বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় কীরূপে
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 5, 2019
- Bangla Articles, সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
যে অভিন্ন স্বপ্ন প্রতিটি ঈমানদারের
দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতির বহুবিষয় নিয়েই মুসলিমদের মাঝে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু যা নিয়ে সামান্যতম বিরোধের অবকাশ নেই তা হল, ইসলামের বিজয়ের স্বপ্ন দেখা নিয়ে। কারণ, ইসলামকে পরাজিত দেখার মধ্যে আনন্দ থাকতে পারে একমাত্র কাফেরদের; মুসলিমের নয়। কে মুসলিম আর কে কাফের -সে বিচার ব্যক্তির নাম দেখে হয় না। মুখে কে কি বললো তা থেকেও নয়। বরং সে বিচার হয়, যেটি সে অন্তর থেকে চাইলো বা বাস্তবে করলো তা থেকে। আর মহান আল্লাহ তো মানুষের মনের ভাষা বুঝেন। এবং দেখেন প্রতিটি কর্ম। মুসলিম জীবনে প্রধানতম ভাবনা ও অঙ্গিকার হলো, আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার ভাবনা। তার চেতনায় সবসময় কাজ করে কি করে সে তার সামর্থ্যকে সে কাজে বিণিয়োগ করবে। কারণ মুসলিম হওয়ার অর্থ, স্রেফ কালিমা পাঠ নয়। রাজনীতির খেলার মাঠে নীরব দর্শক হওয়াও নয়। বরং জ্বিহাদের ময়দানে সক্রিয় মোজাহিদে পরিনত হওয়া। একাজে আত্মনিয়োগ ছাড়া কোন মুসলিম কি মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করতে পারে? নামায-রোযা বা দান-খায়রাতে যেমন নিয়ত বাঁধতে হয়, তেমনি নিয়ত বা লক্ষ্য নিদ্ধারণ করতে হয় বাঁচা-মরা ও জীবন ধারনের ক্ষেত্রেও। ইবাদতের নিয়ত না থাকলে কোন ইবাদতই যেমন ইবাদত হয় না, তেমনি উচ্চতর নিয়ত না থাকলে বাঁচাটিও পশুদের বাঁচা থেকে ভিন্নতর হয়না। বোখারী শরিফের প্রথম হাদীসটি হল, “সকল কাজের মর্যাদা বা মূল্যমান নির্ধারিত হবে তার নিয়ত থেকে।” মানুষের বাঁচবার সে উচ্চতর নিয়ত শেখাতেই পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা আয়াত নাযিল করেছেন এবং বলেছেনঃ “বলুন (হে মহম্মদ)! আমার নামায, আমার কোরবানী এবং আমার জীবন-ধারণ ও মরণ –সব কিছুই সেই বিশ্ব-প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য।” -সুরা আল-আনয়াম, আয়াত ১৬২।
তবে শুধু মহান নবীজী (সাঃ)কে তাঁর বাঁচা-মরার নিয়ত শেখাতে উপরুক্ত আয়াতটি নাযিল হয়নি। নাযিল হয়েছিল সমগ্র মানব জাতির উদ্দেশ্যে। মানুষ কেন বাঁচবে, কেনই বা লড়াই করবে, কেনই বা প্রাণ দিবে –সেটি প্রতিটি মানুষের জীবনেই অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বরং জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো এটি। কোন ব্যক্তির পক্ষে তার সীমিত কান্ড-জ্ঞান নিয়ে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর বের করা কঠিন। ফলে মানব জীবনে সবচেয়ে বড় ভূল হয় এ ক্ষেত্রটিতে। আর তাতে ব্যর্থ হয় সমগ্র জীবনের বাঁচাটাই। মানুষ তখন প্রান দেয় ইতিহাসের হিটলার ও চেঙ্গিজদের বিজয়ী করতে বা কোন সাম্রাজ্যবাদী, জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী যুদ্ধে। এভাবে তার বাঁচা বা মরাটি তখন পশুদের চেয়েও নিকৃষ্টতর হয়। কারণ পশু নিজে শিকার ধরলেও অন্যের হাতে গণহত্যা বা দেশ-দখলের হাতিয়ারে পরিণত হয় না। আল্লাহতায়ালা এমন মানুষদের উদ্দেশ্যেই বলেছেন, “উলায়িকা কা আল-আনয়াম, বাল হুম আদাল।” অর্থঃ এরাই হল তারা যারা গবাদী পশুর ন্যায়, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। উপনিবেশিক ব্রিটিশগণ তো তাদের সেনা বাহিনী পূর্ণ করেছে এসব মানুষ রূপী পশুদের দিয়েই। মানুষ তাদের বাহিনীতে ভাড়ায় খেটেছে। আজও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বজুড়ে আধিপত্য জমিয়েছে এসব পশুবৎ মানুষের সাহায্য নিয়ে। মহান আল্লাহতায়ালাকে তাই মানব জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিতেও পথ দেখাতে হয়েছে। সুরা আনয়ামের উপরুক্ত আয়াতটিতে বস্তুতঃ তিনি মানুষের জন্য তাঁর পছন্দের নিয়তটি তথা জীবনধারণের লক্ষ্যটি সুস্পষ্ট ভবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর মুসলমানের দায়িত্ব হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে বেঁধে দেওয়া সে নিয়তটিকে নিজের নিয়েত রুপে গ্রহণ করা। অন্যথায় তার বাচাটি হবে জাহান্নামের পথে বাঁচা।
ঈমানদার এজন্যই নিছক বাঁচার জন্য বাঁচে না। সে বাঁচে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত লক্ষ্যটি পূরণ করার লক্ষ্যে। নিছক আহারের সন্ধান, ঘরবাধা বা বংশ বিস্তারের লক্ষ্য তো পশুরও থাকে। তাই এরূপ লক্ষ্যে জীবন-ধারণ তাকে পশু-পাখি ও পোকা-মাকড় ভিন্নতর করে না, শ্রেষ্ঠতরও করে না। কোন রাষ্ট্রেই সকল নাগরিকের সম-মর্যাদা থাকে না। মর্যাদা নির্ধারিত হয় নাগরিকদের কাজের মর্যাদা থেকে। যে ব্যক্তিটি তার জীবনের সকল সামর্থ্য ব্যয় করে নিছক নিজের বেঁচে থাকা ও সুখ-সাচ্ছন্দের খাতিরে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে যার কোন আগ্রহ বা সামর্থ্যই অবশিষ্ঠ থাকে না -তাকে কি সে ব্যক্তির সম-মর্যাদা দেওয়া যায় যে তার সমুদয় সামর্থ্য ব্যয় করে, এমনকি প্রাণও বিলিয়ে দেয় রাষ্ট্রের কল্যাণে? এ দুই ব্যক্তি কখনই কোন রাষ্ট্রে সম-মর্যাদা পায় না। ইসলামে শহিদের মর্যাদা এজন্যই অতুলনীয়। তারা জীবনদান করে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে। তাদের বিজয়ে শান্তি নেমে আসে সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে। আল্লাহপাক তাদেরকে মৃত্যুর পরও জীবিত রাখেন এবং পুরস্কৃত করেন জন্নাত দিয়ে। আল্লাহপাক তো চান, তার প্রতিটি বান্দাহ সে মহান লক্ষ্য নিয়ে বাঁচুক, এবং অর্জন করুক সে মহান মর্যাদা। সমাজ মূলতঃ দুটি বিপরীত-মুখী জীবন লক্ষ্য নিয়ে বাঁচার যুদ্ধ। একটি মহান আল্লাহর লক্ষ্যে, আরেকটি গায়রুল্লাহ লক্ষ্যে। প্রথমটি মহা-সাফল্যের। আর দ্বিতীয়টি চরম ব্যর্থতার -যা ব্যক্তিকে জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। তাই কোরআনে বলা হয়েছে, “যারা ঈমানদার তাঁরা লড়াই করে আল্লাহর লক্ষ্যে আর যার কাফের তারা লড়াই করে শয়তানের লক্ষ্যে।”
কীরূপে বিজয় ইসলামের?
প্রশ্ন হল, বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় কীরূপে সম্ভব? এটি কি নির্বাচনের মাধ্যমে? নির্বাচনের মাধ্যমে যারা বাংলাদেশে ইসলামের বিজয়ের স্বপ্ন দেখে, বার বার শোচনীয় পরাজয়ের পর অন্ততঃ তাদের বোধোদয় হওয়া উচিত। নির্বাচন সমাজ বিপ্লবের হাতিয়ার নয। এমনকি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সফল মাধ্যমও নয়। অতীতে কোন দেশেই এ পথে কোন সমাজ বিপ্লব আসেনি। আসেনি মানুষের মন-মনন, রুচিবোধ, বাঁচবার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন। বরং নির্বাচনে দেশ-শাসনের অধিকার পায় তারাই যারা সমাজের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তাই সূদ, ঘুষ ও দূর্নীতি যে সমাজে প্রবল ভাবে বিজয়ী সে সমাজের নির্বাচনেও সূদখোর, ঘুষখোর ও দূর্নীতিবাজরাই বিজয়ী হয়। যেমন সবচেয়ে বড় ডাকাতটিই ডাকাত পাড়ায় সর্দার নির্বাচিত হয়। মক্কার দূর্বত্ত-কবলিত সমাজে আবু জেহল ও আবু লাহাবের ন্যায় দুর্বৃত্ত ব্যক্তি নেতা হবে সেটিই কি স্বাভাবিক ছিল না? তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল নবীজী (সাঃ)র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষকে।
মশা-মাছি কখনই ফুলের উপর বসে না, তারা তো আবর্জনা খুঁজে। তেমনি অবস্থা দূর্নীতিতে ডুবা জনগণের। যারা সমাজ পাল্টাতে চায় তাদের বুঝতে হবে, সমাজে নবীজী (সাঃ)র ন্যায় মহা-মানবকে নেতা রূপে গ্রহণ করার সামর্থ্য হাওয়ায় নির্মিত হয় না। এজন্য জনগণের চেতনায় ঈমানের প্রচণ্ড বল চাই। চাই, বিবেকমান হওয়ার সুশিক্ষা। অজ্ঞতায় ও কুশিক্ষায় সেটি হয় না। সে কারণেই মক্কার কাফেরদের সে সামর্থ্য ছিল না। নবীজী(সাঃ)কে প্রত্যাখ্যান করে তারা বস্তুতঃ নিজেদের নিরেট অযোগ্যতাই প্রমাণ করেছিল। এখানে ব্যর্থতা নবীজী(সাঃ)র ছিল না। ব্যর্থতা ছিল মক্কার মুশরিকদের। কথা হল, বাংলাদেশে এরূপ মাছি-চরিত্রের মানুষের সংখ্যা কি কম? চলতি শতাব্দীর শুরুতে দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্ব-শিরোপা পাওয়ার মধ্য দিয়ে তারা কি প্রমাণ করেনি যে, এমন মাছি-চরিত্রের মানুষের সংখ্যা সমগ্র বিশ্বমাঝে বাংলাদেশেই সর্বাধিক? এটি তো যে কোন সুস্থ্য মানুষের বিবেকে কাঁপন ধরানোর মত বিষয়।
দেহের রোগ লুকিয়ে রেখে লাভ নাই। বরং চিকিৎসার স্বার্থে সে রোগের বিষয়টি যতটা পূর্ণভাবে ও সত্যভাবে বলা যায় ততই ভাল। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বলেছিলেন, “হে বিধাতা! সাত কোটি প্রাণীরে রেখেছো বাঙ্গালী করে, মানুষ করনি।” রবীন্দ্রনাথের এ উচ্চারণের মধ্যে ছিল রোগ-নিরাময়ের লক্ষ্যে বাঙ্গলীর মারাত্মক রোগটি নিয়ে অকপটে কিছু বলার আকুতি। রবীন্দ্রনাথ সেদিন বাঙ্গালীর যে রোগটি নিয়ে প্রচন্ড মনোবেদনায় ভুগছিলেন সেটি হলো, বাঙ্গালীর মানুষ রূপে বেড়ে উঠার ব্যর্থতা। আজ তার সাথে যোগ হয়েছে আরেকটি মারাত্মক রোগ, এবং সেটি হল দুর্বৃত্তি। কথা হল, এমন একটি দুর্বৃত্তকবলিত দেশে স্বয়ং কোন পয়গম্বর নেমে আসলেও তাঁর পক্ষে কি নির্বাচনী বিজয়-লাভ সম্ভব? এখানে তো হোসেন মহম্মদ এরশাদের মত আদালতে প্রমাণিত ও শাস্তিভূগী দুর্বৃত্তরাই বার বার বিপুল ভোটে জিতবে। জিতবে হাসিনা ন্যায় ভোট-ডাকাত। কোটি কোটি মানুষের কাছি শ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে চিত্রিত হবে বাকশালী স্বৈরাচারি শেখ মুজিব। মক্কায় বার বার নির্বাচন হলেও নবীজী (সাঃ) কি সেসব নির্বাচনে একবারও জিততেন? অথচ মক্কা বিজয়ের পর সমগ্র চিত্রটাই পাল্টে যায়। তখন হাজারো বার নির্বাচন হলেও তাঁকে কি কেউ একটি বারও পরাজিত করতে পারতো? কারণ, ইতিমধ্যে সমগ্র আরব জুড়ে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে গেছে। সে বিপ্লবে পাল্টে গিয়েছিল শুধু তাদের ধর্মীয়-বিশ্বাসই নয়, বরং জীবন ও জগত নিয়ে তাদের সকল ধ্যান-ধারনা। পাল্টে গিয়েছিল প্রকৃত যোগ্য মানুষের ধারণা। আমূল বিপ্লব এসেছিল তাদের আচার-আচরণ, রুচীবোধ, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে। ইসলামের বিজয়ের পর আরবের এক কালের মাছি-চরিত্রের মানুষগুলো তখন আর আবর্জনার সন্ধান করেনি, নিজেরাই তখন বিশুদ্ধতা অর্জন করেছিল। মাছি-চরিত্রের বাদবাকি মানুষগুলো তখন আবর্জনার স্তুপে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে এটিই হলো নবীজী (সাঃ)র সফলতার নজির।
নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় আনা বা শরিয়তের প্রতিষ্ঠা করা অনেকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কম্যুউনিস্টদের বিজয়ের মত। নির্বাচন আসে সেদেশের প্রতিষ্ঠিত শাসনতন্ত্র, আইন ও রাজনৈতিক রীতি-নীতির বৈধতা মেনে নিয়ে। এমন নির্বাচনে সরকার পরিবর্তিত হয়, কিন্তু তাতে পরিবর্তন আসে না দেশের আইন বা শাসনন্ত্রে। যেটি আসে সেটি পুরনো ঘরে রঙ-চং লাগানোর মত। শাসনতন্ত্র একটি দেশের নির্বাচিত সরকারের হাত পা যে কতটা কঠোর ভাবে বেধে দেয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল তুরস্ক। ইসলামের ফরয বিধানগুলো বাস্তবায়ন দূরে থাক, নির্বাচনের মাধ্যমে বার বার ক্ষমতায় গিয়েও সেদেশের ইসলামপন্থিগণ ছাত্রীদের মাথায় রুমাল বাধার স্বাধীনতাটুকুও ফিরিয়ে দিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার পথে প্রচন্ড বাধা হয়েছে সে দেশের ধর্মবিরোধী সেকুলার আইন। ফলে সেদেশে ব্যাভিচার হয়, প্রকাশ্য মদ্যপাণ হয়, প্লেবয় ম্যাগাজিনের এডিশনও ছাপা হয়, সর্বোপরি ইসরাইলের সাথে যৌথ সামরিক মহড়াও হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনে ইসলামপন্থিগণ যদি জয়লাভও তবে কি তারা সমাজ পরিবর্তনেরর পথে বেশী দূর এগুতে পারবে? মহম্মদ রেজা শাহর আমলে ইরানে বহুবার নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু সে নির্বাচনে ইরানের ইসলামপন্থিরা অংশ নেয়নি। আর অংশ নিলেও তারা কি জিততে পারতো? এবং জিতলেই কি তারা দেশটির তাগুতী শাহ ও তার বহুদিনের প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা কে পাল্টাতে পারতো? গ্রেট-ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী রূপে কোন আল্লামা বা আয়াতুল্লাহকে বসালেই তিনিই বা কি করতে পারতেন? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনারাজ্য জুড়ে ব্যাপক বিপ্লব না এনে নিছক মন্ত্রী লাভ বা এমপি হওয়াতে ইসলামের কল্যাণ নেই। রেলগাড়ী শুধু বিছানো রেলপথ দিয়েই চলতে পারে, সে পথ থেকে ছিটকে পড়ালে আর এগুতে পারে না। তেমনি ঘটে একটি নির্বাচিত সরকারের বেলায়ও। তাকে বাধাধরা নিয়ম মেনে চলতে হয়, অধিকার থাকে না বিপ্লব ঘটানোর। কারণ সে ম্যান্ডেট নির্বাচনে কোন সরকারই পায় না। অথচ সে ক্ষমতা থাকে বিপ্লবী সরকারের। তাই ইরান, চীন, রাশিয়া বা কিউবাতে রাষ্ট্র জুড়ে যেরূপ ব্যাপক পরিবর্তণ এসেছিল সেটি কি কোন নির্বাচিত সরকার ভাবতে পারে? কারণ বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয় রাজপথে জনগণের প্রচন্ড বিদ্রোহে ও বিপুল রক্তদানে। এমন গণবিপ্লবের ক্ষমতাই আলাদা।
যে কুফরি ও শিরক গণতন্ত্রের নামে
বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে যারা নির্বাচনে নামে তারা তো প্রতিযোগিতায় নামে প্রচলিত শাসতান্ত্রিক বিধি ও জনগণের মাঝে বিরাজমান রাজনৈতিক দর্শন ও সংস্কৃতির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে। আর ইসলাম থেকে বিচ্যুতির শুরু হয় মূলতঃ এখান থেকেই। বাংলাদেশে যে শিরকটি প্রবল ভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেটি মুর্তিপুজা নয়। সে শিরক শুধু মুশরিকদের মাঝেও সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা হল গণতন্ত্রের নামে এমন এক বিশ্বাস যার মূল কথা, “জনগণই ক্ষমতার উৎস।” এবং সে সাথে “জনগণের সার্বভৌমত্ব”-এর ধারণা এবং “আইন প্রণোয়নে পার্লামেন্টের নিরংকুশ ক্ষমতার বিষয়।” অথচ মুসলমান হওয়ার অর্থই হল, আইন-প্রণোয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উপর থাকতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহর পূর্ন-সার্বভৌমত্ব। এক্ষেত্রে আপোষ চলে না। আপোষ হলেই ঈমান বিলুপ্ত হয়। মহান আল্লাহতায়ালার আইনকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজেরাই পার্লামেন্টে আইন নির্মাণে উদ্যোগী হওয়া তো আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহ তো আইনদাতা হিসাবে আল্লাহর রাব্বানিয়াতের বিরুদ্ধে। এটি তো সুস্পষ্ট কুফরি। কোন ঈমানদার ব্যক্তি কি এমন বিদ্রোহ ও এরূপ কুফরিতে অংশ নিতে পারে? এমন বিদ্রোহ তো এমনকি মুগল সম্রাটরাও করেনি। করেনি বাংলার কোন মুসলিম শাসক। আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষে প্রথম বিদ্রোহ করেছিল ব্রিটিশ শাসকেরা। আর বাংলাদেশের সেকুলার শাসকগণ আজও সে বিদ্রোহকেই বৈধতা দিয়েছে এবং অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের সেকুলার পক্ষটি এজন্যই ব্রিটিশসহ সমগ্র কাফের শক্তির এতটা পছন্দের। ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল ও উলামাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, দেশের জনগণকে এ প্রকাণ্ড কুফরির বিরুদ্ধে সতর্ক করতে পারিনি। অন্যদের কি সতর্ক কি করবে, তারা নিজেরাও সেটিকে যথার্থ ভাবে বুঝতে পারেনি।
অথচ ঈমানদারের ভয় জনগণের ভোট হারানো নিয়ে নয়, বরং ঈমান হারানো নিয়ে। সে সাথে আল্লাহর সাহায্য ও হেদায়াত হারানো নিয়ে। আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে প্রতিটি অবাধ্যতা সে অবাধ্য ব্যক্তিটিকে দূরে সরিয়ে নেয় মহান আল্লাহর হেদায়াত থেকে। এবং তাকে নিকটবর্তী করে শয়তানের। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবেঃ “যারা (আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের উপর) বিশ্বাসস্থাপন করেনা, তাদের বন্ধুরূপে শয়তানদেরকে নির্দ্দিষ্ট করে দিয়েছি।”- (সুরা আল-আ’রাফ, আয়াত -২৭। আরো বলা হয়েছেঃ “এবং যারা কুফরি করলো, তাদের বন্ধু হলো শয়তান; তাদেরকে সে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। তারাই হলো জাহান্নামের বাসিন্দা, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।”-(সুরা বাকারা, আয়াত ২৫৭। কথা হলো, কুফরির অর্থ কি? এর অর্থ কি সীমাবদ্ধ নিছক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করার মধ্যে? কুফরির নানা রূপ এবং মানুষের জীবনে এটি আসে নানা ভাবে। মক্কার কাফেরগণ আল্লাহকে শুধু বিশ্বাসই করতো না, নিজেদের সন্তানদের নাম আব্দুল্লাহ, আব্দুর রাহমানও রাখতো -যার অর্থ আল্লাহর দাস। কিন্তু তারপরও তারা কাফের রূপে চিহ্নিত হয়েছে। মুসলমান হওয়ার জন্য যা জরুরী তা শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বিশ্বাস করা নয়; বরং আল্লাহর দ্বীনের সামগ্রীক বিজয় বা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আপোষহীন অঙ্গিকার ও আত্মত্যাগ। ফলে প্রকৃত ঈমানদারের কাছে অতিশয় অসহ্য হলো আল্লাহর দ্বীনের পরাজয়। এক্ষেত্রে সামান্য আপোষমুখিতাই হল কুফরি। নবীজী (সাঃ) ও তার সাহাবায়ে কেরাম এ ব্যাপারে সামান্যতম আপোষ করেননি। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর ন্যায় দয়ালু ব্যক্তি তাঁর খেলাফত কালে তাদেরকে কাফের রূপে চিহ্নিত করেছেন এবং হত্যার শাস্তি দিয়েছেন যারা আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাস ও নামায-কালাম পড়লেও যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল।
গণতন্ত্রের নামে অন্য যে জাহিলিয়াতটি মুসলিম দেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে সেটি হল, “জনগণ কখনই ভূল করে না”। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তারা বলে, “জনগণ একাত্তরেও ভূল করেনি এবং এখনও করছে না।” জনগণ যেন ফেরেশতা। নির্বাচনী বিজয়কে তারা ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব যাচায়ে একটি মাপকাঠি রূপে ব্যবহার করে। সে মাপকাঠিতেই শেখ মুজিবকে তারা বলছে ইতিহাসের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। কারণ, একাত্তরে সবচেয়ে বেশী ভোটে বিজয়ী তিনিই একমাত্র বাঙালী। অথচ তারা একথা বলে না, ইতিহাসে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থণ পেয়েছে এককালের নমরুদ ও ফিরাউন। জনগণ শুধু সমর্থনই দেয়নি তাদের পক্ষে তারা যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে এবং ভগবানও বলেছে। অপর দিকে জনসমর্থণ হারিয়ে পথে পথে ঘুরেছেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ)। বহু শত বছর ধরে দিন-রাত বুঝিয়েও গণসমর্থণ পাননি হযরত নূহ (আঃ)। গণসমর্থণ না থাকায় রাতের আঁধারে লুকিয়ে মাতৃভূমি ছাড়তে হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মহম্মদ (সাঃ)কে। দুর্বৃত্তরা সেদিন মক্কায় প্রবল ভাবে বিজয়ী হয়েছিল, সে বিজয় নিয়ে আজকের ন্যায় সেদিনও ইসলামের বিপক্ষশক্তি মহা-বিজয়ের উল্লাস করেছিল। তারা একথাও ভূলে যায়, বিপুল জনসমর্থণ পেয়েছে দুর্বৃত্ত হিটলার, জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ার। তেমনি পেয়েছে একদলীয় বাকশালের প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশে মানবিক অধিকারের হন্তা শেখ মুজিব। তাই জনগণের ভোটে কি কারো সততা, যোগ্যতা বা অন্য কোন মানবিক গুণ যাচাই হয়? সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়ের, নেক ও দুর্বৃত্তের মাঝে বাছবিচারে জনগণ যে কতটা নিদারুন ভাবে ব্যর্থ হয় -এ হলো তারই নমুনা। গণতন্ত্রের এখানেই প্রচণ্ড ব্যর্থতা।এমন একটি বিফল বা ব্যর্থ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কি ইসলামের বিজয় সম্ভব? বিজয়ের লক্ষ্যে ইসলামের রয়েছে নিজস্ব প্রক্রিয়া। সে প্রক্রিয়ায় দুর্বৃত্তকে ভোটদান নয়, বরং তার শিকড়সহ নির্মূল গুরুত্ব পায়। এখানে গুরুত্ব পায় জনগণের বিবেকবোধের উন্নয়ন। অথচ গণতন্ত্রে ভোটদান ও ভোটগণনা বিপুল গুরুত্ব পেলেও কদর পায় না সে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। ফলে প্রকাণ্ড বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইসলামের বিজয়ে।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018