে -সে নজির সামান্যই। বরং তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে নিজ দলে। কারণ, অপরাধী হলেও দলীয় ক্যাডার রূপে বিরোধী দলীয় কর্মীদের গুম বা খুনে এসব দুর্বৃত্তদের সামর্থ্য প্রচুর। রাজপথে তারা বিরোধীদের লাশ বানাতে পারে। প্রধানমন্ত্রী রূপে শেখ হাসিনার কাজটি হলো, এসব অপরাধীদের নিজ দলে আশ্রয় দেয়া এবং তাদের গায়ে আঁচড়টিও লাগতে না দেওয়া। এবং পুলিশের কাজ হলো, সরকারদলীয়দের অপরাধ কর্মগুলোকে নীরবে দেখা এবং জনগণের হাত থেকে তাদের প্রটেকশন দেয়া।

 

জামায়াতে ইসলামী কেন নির্মূলের টার্গেট?

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর নির্মূলে শেখ হাসিনার উদ্যোগী হওয়ার মূল কারণটি সুস্পষ্ট। সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। মুসলিম লীগের মত পাকিস্থানপন্থি দলগুলি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তারা আর এখন আওয়ামী লীগরে প্রতপিক্ষ নয়। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর অপরাধ, দলটি এখনও বেঁচে আছে। এবং রাজনৈতিক শক্তিও রাখে। বিএনপির শক্তি যাই হোক, জামায়াতে ইসলামীর সমর্থণ ছাড়া দলটির পক্ষে ১৯৯১ সালে যেমন ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব ছিল না; ভবিষ্যতেও সম্ভব নয়। দলটি শেখ হাসিনার টার্গেট একারণই। তাই পাকিস্তানপন্থি অনেকের সাথে হাসিনার পারিবারীক আত্মীয়তা জমলওে নির্মূলে নেমেছে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধ।

তবে জামায়াতে ইসলামীর আরেক বিরাট অপরাধ তারা শুধু অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল না, তারা ইসলামপন্থিও। ভারতপন্থি সেক্যুলারিস্টদের কাছে ইসলামপন্থি হওয়াটাই মূল অপরাধ। একাত্তরে জামায়াত পাকিস্তানের পক্ষ না নিলেও তারা নির্মূলে মুখে পড়তো। কারণ, বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় চায় -এমন দলের অস্তিত্ব ভারত এবং যারা ভারতীয় স্বার্থের পাহারাদার তারা কখনোই মেনে নিতে রাজী নয়। বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির উত্থানকে ভারত তার নিজ অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে। অপর দিকে ক্ষমতায় থাকতে হলে ভারতীয় এজেন্ডা নিয়ে কাজ করা ছাড়া শেখ হাসিনার সামনে ভিন্ন রাস্তা নাই। শেখ মুজিবেরও ছিল না। তাই ক্ষমতা হাতে পেয়েই মুজিব সকল ইসলামী দলকে নিষিদ্ধি করেছিলেন। তাতে প্রচন্ড খুশি হয়েছিল ভারত। হাসিনা জামায়াতের বহু নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে, ফলে ভারতের কাছে হাসিনার গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে। তবে আওয়ামী লীগের শত্রুদের তালিকায় জামায়াতে ইসলামী একা নয়। যারাই ইসলামের চেতনাধারি ও ইসলামের বিজয়ী আগ্রহী –টার্গেট তারাও। তাই জেল-জুলুম ও নির্যাতন নেমে এসেছে হিফাজতে ইসলাম, হিজবুত তাহরীর, আহলে হাদীস আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী দলের নেতা-কর্মীদের উপরও। এমনকি দাড়ী-টুপিধারী সাধারণ মুসল্লীরাও তাদের লগি-বৈঠা থেকে রেহাই পায়না।

 

ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন

তবে বাংলাদেশে ইসলামের শত্রুপক্ষ একা নয়। তাদের আন্তর্জাতিক মিত্র রয়েছে। ইসলামপন্থিদের দাবিয়ে রাখা বা নির্মূল শুধু আওয়ামী লীগ ও ভারতের স্ট্রাটেজী নয়। এমন এক আগ্রাসী স্ট্রাটজেী নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যুদ্ধ করছে আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, আলজিরিয়া, সোমালিয়া, লিবিয়াসহ বহু মুসলিম দেশে। তাদের কাছে রাষ্ট্রের বুকে ইসলামের প্রতিষ্ঠার পক্ষে আওয়াজ উঠানোই অপরাধ। ইসলামের অবস্থান তারা মসজিদের জায়নামাজে মেনে নিতে রাজী, কিন্তু আদালত, প্রশাসন, শিক্ষা ও অর্থনীতি, আইন-কানূনে নয়। তালেবানদের অপরাধ, ইসলামকে তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতষ্ঠায় আগ্রহী। সেটি রুখতেই ৪০টি দেশের সৈন্য আফগানিস্তানে হাজির হয়েছে। তারা বোমা ফেলেছে বিয়ের মহফিলে। বোমা ফেলেছে পাকিস্তানে ইসলামপন্থিদের মাথায়। এবং তাদের হাতে নিহত হয়েছে দশ লাখের বেশী নিরপরাধ মানুষ।

বাংলাদেশে সে অভিন্ন স্ট্রাটেজী নিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে আওয়ামী লীগ। ইসলামবরিোধী যুদ্ধে মার্কিনীদের মিত্র যেমন ভারত ও ইসরাইল, তেমনি আওয়ামী লীগও। ভোটডাকাতি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, দলটির হাতে গণতান্ত্রিক অধিকার ও আইনের শাসন পদদলিত হয়েছে –কিন্তু তা নিয়ে মার্কিনী প্রশাসন ও তার মিত্রদের মুখে নিন্দা বা প্রতিবাদ নাই। হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে প্রচন্ড খুশি ভারত। দিল্লীর শাসক চক্র চায় কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী যে যুদ্ধটি করছে, মুসলিমদের দমনে তেমন একটি যুদ্ধ বাংলাদেশেও লাগাতর হোক। বাংলাদেশেও যে কোন সময় ইসলামের পক্ষে জোয়ার শুরু হতে পারে -সে ভয়ে ভারতীয় শাসক মহলে দারুন দুশ্চিন্তা। সে জোয়ার রুখার কাজে ভারত আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করতে চায়। তাই বাংলাদেশের পুলিশের কাজ হয়েছে ঘরে ঘরে হানা দিয়ে শুধু ইসলামপন্থি ছাত্রদের গ্রেফতার করা নয়, বরং জিহাদ বিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করাও। অথচ নামায-রোযার ন্যায় জিহাদ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। নামায-রোযা না থাকলে যেমন কাউকে মুসলিম বলা যায় না, তেমনি মুসলিম বলা যায় না জীবেন জিহাদ না থাকলে। জিহাদহীন মুসলিমকে নবীজী (সা:) মুনাফিক বলেছেন। এজন্যই নবীজী (সা:)র আমলে জিহাদ করেননি এমন কোন সাহাবা পাওয়া যায়না। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বাংলাদেশে আজ যা কিছু ঘটছে সেটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং মুসিলদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গ্লোবাল যুদ্ধের এটি এক অবিচ্ছে্দ্য ঘটনা।

যুদ্ধাপরাধীদরে বিচার তাই একটি বাহানা মাত্র। মূল লক্ষ্যটি ইসলামপন্থিদের নির্মূল। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের নিজেরও কিছু করার নাই। সে বরং ইসলাম-দুষমন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে ক্রীড়নক মাত্র। বল এখন মার্কিন-নেতুত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী জোটের হাতে। বাংলাদেশে সে জোটের পক্ষ থেকে ইসলামপন্থিদের দমনের ভার পেয়েছে ভারত। একাত্তরেও তেমনই একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। আজকের মত তখনও রাজনৈতিক খেলার নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল দিল্লির দরবারে। সে সময় শেখ মুজিবেরও ভারতের হুকুম তামিল করা ছাড়া কিছু করার ছিল না। সে আমলে ইসলামী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবে এবার নিষিদ্ধ করা না হলেও নির্মূল করা হচ্ছে। মুজিব রক্ষি বাহিনী গড়েছিলেন, শেখ হাসিনা সেনা বাহিনী, RAB এবং পুলিশকে রক্ষি বাহনিী বানিয়ে ফেলেছে।

শান্তিপূর্ণ ভাবে যারা ইসলামের বিজয়ের স্বপ্ন দেখে তাদের এখন স্বপ্নভঙ্গের হওয়ার দিন। শয়তানী শক্তি নবীজী (সা:)’র ন্যায় মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শান্তিবাদী ব্যক্তিকে ইসলামরে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজটি শান্তিপূর্ণ ভাবে হতে দেয়নি। সে পক্ষটি যে আজও হতে দিবে –সেটি কি আশা করা যায়? ইসলামের বিজয়ের পথটি কোরবানীর পথ।  অর্জন করতে হয় অর্থ, রক্ত, মেধা, শ্রম, ছবরের বিনিময়ে। মহান আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে কোরবানী পেশ ছাড়া বিজয়ের অন্য কোন কোন পথ খোলা রাখা হয়নি। ঈমানদারীর পরীক্ষা হয় তো এ পথইে। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামদেরকে সে অভিন্ন পথে অগ্রসর হতে হয়েছে। ঈমানদারদের জন্য সে পরীক্ষাটইি বাংলাদেশেও শুরু হয়ে গেছে। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশের ইসলামপন্থিরা এ পরীক্ষায় কীভাবে অংশ নেয়। আত্মসর্মপণ এখানে কোন পলসি নয়, ভীরুতা বা নীরবতা কোন স্ট্রাটজেী নয়। আত্মসর্মপণ, ভীরুতা ও নীরবতায় যা অনিবার্য করে সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার আযাব –সেটি যেমন এ দুনয়িায়, তেমনি আখেরাতে। কথা হলো, পরীক্ষায় অংশ নেয়া ছাড়া কি প্রমোশন আশা করা যায়? আর ঈমানদারের জীবনে সে প্রমোশনটি তো আসে নিয়ামত ভরা জান্নাত প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। পরিস্থিতির মূল্যায়নে বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের তাই বোধোদয় হওয়া উচতি। চলমান এ পরীক্ষায় পাশ-ফেলের উপর নির্ভর করছে তাদের পরকালের পাশ বা ফেল। ১ম সংস্করণ ১৫/০৮/২০১০; ২য় সংস্করণ ২৩/০১/২০২১।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *