বাংলাদেশে চোর-ডাকাতদের দখলদারিঃ মুক্তি কীরূপে?

নয়া পোষাক ও নয়া কৌশল

বাংলাদেশের নব্য চোর-ডাকাতেরা শুধু পোষাকই বদলায়নি,কৌশলও বদলিয়েছে। তারা এখন চোরের দল বা ডাকাতের দল গড়ে না। দল গড়ে রাজনীতির নামে। দল গড়ে ব্যাংক-বীমা, বাণিজ্য কোম্পানী,ঠিকাদারি কোম্পানী,এনজিও ও শিল্প্রতিষ্ঠানের নামে। রাতের আঁধারে লুকিয়ে লুকিয়ে কারো ঘরে তারা এখন সিঁদ কাটে না।গ্রামগঞ্জের মাঠঘাট ও বনবাদাড় পাড়ি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাকাতিতেও নামে না। তারা কোটি কোটি টাকা ডাকাতি করে দিন-দুপুরে। সেটি চোর ডাকাতের পোষাক পড়ে নয়।তাদের গায়ের পোষাকটি কখনো রাজনৈতীক নেতা-কর্মীর,কখনো পুলিশের,কখনো সামরিক বা বেসমারিক অফিসারের,কখনো শিল্পমালিকের,কখনো ব্যাংক-কর্মকর্তার, কখনো বা এনজিও নেতার। এতে যেমন বিপুল অর্থের উপার্জন বেড়েছে,তেমনি জনগণের চোখে তাদের ইজ্জতও বেড়েছে। গ্রাম-গঞ্জের সকল চোর-ডাকাত মিলে বাংলাদেশের জন্ম থেকে এ অবধি যত টাকা চুরি-ডাকাতি করেছে হলমার্ক কোম্পানী একাই্ তার চেয়ে বেশী চুরি করেছে সোনালী বাংকের একটি মাত্র শাখা থেকে। অন্যান্য বাংক এবং সোনালী ব্যাংকের অন্যান্য শাখা থেকে চুরি যাওয়া টাকার অংক যোগ করলে সে তুলনায় অংকটি হাজার গুণ হবে।

গ্রামেগঞ্জের মানুষ পূর্বে চোরডাকাতদের ধরতে পারলে দলবেঁধে পিটাই করতো,সে উত্তম-মধ্যমে অনেকের প্রাণও যেত। কিন্তু এখন সমাজের এসব অতি পরিচিত চোর-ডাকাতদের গায়ে হাত দিতে কেউ সাহস করে না। বরং সাধারণ মানুষ এদের কুর্নিশ করে চলে। কারণ তাদের ক্ষেপিয়ে শান্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি-বাকুরি বা জীবন ধারণ করাই এখন অসম্ভব। আগেকার চোরদের হাতে থানা পুলিশ ছিল না,মন্ত্রীরাও তাদের ছাড়াতে থানায় যেত না। এখন তো পুলিশের থানা,মন্ত্রী পাড়া ও সেক্রেটারিয়েটে তাদের ঘাঁটি। মন্ত্রীর চুরির টাকার বস্তা টানে তার সরকারি গাড়ী। তবে জনগণের নিজেদের মাঝেও পরিবর্তনটি কম নয়। গ্রাম-গঞ্জের মানুষের মনে চোরডাকাতদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত সাহস যে শুধু লোপ পেয়েছে তা নয়,পূর্বের ন্যায় এখন আর সে ঘৃনাবোধও নাই। বরং চোরডাকাতের তারা এখন সন্মান করে। দলবেঁধে তাদের পিছনে জিন্দাবাদ বলে,ভোট দেয়,নির্বাচনে জিতলে কাঁধে তুলে উৎসবও করে।

গৃহস্থের গহনাপাতি,কাঁসার থালাবাসন,গরুবাছুর বা হাঁসমুরগীর প্রতি এসব আধুনিক চোরদের কোন রুচী নেই।তাদের নজর সরকারি ব্যাংকের কোষাগার,বাজেটের অর্থ,বিদেশী অনুদান,উন্নয়ন প্রজেক্টের টাকা,সরকারি ভূমি,নদীর পাড়,রাস্তার গাছ,বনভূমিসহ বড় বড় অংকের সরকারি সম্পদ।এসব চোর-ডাকাতদের হাতে রাজনীতি,মন্ত্রীত্ব,প্রশাসনে কর্তাগিরি,শিক্ষাকতা,কনসাল্টেন্সী পরিণত হয়েছে চুরি-ডাকাতির হাতিয়ারে। সরকারি প্রশাসনে লোক-নিয়োগ,কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-নিয়োগ,আদালতে বিচারক নিয়োগ,সরকারি স্কুল কলেজে ছাত্রভর্তি ও হাটবাজারের ইজারাদারিসহ অর্থ-উপার্জনের সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রগুলো পরিণত হয়েছে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ারে।পিঁপড়া যেমন কোথায় গুড়ের হাঁড়ি সেটি খুঁজে বের করে,এরাও তেমনি খুঁজে বের করে কোথায় অর্থভাণ্ডার। ফলে সরকারি তহবিলের অর্থ যেখানে যত বেশী,সেখানে তত ভিড় এসব চোর-ডাকাতদের। এজন্যই প্রচণ্ড ভিড় বেড়েছে দেশের রাজনীতির অঙ্গণে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো ভড়ে গিছে রাজনৈতীক ক্যাডারে।অথচ রাজনীতির ময়দানে এত ভিড় যেমন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে ছিল না,তেমনি পাকিস্তান আমলেও ছিল না। সম্প্রতি এরা বিশ্বব্যাংকের অর্থেও হাত দিয়েছিল।

 

দেশ অধিকৃত চোর-ডাকাতদের হাতে

বাংলাদেশের রাজনীতি,প্রশাসন ও অর্থনীতি যে চোর-ডাকাতদের দখলে -সেটি কোন নতুন বিষয় নয়।তবে সে দখলদারি যে কতটা প্রবল সেটিই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ট্রান্সপেরান্সি ইন্টারনেশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর গবেষকগণ তাদের এক সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল থেকে।গবেষণার উপাত্ত সংগৃহীত হয়েছে ১৪৯ জন সংসদ-সদস্যের কার্যকলাপ থেকে। প্রমাণ মিলেছে সংসদ-সদস্যদের ৯৭ শতাংশই ‘নেতিবাচক কাজের’ তথা রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী বা ক্ষতিকারক কর্মের সাথে জড়িত। এর অর্থ দাঁড়ায়,এই হারে যদি অন্য সদস্যগণও কুকর্ম করে তবে তবে ৩৪৫ জন সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৩৩৭ জনই কোন না কোন অপরাধ কর্মের সাথে জড়িত! টিআইবির দেয়া তথ্য মতে এমপিদের এসব অপরাধ-কর্মের মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক কাজে প্রভাব-বিস্তার,সরকারি অফিসে লোক নিয়োগে অর্থগ্রহণ,অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রভর্তিতে অর্থগ্রহণ,অর্থভাণ্ডারের উপর নিয়ন্ত্রন,উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ,হত্যা,জমিদখল,চাঁদাবাজী,টেন্ডারবাজী,প্রতারণা,সরকারি কেনাকাটায় প্রভাব-বিস্তার, নির্বাচনী আইন লংঘন,মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লটবরাদ্দ পাওয়া ইত্যাদী। এমপিদের ৮১ শতাংশ প্রশাসনিক কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহন এবং নিয়োগ বদলীর ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেন। উল্লেখ্য হলো,এমপিদের এসব কুকর্মের স্বাক্ষী দিয়েছেন তাদের নিজ নিজ এলাকার লোকজন। হলমার্কের হাতে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা চুরি হওয়ার ঘটনায় মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে। স্তম্ভিত হয়েছে ডেস্টিনীর হাতে বহু হাজার কোটি টাকা লুন্ঠিত হওয়ায়। স্তম্ভিত হয়েছে দেশের শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ায়। কিন্তু সংসদ-সদস্যদের যে অপরাধগুলি প্রকাশ পেল তা কি কম জঘন্য?

