বাংলাদেশে নির্বাচনের নাশকতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 7, 2019
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
নির্বাচনঃ নাশকতার হাতিয়ার ভোট-ডাকাতদের হাতে
বাংলাদেশে নির্বাচন এখন আর নিরপেক্ষ ভোটদান প্রক্রিয়া নয়; বরং ভয়ানক নাশকতার হাতিয়ার। সেটি চোর-ডাকাত, ভোট-ডাকাত ও অতিশয় দুর্বৃত্ত অপরাধীদের হাতে দেশ দখলের। সে নাশকতারই আলামত হলো গুম, খুন এবং বিনাবিচারে বা ষড়যন্ত্রের বিচারে হাজার মানুষের প্রাণনাশের রাজনীতি। নির্বাচনের উপর ডাকাতি হওয়ায় ডাকাতদের নাশকতা বেড়েছে অর্থনীতির উপরও। সেটি দেশের ব্যাংক, কোষাগর ও শেয়ার মার্কেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ডাকাতি। দেশের শাসক গোষ্ঠি পরিণত হয়েছে সবচেয় বড় চোর-ডাকাতে। দেশে যখন নির্বাচন ছিল না এবং ছিল মোগল বা সুলতানি শাসনও তখনও এমন ডাকাতি কখনো হয়নি। গুম, খুনের রাজনীতিতেও মানুষের প্রাণনাশ হয়নি। পূর্বকালে দেশ দখলের কাজটি মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ ছিল; তাতে রাজায় রাজায় ভয়ংকর যুদ্ধ হতো। এবং তাতে বিপুল প্রাণ নাশ হতো। ফলে সেটি ছিল একমাত্র অতি সাহসী মানুষদের কাজ। কিন্তু এখন সে সাহস লাগে না; লাগে কুচরিত্র, কুরুচি এবং কুটকৌশল। যুদ্ধটি এখন নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে। ফলে দুর্বৃত্ত ভীরুরাও এ কাজে নেমেছে। কারণ ভোটের বাক্সগুলোর পাশ থেকে নিরস্ত্র মহল্লাবাসীদের সরিয়ে ভোটের উপর ডাকাতি করতে যুদ্ধ করতে হয়না। ফলে ডাকাতগণ সহজেই শতকরা ৯০ বা ৯৫ ভাগ ভোটের মালিক হতে পারে। ২০১৮ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তো সেটিই হলো।
পূর্বকালে দেশদখলে বিপুল সংখ্যক লোক-লস্কর পালতে হতো। এখন পালতে হয় রাজনৈতিক ক্যাডার,চাটুকর বুদ্ধিজীবী, এবং অনুগত মিডিয়া্। এ শ্রেণীর বিবেকশূণ্য লোকেরা অতীতে ফিরাউনকে খোদা এবং হিটলারকে মহামানব বলতো। এখন ভোটডাকাতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হাসিনাকে এরাই মহামান্য নেত্রী বলে। একটি দেশ কতটা সভ্য বা অসভ্য, সে বিচারটি হয়ে সে দেশের সরকার কি ভাবে নির্বাচিত হয় এবং অপরাধীগণ কীরূপ শাস্তি পায় -তা থেকে্। কোন সভ্য দেশের জনগণই ভোট ডাকাতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারকে মেনে নেয় না। এটি চোর-ডাকাতকে ইমাম করে তাদের পিছনে নামায পড়ার মত। এটি তাই অকল্পনীয় ব্যাপার। চোর-ডাকাত বা ভোট-ডাকাতদের শাস্তি না দেয়াতে তাই প্রকাশ পায় চরম অসভ্যতা। সভ্যদেশে তাদেরকে কারাগারে থাকতে হয়। অথচ বাংলাদেশে তারাই শাসক। এমন একটি দেশে দুর্নীতিতে বিশ্বে পর পর ৫ বার সবাইকে ছাড়িয় প্রথম হবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?
অধিক দুর্বৃত্ত ভোট-ডাকাতগণ
অর্থের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোট। জনগণের অর্থের উপর চুরি-ডাকাতি করে বহু কো্টি টাকার মালিক হওয়া যায়; কিন্তু তা দিয়ে দেশের দেশের শাসক হওয়া যায় না। ফলে চোর-ডাকাতগণ রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটে বসে দেশকে ইচ্ছামত বিপথগামী করতে পারে না। কিন্ত সেটি সম্ভব হয় জনগণের ভোটের উপর ডাকাতিতে সফল হলে। ভোট-ডাকাতগণ যেমন যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে, তেমনি শত্রুকেও দেশের অভ্যন্তরে ডেকে আনতে পারে। দেশের শিল্পম অর্থনৈতিক বাজার, শিক্ষা-সংস্কৃতিও শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারে। যেমন মুজিব আমলে হয়েছে। তাই চোর-ডাকাতদের চেয়ে গুরুতর অপরাধী হলো ভোট-ডাকাত। তাই দেশবাসীর সবচেয়ে গুরু দায়িত্বটি হলো ভোট-ডাকাতদের ধরা এবং শাস্তি দেয়া। সভ্য দেশের নাগরিকগণ একাজে এতই সজাগ যে ভোট-ডাকাতগণ একাজে সাহস পায় না।অথচ বাংলাদেশের পুলিশ এ ভোট ডাকাতদের গ্রেফতার করে না। আদালতে তুলে তাদের শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থাও করে না। বরং তাদের হাতে অধিকৃত আদালতের কাজ হয়েছে তাদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দিয়ে পুরস্কৃত করা।
নির্বাচন তো তখন্ই কল্যাণ দেয় যখন সেটি সবচেয়ে সৎ ও যোগ্যবান ব্যক্তিদের নির্বাচিত করার সফল মাধ্যমে পরিণত হয়। দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হওয়া থেকে রাষ্ট্রকে বাঁচানোর এটিই তো আধুনিকতম এবং সভ্যতর প্রক্রিয়া। নির্বাচনের সফলতা ও বিফলতা যাচাই হতে হবে নূণ্যতম এ মানদন্ডে। ফলে দেশে নির্বাচন হ্ওয়াটা বড় কথা নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সে নির্বাচন ভোট-ডাকাতদের হাতে ডাকাতি হয়ে যাওয়া থেকে কতটা বাঁচলো -সেটি। অথচ বাংলাদেশে এটিই সবচেয়ে ব্যর্থ খাত। জনগণের পকেটের অধিকাংশ অর্থ চুরি-ডাকাতি হওয়া থেকে বাঁচলেও বাঁচছে না তাদের ভোট। ফলে বাংলাদেশে রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি ঘটছে দুর্বৃত্তদের পরাজিত করার ক্ষেত্রটিতে। এরই আলামত, নির্বাচনে বিজয়ী হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে অপরাধী মানুষেরা। এবং তাদের হাতে ব্যাপক ভাবে বেড়েছে দূর্নীতির চর্চা।
দেশ চলছে পিছনের দিকে
বাংলাদেশ চলছে পিছনের দিকে। পিছিয়ে যাচ্ছে শুধু শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-শৃঙ্খলা ও অর্থনৈতির ক্ষেত্রে নয়, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। অথচ আজ থেকে ৬৪ বছর আগেও দেশে এতটা দুরবস্থা ছিল না। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নূরুল আমীন সরকার যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছিল তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনরূপ বিতর্ক হয়নি। সে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা যাচাইয়ে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের সার্টিফিকেটেরও প্রয়োজন পড়েনি। এমন কি বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও সেনাবাহিনী মোতায়েন ও বিদেশী পর্যবেক্ষক নিয়োগের দাবীও উঠেনি। অথচ সে সময় দেশে এত শিক্ষিত লোক ছিল না। এত পুলিশ ও এত বিশাল সংখ্যক সরকারি আমলা ছিল না। প্রশাসনের হাতে এত ওয়্যারলেস টেলিফোন,হেলিকপ্টার ও গাড়ির বহর ছিল না। প্রশ্ন হল, ৬৪ বছর পর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি কতটুকু? বাস্তবতা কি এই নয় যে এ ক্ষেত্রে দেশ পিছিয়েছে অতি দ্রুততার সাথে? ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন যেভাবে ডাকাতির শিকার হলো তাতে এটি সুস্পষ্ট যে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সামর্থ্য বর্তমান সরকারের নাই। তারা শুধু ভোট-ডাকাতিকেই নিশ্চিত করতে পারে; সুষ্ঠ নির্বাচন নয়। নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচনী কমিশন বা প্রশাসন যে নিরপেক্ষ হবে সেটিও এখন অভাবনীয়। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে তারা কি নির্বাচন বাঁচাবে? বরং তাদের দুর্বৃত্তি থেকে নির্বাচন বাঁচাতে ঘাড়ের উপর বিদেশী পর্যবেক্ষক বসাতে হয়। নিজেদের বিবাদ ঠেকাতে যে পরিবারটি অন্য গ্রামের লোকদের হাতে পায়ে ধরে তাদের কি ইজ্জত থাকে? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে।পর্যবেক্ষক ডেকে আনতে হচ্ছে সূদুর ইউরোপ-আমেরিকা থেকে। হয়ত সেদিন দূরে নয়, বিবাদ থামাতে মানুষ নিজেদের পুলিশ ও সেনাবাহিনীকেও আর বিশ্বাস করবে না। কসোভো, কঙ্গো, সিয়েরালিওনের ন্যায় বাংলাদেশেও তখন জাতিসংঘ-বাহিনীর ডাক পড়বে।
বাংলাদেশের সংকট দিন দিন ঘনিভূতই হচ্ছে। রোগ চলে যাচ্ছে নিরাময়ের বাইরে। অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন, এ সংকট থেকে বেরুবার সহজ রাস্তাও নেই। একটি দেশ তো এভাবেই ব্যর্থ-রাষ্ট্রে পরিণত হয়।তখন বিদেশীদের হাতে পায়ে ধরা এমন জাতির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। দেশ এভাবেই যায় শত্রুর দখলে। এরই উদাহরণ হলো, কার হাতে রাষ্ট্র তুলে দেওয়া হবে তা নিয়ে তাই ২০০৬ সনে সংসদে, সচিবালয়ে বা কোন দেশী প্রতিষ্ঠানে বৈঠক বসেনি, বৈঠক বসেছে বিদেশী দূতাবাসে। কৃষি, শিল্প বা অর্থনীতিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য কোন দেশ ব্যর্থ হয় না। বরং ব্যর্থ হয় রাষ্ট্র কীভাবে চলবে, দেশের শাসক কীভাবে নির্বাচিত হবে এবং কীভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর হবে –সে ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে। বহু শত বছরের রাজবংশ ভূপৃষ্ট থেকে এ ব্যর্থতার কারণে বিলীন হয়ে গেছে। সম্পদের উপর ডাকাতি করে একটি পরিবারকে যেমন বিপর্যস্ত করা যায়, তেমনি দেশকে বিপর্যস্ত করা যায় নির্বাচন পদ্ধতিতে বিকল করে। এবং সেটি ভোটের উপর ডাকাতি করে।
যে ব্যর্থতা জনগণের
বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যর্থ হওয়ার গুরুতর অন্য কারণও রয়েছে। সে ব্যর্থতাটি জনগণের। গণতন্ত্র শুধু সরকারের কারণে ব্যর্থ হয় না, ব্যর্থ হয় জনগণের ব্যর্থতার কারণেও। ব্যর্থ জনগণ অনেক সময় ভোট দিয়ে স্বৈরাচারি ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় আসে। শেখ মুজিব তো এভাবেই ক্ষমতায় এসে একদলীয় বাকশাল চাপিয়ে দিয়েছিল। অথচ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অর্থ রায় দেওয়া। এখানে রায় দেয় জনগণ। জনগণের সে রায়ের বলেই বিজয়ীরা পায় দেশ শাসনের অধিকার। গণতন্ত্র তাই ভোটার বা সাধারণ নাগরিকের উপর দেশের শাসক নির্বাচনে বড় রকমের দায়বদ্ধতা দেয়। রাজতন্ত্রে বা স্বৈরতন্ত্রে সে অধিকার ও সুযোগ সাধারণ মানুষের থাকে না। বিলেত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নাগরিকগণ শুধু ভোটই দেয় না, আদালতে রায়ও দেয়। তাদেরকে দেওয়া হয় জুরির মর্যাদা। তাদেরকে বেছে নেওয়া হয় ভোটার তালিকা থেকে লটারীর মাধ্যমে। তাই ভাগ্যগুণে যে কোন ভোটারই হতে পারেন জুরি। এবং জুরি হিসাবে আদালত থেকে ডাক পড়লে সে কাজে যোগ দেওয়া তার উপর বাধ্যতামূলক হয়।সে দায়িত্বপালনে অবহেলা হলে সেটি গণ্য হয় শাস্তিযোগ্য অপরাধরূপে। ব্যারিস্টারগণও আদালতে এরূপ জুরিদের উদ্দেশ্য করেই তাদের যুক্তিপ্রমাণ পেশ করে, জজকে উদ্দেশ্য করে নয়। ভোটাররা আদালতে বসে যাকে দোষী বা নির্দোষ সাব্যস্ত করেন জজ তাতে কোন পরিবর্তন আনতে পারে না। জজের কাজ,জুরিদের দ্বারা দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির উপর আইন মোতাবেক শাস্তির প্রয়োগ এবং নির্দোষ ব্যক্তির মুক্তিদান।।আর নির্বাচনে আদালত বসে সমগ্র দেশ জুড়ে। এখানে জুরি বা রায়প্রদানকারি হল প্রতিটি ভোটার। বাদী-বিবাদী হল প্রার্থীরা। এবং উকিলের ভূমিকায় নামেন দেশের জ্ঞানীজনেরা। নির্বাচনী কমিশনারের কাজ,বিচারকের দায়িত্বপালন। সফল নির্বাচনের জন্য প্রত্যেকের দায়িত্বই এখানে গুরুত্বপূর্ণ, সে দায়িত্বপালনে ব্যর্থ হলে বিফল হয় নির্বাচন। তবে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ভোটারদের। আদালতের রায়দানের ন্যায় নির্বাচনের রায়দানের কাজও মূলতঃ তাদের। ন্যায় ও সত্যের প্রতি তাদের সদা নিষ্ঠাবান থাকতে হয়।নইলে নির্বাচিত হয়ে অকল্যাণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা।
কিন্তু কথা হল,যোগ্যতা ছাড়া কোন দায়িত্বই কি সঠিক ভাবে পালিত হয়? রাস্তায় ঝাড়ু দিতেও কিছু যোগ্যতা লাগে। নইলে আবর্জনা জমে লোকালয়ে। আর ভোটারদের অযোগ্যতায় আবর্জনা জমে প্রশাসনে ও রাজনীতিতে। তখন বিপর্যয় নেমে আসে সমাজ ও রাষ্ট্রজুড়ে। বাংলাদেশে অতীতে সর্বগ্রাসী দূর্নীতি, বাকশালী স্বৈরাচার,দুর্ভিক্ষ, ভারতীয় দখলদারি, অর্থনৈতিক ধ্বস এবং রক্ষিবাহিনীর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে এসেছিল ভোটারদের সে অযোগ্যতার কারণেই। নির্বাচনে বা আদালতে রায় দিতে যে যোগ্যতাটি অপরিহার্য সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নয়, রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও নয়, বরং সেটি হল সত্য ও ন্যায়ের পক্ষ নেওয়ার নৈতিক বল। তাই গণতান্ত্রিক দেশে কারো ডিগ্রি বা অভিজ্ঞতা দেখে আদালতে ডাকা হয় না। কারণ সেরা ডিগ্রি বা অভিজ্ঞতা ন্যায়পরায়ন হওয়ার গ্যারান্টি দেয় না। ডিগ্রিধারী বা অভিজ্ঞ ব্যক্তিটিও লিপ্ত হতে পারে অতি জঘন্য অপরাধ কর্মে। বাংলাদেশে এমন দুর্বৃত্ত ডিগ্রিধারী এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তির সংখ্যা তো লক্ষ লক্ষ। অপর দিকে যে ব্যক্তির বিবেক-বিবেচনা ভেসে যায় গায়ের রঙ, ভাষা,ভূগোল,দল, গোত্র বা পরিবারের প্রতি আনুগত্যে, তার কি সে সামর্থ্য থাকে? থাকে না। আদালতের জুরিদের জন্য এরূপ ভেসে যাওয়াটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রায় দানের জন্য আলোকিত হতে হয় বিবেককে। নইলে ব্যর্থ হয় বিচার। সে ব্যর্থ বিচারে ভয়ানক অপরাধী ব্যক্তিও জেলে না গিয়ে সমাজের মাঝে নেমে আসে। তখন দুর্বৃত্তির প্লাবন শুরু হয় রাষ্ট্র জুড়ে।তাই কোন রাষ্ট্র দুর্বৃত্ত-কবলিত হলে দায়ী শুধু সরকার নয়,জনগণও।তখন প্রমাণ মেলে,সরকার নির্বাচনের যে গুরু দায়িত্ব জনগণের উপর ছিল সেটিই পালিত হয়নি। তাই সফল রাষ্ট্র নির্মাণে রাস্তাঘাট, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব থাকলেও সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল বিবেকমান মানব-নির্মাণ। সভ্য জাতিরা তাই গুরুত্ব দেয় চরিত্র গড়ায়। তবে সে যোগ্যতা নিছক রাজনৈতিক বক্তৃতায় সৃষ্টি হয় না। বাড়ে না পড়া-লেখার সামর্থ বাড়াতে। এজন্য চাই উন্নত জীবন-দর্শন। মুসলমানের জীবনে সে দর্শনটি হল ইসলাম। রাষ্ট্রের কল্যাণে ইসলাম শুধু ভোটদানেই ন্যায়নিষ্ঠ করে না, নিষ্ঠাবান করে সে লক্ষ্যে অর্থদান, শ্রমদান, এমনকি প্রাণদানেও। ইসলামে এমন কাজ পবিত্র জিহাদ। কিন্তু সেক্যুলারিজমের বিপদ হলো, এ ইহজাগতিক মতবাদ ব্যক্তির জীবন থেকে সে বিপ্লবী শক্তিটাই কেড়ে নেয়। দেয়, একটি পার্থিব লাভ-লোকসানের ধারণা। এমন চেতনার প্রসার বাড়লে শাড়ী-লুঙ্গি বা অর্থ দিয়েও তখন ভোট কেনা যায়। বাংলাদেশে মূলতঃ সেটিই হচ্ছে।
ভোটারের অযোগ্যতায় প্রকটতর হয় নাশকতা
সুযোগ্য ভোটার ছাড়া নির্বাচন কখনোই সুফল দেয় না। বরং ভয়ানক নাশকতা ঘটে ভোটারের অযোগ্যতায়। তখন নির্বাচিত দুর্বৃত্তগণ যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ উপহার দিলেও বিস্ময়ের কিছু থাকে না। ভোটারের যোগ্যতার মূল ভিত্তি হলো সত্য ও ন্যায়ের প্রতি আপোষহীন নিষ্ঠা এবং পক্ষপাতহীনতা। সে গুণটি সৃষ্টি হয় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে জবাবদিহীতার ভয় থেকে। তেমন একটি গুণের কারণে মিথ্যাচারি দুর্বৃত্তকে ভোটদান দূরে থাক, ভোটারগণ সচেষ্ট হয় তার নির্মূলে। তেমন একটি লক্ষ্যে ইসলাম চায়, দায়িত্ববান মানব সৃষ্টি। এরাই সমাজে সুনীতির বিজয় আনে। নবীজী (সাঃ) এজন্যই জীবনের অধিক সময় ব্যয় করেছেন এমন সৃষ্টিশীল মানব তৈরীর কাজে। এজন্যই সেদিন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। মানবিক গুণের পরিচর্যা তখন এতটা বেড়েছিল যে, যারা ভেড়া চড়াতেন বা ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কৃষিকাজ করতেন তারাও পরিণত হয়েছিলেন সুযোগ্য কাজী বা বিচারকে। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিচার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তো তাদের হাতেই। বিচার তখন ক্রয়-সামগ্রীতে পরিণত হয়নি,আদালতের নামে উকিল-ব্যারিস্টারদের বাজারও বসেনি। বিচারক হওয়ার পাশাপাশি তারা সেদিন পরিণত হয়েছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বিজ্ঞ নির্বাচক মন্ডলিতেও। ফলে জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারের ন্যায় যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচিত হওয়াটি সেদিন অভাবনীয় ছিল। তখন নির্বাচিত হয়েছেন হযরত আবু বকর(রাঃ), হযরত ওমর(রাঃ,হযরত ওসমান(রাঃ)ও হযরত আলীর(রাঃ)ন্যায় জান্নাতের ওয়াদা লাভকারি মহান বেহেশতি মানুষেরা। অথচ সমগ্র বিশ্ব সে সময় জর্জরিত হচ্ছিল রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারে।
তাই কোট-কাছারি প্রতিষ্ঠা করাই বড় কথা নয়। বরং অপরিহার্য হলো সঠিক রায় দানের নৈতিক সামর্থ্য। লক্ষ্য হওয়া চাই, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়কারির শাস্তি। এবং সে নির্দেশটি এসেছে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। তিনি বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে এমন একদল মানুষ অবশ্যই থাকতে হবে যারা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে। ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায়কে রুখবে। এবং তারাই হল সফলকাম।”- (সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০৪)। তাই ইসলামে একাজ ইবাদত। বিপরীত কাজটি হল মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্যতা। এরূপ অবাধ্যতা মানুষকে কাফের বানায়। সৎ ও ন্যায়পরায়ন ব্যক্তিদের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেওয়া তাই নিছক রাজনীতি নয়, এটিই ইসলামের মৌলনীতি। সাহাবাগণ এ লক্ষ্যে বহু জিহাদ লড়েছেন। নির্বাচনের মাধ্যমে এ কাজ যদি শান্তিপূর্ণ ভাবে হয় তবে জাতি এক রক্তক্ষয় থেকে বাঁচে। আর সেটি ব্যর্থ হলে ব্যর্থ হয় নির্বাচন বা ভোটদান। তাই বার বার নির্বাচন হওয়াটাই বড় কথা নয়। ইবাদতের দায়িত্ব-পালনও হওয়া চাই। ন্যায়পরায়ন ব্যক্তিদের বিজয় এবং দুর্বৃত্তদের পরাজয়ও হওয়া চাই। নইলে দেশের উপর দখলদারি নেয় ক্ষমতালিপ্সু নেতারা।এক কালে এ লক্ষ্যে নমরুদ-ফেরাউনেরা প্রকাণ্ড যু্দ্ধে লিপ্ত হত। আর এখন তাদের উত্তরসুরীরা লিপ্ত হচ্ছে নির্বাচনে। যে দেশে এরশাদের ন্যায় শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধী পাঁচটি নির্বাচনী আসন থেকে নির্বাচিত হয় -সেদেশে নির্বাচক মন্ডলীর রায়-প্রদানের সামর্থ্য যে কতটুকু তা নিয়ে কি বুঝতে বাঁকী থাকে? বিচারের কাজে জেলা, এলাকা, দল বা পরিবার নিয়ে পক্ষপাতিত্ব করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তেমন পক্ষপাতিত্বের কারণে যে কোন সভ্য দেশে বিচারক চাকুরী হারায়। বরখাস্ত হয় জুরি। আর ইসলাম ধর্মে এমন পক্ষপাতিত্ব হলো মহাপাপ। এমন পক্ষপাতিত্বে শাস্তি বাড়ে আখেরাতে।
তাই প্রকৃত মুসলিম দেখে, কোনটি ন্যায়, কোনটি অন্যায় -সেটি। দেখে, কে সৎ আর কে অসৎ। ঈমানদার ব্যক্তি বাদী-বিবাদী ও নির্বাচনপ্রার্থীর গায়ের রঙ, মুখের ভাষা বা কোন এলাকার -তা দেখে না। অথচ জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, আঞ্চলিকতা ও ট্রাইবালিজমের ন্যায় মতবাদগুলি জনগণের সে সামর্থ্যই কেড়ে নেয়। অথচ বাংলাদেশে এসব মতবাদের চর্চাই প্রবল ভাবে বেড়েছে। মুখের ভাষা বাংলা না হওয়ার কারণে একাত্তরে বহু হাজার বিহারী ও পাকিস্তানীকে হত্যা করা হয়েছে। দখলে নেওয়া হয়েছে তাদের বাড়ীঘর ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে। এমন একটি হিংস্র ও দখলদারি চেতনায় কি ব্যক্তির সামর্থ্য থাকে ন্যায় ও সত্যের পক্ষ নেওয়ার? নেই বলেই দেশে বার বার অসম্ভব হচ্ছে সৎ ও যোগ্য মানুষের নির্বাচন। যদি ইসলামের আরবী-ভাষী নবী স্বয়ং প্রার্থী হতেন ক’জন বাঙ্গালী তাঁকে ভোট দিতেন? ক’জন সমর্থন করে নবীজী (সাঃ)র ইসলামি শিক্ষা, শরিয়তী বিচার ব্যবস্থা ও সূদমূক্ত অর্থনীতিকে? দেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ কি দেশে সে পরিবেশ রেখেছেন? এমন বিভ্রান্ত চেতনায় দেশে নির্বাচন একবার নয়, হাজার বার হলেও কি কল্যাণ হবে? তাছাড়া বাংলাদেশের যে বিভাজন সেটি কি শুধু রাজনৈতিক? এটি তো দর্শনগত তথা আদর্শগতও। তাই কেনিয়া, কঙ্গো, জিম্বোবুয়ে বা থাইল্যান্ডের বিভাজনের চেয়েও এ বিভাজন গুরুতর। রাজনৈতিক উত্তাপের চেয়ে আদৌ কম নয় এসব বিভক্ত মানুষের অন্তরের উত্তাপ। ফলে এ বিভাজন নিছক কিছু বৈঠক করে দূর হওয়ার নয়। নির্বাচন করেও নয়। এমন অবস্থায় নির্বাচন যা প্রসব করে তা শান্তি নয়। সুখ-সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতিও নয়। বরং তা হল আরো সংঘাত ও আরো নাশকতা। ৭/৩/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018