বাংলাদেশে দুর্বৃত্তশাসন ও জনগণের ব্যর্থতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 5, 2019
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
মিশন দুর্বৃত্তির বিজয়!
কোন দেশে সবচেয়ে ভয়ংকর বিপর্যয়টি মহামারি,ঘূর্ণিঝড়,অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি বা সুনামীতে ঘটে না। এরূপ দুর্যোগের কারণে কোন দেশ বিশ্বজুড়ে কলংকিত বা অপমানিতও হয় না।কারণ,এমন বিপর্যয়ের জন্য দায়ী জনগণ নয়। বরং দেশবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ও সবচেয়ে বড় অপমানটি আসে রাষ্ট্র ও সমাজ চোর-ডাকাত,খুনি ও দুর্বৃত্তদের দখলে যাওয়ায়। তবে দুর্বৃত্ত শাসনের অকল্যাণটি আরো ব্যাপক ও ভয়াবহ। তাদের শাসনে শুধু যে সামাজিক সুখশান্তি ও জানমালের নিরাপত্তা বিপন্ন হয় তা নয়, বরং সবচেয়ে বড় বিপদটি ঘটে পরকালে। দুর্বৃত্ত শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ ও সে শাসনের সাথে সহযোগিতা যেটি অনিবার্য করে সেটি হলো জাহান্নাম। সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে জাহান্নামের উম্মুক্ত পথ নির্মাণই হলো এমন দুর্বৃত্ত শাসনের মূল প্রকল্প। চোর-ডাকাতদের হামলায় কিছু লোকের অর্থহানি বা প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু রাষ্ট্রের বুকে চোর-ডাকাতদের শাসন জেঁকে বসলে তাতে শুধু জনগণের অর্থহানি বা প্রাণহানিই ঘটে না, ঈমানহানি এবং সে সাথে জাহান্নাম প্রাপ্তি ঘটে কোটি কোটি মানুষের। তাই দুর্বৃত্ত শাসকদের দু্র্বৃত্তির চেয়ে অধিকতর গুনাহর কাজ যেমন নেই,তেমনি তাদের নির্মূলের চেয়ে অধিক ছওয়াবের কাজও নেই।
রাষ্ট্র ও সমাজের বুক থেকে দুর্বৃত্ত-নির্মূলের কাজটি প্রতি দেশে এবং প্রতি যুগে অতি কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। এটি হলো রাষ্ট্রবিপ্লব ও সভ্যতা নির্মাণের কাজ। এতবড় বিশাল কাজটি কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি, রাজপথের মিছিল, কিছুদিনের হরতাল, টিভি টকশো, পত্রিকায় কলাম লেখার মধ্য দিয়ে সাধিত হয় না। এমন বিপ্লবে প্রাণহানি ঘটে হাজার হাজার মানুষের। সামান্য চোর ধরতে হলেও চোরের পিছনে বহুপথ দৌড়াতে হয়। ডাকাত ধরতে হলে তো তার সাথে অস্ত্রহাতে যুদ্ধে নামতে হয়। সে কাজে প্রাণ যাওয়ার সম্ভাবনাও কি কম? বেতনের লোভে বা স্রেফ চাকুরি বাঁচাতে কেউ কি এমন কাজে প্রাণ দেয়? তাই নিছক বেতনভোগীদের হাতে কোন কালেই দুর্বৃত্ত-নির্মূল হয়নি। উচ্চতর সভ্যতাও নির্মিত হয়নি। বরং এক দল দুর্বৃত্তদের হটিয়ে তখন আরেক দল নতুন দুর্বৃত্ত ক্ষমতায় বসে। নির্মিত হয় নতুন সাম্রাজ্য, উপিনিবেশবাদের মত নতুন দুর্বৃত্তশাসন। তখন প্রচুর প্রাসাদ, অফিস-আদালত, দুর্গ, সামরিক ছাড়নি ও কল-কারখানা গড়ে উঠলেও উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধ ও সভ্যতা নির্মিত হয় না ।
রাষ্ট্রের বুক থেকে চোর-ডাকাত ও দুর্বৃত্ত নির্মূলের কাজে প্রয়োজন পড়ে লাগাতর এক যুদ্ধের। ইসলামে এমন যুদ্ধকে বলা হয় জিহাদ। এমন জিহাদে প্রয়োজন পড়ে হাজার হাজার মোজাহিদের। সে পবিত্র জিহাদে মুজাহিদ সংগ্রহে মহান আল্লাহতায়ালা তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। সে চুক্তিনামাটি হলো মু’মিনদের থেকে জান্নাতের মূল্যে জানমাল ক্রয়ের। বিনিময়ে তারা যুদ্ধ করে দুর্বৃত্ত নির্মূলের জিহাদে। পবিত্র কোর’আনে বর্ণিত সে পবিত্র চুক্তিনামাটি হলো এরূপঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। (শর্ত হলো) তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়,তারা (শত্রু) নিধন করে এবং নিজেরাও নিহত হয়। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে এ বিষয়ে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আর প্রতিশ্রুতি পালনে আল্লাহ অপেক্ষা আর কে বেশী সাচ্চা? তোমরা আল্লাহর সাথে যে চুক্তি করেছো তার জন্য আনন্দ প্রকাশ করো। এর মধ্যেই তো মহা সাফল্য।” –(সুরা তাওবা, আয়াত ১১১)। ঈমানদার হওয়ার শর্ত তাই শুধু মহান আল্লাহতায়ার অস্তিত্বে ও তাঁর নবী-রাসূলে বিশ্বাসী হওয়া নয়। স্রেফ নামাযী,রোযাদার, হাজী বা যাকাত দানকারি হওয়াও নয়। বরং মহান আল্লাহতায়ালার কাছে নিজের জানমালের বিক্রয়ে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। মহান আল্লাহতায়ালা তো এমন চুক্তিবদ্ধদেরই জান্নাত দানে চুক্তিবদ্ধ। এমন চুক্তিবদ্ধ মু’মিনদের জীবনে তখন শুধু নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত আসে না। পবিত্র জিহাদ এবং সে জিহাদে শাহাদতও আসে। নবীজী (সাঃ) র সাহাবাগণ তো সে চুক্তিবদ্ধ মু’মিনদের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তাদের কারণে জিহাদের ময়দান সেদিন মুজাহিদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে উঠতো। নবীজী (সাঃ) র কি এমন কোন সাহাবা ছিলেন যিনি জিহাদের ময়দানে হাজির হননি? ফলে সমাজ থেকে নির্মূল হয়েছে দুর্বৃত্তশাসন ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পরিপূর্ণ ইসলামি শাসন।
যে ব্যর্থতাটি প্রকট
প্রতিটি মুসলিম জনপদে মসজিদ বেড়েছে, মাদ্রাসাও বেড়েছে। বিপুল ভাবে বেড়েছে নামাযী, রোযাদার ও হাজীদের সংখ্যাও। কিন্তু বাড়েনি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে নিজের জানমালের বিক্রয়ে চুক্তিবদ্ধ মুজাহিদদের। ফলে মুসলিম রাষ্ট্রের বুক থেকে নির্মূল হয়নি ইসলামের দুশমনদের দখলদারি। এমন দখলদারির মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে একটি দেশের জনগণের সার্বিক অযোগ্যতা, কাপুরষতা ও নীতিহীনতা। জনগণের চারিত্রিক,নৈতীক ও ঈমানী ব্যর্থতা তখন আর গোপন থাকে না। নানারূপ পাপাচার ও অশান্তিতে পূর্ণ হয় তখন রাষ্ট্র। জনগণের চারিত্রিক বল কখনই চাষাবাদ, গৃহনির্মাণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ধরা পড়ে না। ধরা পড়ে না মশামাছি নির্মূল বা হিংস্র পশু হত্যার মধ্য দিয়েও। বরং সেটি ধরা পড়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের বুক থেকে চোর-ডাকাত, খুনি তথা মানবের বেশধারি দুর্বৃত্তদের নির্মূল করার মধ্য দিয়ে। একমাত্র তখনই রাষ্ট্র বা সমাজ সভ্যতর হয়। কোন শহরের রাস্তা দিয়ে দিনে-দুপুরে যদি বাঘ-ভালুক চলাফেরা করে ও যত্রতত্র হামলা হয় তবে বনজঙ্গল থেকে সে শহরটির পার্থক্য কোথায়? দেশের উপর যদি চোর-ডাকাত, খুনি ও সন্ত্রাসীদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা পায় ও বিলুপ্ত হয় আইনের শাসন, সে দেশকে কি তখন সভ্য দেশ বলা যায়?
দুর্বৃত্ত-নির্মূলের কাজটি ইসলামে পবিত্র ইবাদত। এমন কাজে সুস্পষ্ট নির্দেশ এসেছে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। ইসলামে এটি ফরজ। রয়েছে পবিত্র জিহাদের মর্যাদা। বস্তুত সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্বৃত্ত-নির্মূল কর্মের মধ্য দিয়ে যাচাই হয় মুসলমানদের প্রকৃত ঈমানদারি।এমন ফরজ কাজে মু’মিন ব্যক্তিদের শহীদও হতে হয়।নবীজী (সাঃ)র সত্তর ভাগের বেশী সাহাবীকে জীবন দিতে হয়েছে একাজে। দুর্বৃত্ত-কবলিত ও পাপাচারে পূর্ণ আরবের বুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে তো সে কোরবানীর ফলে। তাদের সে জিহাদে সাফল্য দিতে মহান আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবী পৃষ্ঠে ফেরশতাদের বাহিনী পাঠিয়েছেন। রাষ্ট্রে দুর্বৃত্ত নির্মূলের এ জিহাদটি না হ’লে রাষ্ট্র তখন পাপাচারে পূর্ণ হয়ে হঠে। সভ্য সমাজ নির্মূলের বদলে দেশ তখন রেকর্ড গড়ে পাপাচার ও দুর্বৃত্তিতে। বাংলাদেশের মত দুর্বৃত্তকবলিত দেশতো সে রেকর্ডই বার বার গড়েছে।
পালিত হয়নি যে পবিত্র মিশন
মহান আল্লাহতায়ালার কাছে দুর্বৃত্ত নির্মূলের কর্মটি যে অতি গুরুত্বপূর্ণ,পবিত্র কোরআনে সেটিই বার বার প্রকাশ পেয়েছে। সমাজ থেকে দুর্বৃত্তদের দল ও তাদের প্রতিষ্ঠিত মিথ্যা ও দুর্বৃত্তি নির্মূল না হলে সে সমাজে সত্যদ্বীন বাঁচে না। পৃথিবীপৃষ্ঠে লক্ষাধিক নবীরাসূল এসেছেন। কিন্তু এরূপ দুর্বৃত্তদের কারণে তাদের প্রচারিত সত্যদ্বীন বার বার হামলার মুখে পড়েছে। মু’মিনের জীবনে মূল মিশনটি হলো সত্যকে বাঁচিয়ে রাখার কাজে অংশ নেয়া। কোরআন-হাদীসের জ্ঞানার্জন ও নামায-রোযার ন্যায় ইবাদত পালনের মূল লক্ষ্য তো মু’মিনের জীবনে সে মিশনে অংশ নেয়ার সামর্থ বাড়ানো। বিনিময়ে পরকালে জুটে জান্নাত। পবিত্র কোরআনে সে প্রতিশ্রুতিটি এসেছে বার বার। যেমন বলা হয়েছেঃ “তাদেরকে যখন আমরা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি তখন তারা নামায কায়েম করে, যাকাত দান করে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং দুর্বৃত্ত কর্মকে প্রতিরোধ করে। এবং সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারে।” –(সুরা হাজ্জ, আয়াত ৪১)। দুর্বৃত্ত নির্মূলের সে মহান ইবাদতকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,“তোমাদের মধ্যে অবশ্যই একটি দল থাকবে যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং অসৎ কাজ রুখবে। এরাই হলো সফলকাম।”–(সুরা আল-ইমরান আয়াত ১০৪)। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পেলে মুসলমানগণ তাই শুধু রাস্তাঘাট, হাসপাতাল বা কলকারখানা গড়ে না। তারা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকে এবং সে সাথে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূল ঘটায়। তাই মুসলমানগণ শুধু নামায-রোযা,হ্জ্জ-যাকাতের মধ্যে নিজেদের ধর্মকর্মকে সীমিত রাখে না। শুধু মসজিদ-মাদ্রাসাই গড়ে না। স্রেফ সেগুলির মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার উপরুক্ত ফরমান পালিত হয় না।এ জীবনে সফল হওয়ার পথও সেটি নয়। বরং মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে সফলতার পুরস্কারটি জুটে সৎ কাজের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলে আমৃত্যু অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে। মুসলমানদের জীবনে সে মহান কর্মটি মিশন রূপে প্রতিষ্ঠা পেলে সে সমাজ ও রাষ্ট্র দুর্বৃত্তদের দখলে যায় না। বরং সে সমাজ তখন আরো পবিত্রতর ও সভ্যতর রূপে গড়ে উঠে।
কিন্তু বাংলাদেশের ন্যায় বহু মুসলিম দেশে মহান আল্লাহতায়ালার উপরুক্ত কোরআনী হুকুম আদৌ পালিত হয়নি। অন্যায়ের নির্মূল ও ন্য্যায়ের প্রতিষ্ঠা সরকারি নীতি রূপে আদৌ প্রতিষ্ঠা পায়নি। বরং হচ্ছে উল্টোটি। নিজেদেরকে মুসলমান রূপে পরিচয় দিলেও বিপুল সংখ্যক মানুষের শ্রম, মেধা,অর্থ ও রক্তের বিনিয়োগ হচ্ছে অন্যায়ের প্রতিষ্ঠায়, পাপের প্রসার ও সত্যের নির্মূলে।রাজনীতির অঙ্গণে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান শরিয়তের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে সে লক্ষ্যে শুধু যে রাজনৈতীক দল গড়া হয় তা নয়, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী ও বিচারালয়ও গড়া হয়। গুম, নির্যাতন ও হত্যার ন্যায় অন্যায় কাজে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। রাজনৈতীক প্রতিপক্ষকে হত্যার কাজে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আদালতের বিচারকদেরও কাজে লাগানো হয়। তাদেরকে ব্যবহার করা হয় এমন কি গণতন্ত্র হত্যার ন্যায় স্বৈরাচারি ষড়যন্ত্রকে জায়েজ করতেও। নির্বাচনের নামে প্রহসন হয় স্রেফ রাষ্ট্রের উপর দখলদারি প্রতিষ্ঠায়। আদালতের বিচারকগণ তখন ভোট ডাকাতিকেও বৈধ নির্বাচন রূপে প্রতিষ্ঠ দেয়।জনগণের অর্থ, শ্রম ও ভোটে এভাবে যখন দুর্বৃত্তদের বিজয়ী করা হয় এবং প্রতিহত করা হয় মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠা তখন কি সে সমাজে কি শান্তি আসে? তাতে বরং যা অনিবার্য হয় সেটি হলো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন আযাব।
দখলদারি চোর-ডাকাতদের
বহু শত বছর আগে বাংলাদেশে মায়ানমারের বর্গিদের ভয়াবহ হামলা হতো। তারা গ্রামের পর গ্রাম নিঃস্ব করে লুন্ঠিত সম্পদ নিয়ে সমুদ্র পথে নিজ দেশে ফিরে যেত। সুদূর ইউরোপ থেকে এসেছিল পর্তুগীজ জলদস্যুরা। এসেছে মারাঠা। লুন্ঠনে তাদের নৃশংসতাও ছিল লোমহর্ষক। এরপর আসে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশেররা। ডাকাতদের একমাত্র লক্ষ্য যেমন গৃহস্বামীর ঘরে লুটপাট। তেমনি ঔপনিবেশিক শাসনেরও একমাত্র লক্ষ্য শোষন। বাংলার বুক থেকে ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হলেও দুর্বৃত্তদের দখলদারি আজও শেষ হয়নি। বিদেশী দুর্বৃত্তদের বদলে দখলদারিদটা এখন দেশী দুর্বৃত্তদের। শুধু মানচিত্র ও পতাকা পাল্টে গেছে মাত্র। বাঘ-ভালুকের ন্যায় হিংস্র জানোয়েরা যে বনেরই হোক, হিংস্রতায় কোন পার্থক্য হয় না। তেমনি অভিন্ন নাশকতা বিদেশীদের ন্যায় দেশী দুর্বৃত্তদেরও। বাংলার ইতিহাসে দুর্ভিক্ষ হয়েছে তিনবার। প্রথম দুইবার ব্রিটিশদের আমলে এবং তৃতীয়বার মুজিবের আমলে। ব্রিটিশদের সীমাহীন লুটে বাংলা ১১৭৬ সনে দেখা দেয় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। বাংলার ইতিহাসে সেটিই হলো ছিয়াত্তরের মনন্তর। বাংলার বহুলক্ষ মানুষ তখন না খেয়ে মারা গিয়েছিল। দ্বিতীয় বার এসেছিল ১৯৪৩ সালে। তখনও বহু লক্ষ মানুষের প্রাননাশ ঘটেছিল। তৃতীয়বার দুর্ভিক্ষ এসেছিল ১৯৭৪ সালে মুজিবামলে। বহুলক্ষ মানুষ তখন মারা গিয়েছিল বাঙালী ডাকাতদের হাতে দেশ সরকারিভাবে অধিকৃত হওয়ায়। লক্ষণীয় হলো, দেশের বেসরকারি চোর-ডাকাতগণ যতই উৎপাত করুক তাদের হাতে কোন দেশেই দুর্ভিক্ষ আসে না।লাখ লাখ মানুষও মারা যায় না। কাউকে তখন কাপড়ের অভাবে মাছধরা জাল পড়তে হয়না। কারণ তাদের ডাকাতিতে সমগ্র সরকারি প্রতিষ্ঠান লিপ্ত হয় না। বরং পুলিশ তখন সাধ্যমত ডাকাতি থামায়। আদালতও তখন বহু ডাকাতদের শাস্তি দেয়। কিন্তু ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয় রাজনীতির নামে গড়ে উঠা ডাকাত দলের দখলে রাষ্ট্র গেলে। তখন পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত ও প্রশাসনও ডাকাতিতে লিপ্ত হয়। সেটি যেমন ব্রিটিশদের সাম্রজ্যবাদি শাসনামলে হয়েছিল,তেমনি হয়েছিল মুজিব আমলেও। সমগ্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তখন চুরিডাকাতির হাতিয়ারে পরিণত হয়।
ডাকাতদের বড় অস্ত্রটি হলো জনমনে ত্রাস বা ভয় সৃষ্টি। কারণ অতি ভয় মানুষকে প্রতিরোধহীন করে। সেরূপ ত্রাস সৃষ্টিতে তারা শুধু অর্থলুটই করে না,নির্মম ভাবে মানব হত্যাও করে।ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগও করে। এভাবে কেড়ে নেয় জনগণের প্রতিরোধের সাহস। ফলে নিষ্ঠুর বর্গি ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের হাতে বাংলায় বহু মানুষের প্রাণনাশ হতো। ঘরবাড়িও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতো। মানুষ তখন ধনসম্পদ ফেলে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতো। সে বিদেশী ডাকাতদের হাত থেকে সাধারণ মানুষদের বাঁচাতে বাংলার মোগল সুবেদার মুর্শিদ কুলিখানকে তার বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে দীর্ঘকাল যুদ্ধ করতে হয়েছে।যুদ্ধ করতে হয়েছিল আলিবর্দি খাঁকেও। সে পুরনো আমল বাংলাদেশে আবার ফিরে এসেছে। এবারের ডাকাতেরা দেশী হলেও পুরনো বর্গিদের থেকে তাদের নিষ্ঠুরতাও কম নয়। এসব দেশী বর্গিরা লগিবৈঠা নিয়ে মানুষ খুন করে রাজধানীর রাজপথে। মানুষ খুন ও ঘরবাড়িতে আগুন দিতে তারা গ্রামেগঞ্জে নেমেছে। বার্মীজ বর্গি, মারাঠী ডাকাত ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের হাতে বুলডোজার ছিল না, মেশিনগাণও ছিল না। কিন্তু বাঙালী দস্যুদের তা আছে। দেশের বহু শহর ও বহু গ্রাম এখন তাদের হাতে ধ্বংসপুরী। তাদের হাতে মানুষ লাশ হচ্ছে, ঘরবাড়ি লুন্ঠিত হচ্ছে এবং লুন্ঠন শেষে ভস্মিভূতও হচ্ছে।
বাংলাদেশের মানুষের বড় বিপদ, এ দেশী ডাকাতদের ডাকাতি ঠ্যাকাতে দেশে মুর্শিদ কুলি খান নেই। কোন রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীও নেই। বরং সরকারি দলের নেতাকর্মী ও মন্ত্রীগণ নিজেরাই পরিনত হয়েছে ডাকাত সর্দারে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে র্যাব, বিজেবী, পুলিশবাহিনী ও সেনাবাহিনী।মানব সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠা হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে সামরিক বাহিনী,পুলিশ বাহিনী, আদালত, অর্থভান্ডার, প্রশাসন, প্রচার মাধ্যমের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুণি যখন চোর ডাকাতদের হাতে অধিকৃত হয় তখন রাষ্ট্রের সকল সামর্থ ব্যয় হয় চুরিডাকাতির কাজে। তখন সাধারণ মানুষের অর্থভান্ডারই শুধু নয়, হামলার মুখে পড়ে তাদের জানমাল ও ইজ্জত আবরুও। ফলে এক দিকে যেমন মানুষ খুন ও ধর্ষণ বেড়েছে,তেমনি লুট হয়ে যাচ্ছে সরকারি প্রকল্প ও সরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা। আর সে লুটের মালে আকাশচুম্বি জৌলুস বাড়ছে দুর্বৃত্তদের।
জিম্মি দুর্বৃত্তদের হাতে
ডাকাতগণ এখন আর আগের মত ডাকাত দল গড়ে না। তারা বরং প্রবল প্রতাপ নিয়ে বেঁচে আছে রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে। এতে সুবিধা হয়,ডাকাতি করতে গ্রামে-গঞ্জে নামতে হয় না। তখন ইচ্ছামত ডাকাতি করতে পারে সরকারি ব্যাংক,রাষ্ট্রীয় কোষাগার,সরকারি টেন্ডার,সরকারি ভূমি,রাস্তার সরকারি গাছ,শেয়ার বাজার এসবের উপর।বিনাশ্রমে হাজার হাজার কাটি টাকা লুন্ঠন করাও তখন সহজ হয়ে পড়ে। শুধু রাজনৈতীক দলগুলিই নয়, সমগ্র দেশ জিম্মি এসব চোর-ডাকাত-দুর্বৃত্তদের হাতে। ফলে দেশের রাজস্ব ভান্ডার,শেয়ার মার্কেট ও সরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ডাকাতি হয়ে গেলেও কারো কোন বিচার হয়না। কারো কোন শাস্তিও হয় না। কারন দলীয় ডাকাতদের শাস্তি দেয়া ডাকাতদলের সংস্কৃতি নয়। বরং পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর মূল কাজটি হয়েছে সরকারি ডাকাতদের গদি,ঘর বাড়ি ও ডাকাতির সম্পদ পাহারা দেয়া।ডাকাতদের চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো,তাদের সম্পদ ও জৌলুসের দিকে তাকানো। কারণ অর্থ-সম্পদ ও জৌলুস কখনোই মিথ্যা বলে না। টাকা-পয়সা আকাশ থেকে পড়ে না, মাটি ফুঁড়েও বেরুয় না।যাদের বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য নাই, বড় কোন চাকুরি নাই, পিতার জমিদারিও নাই -এমন ব্যক্তি যদি কোটি কোটি টাকার মালিক হয় বা হঠাৎ বিশাল ব্যবসা শুরু করে তখন কি বুঝতে বাঁকি থাকে যে,সে অর্থ নিশ্চয়ই চুরি-ডাকাতির? এ সহজ বিষয়টি বুঝতে কি বিদ্যাবুদ্ধি লাগে? কিন্তু দেশের পুলিশ. প্রশাসন ও আদালত তা নিয়ে ভাবে না, তদন্তও করে না। ডাকাতেরা এজন্যই সরকারি দলে যোগ দেয়। তাতে যেমন উপার্জন বাড়ে,তেমনি নিরাপত্তাও বাড়ে। সমগ্র প্রশাসন তখন আজ্ঞাবহ সেবকে পরিণত হয়। এসব ডাকাতেরা তখন রাজনৈতিক নেতা, এমপি ও মন্ত্রী সাজে। পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিগণও তখন এসব ডাকাতদের মাননীয় বলে এবং বিনয় ভরে কুর্ণিশও করে। এসব ডাকাতেরা মুজিবের আমলে যেমন প্রচুর লুটেছে,তেমনি আজও লুটছে এসব ডাকাতেরা বিশ্বব্যাংকের অর্থেও হাত দিয়েছিল। আর সে কারণে বাতিল হয়ে গেল পদ্মা সেতুর নামে বিশ্বব্যাংকের বরাদ্দকৃত ঋণ। সৎভাবে চাকুরি-বাকুরি ও ব্যাবসা বানিজ্য করে সারা জীবনেও সম্পদের দ্বিগুণ করা যায় না। কোন রূপে পেটে ভাতে বাঁচতে, পরিবারের চিকিৎসায় ও সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষায় প্রায় সবই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ডাকাতদের সম্পদ রাতারাতি বাড়ে। ঘর থেকে শূণ্য হাতে বেরিয়ে বহু কোটি টাকা নিয়ে তারা ঘরে ফেরে।
যে বিশাল ব্যর্থতা বাঙালী মুসলমানের
সুস্থ্য মানুষের দায়ভার শুধু বিষাক্ত পোকামাকড় ও হিংস্র জন্তু-জানোয়ারদের চেনা নয়, সমাজের চোর-ডাকাতদের চেনাও। মু’মিনের জীবনে সেটি এক ঈমানী দায়বদ্ধতাও। চেনার সে কাজটি সঠিক না হলে তাদের নির্মূলের ঈমানী দায়ভারটি কীরূপে পালিত হবে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুসলমানদের ব্যর্থতা বিশাল। চুরি-ডাকাতিতে যারা বাংলার ইতিহাসের সকল রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে তারাও বাংলাদেশে ভোট পায়। দেশবাসীর নেতা তথা ইমাম রূপেও তারা স্বীকৃতি পায়। গরুকে গরু বলাই বিবেকের দায়বদ্ধতা;সেটিকে হাতি,ঘোড়া বা অন্যজন্তু বলা নয়।তেমনি বিবেকের দায়বদ্ধতা হলো চোর-ডাকাতদের চোর-ডাকাত,স্বৈরাচারিকে স্বৈরাচারি ও বিদেশের দালালকে দালাল বলা। তাদেরকে নেতা, নেত্রী, বন্ধু ও জাতির পিতা বললে কি বিবেকের দায়ভার পালিত হয়? তেমনি রাজপথে মুসল্লি হত্যাকারি, সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা বিলোপকারি, জিহাদ বিষয়ক বই বাজেয়াপ্তকারি ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা বিরোধীকে কি মুসলমানদের নেতা বা নেত্রী বলা যায়? এমন ব্যক্তি তো শয়তানের খলিফা। এমন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের ইমাম মেনে নিলে কি ঈমানী দায়ভার পালিত হয়? ডাকাতদলে এমন চেতনা ও বিবেকবোধ থাকে না বলেই তারা সবচেয়ে বড় ডাকাতকে নিজেদের নেতা মেনে নেয়। অথচ মু’মিনের উপর ঈমানী দায়ভার তো হলো নবীজী (সাঃ)কে জীবনের চলার পথে প্রতি পদে আদর্শ রূপে অনুসরণ করা। এবং রাজনীতিতে তাদেরকে নেতা রূপে মেনে নেয় যারা নবীজী (সাঃ)র অনুসারি।
বাঙালী মুসলমানদের বড় ব্যর্থতাটি মূলত দারিদ্র্যতা নয়।সে ব্যর্থতাটি জ্ঞানের ভূবনে -বিশেষ করে চোর-ডাকাত ও দুবৃত্তদের চেনার ক্ষেত্রে। চেনার এ ব্যর্থতার কারণেই শাপ-শকুন,গরুবাছুর এবং মাটির মুর্তিও দেবতা রূপে পুজা পায়। একই রূপ ব্যর্থতার কারণে মানুষ ব্যর্থ হয় মহান স্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালাকে চিনতে ও তাঁর দ্বীনের পূর্ণ অনুসরণে। প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের হাতে প্রাসাদ ও তাজমহল নির্মিত হয়নি। কিন্তু তারা যেমন মহান আল্লাহতায়ালাকে চিনতে ভূল করেননি তেমনি ভূল করেননি দেশের দুর্বৃত্তদের চিনতেও। মানব জীবনের এটিই তো শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে কল্যাণকর সামর্থ। তাদের হাতেই নির্মিত হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।সে সভ্যতার মূল উপাদান ছিল চরিত্রবান মানুষ ও দায়িত্বশীল সরকার।তাদের আমলে সমগ্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি দাঁড়িয়েছিল সত্যের পক্ষে ও মিথ্যার বিরুদ্ধে। সরকারের প্রধান নিজেকে সার্বভৌম শাসক না ভেবে জনগণের সেবক গণ্য করতেন। তাঁরা কাজ করেছেন নবীজী (সাঃ)র খলিফা বা প্রতিনিধি রূপে। তাদের শাসনামলে জনগণ পেয়েছিল জীবনের সার্বিক নিরাপত্তা।পেয়েছিল মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত শরিয়তি আইনের শাসন। ফলে পেয়েছে সুবিচার ও সুশাসন। সমাজ থেকে তখন নির্মূল হয়েছিল দুর্বৃত্তদের প্রতিপত্তি এবং সর্বস্তরের মানুষ পেয়েছিল জান্নাতের সন্ধান। মহান আল্লাহতায়ালা আর কোন কালেই মানুষদের কর্ম ও আত্মদান নিয়ে এতটা খুশি হননি যা হয়েছেন নবীজী (সাঃ)র সাহাবীদের নিয়ে।
নবীজী (সাঃ)র উম্মত রূপে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে একটি দেশের জনগণ কতটা ব্যর্থ সেটি বুঝা যায় দেশের উপর চোরডাকাত ও খুনিদের দখলদারি কতটা প্রবল তা দেখে।তখন সম্মান বা বিজয়ের বদলে বিশ্বব্যাপী কলংক অর্জিত হয়।রুচিবান ভদ্র মানুষদের বড় পরিচয় হলো,ঘরের মাঝে আবর্জনা নিয়ে তারা বসবাস করে না। তেমনি রাষ্ট্রের আঙিনাতেও তারা চোর-ডাকাতদের বেড়ে উঠতে দেয় না। নইলে সমাজে পবিত্রতা আসে না। প্রতিটি মু’মিনের জীবনে এটি এক ঈমানী দায়বদ্ধতা।সভ্য মানুষের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি হয় নিজ রাষ্ট্রে বেড়ে উঠা দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। মুমিনের জীবনে এটিই তো প্রকৃত মিশন। এ মিশন জারি রাখার নামই জিহাদ। ইসলামে এটিই শ্রেষ্ঠ ইবাদত।এ ইবাদত পালনে অপরিহার্য হয় জানমালের বিপুল বিনিয়োগ।এ ইবাদতে ব্যয় হয় বিপুল অর্থ ও শহীদ হয় বহু মানুষ। মুসলিম ইতিহাসে যা কিছু গর্বের তার সিংহ ভাগ তো নির্মিত হয়েছে সে শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই। যে দেশে শহীদ নেই,সে দেশে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ও আসে না।মুসলমানের গৌরবও বাড়ে না।মুসলমানগণ তখন ব্যর্থ হয় বিশ্বমাঝে শ্রেষ্ঠ উম্মত রূপে বেড়ে উঠায়। বরং মুসলিম ভূমি তখন কলংকিত হয় দুর্বৃত্ত কবলিত রাষ্ট্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে।এরূপ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পরিণত হয় শয়তানের হাতিয়ারে। এমন রাষ্ট্রের মূল মিশনে পরিণত হয় ইসলামের প্রতিষ্ঠারোধ।তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো আজকের বাংলাদেশ।
মুসলমানের দায়ভারটি বিশাল।মু’মিনদের প্রতি মহান আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশ:“হে ঈমানদারগণ!তোমরা সুবিচারের প্রতিষ্ঠাকারি রূপে দাঁড়িয়ে যাও এবং আল্লাহর পক্ষে নিজেকে সাক্ষি রূপে পেশ করো –যদিও সে সাক্ষ্যটি তোমাদের নিজের বা তোমাদের পিতমাতা ও নিকটজনদের বিপক্ষে যায়;এবং সে দরিদ্র হোক বা ধনি হোক -আল্লাহই তাদের জন্য যথেষ্ট। অতএব সুবিচার প্রতিষ্ঠায় নিজ-প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। যদি তোমরা বক্রতা অবলম্বন করো বা পশ্চাৎপদ হও তবে নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তোমাদের সমস্ত কর্মের পূর্ণ খবর রাখেন।”–(সুরা নিসা,আয়াত ১৩৫)।অনুরূপ নির্দেশ দেয়া হয়েছে সুরা মায়েদায়,“হে ঈমানদারগণ!তোমরা আল্লাহর জন্য খাড়া হয়ে যাও,সুবিচারের জন্য সাক্ষি রূপে দাড়িয়ে যাও।”-(সুরা মায়েদা আয়াত ৮)। মুসলিম সমাজে তাই কাঙ্খিত হলো অন্যায় ও অবিচারের বিলোপ।প্রকৃত মুসলমান তাই শুধু জায়নামাযে খাড়া হয় না। বরং সে সর্বশক্তি দিয়ে খাড়া হয় মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে। এরূপ খাড়া হওয়ার কারণেই মহান আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিটি স্বীকৃতি পায় তাঁর নিজ দলের সৈনিক রূপে।সে দায়িত্বপালনে নিহত হলে পায় শহীদের মর্যাদা।এমন ব্যক্তি তার সমগ্র সামর্থ নিয়ে খাড়া হয় ও সাক্ষি দেয় সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং সুবিচারের পক্ষে।আল্লাহর পক্ষে খাড়া হওয়ার অর্থ,তাঁর শরিয়তি বিধানের পক্ষে খাড়া হওয়া। কারণ,শরিয়তে বিধান প্রতিষ্ঠা না পেলে কি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব? শরিয়ত ছাড়া রাষ্ট্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠা হতে পারে -সেটি বিশ্বাস করাই তো হারাম। সেটি বিশ্বাস করলে পরম অবিশ্বাস ও অবজ্ঞা করা হয় মহান আল্লাহতায়ালার কোরআনী বিধানের প্রতি।সেরূপ অবিশ্বাস ও অবজ্ঞার কারণে অবিশ্বাসী ব্যক্তিটি নিরেট কাফেরে পরিনত হয়।অথচ সে বিশ্বাস নিয়েই শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তাবত সেক্যুলারিস্টদের রাজনীতি।
ব্যর্থতা নির্দেশিত মিশন নিয়ে বাঁচায়
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা,“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত,তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য।তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং অন্যায় নির্মূল করো এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস করো.।”–(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১১০)।এটি হলো পবিত্র কোরআনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়াত। যে বিষয়টি এ আয়াতে গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো সুবিচারের প্রতিষ্টা ও অবিচারের মূলোৎপাটন। এতে ঘোষিত হয়েছে মুসলিম জীবনের ভিশন ও মিশন স্টেটমেন্ট। ভিশনটি হলো সর্বজাতির মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মতের মর্যাদা লাভ। আর সে ভিশন অর্জনে মু’মিনের জীবনে মূল মিশনটি হলো ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূল। ভিশন তো ব্যক্তির জীবনে এমন এক স্বপ্ন -যা অর্জনে সে তার সমগ্র সামর্থকে নিয়োজিত করে। আর মিশন হলো মূলত সে ভিশনে পৌছার কর্মকৌশল। আল্লাহ নির্দেশিত সে ভিশন ও মিশন নিয়ে বাঁচায় ঈমানদারের জীবনে কি করণীয় সেটিই ঘোষিত হয়েছে পূর্বে উল্লেখিত সুরা নিসার ১৩৫ নম্বর ও সুরা মায়েদার ৮ নম্বর আয়াতে। এ দুটি আয়াতে মহান আল্লাহর পক্ষে ও ন্যায় বিচারের প্রতিষ্ঠায় দাঁড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তাই যে দেশে ঈমানদারের সংখ্যা বাড়ে সেদেশে সুবিচারের প্রতিষ্ঠায় ও অবিচার নির্মূলে মোজাহিদদের সংখ্যাও বাড়ে। সেটি না হলে বুঝতে হবে প্রকৃত ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠায় সমস্যা রয়েছে। সমগ্র মানবকূলে মুসলমান যে শ্রেষ্ঠ তা তো সে মিশন পালনের বরকতেই। শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা বৃদ্ধির কারণে কি কোন দেশে সুবিচার প্রতিষ্ঠা পায়? সুবিচারের পক্ষে দাঁড়ানোর মুজাহিদও চাই। সৎকাজের নির্দেশ এবং অন্যায় কাজের নির্মূলে কারো আগ্রহ থাকলে ধর্মকর্মকে কি শুধু মসজিদ-মাদ্রাসায় সীমিত থাকে? তখন তো তার জীবনে অপরিহার্য হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গনে নামা।তখন অনিবার্য হয় মানব সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তথা রাষ্ট্রের উপর দখলদারি প্রতিষ্ঠা করা এবং সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে সুবিচারের প্রতিষ্ঠায় ও অন্যাযের নির্মূলে কাজে লাগানো। নবীজী (সাঃ) নিজে হাতে রাষ্ট্র গড়েছেন এবং রাষ্ট্র-প্রধান হয়েছিলেন তো এমন দায়িত্ববোধ নিয়েই। নবীজী(সাঃ)র সে সূন্নতটিকে শক্ত ভাবে ধরে রেখেছিলেন খোলাফায়ে রাশেদা।ফলে যাদের জীবনে রাজনীতি নেই এবং রাষ্ট্রের বুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগ্রহও নাই তারা আল্লামা বা আলেম সাজলেও আসলে তারা যে জাহেল ও নবীজী (সাঃ)র সূন্নত থেকে দূরে তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? অথচ বাংলাদেশে বহু আলেম,বহু নামাযী ও রোযাদার বেড়ে উঠেছে সে জাহিলিয়াত বা অজ্ঞতা নিয়ে।তাদের জীবনে তাই আল্লাহর দ্বীনের পক্ষে সাক্ষিদানে আগ্রহ নেই। আগ্রহ নেই শরিয়তের প্রতিষ্ঠায়।দেশের আদালতে শরিয়তি বিধান পরিত্যক্ত হলেও তাদের জীবনে তা নিয়ে মাতম উঠে না।বাংলার একটি জেলায় যত মসজিদ-মাদ্রাসা আছে নবীজীর আমলে বা সাহাবায়ে কেরামের আমলে সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রে তা ছিল না। কিন্তু সেদিন ইসলামের বিজয় এসেছিল। অথচ আজ বাড়ছে পরাজয় ও কলংক। কারণ,প্রতিটি মুসলমান সেদিন জানমাল নিয়ে খাড়া হয়েছিলেন মহান আল্লাহর শরিয়তি বিধান প্রতিষ্ঠায়। শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় সেদিন তারা নিজেদের জান-মালের বিপুল কোরবানীও দিয়েছিলেন।
দুর্বৃত্তশাসনের নির্মূল কীরূপে?
বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশে বেড়েছে মসজিদ-মাদ্রাসা,বেড়েছে নামাযী ও রোযাদারের সংখ্যাও।বেড়েছে হজ-ওমরা পালনকারিদের সংখ্যাও।কিন্তু বেড়েছে কি আল্লাহর পক্ষে মুজাহিদের সংখ্যা? জিহাদের ময়দান এদেশে ফাঁকা।মদিনার ক্ষুদ্র নগর থেকে যতজন মুজাহিদ ও শহীদ গড়ে উঠেছিলেন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বাংলাদেশে বিগত বহু যুগেও তা সৃষ্টি হয় নাই। ১৬ কোটি মুসলমানের দেশে জনগণ সুবিচারের পক্ষে দাঁড়ালে কি দেশ দুর্বৃত্তদের দখলে যেত? পরাজিত হতো কি শরিয়ত? রাজনীতিতে দখলদারি প্রতিষ্ঠা হতো কি চোর-ডাকাতদের? দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ বরং ভোট দিয়েছে,লাঠি ধরেছে ও রাজপথে নেমেছে জাতিয়তাবাদ,সেক্যুলারিজম,সমাজবাদ ও পাশ্চাত্যের কুফরি বিধানের প্রতিষ্ঠায়। সরকারি দল,সরকারের প্রশাসন,পুলিশ,র্যাব আদালত,রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীগণ দাঁড়িয়েছে আল্লাহাতায়ালা ও তাঁর শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠা রোধে। তারা সুস্পষ্ট পক্ষ নিয়েছে বরং শয়তান ও শয়তানি বিধানকে বিজয়ী করতে। সরকারের পক্ষ থেকে এ হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ। আর সে বিদ্রোহে অর্থ ও জনবল জোগাতে বাধ্য করা হচ্ছে জনগণকে। জনগণের রাজস্বে পালিত পুলিশ ও র্যাব বন্ধ করেছে কোরআনে তাফসির। নিয়ন্ত্রিত হয়েছে জুম্মাহর খোতবা দান। অথচ পুলিশ দিবারাত্র পাহারা দিচ্ছে ব্যাভিচার-পল্লি তথা পতিতাপল্লির। পাহারা দিচ্ছে কুফরি আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত আদালত ও সে আদালতের বিচারকদের। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যাগারিষ্ঠ একটি দেশে ইসলামের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে এরূপ প্রচেষ্ঠা হবে সেটি কি ভাবা যায়? ভারতের ন্যায় কাফের দেশেও সেটি হয় না। ইউরোপ আমেরিকাতেও হয় না। কারণ, শয়তানের মিশন কাফেরদের নতুন করে কাফের বানানো নয়। উলঙ্গ পাপীদের উলঙ্গ করাও নয়। শয়তান ও তার পক্ষের শক্তি তো চায় মুসলমানদের পথভ্রষ্ট করতে। বাংলাদেশে শয়তানী শক্তির দলবল ও বিনিয়োগ এজন্যই বিশাল।
চোর-ডাকাতদের হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ায় অসম্ভব হয়েছে সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। ফলে বাংলাদেশ আজ অন্যায়-অবিচার ও দুর্বৃত্তিতে পরিপূর্ণ। দুর্বৃত্তিতে সমগ্র বিশ্বে ৫ বার প্রথম স্থান দখলের প্রেক্ষাপট তো এটাই। প্রশ্ন হলো,দুনিয়াতে যাদের এরূপ লজ্জাজনক অর্জন,আল্লাহর দরবারেও কি তারা সম্মান আশা করতে পারে? রোজ হাশরের বিচার দিনে মহান আল্লাহতায়ালার সামনে দাঁড়ানোর সামান্য ভয় থাকলে কোন ঈমানদার কি নিজ দেশে চোর-ডাকাত ও খুনিদের এমন দখলদারি এবং আল্লাহর দ্বীনের এমন পরাজয় মেনে নিতে পারে? শয়তানদের দখলদারি এভাবে মেনে নেয়া কি মুসলমানের কাজ? নিজ ঘরে চোর-ডাকাত ঢুকলে মানুষ সর্ব সামর্থ দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। সেটি স্রেফ নিজের সম্পদ বাঁচাতে। কিন্তু অনন্ত অসীম কালের পরকাল বাঁচানোর দায়ভার তো বহুগুণ বেশী। মহান আল্লাহতায়ালার সৈনিক রূপে ঈমানদার ব্যক্তিকে তখন রণাঙ্গণে নামতে হয়। অধিকাংশ সাহাবী তো সে দায়ভার নিয়ে প্রাণদান করেছেন।
শয়তানি শক্তির শাসন কি কোন ঈমানদার ব্যক্তি সামান্য ক্ষণের জন্যও বরদাশত করতে পারে? বাংলাদেশের বুকে দুর্বৃত্তশাসনের প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মুহুর্ত কি শয়তানেরই আনন্দ বাড়াচ্ছে না? এভাবে শয়তানের আনন্দ বাড়িয়ে কি জান্নাত আশা করা যায়? অথচ মুসলমান তো প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মুহুর্ত বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করতে। সেটি দুর্বৃত্তশাসনের নির্মূল ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করে।সে কাজে সে যেমন অর্থ দেয়,তেমনি প্রাণও দেয়। মহান আল্লাহতায়ালা সুরা তাওবার ১১১ আয়াতে মু’মিন ব্যক্তির প্রাণ ও সম্পদ কেনাবেচার যে চুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন তার মূল বিষয় তো এটাই।কিন্তু মুসলমানদের জীবনে সে চুক্তিপালনের চেয়ে চুক্তিভঙ্গের আয়োজনই কি প্রবলতর নয়? মহান আল্লাহতায়ালার সাথে এমন চুক্তিভঙ্গ ও এমন গাদ্দারির মধ্য দিয়ে কোন মুসলমান কি পরকালে জান্নাত আশা করতে পারে? এমন গাদ্দারদের কি তিনি দুনিয়াতেও ইজ্জত দেন? ১৯/১০/২০১৪
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018