লক্ষণীয় হলো,এমপিদের অপরাধকর্মগুলি রাষ্ট্রের জন্য যত ক্ষতিকারকই হোক,তা নিয়ে সরকারের মাথা ব্যাথা নেই। মাথাব্যাথা নেই পুলিশেরও। আদালতে তাদের নিয়ে কোন বিচার বসছে না। দূদকও তাদের পিছনে লাগেনি। চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবী –তারা যাই করুক না কেন সে জন্য সংসদ সদস্যদের কিছু বলা যাবে না। বিচারও করা যাবে না। অতীতে সংসদে সংসদ-সদস্যদের দ্বারা ডিপুটি স্পীকার শাহেদ আলীকে খুন হয়েছিলেন,কিন্তু তারপর আদালতে কোন কেস উঠিনি। পুলিশের খাতায় কোন কেস রেকর্ড হয়নি। রাজার শাসনামলে রাজাকে আদালতে তোলা যায় না। বাংলাদেশে তেমনি রাজা হয়ে দাড়িয়েছে সংসদের এমপিগণ। নিজ হাতে শাসনতন্ত্র তৈরী করে নিজেদের স্বার্থটি তারা আদায় করে নিয়েছে। ভাবটা এমন,তারা যেহেতু সংসদ-সদস্য,আইন তৈরীর ন্যায় আইন ভাঙ্গারও অধিকার তাদের রয়েছে। চুরিডাকাতির ন্যায় অপরাধগুলো যে তাদের কাছে কত তুচ্ছ সেটির প্রমাণ মিলিছে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার টাকা চুরি যাওয়ার পর অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য। তিনি বল্লেন,এটা কোন ব্যাপার নয়। কারণ,বাংলাদেশের বাজেট হাজার হাজার কোটি টাকার। অর্থমন্ত্রী সম্ভবতঃ বলতে চেয়েছেন,বাজেট যেহেতু বেড়েছে,চুরিডাকাতিও তেমনি বড় অংকের হবে। তাতে আবার আশ্চর্যের কি?

চোরডাকাত ধরার কাজটি সরকারের কাছে গুরুত্বহীন হওয়ায় পুলিশ,দূদক ও সরকারি উকিলগণও নির্জীব। তারা ব্যস্ত যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে সরকার-বিরোধীদের শাস্তি দিতে। ফলে চোর-ডাকাতগণ পেয়েছে পালাবার খোলা দরজা। তাই ডেস্টিনী নামক প্রতারক প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সাবেক সামরিক বাহিনীর প্রধান লে.জেনারেল (অবঃ) হারুনর রশিদ জামিন পেয়ে হাজত থেকে বেরিয়ে এসেছে। দেশে গরুচোর বা ছাগলচোরেরা জামিন পায় না,কিন্তু এসব বড় বড় চোরডাকাতদের জামিন পেতে বেগ পেতে হয়না। এভাবে এদের আইনের উর্দ্ধে রাখা হয়েছে।

ট্রান্সপেরান্সি ইন্টারনেশনালের প্রতিবেদন বলা হয়েছে,প্রায় ৭৭ শতাংশ সংসদ সদস্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসাবে ক্ষমতার অপব্যবহার,কমিটি নিয়ন্ত্রন,পছন্দের সদস্য নির্বাচন,শিক্ষক নিয়োগ নিয়ন্ত্রন,অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেয়া,কমিশনের বিনিময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি করানো,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বরাদ্দের অপব্যবহার ইত্যাদী দূর্নীতির সাথে জড়িত। উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার করেছেন সাড়ে ৭৫ ভাগ সংসদ সদস্য। সাড়ে ৭০ ভাগ সংসদ সদস্য খাসজমি দখল, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী ও প্রতারণার সাথে জড়িত। এদের অর্ধেকেরও বেশী নিজেরাই নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত। প্রায় ৭০ ভাগ সংসদ সদস্য জেলা পর্যায়ের সরকারি, স্বায়ত্বশাষিত ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। এদের মধ্যে প্রায় ৭২ ভাগ সংসদ সদস্য নিজের কিংবা আত্মীয় স্বজনের কিংবা অন্যের লাইসেন্স ব্যবহার করে ঠিকাদারি ব্যবসা পরিচালনা করেন। তাছাড়া দরপত্র কিনতে বা জমা দিতে বাধা দেওয়া, সমঝোতার মাধ্যমে কাজ বন্টনের সঙ্গে এরা জড়িত। ৬২ ভাগ সংসদ সদস্য নির্বাচনী আইন লংঘন করেন এবং সাড়ে ৮ ভাগ সংসদ সদস্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ নেয়ার সাথে জড়িত।

 

প্রায়োরিটি বিরোধী দল নির্মূল

রাজনৈতীক দলগুলোর শুধু চুরি-ডাকাতি নিয়ে ব্যস্ত নয়। চুরিডাকাতি আজীবন অব্যাহত রাখার সার্থে বিরোধীদের বেঁচে থাকার অধিকারও তারা হনন করে। সকল রাজাই যেমন আজীবন রাজা থাকতে চায়,স্বৈরাচারিরাও তেমনি চায় যে কোন রূপে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে। কারণ,রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে থাকলে চুরিডাকাতির যে মহাসুযোগ মিলে সেটি অন্য কোন ভাবে সম্ভব নয়।পুলিশ ও সেনাবাহিনী তখন তাদের পাহারাদার নওকরে পরিণত হয়। ক্ষমতায় থাকাটা আজীবনের জন্য নিশ্চিত করতেই শেখ মুজিব তাই একদলীয় বাকশাল গড়েছিলেন। শেখ হাসিনার সরকারও তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে রহিত করেছে। কারণ, সে বিধান থাকলে নির্বাচনে ইচ্ছামত চুরির কাজটি সহজ হয় না। রাজনৈতীক শত্রুদের নির্মূলে আওয়ামী লীগ যেমন অতীতে তাঁবেদার ক্যাডারবাহিনীর হাতে লগি-বৈঠা ও আগ্নেয় অস্ত্র তুলে দিয়েছে,তেমনি ক্ষমতায় গিয়ে শত্রুদমনে আদালতও বসিয়েছে। সেসব আদালতে চোর-ডাকাতদের স্থলে তোলা হয় রাজনৈতীক প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের। ফলে সরকারি ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারগণ তাই প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে ঘুরলেও সে অপরাধে কাউকে জেলে নেয়া হয়না। অথচ জেলে নেয়া হয় জিহাদ বিষয়ক বই রাখার অপরাধে। ফলে দেশে বাড়ছে রাজনৈতীক নেতাদের গুম ও  হত্যা।

স্বৈরাচারি সরকার শুধু জনগণকেই ক্ষমতাহীন করে না,ক্ষমতা কেড়ে নেয় আদালতের হাত থেকেও। তারা মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয় আদালতের বিচারকদের। আদালতের বিচারকগণ তখন পরিণত হয় স্বৈরাচারের লাঠিয়ালে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশগণ এমন অভিন্ন লক্ষ্যে ভারত জুড়ে যেমন ঠেঙ্গারে পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলেছিল,তেমনি প্রচুর আদালতও বসেয়েছিল। তাদের কাছে অপরাধ বিবেচিত হত জনগণের দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেম।দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেমের কারণে অনেককে তারা ফাঁসীর হুকুমও শুনিয়েছে। তখন পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সেপাইগণ ছিল লাইসেন্সধারি খুনি,তাদের হাতে নিরাপরাধ মানুষ খুন হলেও সে অপরাধে তাদের বিচার হতো না। বাংলাদেশেও আজ  একই অবস্থা ফিরে এসেছে। পত্রিকায় প্রকাশ,পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে ৫৩ জন বিডিআর সদস্য মারা গেছে। কোন সভ্য দেশে এটি কি আশা করা যায়? গত ৪ বছরে র‌্যাব হত্যা করেছে ৭৬৭ জনকে। (দৈনিক আমার দেশ,১২/১০/১২)। সন্ত্রাসীরা যেরূপ রাস্তাঘাটে মানব হত্যা করে,র‌্যাবও সেটিই করছে। সন্ত্রাসী খুনিদের বিরুদ্ধে বিচারের দাবী নিয়ে তবুও আদালতে যাওয়া যায়, কিন্তু র‌্যাবের খুনিদের বিরুদ্ধে সে নাগরিক অধিকার কারো নাই। এরা পরিণত হয়েছে লাইসেন্সধারি খুনিতে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শাসনের দিনগুলি তারা বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছে। গ্রামে গঞ্জে মানুষ খুন হলে তবুও তদন্ত হয়,পোষ্টমর্টেম হয়। এবং কেস আদালতে উঠে। কিন্তু পুলিশ বা র‌্যাবের হাতে এত মানুষ যে খুন হচ্ছে অথচ তদন্তের কোন বালাই নেই।দেশ পরিণত হয়েছে এক মগের মুল্লুকে।

 

নব্য রক্ষিবাহিনী এবং পুরাতন এজেণ্ডা

রাজনৈতীক বিরোধীদের নির্মূলে শেখ মুজিব রক্ষিবাহিনী গড়েছিলেন। মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। রক্ষিবাহিনীর হাতে বন্দী অবস্থায় সিরাজ সিকদার নিহত হয়েছিলেন,আর শেখ মুজব তাতে এতটা প্রসন্ন হয়েছিলেন যে সংসদে দাড়িয়ে দম্ভ ভরে বলেছিলেন,“কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?” আর সেখ হাসিনার আমলে নীরবে গুম হয়ে যাচ্ছে ইলিয়াসের ন্যায় অনেকেই। এখন রক্ষিবাহিনী শুধু একটি নয়,বহু। র‌্যাব,পুলিশ বাহিনী, ডিআইবি,এনএসআই -এমন কি সমগ্র প্রশাসন আজ শেখ হাসিনার সরকার রক্ষার রক্ষিবাহিনী। র‌্যাব,পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তা রূপে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে দলীয় কর্মী ও হিন্দুদের -যারা আওয়ামী শাসন টিকিয়ে রাখা এবং বিরোধী দলীয় কর্মীদের নির্মূলের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কর্মীদের চেয়েও বেশী আওয়ামী লীগার। কারণ আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সাথে জড়িত তাদের নিজেদের চাকুরিতে টিকে থাকার বিষয়টিও। পুলিশ বাহিনীর লোকেরা তাই সরকারের দুর্বলতা বুঝে। বুঝে,তাদের উপর সরকারের নির্ভরশীলতার বিষয়টি। ফলে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে পুলিশের মধ্যে চরম বেপরোয়া ভাব। সরকারকে নিরাপত্তা দেয়ার মূল্যটি আদায় করে নিচ্ছে দূর্নীতির মাধ্যমে সর্বভাবে অর্থ-উপার্জনের মধ্য দিয়ে। ফলে সরকার-বিরোধীদের পিঠানোর ক্ষেত্রে যেমন নির্মম,তেমনি তারা নির্মম হলো চাঁদা সংগ্রহে। শত শত কোটি চাঁদা তুলছে দেশের মাদকব্যাবসায়ী,জুয়ারি,কালোবাজারী,দেহব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের থেকে। বিনিময়ে অপরাধীদের অধিকার দিচ্ছে ইচ্ছামত অপরাধ কর্ম পরিচালনার। সে অধিকার পেয়েই দেহব্যবসায়ীরা শহরের সড়কে¸পার্কে,নদীর তীরে ও নদীবক্ষে পতিতাবৃত্তির অবাধ বাজার বসিয়েছে। সন্ত্রাসীরা অধিকার পাচ্ছে যথেচ্ছা সন্ত্রাসের।এবং কালোবাজারী লাইসেন্স পাচ্ছে দেশ জুড়ে মাদক দ্রব্যের প্লাবন সৃষ্টির। অবস্থা দাঁড়িয়েছে,দেশের সর্বত্র জুড়ে এখন অপরাধিদেরই দখলদারি।পুলিশ ও প্রশাসন এদের দেখেও না দেখার ভান করে। বরং চায়,অপরাধের ব্যাপক বিস্তার হোক। কারণ,যতই বাড়বে অপরাধীর সংখ্যা,ততই বাড়বে তাদের চাঁদার অংক। পুলিশ ও প্রশাসনের চাঁদা দিলে কোন অপরাধই আর অপরাধ থাকে না। খুন,ধর্ষণ,দেহব্যাবসা ও কালোবাজারীর ন্যায় অতি অপরাধ কর্মও তখন হালাল হয়ে যায়। অপরাধ কর্ম হালাল হয়ে যায় সরকারি দলের ক্যাডার হলেও। কোন কুকর্মই তখন আর নিষিদ্ধ থাকে না। জঘন্য অপরাধ কর্মগুলি তখন উৎসব ভরে হয়। ধর্ষনে সেঞ্চুরির উৎসবও তখন অপরাধ রূপে গণ্য হয় না।সেরূপ ঘৃণ্যকর্ম জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ছাত্রলীগের ক্যাডার দ্বারা সংঘটিত হলেও পুলিশ সে উদ্ধত অপরাধীদের গ্রেফতার করেনি।

 

চোর-ডাকাতদের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ

বাংলাদেশের ইতিহাসে লোমহর্ষক যত বীভৎস ঘটনা ঘটেছে,সেগুলি দেশের ছিঁছকে চোর-ডাকাত বা অপরাধিদের হাতে ঘটেনি। ঘটেছে ক্ষমতালোভি রাজনৈতীক চোর-ডাকাতদের হাতে। তারা ডাকাতির মাধ্যমে দখলে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় কুরসীর। সেটি শুধু সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নয়, তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমেও। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতীক দলগুলোর অতীত ইতিহাস আজ  আর গোপন বিষয় নয়। ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় গেলে যে কোন ভাবে সে ক্ষমতায় টিকেই তাদের রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য। এ নিয়ে কোন অস্পষ্টতা নেই। রাজনৈতীক প্রয়োজনে অতীতে ঢাকার রাস্তায় যেমন যাত্রীভতি বাসে আগুণ দেয়া হয়েছে,তেমনি হরতালের দিনে রিকসাচালকের মাথার উপর বোমাও ফেলা হয়েছে।হরতালের দিনে উলঙ্গ করা হয়েছে অফিসগামী পথচারিকে।ক্ষমতায় যাওয়ার প্রয়োজনে নিজে দেশে একাত্তরে ভারতীয় লুটেরা হানাদার বাহিনীকেও ডেকে এনেছে -যারা লুটে নিয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ও সম্পদ।এসবই বাংলাদেশের ইতিহাস।

১৯৭৪ সালে বহুলক্ষ মানুষের জীবননাশী যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নেমে আসে সেটিও কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নয়। ১৯৭১য়ের যুদ্ধের কারণেও নয়। বরং এ ভয়ানক দুর্ভিক্ষটিও রাজনৈতীক চোর-ডাকাতদের সৃষ্ট। পাকিস্তান সরকার একাত্তরে দেশকে তলাহীন করে ছেড়ে যায়নি। দীর্ঘকালীন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি স্বরূপ ভাণ্ডারে বহু অস্ত্র ও বহু অর্থও জমা করেছিল।কিন্তু সে অর্থ ও অস্ত্র সবই লুট হয়ে যায়। অথচ ১৯৪৭য়ের ১৪ই আগস্ট এর চেয়ে বড় দুর্যোগ ও দারিদ্র্যতা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৭১য়ে তো বাংলাদেশে সরকার তো অনেকগুলি বড় বড় সেক্রেটারিয়েট ভবন পেয়েছে,বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংসদ ভবনও পেয়েছে। রেডিমেট প্রেসিডেন্ট ভবন,কয়েকটি প্রধানমন্ত্রী ভবন ও সুপ্রিম কোর্ট ভবনও পেয়েছে। দুটি সামদ্রিক বন্দরও পেয়েছে। প্রশস্ত্র কিছু রাস্তাঘাট ও কয়েক শত বড় বড় কলকারাখানাও পেয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিলও পেয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে এসব কিছুই ছিল না। একটি পাটকল বা একটি সামুদ্রিক বন্দরও ছিল না। তখন সেক্রেটারিয়েট বসতো টিনের ঘরে। একাত্তরের পর বিদেশ থেকে শত শত কোটি টাকার সাহায্যও এসেছে। কিন্তু ১৯৪৭য়ে স্বাধীনতা লাভের পর সে সাহায্য আসেনি। বরং অখণ্ড ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় কোষাগারের রিজার্ভ থেকে যা পাওনা ছিল দিল্লি সরকার সেটিও দেয়নি। বরং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে ঠেলে দিয়েছিল লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মুসলিম উৎবাস্তুদের। নিরাশ্রয় সে মানুষদের জন্য পাকিস্তান সরকারকে সেদিন বহু লক্ষ ঘরবাড়ি বানাতে হয়েছিল। কিন্তু এত কিছুর পরও সেদিন দেশে দুর্ভিক্ষ আসেনি। বিদেশের কাছে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির খেতাবও জুটেনি –যেমনটি জুটেছিল মুজিব আমলে। কারণ,দেশে তখন রাজনৈতীক  চোর-ডাকাতদের এত উপদ্রব ছিল না। কৃষকের ঘরে ফসলের পরিমাণ যত বেশীই হোক তার উপর যদি দিবারাত্র ডাকাতি হয় তখন ভিক্ষার থলি নিয়ে রাস্তায় নামা ছাড়া কি কোন উপায় থাকে? মুজিবী শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থভাণ্ডারের উপর তেমনি লাগাতর ডাকাতি হয়েছে। এক পাল ক্ষুদার্ত নেকড়ের মুখে কোন ভেড়া পড়লে যেমন হয় সেদিন তেমনি অবস্থা হয়েছিল বাংলাদেশের। লাগাতর সে ডাকাতির ফলেই বাংলাদেশে সেদিন ভয়ানক দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল এবং লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যুও হয়েছিল।আজও সেই একই রূপ হিংস্রতা নিয়ে চোর-ডাকাতগণ আবার রাস্তায় নেমেছে।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *